সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

সঞ্চয়

আজি পড়ে মনে
মুখর নদীর তটে, মর্মরিত দেওদারবনে,
কোনও এক নিদাঘের জনশূন্য দিনে
সদ্যস্নাত দেহ রাখি তৃণে,
বলেছিলে অকপটে, হে লীলাসঙ্গিনী,
আপনার অতীত কাহিনী।
উপেক্ষি মিনতি,
হানি মোর চুম্বনে বিরতি,
বলেছিলে সে-নিকুঞ্জে কী মহার্ঘ দান
পেয়েছে তোমার কাছে মোর পূর্বে কত ভাগ্যবান।।

তার পরে বিশ্বস্ত নয়ানে
চেয়েছিলে মুখপানে; বেজেছিল অকস্মাৎ কানে,
অধরার আকৃতির মতো,
তোমার সংযমগত
প্রিয়সম্বোধন।
তবু মোর অভিমানী মন,
মার্জনায় অপারগ, ভেবেছিল ভবিষ্যতে নাই
কৃতজ্ঞ স্বীকৃতি কিংবা স্মৃতির বালাই,
চেয়েছিল প্রমাণিতে নিদারুণ মোর দস্যুতার
নির্বিকার
ক্ষেত্র-মাত্র তুমি,—
কীর্তির সমাধিস্তূপ, স্বত্বশূন্য, মুক্ত মরুভূমি,
যার ’পরে
অবৈধ প্রবৃত্তি মোর অবাধে বিচরে
অবলুপ্ত ধন-রত্ন-আশে;
রিক্ত যৌবনের পূর্তি ঘটায়ে প্রবাসে,
ঘরে ফিরে, যথারুচি অপচয় করিব সে-ধন।।

বুঝিনি তখন
আত্মপ্রসাদের শত্রু, সেই ইতিহাস
অনাগত সর্বনাশে হবে মোর অনন্য আশ্বাস।
তোমার নয়নে
অতীতের ছায়া অবলোকি,
শুধায়েছিলাম তাই, ঈর্ষায় কণ্টকি,
“কেন রবে মনে?
আমি নিমেষের সখা, শুধু তব চাঞ্চল্যের সাথী,
চ’লে যাব স্বল্পপ্রাণ নিদাঘের শেষে
নিরুদ্দেশ থেকে নিরুদ্দেশে।
স্বপ্নাদ্য প্রেমের কলি জাগাল যে-রবির প্রভাতী,
প্রথমে যে-অলি
উচ্ছল হৃদয়সুধা ল’য়ে, গেল চলি,
স্থান তব তাদের স্মরণে।
লাঞ্ছিত ভ্রমর,
মলয়ের ভ্রষ্ট অনুচর,
অকারণে
মধুরিক্ত কমলেরে করিলাম আমি প্রদক্ষিণ॥”

বিগত সে-দিন;
সে-মৎসর অহংকার চিহ্নহীন অক্ষম ধিক্কারে;
রুদ্র কালবৈশাখীর প্রহারে প্রহারে
অপর্ণ সে-উপবন, যার মাঝে নষ্টনীড় স্মৃতি
ঘুরে মরে নিতি,
আর মানে নিরুপায়ে জীবনের পরম সঞ্চয়
নিক্রোধ নয়নে তব ব্যথিত বিস্ময়।।

১০ ডিসেম্বর ১৯২৯

সকল অধ্যায়

১. হৈমন্তী (বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়)
২. চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)
৩. অপচয় (প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী)
৪. কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)
৫. পণ্ডশ্রম (অভ্যস্ত লজ্জার ছল, আচারের ব্যর্থ ব্যবধান)
৬. মূর্তিপূজা (মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে)
৭. মহাসত্য (অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ)
৮. পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)
৯. ভবিতব্য (শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী)
১০. বিকলতা (শেফালী অঙ্গুলি তব গণ্ডে মম বিচরে কৌতুকে)
১১. অনুষঙ্গ (তোমারে যে কেন বাসি ভালো)
১২. মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)
১৩. সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)
১৪. প্রলাপ (জানি, জানি)
১৫. উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)
১৬. নাম (চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই)
১৭. জিজ্ঞাসা (দিলেম বিমুক্ত ক’রে পিষ্টপুষ্প নিকুঞ্জের দ্বার)
১৮. সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)
১৯. দৈন্য (নিরালোক, স্তব্ধশোক, আয়ত নয়ানে)
২০. ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)
২১. সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)
২২. মার্জনা (ক্ষমা? ক্ষমা? কেন চাও ক্ষমা)
২৩. শাশ্বতী (শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে)
২৪. বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)
২৫. অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন