চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

জনমে জনমে, মরণে মরণে,
মনে হয় যেন তোমারে চিনি।
ও-শরমার্ত অরূপ আনন
দেখেছি কোথায়, হে বিদেশিনী?
নীল নবঘন, চঞ্চল আঁখি
যে-তড়িৎময়ী কালবৈশাখী
থেকে থেকে আজ হানিছে আমার
তাপনিরিক্ত চিত্তাকাশে,
ফুরায়েছিল কি বিগত জীবন,
ও-মদমত্ত সর্বনাশে?

শত ফাল্গুন তোমার অভাবে
বিফল হয়েছে, অপরিচিতা;
সার্থক যোগে মূর্ত হতাশ
কানে কানে মোরে ডেকেছে—মিতা;
শিথিল নীবিতে প্রগল্ভ পাণি
বারে বারে কেন থেমেছে না জানি;
শূন্যগর্ভ বহ্নির মতো
উল্লাসে মোর অশেষ ক্ষুধা;
বিরহ বিরাজে দলিত বাসরে;
মরণাসক্ত ফেনিল সুধা।।

চকিতে চমকি তৃপ্ত হৃদয়
উতল, অকায় আবির্ভাবে,
ভরিলে চরম ক্ষতির দীনতা
বারে বারে মোর পরম লাভে;
অকারণে আঁখি ভারাতুর করি,
অক্ষম লোর সাঁঝে দিলে ভরি;
শীর্ণ স্মৃতির চ্যুত পল্লব
মুখরি অলখ চরণপাতে,
মুহু মুহু মোর বিজন মানসে
এসেছিলে তুমি বিনিদ রাতে।।

ঘাটে, বাটে, মাঠে ঘটেছে মোদের
আধোপরিচয় নিত্যনব :
দেখেছি বিকচ দাড়িম্ববনে
প্রচুরপরাগ প্রসাদ তব;
তোমারই কেশের প্রতিচ্ছায়ায়
গোধূলির মেঘ সোনা হয়ে যায়
পাকা দ্রাক্ষার অরাল লতায়
তোমারই তনুর মদিরা ভরা;
পথপার্শ্বের অপরাজিতা, সে
তোমারই দৃষ্টি লক্ষ্যহরা।।

 ঈর্ষা তোমার হেনেছে ঝঞ্ঝা
রভসবিবশ কুটীরে মম;
ফাটলে ফাটলে কষায় নয়ন
ভ্রূকুটি করেছে ত্রুটিরে মম।
ডেকেছ আমারে উদ্ধত প্ৰেমে,
দেখেছি লগ্ন গত, পথে নেমে;
বাদলশেষের ঝিল্লির স্বনে
বাজায়ে নূপুর অধীর সুরে,
করি অবিরত উপেক্ষাহত,
চ’লে গেছ তুমি অগম দূরে।।

চির জনমের প্রবঞ্চনার
ক্ষালনে আজি কি, ছলনাময়ী,
চিতসঞ্চিত অমৃত বিতরি
করিবে আমারে মরণজয়ী?
অথবা আবার খামখা খেয়ালে
অন্ধেরে ঘিরে মমতার জালে,
সন্ধিপূজার ষোড়শোপচার
রচাবে কেবলই শূন্য পীঠে?
অমর হাসির বজ্রদাহনে
জ্বালাবে লোলুপ মর্ত্যকীটে?

৮ অগস্ট ১৯২৯

সকল অধ্যায়

১. হৈমন্তী (বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়)
২. চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)
৩. অপচয় (প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী)
৪. কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)
৫. পণ্ডশ্রম (অভ্যস্ত লজ্জার ছল, আচারের ব্যর্থ ব্যবধান)
৬. মূর্তিপূজা (মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে)
৭. মহাসত্য (অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ)
৮. পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)
৯. ভবিতব্য (শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী)
১০. বিকলতা (শেফালী অঙ্গুলি তব গণ্ডে মম বিচরে কৌতুকে)
১১. অনুষঙ্গ (তোমারে যে কেন বাসি ভালো)
১২. মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)
১৩. সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)
১৪. প্রলাপ (জানি, জানি)
১৫. উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)
১৬. নাম (চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই)
১৭. জিজ্ঞাসা (দিলেম বিমুক্ত ক’রে পিষ্টপুষ্প নিকুঞ্জের দ্বার)
১৮. সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)
১৯. দৈন্য (নিরালোক, স্তব্ধশোক, আয়ত নয়ানে)
২০. ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)
২১. সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)
২২. মার্জনা (ক্ষমা? ক্ষমা? কেন চাও ক্ষমা)
২৩. শাশ্বতী (শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে)
২৪. বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)
২৫. অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন