এক কৃষ্ণকলির কথা – চকিতা চট্টোপাধ্যায়

বিশ্বরূপ মজুমদার

এক কৃষ্ণকলির কথা – চকিতা চট্টোপাধ্যায়

উনিশশো বত্রিশ সালের বাইশে সেপ্টেম্বরের রাত। আজকের রাতটা পেরোলেই ক‍্যালেন্ডারে পালটে যাবে তারিখটা—হয়ে যাবে তেইশে সেপ্টেম্বর—সেই সঙ্গে হয়তো পালটে যাবে একটা জীবনও! এই তেইশে সেপ্টেম্বর হল সেই দিন, যে দিনটার জন্য উনিশ বছরের একটি তরতাজা জীবন অধীর আগ্রহে এতকাল ধরে তিলতিল করে প্রতীক্ষা করছিল! এই দিনটার অবশ‍্য একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে—তেইশে সেপ্টেম্বরে রাত আর দিন সমান হয়ে যায়। যেন জীবন আর মৃত্যু—কোনও দিকেই পাল্লা ঝুঁকে নেই—যেন একটা সন্ধিক্ষণ! আচ্ছা, আশৈশব কাঙ্ক্ষিত জীবনের কোনও স্বপ্নপূরণের সুযোগ পাওয়ার পরও কি বেঁচে থাকার সত্যিই আর কোনও প্রয়োজন থাকে?

চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকের এই পাহাড়তলী অঞ্চল এখন গভীর ঘুমে নিঃঝুম! ঘুম নেই শুধু একজনের চোখে। রাত জেগে সে শুধু এই প্রশ্নটারই উত্তর খুঁজে চলেছে! উত্তরটা যে আজ রাতের মধ্যেই তাকে পেতে হবে! আজ যে তার গুরু তার ওপর অর্পণ করেছেন এক গুরুভার—যে ভার বহন করবার সুপ্ত বাসনা সে নিজেই এতকাল ধরে মনের ভেতর লালন করে এসেছে, আর নিজেকে একটু একটু করে প্রস্তুত করে তুলেছে সেই জন্য!

কেন যেন আজ চোখের সামনে বার বার শুধু ভেসে উঠছে তার এই উনিশ বছরের তুচ্ছ জীবনটার প্রত‍্যেকটি ছবি! ভেসে আসছে তার মা প্রতিভার মুখখানা!

মেয়েমানুষের গায়ের রং যে তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে সে কথা তো সবারই জানা! তার জন্মের পর নাকি তার গায়ের কুচকুচে কালো রং দেখে সবাই হা-হুতাশ করে প্রতিভাকে বলেছিল, “এই মেয়ের বিয়ে কী করে দেবে প‍্রতিভা?”

প্রতিভা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আদর করে সেদিন বলেছিলেন, “ও আমার রানি। আমার এই কালো মেয়েই একদিন তোমাদের মুখ আলো করবে, তোমরা দেখে নিয়ো!”

আজ জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সেই কালো মেয়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তাই শুধু মনে মনে বলতে চাইছে—মাগো! সত্যিই কি তাহলে তোমার সেই কথা ফলে যাওয়ার দিন এসেছে! তোমার রানি কি সত্যিই পারবে তোমার মুখ উজ্জ্বল করতে! আজ কতদিন হয়ে গেল মায়ের মুখখানা সে দেখেনি। মা-বাবা-ভাই-বোন কারওর মুখই না! কারণ আজ কতদিন হয়ে গেল সে আত্মগোপন করে আছে!

মেয়েরাও যে বিপ্লবের কাজে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এ ধারণা বোধহয় ব্রিটিশ পুলিশেরও তখন তেমন করে জানা ছিল না! পুলিশ, বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি ‘আশ্রম’ তল্লাশি করার সময় পেয়ে গিয়েছিল তার একখানা ছবি! ধলঘাটের সাবিত্রী মাসিমার বাড়ি, অর্থাৎ বিপ্লবীদের গোপন ডেরা ‘আশ্রম’-এ পাওয়া তার সেই ছবি দেখে পুলিশ এসেছিল তাদের বাসায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে! তার নিজের হাতে লেখা বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার যে সমস্ত বিবরণ সে লিখে এনেছিল মাষ্টারদাকে দেখানোর জন্য, তা পড়ে গিয়েছিল পুলিশের হাতে! হাতের লেখা মেলানোর জন্য পুলিশ তার বাড়ি থেকে তার গানের খাতাখানা নিয়ে গিয়েছিল! এই পরিস্থিতিতে মাষ্টারদা সূর্য সেন তাকে আদেশ করেছিলেন আত্মগোপন করার। কিন্তু সে যে আত্মগোপন করতে যাচ্ছে সে কথা জানলে বাবা কিছুতেই তাকে যেতে দিতেন না, তা প্রীতিলতা জানত। তাইতো পড়াতে যাওয়ার নাম করে জুলাই মাসের পাঁচ তারিখে সে মণিলাল দত্ত আর বীরেশ্বর রায়ের সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল! সতেরোদিন পরে জুলাই মাসের তেরো তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছিল! শিরোনামে লেখা হয়েছিল “চট্টগ্রামের পলাতকা”!—‘চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতী প্রীতি ওয়াদ্দেদার গত ৫ই জুলাই, মঙ্গলবার, চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধাণ করিয়াছেন। তাঁহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানের জন্য ব‍্যস্ত।’

শুধু এইটুকুতেই অবশ‍্য ক্ষান্ত হয়নি ব্রিটিশ পুলিশ। পুলিশের সি.আই.ডি. প্রীতিলতার সন্ধান পেতে ‘লুক আউট’ নোটিশও সেই সঙ্গে জারি করেছিল!

॥ ২ ॥

সেই কোন কিশোরী বয়সে একদিন তাদের ডঃ খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ‍্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা ঊষাদি তাকে শুনিয়েছিলেন পুরুষের বেশে ইংরেজ সেনাদের সঙ্গে ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের লড়াইয়ের কাহিনি! সেইদিন থেকে—হ‍্যাঁ, ঠিক সেই দিন থেকেই মনের মধ্যে সে শুধু একটি মাত্র স্বপ্নই বহন করে চলেছে—সেও একদিন ঠিক অমন সাজে সজ্জিতা হয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে!

তার এই গোপন ইচ্ছের কথাটা জানত আর একজন। স্কুলে তার চেয়ে এক ক্লাস নীচে পড়া প্রিয় বন্ধু কল্পনা। কল্পনা দত্ত। তারা যখন একসঙ্গে ব‍্যাডমিন্টন খেলত, তখন এই সব স্বপ্ন তারা ভাগ করে নিত একে অপরের সঙ্গে!

“আমার খুব ইচ্ছে বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবার, জানো প্রীতি!”

“আমিও আগে তাই ভাবতাম। কিন্তু জানো কল্পনা, যেদিন থেকে ঊষাদি আমাদের ঝাঁসীর রানির জীবন-কাহিনি শুনিয়েছেন, সেদিন থেকেই আমার একমাত্র ইচ্ছে যে আমিও তাঁর মতো পুরুষবেশে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করব!”

“সত্যি বলব প্রীতি? এই ইচ্ছে যে আমারও করেনি তা নয়—”

“তাহলে এসো কল্পনা, আজ থেকে আমরা নিজেদের দুঃসাহসী বিপ্লবী হিসেবেই ভাবতে শুরু করি!”

সেই দিন থেকেই যেন তার ভবিতব‍্য লেখা হয়ে গিয়েছিল!

চারিদিকে তখন বিপ্লবের হাওয়া বইছে। একদিকে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন করছেন, অন‍্যদিকে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা সক্রিয় হয়ে উঠছেন আরও বেশি করে। এরই মধ্যে বিপ্লবীদের যাতে বিনা বিচারে আটক করা যায় সেই জন্য বেঙ্গল অর্ডিন‍্যান্স আইন জারি করল চতুর ব্রিটিশরাজ। টাইগার পাসের মোড়ে প্রকাশ‍্য দিবালোকে সরকারি কর্মচারিদের বেতন বাবদ সতেরো হাজার টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় মাষ্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস‍্যরা তা ছিনিয়ে নিল! ব্রিটিশ পুলিশও এর প্রতিশোধ তুলতে বিপ্লবীদের এক আস্তানায় গোপন বৈঠক চলাকালীন হানা দিল! তুমুল যুদ্ধ হল পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের। গ্রেফতার হলেন বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী এবং মাষ্টারদা!

এই সমস্ত খবর প্রীতিলতার কানে যতই আসে, ততই যেন শরীরের অণু-পরমাণুর মধ্যে কী এক উন্মাদনা টের পায় সে! তার শিরায় শিরায় যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার শব্দ যেন স্পষ্ট শুনতে পায় সে!

পুলিশের কড়া পদক্ষেপে সেই সময় বিপ্লবী সংগঠনের ছাত্র আর যুবকদের অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল, এমনকি বইপত্র পযর্ন্ত অত্যন্ত গোপনে রাখতে হত। ব্রিটিশ সরকার যখন বিপ্লবীদের প্রকাশনা পযর্ন্ত বাজেয়াপ্ত করে দিল, ঠিক সেই সময় একদিন তার হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তারই নিজের এক তুতো দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সঙ্গে।

“এগুলো কী দাদা?”

পূর্ণেন্দুদা’র হাতে ধরা কয়েকটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে সেদিন বিস্মিত প্রশ্ন করেছিল তাদের রানি। হ‍্যাঁ, আত্মীয়-স্বজনরা তাকে এই নামেই ডাকত। পূর্ণেন্দু সতর্ক দৃষ্টি চারিদিকে একবার বুলিয়ে নিয়ে বলেছিলেন, “চুপ কর! কেউ শুনে ফেলতে পারে!” তারপর তার দিকে বইগুলো বাড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “এগুলো সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। তুই পারবি এগুলো তোর কাছে লুকিয়ে রাখতে?”

প্রীতিলতা তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। কিন্তু যার মনের গভীরে বিপ্লবী হওয়ার তীব্র বাসনা, সে কেন ভয় পাবে? হাত বাড়িয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বইগুলো সেদিন নিয়েছিল সে! বলেছিল, “আমাকে দাও দাদা! আমি পারব রাখতে!”

সেই বইগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে তারপর থেকে যতবার পড়েছে সে, ততবারই বিস্মিত হয়েছে!

‘দেশের কথা’, ‘বাঘাযতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’, ‘কানাইলাল’—এঁদের জীবনযুদ্ধ তাকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছে বিপ্লবের পথে!

সাহস করে একদিন পূর্ণেন্দুদা’র কাছে তার মনের গোপন ইচ্ছেটার কথা মুখ ফুটে জানিয়েই ফেলেছিল সে!

“দাদা, আমি বিপ্লবী দলে যোগ দিতে চাই!”

কিন্তু পূর্ণেন্দুদা’র উত্তর শুনে মনটা ভরে গিয়েছিল একরাশ হতাশায়! পূর্ণেন্দুদা বলেছিলেন, “এখনও পযর্ন্ত বিপ্লবীদলে কোনও নারী সদস্য নেওয়ার নিয়ম যে শুরু হয়নি রানি! এমনকী আমাদের বিপ্লবীদের কত কঠিন অনুশাসন মেনে চলতে হয়! নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করাও যে নিষেধ আমাদের!”

মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন প্রীতিলতার। তাহলে কি তার মনের ইচ্ছে মনেই রয়ে যাবে?

॥ ৩ ॥

এরমধ্যে ম‍্যাট্রিক পাশ করল সে। পড়াশোনায় বরাবরই মেধাবী ছাত্রী বলে তার সুনাম ছিল। লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগেই তাই ম‍্যাট্রিক পাশ করল সে। আর সঙ্গে সঙ্গেই এল বিয়ের সম্মন্ধও। কিন্তু না, সে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না! তার যে জীবনটাকে অন্য খাতে বইয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে!

“আমি বিয়ে করব না বাবা—!” তার আপত্তির কথাটা সেদিন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেই ফেলেছিল সে।

“সে কী! কেন?”

“আমি আরও পড়তে চাই—!”

“কিন্তু—” এক মুহূর্ত কিছু ভেবেছিলেন সেদিন জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার। তারপর বলেছিলেন, “ঠিক আছে। তোর যখন পড়াশোনা করার এত ইচ্ছে তখন তাই হবে। তোকে আমি আই.এ. পড়তে ঢাকার ইডেন কলেজে পাঠাব।”

ভাগ‍্যিস সেদিন মেয়ের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন জগবন্ধু!

রাত কত হল? রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আজ যেন স্মৃতিগুলোও একের পর এক ভিড় করে আসছে তার মনের পর্দায়! ভেসে উঠছে এক একটা মুখ! তার এই উনিশ বছরের জীবনের পথটা চলতে চলতে আজকের দিনটা পযর্ন্ত যে সে এসে পৌঁছতে পেরেছে, এর পেছনে যাঁদের যাঁদের যা যা ভূমিকা ছিল, আজ যেন আরও বেশি করে মনে পড়ছে তাঁদের প্রত‍্যেকের কথাই! হয়তো পরোক্ষে ঋণস্বীকার করে নিতে চাইছে এই মনটা!

ঢাকায় যখন প্রীতিলতা পড়তে এল তখন ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন সেখানে বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব তৈরি করে প্রকাশ‍্যে লাঠিখেলা, কুস্তি, ছোরাখেলা, মুষ্টিযুদ্ধ, ডনবৈঠক শেখাত। এই শ্রীসংঘের একটি মহিলা–শাখাও ছিল—‘দীপালি সংঘ’।

“লীলাদি—আপনার সঙ্গে আজ এই মেয়েটির পরিচয় করাবো বলে এনেছি—।” ইডেন কলেজের দিদিমণি নীলিমাদি যেদিন লীলা নাগের সঙ্গে প্রীতিলতার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেদিন লীলাদি হেসে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “শিখতে পারবে তো লাঠিখেলা, ছোরাখেলা—?” প্রীতিলতা সাগ্রহে বলেছিল, “হ‍্যাঁ, অবশ্যই!” কারণ, সে তো সবসময় ব‍্যাকুল হয়ে চাইত মাষ্টারদার একজন যোগ্য কমরেড হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে! তাইতো মাত্র দু’বছরের ভেতর সে সব কিছু অনায়াসে আয়ত্ত করে ফেলেছিল! যা দেখে বিস্মিত আর খুশি দুই-ই হয়েছিলেন লীলাদি আর নীলিমাদিও!

মাষ্টারদাকে চাক্ষুষ দেখবার বাসনা সে তো কবে থেকেই মনের ভেতর পোষণ করছে! তাই যখন পূর্ণেন্দুদা’র কাছে শুনেছিল যে মাষ্টারদা তাঁদের সবার উৎসাহে শেষপর্যন্ত নারী সন্মেলন করবার অনুমতি দিয়েছেন, খুব শিগগিরই চট্টগ্রামে আয়োজিত হবে কংগ্রেসনেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে, তখন প্রীতিলতা আনন্দে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল! কল্পনার আর তার দু’জনেরই ইচ্ছে ছিল ওই সন্মেলনেই তারা মাষ্টারদাকে সরাসরি তাঁর অধীনে বিপ্লবী দলে যুক্ত হবার কথা বলবে—অনুমতি চাইবে তাঁর!

ঢাকা থেকে সে, আর কলকাতা থেকে কল্পনা তাই ছুটে গিয়েছিল সেই সন্মেলনে যোগদান করতে! কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য মাষ্টারদার সঙ্গে সে যাত্রায় তাদের দেখা হয়নি! বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল তাদের দু’জনকেই।

॥ ৪ ॥

আই.এ. পরীক্ষা হয়ে গেল। পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরেই সে শুনেছিল যে আগের দিন রাতেই ঘটে গেছে সেই ঐতিহাসিক ঘটনা! ইতিহাস যাকে মনে রেখেছে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ বা ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ হিসেবে! শোনার পর থেকেই একইসঙ্গে তার মন সেই বীর যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে এসেছিল, আবার একই সঙ্গে খুব কষ্ট হয়েছিল এই সংগ্রামে নিজে সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকতে না পারার জন্য! তার যে আশৈশবের স্বপ্ন সক্রিয় বিপ্লবী হবার! সে স্বপ্ন কি কোনওদিনই সত্যি হবে না!

কেমন করে একটু একটু করে সে তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে এসেছে হাজার বাধা পেরিয়ে, সেই কথাই আজকের এই বাইশে সেপ্টেম্বরের রাতে একান্তে ভাবছে প্রীতিলতা! কে জানে কখনও আর এইভাবে ভাববার অবকাশ সে পাবে কি না!

গুণুপিসির বাড়ি প্রথম যখন গিয়েছিল তখন সে বেথুন কলেজে বি.এ. পড়বার জন্য সবে কলকাতায় এসেছে। হঠাৎই খবর পেল তার পূর্ণেন্দুদা যুব বিদ্রোহের পর চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় এসে, সহযোদ্ধা বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের পিসি, সকলের গুণুপিসির বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। দাদার সঙ্গে দেখা করতে যেদিন সে গিয়েছিল গুণুপিসির বাড়ি, সেদিনই প্রথম আলাপ হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের কেমিস্ট্রির ছাত্র মনোরঞ্জন রায়ের সঙ্গে।

“আমাকে তুমি ক‍্যাবলাদা বলেই ডেকো রানি।” বলেছিলেন তিনি।

“আমার কাজটা কি তা জানো তো? আমি নারী বিপ্লবীদের সংগঠিত করি।”

শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল প্রীতিলতা ক‍্যাবলাদার দিকে। পূর্ণেন্দুদা হেসে বলেছিলেন, “রানি, তোর তো বিপ্লবী হওয়ার ইচ্ছে? জানিস তো, তোর ক‍্যাবলাদাকে মাষ্টারদা কী ভার দিয়েছেন?”

“কী?” জিজ্ঞেস করেছিল প্রীতিলতা।

“গান–কটন আর বোমা তৈরি করবার ভার।”

পূর্ণেন্দুদাদার মুখে কথাটা শোনামাত্রই বিস্ময়ে, আবেগে সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল তার! প্রীতিলতার মুখের ভাব বোধহয় সেদিন পড়তে পেরেছিলেন বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়! তাইতো তিনি উৎসাহিত করেছিলেন তাকে, কল্পনা দত্তকে, রেণুকা রায়কে, কমলা চ‍্যাটার্জীকে পলাতক বিপ্লবীদের আশ্রয়দাত্রী এই গুণুপিসির বাসায় এসে গোপন বৈঠক করতে, মাষ্টারদার পাঠানো ইস্তাহার সাইক্লোস্টাইলে ছাপিয়ে কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় তা বিলি করতে! কারণ, প্রীতিলতা আর কল্পনা দত্তর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর, তাদের চোখে মুখে বিপ্লবের প্রতি আগ্রহ আর প্রত‍্যয় যে দেখতে পেয়েছিলেন সংগঠক মনোরঞ্জন রায়! তাঁর মনে হয়েছিল, পারবে! পারলে এই মেয়ে দুটিই পারবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপ্লবের কাজে প্রাণের মায়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়তে! তাই, তিনি যখন তাঁর তৈরি করা বোমা আর গান-কটন কোনওরকমে পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে মাষ্টারদার হাতে গিয়ে তুলে দিলেন, তখন অকপটে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মাষ্টারদাকে জানিয়েছিলেন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা থেকে বিস্ফোরক বয়ে আনা সত্যিই প্রায় দুঃসাধ‍্য হয়ে উঠছিল! সেই সঙ্গে দুঃসাধ‍্য হয়ে উঠছিল জেল-বন্দি বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিঠির আদানপ্রদান করা! কারণ, শহর আর গ্রাম দুই জায়গার যুবকরাই তখন পুলিশের চোখে সবচেয়ে বড় সন্দেহভাজন ছিল! মনোরঞ্জনের কাছে অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে মাষ্টারদা সেদিন এক মুহূর্ত ভেবেছিলেন। তারপর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শান্ত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, “একমাত্র এখন একটিই উপায় আছে মনোরঞ্জন!”

মনোরঞ্জন উদগ্রীব হয়ে তাকিয়েছিলেন মাষ্টারদার দিকে। কী উপায়ের কথা বলতে চাইছেন উনি?

“গোয়েন্দা বিভাগ এখনও মেয়েদের সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করেনি। তাই এই সব কাজে এবার থেকে নারী বিপ্লবীদের দায়িত্ব দিতেই হবে। তুমি তেমন মেয়েদের সন্ধান করো।”

“সন্ধান আমি আগেই করে রেখেছি মাষ্টারদা! আর পেয়েও গিয়েছি—!”

মনোরঞ্জন রায় সেদিনই মাষ্টারদাকে জানিয়েছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আর কল্পনা দত্তর কথা।

কিন্তু, এবার থেকে মাষ্টারদা যে মেয়েদের সক্রিয়ভাবে বিপ্লবের কাজে অংশ নেবার অনুমতি দিয়েছেন সেই খবরটা প্রীতিলতা আর কল্পনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার আগেই চট্টগ্রামে মাষ্টারদার হাতে বোমা তুলে দিয়ে কলকাতায় ফেরার পরের দিনই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলেন মনোরঞ্জন রায়! হিজলী জেলে বন্দি করা হল তাঁকে।

মাষ্টারদার আদেশে মনোরঞ্জন রায়ের তৈরি করা বোমা এবং সেই সঙ্গে রিভলবার নিয়ে বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস আর কালীপদ চক্রবর্তী বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ টি.জে.ক্রেগকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে চাঁদপুর রেল স্টেশনে তাঁকে আক্রমণ করলেন! কিন্তু ভুলবশতঃ ক্রেগের বদলে তাঁরা এস.ডি.ও. তারিণী মুখার্জীকে হত্যা করে ফেললেন! ধরা পড়লেন তাঁরা। বিচারে কালীপদ চক্রবর্তীর নির্বাসন হল আর রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুদণ্ড!

“আমাকে ডেকেছিলেন গুণুপিসি?”

গুণুপিসির বাসায় সেদিন যখন প্রীতিলতা পৌঁছল, তখন গুণুপিসি তার হাতে তুলে দিলেন তাকেই লেখা তার ক‍্যাবলাদার একটা চিঠি। চিঠিটা ক‍্যাবলাদা পাঠিয়েছিলেন নিজের মায়ের হাত দিয়ে অতি গোপনে, যখন তাঁর মা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হিজলী জেলে গিয়েছিলেন! সে চিঠিতে ছিল মাষ্টারদার সিদ্ধান্তের কথাটা। আর ছিল একটি অনুরোধ—প্রীতিলতা যেন আলিপুর জেলে বন্দি থাকা ফাঁসির আসামী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে।

“তুই যা রানি—যে কাজের ভার তোকে তোর ক‍্যাবলাদা দিয়েছেন, আমি জানি তুই ঠিক তা পালন করতে পারবি—।”

“—কিন্তু গুণুপিসি—”

“কিন্তু কীসের?”

জোরের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন গুণুপিসি। প্রীতিলতাকে ইতস্তত করতে দেখে বলেছিলেন, “মৃত্যুকে নিঃশব্দে আলিঙ্গন করবে বলে প্রতীক্ষা করে থাকা এক অমূল্য প্রাণ! তুই তার সঙ্গে দেখা করবি—এতে কিন্তুর তো কিছু নেই রানি! সেই সুদূর চট্টগ্রাম থেকে কলকাতার আলিপুর জেলে এসে দেখা করবার যে অনেক খরচ! তাই তো ওর আপনজনেরা কেউই ওর সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারে না। আহা! কতদিন হয়ে গেল—বাড়ির লোকের মুখ পযর্ন্ত দেখতে পায়নি ছেলেটা!”

“—কিন্তু আমি তো তাঁর কোনও আপনজন নই! আমার সঙ্গে দেখা করতে দেবে কেন জেল কর্তৃপক্ষ? আমি সেখানে যাব কোন পরিচয়ে?”

প্রীতিলতার কথা শুনে গুণুপিসি এগিয়ে এসে তার দু’-কাঁধ ধরে সেদিন বলেছিলেন, “ওরে! তোরা দু’জন হলি দেশের দুই বিপ্লবী! এর চেয়ে বড় আপনজন হয় নাকি?”

॥ ৫ ॥

জেল কর্তৃপক্ষের কাছে ‘অমিতা দাস’ ছদ্মনামে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ‘কাজিন’ পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করেছিল প্রীতিলতা তাঁর সঙ্গে দেখা করবার অনুমতি চেয়ে।

অনুমতি পেয়ে প্রথম যেদিন জেলের ভেতর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল সে, সেদিনই একরাশ মুগ্ধতায় যেন আপনা থেকেই তার হাত দুটো পৌঁছে গিয়েছিল এই মহান বিপ্লবীর পায়ে! জানিয়েছিল শ্রদ্ধা! তাঁর চাহনিতে কী এক অপরিসীম গাম্ভীর্য ছিল! অথচ তাঁর কথাবার্তা কী খোলামেলা! সেই সঙ্গে ঈশ্বরের প্রতি কী প্রগাঢ় ভক্তি! অথচ এই মানুষটাই ঠিক যেন শিশুর মতো হয়ে যেতেন যখন নানান বিষয় নিয়ে প্রীতিলতার সঙ্গে কথা বলতেন!

তাঁর এই জেলে থাকবার সময়টাতে এরপর আরও চল্লিশবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে প্রীতিলতা। প্রতিবারই মুগ্ধতার মাত্রা যেন একটু একটু করে বেড়ে গেছে! রামকৃষ্ণ বিশ্বাস যেন আস্তে আস্তে প্রীতিলতার সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে, সমস্ত সত্বার সঙ্গে মিশে গিয়েছেন!

ফাঁসির আগের দিন শেষবারের মতো সে দেখা করতে গিয়েছিল। সেদিনই প্রথমবার তাঁকে অস্থির হয়ে উঠতে দেখেছিল প্রীতিলতা!

“মরতে আমার দুঃখ নেই প্রীতি! কিন্তু যদি সেই মৃত্যু আসত অন্তত একজন ব্রিটিশকেও হত‍্যা করার পর—তাহলে আমার কোনও কষ্টই থাকত না। কিন্তু আমি যে সেদিন ভুল করে মেরে ফেলেছিলাম আমারই নিজের দেশের একজন মানুষকে! আজ শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে—আমার কাজ অসম্পূর্ণ রেখে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে!”

কথাগুলো বলার সময় অসহায় কষ্টে রামকৃষ্ণদাকে ছটফট করতে দেখে আপনা থেকেই সেদিন প্রীতিলতার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, “তোমার অসম্পূর্ণ কাজ আমি সম্পূর্ণ করব রামকৃষ্ণদা!”

চমকে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন সেদিন রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। প্রীতিলতা তার চোখে চোখ রেখে বলেছিল,” আজ রাত পোহালেই তোমার ফাঁসি হয়ে যাবে! আজই আমাদের শেষ সাক্ষাৎকার! তাই আজ তোমার কাছে কিচ্ছু গোপন করব না।—তোমাকে—আমি—ভালোবাসি রামকৃষ্ণদা!”

কথা ক’টা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই সেদিন তার রামকৃষ্ণদার পায়ে লুটিয়ে পড়েছিল প্রীতিলতা! বিহ্বল রামকৃষ্ণ তাকে দু’হাত দিয়ে তুলে দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁর মুখোমুখি। প্রীতিলতা তাঁর চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “জানি—জাগতিক নিয়মে এই জীবনে আমি তোমার সহধর্মিনী হতে পারলাম না—কিন্তু মনে প্রাণে আমি তোমারই সহধর্মিনী—তোমার আর আমার ধর্ম যে এক—সে ধর্ম বিপ্লবের ধর্ম!”

রামকৃষ্ণের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠতে দেখেছিল প্রীতিলতা!

“আজ থেকে তোমার অসম্পূর্ণ কাজের ভার আমি নিলাম। আমার এই হাত একদিন আমি ব্রিটিশের রক্তে রাঙাবই—তোমাকে কথা দিলাম! ব‍্যস! তারপরই আমার ছুটি! যদি মৃত্যুর পরেও কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেই জগতেই আবার দেখা হবে আমাদের! তুমি শুধু আজ আমাকে এই আশীর্বাদ করো!”

পরম মমতায় স্থির, শান্ত ভঙ্গিতে প্রীতিলতার মাথায় হাত রেখেছিলেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। এবার তিনি নিশ্চিন্ত শান্তিতে আগামীকাল ভোরে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে পারবেন!

জগতের কেউই সেদিন সাক্ষী ছিল না তাদের এই একান্ত অঙ্গীকারের। প্রীতিলতা বলেছিল, “আজ থেকে আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পযর্ন্ত আমার সঙ্গেই থাকবে তুমি!”

রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির পর আরও প্রায় ন’মাস প্রীতিলতাকে কলকাতায় থাকতে হয়েছিল বেথুন কলেজে বি.এ. পড়া শেষ করে পরীক্ষা দেবার জন্য। পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে সে দেখেছিল তার বাবার চাকরি নেই! নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ‍্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার চাকরিটা চট্টগ্রামের বিশিষ্ট দানশীল মানুষ অর্পণচরণ দে’র সহযোগিতায় এরপরই পেয়ে গিয়েছিল সে।

স্কুলে পড়ানো, প্রাইভেট ছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে টিউশানি, আর সাংসারিক কাজে মাকে সাহায্য করা—এই সব নিয়েই কেটে যাচ্ছিল তার দিনগুলো।

ইতিমধ্যে কিন্তু কল্পনার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ হয়ে গিয়েছে। সে দেখা পেয়ে গেছে মাষ্টারদা সূর্য সেনের!

একদিন কল্পনার মুখেই প্রীতিলতা শুনতে পেল সংগঠনের কাজে জরুরি ভিত্তিতে কিছু অর্থের দরকার হয়ে পড়েছে মাষ্টারদার। কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই সে তাদের সংসার খরচের পুরো টাকাটাই সেদিন তুলে দিতে চেয়েছিল কল্পনার হাতে! কল্পনা জানত তাদের আর্থিক অবস্থার কথা তাই সে ইতস্তত করছিল সেই টাকাটা নিতে। কল্পনার মনের দ্বিধার কারণটা বুঝতে পেরে সেদিন কেঁদে ফেলেছিল প্রীতিলতা। আকুল হয়ে বলেছিল যে সে বুঝতে পেরেছে সে গরিব বলেই কল্পনা তার টাকা নিতে চাইছে না! কিন্তু মনে প্রাণে সে যে একজন একনিষ্ঠ বিপ্লবী এইটুকু প্রমাণ করবার সুযোগও কি তাহলে সে পাবে না?

॥ ৬ ॥

প্রীতিলতার মনের এই দৃঢ়তা সেদিন উপলদ্ধি করতে পেরেছিল কল্পনা। আর তাইতো একদিন রাতে চুপিচুপি তাকে নিয়ে সে পৌঁছে গিয়েছিল একটি ছোট্ট কুটিরে। সেখানে তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল বিপ্লবী নির্মল সেনের সঙ্গে। আলাপ হওয়া মাত্রই নির্মল সেন সেদিন প্রীতিলতার কাছে প্রথম প্রশ্ন করেছিলেন, “পরিবারের প্রতি তোমার কেমন টান আছে রানি?” উত্তরে দৃপ্ত কন্ঠে সে বলেছিল, “টান আছে। কিন্তু ডিউটি টু ফ‍্যামেলিকে ডিউটি টু কান্ট্রির কাছে বলি দিতে পারব নির্মলদা!”

নির্মল সেন কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে ছিলেন এক দৃষ্টিতে। তারপর বলেছিলেন, “বেশ। আমি তোমাকে তাহলে কথা দিচ্ছি রানি, আমি মাষ্টারদার সঙ্গে তোমার দেখা করাবই।”

বহু কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন অবশেষে পূর্ণ হল প্রীতিলতার জীবনে!

প্রথম যেদিন মাষ্টারদাকে চাক্ষুষ দেখেছিল প্রীতিলতা, সেদিনই তাঁর পায়ে প্রণাম করে আবেদন জানিয়েছিল তাঁর কাছে—

“আমি অ‍্যাকশান করতে চাই মাষ্টারদা!”

সশস্ত্র বিপ্লবে তার আগ্রহ দেখে ধলঘাটের সাবিত্রী চক্রবর্তীর সেই গোপন আস্তানা যাকে বিপ্লবীরা ‘আশ্রম’ বলে ডাকতেন, সেখানে আত্মগোপন করে থাকবার সময় মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে ডেকে পাঠিয়ে সেখানে থেকেই বন্দুক চালানো শিখে নেবার আদেশ দিয়েছিলেন।

উনিশশো বত্রিশ সালের বারোই জুনের এক প্রবল ঝড়বৃষ্টির দিনে মাষ্টারদা যেদিন লোক পাঠিয়ে তাকে জরুরি তলব করেছিলেন, সেই দিনটা চোখের সামনে আজ ভাসছে প্রীতিলতার! সেই ছিল তার প্রথম সক্রিয়ভাবে বিপ্লবী অভিযানে অংশ নেওয়া!

মাকে সে সীতাকুণ্ড যাওয়ার কথা বলে সেই লোকটির সঙ্গে চলে এসেছিল ‘আশ্রম’-এ। সেখানে তখন ছিলেন মাষ্টারদা, নির্মলদা আর বিপ্লবী অপূর্ব সেন, যাঁকে তারা ভোলাদা বলে ডাকত। মাত্র মাসখানেক আগেই মাষ্টারদা আর নির্মল সেনের মাথার দাম ঘোষণা করেছে ব্রিটিশ পুলিশ—দশ হাজার টাকা! চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন আর জালালাবাদ যুদ্ধের পর থেকেই গ্রামে ছিল মিলিটারি ক‍্যাম্প। এই ক‍্যাম্প থেকে প্রায়ই সৈন্যরা বিভিন্ন বাড়িতে আচমকা তল্লাশি চালিয়ে আত্মগোপন করে থাকা বিপ্লবীদের ধরপাকড় করত। এই ক‍্যাম্প থেকে মাত্র দশ মিনিট দূরে ছিল সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়ি, যার ছদ্মনাম ‘আশ্রম’।

সেই রাতে নির্মলদা আর অপূর্বদা দু’জনেরই খুব জ্বর এসেছিল। তাঁরা তাই রাতের খাবার না খেয়ে মাটির দোতলার ঘরে শুয়ে ছিলেন। নীচে মাষ্টারদার সঙ্গে ভাত খেতে বসেছিল সে নিজে।

পুরস্কারের লোভে ক‍্যাপ্টেন ক‍্যামারুণ দু’জন সাব ইন্সপেক্টর, সাতজন সেপাই, একজন হাবিলদার আর দু’জন কন্সটেবল নিয়ে কখন যে ‘আশ্রম’ ঘিরে ফেলেছিল তা তারা কেউই টের পায়নি!

সাব–ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন বোস ধাক্কা দিয়ে নীচের দরজাটা খুলে সাবিত্রী মাসিমা আর তাঁর ছেলে মেয়েদের দেখা মাত্রই চিৎকার করে উঠেছিল—“ঘরে আর কে আছে? বলো!”

ক‍্যাপ্টেন ক‍্যামারুণ রিভলবার হাতে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে নির্মলদার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মলদা গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছিলেন! নির্মলদা’র ছোঁড়া গুলি এসে লেগেছিল ক‍্যামারুণের বুকে! মৃত্যুর মুখে তৎক্ষণাৎ ঢলে পড়েছিল ক‍্যাপ্টেন ক‍্যামারুণ! পুলিশের বাকিরাও তখন গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছিল। তাদের ছোঁড়া গুলিতে সেদিন শহিদ হয়েছিলেন নির্মলদা!

অপূর্বদা, মাষ্টারদা আর সে অন্ধকারে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল সন্তর্পণে! কিন্তু ঝরা পাতার ওপর তাদের পায়ের খস্ খস্ শব্দ হতেই সেপাইরা আবার গুলি চালাতে শুরু করেছিল! সবার আগে ছিলেন অপূর্বদা। সেপাইদের ছোঁড়া গুলি এসে লেগেছিল তাঁর বুকে!

মাষ্টারদা আর সে কচুরিপানা ভরা পুকুর সেই রাতে সাঁতরে পার হয়ে কাশীয়াই গ্রামে মণিলাল দত্তর বাড়ি গিয়ে পৌঁছেছিল! তারপর সেখান থেকে বিপ্লবীদের আর এক গোপন আস্তানা ‘কুটির’-এ।

পরদিন মাষ্টারদা মণিলালকে পাঠিয়েছিলেন প্রীতিলতার বাসার ওপর পুলিশের নজর পড়েছে কি না তা জানতে। সব কিছু ঠিক আছে জানার পর তিনি আদেশ দিয়েছিলেন তাকে বাড়ি ফিরে যেতে।

সেই রাতে মাষ্টারদা আর সে যখন নিরাপদ দূরত্বে পালাচ্ছিল, তখন রামকৃষ্ণদা’র সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের যে বিবরণখানা সে লিখে এনেছিল মাষ্টারদাকে দেখানোর জন্য, তা পুকুরের জলে কখন পড়ে গিয়েছিল তা প্রীতিলতা টেরও পায়নি!

এই ঘটনার পর বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে সাবিত্রী চক্রবর্তী ও তাঁর ছেলেমেয়েরা গ্রেফতার হয়েছিলেন। ‘আশ্রম’ বাড়ি তল্লাশি করবার সময় প্রীতিলতার ছবি প্রথম হাতে এসেছিল ব্রিটিশ পুলিশের! আশেপাশে পাওয়া গিয়েছিল বিপ্লবের অনেক কাগজপত্র। সেই সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল প্রীতিলতার নিজের হাতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে তার ‘অমিতা দাস’ কাজিন ছদ্মনামে লেখা সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণখানা যেটি সেই রাতে পালাবার সময় হারিয়ে গিয়েছিল!

পুলিশ হাতের লেখা মিলিয়ে দেখার জন্য তার বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছিল তার গানের খাতাখানা!

মাষ্টারদার নির্দেশে তারপর থেকেই তো তার এই আত্মগোপনের জীবন শুরু!

অবশেষে তার সেই বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন পূরণের শুভক্ষণটি এসে উপস্থিত হয়েছে!

পাহারতলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্বের ভার তাকেই দিয়েছেন মাষ্টারদা সূর্য সেন! এ যে তার জীবনের কত বড় পাওয়া তা শুধু সে-ই জানে! রামকৃষ্ণদার অসম্পূর্ণ কাজ যে তাকে শেষ করতেই হবে!

সিদ্ধান্ত হয়েছে এ যুদ্ধে তার পরনে থাকবে মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবি। পায়ে থাকবে জুতো, আর তার চুল ঢাকা থাকবে সাদা পাগড়ীতে—ঠিক যেমন সেজেছিলেন ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈ! যে যুদ্ধ–সাজে সজ্জিতা হতে সে চেয়ে এসেছে সেই কিশোরীবেলা থেকে!

রাত এগারোটা নাগাদ শুরু হবে অভিযান! প্রীতিলতা নিজে ক্লাবের পূবদিকের গেটে ওয়েবলি রিভলবার ও বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে থাকবে। সঙ্গে থাকবেন শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিঙ্কর দে। ক্লাবের দক্ষিণ ও উত্তর দিকে থাকবেন সুশীল দে, মহেন্দ্র চৌধুরী, বীরেশ্বর রায়, পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাশ। সে হুইসিল বাজিয়ে আক্রমণের সংকেত দেওয়া মাত্রই শুরু হবে অ‍্যাকশান!

কালকের যুদ্ধে ব্রিটিশ যদি তার প্রাণ নিতে পারে তো নিক—কিন্তু—যদি না পারে?

প্রীতিলতা আস্তে আস্তে উঠে এসে দাঁড়াল দেরাজের সামনে। তারপর দৃপ্ত হাতে দেরাজ খুলে বার করল একটা ছোট্ট শিশি। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল তার! ব্রিটিশ পুলিশ তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না কাল! রামকৃষ্ণদাকে দেওয়া কথা যে তাকে রাখতেই হবে! দেরাজের একদম ভেতর থেকে সে এবার বার করে আনল রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের একটি ছবি। ছবির রামকৃষ্ণদার চোখে চোখ রেখে বলল, “ব্রিটিশের রক্তে আমার হাত দুটো কাল রাঙাতে যাচ্ছি রামকৃষ্ণদা! এ যুদ্ধে যে তাই তোমাকেও কাল থাকতে হবে আমার সঙ্গে!

এক হাতে সেই ছোট্ট শিশিটা আর অন্য হাতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবিখানা আঁকড়ে পরম নিশ্চিন্তের ঘুমে এবার আস্তে আস্তে ডুবে গেল প্রীতিলতা—আগামীকালের যুদ্ধের আগে এই ঘুমটা যে আজ তার খুব দরকার!

বাইশে সেপ্টেম্বরের রাত গড়িয়ে তেইশে সেপ্টেম্বরের ভোরে পৌঁছে গেল।

বাকিটা ইতিহাস। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম নারী–শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তাঁর কথা রেখেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে মারা যান একজন ব্রিটিশ, আহত হন আরও অনেকে! ব্রিটিশ পুলিশ সত্যিই তাঁকে ছুঁতে পারেনি কারণ তারা তাঁকে ধরবার আগেই তিনি পটাশিয়াম সায়েনাইডের শিশি গলায় ঢেলে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন!

তাঁর প্রাণহীন শরীরটা তল্লাশি করে ব্রিটিশ পুলিশ শুধু পেয়েছিল পটাশিয়াম সায়েনাইডের একটা খালি শিশি, রিভলবার, গুলি আর—ফাঁসির দড়ি গলায় পরে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের একখানা ছবি!

.

চকিতা চট্টোপাধ্যায়

লেখালেখির অভ্যাস অক্ষর পরিচয়ের শুরু থেকেই ভুলভাল বানানে ডায়েরি লেখা দিয়ে, দাদু-দিদিমা, মা-বাবা, মামা-মাসিদের অনুপ্রেরণায়। এগারো বছর বয়সে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। তারপর ‘শুকতারা’, ‘নবকল্লোল’, ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’, ‘প্রাত্যহিক খবর’, ‘শিলাদিত্য’, ‘গণশক্তি’ সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ পায়। ওঁর প্রকাশিত পুস্তকের ভেতরে যেমন রয়েছে ‘শুকতারার ১০১ ভূতের গল্প (৩য় খণ্ড)’, শির্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘একশো ভূতের একশো বাড়ি’-র মতো গল্প সংকলন, তেমনি আছে ‘বেতারের তেরো নাটক’, ‘শ্রুতিতে সুচিত্রা’, ‘তারাপীঠ ভৈরব সাধক বামাক্ষ্যাপা’, ‘সেরা শ্রুতিনাটক’, ‘অনুশ্রুতি’-র মতো নাটকের বই।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন