বিশ্বরূপ মজুমদার
গতকাল রাতে আমরা এলাহাবাদ স্টেশন থেকে হাওড়ার উদ্দেশে ট্রেনে চেপেছি। অনেক দিন কাজের চাপে কোথাও ঠিক বেড়ানোর সুযোগ হয় না। তবু আমি, ঐশিক আর দ্যুতি বেরিয়ে পড়েছিলাম। তিন জনেই আমরা যে যার কাজের জগতে ব্যস্ত। আমরা একসঙ্গে কলকাতার একটা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সে প্রায় বহুকাল আগের কথা। কিন্তু এলাহাবাদে যে অভিজ্ঞতা হল তা অবর্ণনীয়। মনের ভিতর অজস্র প্রশ্নের ঝড় উঠেছে। আমি উত্তর খুঁজছি। ইহজগতের পর পরজগতের দুনিয়া সত্যি কি বাস্তব? সেই দুনিয়ার অস্তিত্ব কি আদপেই আছে? আরও কত কী! এইসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই। কিন্তু এই জীবনের অভিজ্ঞতার ভান্ডার নিদারুণ এক দুঃস্বপ্নের মতো সমৃদ্ধ হল।
এলাহাবাদ শহরটা ইতিহাসের পাতায় সুবিখ্যাত অঞ্চল রূপেই পরিচিত। এলাহাবাদের কাছেই রয়েছে ত্রিবেণী সঙ্গমের তিন নদীর মিলন — গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতী নদী। এটি একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে হিন্দু ধর্মগ্রন্থে। একে পবিত্র শহর হিসাবে পুজো করার কথা উল্লেখ করা রয়েছে প্রাচীন বেদে। এলাহাবাদ কোসাম্বি দেবী বৈদিক কালের নাম কুরু শাসকরা রেখেছেন হস্তিনাপুর যারা একে রাজধানী হিসাবে গড়ে তুলেছিল। সতেরোশো শতকের গোড়ার দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে রাজধানী হিসাবে শহরটা ছিল জাহাঙ্গীরের আয়ত্তে।
যাই হোক, অনেক ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে ফেললাম। আমরা পাঁচদিন আগে এলাহাবাদ পৌঁছে গেছিলাম। একটা থাকার মতো মোটামুটি হোটেল পেয়েই গেছিলাম। সেখানে বাঙালি রান্না মন্দ হয় না। আমার ঠিক করলাম সকলে মিলে খুশরু বাগানে যাব। সেখানে ইতিহাসের বিখ্যাত মানুষের কবরস্থানও রয়েছে। একটা টাঙ্গায় চেপে তিনজনে সকালেই উঠে পড়লাম। গাড়ির চালাককে যখন কথাটা বললাম, বেশ অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। হিন্দিতে বললেন, “কঁহা যানা চাহতে হ্যায়। উধর পে ব্যুউরিয়াল গ্রাউন্ড। লেকিন!”
“লেকিন ক্যায়?”
লোকটার মুখে কোনও কথা নেই। ঐশিক আমার দিকে চেয়ে বলল, “এত হেঁয়ালি করছে কেন লোকটা?”
খানিক বাদে লোকটা বলল, “মুঝে জলদি লটনা হ্যয়। ইয়ে জাগা থোড়া ডরাবনি অউর খতরনাক ভি হ্যয়।”
“কিঁউ? ক্যায় হ্যয় ইঁহা পর?”
“ক্যায় হ্যয় কুছ লোগ কহতে হ্যয় কুছ তো উস জগা পর হ্যয়। পর ক্যায় হ্যয় মালুম নেহি। আপ লোগ কলকত্তা সে আয়ে হ্যয়। মেহেমান হ্যয়। ইসলিয়ে চকিত করনা মেরা কাম হ্যয়!”
“কী বলছে রে? কোনও ভয়ের ব্যপার আছে নাকি?” দ্যুতির উদ্বিগ্ন প্রশ্নে বলে উঠলাম, “দেখা যাক।”
আমরা টাঙ্গা থেকে নামতেই একজন স্থানীয় মানুষ এগিয়ে এলেন, “আপনারা শেষে কবর স্থানে ঘুরতে এসেছেন?”
এই কথা শুনে আমরা চমকে গেলাম। বাঙালি ভদ্রলোক এখানে! আমি বলে উঠলাম, “হ্যাঁ আমরা ঘুরতে এসেছি। আপনি এখানেই থাকেন? আপনি বাংলা বলতে পারেন?”
“আমি এখানে প্রায় অনেক বছর আছি। কলকাতা থেকেই এসেছিলাম কাজের সন্ধানে। তারপর কাছেই একটা হোটেলে রান্নার কাজ করি। কেন জানি মনে হল আপনারা কলকাতা থেকে এসেছেন। তাই এলাম আলাপ করতে। গোরস্থানের আশপাশ দেখতেই পারেন। তবে সাবধানে ঘুরবেন।” লোকটা বলল।
আমি কেন জানি খুশরু বাগানের একদিকে নিজে থেকেই খানিকটা ভিতরে ঢুকে গেলাম। ওরা দু’জন ওই লোকটার সঙ্গেই কথা বলতে ব্যস্ত।
একটা বহু পুরানো সমাধির কাছে এগিয়ে এলাম। হঠাৎ মনে হল একটা তীব্র ঠান্ডা বাতাস চারপাশে বইছে। কেন এমন হল? কিছুই বুঝছি না। হৃদয়ের অলিন্দে একটা খামোকা আশঙ্কা ছুঁয়ে গেল। কী একটা অশুভ কিছু হবে! খালি মনে হতে থাকল। তারপর খানিক বাদে দ্যুতি আর ঐশিক আমার কাছে এগিয়ে আসতেই মনে হল যাক চারপাশে ঠান্ডা বাতাসটা আর নেই! আমি ওদের জিজ্ঞাসা করলাম, “হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া বইছিল না?”
“কই কখন?” দ্যুতির কথায় আমি বুঝলাম এটা আমারই খালি মনে হয়েছে।
আমরা তিনজনে নিজেদের হোটেলের রুমে ফিরে এলাম। সবাই গরম ভাত, মুরগির মাংসের ঝোল খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। এমন সময় হোটেলের একজন কর্মচারী ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনারা রাতে কী খাবেন? খুশরু বাগানে আবার ঘুরতে যাবেন নাকি? রাতের বেলা ওই দিকে না যাওয়াই ভালো। জায়গাটা ভালো না।”
লোকটা মাঝবয়সী হবে। এলাহাবাদে বহু বাঙালি নিজের মতো করে জীবিকা অর্জন করে। নিজের মতো করে থেকে গেছে। আমি অনুমান করলাম এই লোকটিও তাই হবে। কিন্তু আমরা খুশরু বাগানে গেছি। সেটা এই লোকটা জানল কী করে? এই প্রশ্নটা ঐশিক জিজ্ঞাসা করল। লোকটা বলে উঠল, “না, টাঙ্গাওয়ালা ওই দিকেই আপনাদের নিয়ে যাচ্ছে। তাই আন্দাজে মনে হয়েছিল।” এই বলে লোকটা বেরিয়ে গেল। দ্যুতি আর ঐশিক রুমে ঘুমিয়ে নিল। ঐশিক পাশের রুমে থাকছে। আমি আর দ্যুতি একসঙ্গে রুম শেয়ার করছি। দুই জন মেয়ে। আলাদা রুম নেইনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সারাক্ষণ মনের কোণে খচ খচ করতে লাগল আমার। ওই কবরস্থানে কেন আমার ওমন অস্বস্তিকর অনুভব হল। যাই হোক তিনজনে খাওয়া দাওয়া পর্ব তাড়াতাড়ি রাত ন’টার পর সেরে নিলাম। কী মনে হল জানি না। দ্যুতি শহরের একটা ম্যাপ জোগাড় করে আগামী দুই দিন কোথায় কোথায় ঘোরা হবে ঠিক করল। কিন্তু আমার নিজের কেন জানি ওই খুশরু বাগানে আবার যাওয়ার ইচ্ছে জাগল। কোন এক আকর্ষণ আমাকে বার বার বশীভূত করে ওই বাগানে টানছে। আমি পরের দিন সকাল থেকেই দ্যুতি আর ঐশিককে সঙ্গে নিয়ে চারপাশের আরও দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখলাম। কিন্তু আমার কেন জানি মনটা ছটফট করছে খুশরু বাগানে যেতে। দ্বিতীয় দিন সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট করার পর আমি দ্যুতি আর ঐশিককে বললাম, “তোরা কোথাও ঘুরে আয়। আমি রুমেই থাকছি। শরীরটা ভালো নেই।” ওরাও রাজি হয়ে গেল। দুই জনে বেরিয়ে পড়ল। আমি নিজেকে ঘরে আটকে আর রাখতে পারলাম না। হাঁটা লাগালাম। বেলা গড়িয়েছে অনেকটা। প্রায় দুপুর হবে। একটা টাঙ্গা নিয়ে খুশরু বাগানের সামনে নামলাম। খুশরু বাগানে অনুমতি নিয়েই ওই সমাধি ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চললাম। মনে হল কবরস্থানের প্রহরী আমাকে অনুসরণ করছে। খানিক বাদে আমি পিছন ঘুরতেই চোখাচোখি হয়ে গেল।
“ওই সমাধিটা জাহাঙ্গীরের সময়ের। মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ের। কিন্তু আপনি ওইখানে বার বার আসছেন কেন? আপনি একজন একাকী মেয়ে এত সাহস দেখাচ্ছেন যে বড়! ওটা মান বাঈয়ের সমাধি। জাহাঙ্গীরের প্রথম পত্নীর। বহু পুরানো। ভর দুপুরে এখানে থাকবেন না। চলে যান।” প্রহরী বলে উঠল।
আমার কেন জানি জেদ চেপে গেছিল। লোকটার কথা শোনার পর বললাম, “এক ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আমি!” লোকটা চুপ। ভয়ানক ক্রূর দৃষ্টিতে দেখছে। কিছুটা বিকেল হতে আমি খুশরু বাগানের বাইরে বেরিয়ে গেলাম। খানিকটা এগিয়ে কোনও টাঙ্গা আর আমি পেলাম না। সন্ধ্যা গড়াতে যায়। খুব জল তেষ্টা পেয়েছিল। সামনে একটা পুরনো ঐতিহাসিক সামগ্রীর অকশান হাউস পড়ল। বাইরে নোটিশ বোর্ডে লেখা সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত খোলা। সেখানে ঢুকলাম। একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এলেন।
“কী চাই?”
“একটু জল হবে? বড় তেষ্টা পেয়েছে? মোবাইলে চার্জ প্রায় নেই। একটু চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন? আমি কলকাতা থেকে আসছি। আমার বন্ধুরা হোটেলে ফিরবে। ওরা ঘুরতে গেছে। আমাকে রুমে না দেখতে পেলে চিন্তা করবে। ওদের একটা ফোন করে দিতাম। তাই বললাম।” আমার বক্তব্য শুনে লোকটা ভদ্রভাবে সম্মত হল। আমাকে একটা পুরানো ভাঙা চেয়ারে বসতে দিল। মোবাইলে ব্যাটারি চার্জের ব্যবস্থা করে দিল। তারপর ভিতরে জল আনতে গেল। আমি তার অকশান হাউসটা ভালো করে দেখতে লাগলাম। কত রাজা রাজরা, সম্রাট সম্রাজ্ঞীর ছবি, বহু পুরানো কালের মুদ্রা, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, শিকারের যন্ত্র, পশুর ছাল, আরও কত কী! আমি ভালো করে দেখছিলাম খুঁটিয়ে। খানিক পর লোকটা ভিতর থেকে জল নিয়ে এল। আমি একটা মহিলার হাতে আঁকা পেইন্টিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কেন জানি আমার ভিতরে ঝড় উঠেছে। কে ইনি? কোথায় দেখেছি? আমি দেখলাম ভদ্রলোক আমার হাতে জলের গ্লাস ধরিয়ে অবাক হয়ে আমাকে দেখছেন। কী দেখছেন বুঝলাম না। আমি বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করলাম, “এই ধূসর ছবিটা কার?”
লোকটা হতবাক হয়ে চুপ করে আমাকেই দেখছে। কিন্তু কেন বুঝলাম না। খানিক পর তার সম্বিৎ ফিরল। বলল, “জাহাঙ্গীরের প্রথম স্ত্রী মান বাঈ! তখনকার সময়ে এক চিত্রকর হাতে এঁকেছিলেন। আমার অকশান হাউসে বহু ঐতিহাসিক মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ের জিনিস, ছবি রয়েছে। যেগুলো বহু মূল্যেই আমি বিক্রি করতে পারি। আপাতত এইগুলো সংগ্রহে রয়েছে। আচ্ছা একটা কথা, আপনি কে?”
লোকটার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম। অপ্রস্তুত হয়েই বললাম, “কেন বলুন তো? আমি সুলোচনা। বর্তমানে একটা কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপনার কাজ করি। কলকাতা থেকে আরও দুই বন্ধু সহ এসেছি। ঐতিহাসিক স্থান ঘুরতে যাওয়া আমার একটা প্যাশন বলতে পারেন।” তারপর লোকটার দেওয়া গ্লাসের জল শেষ করলাম। তারপর থেকেই সারা শরীর কেঁপে উঠল। কেমন চারিদিকে নেশাময় ধূসর মনে হতে লাগল। ঘড়ির দিকে নজর পড়তে বুঝলাম রাত আটটা বাজে। কেন জানি পা টলমল করছে। কী খেলাম! কে জানে! কীসের আকর্ষণে খুশরু বাগানের দিকে হাঁটা লাগালাম। আমার ঠিক জানা নাই। চারিদিক প্রায় অন্ধকার। টুকটাক কয়েকটা বাতি নজরে পড়লেও আমি কোনও দিকে না তাকিয়ে বাগানের গেটের কাছে উপস্থিত হলাম। সেই সময়ে কোনও প্রহরী উপস্থিত ছিল না। সোজা অন্ধকারেই বড় বড় পা ফেলে সেই সমাধি স্থানে উপস্থিত হলাম। তারপর আমার মনে হতে লাগল চারপাশে যেন ঝড় উঠেছে। কোনও এক নারী চরিত্র চোখের সামনে ছায়ার মতো ধীরে ধীরে উপস্থিত হল। আমি বার বার চোখ কচলাতে লাগলাম। হাতে চিমটি কাটলাম। বুঝলাম ভুল কিছু দেখছি। এ কী! এ যে আমি! আমার মূর্তি আমার সামনে! আমার কী মাথা খারাপ হয়েছে! তারপর একটা দৃশ্য নজরে এলে। সেই নারী মূর্তি একটা গ্লাসে কিছু খেল। তারপর চিৎকার করতে লাগল — “সেলিম তুমি মমতাজকে ভালোবাসো। আমি তোমার কেউ নই! কেন কেন! কেন এমন করলে আমার সঙ্গে?”
তারপর আবার একটা দৃশ্য হাওয়ায় বার বার আমাকে ঘিরে অন্ধকারে ঘুরতে লাগল। তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি দেখলাম এক পুরুষকে আমি মানে আমার মতো দেখতে ওই নারীর মূর্তি বার বার বলছে, “খুসারাউ তুমি আব্বার প্রতি বিশ্বস্ত হও। এই সাম্রাজ্যের মালিক হবে তুমি। কেন আব্বার বিরোধীতা করছ?” তারপরেই দেখলাম আমি নিজের হাতে নিজেকেই একটা লোহার কিছু দিয়ে হত্যা করলাম!”
তারপরই মনে হল সেই ঝড়ের ধুলোকণা আমাকে ঘিরে ঊর্ধ্ব আকাশে বয়ে চলেছে। আমি সেই ধুলোকণায় বন্দি এক পাখির মতো ছটপট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। পরের দিন আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি আমি স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি। মাথার কাছে দ্যুতি আর ঐশিক বসা। দুই জনেই আমার চোখ খুলতে বলে উঠল, “কেমন আছিস? কী করতে ওই খুশরু বাগানে গেছিলি? আমরা সারা সন্ধ্যা তোকে খুঁজে খুঁজেও পেলাম না।” সারা শরীর আমার অবশ লাগছে। সবটা আমার মনে পড়ল। তারপরই আমি উঠে বসলাম। চিৎকার করে উঠলাম, “আমি কে? আমি কে? আমি কে?” তারপরই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। অজ্ঞান হওয়ার আগের মুহূর্তে সেই অকশান হাউসের ভদ্রলোক আর খুশরু বাগানের সেই প্রহরীকে যেন দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। গতকালও আমার শরীরটা খারাপ ছিল। খানিকটা ধাতস্থ হয়েছি। দ্যুতির কাছে যেইটুকু জানলাম যে সারা সন্ধ্যা ওই সমাধির ক্ষেত্রের পাশে আমি মাথা ঘুরে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলাম। ওরা আমায় বহুবার ফোন করে। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ওই অকশান হাউসের ভদ্রলোক ওদের ফোন ধরে তার অকশান হাউসে ডাকেন। তারপর আমার সেখানে যাওয়ার কথা বলেন। ওই সম্রাজ্ঞীর চিত্রটাও ওদের দেখায়। তাতে ওরা নাকি বিস্মিত! ওরা দ্রুত খুশরু বাগানে ছুটে আসে। সেই প্রহরীর সাহায্যে আমাকে ওই বাগান থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে। আমি ধীরে ধীরে ওদের নিজের ছায়ামূর্তির আর ধুলো ঝড়ের হাতে বন্দি হওয়ার সবটা বলি। তারপর ঐশিক আমাকে ধীরে ধীরে সেই অকশান হাউসে বেলার দিকে আবার নিয়ে গেল। ওই সেই সম্রাজ্ঞীর ছবির সামনে দাঁড় করাল। বলে উঠল, “এটা জাহাঙ্গীরের প্রথম স্ত্রী আর তার প্রথম সন্তান খুসারাউ মির্জার মা শাহ বেগমের ছবি। ছবির দিকে ভালো করে দ্যাখ! এটা তো তোর চেহারাটাই পুরোপুরি বসানো!”
দ্যুতি বলে উঠল, “মানে জাতিস্মর!” অকশান হাউসের ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “সুলোচনা ম্যাডামের সঙ্গে শাহ বেগমের এমন অদ্ভুত মিল দেখে সেই দিনই আমি চমকে যাই! এত এত যুগের পর জাতিস্মর রূপে জন্ম!”
অকশান হাউসের ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, “মান বাঈ আমেরের রাজা ভগবন্ত দাসের কন্যা ছিলেন। ভারমল রাজার নাতনী। খুসারাউ মির্জার জন্মের পর সেলিম তাকে শাহ বেগম উপাধি দেন। পনেরো বছর বয়সেই সেলিম মান বাঈকে বিয়ে করেন। দুই কোটি টঙ্কায় বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আকবর নিজে দাঁড়িয়ে এই বিবাহ দেন। ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৫৮৫ সালে মুসলিম কাজীদের উপস্থিতিতে এই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। ভগবন্ত দাস যৌতুকে একশো হাতি, ঘোড়া, মূল্যবান পাথর, সোনা রূপার পাত্র, বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র দিয়েছিলেন। তার কিছু নমুনা আমার অকশান হাউসে আছে বটে। গণ্যমান্যদের জন্য পার্সিয়ান, তুর্কি আরবীয় ঘোড়ায় সোনার জিন দেওয়া হয়। সেই দিনের দুটো আমার সংগ্রহ শালায় আছে। এই দম্পতির প্রথম সন্তান ছিলেন সুলতান উন নিসা বেগম। দ্বিতীয় সন্তান খুসারাউ মির্জা ১৫৮৭ সালে ৬ই আগস্ট জন্মায়। শোনা যায় জাহাঙ্গীরের প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততা ও আন্তরিক নিষ্ঠা বিশেষ ভাবে সম্রাটের মনে জায়গা করে নিয়ে ছিল। তবে তিনি স্নায়বিক রোগী ছিলেন। সহজেই কল্পনা করে অপমানিত বোধ করতেন। জাহাঙ্গীর নিজে বলেছিলেন উনি অপ্রকৃতস্থ। শাহ বেগম খুসারাউ মির্জা আর ভাইয়েদের জাহাঙ্গীরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে অনুরোধ করতেন। কিন্তু তা না হওয়ায় তিনি মর্মাহত হন। আফিম খেয়ে নিজেই নিজেকে হত্যা করেন। তার সমাধি এই খুশরু বাগানে করা হয়। তাঁর সমাধি নির্মাণ করেন এলাহাবাদ দরবারের প্রধান শিল্পী আকা রেজা। দুর্ভাগ্যবশত শাহ বেগমের চেহারা পুরোটাই সুলোচনার মতো!”
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, “ধুর এইসব জাতিস্মর অবিশ্বাস্য ব্যপার। কোনও মানে নেই। ফালতু। তার মানে আমি কোন আগের জন্মের শাহ বেগম ছিলাম! ধুস!”
কিন্তু কলকাতায় ফেরার ট্রেনে বার বার কয়েকটা প্রশ্ন আমাকে ভাবিয়ে তুলল। যার উত্তর আমার কাছে নাই। খুশরু বাগানে আমি কেন বার বার কীসের আকর্ষণে ছুটে গেলাম? ওই টাঙ্গাওয়ালা আর কবরস্থানের প্রহরী কেন সন্ধ্যায় থাকতে বারণ করছিল? আমিই কেন ওই ধুলোকণায় আটকে গেলাম? আমিই বা কেন ওই ছায়ামূর্তি দেখলাম? দ্যুতি বা ঐশিক ওরা কেন কিছু ছায়া মূর্তি বা দৃশ্য দেখতে পেল না? সবটাই কি আমার মনের ভুল? ওই কবরস্থানে কেনই বা সন্ধ্যায় জ্ঞান হারালাম! আমি তো শাহ বেগমের মতো অপ্রকৃতস্থ নই। জাতিস্মর বলে কিছু হয় নাকি!
মনে মনে ঠিক করলাম মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস আবার পড়ব। আর জাতিস্মর ব্যপারটা সত্যি হয় নাকি? জানতেই হবে। তাও আবার এত বছর পর!
.
অন্তরা বিশ্বাস
হাওড়ার বালিতে জন্ম হলেও লেখিকা অন্তরা বিশ্বাস বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে এম.এস.সি এবং বি.এড পাশ করেন। এখন তিনি একটি সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা পদে কর্মরত। বর্তমানে একটি নিউজ পোর্টালে কলকাতার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য বিষয়ে নিয়মিত কলাম লেখেন। সাহিত্যের প্রতি তাঁর আসক্তি চিরকালের। “নভোরজ”
, “স্বদেশ টাইমস”, “রা অভয়া”, “বঙ্গদেশ”, “বাণিজ্যিক পত্রিকা প্রসাদ”, “সাহিত্য আর সংবাদ” ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা গল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়। বিগত কয়েকটি কলকাতা বইমেলায় তাঁর বই ‘রিপুসংহার’
, ‘গল্প ডট কম’, ‘গল্প ক্যাফে’ প্রকাশিত হয়। আর ‘গল্পের গল্প’ বইটি তাঁর ভিন্ন স্বাদের একটি ছোট একক গল্পের সংকলন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন