এক ঐতিহাসিক আত্মবলিদান – অনন্যা দাশ

বিশ্বরূপ মজুমদার

রাজপ্রাসাদের জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা আবছা চাঁদের আলোতে রতন সিংহ নিজের সদ্য বিবাহিতা ঘুমন্ত স্ত্রী’র মুখটা দেখছিলেন। রুপালি আলোতে সালেহ কনভরকে মনে হচ্ছে যেন কোনও অপ্সরা। রতন সিংহ মনে মনে ভাবলেন ওর কপালের টিপ, হাতের মেহেন্দি আর মাথার সিঁদুর না থাকলে তিনি হয়তো ভাবতেন স্বর্গ থেকে কোনও অপ্সরা নেমে এসেছে তাঁর ঘরে। বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল কিন্তু এই ক’দিন পরও তাঁর বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয় যে এইরকম একজন অসামান্য রূপসী ও গুণী একজনকে তিনি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, ‘গত জন্মে আমি নিশ্চয়ই অনেক পুণ্য করেছিলাম তাই সালেহকে স্ত্রী রূপে পেয়েছি। নাহলে আমি, রাওয়ত রতন সিংহ চুড়াবত, মেবারের সলুম্বরের মতন একটা ছোট জায়গার অধিপতি মাত্র, আমার ভাগ্যে বুঁদির রাজার কন্যা অসামান্য এই চাঁদের টুকরো এসে পড়েছে। সারা পৃথিবীতে যা কিছু সব চেয়ে সুন্দর সেই সব কিছু একজন নারীর মধ্যে কী করে একত্রিত হল তা ভেবেই আমি অবাক হয়ে যাই প্রতি মুহূর্তে।’ 

আবার রানির মুখের দিকে তাকালেন রতন সিংহ, ফর্সা মুখে টানাটানা চোখ, লাল ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা, মরাল গ্রীবা – নাহ সারা জীবন ধরে এই মুখ দেখেও তিনি ক্লান্ত হবেন না। সারা রাত ধরে প্রেয়সীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফোটার একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়লেন রতন সিংহ। 

সকালে দরজার করাঘাতে ঘুম ভাঙল রতন সিংহের। রানি কক্ষ ছেড়ে কখন উঠে চলে গেছেন টেরও পাননি তিনি। কক্ষে ঢুকতে আজ্ঞা দিতে ওঁর অনুগত পরিচারক এসে ঢুকল, “আমি মোটেও আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি সর্দার কিন্তু মেবারের রাজা রাজ সিংহের তরফ থেকে বার্তা নিয়ে এসেছে এক দূত। বলছে বার্তা নাকি অত্যন্ত জরুরি আর আপনাকে ছাড়া অন্য কারও হাতে দেওয়ার হুকুম নেই। আমি তাই আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে বাধ্য হলাম।”

রতন সিংহ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন, “ঠিক আছে, দূতকে অপেক্ষা করতে বলো আমি এখুনি আসছি। রাজ সিংহ কী বলেছেন জানতে আমিও আগ্রহী। অবশ্য এমনও হতে পারে আমার বিয়ের জন্যে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন!”

অনুগত বয়স্ক পরিচারকের উদ্বিগ্ন মুখে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না, সে শুধু বলল, “ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা তাই যেন হয় সর্দার, তাই যেন হয়।”

কয়েকজন পরিচারকের সাহায্যে রাজ পোশাক পরে রাজ সিংহের পাঠানো দূতের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন রতন সিংহ। অভিবাদন করে রাজ সিংহের লেখা বার্তা ওঁর হাতে তুলে দিল দূত। 
 

রাজ সিংহের বার্তা পড়ে রতন সিংহের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। মেবারের শাসক আদেশ লিখেছেন ‘রাওয়ত রতন সিংহ চুড়াবত, মেবারের আকাশে যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে। সব মুঘল শাসকদের মতন আওরঙ্গজেবও মেবারকে নিজের সাম্রাজ্যের অংশ করে নিতে চায়। সে তার বিপুল সেনা বাহিনীকে নিয়ে মেবারের দিকে ধেয়ে আসছে কিন্তু যতদিন মেওয়ারের রাজপুতদের শরীরে এক বিন্দু রক্তও অবশিষ্ট থাকবে আমরা তা হতে দেব না। এই যুদ্ধে আমার তোমাকে বিশেষভাবে প্রয়োজন। এই বার্তা পাওয়া মাত্র তুমি তোমার সেনা বাহিনীকে একত্র করে ফেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে মুঘল সম্রাটের মেবারের দিকে এগিয়ে আসার পথ আটকাও। সে যেন আর একটুও এগিয়ে না যেতে পারে। তুমি বীর, তোমার আর তোমার সেনার সাহস এবং যুদ্ধ করার ক্ষমতার প্রতি আমার প্রবল আস্থা আছে, সেই আস্থার ওপর ভর করেই এই বার্তা তোমাকে পাঠালাম। অবিলম্বে যুদ্ধে বেরিয়ে পড়ো এবং বিজয়ী হও।’

দূতকে কী বললেন রাওয়ত রতন সিংহ চুড়াবত তাঁর নিজেরই মনে নেই। মন আর হৃদয়ে এক গভীর আঁধার নিয়ে নিজের কক্ষে ফিরে এলেন। তিনি রাজপুত, যুদ্ধে যাওয়াটা তাঁর কাছে নতুন কিছু নয় কিন্তু এ যুদ্ধ তো আর যে সে যুদ্ধ নয়, একেবারে বিশাল মুঘল সেনাবাহিনী আর আওরঙ্গজেবের সঙ্গে লড়াই। এই যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পারবেন এমন আশা নেই রতন সিংহের মনে। শুভ পরিণয়ের এখনও এক সপ্তাহও হয়নি, এই অবস্থায় রানিকে ছেড়ে যেতে একেবারেই মন চাইছিল না তাঁর।

কী করবেন তাই ভাবছেন এমন সময় রানি এসে ঢুকলেন কক্ষে। সারা ঘরটা যেন তাঁর উপস্থিতিতে সোনালি আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল।

“কুঁভরসাকে আজ বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কী হয়েছে? কোনও দুঃসংবাদ?”

“এ এমন দুঃসংবাদ যা আমি একেবারেই আশা করিনি। রাজ সিংহের দূত বার্তা নিয়ে এসেছিল। আওরঙ্গজেব তার সেনা নিয়ে মেবারের দিকে এগিয়ে আসছে। রাজ সিং চান আমি আমার সেনাবাহিনীকে নিয়ে গিয়ে তাকে আটকাই। আমাকে তাহলে সেনাবাহিনীকে একত্র হওয়ার আদেশ দিতে হবে আর তারা একত্র হলে যুদ্ধে বেরিয়ে পড়তে হবে।”

রানির মুখের অভিব্যক্তিতে এতটুকু বদল হল না, তিনি বললেন, “ও, তাহলে তো আপনাকে যুদ্ধে যেতে হবে কুঁভরসা, আমি দেখি আপনার বর্ম আর অন্য সব কিছু ঠিকঠাক করি।”

রতন সিংহের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরচ্ছিল না, কোনও রকমে বললেন, “কিন্তু রানি আমাদের বিবাহের এখনও সাতটা দিনও হয়নি। এই যুদ্ধ কত ভয়ানক হতে পারে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ? আমি হয়তো আর ফিরে আসতে পারব না। না, না, এই যুদ্ধে যেতে চাই না আমি! তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে চাই আমি।”

রানির ফর্সা কপালে ভাঁজ পড়ল, “না কুঁভরসা, তা হয় না। আমি রাজপুত কন্যা ও নারী। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি জানি যুদ্ধ কী আর তার পরিণাম কী হতে পারে কিন্তু পরিণামের ভয় আমরা পাই না। এই মুহূর্তে মেবারের আপনাকে দরকার। মেবারে মুঘলদের আধিপত্য হোক এটা আমরা কেউই কোনওদিন চাই না। আপনি রাজপুত বীর, আপনার কর্তব্য এই যুদ্ধে যাওয়া। ঈশ্বরের কৃপা যদি হয় তাহলে আপনি যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ফিরবেন এবং তখন আমি তখন গর্বিত স্ত্রী এবং মেবার-বাসিনী হয়ে আপনাকে বরণ করব। এই যুদ্ধে আপনাকে যেতেই হবে কুঁভরসা।”

“কিন্তু আমার যে খুব ভয় করছে, আমার কিছু হয়ে গেলে তোমার কী হবে? তোমার হাতের মেহেন্দি এখনও টকটকে লাল… এই অবস্থায় তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার মন চাইছে না কিছুতেই…।”

“আমার জন্যে চিন্তা করবেন না কুঁভরসা। আমি আপনার বিজয়ী হয়ে ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করব। আর যে কথা মুখে আনতেও চাই না তাই যদি ঘটে ঈশ্বরের ইচ্ছেতে তাহলে আপনার স্মৃতিটুকুকে সম্বল করেই আমি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। আর যদি শত্রু এই প্রাসাদ পর্যন্ত এগিয়ে আসে তাহলে আমি এই প্রাসাদের সব নারীদের সঙ্গে জৌহর ব্রত পালন করতেও পিছপা হব না। আমরা রাজপুত নারী কুঁভরসা, আমাদের ভয় পেলে চলে না।”

রতন সিংহ অবাক হয়ে স্ত্রী’র দিকে তাকালেন। তাঁর মনে হল শান্ত সৌম্য একটা দ্যুতি ফুটে বেরোচ্ছে তার মুখ থেকে। রানির কথা শুনে তাঁর মনে হতে লাগল, হ্যাঁ, তিনি এই যুদ্ধ থেকে বিজয়ী হয়েই ফিরে আসবেন। এক অজানা শক্তি অভূতপূর্ব বল সঞ্চার করে দিল তাঁর দেহে। তিনি দ্রুত পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সেনাপতিকে যুদ্ধের জন্যে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিলেন। 

রতন সিংহ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রানি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে ফেললেন। নিজের দুঃখ কষ্ট নিজের মনেই রাখতে হবে তাঁকে। কুঁভরসা দেখে ফেললে তিনি দুর্বল হয়ে পড়বেন। ক্ষত্রিয় রাজপুত নারীদের কর্তব্য নিজের স্বামীকে আরও শক্তিশালী করে তোলা, দুর্বল করে ফেলা নয়। চোখের জল মুছে রানি স্বামীর যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে বরণডালা সাজাবার প্রস্তুতি করতে গেলেন।

॥ ২ ॥

সলুম্বরের সেনাবাহিনী একত্রিত হয়ে গেছে। চারিদিকে সাজসাজ রব। অস্ত্র-বর্ম-ঢাল-তলোয়ারের ঝনঝনে চারিদিক মুখর। খবর পাওয়া গেছে যে আওরঙ্গজেবের সেনা সনসন করে প্রবল গতিতে মেবারের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের পরাস্ত করার জন্য রাজপুত সেনা তৈরি। রানির ক্রমাগত প্রোৎসাহনে রতন সিংহও দোটানার মেঘ কাটিয়ে উঠে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। তরুণ যুবক রতন সিংহকে বর্মে সুসজ্জিত করে রানি ভক্তিভরে তাঁর স্বামীকে বরণ করলেন। মনের, হৃদয়ের যত কান্না, যত ব্যথা সব একেবারে অন্তরে চেপে রেখে কারণ সেই কান্নার এতটুকু আভাস পেলেই যে রতন সিংহ আর যুদ্ধে যেতে চাইবেন না। তাঁর সাহস, উৎসাহ এবং স্ফুর্তিতে এতটুকু ভাঁটা পড়লে চলবে না। হাসিমুখে স্বামীকে বিদায় জানালেন রাজপুত বিরাঙ্গনা সালেহ কনবর, যিনি একদা বুঁদির হাড়া বংশের রাজকন্যা ছিলেন আর এখন রতন সিংহের অর্ধাঙ্গিনী। 
 

টগবগে তেজী সাদা ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ ক্ষেত্রের পথে এগিয়ে চললেন বটে রতন সিংহ কিন্তু মনটা তাঁর পড়ে রইল প্রাসাদে রানির সঙ্গে। সেই দিন সারাটা দিন ধরে যেতে যেতে ভাবতে লাগলেন, “এখন সে কী করছে? আমার কথা মনে পড়ছে কী তার? আমি যদি আর না ফিরতে পারি তাহলে তার কী হবে?”

পরের দিন আবার ঘোড়ায় চড়ে যাত্রা। সেদিন যেতে যেতে হঠাৎ রতন সিংহের মনে হল, “ইস, একটা খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। রানির কাছ থেকে তার একান্ত প্রিয় বা আপন কিছু একটা নিয়ে এলে ভালো হত। সেই জিনিসটার দিকে তাকিয়ে আমার এই ভেঙে যাওয়া মনটাকে সান্ত্বনা দেওয়া যেত। কোনও কিছু একটা, হার, বা কানের দুল বা বালা… যেটাকে দেখলেই আমার প্রিয়ার অপরূপ সুন্দর অস্তিত্বের অনুভব হবে।”

কথাটা মাথায় আসতেই তাঁর সঙ্গে আসা বৃদ্ধ পরিচারককে বললেন রতন সিংহ, “শোনো একটা কাজ করো। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি। তুমি একটা তেজি ঘোড়া নিয়ে প্রাসাদে চলে যাও। সেখানে গিয়ে রানিকে বলবে যে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি তাঁর কাছ থেকে কিছু একটা জিনিস চিহ্ন স্বরূপ নিয়ে আসার জন্যে। আমি সেই জিনিস আমার বুকের কাছে ধারণ করে রাখব আর ইচ্ছে হলে সেটার দিকে তাকিয়ে রানির কথা ভাবব। আমি তাঁর জন্যে একটা পত্রে সেটা লিখে দিচ্ছি।”

রতন সিংহ ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে রানিকে পত্রে লিখলেন,

প্রিয়ে,

আমার সংশয় কেটে গেছে। যুদ্ধে আমি যাবই। কিন্তু তাও মনটা ভারি ব্যাকুল হচ্ছে। বারবার তোমার কথা মনে পড়ছে। তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো? তোমার নিজস্ব অভিনব কিছু একটা আমি আমার সঙ্গে করে যুদ্ধে নিয়ে যেতে চাই। যাতে ইচ্ছে হলেই যেন সেটার দিকে তাকিয়ে আমি তোমার কাছে পৌঁছে যাই। আমার পরিচারককে পাঠালাম। তার হাতে আমার জন্যে বিশেষ কিছু একটা দিয়ে দিয়ো। আর প্রার্থনা কোরো আমি যেন যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ফিরি।

শুধু তোমারই,

রতন সিংহ

বৃদ্ধ পরিচারক রতন সিংহের চিঠি নিয়ে প্রাসাদে পৌঁছে রানিকে চিঠিটা দিল। চিঠি পড়ে রানির মনটা দুঃখে ভরে গেল, বললেন, “আমার এই রূপ, এই নশ্বর শরীরটার প্রতি কুঁভরসার প্রেম তাঁকে তাঁর কর্তব্য থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধে বেরিয়ে পড়েও তিনি শুধু আমার কথাই ভাবছেন। ছি ছি… মেবারের কথা না ভেবে, মাতৃভূমির কথা না ভেবে তিনি কিনা আমার এই পোড়া রূপের কথা ভেবে চলেছেন! সারাক্ষণ এই ভাবে আমার কথা ভাবলে তো তিনি একাগ্রচিত্ত হয়ে যুদ্ধ করতে পারবেন না আর যুদ্ধে একাগ্রতার বড় প্রয়োজন। মেবারকে জিততেই হবে। ঠিক আছে তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও আমি আমার পরিচারিকার হাতে থালাতে করে কুঁভরসার জন্যে বিশেষ চিহ্ন পাঠিয়ে দিচ্ছি। আশা করছি সেই স্মারক চিহ্ন পেয়ে তিনি যুদ্ধে জয়ী হয়েই ফিরবেন।” 

বৃদ্ধ পরিচারক কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বিচক্ষণ রানি আর বেশি কিছু না ভেবে তাঁর প্রিয় পরিচারিকাকে ডেকে তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন। তারপর এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে ধারালো তরবারি দিয়ে এক কোপে নিজের মাথাটা কেটে ফেললেন, পরিচারিকা চোখের জল মুছতে মুছতে মুছতে রানির কাটা মাথাটা রুপোর থালায় সাজিয়ে রেশমি কাপড় দিয়ে ঢেকে বৃদ্ধ পরিচারকের হাতে দিয়ে দিল। 

রতন সিং অধীর আগ্রহে পরিচারকের ফিরে আসার অপেক্ষা করছিলেন। সে কাছে আসতেই তার হাত থেকে থালাটা নিয়ে রেশমি কাপড়টা সরাতেই দেখতে পেলেন থালায় রাখা তাঁর প্রিয় রানির কাটা মাথা। রাগে দুঃখে বিহ্বল হয়ে পড়লেন রতন সিংহ। বৃষ্টির ধারার মতন চোখের জল পড়তে লাগল। 

চোখে জল নিয়ে বৃদ্ধ পরিচারক বলল, “ভেঙে পড়বেন না সর্দার। রানি আপনাকে যা বোঝাতে চাইছিলেন সেটা বুঝুন। আমাকে বললেন কুঁভরসার কাছে মেবারের চেয়ে আমার এই নশ্বর শরীরটা বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে! মাতৃভূমির স্থান সবার ওপরে! হাড়ি রানির এই মহৎ বলিদান, এই মহান আত্মত্যাগ বিফল হতে দেবেন না সর্দার!”

পরিচারকের কথা শুনে রতন সিংহ বুঝতে পারলেন হাড়ি রানি কী বলতে চাইছিল তাঁকে। ঋজু হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। কপালে প্রিয়তমার রক্তের তিলক কেটে, বুকে তার কাটা মাথাটাকে হারের মতন করে ঝুলিয়ে রাওয়ত রতন সিংহ চুড়াবত তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেদিন তাঁর ওই রুদ্র মূর্তি দেখে সবার বুক কেঁপে উঠছিল। সারাদিন ধরে চলল সেই ভয়ানক যুদ্ধ। আকাশ বাতাস চতুর্দিক রাজপুত সেনার গগনভেদী নিনাদে কেঁপে উঠল। ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্র এদিক ওদিক উড়ল। শেষমেশ আওরঙ্গজেবের মুঘল সেনা পেরে উঠল না রাজপুতদের বীরত্বের সামনে। তাদের পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ফিরে যেতে হল। মেওয়ারের ওপর বিপদের যে মেঘ ঘনিয়ে উঠেছিল সেই মেঘ কেটে গেল।

সূর্য তখন অস্তাচলের পথে। আকাশের সোনালি রঙের দিকে তাকিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়লেন আহত, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত রতন সিংহ। রানিকে ছাড়া বাঁচার কোনও ইচ্ছে তার মনে ছিল না। কোমরের থেকে তলোয়ার বার করে ধীর গতিতে হাঁটু গেড়ে বসে পরে নিজের প্রিয়তমাকে স্মরণ করে বিড়বিড় করে বললেন, “আমি পেরেছি রানি, আমি পেরেছি। তোমার মতন বীর একজন স্ত্রী’র স্বামী যে কাপুরুষ ছিল সেটা আর কেউ বলতে পারবে না। মুঘল সেনাবাহিনী হার স্বীকার করে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেছে। মেওয়ারের আর কোনও বিপদ নেই! এবার আমি আসছি আবার তোমার সঙ্গে মিলিত হতে। আমাকে তোমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকার কোনও অর্থই নেই।” 
 

এই বলে তলোয়ারের এক কোপে নিজেই নিজের মাথা কেটে ফেললেন, ঠিক যেভাবে কেটেছিলেন তাঁর প্রিয় রানি। রক্তে ভেসে গেল চারপাশ। ততক্ষণে আঁধার নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে কিন্তু লক্ষ তারার আলোয় আকাশে মিলন হল দুই বীর প্রেমিক যুগলের। 

কথায় বলে কাপুরুষরা রোজ প্রতিনিয়ত মরে আর যারা বীর তারা অমর, তাদের কোনওদিনও মৃত্যু হয় না। হাড়া বংশের বীরাঙ্গনা হাড়ি রানিকে নিয়ে অনেক কবিতা আর অসংখ্য গান লেখা হয়েছে। সাময়িক ভাবে পথ ভোলা স্বামীকে সঠিক পথে চালিত করার জন্যে, মাতৃভূমির জন্যে, তাঁর ওই চরম আত্মবলিদান মেবার, রাজস্থান ও ইতিহাস কোনওদিন ভোলেনি।

.

অনন্যা দাশ

বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ছোটবেলা কেটেছে জয়পুর শহরে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া নিবাসী এবং পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। ইংরাজি ও হিন্দি ভাষায় সৃজনশীল রচনার সঙ্গে বাংলা থেকে অনুবাদও করেন। শিশু-কিশোরদের জন্যে লেখা গল্প এবং উপন্যাস কলকাতার প্রায় সব নামকরা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘ইন্দ্রজালের নেপথ্যে’, ‘মার্কিন মুলুকে নিরুদ্দেশ’, ‘রুজভেল্টের পাণ্ডুলিপি’, ‘ফুলের দেশের বিভীষিকা’, ‘হিরের চেয়ে দামি’, ‘মৎসকন্যার অভিশাপ’, ত্রি-তীর্থঙ্করের অন্তর্ধান’, ‘উত্তরাধিকার এবং’ তাঁর বিখ্যাত কিছু বই।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন