পলাতক শিবাজি – বিপুল মজুমদার

বিশ্বরূপ মজুমদার

সন্ধ্যার অন্ধকারে চরাচর ডুবে গেছে। ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠা আলোয় মোহময়ী লাগছে মথুরা নগরীকে। দূর থেকে ভেসে আসছে শঙ্খধ্বনি আর কাসর ঘণ্টার শব্দ। নিশ্চয় মন্দিরে মন্দিরে শুরু হয়েছে সন্ধ্যারতি। তারমধ্যেই মা ভবানীকে মনে মনে প্রণাম করে ঘোড়া থেকে নেমে এলেন দলপতি। অন্যদের বললেন, ‘এটাই উপযুক্ত জায়গা। এখানেই তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা করবে।’

মথুরা নগরীর শেষ প্রান্তে গাছপালায় ঘেরা নির্জন প্রান্তর। দলপতির নির্দেশে বাকি চারজন তাঁদের ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ালে দলপতি আবার বললেন, ‘আমার সংকেত না পেলে কেউ জনসমক্ষে বের হবে না। এখানে ঘাপটি মেরে থেকে নিজেদের চোখ-কান খোলা রাখবে। আশা করছি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আমি ফিরে আসতে পারব।’

অন্ধকারের মধ্যে বাকি অশ্বারোহীরা নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লে দলপতি এগিয়ে পড়লেন। তাঁকে অনুসরণ করল নয় বছরের এক খুদে বালক।

দলপতি আর তাঁর পুত্রের পরনে সন্ন্যাসীর পোশাক। রাতের অন্ধকারে আধ মাইলটাক হেঁটে যাওয়ার পর তাঁরা প্রাচীর ঘেরা এক বড় ইমারতের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ইমারতের সামনে চওড়া ফটক। ফটক লাগোয়া একটা ঘরে একজন দ্বারপালও রয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসী তাকে গলা চড়িয়ে ডাকলেন। দ্বারপাল বেরিয়ে এলে তাকে বললেন, ‘কৃষ্ণাজি পন্তকে বলো দু’জন সন্ন্যাসী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। খুবই জরুরি!’

দ্বারপালের মুখে সন্ন্যাসীদের আগমনের সংবাদ আর ‘জরুরি’ কথাটা শুনে বেশ অবাক হলেন কৃষ্ণাজি পন্ত। সন্ন্যাসীরা সবসময় গৃহীদের কাছে সম্মাননীয়। তাই বেশি না ভেবেই তাদের ভেতরে আসবার অনুমতি দিলেন তিনি।

বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসী ভেতরে ঢুকে কৃষ্ণাজি পন্তের মুখোমুখি হয়ে তাকে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলতে চাই আমরা।’

দুই সন্ন্যাসীর একজন যুবক এবং বলিষ্ঠ, অন্যজন নিতান্তই বালক। পরিবারের লোকেরা তাঁদের দেখবে বলে ভিড় জমিয়েছে। কৃষ্ণাজি সবাইকে ভেতরে যেতে বললেন। সবাই অন্তরালে চলে গেলে বললেন, ‘এবার বলুন মহাশয় কী বলতে চান।’

বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসী মৃদু হাসলেন, ‘শিবাজি ঘনিষ্ঠ মোরো পন্ত পেশোয়ারের শ্যালক আপনি। মথুরা রাজদরবারের কর্মচারী হিসাবে একজন প্রভাবশালীও বটে। আপনাকে আমার একটা উপকার করতে হবে।’

অচেনা অজানা একজন সন্ন্যাসী তাঁর সম্পর্কে এতকিছু জানল কী করে! কৃষ্ণাজি পন্ত অবাকই হলেন। মনের ভাব গোপন রেখে বললেন, ‘বলুন কী উপকার করতে হবে আপনার?’

সহসা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন সন্ন্যাসী। যেন বহুদূর থেকে বলছেন এমনভাবে বললেন, ‘চারিদিকে বাদশার চরেরা হন্যে হয়ে ঘুরছে আমাকে ধরবার জন্য। এই অবস্থায় আপনিই আমার একমাত্র ভরসা!’

কৃষ্ণাজি ঘাবড়ে গেলেন, ‘সন্ন্যাসীকে কেন বাদশার চরেরা ধরবে! কী করেছেন আপনি?’

সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘আমি সন্ন্যাসী নই। সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে আপনার মাতৃভূমির সেবক শিবাজি! মারাঠাদের স্বরাজের জন্য লড়াই করতে নেমে মুঘলদের চক্রান্তে আগ্রা দুর্গে বন্দি ছিলাম। আজ সকালেই সেখান থেকে পালিয়ে আপনাদের এই মথুরাতে এসে হাজির হয়েছি। আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য আমার এই পুত্র শম্ভুজি। আপানাকে এর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে!’

সন্ন্যাসী-রূপী শিবাজির কথায় বিস্ময়ে থ হয়ে গেলেন কৃষ্ণাজি। এ তিনি কী শুনছেন! দেশে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার মারাঠা বীর শিবাজিকে তিনি চাক্ষুস দেখেছেন। কিন্তু সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর মুণ্ডিত মস্তক, দাড়ি গোঁফহীন মসৃণ মুখমণ্ডল। পরনে সন্ন্যাসীর পোশাক আর মাথায় গেরুয়া পাগড়ি থাকায় চেনার কোনও উপায়ই নেই! মুহূর্তের স্থবিরতা। তারপরেই হতভম্ব ভাব কাটিয়ে শিবাজির পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন কৃষ্ণাজি। ধরা গলায় বলে উঠলেন, ‘আপনি আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, সকলের নমস্য। চিনতে পারিনি বলে আমায় আপনি মাফ করবেন মহারাজ। আপনার বন্দি হওয়ার খবরটা আমাদের জানা থাকলেও, পালানোর সংবাদটা এখনও কর্ণগোচর হয়নি। হয়তো কাল রাজ দরবারে গেলে সে খবর পেয়েই যেতাম। তবে ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ যে আপনি ওই শয়তান আওরঙ্গজেবের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এখন বলুন শম্ভুজির ব্যাপারে আমাকে কী করতে হবে?’

শিবাজি পাশে দাঁড়ানো শম্ভুজির দিকে তাকালেন একবার, তারপর বললেন, ‘আমি জানি না পালিয়ে পালিয়ে কতদিন আমি থাকতে পারব। এতক্ষণে মুঘল চরেরা আগ্রা থেকে দক্ষিণমুখী সবক’টা ফেরিঘাট, গিরিপথ এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজপথে তাদের তীক্ষ্ণ নজর ছড়িয়ে দিয়েছে। রক্ষীরাও পাহারা তাদের কড়া করেছে। তাদের কারও চোখে দু’জনে ধরা পড়ে গেলে সমূহ বিপদ। মারাঠা স্বরাজের জন্য আমাদের বেঁচে থাকা দরকার। আমি চাই আমি ধরা পড়ে গেলেও শম্ভুজি যেন অধরা থাকে। সেইজন্যই আপনার এখানে আসা কৃষ্ণাজি। শম্ভুজির নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। ওকে কিছুদিন আপনার এখানে রাখবেন। তারপর পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা হলে অত্যন্ত গোপনে পৌঁছে দেবেন ওকে আমাদের রায়গড় দুর্গে। মোদ্দা কথা ওর যাবতীয় দায়-দায়িত্বের ভার আপনার উপর দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে এখান থেকে আমি বিদায় নিতে চাই কৃষ্ণাজি।’

দীর্ঘ কথার পর শিবাজি থামলেন। বিনয়ের সঙ্গে হাতজোড় করলেন কৃষ্ণাজি, ‘আপনি মারাঠাদের গৌরব মহারাজ। কথা দিচ্ছি এই দায়িত্ব আমি নিজের জীবন দিয়েও পালন করব। আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকুন।’

১৬৬৬ সালের ১৮-ই আগস্ট। শনিবার। আজ সকালেই আগ্রা দুর্গ থেকে পালিয়েছেন শিবাজি। পালানোর আগে কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকে সে খবর পাঠিয়েও দিয়েছিলেন। তারা আগ্রা দুর্গের বাইরে এক নিরিবিলি জায়গায় কয়েকটা দ্রুতগামী অশ্ব নিয়ে অপেক্ষা করছিল। শিবাজি রক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে সেখানে পৌঁছালে সকলে মিলে চুল দাড়ি গোঁফ বিসর্জন দিয়ে সন্ন্যাসীর বেশে বেরিয়ে পড়েছিলেন মথুরার উদ্দেশে। এরপর কৃষ্ণাজি পন্ত শিবাজির আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে চাইলে মহারাজ রাজি হলেন না। শম্ভুজির দায়িত্বের কথা আর একবার মনে করিয়ে দিয়ে দ্রুত মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারের মধ্যে।

চারিদিকে জনরব আছে শিবাজি মহারাজ জাদু জানেন! মারাঠা বীরের পলায়নের পর আওরঙ্গজেবও সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন বোধহয়। নইলে আগ্রা দুর্গের এমন সুরক্ষিত জায়গা থেকে কীভাবে একটা মানুষ পালিয়ে যেতে পারলেন! অন্ধকারের মধ্যে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সঙ্গীদের দিকে এগোতে থাকলেন শিবাজি। ধুরন্ধর বুদ্ধি ধরেন বটে মারাঠা বীর। তিনি জানেন ধরা পড়লে মৃত্যু অনিবার্য তাঁর। আওরঙ্গজেব আর তাঁকে রেহাই দেবেন না। মুঘল সম্রাট নিশ্চয় তাঁর রাজকর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছেন যে আগ্রা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে যাওয়ার প্রতিটা রাস্তায় যেন কড়া নজর রাখা হয়। তাই বুদ্ধি করে ওই পথে পা বাড়াননি শিবাজি। মুঘল রক্ষীদের চোখে ধুলো দিতে আগ্রা থেকে চলে এসেছেন উত্তর দিকে এই মথুরায়। মথুরা থেকে মহারাষ্ট্র যেতে হলে দক্ষিণের পথ ধরতে হবে। শিবাজি মনস্থির করলেন সে পথে না গিয়ে এবার তিনি পূব দিকে চলে যাবেন। চলে যাবেন প্রয়াগে। ওদিকে নিশ্চয় মুঘল রক্ষীদের পাহারা অনেক কম থাকবে।

॥ ২ ॥

মথুরা থেকে প্রয়াগ। চারজন সন্ন্যাসীর ছোট্ট একটা দল ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি তুলতে তুলতে পৌঁছে গেল প্রয়াগে। প্রয়াগ সাধু সন্ন্যাসীদের কাছে পবিত্রস্থান। ফলে সেখানে সাধু সন্ন্যাসীদের ভিড়ে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে শিবাজিদের কোনও বেগ পেতেই হল না। থাকেন মন্দির চত্বরে। খান মন্দিরের ভোগ প্রসাদ। তবে সবসময় চোখ-কান খোলা রাখেন। কোমরে লুকিয়ে রাখেন ধারালো ছোরা! পথে অর্থের প্রয়োজন। তাই হাতের লাঠির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন মূল্যবান রত্ন, হীরা পান্না সোনা এবং প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা। প্রয়াগে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর শিবাজি এরপর পূর্ব দিকের পথ ধরে গেলেন বারাণসী। বারাণসী হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ ধর্মস্থান। সেখানকার গঙ্গায় স্নান ও পূজার্চনা করে পরম তৃপ্তিতে ছদ্মবেশে পথ পরিক্রমা করতে থাকেন শিবাজি। মারাঠা বীর জানতেন সর্বত্রই প্রথম প্রথম যে কড়া নজর থাকে কালে কালে ক্রমশ তা শিথিল হয়ে আসে। তাই তিনি আরও কালক্ষেপ করতে চাইলেন। বারাণসী থেকে মহারাষ্ট্রে না ফিরে গেলেন আরও পূবের দিকে গয়ায়।

গয়ায় তীর্থদর্শনের পুণ্য অর্জন করে এরপর তিনি মনস্থ করলেন মহারাষ্ট্রে নিজের এলাকায় প্রত্যাবর্তন করবেন। সন্ন্যাসীর দলটা সেইমতো দক্ষিণের পথে অগ্রসর হল। গয়া থেকে মহারাষ্ট্র কম পথ নয়। এইভাবে দীর্ঘ পথ পার হতে বেশিরভাগ সময় তারা পদব্রজেই গমন করতেন। কখনও নির্জন এলাকা পার হতেন ঘোড়ায় চেপে। মুঘল রক্ষীদের চোখ এড়াতে কখনও নদী পার হতেন ভেলায় চেপে, জনপদ এড়িয়ে যেতে বেছে নিতেন শ্বাপদসঙ্কুল জঙ্গলের রাস্তা। এইভাবে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে গিয়ে একবার পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েন শিবাজি। পা যেন আর তাঁর চলতেই চায় না। সঙ্গের সঙ্গী নিরাজি পন্ত, দত্তাজি পন্ত আর রাঘোজি তিনজনেও ক্লান্ত। তাঁরা বললেন সামনের পাহাড়টা টপকাতে হলে ঘোড়া ছাড়া যো নেই। শিবাজি দ্বিধাগ্রস্ত। শেষে সঙ্গীদের চাপাচাপিতে স্থানীয় পশুর হাটে যান ঘোড়া কিনতে।

পশু কেনাবেচার বিশাল হাট। এক ঘোড়ার ব্যাপারী আট দশখানা তেজি ঘোড়া নিয়ে এক অশ্বত্থ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। অনুচরদের নিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন শিবাজি। দরদামের পর ঝোলায় হাত দিয়ে দেখেন যথেষ্ট মুদ্রা নেই। অগত্যা দাম মেটাতে ঝোলায় রাখা দু’খানা ভারী সোনার হার তুলে দেন বিক্রেতার হাতে! সন্ন্যাসীর ঝোলায় সোনার হার! তাছাড়া ঘোড়ার যা দাম তার তুলনায় ওই হারদুটোর দাম অনেক। বিক্রেতার সন্দেহ হয়। সে বুঝতে পারে সন্ন্যাসী সাধারণ ক্রেতা নন। ইতিমধ্যেই আগ্রা দুর্গ থেকে শিবাজির পালানোর সংবাদ নানা রঙে পল্লবিত হয়ে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সংবাদ ঘোড়া বিক্রেতারও কানে এসেছে। সে ভাবে, তবে কি ইনিই সেই শিবাজি! সত্য জানতে বিক্রেতা চেপে ধরেন সন্ন্যাসীকে। শিবাজির অনুগামীরা প্রমাদ গোনেন। চোখে চোখে কথা হয়ে যায় তাঁদের। পরিস্থিতি ঘোরালো হলে বিক্রেতাকে হত্যা করে এখান থেকে পালাতে হবে তাঁদের! কিন্তু জনবহুল এই হাটের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটালে খবরটা মুহূর্তে রাষ্ট্র হয়ে যাবে চতুর্দিকে। তীরে এসে তরী ডুববে শিবাজির। মারাঠা বীর তাই কৌশলের আশ্রয় নেন। ঘোড়ার ব্যাপারীকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, আপনার অনুমান সঠিক। আমিই শিবাজি! মুঘলদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য কয়েকটা ঘোড়ার আমার বিশেষ প্রয়োজন। তবে একথা গোপন রাখার জন্য যথাযোগ্য পুরস্কার আপনি পাবেন। অনেক মুল্যবান রত্ন আপনাকে দেওয়া হবে। বিনিময়ে মুখখানাকে বন্ধ রাখতে হবে আপনার!’

ঘোড়ার ব্যাপারী রত্নের লোভে মুখে কুলুপ আঁটলেন। শিবাজি বুদ্ধিমান মানুষ। সোনার হার আর মূল্যবান মণিমাণিক্য ব্যাপারীর হাতে তুলে দেওয়ার পর দ্রুত সরে পড়েন ঘোড়া নিয়ে।

॥ ৩ ॥

পলাতক জীবনের তিনমাস অতিক্রান্ত। শেষপর্যন্ত মারাঠা বীর এসে পৌঁছান মহারাষ্ট্রে নিজের এলাকায়। জঙ্গলে ঘোড়াগুলিকে ছেড়ে দিয়ে হাঁটা পথে এগিয়ে চলেন জনপদের দিকে। সঙ্গে সেই তিনজন অনুগামী। গোদাবরীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় এতটাই অবসন্ন হয়ে পড়েন যে পা যেন আর চলতেই চায় না। দূরে দিকচক্রবালে দেখা যাচ্ছে অজানা এক গ্রাম। গ্রামবাসীদের ছোট ছোট কুটিরগুলি দূর থেকে দৃশ্যমান হওয়ায় সঙ্গী নিরাজি পন্ত পরামর্শ দেন সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নিতে। শিবাজি নিরাজি পন্তের পরামর্শ মেনে নেন। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের প্রান্তে পৌঁছে এক দরিদ্র গ্রামবাসীর কুটিরে গিয়ে আতিথ্য গ্রহণ করেন।

মাঝবয়সী গ্রামবাসীটি বড়ই সজ্জন। নিজের জমিতে চাষবাস করে পরিবার প্রতিপালন করেন। সন্ন্যাসীদের সেবাযত্ন করবার পর গল্পগাছা করবার সময় তিনি তার দুঃখের কথা বলতে শুরু করেন অতিথিদের। তিনি বলেন, শিবাজি মহারাজ মুঘলদের হাতে বন্দি হওয়ার পর মারাঠা সৈন্যরা যথেচ্ছাচার শুরু করেছে! তারা অন্যায়ভাবে লুঠতরাজ চালাচ্ছে। এই ক’দিন আগেই তো, খাজনা আদায়ের নামে তাদের গ্রামে এসেও হানা দিয়েছিল মারাঠা বাহিনী। তৈলঙ্গরাও পরিচালিত সেই বাহিনী তার পরিবারের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে।

ছদ্মবেশী শিবাজি সব শোনেন। কিন্তু মুখে কোনও রা কাড়েন না। মনে মনে তিনি ভাবেন, মাত্র তিনমাস তিনি অনুপস্থিত, তারমধ্যেই এতকিছু! প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তাঁর সারাজীবনের সাধনা তৈলঙ্গরাওয়ের মতো সেনানায়কের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে এ কেমন কথা! মারাঠা বীর শিবাজি গ্রামবাসীটিকে সান্ত্বনা দেন। বলেন, ‘আমি রায়গড় দুর্গের দিকেই যাচ্ছি। রাজমাতা জিজাবাঈয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে একথা তাঁর কানে আমি তুলে দেব। তিনি নিশ্চয় এ অন্যায়ের প্রতিকার করবেন!’

॥ ৪ ॥

শিবাজির মা জিজাবাঈ রায়গড় দুর্গে গভীর মনের দুঃখে দিন কাটাচ্ছেন। পুত্র শিবাজির মনে স্বরাজের স্বপ্ন জাগিয়ে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছেন ছেলেবেলা থেকে। স্বপ্ন ধীরে ধীরে সাকারও হচ্ছিল। পুনার সামান্য এক জায়গীরদার থেকে নিজের বুদ্ধিবলে গড়ে তুলেছিলেন এক ছোট্ট মারাঠা রাজত্ব। ভারতের হিন্দু সমাজ ঘোর সংকটে। হানাদার মুসলিম শাসকরা সারা ভারতবর্ষে তাদের জাল বিস্তার করে অত্যাচারের মুগুর চালাচ্ছে। দিকে দিকে প্রজাদের মধ্যে হাহাকার। নারী জাতির সম্মান ভূলুণ্ঠিত। ধর্মান্তরের জোরজুলুমে সকলেই সন্ত্রস্ত। এই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শিবাজি। তাঁর চোখে মারাঠা সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি এলাকা দখলে। তোরনা দুর্গ জয় করবার মধ্য দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি তাঁর বিজয়যাত্রা। তারপর একে একে রায়গড় দুর্গ, কোন্ডলা দুর্গ, সুভামঙ্গল দুর্গ…!

ছেলেবেলায় জ্যোতিষী শিবাজির ভাগ্য গণনা করে বলেছিলেন, এ ছেলে অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সাহসী ও বীরপুরুষ হবে। হবে অতি ক্ষুরধার বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ ধী-শক্তির অধিকারী। চতুর্দিকে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির গৌরব পতাকা উড্ডীন করবে এ ছেলে! বাস্তবে তো তেমনটাই ঘটেছে। অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে গেছে শিবাজি। কিন্তু আওরঙ্গজেবের আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে ঘটে গেল চরম বিপত্তি। শয়তান আওরঙ্গজেবের জালে আটকে পড়ল তার বীর পুত্র। ছেলের বন্দি হওয়ার খবর শুনে চোখের জলে দিন কাটিয়েছেন জিজাবাঈ। তারপর একদিন যখন খবর পেলেন যে শিবাজি আওরঙ্গজেবের জাল ছিঁড়ে পালিয়েছেন; তখনও তাঁর উৎকণ্ঠার শেষ নেই। কারণ তিনি জানতেন যে ধরা পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত শিবাজির!

রায়গড় দুর্গে অপরাহ্ন ঘনিয়ে আসছে। মা ভবানীর সামনে বসে সন্ধ্যা আহ্নিক করবেন বলে মাতা জিজাবাঈ প্রস্তুত হচ্ছিলেন। হঠাৎ অন্দরমহলে তার কাছে খবর এল কয়েকজন সন্ন্যাসী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। জিজাবাঈ তাঁদের ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন। একটু পরেই সন্ন্যাসীর দলটা ভেতরে এসে উপস্থিত হলে জিজাবাঈ তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সামনে থাকা বয়স্ক নিরাজি পন্তকে জিজাবাঈ প্রণাম করলে শিবাজির ইঙ্গিতে নিরাজি পন্ত জিজাবাঈকে আশীর্বাদ করেন। এরপর শিবাজির পালা। সন্ন্যাসী-রূপী শিবাজিকে জিজাবাঈ প্রণাম করতে গেলে আবেগতাড়িত শিবাজি মায়ের চরণে লুটিয়ে পড়েন। জিজাবাঈ হতচকিত। তখন শিবাজি নিজের মস্তকাবরণ খুলে মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই জিজাবাঈ তাঁর বীর সন্তানকে চিনতে পারেন। মুহূর্তে বিস্ময় আর আনন্দে মায়ের চোখ অশ্রুসিক্ত। কালবিলম্ব না করে নিমেশে জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে। সমাপ্ত হয় শিবাজির পলাতক জীবন। কিছুক্ষণ বাদেই শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে রায়গড় দুর্গ। উৎসব আনন্দে মেতে ওঠে দুর্গবাসীরা।

॥ ৫ ॥

পলাতক জীবন শেষ হয়েছে শিবাজির। সামনে প্রচুর কাজ। মারাঠা সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন তাঁর চোখে-মুখে। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে যদি শম্ভুজিকে না পাওয়া যায়! শম্ভুজি শিবাজির যোগ্য উত্তরাধিকারী। শিবাজির অবর্তমানে স্বরাজের সংগ্রাম শম্ভুজিই চালাবে। তাই মারাঠা বীর এক নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন। মুঘলদের বিভ্রান্ত করতে রটিয়ে দিলেন তাঁর শরীর খুবই খারাপ। এবং পথশ্রমে ও অসুস্থতায় মৃত্যু হয়েছে যুবরাজ শম্ভুজির! শিবাজি ভালোই জানেন চরের মাধ্যমে এই খবর অচিরেই আওরঙ্গজেবের কানে পৌঁছবে। সেক্ষেত্রে খবরটা শোনার পর শম্ভুজিকে খোঁজার ব্যাপারে নির্ঘাত ক্ষান্তি দেবেন বাদশা। ফলে নির্বিঘ্নে রায়গড়ে ফিরে আসতে শম্ভুজির আর কোনও বেগ পেতে হবে না!

বিপুল মজুমদার

জন্ম ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হালিশহরে। অধুনা বারাসাত নিবাসী। রাজ্য সরকারের পূর্ত (সড়ক) দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত সহকারি বাস্তুকার। নয়ের দশক থেকে লেখালেখির শুরু। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় রবিবারের ‘বর্তমান’ পত্রিকায়। পরবর্তীকালে “আনন্দবাজার”, “শুকতারা”, “কিশোর ভারতী”, “সাপ্তাহিক বর্তমান”, “সানন্দা”, “নবকল্লোল”, “সুখী গৃহকোণ” সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছোট এবং বড়দের জন্য নানাধরনের গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থ – ‘গা ছমছম’, ‘বিচিত্রমামার বিচিত্রকাণ্ড’, ‘কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষ’, ‘ভো-কাট্টা’, ‘অশরীরী ২১’, ‘রক্ত-দাগের রহস্য’ ইত্যাদি। 

সূচিপত্রে ফিরে যান

অকথিত গল্পবনবীথি পাত্র

‘আম্মু…’

জোহরার শীর্ণ কণ্ঠস্বরে পশ্চাৎ ফিরিয়া তাকাইলেন লুৎফুন্নেসা। বাতায়নের নিকট হইতে কন্যার শিয়রে আসিয়া আপন হস্তখানি কন্যার ললাটে রাখিতেই চমকিয়া উঠিলেন, প্রবল উত্তাপে গাত্র যে পুড়িয়া যাইতেছে! শয্যা পার্শ্বে বাতিখানি মৃদুভাবে জ্বলিতেছিল। বাতিখানি সামান্য উসকাইয়া দিয়া কক্ষের বাহিরে আসিয়া একটু উচ্চস্বরেই ডাকিলেন, ‘রুক্মা।’

রুক্মা হইল লুৎফুন্নেসার মহলের খাস বাঁদি। বাঁদি হইলে কী হইবে তাহার সহিত বেগমের সখীত্বের সম্পর্ক। আমেনা বেগমের খাস মহলের বাঁদি ছিল তাহারা দুইজনেই। লুৎফুন্নেসা সিরাজের বেগম হইয়াও সে সখীত্বকে অস্বীকার করে নাই। রুক্মার বিটিয়া সালমাও যে জোহরার সমবয়সী! জোহরা আর সালমা হামজুটির ন্যায় এই মহলেই বাড়িয়া উঠিতেছিল। কিন্তু এক বাঁদির বিটিয়ার সহিত নবাব নন্দিনীর সখীত্ব সিরাজের না-পসন্দ। সালমার এই মহলে আসা নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন সিরাজ। রুক্মা তথাপি জোহরাকে আপন বিটিয়ার ন্যায় স্নেহ করে।

কিন্তু আজ এহেন সংকটের মুহূর্তে কোথায় যাইল রুক্মা! জোহরার শরীরের তাপ যে নামিবার বদলে ক্রমাগত বাড়িয়াই চলিতেছে। হাকিমকে একটিবার ডাকিয়া আনিবার বড় প্রয়োজন। রাত্রি তো ক্রমশ গাঢ় হইতেছে। এখন কোন তিথি চলিতেছে কে জানে! বাহিরে ঘন অন্ধকার। অমাবস্যা নিকটে হইবে হয়তো। নবাব কেল্লায় গতকল্য হইতেই আঁধার নামিয়াছে। এক অদ্ভুত নীরবতা যেন গ্রাস করিয়া রাখিয়াছে কেল্লাখানিকে। লুৎফুন্নেসা আবারও ডাকিলেন, ‘রুক্মা…’

নীরবতার গাম্ভীর্য্য ভাঙিয়া তাহার কণ্ঠস্বরটিই যেন প্রতিধ্বনিত হইল। তথাপি রুক্মার সাক্ষাৎ পাইলেন না। দক্ষিণের মহলটি নবাব সিরাজের প্রথমা বেগম উমদাতুন্নেসার। নবাব কেল্লায় তিনি বহু বেগম নামেই পরিচিত। বহু বেগম সাহেবার মহল থেকে বামাকণ্ঠের হাসির শব্দ আসিতেছে। সিরাজের পরাজয়ে সমগ্র দেশ যখন চিন্তিত, তখনও সেই পরাজয়ের গ্লানি তাহাকে এতটুকু স্পর্শ করে নাই। সখীদের লইয়া আত্ম আমোদেই এখনও মজিয়া রহিয়াছেন তিনি।

জোহরাকে লইয়া ব্যস্ত ছিলেন লুৎফুন্নেসা। সহসাই তাহার নবাবের কথা স্মরণে আসিল। যুদ্ধক্ষেত্র হইতে সেই প্রত্যুষেই তো ফিরিয়াছেন তিনি। একটিবার তো এই মহলে আসেন নাই তিনি! কন্যা জোহরা তো তার আব্বুর নয়নের মণি, তাহাকেও একটিবার দেখিতে আসিলেন না! লুৎফুন্নেসার অন্তরে এক অজানা ভীতির সঞ্চার হইল। পুনরায় উচ্চস্বরে রুক্মাকে ডাকিতে যাইতেছিল, তাহার পূর্বেই রুক্মা অধঃবদনে লুৎফুন্নেসার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

অতখানি বিলম্বের জন্য রুক্মাকে বকিতে গিয়াও বকিতে পারিল না। কিঞ্চিৎ স্নেহার্দ্র স্বরেই কহিল, ‘কী হইয়াছে রুক্মা, মুখখানি অমন শুষ্ক লাগিতেছে কেন?’

রুক্মা নিরুত্তর রহিল। নীরবতা রুক্মার স্বভাব বিরুদ্ধ। তথাপি তাহাকে এরূপ নীরব থাকিতে দেখিয়া লুৎফুন্নেসার চিত্তে এক অজানা অশঙ্কা জন্মাইল। কম্পিত স্বরে শুধাইল, ‘ফঈজুলের কিছু হইয়াছে?’

নবাব সিরাজের অশ্বারোহী বাহিনীর সেনা ছিল রুক্মার খসম। পার্শ্ববর্তী এক রাজ্যের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া সে প্রাণ হারাইয়াছে বছর পাঁচেক হইল। কিন্তু কিয়ৎকাল যাবৎ ফঈজুলের সহিত রুক্মার অন্তরঙ্গতা লুৎফুন্নেসার দৃষ্টিগোচর হইতেছিল। কিছু প্রশ্ন করিলে রুক্মা অস্বস্তিতে পড়িতে পারে ভাবিয়া কখনও তাহাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই। অদ্য সংকটককালে ফঈজুলের নামটি যেন অজ্ঞাতসারেই লুৎফুন্নেসার জিহ্বাগ্রে আসিয়া পড়িল।

বেগমের নিকট ফঈজুল নামটি শুনিয়া মুহূর্তকাল যেন চমকিয়া উঠিল রুক্মা। তাহার পর সকরুণ দৃষ্টিতে বেগমের মুখ পানে চাহিয়া কী যেন বলিতে যাইতেছিল। কিন্তু তাহার পূর্বেই কক্ষ হইতে জোহরার করুণ কণ্ঠস্বরে সকল কিছু ভুলিয়া দুইজনেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল।

রুক্মা আপন বক্ষে জোহরার মস্তকটি তুলিয়া ধরিয়া উদ্বেগের সহিত কহিল, ‘গাত্রতাপ তো অগ্নিসম বোধ হইতেছে।’

লুৎফুন্নেসা কহিল, ‘এখনই একটিবার হাকিম সাহেবকে সংবাদ পাঠাইয়া ডাকাইয়া আনিবার বন্দোবস্ত করো।’

‘মহলের ভিতর হইতে কাহাকেও বাহিরে যাইতে দেওয়া হইতেছে না।’ অধঃবদনে কহিল রুক্মা।

‘কাহার আদেশ?’ দুই চক্ষু ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল লুৎফুন্নেসার।

রুক্মা শুধু একখানি নাম উচ্চারণ করিল, ‘মীরজাফর।’

রুক্মা কালবিলম্ব না করিয়া আপন পোশাকের অঞ্চলখানি সিক্ত করিয়া বারিসিঞ্চন করিতে লাগিল জোহরার মস্তকে।

লুৎফুন্নেসা উদ্বিগ্ন নয়নে শিয়রে দাঁড়াইয়া ভাবিতেছিল সহসা নবাব কেল্লায় এতখানি বিপর্যয় নামিয়া আসিল, অথচ নবাব একটিবার তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার প্রয়োজনটুকুও অনুভব করিলেন না!

গোরা সাহেব দিগের এত ক্ষমতা নাহি যে তাহারা বাংলার নবাবকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া বাংলার দখল লইবে। নির্ঘাত কোনও গৃহশত্রু গোরা সাহেবদের সহিত হস্ত মিলাইয়াছে। সেনাপতি মীরজাফরকে কোনওদিনই সুবিধার মনে হয় নাই লুৎফুন্নেসার। তাহার সন্দেহের কথা সিরাজকে কহিয়াছিল লুৎফুন্নেসা। কিন্তু সিরাজ তাহার ভাবনাকে কোনও প্রকার গুরুত্ব না দিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিয়াছিলেন। লুৎফুন্নেসার কেন জানি না মনে হইতেছে, তাহার সন্দেহই বুঝি সত্য হইয়াছে।

‘উত্তাপ মনে হইতেছে কিছুটা কমিতেছে।’ রুক্মার কথাতে জোহরার কপালখানি স্পর্শ করিল লুৎফুন্নেসা। একখানি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিল, ‘খোদা মেহেরবান।’

শয্যার এক পার্শ্বে বসিলেন লুৎফুন্নেসা। রুক্মার স্কন্ধ স্পর্শ করিয়া বলিলেন, ‘ফঈজুলের কথা কী বলিতে যাইতেছিল তখন?’

রুক্মা অধঃবদনে কহিল, ‘তাহাকে ভালোবাসি।’

কিঞ্চিৎ যেন কাঁপিয়া উঠিল লুৎফুন্নেসার কণ্ঠস্বর।

‘তাহাকে ভালোবাসো!’

অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে রুক্মা কহিল, ‘হ্যাঁ বেগম সাহেবা। ভালোবাসি, ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি তাহাকে।’

খোজা ফঈজুল নবাব কেল্লার হারেমের পাহারাদার। হারেমের বন্দিনীদের জন্য কোনও পুরুষ পাহারাদারের উপরে ভরসা করিতে পারেন না নবাবরা। আর পাহারার মতো কঠিন কার্য স্ত্রীজাতিকে দিয়া হইবে না। অগত্যা হারেম পাহারা দিবার জন্য রাজ্য খুঁজিয়া ফঈজুলদের ন্যায় খোজাদিগকে ধরিয়া আনা হইত।

লুৎফুন্নেসা কেমন একটা সন্দিগ্ধ নয়নে তাকাইল রুক্মার দিকে। স্বল্প আলোতেও বুঝি বেগমের আঁখিলিপি পড়িতে পারিল সে। মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে কহিল, ‘দেহের সুখ তো পূর্বেই পাইয়াছি। কিন্তু অন্তরের ভালোবাসায় যে সুখ লুকাইয়া আছে, তাহা যে জীবনে কখনও পাই নাই বেগম সাহেবা। সেই সুখটুকুকেই না হয় পাথেয় করিয়া আগামী জীবনের পথটুকু একসঙ্গে হাঁটিব।’

এ কেমনতর ভালোবাসার সন্ধান পাইয়াছে রুক্মা! এমনভাবেও কাহাকেও ভালোবেসে আপন করিবার স্বপ্ন রচনা করা যায়, লুৎফুন্নেসা কল্পনাও করিতে পারিতেছে না। দুই চক্ষু ভরিয়া রুক্মাকে দেখিতেছিল আর তাহাদের প্রেমের গভীরতাখানি বুঝিবার প্রচেষ্টা করিতেছিল।

এক বাঁদি আসিয়া সংবাদ দিল, ‘নবাব বেগম লুৎফুন্নেসার মহলে আসিতেছেন। সংবাদটি শ্রবণ করিবা মাত্র রুক্মা শয্যা হইতে নামিয়া কক্ষ হইতে প্রস্থান করিল।’

নবাব কক্ষে প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়াই অতীব বিচলিত বলিয়া বোধ হইতেছিল। পোশাক পরিচ্ছদও কেমন যেন অবিন্যস্ত লাগিতেছে। মণিমুক্তা খচিত তাঁহার সাধের উষ্ণীষখানিও মস্তকে না দেখিয়া লুৎফুন্নেসা কহিল, ‘আপনার উষ্ণীষ?’

‘পরাজিত নবাবের কোনও উষ্ণীষ থাকে না লুৎফা। আমি ব্রিটিশদের নিকট পরাজিত হইয়াছি।’

একখানি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া সিরাজ পুনরায় কহিলেন, ‘তোমার সিরাজকে কেহ কখনও নবাব বলিবে না লুৎফা। তোমার সিরাজের সকল মান-যশ-খ্যাতি খতম হইয়া গিয়েছে। আমি এখন একজন বন্দি পরাজিত ইনসান ব্যতীত কিছু নই। যে মহল্লাতে একদিন আমার কথাই শেষ কথা ছিল, সেই মহল্লাতে আমি বন্দি হইয়া থাকিতে পারিব না লুৎফা।’

‘এক্ষণে আপনি তবে কী করিবেন নবাব?’ লুৎফুন্নেসার কণ্ঠে উদ্বেগের সুর নবাবের দৃষ্টি এড়াইল না।

নবাব লুৎফুন্নেসার নিকটে সরিয়া আসিয়া তাহার দুই হস্ত ধরিয়া অনুনয়ের স্বরে কহিলেন, ‘আমার নিকট অধিক সময় নাই লুৎফা। অদ্য রাত্রি তৃতীয় প্রহরের মধ্যে আমাকে এই মহল্লা ছাড়িয়া, তোমাদিগকে ছাড়িয়া, মুর্শিদাবাদ ছাড়িয়া পলায়ন করিতে হইবে।’

জোহরা আমার নয়নের মণি আছে। তুমি আমার জোহরা বিটিয়াকে দেখিও লুৎফা। আমার দুর্ভাগ্যের করাল ছায়া তাহার উপর কখনও পড়িতে দিবে না অঙ্গীকার করো লুৎফা।

আপন হস্তখানি নবাবের হস্ত হইতে ছাড়াইয়া লইয়া মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে কহিল, ‘আমরাও আপনার সহিত যাইব।’

নবাব অবাক দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, ‘আমি কোথায় যাইব তাহার কোনও পূর্বপরিকল্পনাও নাই। তুমি কোথায় যাইবে?’

‘আপনি যত্র যাইবেন।’ নির্বিকার উত্তর লুৎফুন্নেসার।

‘তুমি চলিয়া যাইলে জোহরার তত্ত্বাবধান কে করিবে? জোহরা এখনও শিশু, সর্বক্ষণ তাহার তোমাকে প্রয়োজন হইবে।’

‘জোহরা আমাদিগের সহিত যাইবে জাঁহাপনা।’

লুৎফুন্নেসাকে অনেক বোঝাইবার চেষ্টা করিয়াও ব্যর্থ হইলেন সিরাজ। অজানা পথ যতই কঠিন হউক, নবাবকে একা কিছুতেই যাইতে দিতে সম্মত হইলেন না লুৎফা। অধিক কালবিলম্বও সম্ভব নয়। রাত্রির অন্ধকার থাকিতে থাকিতে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করিতে হইবে। নিদ্রিত জোহরাকে কোলে তুলিয়া লইল লুৎফা। কেল্লার গোপন সুড়ঙ্গ পথ দিয়া তাহারা বাহিরে আসিয়া পৌঁছাইল।

নৌকা অপেক্ষা করিতেছে ভাগীরথীর তীরে। আষাঢ় মাস। বর্ষা আসিয়াছে। বর্ষার বারিধারায় সিক্ত কর্দমাক্ত পথে জোহরাকে বক্ষে আঁকড়াইয়া সাবধানী পদক্ষেপে হাঁটিতে লাগিল লুৎফুন্নেসা। সম্মুখে সম্মুখে নবাব পথ দেখাইয়া চলিতেছেন।

জ্ঞান হইয়া অবধি এই কেল্লার মধ্যেই বাড়িয়া উঠিয়াছিল লুৎফুন্নেসা। শুনিয়াছে তাহার মাতা হিন্দু ছিল। আপন পরিচয় সম্বন্ধে ইহার অধিক কিছু জানা নাই তাহার। পিতামাতা কাহাকেও তাহার স্মরণে আসে না। নবাবের আম্মু আমেনা বেগমের মহলেই কাটিয়াছে লুৎফুন্নেসার শৈশব কৈশোর। তখন অবশ্য তাহার নাম ছিল ‘রাজ কুনোয়ার’। সিরাজ তাহার রূপে আকৃষ্ট হইয়া তাহার প্রেমে পড়িয়াছিলেন এবং নিকা করিয়াছিলেন। পূর্বে কখনও কেল্লার বাহিরে বাহির হয় নাই লুৎফুন্নেসা। কেল্লাকে ঘিরিয়াই তাহার জীবনের সকল স্মৃতি। অদ্য যখন সেই কেল্লা ছাড়িয়া গোপনে পলায়ন করিতে হইতেছে, স্মৃতিভার যেন তাহার পথ রুধিয়া দাঁড়াইতেছে। মন্থর হইয়া আসিতেছে চলার গতি। পশ্চাতে কেল্লার পানে পুনরায় ফিরিয়া চাহিল লুৎফুন্নেসা। আঁধার যেন গ্রাস করিয়াছে কেল্লাকে। শাদির কথা স্মরণে আসিল লুৎফুন্নেসার। ঝাড়বাতি আর আতসবাজির আলোকে সেইদিন কেল্লায় কোনওখানে কোনও অন্ধকার ছিল না। আলোয় আলোয় সকল অন্ধকারকে ভরাইয়া তুলিয়াছিলেন সিরাজ।

‘সম্মুখে ওই ভাগীরথীর ঘাট। আমরা আসিয়া পড়িয়াছি।’ সিরাজের কথায় সম্বিৎ ফিরিল লুৎফার। সম্মুখেই মশালের আলো দেখিয়া অনুধাবন করিল, ওই স্থানেই হয়তো নৌকা অপেক্ষা করিতেছে।

নৌকার উঠিয়া ফঈজুলকে দেখিয়া বিস্মিত হইল লুৎফুন্নেসা।

কোনও প্রকার প্রশ্ন না করিতেই বুঝি প্রিয়তমা বেগমের চক্ষুর ভাষা বুঝিতে পারিলেন নবাব। তিনি কহিলেন, ‘রক্ষীদের কাহারও বাহিরে আসিবার আদেশ নাই। তোমার কোনও চিন্তা নাই, ফঈজুল অস্ত্র চালনাতে কোনও রক্ষী অপেক্ষা কম নহে।’

রুক্মার বিষণ্ণতার হেতু এক্ষণে বুঝিতে পারিল লুৎফুন্নেসা। প্রেমাস্পদের সহিত আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনাতে কাতর ছিল সে। বৃষ্টি পড়িতেছে। নৌকার ছইয়ের মধ্যে ঢুকিয়া বসিল লুৎফুন্নেসা। জোহরা দেহগাত্র পুনরায় বুঝি উত্তপ্ত হইতেছে। আল্লাকে স্মরণ ব্যতীত কিছু তো করিবার নাই। আল্লাকে স্মরণ করিল লুৎফা।

নৌকা ছাড়িল। কেল্লার পশ্চিম দিকের উপরতলার শেষপ্রান্তে একখানি ক্ষীণ আলোর রেখা। কেল্লার বাঁদিদের থাকিবার ব্যবস্থা ওই পশ্চিম প্রান্তে। লুৎফা মানসচক্ষে রুক্মাকে দেখিতে পাইল। রুক্মাই যে ওইস্থানে দণ্ডায়মান তাহা বুঝিতে কোনওরূপ অসুবিধা হইল না লুৎফার।

ফঈজুল নবাবের সহিত কথা বলিতে ব্যস্ত থাকিলেও তাহার নজর যে ওই ক্ষীণ আলোকশিখাকে পর্যবেক্ষণ করিল, লুৎফা বুঝিতে পারিল। এক্ষণে মনে হইল রুক্মাকে সঙ্গে আনিলেই বুঝি বা ভালো হইত।

অধিক পথ অগ্রসর হইতে পারিল না সিরাজের নৌকা। মীর জাফরের ভ্রাতা ব্রিটিশ সৈন্য লইয়া সে পথেও পাহারায় ছিল। তাহাদের তীক্ষ্ণ নজর এড়াইয়া পলায়ন করা সম্ভব হইল না। স্ত্রী-কন্যা সহ ধরা পড়িল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। চর মারফত সংবাদ আসিল মুর্শিদাবাদে। মীরজাফরের জামাতা মীরকাসিম রাজমহলে পৌঁছাইল এবং বন্দি করিয়া নবাব কেল্লাতে ফিরাইয়া আনিল সিরাজকে। সিরাজের সহিত ফিরিয়া আসিল লুৎফুন্নেসা, জোহরা আর ফঈজুল।

নবাব বন্দি হইল কারাগারে। লুৎফুন্নেসা আপন মহলে ফিরিতে পারিল না। বাঁদি মহলের পার্শ্বে একখানি ক্ষুদ্র কক্ষে তাহার ঠাঁই হইল। তাহাদিগের সহিত এক কক্ষতেই রহিল ফঈজুল। নবাবের নসিবে মৃত্যুদণ্ড যেন দেখিতেই পাইতেছিল লুৎফুন্নেসা। আপন জীবনের কথা ভাবিবার ন্যায় মানসিক অবস্থা এক্ষণে তাহার নাই। চিন্তা হইতেছে কন্যার জোহরার জন্য। তাহার কী হইবে!

ফঈজুল কক্ষের এক পার্শ্বে বসিয়া আনমনে কী জানি কি ভাবিতেছিল! তাহার এই পরিণতির জন্য যেন নিজেকেই দোষী মনে হইতেছে লুৎফার। তাহাদিগের পলায়নের সঙ্গী না হইতে হইলে হয়তো এই দুর্গতি নামিয়া আসিত না ফঈজুলের জীবনে।

খাবার দিতে যে কক্ষে আসিল, তাহাকে দিয়া রুক্মাকে একটিবার এই কক্ষে আসিবার কথা বলিল লুৎফুন্নেসা।

সে কহিল, ‘হুকুম নাই।’

এই কেল্লায় তাহাদিগের কোনও কথাই যে আর চলিবে না বুঝিতে পারিল লুৎফা।

রাত্রি তখন কোন প্রহর ঠাহর করিতে পারিল না লুৎফুন্নেসা। কক্ষের বাতিখানি তৈলের অভাবে নিভিয়া গিয়াছিল পূর্বেই। কক্ষের দরজাখানি মৃদু শব্দ করিয়া খুলিয়া যাইতেই, তাহার নিদ্রা ভাঙিয়া যাইল। আগন্তুকের হস্তে ক্ষীণ শিখায় প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের আলোতেই রুক্মাকে চিনিতে পারিল লুৎফা। শয্যা ছাড়িয়া দ্রুত উঠিতে গিয়া দেখিল নিদ্রিত জোহরা তাহার ছোট্ট মুষ্ঠিখানিতে আম্মুর বসনপ্রান্তটি ধরিয়া রাখিয়াছে। জোহরার ন্যায় শিশুও বুঝিবা নিরাপত্তাহীনতায় শঙ্কিত। অবোধ শিশু তাহার আম্মুকেই পৃথিবীর সর্বাধিক নিরাপদ আস্তানা ভাবিয়া আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে। জোহরার মুষ্ঠি ছাড়াইয়া উঠিয়া আসিল লুৎফুন্নেসা। আপনজনের ন্যায় সস্নেহে বক্ষে জড়াইয়া ধরিল রুক্মাকে। জাগিয়া উঠিয়াছিল ফঈজুল। রুদ্ধ দ্বারের ভিতরে লুৎফুন্নেসা বেগমের ন্যায় আদেশ করিল ফঈজুলকে।

‘তুমি এক্ষণে রুক্মাকে লইয়া গোপন সুড়ঙ্গ দিয়া প্রাসাদ ত্যাগ করো ফঈজুল।’

এহেন আদেশের জন্য বোধ করি প্রস্তুত ছিল না সে। অপার বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল বেগমের মুখপানে।

রুক্মা কহিল, ‘তাহা সম্ভব নহে বেগম সাহেবা। আমাদিগের নবাব বন্দি। আপনাকেও উহারা নজরবন্দি করিয়া রাখিয়াছে। এক্ষণে আমরা পলায়ন করিলে…’

রুক্মাকে তাহার কথা শেষ করিতে দিল না লুৎফা। তাহার পূর্বেই কহিল, ‘যদি আমাকে তোমাদিগের বেগম বলিয়া মানিয়া থাকো, আমার আদেশের অন্যথা করিও না।’

ফঈজুল-রুক্মা কেহ কোনও কথা বলিতে পারিল না। অধঃবদনে দাঁড়াইয়া রহিল নীরবে।

লুৎফুন্নেসা কহিল, ‘রাত্রি হয়তো ফুরাইয়া আসিতেছে। আর বিলম্ব করিও না।’

ফঈজুলকে ভালো করিয়া গোপন সুড়ঙ্গের নিশানা বুঝাইয়া দিল। আপন কণ্ঠহারখানি খুলিয়া পরাইয়া দিল রুক্মার কণ্ঠে। অতঃপর মৃদুস্বরে কহিল, ‘একখানি অনুরোধ করিতে পারি রুক্মা?’

‘অনুরোধ কেন বলিতেছেন বেগম সাহেবা? আপনি তো হুকুম করিবেন।’

‘আমার অথবা তোমাদিগের নবাব কাহারও জীবনের কী যে পরিণতি হইতে চলিয়াছে, তাহা সম্বন্ধে কেহ অবগত নহে।’

খানিক থামিল লুৎফা। রুক্মার হস্ত দুইটি আপন মুষ্ঠিতে লইয়া কহিল, ‘জোহরাকে তোমাদিগের সহিত লইয়া যাইবে?’

চমকিয়া উঠিল রুক্মা। কম্পিত স্বরে বলিল, ‘সকলে তো জোহরা বিটিয়ার অনুসন্ধান করিবে। উহাকে না পাইলে আপনার উপর উহারা অত্যাচার করিবে বেগম সাহেবা।’

‘অত ভাবিবার অবকাশ নাই রুক্মা। যেরূপ পরিস্থিতি আসিবে আমি সামলাইয়া লইব। তুমি আমার জোহরাকে তোমাদিগের সহিত লইয়া যাও। অদ্য হইতে সে তোমারই পুত্রী হইল। সে জানিবে তুমিই তাহার আম্মু।’

রুক্মা কোনও কথা বলিতে পারিল না। বেগম সাহেবার সহিত আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় বুঝি তাহার কণ্ঠও রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল। বাক্যালাপ দীর্ঘায়িত না করিয়া নিদ্রিত জোহরাকে রুক্মার ক্রোড়ে তুলিয়া দিল লুৎফা। আলগোছে একখানি চুম্বন করিল জোহরার ললাটে।

রাত্রি বুঝি ফুরাইয়া আসিতেছে। উহারা কক্ষ হইতে বাহির হইতেই সদ্য পরিত্যক্ত জোহরা শূন্য শয্যাখানিতে মস্তক রাখিয়া ক্রন্দনে ভাঙিয়া পড়িল লুৎফা। জোহরার আম্মু সম্বোধনখানি আর কখনও শুনিতে পাইবে না ভাবিয়াই এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় বক্ষ বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল লুৎফার।

কক্ষের রুদ্ধদ্বারখানি খুলিবার শব্দ হইতেই অজ্ঞাত আশঙ্কাতে উঠিয়া দাঁড়াইল লুৎফা। ঘুমন্ত এক শিশুকে বক্ষে জড়াইয়া এক বাঁদি কক্ষে প্রবেশ করিল। জোহরাকে লইয়া আসিয়াছে কেন? রুক্মারা তবে কি প্রহরীদিগের নিকট ধরা পড়িয়া যাইল!

কোনওরূপ প্রশ্ন করিবার পূর্বেই সেই বাঁদি কহিল, ‘আমি রুক্মার বিশ্বস্ত দোস্ত আছি বেগম সাহেবা। আপনি আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারেন। বিটিয়াকে আপনার নিকট পৌঁছাইয়া দিতে বলিয়া গিয়াছে রুক্মা।’

তাহার ক্রোড় হইতে জোহরাকে আপন ক্রোড়ে লইতে গিয়াই লুৎফা বুঝিল এ তাহার জোহরা নহে। চিৎকার করিয়া উঠিল লুৎফা, ‘এ তুমি কাহারে লইয়া আসিয়াছ?’

‘প্রহরীগণ নিকটেই রহিয়াছে বেগম সাহেবা। আপনার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলে উহারা ছুটিয়া আসিবে। তখন বিপদ হইতে পারে।’

কণ্ঠস্বর আরও খানিক ক্ষীণ করিয়া কহিল, ‘এ সালমা আছে, রুক্মার বিটিয়া।’

হিসহিস স্বরে যেন গর্জে উঠিল বেগম।

‘উহারে এই স্থানে লইয়া আসিলে কেন?’

‘রুক্মার অনুরোধে। রুক্মা বলিয়াছে, আগামী প্রভাত হইতে সালমা সকলের নিকট জোহরার পরিচয় পাইবে। আপনাকে চিন্তা করিতে নিষেধ করিয়াছে। আপনার জোহরাকে সে প্রাণ দিয়াও রক্ষা করিবে।’

বাঁদি কক্ষ ত্যাগ করিল। অন্ধকার কক্ষের ক্ষুদ্র বাতায়নটির রুদ্ধ দ্বার ভেদ করিয়া বুঝি ক্ষীণ আলোর রেখা আসিতেছে। লুৎফা প্রায় ছুটিয়া গিয়া খুলিয়া ফেলিল বাতায়নের আগল।

সূর্য উদিত হইতে এখনও বিলম্ব রহিয়াছে। প্রত্যুষের মৃদু আলোকে অধিক দূরের দৃশ্যাবলী স্পষ্ট দেখা যাইতেছে না। তবু কী যেন খুঁজিতেছে লুৎফা। একসময় বুঝি লক্ষ্যবস্তুর সন্ধান পাইল। দূরে, ওই দূরে নদীতীরে একখানি নৌকাতে যেন দুটি ছায়ামূর্তি উঠিল। ছাড়িয়া যাইল নৌকা।

লুৎফাকে অত্যাচার হইতে বাঁচাইতে আপন সন্তানকে উৎসর্গ করিল রুক্মা…

রুক্মার এই ঋণ ইহ জীবনে পরিশোধ করিতে পারিবে না। সালমাকে বক্ষে জড়াইয়া কাঁদিয়া উঠিল লুৎফা। নিদ্রিত নবাব মহলের প্রতিটি প্রস্তরে ধাক্কা খাইয়া গুমরে মরিতে লাগিল সে কান্না। লুৎফা ব্যতীত কেহ তাহা জানিতও পারিল না।

.

বনবীথি পাত্র

জন্ম ৬ই নভেম্বর। স্কুল জীবনের শুরু কলকাতাতে হলেও, পরবর্তী শিক্ষা এবং বড় হওয়া পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়াতে। প্রথাগত শিক্ষানুযায়ী বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও, সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ ছোট থেকেই। লেখালেখির শুরু সেই শৈশবে। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় “শুকতারা” পত্রিকায়। তবে বহুবছর নানা কারণে লেখার জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার পর, নতুন করে লেখা শুরু করেন ২০১৫ তে। মানুষের মনের কথা, মানুষের জীবনের কথা লিখতেই ভালোবাসেন লেখিকা।

অধ্যায় ১ / ৯

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন