সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

ভুলেছ কি তবে?
আগন্তুক বিরহের উদ্‌ভ্রান্ত গৌরবে
দিয়েছিলে যেই অঙ্গীকার,
একটি অক্ষরও তার
কালের কবল হতে পারোনি কি রাখিতে সঞ্চিয়া,
হায়, মোর অতিক্রান্ত বসন্তের প্রিয়া?
নাই মনে
বিদায়ের পথপ্রান্তে অন্তহীন অন্তিম চুম্বনে
আমার স্বতন্ত্র সত্তা চেয়েছিলে স্বায়ত্তে আনিতে
হেমন্তের জঙ্গম নিশীথে?
নিবিড় চোখের মৌনে দুঃসহ মিনতি
করেছিল দ্বিধায় মন্থর
অসমাপ্ত মুহূর্তের ঊর্ধ্বশ্বাস গতি।
ক্ষীয়মাণ তব কণ্ঠস্বর,
ব্যাপক বিচ্ছেদে হানি প্রগলভ ঘোষণা,
বলেছিল, কভু ভুলিব না।।

আজি যদি বসন্তের যবনবাহিনী
লণ্ড ভণ্ড ক’রে থাকে প্রস্তরিত সে-পুরাকাহিনী
অরক্ষিত অন্তরে তোমার;
বিশ্ববাসনার
অধীর মদির ঘ্রাণ বিকশিত লাইলাক্-বাসে,
অন্বেষি অদৃশ্য ছিদ্র, যদি ছুটে আসে
শোকস্তব্ধ সমাধিমন্দিরে;
রাত্রির গভীরে
আনে যদি চক্রী সমীরণ
নিরতীত নৈরাজ্যের রূঢ় নিমন্ত্রণ
রাজভক্ত নিবৃত্তির দ্বারে;
তোমার অক্ষম হিয়া নিরুদ্দিষ্ট প্রণয়ের ভারে
প্রথম দস্যুর পদে যদি লুটে পড়ে,
তাই হবে সিদ্ধ হোক; অপ্রাকৃত নিষ্ঠার নিগড়ে
তোমার দাক্ষিণ্য যেন বিষায়ে না উঠে,
ধর্মভ্রষ্ট অঙ্গ-সম, আত্মগত উগ্ৰ কালকূটে॥

করিলাম স্বত পরিহার
কপোলকল্পিত দাবি, বৃথা অধিকার;
আমার প্রলাপ,
পঙ্গু ঈর্ষা, ব্যর্থ অভিশাপ
ও-তনুর ভোগাতীত ঐশ্বর্যের ’পরে,
সন্তপ্ত যক্ষের মতো, জাগিবে না যুগে যুগান্তরে।
যেও সবই ভুলে;
চিত্ত হতে ফেলে দিও তুলে
প্রাণহীন প্রতিজ্ঞার অন্তর্ভৌম মূল।
অবসিত দুঃস্বপ্নের ভুল
জাগ্রত হৃদয় হতে যেন খ’সে যায়,
মিলনের সমারোহে প্রোষিতার জীর্ণ বস্ত্র প্রায় ॥

শুধু যবে গোধূলিলগনে
এ-বসন্তে পুনর্বার নব সখা-সনে
উপনীত হবে নদীতীরে:
চক্ষে অকারণ নীর, সুখশান্তি শায়িত শরীরে,
আবার দেখিবে চাহি রাত্রি দেয় জ্বালি,
দিনের স্ফুলিঙ্গ-যোগে, স্বর্গদ্বারে তারার দীপালী,
তখন পারো তো মনে কোরো ক্ষণতরে
বিগত বৎসরে,
এই পীঠে, এমনই প্রদোষে,
বিপন্ন পথিক এক, পদপ্রান্তে ব’সে,
তোমাতে জাগায়েছিল শাশ্বতীরে অকাল বোধনে।
কিন্তু যদি লজ্জা পাও সে-কথাস্মরণে,
নিঃসংকোচে তবে
নাম সুদ্ধ ভুলে যেও, মেনে নেব বিলুপ্তি নীরবে।।

২০ মে ১৯৩১

সকল অধ্যায়

১. হৈমন্তী (বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়)
২. চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)
৩. অপচয় (প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী)
৪. কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)
৫. পণ্ডশ্রম (অভ্যস্ত লজ্জার ছল, আচারের ব্যর্থ ব্যবধান)
৬. মূর্তিপূজা (মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে)
৭. মহাসত্য (অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ)
৮. পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)
৯. ভবিতব্য (শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী)
১০. বিকলতা (শেফালী অঙ্গুলি তব গণ্ডে মম বিচরে কৌতুকে)
১১. অনুষঙ্গ (তোমারে যে কেন বাসি ভালো)
১২. মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)
১৩. সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)
১৪. প্রলাপ (জানি, জানি)
১৫. উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)
১৬. নাম (চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই)
১৭. জিজ্ঞাসা (দিলেম বিমুক্ত ক’রে পিষ্টপুষ্প নিকুঞ্জের দ্বার)
১৮. সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)
১৯. দৈন্য (নিরালোক, স্তব্ধশোক, আয়ত নয়ানে)
২০. ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)
২১. সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)
২২. মার্জনা (ক্ষমা? ক্ষমা? কেন চাও ক্ষমা)
২৩. শাশ্বতী (শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে)
২৪. বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)
২৫. অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন