শিকার অভিলাষী এক রাজা – দেবব্রত দাশ

বিশ্বরূপ মজুমদার

দেবায়ন দাশের মেজাজটা আজ ফুরফুরে। বহুবছর পর তিনি এসেছেন তাঁর গ্রামে, যেখানে কেটেছে শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলি। তারপর… পড়াশোনা কলকাতার কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে হলেও ছুটিছাটায় গিয়েছেন এই গ্রামে নিজেদের কোয়ার্টারে মা-বাবার কাছে। সরকারি চাকরিতে হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়ালেও শিকড়ের টানে বারবার ফিরে এসেছেন।

অবসরের পর থিতু হয়েছেন কলকাতার এক আবাসনের ফ্ল্যাটে, যা তিনি কিনেছিলেন কেরিয়ারের মাঝপথেই… স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে দিয়েছিলেন মাথাগোঁজার এক স্থায়ী বাসস্থান। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার বছরখানেক আগে প্রথমে বাবা আর তারপর দু’মাসের মধ্যেই মা-ও চলে গিয়েছেন না-ফেরার দেশে। স্বাভাবিকভাবে তখনই শিকড়ের টান আলগা হয়ে গিয়েছে। এই যে এসেছেন… অবসর নেওয়ার ছ’বছর পরে… তার মানে প্রায় সাত বছর পার করে আবার নিজের রঙিন শৈশব-কৈশোরের সেই গাঁয়ে, যদিও এখন… এখন কেন, অনেকদিন আগে থেকেই… সেই গাঁ আর গ্রামগঞ্জ নয়, তার সর্বাঙ্গজুড়ে শহুরে চাকচিক্য… নতুন নতুন পাকাবাড়ি, সাজানো-গোছানো দোকানপাটের পাশাপাশি সুদৃশ্য বিউটি পার্লার… ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট! এবার তো এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে, চিনতেই পারছিলেন না দেবায়ন তাঁর এতকালের চেনা জায়গাটাকে!

সঙ্গে এসেছে ছেলে, বউমা আর আদরের পঞ্চদশী নাতনি রুহিকা। দেবায়নের বাবা এই গ্রামের কলেজে অধ্যাপনার সূত্রে যে কোয়ার্টার পেয়েছিলেন, মা গত হওয়ার পর সে-কোয়ার্টার স্বাভাবিক নিয়মেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রথমবার নিজের জায়গায় এসেও উঠেছেন গেস্টহাউসে। সব ব্যবস্থা করেছে আর এক ভূমিপুত্র সুজিত ভৌমিক, যে পেশায় এক নামি নিউজ চ্যানেলের জনপ্রিয় সাংবাদিক। দেবায়নের চেয়ে বছর দশেকের ছোট হয়েও বন্ধুত্বের নিগূঢ় সম্পর্কে সে আবদ্ধ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। রুহিকার পছন্দের তালিকায় সুজিতের স্থান একেবারে প্রথম দিকে, কলকাতার ফ্ল্যাটে এলে সে তার ‘সুজিত আঙ্কল’-এর সঙ্গে জোট বেঁধে থাকে সর্বক্ষণ আর কিছুতেই বাড়ি ফিরে যেতে দিতে চায় না।

ইতিহাস নিয়ে পড়তে চায় রুহিকা। কলেজ-ইউনিভার্সিটির গণ্ডি পেরিয়ে গবেষণায় আগ্রহী। তার এই ভাবনায় নিরন্তর ইন্ধন যোগায় সুজিত। সে বলে, “ইতিহাস নিয়ে পড়ে অনার্স গ্রাজুয়েট… এমনকি মাস্টার ডিগ্রি করলেও এক শ্রেণির মানুষের নাক কুঁচকে থাকে, যেন বলতে চায় — ইতিহাস মানেই সাল-তারিখের পঞ্জিকা। আসলে, ব্যাপারটা তো আদৌ তা নয়। সব সাবজেক্টের ক্ষেত্রেই আছে ইতিহাস… চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস নেই? ইতিহাস নেই কি বিশ্বের যে কোনও দেশের ভাষা কিংবা সাহিত্যের? সমস্ত বিষয়েরই ইতিহাস আছে। অতীত ইতিহাস মানুষকে সামনের দিকে মানে ভবিষ্যতের সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে। কাজেই, তুই কিন্তু রুহি কারও বিরূপ মন্তব্যে কখনওই হীনমন্যতায় ভুগবি না… আমি আছি তোর পাশে।”

সুজিত রুহিকাকে নিয়ে এসেছে মহিষাদলের রাজবাড়ি-পরিদর্শনে, যেখানে আছে সংগ্রহশালা এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বহু বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন।

সমুদ্র তীরবর্তী তাম্রলিপ্ত বন্দরে যখন রমরমিয়ে বাণিজ্য চলছে, তখনও খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের শুরু অবধি মহিষাদল ছিল সমুদ্রগর্ভে। ওই সময় মানে সপ্তম শতকের শুরুতে চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এসেছিলেন তাম্রলিপ্ত বন্দরে। তাঁর বিবরণ থেকেই এই তথ্য জানা যায়। ধীরে ধীরে পলি জমে চর পড়ে ও জঙ্গল তৈরি হয়ে জনপদ গড়ে ওঠে। ‘মহিষাদল’-এর নামকরণ নিয়ে বহু জনশ্রুতি আছে। কারও মতে সমুদ্রের ভেতর থেকে যখন এই দ্বীপ একটু একটু করে মাথাচাড়া দিয়ে জেগে ওঠে, তখন তার আকৃতি ছিল মহিষের মতো। নাবিকরা এই দ্বীপকে বলত ‘বাফেলো পয়েন্ট’। বাফেলো মানে মহিষের আকারের জন্যেও বলা হতে পারে আবার কেউ কেউ বলেন — নাবিকেরা নাকি বহু বন্যমহিষকে পরস্পরের সঙ্গে মারামারি করতে দেখেই এই নাম দিয়েছিল। আবার অন্য জনশ্রুতি অনুযায়ী, মহিষাদলে বসতি গড়ে ওঠার প্রথম দিকে নাকি মাহিষ্য জাতের লোকজনের আধিক্য ছিল।

রুহিকা তার দাদানের মুখ থেকে মহিষাদল-সম্পর্কে এত কথা শুনেছে যে সুজিত আঙ্কল যখন মহিষাদলে নিয়ে যেতে চাইল, তখন তার চোখের সামনে মন ভরিয়ে তোলা ছায়া সুনিবিড় এক গাঁয়ের ছবি ভেসে উঠেছিল। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমেই সে বলে উঠেছে, “মহিষাদল নাকি গ্রাম? — এ তো দেখছি বেশ জমজমাট শহর!”

“হ্যাঁ, তাই।” জবাব দিয়েছেন দেবায়ন, “ভোল পালটে ফেলেছে একেবারে! তুই এর আগে বার দুই এসেছিস, আমার মা-বাবা তখন বেঁচেছিলেন। তুই অবশ্য সেসময় খুবই ছোট, বয়েস চার পাঁচ হবে… কিছুই কি মনে নেই তোর?”

“খুব আবছা মনে আছে দাদান,” বলে রুহিকা, “লম্বা সাদা রঙের কোয়ার্টার, পাশে টলটল স্বচ্ছ জলের দিঘি আর দিঘির একপাশজুড়ে সারিসারি ঝাউগাছ ছিল… শুধু এটুকুই মনে আছে দাদান।”

“এবার তো আমরা ওদিকটায় মানে মহিষাদলের ফুলবাগ রাজবাড়ির দিকে এখনও যাইনি, আছি মেচেদা-হলদিয়ার রাস্তার পাশের এই গেস্টহাউসে। এদিকটা আগেও তুলনায় জমজমাট ছিল। আরে — আর একটু পরেই তো আমরা যাব ফুলবাগ প্যালেসে, গেলে দূর থেকেই তুই দেখতে পাবি রুহি — আমাদের সেই কোয়ার্টার, দিঘি আর ঝাউবীথি।”

ব্রেকফাস্ট পথেই কোলাঘাটের কাছে এক ধাবায় সেরে নিয়েছিল ওরা। গেস্টহাউসে এসে চা আর স্ন্যাকস খেয়ে নিয়েছে সাড়ে দশটার মধ্যেই। সুজিত তাগাদা দিয়ে রুহিকাকে বলে, “আরে — এগারোটায় ফুলবাগ প্যালেসে যাব, বলে রেখেছি কেয়ারটেকারকে। তোর বাবা-মাকে তৈরি হয়ে নিতে বল, অলরেডি দেরি হয়ে গেছে।”

“দাঁড়াও আঙ্কল, আমি গিয়ে বলছি।” বলেই পাশের ঘরে ঢুকে গেল সে। তারপর… মিনিট দুয়েকের মধ্যেই হতাশ হয়ে ফিরে এল, পেছন পেছন এল তার মা, “সুজিতদা, রুহির বাবা এখন অনলাইনে অফিসের এক ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং-এর মধ্যে রয়েছে। শিগগির শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আপনি বরং বাবা আর রুহিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। আমরা দু’জন আগামীকাল যাব… অসুবিধে নেই… আছি তো আমরা আরও দু’দিন।”

॥ ২ ॥

মিনিট পনেরোর মধ্যেই তিনজন পৌঁছে গেল ‘ফুলবাগ প্যালেস’-এর তোরণদ্বারে। মরচে ধরা লোহার উপরে পড়েছে নতুন রঙের প্রলেপ। আনুমানিক ১৯৩৪ সালে নির্মিত হয়েছিল এই রাজপ্রাসাদ… এতগুলো বছর পেরিয়েও অমলিন… অটুট! এই তোরণদ্বারের সামনে সামান্য দূরত্বে থাকা ‘হিজলি টাইডাল ক্যানাল’-এর অবস্থা অবশ্য শোচনীয়, সংস্কারের অভাবে হেজে-মজে গিয়েছে একেবারে! একসময়ে হলদি নদী এবং রূপনারায়ণ নদ সংযোগকারী জোয়ারের জলে পুষ্ট এগারো মাইল দীর্ঘ এই ক্যানাল দিয়ে যাতায়াত করত খড়বোঝাই বড় বড় নৌকো… সেসব বন্ধ হয়ে গেছে কবেই… কৈশোরের সেসব দিনের কথা আজও দেবায়নের মনকে উতলা করে দেয় এবং দিচ্ছে এই মুহূর্তেও, “ডান দিকে তাকিয়ে দ্যাখ রুহি — একশো মিটারেরও বেশি লম্বা প্রাচীরের পাশে পামগাছের সারি… শেষে প্যালেসের দক্ষিণ তোরণদ্বার, যেখান দিয়ে ঢুকলেই আমাদের সেই সাদা রঙের কোয়ার্টার… দেখতে পাচ্ছিস কোয়ার্টার আর তার ঠিক দক্ষিণে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত টলটলে জলের দিঘি?”

“হ্যাঁ দেখছি তো… ফেরার সময় ওখানেও যাব দাদান, কাছ থেকে দেখব।” রুহিকার কণ্ঠস্বরে বিস্ময়, “যাবে না তুমি!”

“অবশ্যই যাব। এত বছর পরে এসেছি, যাব না মানে!” পালটা বিস্ময় প্রকাশ করেন দেবায়ন। উত্তেজিত তিনি, কারণ, তাঁর আদরের নাতনিকে ইতিহাসের সামনে উপস্থিত করবেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই, “চল এগিয়ে যাই, সামনে গিয়ে ডান দিকে।”

মোরাম-বিছানো পথের দু’ধারে দেশি-বিদেশি ফুলগাছের সারি। রঙিন ফুল-দলে বিচরণরত রঙিন প্রজাপতি আর কালো ভ্রমরের মতোই রুহিকা যেন পাখা মেলে দিয়ে উড়ে চলে। তার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে হিমসিম খান দেবায়ন, “এত তাড়াহুড়ো করিস না, হোঁচট খেয়ে পড়বি রুহি। আরে — দাঁড়া এখানে… এই দ্যাখ পুরোনো আমলের কামান আর তার পাশে যাঁর মর্মর-মূর্তি দেখছিস, তিনি হলেন গিয়ে রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ, যিনি এই ‘ফুলবাগ প্যালেস’ তৈরি করিয়েছিলেন।”

সুজিত গাড়ি থেকে নেমেই বলেছিল, “দাদা, তুমি রুহিকে নিয়ে ধীরেসুস্থে এসো, আমি চটজলদি গিয়ে কেয়ারটেকার শক্তি আচার্যর সঙ্গে দেখা করছি।”

সুজিত শক্তিকে নিয়ে একতলার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল, “চলো দাদা রিসেপশন-রুমে… একটু বিশ্রাম নিয়ে এক এক করে সব দেখাবে রুহিকে।”

“বিশ্রাম নেব কেন!” ভুরু কোঁচকান দেবায়ন।

“একতলার বারান্দায় উঠতেই কতগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হবে দেখেছ… এখন কি তুমি আর কিশোর বেলায় আছ দাদা!”

“তা যা বলেছ সুজিত, কৈশোরের মনটা আছে, কিন্তু শরীরের বয়েস বেড়েছে।” মৃদু হেসে জবাব দেন দেবায়ন।

রিসেপশন-রুমে না-বসেই এগিয়ে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই শক্তি বলে ওঠে, “একটু কফি বা চা খেয়ে নিন। আমি দুটোই আনিয়ে রেখেছি।”

বাধ্য হয়ে বসলেন দেবায়ন। রুহিকার উদ্দেশে বললেন, “শোন রুহি, ভালোই হল… মিনিট দশেকের মধ্যেই কফি খেতে খেতে তোকে আমি মহিষাদলের রাজ-পরিবার সম্পর্কে ব্রিফিং করে দিতে পারব। তারপর চাক্ষুষ দেখবি যখন সংগ্রহশালা, তখন আমি বলার আগেই সব বুঝে যাবি।”

“হ্যাঁ দাদান, তুমি এর আগে ছাড়া-ছাড়া ভাবে বলেছ অনেক কথাই, কিন্তু এখানে এই ‘ফুলবাগ প্যালেস’-এ বসে তোমার মুখ থেকে শোনার মধ্যে দারুণ রোমাঞ্চ আছে… মনে হবে, শতাব্দীপারের আঙিনায় প্রবেশ করেছি আমি!”

চা-কফি আসার আগেই শুরু করেন দেবায়ন, “শোন তাহলে এবার, ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আনুমানিক ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশ থেকে ব্যবসাবাণিজ্যের অভিপ্রায়ে মেদিনীপুরের গেঁওখালিতে আসেন জনার্দন উপাধ্যায়। গেঁওখালির তখন নাম ছিল জীবনখালি। এর আগে জনার্দন উপাধ্যায় ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মচারী। সেসময় মহিষাদলের জমিদার তথা রাজা ছিলেন তমলুকের রাজপরিবারের বীরনারায়ণ রায়চৌধুরীর বংশধর কল্যাণ রায়চৌধুরী। নবাব সরকারের কাছে কর জমা দিতে না-পারায় তাঁর জমিদারি নিলামে ওঠে। জনার্দন উপাধ্যায় বকেয়া কর জমা দিয়ে সেই নিলামী জমিদারি কেনেন। সম্রাট আকবরের স্বীকৃতি ও সনদ লাভ করার ফলে তিনি মহিষাদলাধিপতির মর্যাদা পান। সেই সঙ্গে উপহার হিসেবে পান সম্রাট হুমায়ুনের বিশেষ বন্ধু, বিশ্বস্ত রক্ষক ও আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁর নামাঙ্কিত সুদৃশ্য এক তরবারি এবং সেই থেকে নতুন অধ্যায়ের শুরু। জনার্দন উপাধ্যায়ই হলেন মহিষাদলের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।

জনার্দন উপাধ্যায়ের বংশের পঞ্চম পুরুষ আনন্দগোপাল উপাধ্যায় অপুত্রক হওয়ায় তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী জানকী দেবী দক্ষ হাতে রাজ্যপাট পরিচালনা করেন এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে অন্য কারও হাতে বংশ তুলে না-দিয়ে কন্যা মন্থরা দেবী ও জামাতা ছক্কনপ্রসাদ গর্গের পুত্র গুরুপ্রসাদ গর্গকে হেবা (ইসলাম মতে সম্পত্তি দান) করে দেন রাজসম্পত্তি ও রাজপ্রাসাদ। হেবা-সূত্রে রাজা হন গুরুপ্রসাদ গর্গ এবং সেই থেকে মহিষাদলের রাজবংশে গর্গ-পরিবারের অভ্যুত্থান।

রানি জানকীদেবী দানধ্যান ও বহু জনহিতকর কাজ করেন। মহিষাদল এস্টেটের মধ্যে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মদনগোপাল জিউ’-এর মন্দির। শোনা যায়, নবরত্নশৈলিতে তৈরি এই মন্দিরের কারুকার্যে মুগ্ধ হয়েই বহু বছর পরে নকশার পুনরাবৃত্তির ফলেই নির্মিত হয়েছে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির। আজ অবশ্য আমরা সেখানে যেতে পারব না রে রুহি, তুই চাইলে কাল যাওয়া যাবে। এবার চল যাই… এই রাজবাড়িতে দেখার এত কিছু আছে যে, সারাটাদিন কাবার হয়ে যাবে… ওঠ ওঠ…” কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ান দেবায়ন, “চল, এবার দেখতে দেখতে বলব।”

॥ ৩ ॥

“প্রথমে আমরা কী দেখব দাদান?”

“একতলা জুড়ে সংগ্রহশালা। পরপর সব ঘর…” দেবায়ন জবাব দেন, “প্রথমেই ঢুকব ‘দরবার-হল’-এ… সুজিত তাই তো? এত বছর পরে এসেছি… অদলবদল হয়নি তো কোনও?”

“না দাদা, হলেও সামান্য এদিক-ওদিক হতে পারে… তুমি যা যা দেখেছ, তোমার কৈশোরে, সবই আছে। বরং টিকিটের বিনিময়ে সংগ্রহশালা দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে বলে আগের তুলনায় অনেক বেশি সাজানো-গোছানো… মানে পেশাদারিত্বের ছাপ দেখতে পাবে তুমি সর্বত্র।”

“এই যে জনসাধারণের জন্যে খুলে দেওয়া হল একসময়ের অতি রক্ষণশীল রাজপরিবারের অন্দরমহলের অনেকটাই, সেটা হল কবে থেকে?”

“২০১২-সালের ৩০-এ জুলাই তখনকার তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী উদ্বোধন করেন এই সংগ্রহশালা।” বলল সুজিত, “এখানে রয়েছে দরবার কক্ষ, অস্ত্র কক্ষ, শিকার কক্ষ, শয়ন কক্ষ, খেলার ঘর এবং পুস্তক কক্ষ… এই এখন যে ঘরে আমরা ঢুকলাম, সেটা হল গিয়ে দরবার কক্ষ।”

তারপর সুজিত রুহিকার উদ্দেশে বলে ওঠে, “দুই প্রান্তের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ তুই, বেলজিয়াম কাঁচের তৈরি বিশাল দুটো ড্রেসিং টেবিল… দেখেছিস? আর ওই দ্যাখ — সিলিং থেকে ঝুলছে কী সুন্দর সব ঝাড়বাতি! আর… আর…এই এদিকে রয়েছে রাজাদের মূর্তি, অয়েল পেইন্টিং… ওদিকে একগাদা চিঠিপত্র আর রাজপরিবারের ব্যবহৃত নানান সামগ্রী… দেখতে থাক এক এক করে।”

“রুহি, এক কাজ কর,” হঠাৎ চঞ্চল হয়ে বলে ওঠেন দেবায়ন, “এর পরেই তোকে নিয়ে যাব শিকার কক্ষে… তুই অবাক হয়ে যাবি দেখলে… বুঝেছিস?”

“এমন কী আছে ওই ঘরে দাদান? শিকার করা বাঘ-ভালুকের স্টাফড বডি, তুমি তো সেকথাই বলেছিলে আমায়!”

“হ্যাঁ, বলেছিলাম। সেগুলো তো দেখবিই তুই, তার সঙ্গে শুনবি রোমহর্ষক শিকার-কাহিনি… সত্যিকারের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা।”

“কে শোনাবে দাদান?” রুহিকার কণ্ঠস্বরে একরাশ বিস্ময়।

“শোনাব আমি।” দেবায়ন আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলতে থাকেন, “আমার বয়েস যখন সাত কি আট, তখন এই রাজবংশের শেষ রানিমা কল্যাণী দেবীর মুখ থেকে আমি শুনেছি… আসলে, মাকে উনি খুবই পছন্দ করতেন আর তাই মাঝেমধ্যেই রিকশা পাঠিয়ে আমাদের কোয়ার্টার থেকে ডেকে নিয়ে যেতেন গল্পগাছা করার জন্যে। আমি আবদার করতাম যাওয়ার জন্যে । মা বোঝাতে চেষ্টা করত — মেয়েমহলে মেয়েলি আড্ডায় ছেলেদের থাকা যে মানায় না, সেটা বোঝার চেষ্টা কর… তুই খুব ছোটো নেই এখন দেব! কিন্তু আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা আর সে-কথা কীভাবে যেন রানিমা’র কানে পৌঁছে গিয়েছিল এবং তারপর একদিন উনি খবর পাঠালেন — মা যেন আমাকে নিয়ে যায়।”

“তাই দাদান! তুমি মেয়েমহলে গেলে!”

“আরে, যাওয়ার জন্যেই তো মুখিয়ে ছিলাম…” স্মৃতির সরণিতে প্রবেশ করেন দেবায়ন, “আমায় তখন আর পায় কে! আমাকে প্রথম দিনেই রানিমা নিয়ে গিয়েছিলেন শিকার কক্ষে। তার আগে মা’র মুখ থেকে আমার শোনা হয়ে গিয়েছিল বড় রাজা দেবপ্রসাদ গর্গের অনেক অনেক শিকার-কাহিনি। দেবপ্রসাদ গর্গ মানে কে বুঝলি তো?”

“হ্যাঁ, তুমি বলেছ আগে… কল্যাণী রানিমার হাজব্যান্ড, মহিষাদলের রাজপরিবারের শেষ রাজা।”

“ঠিক। আর কল্যাণী রানিমাও শেষ রানি। দেবপ্রসাদ গর্গ যে শুধু শিকার করতেই পছন্দ করতেন, তাই নয়… অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি।”

“তুমি বলেছ সে-কথাও, শিল্প-রসিক এই মানুষটি ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতে তালিম নিয়ে যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, তাতে ‘আকাশবাণী কলকাতা’-য় খেয়াল গান গাওয়ার জন্যে ডাক পেয়েছেন বহুবার। এই দরবার কক্ষে এসে সঙ্গত করে গিয়েছেন ফৈয়াজ খাঁ এবং বড়ে গুলাম আলির মতন স্বনামধন্য গুণীজন।”

“বাহ্! মনে রেখেছিস তো সব দেখছি! তা — এই সে-দরবার কক্ষ।” দেবায়ন শিকার কক্ষের দিকে যেতে যেতে রুহিকার উদ্দেশে বলেন, “আসার সময় পথের ধারে যে কলেজ আর স্কুল দেখেছিস, দুটোরই প্রতিষ্ঠাতা এই মানুষটি। রাজপরিবারের কীর্তিমান শ্রেষ্ঠ রাজা দেবপ্রসাদ গর্গ।”

“আরিব্বাস… দারুণ!” শিকার কক্ষে ঢুকেই মেঝে আর দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে রুহিকা, “এ তো দেখছি — ছোটখাটো মিউজিয়াম একটা!”

“মিউজিয়ামই তো!” মন্তব্য করেন দেবায়ন, “বিজ্ঞান-সম্মত পদ্ধতিতে মৃত জীবজন্তুর চামড়া, দাঁত, শিং ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হয়েছে।”

“আচ্ছা দাদান, তখন আমাদের দেশে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’ চালু হয়নি?”

“না, হয়নি। ১৯৪৭-এর আগে মানে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে ইংরেজ আমলে শিকারের উপরে কোনও রকম বিধিনিষেধ ছিলই না। ইংরেজরা এবং বড় বড় রাজা-মহারাজারা সেসময় চুটিয়ে শিকার করেছেন।”

“কোন জঙ্গলে শিকার করতেন রাজা দেবপ্রসাদ গর্গ?” প্রশ্ন করে রুহিকা।

“রানিমার মুখ থেকে শোনা কথাগুলো এত এত বছর পরেও ভুলিনি রে আমি। উনি শিকার করতে যেতেন প্রধানত কানহার জঙ্গলে আর নৈনিতাল অঞ্চলে।”

“নৈনিতাল অঞ্চলের জঙ্গল মানে তো ‘জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক’, তাই না দাদান?” রুহিকা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে।

“হ্যাঁ রে — ওই জঙ্গলই হবে, তবে নামকরণ তখনও বোধহয় হয়নি।” বলেন দেবায়ন, “জানিস তো রুহি, কতবার বিপদে পড়েছেন রাজা… একবার তো…” কথা অসমাপ্ত রাখেন তিনি, “একেবারে সেই স্টাফড ভালুকের সামনে গিয়ে যখন তোকে দেখাব, তখন বলব সে-রাতের ঘটনা। এখন এই যে চিতাটা দেখছিস… আমার মনে আছে… রানিমা বলেছিলেন…”

“তুমি উত্তেজিত হয়ে বড্ড তাড়াহুড়ো করছ দাদান! শান্ত হয়ে ধীরেসুস্থে একটা একটা করে বলো, না-হলে তো গুলিয়ে যাবে! তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, এই ঘরে আমরা বহু সময় ধরে দেখব সব, শুনবও তোমার বলা সব কথা। একটাও মিস হবে না।”

“বেশ, যা বলছিলাম… এই যে চিতাটা দেখছিস মেঝেতে দাঁড়ানো, এটা নৈনিতাল অঞ্চলের জঙ্গলে ছিল। চিতা অমনিতেই ভীষণ ধূর্ত, অথচ ভিতু! সরাসরি মানুষকে আক্রমণ করে না সাধারণত, লুকিয়ে আসে এমন ভাবে যে, তাকে যখন দেখতে পাওয়া যায়, তখন আর নিজেকে বাঁচানোর উপায় থাকে না। জানিস নিশ্চয়ই — চিতা সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণী । গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। তা কী হয়েছিল একবার… রাজা শিকার করতেন গাছের উঁচু ডালে বাঁধা মাচায় বসে… তো, যখন উনি নীচে চোখ রেখে বাঘ-ভালুক-চিতা-হরিণ-নীলগাই-শম্বরের জন্যে অপেক্ষা করছেন, তখন হঠাৎই তাঁর পাশে বসা বহু শিকার-অভিযানের বিশ্বস্ত সঙ্গী… নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না… আঁতকে উঠে বলল — সাবধান রাজা বাহাদুর, আপনার ডানদিকের ডালের দিকে তাকিয়ে দেখুন — জ্বলন্ত দুটো চোখ এগিয়ে আসছে ।

দেবপ্রসাদ গর্গ বাহাদুর ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি-সম্পন্ন দক্ষ শিকারী মানে — দারুণ রিফ্লেক্স ছিল আর কি। কালবিলম্ব না-করে তিনি তাঁর ‘ডাবল ব্যারেল গান’ থেকে পরপর গুলি ছুড়লেন। অব্যর্থ নিশানায় গুলি লাগল চিতার মাথায়… গাছের ডাল থেকে নীচে পড়ে নিথর হয়ে গেল তার দেহ।”

“এটাই যে সেই চিতা, তুমি মনে রাখলে কেমন করে দাদান এত এত বছর পরে!” বিস্ময় চেপে রাখতে পারে না রুহিকা, “আর একটা প্রশ্ন :- বাঘ তো গাছে উঠতে পারে না শুনেছি দাদান, তাহলে!”

“চিতা গাছে ওঠার ব্যাপারে ব্যাঘ্রকুলে সবচেয়ে পারদর্শী মানে এফিশিয়েন্ট আর এই যে জানতে চাইছিস — মনে রাখলাম কেমন করে, তার জবাবে বলি — ছোটবেলা থেকেই শার্প মেমরি আমার… এই বয়েসে হয়তো ভুলে যাই সাময়িক, কিন্তু পরে ঠিক মনে করতে পারি। আর কী বল তো? এই মিউজিয়াম আমি এত বার দেখেছি যে, আমার মাথার ‘নিউরন-সেল’-এ গেঁথে আছে সবটা পার্মানেন্টলি।”

“বলো আর যা যা বলবে, বলো দাদান।” রুহিকা দেবায়নের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে, “ভালুক নিয়ে কী যেন বলছিলে তুমি…?”

“হ্যাঁ, আর সামান্য দূরেই রয়েছে… আমি এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি।” বললেন দেবায়ন।

“হ্যাঁ এই তো দেখছি বাঁ দিকের দেয়ালে আটকানো স্টাফড ভালুকের মুণ্ডু একটা…” দেবায়নের চোখে চোখ রাখে রুহিকা, “এই ভালুকটার কথাই কি বলছিলে তুমি দাদান?”

“হ্যাঁ, এটা দুটো ভালুকের একটা। যা ঘটেছিল সেদিন, তাতে ভূমিকা ছিল একজোড়া ভালুকের। অন্যটার মুণ্ডু দেখতে পাচ্ছিস না তুই রুহি? আর সামান্য এগিয়ে যা, এবার তাকিয়ে দ্যাখ… এই যে — এটা হল গিয়ে মেয়ে ভালুক ।”

“এক কাজ করো দাদান,” বলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘরের এককোণে একটা টুল দেখতে পেয়ে চটপট টেনে নিয়ে আসে সে, “এই টুলে বসে তুমি বলো জম্পেশ করে — কী সেই রোমহষর্ক ঘটনা।”

“ঘটনাস্থল ছিল মধ্যপ্রদেশের কানহার জঙ্গল। এত বছর পার করেও রানিমার কণ্ঠস্বর যেন শুনতে পাচ্ছি। সেই কিশোর-বয়েসের আমি চোখ গোল গোল করে শুনছি… কানহার জঙ্গলেও দেবপ্রসাদ গর্গ মাচায় বসে ছিলেন দোনলা বন্দুক মানে ‘ডাবল ব্যারেল গান’ নিয়ে। সঙ্গে ছিল বিশ্বস্ত সেই সঙ্গী… হ্যাঁ, নাম মনে পড়েছে এখন… উমাশঙ্কর দুবে। সারা রাত বসে থাকতে থাকতে যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন রাজা, ভোরের আলো ফুটতে বড়জোর আর ঘণ্টাখানেক দেরি, ঠিক তখনই বেরিয়ে এসেছিল এই পুরুষ ভালুকটা,” বলেই ডানহাতের তর্জনী তুলে রুহির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন দেবায়ন, “ওই মুণ্ডুটার দিকে তাকা, যেটা প্রথমে দেখলি…ওটাই পুরুষ ভালুক। ভালুকটা শুটিং রেঞ্জের মধ্যে আসতেই কালবিলম্ব না-করে রাজা ট্রিগার টিপলেন সঙ্গীর হাতের ছ’ব্যাটারির টর্চ জ্বলে ওঠামাত্র। নিশানায় সামান্যতম ভুলচুক ছিল না। এক গুলিতেই শেষ। কিছু সময় অপেক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে রাজা মাচা থেকে নীচে নামলেন, প্রায় একই সঙ্গে নামল উমাশঙ্করও। ভালুকের বিশাল শরীর পড়ে ছিল নিথর। তবু, সময় নিয়ে মুখ দিয়ে বারকয়েক আওয়াজ করে তবে মৃত ভালুকটার দিকে এগিয়ে গেলেন দেবপ্রসাদ। আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ গর্জন করতে করতে ঝোপঝাড় ভেদ করে তেড়ে এল আর একটা ভালুক। উমাশঙ্করের ভয়ার্ত চিৎকার শুনে পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়িয়েই বন্দুক তুলে ট্রিগার টিপলেন দেবপ্রসাদ, কিন্তু কী আশ্চর্য! খুট করে শব্দ হল, গুলি বেরোল না। আসলে, হিসেবে কোথাও ভুল হওয়ায় বন্দুকে কার্তুজ ছিল না একটাও। আগের মৃত ভালুকটার জন্যে দুটো কার্তুজ খরচ করেছিলেন রাজা, তার পর যে ম্যাগাজিন শূন্য, তা তিনি বোঝেননি। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় দেবপ্রসাদ গর্গের হাতে উমাশঙ্কর অতি দ্রুত ধরিয়ে দিল কার্তুজ। অব্যর্থ লক্ষ্য যখন সরাসরি হৃৎপিণ্ড ভেদ করল ছুটে আসা সাক্ষাৎ শমনের, তখন শিকার আর শিকারীর মধ্যেকার দূরত্ব ছিল এতটাই কম যে, প্রায় পায়ের গোড়ায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটু আগে মৃত পুরুষ ভালুকের সঙ্গিনী ভালুক। এক লহমার দেরিতে কী হত রাজার হাল, বুঝতে পারছিস তো রুহি?”

“না-বোঝার কী আছে?” রুহিকা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, “সঙ্গীর জন্যে নিজেকে বলি দিল সঙ্গিনী।”

“মন খারাপ লাগছে তো তোর? আমারও লেগেছিল, ওই কিশোর-বয়েসে মিশ্র অনুভূতি হয়েছিল আমার। খুশি হয়েছিলাম রাজার প্রাণ বেঁচেছিল বলে… অথচ, মরে যাওয়া মেয়ে ভালুকটার জন্যে যে মনোকষ্ট হয়েছিল, তা অস্বীকার করব কেমন করে?”

“আসলে কী জানো দাদান, মানুষ যে শখ করে শিকার করত… বন্যপ্রাণীদের বাঁচতে দিত না, এ ব্যাপারটাই খুব খারাপ। বাঘ-ভালুক তৃণভোজী প্রাণী হরিণ, নীলগাই, শম্বর ইত্যাদি শিকার করে নিজেদের পেট ভরানোর জন্যে, না-করলে তো ওরা না-খেয়ে মরবে। কিন্তু সভ্য সমাজের মানুষের তো বাঁচার জন্যে বন্য জীবজন্তু শিকার করার প্রয়োজনই নেই। শুধু শখ মেটানোর জন্যে প্রাণ কেড়ে নেওয়া… একদম মানা যায় না দাদান। দেরিতে হলেও যে মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে… ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন করেছে বিশ্বের প্রায় সব দেশ, এতে তুমি খুশি নও?”

“খুশি না-ও হতে পারি, ভাবলি কেমন করে তুই রুহি!” দেবায়নের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, “এটা কি তুই ভেবে দেখেছিস, মানুষ কেন ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন করেছে?”

“ভাবব না কেন দাদান!” আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে জবাব দেয় রুহিকা, “নিজেদেরকে বাঁচানোর প্রয়োজনে। আমি এবার ক্লাস টেন-এ উঠব, ‘ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স’ জানব না!”

“একদম ঠিক বলেছিস রুহি-সোনা, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত করছি আমরা নানাভাবেই, এখনও সচেতন না-হলে কপালে দুঃখ আছে অনেক।” বলতে বলতে দেবায়ন টুল থেকে উঠে দাঁড়ান, “চল, এ ঘর শেষ করে অন্য ঘরগুলোতে যাই।”

“না দাদান, আজ আর কিছু দেখতেই ইচ্ছে করছে না… ভালো লাগছে না একদম, চলো গেস্ট হাউসে ফিরে যাই।”

“বড্ড নরম-সরম মনের মেয়ে রে তুই রুহি!” দেবায়ন আদরের নাতনিকে কাছে টেনে নিয়ে তার মাথার চুলে স্নেহভরে বিলি কেটে দিতে দিতে বলেন, “দুনিয়াটা কিন্তু ‘বেড অফ রোজেস’ নয়… মনে রাখিস।”

.

দেবব্রত দাশ

জন্ম ১৯৪৪। পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। প্রথমে অধ্যাপনা। ১৯৭৭ থেকে কর্মজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন ডব্লিউ বিসিএস অফিসার। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। লেখালেখির জীবন। লিখেছেন “কিশোর ভারতী”, “শুকতারা”, “নবকল্লোল”, “আনন্দমেলা” প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায়। এছাড়া “ম্যাজিক ল্যাম্প, “জয়ঢাক”, “অপার বাংলা”, “ভো-কাট্টা” প্রভৃতি ওয়েব ম্যাগাজিনেও নিয়মিত লেখকের গল্প প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত একক বই – ‘জীবনের জলতরঙ্গ’, ‘জীবনের যত রঙ’, ‘জীবনের ঝরাপাতা’, মহাকাশে হীরকবৃষ্টি’, ‘কেল্লাফতে’ ইত্যাদি। 

অধ্যায় ৯ / ৯

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন