নবীন তপস্বিনী – দেবদুলাল কুণ্ডু

বিশ্বরূপ মজুমদার

আরাকানের মদক পাহাড় থেকে উৎপত্তি লাভ করে আরাকান রাজ্য হয়ে বাংলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে শঙ্খ নদী। এই নদীর তীরে আরাকানের অধীনে মগজাতির ছোট্ট একটা অঙ্গরাজ্য ছিল। মগরাজ ছাথো বর্তমানে এই রাজ্যের অধিপতি। ছাথোর একমাত্র কন্যার নাম কমলা।

রাজকন্যা কমলা রূপে-গুণে সত্যিই কমলা বা লক্ষ্মী। কোমর ছাপিয়ে পড়েছে তার চুলের গোছা। বাঁশপাতা ঠোঁট; চোখদুটি শান্ত কিন্তু জ্ঞানাঞ্জনমাখা। সমস্ত কর্মে সে দক্ষ। মৎস্যশিকার, নৌকাচালনা, অশ্বারোহণ বা অসিচালনা প্রভৃতি কাজে তার জুড়ি নেই। বিভিন্ন শাস্ত্রেও তার অগাধ পাণ্ডিত্য। সর্বোপরি তার মন ছিল কুসংস্কার মুক্ত।

ফাল্গুনের দ্বিপ্রহরে দু’জন সখীকে নিয়ে চাছর দীঘির টঙ্গি-ঘরে বসে বঁড়শি ফেলে মাছ ধরছিল অষ্টাদশী কমলা।

“বঁড়শিতে ঠিক মতো টোপ লাগিয়েছিলি তো তোরা?” কমলা জিজ্ঞেস করে।

“হ্যাঁ, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাক,” এক সখী উত্তর দিল।

“ওই দ্যাখ, ছিপে টান ধরেছে; ফাৎনা ডুবল; জোরে টান দে ভাই,” অপর সখী বলল।

“আরে ছিপ যে বেঁকে যাচ্ছে! মাছটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না!” কমলা বলল।

“ওই দ্যাখ, কী বড় রুই মাছ! কমলা, তুই একা পারবি না, আমাদের দু’জনকে দে।”

“ঠিক আছে ধর,” কমলা ছিপটা ওদের হাতে দিতে গেল; কিন্তু ওরা ধরার আগেই মাছের টানে ছিপটা দীঘিতে ভেসে গেল। এখন কী হবে — তিন বন্ধুর মাথায় হাত।

দীঘির পাশেই একটা ছোট্ট ডিঙিনৌকা বাঁধা ছিল। তিনজনে টঙ্গি থেকে নেমে এসে সেই ডিঙিতে উঠল। “আমি দাঁড় টেনে ছিপটার কাছে নৌকা নিয়ে যাচ্ছি; তোরা ধরার চেষ্টা করবি,” কমলা বলল।

ছিপ অনুসরণ করে কমলা নৌকাটাকে ছিপের যত কাছে নিয়ে যায়, মাছের টানে ছিপটি তখন আরও দূরে সরে যায়। একসময় যখন ছিপটা প্রায় নাগালের ভেতরে চলে এল, ঠিক তখন কমলার দুই সখী ঝুঁকে ছিপটা ধরতে গেল। অমনি দু’জনেই ঝপাৎ করে পড়ল জলে।

মুহূর্তের ঘটনায় কমলা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল; কারণ সখীদের কেউই সাঁতার জানত না। কমলা নিজে সাঁতার জানত। সে ঝাঁপ দিয়ে ধরতে গেল সখীদের; কিন্তু ততক্ষণে তারা তলিয়ে গেছে জলের অতলে। সে ডুব-সাঁতার দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। তখন ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল তার, মাথা ঘুরতে লাগল বনবন করে। মনে হচ্ছে যেন জ্ঞান হারাবে। 

ঠিক সেই সময় দীঘির পাড় ধরে যাচ্ছিল কঙ্ক নামে এক যুবক। সে দীঘির দিকে তাকিয়ে ঘটনাটার গুরুত্ব বুঝে ঝাঁপ দিল দীঘিতে। তারপর রাজকুমারীকে টেনে তুলল নৌকায়। জ্ঞান হারানোর পূর্বে কমলা শুধু দুটো শব্দ বলল, “ওরা ওখানে—”

কঙ্ক রাজকুমারীকে নৌকায় শুইয়ে দিয়ে পুনরায় জলে ঝাঁপ দিল। তারপর অনতিবিলম্বে জলের নীচ থেকে তুলে আনল কমলার সখীদের অচেতন দেহ। ইতিমধ্যে দীঘির পাড়ে ভিড় জমেছে। রাজার কাছে পৌঁছেছে সংবাদ। রাজবাড়ি থেকে ছুটে এসেছে সপারিষদ রাজা-রানি। তিনজনের অচেতন দেহ ধরাধরি করে নৌকা থেকে তুলে প্রাসাদে আনা হল। কিন্তু কিছুতেই তাদের জ্ঞান ফিরছে না দেখে তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তখন কঙ্ক বলল, “হুজুর, একমাত্র ভিক্ষু লাল ঠাকুর পারবেন এঁদের জ্ঞান ফেরাতে।”

“কথাটা মন্দ নয়; একজন ছুটে গিয়ে কেয়াং থেকে লাল ঠাকুরকে ডেকে আনো।” ছাথো বললেন।

“তাতে বেশি সময় চলে যাবে; এঁদেরকেই বরং তাঁর কাছে নিয়ে গেলে ভালো হয়।” কঙ্ক পরামর্শ দিল।

“ঠিক বলেছ; সময় নষ্ট না করে মেয়েদেরকেই বরং কেয়াং-এ নিয়ে চলো।” রাজা ছাথো বললেন।

সকলে যখন কেয়াং-এ পৌঁছাল, তখন সবে মাত্র লাল ঠাকুর উপাসনা থেকে উঠেছেন; তিনি তিনজনের নাড়ি দেখে গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে জানালেন, রাজকুমারী কমলা ছাড়া বাকি দু’জনে মৃত। তারপর কেয়াং-এর পেছনের ঝোপ থেকে কী একটা পাতা এনে হাতে ভালো করে ডলে সেই পাতার রস কয়েক ফোঁটা রাজকুমারীর জিভের উপর দিলেন। অনতিবিলম্বে জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসল কমলা।

॥ ২ ॥

“একবার যুদ্ধে হার হয়েছে তো কী হয়েছে? আবার নতুন উদ্যমে আরম্ভ করুন,” বললেন শাহ সুজার সফরসঙ্গী পীর হাফেজ খান।

“পীরবাবা, এই দুর্দিনে আপনি আর আমার বাইশজন আলেম পাশে আছেন। সবই তো জানেন, আওরঙ্গজেব কীভাবে আমাদের তিন ভাইকে বঞ্চিত করে দিল্লির মসনদে বসল। আগ্রাতে আব্বাজানকে একপ্রকার বন্দি করেই রেখেছে সে। আমি তো চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। আর এই ব্যর্থতার যন্ত্রণা ঘিরে রেখেছে আমাকে,” সুজার কণ্ঠে হতাশা।

১৬৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। নর্মদা নদীর তীরে শাহ সুজার বাহিনীকে হারিয়ে দিল আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সম্মিলিত বাহিনী। পরাজিত শাহ সুজা বাংলায় চলে এলেন। এই সময় সুজার সঙ্গে ছিল ফতে খাঁ, শেরমস্ত খাঁ, গোলাম হোসেন খাঁ সহ প্রায় আঠেরো জন সেনাপতি ও সাড়ে চারহাজার যোদ্ধা। এছাড়াও ছিল সুজার আত্মীয়-পরিজন সহ প্রায় পঞ্চাশহাজার অনুগামী। ওদিকে যুদ্ধজয়ের পরেই আওরঙ্গজেব মুরাদকে গোয়ালিয়র কারাগারে বন্দি করে রাখলেন; আর দারাকেও বন্দি করে দিল্লিতে এনে নির্মম ভাবে হত্যা করলেন।

বাংলায় ফিরে বসন্তের মনোরম এক সন্ধ্যায় পীর হাফেজ খানের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নিজের যন্ত্রণার কথা বলে চলেছেন সুজা। সারা আকাশ জুড়ে ফুটে আছে তারার দল; একফালি চাঁদও উঠেছে।

“আমাকেও ছেড়ে কথা বলবে না। আওরঙ্গজেব ভালো করেই জানে—আমিই এখন ওর পথের একমাত্র কাঁটা।” সুজা বললেন।

“হুজুরে আলী, শান্ত হোন। মনে রাখবেন, জগতে যা ঘটছে—আল্লাহর ইচ্ছেয় ঘটছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“আমার জন্য ভাবছি না; আমার চিন্তা পরীবানু আর আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে,” সুজার কণ্ঠ আর্দ্র হয়ে আসে।

ঠিক সেই সময় শাহ সুজার বেগম পরীবানু নিজের হাতে নিয়ে এল সুস্বাদু শরবত আর পেস্তা বাদাম।

“হুজুরে আলী, আপনাদের আলোচনার মাঝখানে একটা কথা বলব?” পরীবানু জিজ্ঞেস করেন।

“হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে করতে পারো।” সুজা বললেন।

“বলতে পারেন, কবে থামবে আপনাদের এই যুদ্ধ? আমার আর ভালো লাগছে না। ভাই হয়ে আরেক ভাইয়ের রক্ত পানের জন্য এত উদ্গ্রীব আপনারা!” পরীবানুর কণ্ঠে উষ্মা।

“তুমি আমাকেও এই দলে ফেললে নাকি? বেগম সাহেবা, আমি আমার আব্বাজানের মসনদের সমান অধিকার চেয়েছি মাত্র। এটা তো আমার হকের জিনিস; কেন পাব না আমি?”

“আমি সেসব কিছু শুনতে চাই না। আমি চাই আমার সন্তানেরা যেন সুরক্ষিত থাকে। এইভাবে যাযাবরের মতো পালিয়ে বাঁচার কোনও মানে আছে!” পরীবানু বললেন।

হঠাৎ ঝাউঝোপের কাছটাতে একটা ছায়া যেন নড়ে উঠল। সুজার দৃষ্টি এড়াল না। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “কে—? কে ওখানে? কে আছিস—দ্যাখ তো কে ওখানে!”

মশাল হাতে সান্ত্রীরা ছুটে যাবার আগেই ঝোপের আড়ালে আলো-আঁধারি থেকে এক যুবক উঠে এল।

॥ ৩ ॥

“এ কী! আমি এখানে শয্যাতে এভাবে শুয়ে আছি কেন? কী হয়েছিল আমার?” জ্ঞান ফিরে পেয়েই কমলা কেয়াং-এর চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করল।

“তুমি মাছ ধরতে গিয়ে জলে ডুবে গিয়েছিলে মা কমলা,” পিতার কথায় সম্বিত ফেরে পেল কমলা। তার মনে পড়ে গেল চাছর দীঘির দুর্ঘটনার কথা। সে তখন নিজের সখীদের জন্য উতলা হয়ে পড়ল।

“মাগধী আর দিতিপ্রিয়া কোথায়?” জিজ্ঞেস করল কমলা। ওরা কমলার মৃত দুই সখী।

“ওদের দেহ এই কক্ষের দক্ষিণপ্রান্তে রাখা আছে।” লাল ঠাকুর বললেন।

“ওরা বেঁচে নেই?! আমারই জন্য ওদের এই অবস্থা হল,” ভেঙে পড়ল কমলা।

“নিজেকে দোষী মনে কোরো না। ওদের আয়ু এই পর্যন্তই ছিল।” লাল ঠাকুর বললেন।

“মানি না এই সব নিয়তির কথা।” শয্যা থেকে উঠতে গেল কমলা; কিন্তু পারল না শারীরিক দুর্বলতার জন্য।

“তুমি উঠো না। এই উষ্ণ দুগ্ধটুকু পান করো; দেহে বল পাবে,” রানি বললেন।

“না, আমি দুগ্ধ পান করতে চাই না। তার আগে বলুন আমার প্রাণ রক্ষা করল কে?”

“এই যুবক তোমাকে উদ্ধার করেছে,” বলে পেছনে তাকালেন রাজা ছাথো; কিন্তু যুবককে দেখতে পেলেন না।

“কোন যুবক?”

“এখানেই তো ছিল; কোথায় গেল?”

একজন বললেন, “ওর নাম কঙ্ক; মালোপাড়ায় থাকে। ও আরাকান সেনাদলের আস্তাবলের সহিস।”

“আমাকে না বলেই চলে গেল? ভেবেছিলাম ওকে কিছু উপহার দেব,” রাজা বললেন।

“না, উপহার নয়; আমাকে বাঁচিয়ে ভয়ানক অপরাধ করেছে ও।”

“মা, এভাবে কথা বলে না। আর তোমার জ্ঞান ফিরিয়েছেন সঙ্ঘ-প্রধান লাল ঠাকুর। এঁর প্রতি তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।”

“লাল ঠাকুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতাম, যদি উনি আমার সখীদের দেহেও প্রাণসঞ্চার করতে পারতেন। আমি নিজের দোষে হারালাম তাদের।” কমলার চোখে জল।

॥ ৪ ॥

“হুজুরে আলী, এই সেই অপরিচিত যুবক,” সান্ত্রীরা যুবকের গলায় তরবারি ঠেকিয়ে শাহ সুজার কাছে নিয়ে এল।

শাহ সুজা মশালের আলোয় ভালো করে দেখলেন; যুবকটি দীর্ঘদেহী, কুঞ্চিত কেশরাশি কাঁধ স্পর্শ করেছে। গায়ের রং ফরসা, টিকালো নাক, পেশীবহুল অথচ নির্মেদ চেহারা; চোখদুটো বাঙ্‌ময়।

“তোমার পরিচয় দাও যুবক,” সুজা বললেন।

“আমি জাতিতে মগ; আরাকানের শঙ্খনদীর তীরে এক অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা।”

“এদিকে এসেছ কেন?”

“আরাকান সেনাপতি ভালো জাতের ঘোড়া কিনতে চান; তারই খোঁজে আমাকে পাঠিয়েছিলেন।”

“তোমার নাম?”

“কঙ্ক।”

“এখানে লুকিয়ে কী করছিলে?”

“আপনার সঙ্গে কথা বলব বলে—”

“কেন?”

“একটা সংবাদ দিতে চাই; সকলের সামনে এভাবে…” কঙ্ক চারপাশে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল।

“নির্দ্বিধায় বলতে পারো; সকলেই আমার বিশ্বস্ত।”

“আপনার এখন ঘোরতর বিপদ।”

“বিপদ!? কীসের বিপদ?”

“আওরঙ্গজেব সৈন্য পাঠিয়েছেন আপনাকে পরাস্ত করে দিল্লিতে নিয়ে যাবার জন্য।”

সুজার চোখে-মুখে নেমে এল হতাশার অন্ধকার; আবার একই সঙ্গে এই অচেনা যুবকের প্রতি প্রবল সন্দেহ জেগে উঠল তাঁর মনে।

“তার আগে বলো তো তুমি এত কথা জানলে কী করে?” পীর হাফিজ খান জিজ্ঞেস করলেন।

“আজ্ঞে, আমি নিজের কানে শুনেছি।”

“কোথায় শুনলে?”

“আরাকান-সেনারা বলছিল, মুঘল সৈন্য বাংলায় চলে এসেছে; ওরা নাকি নাফে নদীর তীরে ঘাটি গেড়েছে। এই কথাটা না জানিয়ে পারলাম না।”

“এই আশঙ্কাই করেছিলাম পীরবাবা। সান্ত্রী, তুমি সেনাপতিদের ডাকো; তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসব আমি। আর শোন হে যুবক! যতক্ষণ না আমার গুপ্তচরেরা সঠিক সংবাদ আনছে, ততক্ষণ তুমি আমার শিবিরে বন্দি থাকবে। এক্ষুণি আমি চর পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।” সুজা বললেন।

“তাহলে আমাকে বন্দি থাকতে হবে?” কঙ্কের মুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি।

“না, ঠিক বন্দি নয়, তুমি আজকের রাতটুকু এখানে অতিথি হিসেবে থাকবে।” সুজার নির্দেশে একজন সান্ত্রী কঙ্ককে নিয়ে গেল প্রাসাদের একটা নির্দিষ্ট কক্ষে।

পরদিন সকালে শাহ সুজা ডেকে পাঠালেন কঙ্ককে। প্রাতঃকৃত্য সেরে কঙ্ক দেখা করল সুজার সঙ্গে।

“বোসো; রাতে ঠিক মতো ঘুম হয়েছে তো তোমার?” সুজা জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ।”

“আজ আমার সঙ্গে প্রাতঃরাশ করবে।।”

সুজার কথা ফেলতে পারে না কঙ্ক। খেতে খেতেই সুজা বলেন, “তোমার অনুমানই ঠিক। ভাবছি আরাকানরাজের আশ্রয়েই যাব। আচ্ছা, তুমি যেতে পারো; তোমার কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে।”

সুজাকে ‘বাও’ করে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল কঙ্ক। কিছুটা দূরে একটা গাছের সঙ্গে তার ঘোড়াটি বাঁধা ছিল। কঙ্ক ঘোড়ায় চড়ে দ্রুততায় হারিয়ে গেল দৃষ্টিপথের আড়ালে।

॥ ৫ ॥

ঘোড়াটাকে এভাবে কেউ বল্লম মেরে ঘায়েল করতে পারে তা কঙ্ক ভাবতে পারেনি। বাড়ির কাছে চাছর দীঘির পাশে মাঠের মাঝে এসেই বল্লমের আঘাতে বসে পড়ল ঘোড়াটা; আর সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কও পড়ে গেল মাটিতে। তারপর পেছনে তাকিয়ে দেখল, কিছুটা দূরে ঘোড়ার উপর গম্ভীর মুখে বসে রয়েছে রাজকুমারী কমলা। মাটি থেকে উঠে ধুলো ঝেড়ে কঙ্ক আহত ঘোড়ার গা থেকে বল্লমটা তুলে নিল। তারপর ঘোড়ার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকেও তুলল মাটি থেকে।

“প্রাণ বাঁচানোর প্রতিদান যে এইভাবে পাওয়া যায়, তা এই প্রথম শিখলাম এক রাজকুমারীর কাছ থেকে।” কণ্ঠে উষ্মা নিয়ে বলল কঙ্ক।

ঠিক তখন রাজকুমারী কমলা নিষ্কোশিত তরবারি হাতে নিয়ে ধেয়ে এল কঙ্কের দিকে। কঙ্কের গলার কাছে আঘাত করতে গেল সে। কঙ্ক সুনিপুণ ভাবে হাতের বল্লমটা দিয়ে রাজকুমারির আঘাত প্রতিহত করল। কিন্তু কঙ্কের গায়ের পোশাকটা ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গেল। কঙ্ক কমলাকে বল্লম দিয়ে মাটতে চেপে ধরে বলল, “আরাকান সৈনিকদের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে থাকতে আমিও কিছু কৌশল আয়ত্ত করেছি। আপনাকে ধরাশায়ী করার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনি আমাকে মারতে চাইছেন কেন?”

“কে বলেছিল আমার প্রাণরক্ষা করতে? আমার প্রাণপ্রিয় সখীরা আমাকে ছেড়ে চলে গেল, আর আমি বেঁচে থেকে পার্থিব সুখ ভোগ করব, এটা আমাকে কাঁটার মতো বিঁধছে। এর জন্য তুমিই দায়ী।” রাজকুমারীর চোখে জল।

“রাজকুমারী, আমি তিনজনকেই জল থেকে তুলেছিলাম। আমার যা কর্তব্য, তা-ই করেছি।”

“বেঁচে ফিরে আমার নিজেকে বড্ড দোষী মনে হচ্ছে।” পোশাকে লেগে থাকা ধুলো ঝেড়ে নিয়ে নিজের আলুলায়িত চুল ঠিক করল কমলা।

“পৃথিবীতে বাঁচা-মরা সমস্ত নির্ভর করছে একজনের হাতে।”

“আমি ভাগ্যবাদী নই; ঈশ্বরে বিশ্বাসীও নই। পার্থিব জীবন, মানবিকতা এবং ঐহিক জগতের উপর আস্থাশীল আমি।”

“রাজকুমারী, আমি মুখ্যু সহিস মাত্র। ঘোড়ার আস্তাবলে কেটে গেল আমার কৈশোর আর যৌবনের অনেকগুলো দিন। তাই অতো সব যুক্তি-তর্ক আমি বুঝি না। কিন্তু আপনার ডুবে যাবার মুহূর্তে যা কর্তব্য ছিল, সেই কাজটাই করেছি আমি।”

“আসলে ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে আমরা বড় হয়েছি; তাই ওদের এভাবে মৃত্যু হওয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।” রাজকুমারী চোখ মুছতে মুছতে বলল, “আমি তোমাকে অনেক কটু কথা বলেছি; কিছু মনে কোরো না।”

“না-না, কী আর মনে করব? আমরা সাধারণ প্রজা মাত্র।”

“আমি ফিরে গিয়ে তোমার জন্য একটা ভালো পোশাক আর আমাদের ঘোড়ার চিকিৎসককে পাঠিয়ে দিচ্ছি।” কমলার কণ্ঠে অনুনয়।

“না-না! এ কী! আমার জন্য রাজবাড়ির পোশাকের কী দরকার? আর তাছাড়া ঘোড়ার চিকিৎসাপদ্ধতি আমারও জানা আছে।”

“দ্যাখো কঙ্ক, আমি ছোটবেলা থেকেই পিতার খুব আদুরে সন্তান। আমার কথার অবাধ্য হলে বা আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমি সহ্য করতে পারি না। তোমাকে নিতেই হবে পোশাক।” বেশ জোরের সঙ্গে বলল কমলা। তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কঙ্ক।

॥ ৬ ॥

শঙ্খ নদীর তীরে এক পড়ন্ত বিকেল। কঙ্ক পাড়ে বসে নদীর শোভা দেখছে। অদূরে তার ঘোড়াটি ঘাস চিবোচ্ছে। আরাকান সেনাপতি ভালবেসে এই ঘোড়াটি দিয়েছেন কঙ্ককে। দু’দিন পূর্বে ঘোড়াটি আহত হয়েছিল কমলার ছোড়া বল্লমের খোঁচায়। ঘা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। কমলা-ই ঘোড়ার চিকিৎসার জন্য রাজপরিবারের বৈদ্যকে পাঠিয়েছিল; সেই সঙ্গে তার জন্য নতুনপোশাক। রাজবৈদ্যের সঙ্গে কমলার যে খাস-চাকরানী এসেছিল, সেই বলল, ‘পরশুদিন অপরাহ্নে আপনার সঙ্গে রাজকুমারী দেখা করতে চান শঙ্খ নদীর তীরে।’

আজকেই তার আরাকানে ফিরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু রাজকুমারীর কথা কঙ্ক ফেলতে পারেনি। সে নদীর তীরে বসে ভাবছিল, এই নদীর কী বিচিত্র গতি; কখনও জোয়ার, আবার কখনও ভাটা। মানুষের জীবনটাও নদীর মতো। এই জীবনেও জোয়ার-ভাটা খেলে। আবার নানা আচারের পঙ্কিল-পানা জীবনের গতিকে রুদ্ধ করে; অথচ গতি রুদ্ধ হলেই মৃত্যু।

“অনেকক্ষণ বসে আছ?” কমলার কণ্ঠ শুনে চমকে পিছন ফিরে তাকায় কঙ্ক। আজ কমলাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। কঙ্ক চোখ নামিয়ে নিল রাজকুমারীর দিক থেকে।

“না, এই তো কিছুক্ষণ হল এসেছি। তা আমাকে এখানে ডাকার কারণ?” কঙ্কর চোখে জিজ্ঞাসা।

“তোমার পাশে একটু বসতে পারি?” কমলার কণ্ঠে কীসের যেন একটা আর্তি।

“বসতে আপনি সব জায়গাতেই পারেন; কিন্তু একজন সহিসের পাশে এক রাজকুমারীর আসন হবে—এটা শোভা পায় না। আপনি উঁচুতে বসুন, আমি আপনার পাদদেশে বসছি।” কঙ্কর কণ্ঠে বিনয়।

“এই কথাটা আমাকে জল থেকে তোলার সময় মনে ছিল না?”

“না—আসলে—”

“আমি জাতি-বর্ণ-ধর্ম-পদমর্যদা ইত্যাদি দিয়ে মানুষকে বিচার করি না।” কঙ্কের পাশে কমলা বসল।

“রাজকুমারী, আমি ভীষণ কুণ্ঠা বোধ করছি। কেউ দেখে ফেললে আপনার অসম্মান ঘটবে।”

“কুন্ঠার কিছু তো নেই। আমার সম্মান-অসম্মান নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।”

“আপনি কেন ডেকেছেন আমাকে?”

“কোথা থেকে শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না। আসলে পৃথিবীর সব সমাজেই নারীর স্থান পুরুষের নীচে। অথচ নারী না থাকলে পুরুষ একা একা বাঁচত কী করে বলতে পারো? কীভাবে সমাজ-সংসার গড়ে উঠত? তোমরা-পুরুষেরা এই কথাটা মানতে চাও না। নারীকে সংসারের ভেতরে আটকে রাখতে চাও।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল কমলা।

“হঠাৎ এরকম কথা বলছেন কেন?”

“বলছি কারণ আমাদের একটা মন আছে; আমাদেরও একটা স্বাধীন অভিমত আছে—সেটা তোমরা বুঝতে চাও না।”

“আপনাদের পারিবারিক কোনও সমস্যা …”

“সেটাই তো বলবার চেষ্টা করছি। তুমি বোধহয় জানো মগরাজপরিবারে একটা প্রথা আছে—নিজেদের পরিবারের ভেতরেই কন্যার বিয়ে দেওয়া হয়।”

“তাই নাকি!”

“হ্যাঁ; আর এই প্রথা অনুযায়ী আমাকে জোর করা হচ্ছে আমার কাকার ছেলেকে বিয়ে করার জন্য—”

“সে কী?”

“এতকাল যাকে আমি বড়ভাই হিসেবে জেনে এসেছি, তাকেই বিয়ে করতে বলা হচ্ছে আমাকে! তুমি বলো তো—এর থেকে অসম্মানের আর কী আছে?”

“তাহলে উপায়?”

“আমি কোনওদিন পিতা-মাতার অবাধ্য হইনি, কিন্তু আজ পিতার এই একটা বিষয়ে বিরোধ বেধেছে। না-না, আমি কিছুতেই এই পাপ করতে পারব না—কঙ্ক তুমি আমায় বিয়ে করবে?” কমলার কণ্ঠে প্রবল আকুতি।

মুহূর্তে কঙ্কের হৃৎপিণ্ড ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠল। শিরায় শিরায় রক্তপ্রবাহের মাত্রা গেল বেড়ে। তখন অস্তায়মান সূর্যের রশ্মি গলিত সোনা ঢেলে দিচ্ছে নদীর অগভীর জলতলে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে বয়ে চলেছে নদী। পাশের কেয়াঝোপের ফুটন্ত ফুলের সুগন্ধ ভেসে আসছে।

“না—এ অসম্ভব।”

“কেন অসম্ভব?” কমলার কণ্ঠে ব্যগ্রতা।

“আমি সামান্য একজন সহিস।”

“আজ সহিস, কাল তুমি আরাকানের সেনাবাহিনিতে যোগদান করবে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর বাহুবল থাকলে সেনাপতির আসন লাভ করতেও তোমার সময় লাগবে না। আমি তোমাকে সর্বদা সাহস জুগিয়ে যাব—কঙ্ক।”

“আ—আমার ভয় করছে; গলা শুকিয়ে যাচ্ছে…”

“কঙ্ক, আমাকে বাঁচাও; আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি।” কমলা জড়িয়ে ধরল কঙ্ককে। তারপর আদরে আদরে ভরিয়ে দিল কঙ্কর চোখ-মুখ-কপাল ও কপোল।

॥ ৭ ॥

দিনকয়েক হল শাহ সুজা শঙ্খনদীর তীরে তাঁর অস্থায়ী শিবির গড়েছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন পরিবার-পরিজন, সেনাপতি, পরামর্শদাতা এবং সেনাবাহিনী। হাতি-ঘোড়া তো আছেই; আর আছে ধনরত্ন বোঝাই উট। রাজা ছাথো সংবাদ পেয়ে এলেন ছুটে। হাজার হলেও বাংলাদেশের শাসনকর্তা; এবং বলা যায় না, পাশার দান উলটে গেলে ভবিষ্যতে মোগল সাম্রাজ্যের অধিপতিও হতে পারেন শাহ সুজা। তাই আদর-যত্ন আর খাই-খাতিরের খামতি যেন না থাকে, সেদিকে ছাথোর সজাগ দৃষ্টি।

পরেরদিন শিবির তুলে আরাকানের দিকে রওনা দেবেন সুজা; শিবিরে তাই ব্যস্ততার শেষ নেই। বিকেলবেলা ছাথো নিজে এসে সুজাকে মখমলে মোড়া রঙিন জরিতে মোড়া বড়বড় ডালায় ধনরত্ন সাজিয়ে উপহার দিলেন। কোনওটায় সোনা; কোনওটাতে হিরে-মণি-জহরত। ঝলমলে পোশাক পরা সুন্দরী বাঁদিরা সেইসব উপঢৌকন হাতে দাঁড়িয়ে আছে সুজার ছাউনির ভেতরে।

“হুজুরে আলী, এই বাঁদিদেরকেও উপহার দিলাম,” ছাথো বললেন।

“কিন্তু রাজা, আমি নিজেই তো যাযাবর। কি করব এসব নিয়ে?”

“আপনি আমাদের পর ভাববেন না—”

“সে তো আপনাদের আতিথেয়তা দেখেই বুঝতে পারছি।”

“আরেকটা অমূল্য উপহার আপনাকে দেব; আমার রাজ্যের সবচেয়ে কিমতি জেনানা।”

“সে কী? আমার স্ত্রী-কন্যা-আছে—”

“এই উপহার আপনাকে নিতে হবে। এখন আপনি তাকে শাদী করবেন কি বাঁদি করে রাখবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। এই কে আছিস ওকে নিয়ে আয়।” ছাথোর নির্দেশে কালো বোরখাপরা এক নারীকে এনে দাঁড় করানো হল শাহ সুজার সামনে।

“আচ্ছা আমি এখন যাই। আরাকান থেকে যদি এদিকে ফিরে আসেন তবে আমার এই ছোট্ট রাজ্যে পদার্পন করবেন।” ছাথো বললেন। তারপরে দু’জনে দু’জনকে আলিঙ্গন করলেন। শাহ সুজা বললেন, “আমি কোনওদিন আপনার এই আতিথ্য ভুলতে পারব না।”

ছাথো আর দেরি করে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলেন সুজার ছাউনি থেকে।

সুজার নির্দেশে পরীবানু আর তাঁর বিশ্বাসী দু’জন পরিচারিকা এসে মূল্যবান সামগ্রী তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখলেন।

“পরীবাঈ, এই জেনানার বোরখটা সরাও তো। রাজা ছাথো আমাকে উপহার হিসেবে দিয়ে গেলেন।” সুজা বললেন।

সুজার নির্দেশে পরীবানু ওই নারীর বোরখা সরালেন; বোরখার আড়াল থেকে হাত ও মুখবাঁধা অবস্থায় বেরিয়ে এল রাজকুমারী কমলা। তার চুল আলুলায়িত; চোখ দিয়ে অনর্গল জল গড়িয়ে পড়ছে। পরী তার হাত-মুখ বন্ধনমুক্ত করল।

“কে তুমি?” সুজা জিজ্ঞেস করলেন মোলায়েম কণ্ঠে।

“আমি কমলা; দুর্ভাগ্যজনক ভাবে রাজা ছাথোর কন্যা।”

“কী?! অবিশ্বাস্য!” রাজার চোখে সংশয়। শেষে উপঢৌকন নিয়ে আসা বাঁদিদের একজন সুজার সন্দেহের নিরসন ঘটাল।

“আমি ঠিকই বলেছি। পিতার অবাধ্যতার শাস্তি স্বরূপ আমার এই পরিণতি। তিনি আমাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন; কিন্তু মন্ত্রীর পরামর্শে শেষ পর্যন্ত না পুড়িয়ে আপনাকে উপঢৌকন দিলেন।”

“ফুলের মতো একটা মেয়ের এই অবস্থা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। তুমি আমার মেয়ের বয়সী। নির্দ্বিধায় সব খুলে বলো তো মা।”

সুজার স্নেহপূর্ণ কথায় একেবারে ভেঙে পড়ল কমলা। পারিবারিক দ্বন্দ্বের ঘটনা সে ব্যক্ত করল সুজার কাছে।

“তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?”

“হ্যাঁ।”

“কে সে?”

“কঙ্ক।”

“নামটা কোথায় শুনেছি বলে মনে হচ্ছে …!”

“হ্যাঁ। আওরঙ্গজেবের ষড়যন্ত্রের খবর আপনাকে দিয়েছিল যে যুবক।”

“ওঃ হ্যাঁ—চিনেছি চিনেছি। ভীষণ ভালো ছেলে। তা তুমি কি ওর কাছে যাবে?”

“কীভাবে যাব? আমার পিতা কঙ্ককে মেরে ভাসিয়ে দিয়েছে চাছরদীঘির জলে।” কমলার কণ্ঠ ভাবলেশহীন।

কয়েক মুহূর্ত কথা সরে না সুজার মুখে। ছাউনির ভেতরে বিরাজ করে অখন্ড নীরবতা। মুহূর্তকাল পরে সুজা জিজ্ঞেস করলেন, “কঙ্ককে কেন হত্যা করলেন তোমার পিতা?”

“আমার সঙ্গে ওর ভালোবাসার সম্পর্কের কথা জানতে পেরেই হত্যা করেছে। কিন্তু কঙ্কর কোনও দোষ ছিল না…।”

“তা তুমি এখন কী করবে?”

“আমি আপনার বাঁদি; এখন আপনিই ঠিক করুন আমাকে নিয়ে কী করবেন?”

“আমার মতো যাযাবরের সঙ্গে থেকে তুমি কীই বা করবে? তুমি মুক্ত। তুমি স্বাধীন।”

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ; আসলে পার্থিব ভোগ-সুখের আকাঙ্ক্ষা আমি হারিয়ে ফেলেছি। তাহলে আমি কি যেতে পারি?”

“সানন্দে। প্রহরীরা তোমাকে পৌঁছে দেবে।”

“না; তার আর দরকার হবে না,” সুজাকে বাও করে ছাউনি থেকে বেরিয়ে কমলা ধীরপদক্ষেপে চলে গেল দৃষ্টিপথের বাইরে। সুজার বুক চিরে বেরিয়ে এল একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস।

॥ ৮ ॥

বৌদ্ধ কেয়াং-এ অপরাহ্নকালীন উপাসনা সেরে সবেমাত্র উঠে দাঁড়ালেন ভিক্ষু-ভিক্ষুনীরা। মুণ্ডিত মস্তক ও চীরবসন পরিহিতা এক ভিক্ষুনী উঠে এসে লাল ঠাকুরের মুখোমুখি হলেন।

“কমলা, তুমি কিছু বলবে?” লাল ঠাকুর বললেন।

“প্রভু, এবারে আমায় যাবার সম্মতি দিন; এই মুহূর্তেই আমি রওনা দেব।”

“আজই যাবে?”

“হ্যাঁ, আর দেরি করব না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।”

তাদের ভেতরে যখন এই রকম আলোচনা চলছে, ঠিক তখন আলুথালু বেশে প্রবেশ করলেন কমলার গর্ভধারিনী জননী। তারপর ভিক্ষুদের জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায়, আমার মেয়ে কমলা কোথায়?”

ভিক্ষুরা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

“মা কমলা; তুমি প্রবজ্যা নিয়েছ? তাহলে আমি বাঁচব কাকে নিয়ে?” রানি জিজ্ঞেস করলেন।

“জানি, জননীর থেকে প্রিয় বস্তু পৃথিবীতে নেই; তাঁর ঋণও জীবনে শোধ করা যায় না। কিন্তু আমি নিরুপায় মা। আমাকে যে যেতেই হবে জগতের কল্যানে বৌদ্ধধর্মের প্রচারের জন্য।” কমলার চোখে-মুখে দৃঢ় প্রত্যয়।

“তোমার পিতা শয্যা নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে একটি বার দেখা করবে না? তোমাকে শাহ সুজার হাতে তুলে দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত জলটুকু পান করেননি।”

“এই মুহূর্তে আমি ভগবানের উদ্দেশে নিবেদিত প্রাণ। আর পিছন ফিরে তাকানো সম্ভব নয় মা।”

“তোমার পিতা নিজের সিদ্ধান্ত বদলেছেন; তুমি স্বাধীন। যা ইচ্ছে করতে পারো। কেউ বাধা দেবে না।”

“না, মা। এতকাল যাকে যাকে জড়িয়ে ধরেছি, তারাই চলে গিয়েছে আমাকে ছেড়ে। তাই জাগতিক ভোগ-সুখের সমস্ত দরোজা আমি বন্ধ করে দিয়েছি। এখন একটু শান্তির জন্য এই কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনার পথকেই বেছে নিলাম; ভগবান বুদ্ধ আমাকে মার্গ দেখাবেন। তোমরা ভালো থেকো মা।”

এই বলে হাতে একটিমাত্র লাঠি সম্বল করে পথে নামল কমলা। আর তার অভাগী-জননী মুখে আঁচল দিয়ে কন্যার যাত্রাপথের দিকে নির্নিমেষে চেয়ে রইলেন। তারপর কমলা আলোকবিন্দুর মতো দিগন্তে মিলিয়ে গেলে ভগবান বুদ্ধের প্রস্তরমূর্তির পায়ে পড়ে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন রানি।

.

দেবদুলাল কুণ্ডু

জন্ম ১৯৭৪। শিক্ষাগত যোগ্যতা বাংলায় এম.এ, বি.এড। পেশায় শিক্ষক। আকৈশোর সাহিত্যপ্রেম। ছাত্রজীবনে কবিতা ও প্রবন্ধ দিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত। ২০০৯ সালে ছোটদের সাহিত্য পত্রিকা ‘দোলনা’র সম্পাদনা শুরু। ওই বছরেই “গণশক্তি” সংবাদপত্রে প্রথম গল্পের প্রকাশ। তারপর থেকে ছোট ও বড়দের জন্য সমানে গল্প-ছড়া-কবিতা লিখে চলেছেন। “দেশ”, “আনন্দবাজার পত্রিকা”, “আনন্দমেলা” “সন্দেশ”, “শুকতারা”, “কিশোর ভারতী”, “সাপ্তাহিক বর্তমান”, “চিরসবুজ লেখা” প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। ২০১৬ সালে শিশুসাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ছোটদের গল্পসংকলন ‘হাতু ও বাঘা’।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন