সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

“বুঝি”, বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি।
করিব না পুঁজি
প্রেমের সমাধিস্তূপে মমত্বের জঘন্য জঞ্জাল।
মহাকাল
আমার ঈর্ষার বিষে নীলকণ্ঠ কখনও হবে না।
মূঢ়তার সেনা
ফাল্গুনীর প্রতিপক্ষে স্মরণের অক্ষম সঞ্চয়
জমাবে না পণ্ডশ্রমে যাবার সময়।।”

“জানি”, বলেছিলাম, “ও-তনু
আশুক্লান্ত উপাদানে বিরচিল বিধি।
তাই ফুলধনু
ক্রমাগত হানে তব হৃদি;
ধৈর্যের অনর্থে তুমি কণ্ঠাগত প্ৰাণ;
তোমার সাহস কাড়ে বৈধব্যের প্রেতাত শ্মশান।
তাই নিরন্তর
খোঁজে হিয়া বাটে বাটে যাত্রাসহচর।
শেফালীর প্রায়
তোমার কোমল বৃন্ত নিজ ভারে তাই ছিঁড়ে যায়
নিষ্ঠার জটিল বৃক্ষ হতে;
প্রীতির উদ্ভিন্ন কলি অকৃপণ মলয়ের স্রোতে
খ’সে পড়ে পদাশ্রিত পথিকের শিরে।”
অন্তিম চুম্বন মম বিসর্জি তোমার অশ্রুনীরে,
তাই বলেছিলাম, “ইন্দ্ৰাণী
ইন্দ্রত্বের বিপর্যয়ে তুমি, দিবে আনি
প্রসন্ন স্বর্গের বর আগন্তুক তপস্বীর হাতে
অনাগত ফাল্গুনের প্রাতে॥”

আজও সবই বুঝি।
প্রাণপণে অন্তশ্চক্ষু বুজি,
সত্যের নিষ্ঠুর রশ্মি কোনও দিন করিনি ব্যাহত।
আজও জানি, বুদ্বুদের মতো,
ক্ষণপ্রাণ মানুষের ভঙ্গুর, রঙ্গিল অঙ্গীকার,
ব্যর্থতাফেনিল হয়ে, টুটে বারংবার,
কালের প্রপাত যেথা, বিপর্যস্ত সৃষ্টির কিনারে,
বেগে নামে অনন্ত আঁধারে।।

আরও জানি
অনিত্য ব’লেই তুমি, দীপ্র তব নয়নের বাণী,
মদালস নিকুঞ্জের অন্ধকার নাশি,
বিদ্যুদ্‌বিলাসসহ ফুটেছিল, সহসা উদ্ভাসি
মোর ক্ষিপ্র বাসনার পৃথুল প্রসার।
কটিভ্ৰষ্ট বসন তোমার
তাই ক্ষণে ক্ষণে
উপেক্ষার অভিযোগ এনেছিল মৌনের শ্রবণে;
রোমাঞ্চের সংক্রামী বিস্ময়ে
অলক্ষ্য সৌন্দর্য তব ফিরেছিল মদির মলয়ে।।

সবই জানি, সবই আছে মনে।
তবু বুদ্ধি হার মানে, নিরশ্রু ক্রন্দনে
প্রাণের পরম শিরা ছিঁড়ে যায় মর্মমাঝে যেন।
যদি তুমি পরাঙ্কে আসীনা,
তবে কেন
আজও বাজে সৃজনের বীণা,;
এখনও ভাঙে না তাল উর্বশীর হীরক নূপুরে?
কেন মরে ঘুরে,
বিলয়ের পথরোধ করি,
ব্যোমের পরিধি-’পরে সমান্তর নক্ষত্রপ্রহরী?

মনে হয় ফাঁকি, সবই ফাঁকি,–
মায়ার মুকুরপটে রিক্তগর্ভ প্রতিবিম্ব আঁকি,
যত সত্তা চ’লে গেছে অন্য কোনওখানে
নিয়ন্ত্রিত বিশ্বের সন্ধানে।
মনে হয়
অতল শূন্যের শেষে প’ড়ে আছি আমি নিরাশ্রয়,
দেখিতেছি ভ্রমিভ্রান্ত চোখে
গতাসু আলোর প্রেত বিচরিছে স্তবকে স্তবকে
নিরালম্ব নৈরাশ্যের নিঃসঙ্গ আঁধারে।।

জানি, জানি অনাদ্যন্ত কালের মাঝারে,
জানি, তুমি অতিশয় হেয়,
নগণ্য বিন্দুর চেয়ে, অণু হতে আরও অবজ্ঞেয়।
তাহলেও তোমার অস্থিতি
নিয়েছে হরণ ক’রে ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রস্থ প্রমিতি।
জানি সবই, তবু পরিবর্তনে তোমার
অসূর্য পেয়েছে ছাড়া, এমনকি নিত্য বিধাতার
জ্যোতির্ময় সিংহাসনখানি
ডুবেছে নাস্তির গর্ভে, সে-কথাও জানি।

২৩ জানুআরি ১৯৩১

সকল অধ্যায়

১. হৈমন্তী (বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়)
২. চপলা (জনমে জনমে, মরণে মরণে)
৩. অপচয় (প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী)
৪. কস্মৈ দেবায় (হায়, গৰ্বান্বিতা)
৫. পণ্ডশ্রম (অভ্যস্ত লজ্জার ছল, আচারের ব্যর্থ ব্যবধান)
৬. মূর্তিপূজা (মিলনার্ত বসন্তপ্রদোষে)
৭. মহাসত্য (অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ)
৮. পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)
৯. ভবিতব্য (শিপ্রার অপর তটে নেমে আসে সুদীর্ঘ রজনী)
১০. বিকলতা (শেফালী অঙ্গুলি তব গণ্ডে মম বিচরে কৌতুকে)
১১. অনুষঙ্গ (তোমারে যে কেন বাসি ভালো)
১২. মহাশ্বেতা (মনে হয়েছিল বুঝি উদ্‌ভ্রান্ত হৃদয়)
১৩. সঞ্চয় (আজি পড়ে মনে)
১৪. প্রলাপ (জানি, জানি)
১৫. উদ্‌ভ্রান্তি (সে-দিনে বৈশাখ)
১৬. নাম (চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই)
১৭. জিজ্ঞাসা (দিলেম বিমুক্ত ক’রে পিষ্টপুষ্প নিকুঞ্জের দ্বার)
১৮. সমাপ্তি (ভুলেছ কি তবে)
১৯. দৈন্য (নিরালোক, স্তব্ধশোক, আয়ত নয়ানে)
২০. ধিক্কার (ধিক্কারে বিষায়ে ওঠে মন)
২১. সর্বনাশ (“বুঝি,” বলেছিলাম সে-দিন, “সবই বুঝি”)
২২. মার্জনা (ক্ষমা? ক্ষমা? কেন চাও ক্ষমা)
২৩. শাশ্বতী (শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে)
২৪. বিস্মরণী (কেন ধাও মোর পাছে পাছে)
২৫. অর্কেস্ট্রা (নিবে গেল দীপাবলী; অকস্মাৎ অস্ফুট গুঞ্জন)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন