বিশ্বরূপ মজুমদার
যখন গোধূলির আকাশ লাল আবিরে ভরে ওঠে, যখন দূরে ভেসে ওঠে আজানের সুর, মন্দিরের ঘণ্টা যে মুহূর্তে টঙ্কার দিয়ে গগন বিদীর্ণ করে—ঠিক সেই মুহূর্তে বিপ্লবের চোখে ভেসে ওঠে সহস্র ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্য, বিচ্ছিন্ন। মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে গিয়ে সব যেন এলোমেলো হয়ে যায়। কর্ণকুহরে ভেসে আসে কলরব, অম্বর বিদারী চিৎকার, কোলাহল। বিপ্লব দু’হাতে তার কান চেপে ধরে। চোখ দু’টি বন্ধ করে ফিরে আসতে চায় নিজের জগতে। মুহূর্তে সমস্ত শব্দ থেমে যায়। সব দৃশ্য মুছে যায়। বিপ্লবের মনে হয় ঘটনাগুলো তার সঙ্গে এর আগেও ঘটেছে। কিন্তু কখন, কবে সে স্পষ্টভাবে মনে করতে পারে না।
“ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে খুবই নর্মাল বলে মনে হলেও। আপনার ব্যাপারটা আমার একটু অদ্ভুত লাগছে। দেজা ভ্যু আমাদের সকলের সঙ্গেই ঘটে। তবে তা কয়েক সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হয় না। আপনার সঙ্গেও সেরকমই কিছু হচ্ছে কিন্তু তার স্থায়িত্ব একটু বেশি। তাই আপনার কষ্টটাও বেশি।” কথাগুলো বললেন মনোবিদ সুব্রত মিত্র। বন্ধু অজিতের কথা মেনে বিপ্লব অবশেষে মনোবিদের কাছে যেতে রাজি হল। আসলে বেশ কয়েকদিন ধরেই তার এই সমস্যা হচ্ছে কিন্তু এর সুরাহা কী হবে, ভেবে পাচ্ছে না। নিজের সঙ্গে অনেক টানাপোড়েনের পরে সে একাই হাজির হল ডাক্তার মিত্রর অফিসে। ডাক্তার মিত্র সবটা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বেশ কয়েক রকমের বিশ্লেষণ আছে এই ‘দেজা ভ্যু’-এর। কেউ বলেন, পূর্ব জন্মের স্মৃতি ফিরে আসে, কেউ বা অতি জাগতিক বা পরাবাস্তবের অবতারণা টেনে আনেন। কিন্তু এই অনুভূতির সঠিক ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেননি আজও। তবে বিপ্লবের ব্যাপারটা একটু জটিল। এভাবে একের পর বিচ্ছিন্ন চিত্রের খেলা, শব্দ শোনার ঘটনা নিজের কেরিয়ারে এই প্রথম পেলেন উনি। হ্যালুসিনেশনের আওতায় কি ফেলা যায় ঘটনাকে? নাকি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে… জাতিস্মরবাদ?
* * * * *
মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন কালাচাঁদ রায়। শিক্ত বস্ত্র, সৌম্যকান্তি, গলায় শোভা পাচ্ছে পবিত্র উপবীত। দ্রুত ও দৃঢ় ভাবে বলিষ্ঠ পা ফেলে এগিয়ে আসছেন মন্দিরের দিকে। সকাল ও সন্ধ্যায় আহ্নিক করেই তিনি খাবার মুখে তোলেন। কিছুক্ষণ আগেই গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন তিনি। সপ্তাহের শুরুতেই গুরুদেবের আশীর্বাদ নিয়ে আসা তার অভ্যাস। এমন সময় চারজন অশ্বরোহী এসে দাঁড়াল তার সামনে। কালাচাঁদ যারপরনাই অবাক হলেন। বাদশাহ তাকে মহলে ডেকেছেন? বরকন্দাজের হাত থেকে পরোয়ানাটি নিয়ে মন দিয়ে পড়লেন কালাচাঁদ। তারপর তাদের সঙ্গেই রওনা হলেন।
* * * * *
“বিপ্লব লাহিড়ী?” একজন মহিলার ডাকে চমকে উঠল বিপ্লব। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে যেন কোথায় হারিয়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল এইরকম পরিস্থিতির এর আগেও মুখোমুখি হয়েছে সে। সুসজ্জিতা মহিলাটি তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন। তার কপালে ভাঁজ। বিপ্লব লজ্জিত হল মনে মনে। কী জানি, কতক্ষণ ধরে ডেকে চলেছেন মানুষটি। প্রথম ধাপেই হয়তো রিজেক্ট করে দেবে। ইন্টারভিউয়ার হয়তো বলবে, এত অন্যমনস্ক? তাহলে কাজ করবে কীভাবে? বিপ্লব তখন তাদের বোঝাতে পারবে না কিছুই। কেউ কিছুই বুঝবে না বিপ্লব জানে। অতএব সাত নম্বর ইন্টারভিউতেও লাথি খেয়ে বেরোতে হবে। বিপ্লব ধীর পায়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। চকিতে মাথার ভেতরে একটা দৃশ্য পাক দিয়ে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল সুসজ্জিত প্রাসাদ। মসনদে বসে আছেন বাদশাহ স্বয়ং। তার পাশের সিংহাসনে বসে আছেন উজির। তার উভয়েই তার দিকে চেয়ে হাসলেন। বিপ্লব মৃদু মাথা নাড়িয়ে বসে পড়ল সামনের চেয়ারে। “গুড মর্নিং মিস্টার লাহিড়ী।” বিপ্লবের চমক ভাঙল। মনে মনে জিভ কাটল, ইস্ এই সম্ভাষণ তো তারই আগে দেওয়ার কথা। গেল, এবারের চাকরিটাও গেল। ইন্টারভিউ শুরু হল। বিপ্লব বিফল মনোরথ হয়েই প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করল। বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরাল বিপ্লব। নাহ, আর ভাল লাগছে না। এভাবে আর কত দিন? কী যে হচ্ছে তার সঙ্গে তা সে বুঝতে পারছে না। ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে রাত্রে ঘুমটা ভালো হয় ঠিকই কিন্তু দিনের বেলার কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সেই দৃশ্যপটের ভেসে ওঠা। পরিবেশ, পরিস্থিতি গুলিয়ে ফেলা, সেই দেজা ভ্যু। বিপ্লব মনে মনে স্থির করে নেয় সামনের মাসেই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
পার্কের একটা বেঞ্চে বসে এক মনে একটা বই পড়ছে সুমনা। বিপ্লব ভূঁইফোড়ের মতো উদয় হয়ে সেটি কেড়ে নিতেই সুমনা চমকে উঠল। তারপর বিপ্লবকে দেখে একগাল হেসে ফেলে তার অবিন্যস্ত চুলগুলো আরেকটু ঘেঁটে দিয়ে তাকে পাশে টেনে বসাল। এই একটি জায়গায় এসেই বিপ্লবের ভারি ভালো লাগে। তার মনের ভেতরের সব দোলাচলতা শান্ত হয়ে যায়। তখন আর ফিরে আসে না কোনও দেজা ভ্যু। মনে হয় না, এই মুহূর্তটা তার জীবনে আগেও এসেছে। সুমনার গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে এক চিলতে আশ্রয় খুঁজে পায় বিপ্লব। সুমনা ব্যাগ থেকে একটা টিফিন বক্স বের করে নিজের হাতে বানানো খাবার বিপ্লবের মুখে পুড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কেমন হল আজ?” বিপ্লব মাথা নাড়ে। ধীরে ধীরে সব বলে। সুমনা ব্যথাতুর চোখে তাকায়। “ওষুধে কাজ দিচ্ছে না, না?” বিপ্লব ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে, আবার। সুমনার চোখের এই ব্যথার মানে সে জানে। এই ব্যথা শুধুমাত্র তার জন্য নয়। এরমধ্যে লুকিয়ে আছে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা। এখনও পর্যন্ত সবক’টা ইন্টারভিউতেই পুনরায় ডাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আর ডাক পায়নি। এবারেও হয়তো তাই হবে। আর প্রত্যেক চাকরির রিজেকশানের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় তাদের সম্পর্কের সামাজিক পরিণতির পূর্ণতার মেয়াদ। সুমনা ঝড় সামলে সব ভাঙন ধরে রেখেছে। এদিকে বিপ্লব এখনও শ্রোতের টান খুঁজে পেল না।
* * * * *
মসনদে বসে আছেন গৌড়ের শাসক বাদশাহ সোলেমান। তার পাশের সিংহাসনেই আসীন উজির করিম খাঁ। কালাচাঁদকে দেখেই তারা প্রসন্ন হলেন। কালাচাঁদ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সেলাম ঠুকলেন। একসময়, তার পিতা নঞান রায় ছিলেন সরকারের একনিষ্ঠ কর্মী। সেই সূত্রে তার ডাক পড়েছে। বাদশাহ তাকে মাস মাইনে দিয়ে কাজে বহাল করতে চান। তবে সাধারণ কর্মচারী হিসেবে নয়। ফৌজদার হিসেবে। কালাচাঁদের শক্তি, বুদ্ধি ও জ্ঞান সম্পর্কে অবগত নয়, এমন মানুষ বাংলায় একটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কালার শরীরে বিশ মানুষের বল। সংস্কৃত ও পারসি ভাষা তার নখদর্পণে। তার শরীরে নঞান রায়ের রক্ত। যে রক্ত কখনও কোনও পারিস্থিতিতে বেইমানি করতে শেখায়নি তাকে। কালাচাঁদের শরীর শোভিত হল চাপকান, চোগা, পাগড়িতে। পায়ে শোভা পেল নাগড়াই। কালাচাঁদ রায় হল বাদশাহের ফৌজদার।
প্রাসাদের পাশ দিয়েই মহানন্দায় যাওয়ার পথ। কালাচাঁদ ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী বক্ষে। স্পষ্ট সংস্কৃত উচ্চারণে আহ্বান করেন দিনমণিকে। তার গৌরবর্ণ সদ্য প্রস্ফুটিত রবির আলোয় ঝকঝক করে ওঠে। তার সুগম্ভীর, সুরেলা মন্ত্রোচ্চারণে চারিদিক সুলোলিত হয়ে ওঠে। কিন্তু কালাচাঁদ তার কৃতকর্ম সম্বন্ধে উদাসীন। তার জীবন শুধুই কর্মবহুল। দেব সেবা ও অন্নদাতার সেবা ব্যতিরেকে, তার জীবনে আর কিছুই যেন নেই। তাই সে বুঝতেও পারে না তার এক ঝলক দর্শনের জন্য কাতর দু’টি চোখ রোজ সকালে গুটিগুটি পায়ে জানলায় এসে দাঁড়ায়। তৃষ্ণার্ত দু’টি নয়ন মেলে আকণ্ঠ পান ওঠে তার দেহ সৌষ্ঠব। মন দিয়ে শোনে তার বাণী। তার প্রতিটি পদক্ষেপে বিদীর্ণ হয় সেই অদৃশ্য মানবীর হৃদয়। অজানা আশঙ্কায় যার মনের ভেতর বইতে থাকে হাজার ঝড়। কালাচাঁদ সেই মানবী সম্বন্ধে উদাসীন, অনবগত।
* * * * *
“দ্যাখো বিপ্লব দশ-বারো হাজার মাইনে নিয়ে তো আর বিয়ে করা যায় না। আর আমরাও মেয়ে দিতে পারি না। তাছাড়া, আমার মেয়েই তো তোমার থেকে বেশি কামায়। তোমার কেরিয়ার ওর কাছাকাছিও নয়। এরপর তোমাদের দু’জনের মধ্যেই সমস্যা দেখা দেবে। আমি তোমাদের ডিসকারেজ করছি না। যেটা সত্যি, সেটাই বোঝাচ্ছি।” সুমনা বাবার এহেন কথোপকথনে অস্বস্তি বোধ করছে। বিপ্লবকে সে চাপ দেয়নি বিয়ের জন্য। বরং সে নিজেই কথা বলতে এসেছে। বলা যায়, সময় চাইতে এসেছে। সুমনাকে যেন বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া না হয়। যেন ওদের দু’জনকে আরও কিছুদিন সময় দেওয়া হয়। বিপ্লব মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার যা বলার ও বোঝার তা সবই শেষ। এবার সবকিছুই নিয়তির হাতে ন্যস্ত। সুমনার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে একবার চেয়ে সে মিশে গেল শহরের কোলাহলে। জীবন বড় জটিল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
* * * * *
বাদশাহের প্রস্তাবে কালাচাঁদ চমকে উঠলেন। বাদশাহের হুকুম অমান্য করা তার কাছে যেমন দূরূহ, তেমনি তা মেনে নেওয়াও তার পক্ষে কঠিন। জাতি, ধর্ম, সমাজ, পরিবার বিসর্জন দিয়ে সে শুধুমাত্র নিজের লাভালাভের কথা ভেবে এগিয়ে যেতে পারল না। বুকের ভেতর দামামা বেজে উঠল। কালাচাঁদ বললেন, “ভৃত্যকে মাফ করবেন হুজুর। এ প্রস্তাবে আমি রাজি হতে পারলাম না। অর্থ, সুখ, বৈভবের আগে আমার ধর্ম, আমার সমাজ। সমাজচ্যুত মানুষ জলবিহীন মাছের মতো। আপনার প্রস্তাব মেনে নিলে আপনার সম্মান রক্ষা হলেও, আমার সংস্কৃতির অবমাননা হবে।” বাদশাহ ফৌজদারের এহেন স্পর্ধায় বিস্মিত হলেন। তার কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। ঘন ঘন নিশ্বাসের ওঠা নামায় কালাচাঁদ বুঝতে পারলেন তার নিয়তির পরিণতি। বাদশাহ বিকৃত স্বরে ডেকে উঠলেন পাহারাদারকে। হুকুম দিলেন ফৌজদারকে বন্দি করার। পাহারাদার হতবাক। ফৌজদার সাহেবের মতো সজ্জন সে খুবই কম দেখেছে। বাদশাহের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। তবু বাদশাহ তাকে আটক করতে বলছেন! কিন্তু বাদশাহের আদেশ অমান্য করার সাহস গৌড়ে কারুর নেই। অগত্যা কালাচাঁদ চললেন কুঠুরির উদ্দেশে।
কুঠুরির অন্ধকারে প্রবেশ করে কালাচাঁদ মনে মনে হাসলেন। অন্ধকার যেমন অপ্রিয়, তেমনি মাঝে মাঝে তা ভীষণ প্রিয় হয়ে যায়। অন্ধকারে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে। বুঝতে পারে। জটিল ভাবনায় অনায়াসে ডুবে যেতে পারে। কালাচাঁদ অবাক হয়ে ভাবতে বসলেন, বাদশাহের দেওয়া প্রস্তাবের ব্যাপারে। তিনি কালাচাঁদকে নিজের জামাতা হিসেবে পেতে চেয়েছেন। তার কন্যা নাকি কালাচাঁদকে মনে মনে স্বামী হিসেবে বরণ করেছেন। কিন্তু যে মানুষটিকে সে চোখে দেখেইনি। শুধুমাত্র নামটুকু শুনেছে। যার সম্বন্ধে বিস্তারিত কোনও তথ্য তার কাছে নেই। সেই মানুষটিকে শুধুমাত্র বাদশাহের মুখের কথায় জীবনসঙ্গী হিসেবে কীভাবে মেনে নেবেন? তার থেকেও বড় বাধা হল ধর্ম। হিন্দু ধর্মে বিজাতির সঙ্গে বিবাহের নিয়ম নেই। বাদশাহের কন্যাকে বিবাহ করলে তাকে ছাড়তে হবে পরিবার, সমাজ। যা তার পক্ষে অসম্ভব। ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত কালাচাঁদের চোখে ঘুম নেমে এল।
ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কারাগারের দরজা খুলে গেল। কালাচাঁদ অবাক হয়ে দেখল তাকে প্রহরী চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল। কালাচাঁদ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কি বাদশাহের নির্দেশ?” প্রহরী নিস্তব্ধ। কালাচাঁদ বিরক্ত হলেন। হলেন অবাক। তবু কৌতূহল বশে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন একজন সুন্দরী রূপসী দন্ডায়মান। কালাচাঁদকে দেখেই সে কুর্নিশ করে জানাল, সে শাহজাদীর সখী। শাহজাদীই তাকে নির্দেশ দিয়েছেন কালাকে মুক্তি করানোর। কালাচাঁদ আবারও বিরক্ত হলেন। কে এই নারী, যার জন্য তাকে একবার কারাগারে নিক্ষেপ করা হল, আবার তারই কথায় তাকে মুক্তি দেওয়া হল? কালাচাঁদ অপমানিত বোধ করলেন। কারুর বদান্যতা তার পছন্দ নয়। তিনি বলে উঠলেন, “স্বয়ং বাদশাহের হুকুম ছাড়া আমি এই কারাগার ত্যাগ করব না। কালাচাঁদ রায় পলায়ন করতে শেখেনি।” উপস্থিত সকলকে অবাক করে কালাচাঁদ আবার কারাগারে প্রবেশ করলেন। প্রতিদিন প্রাতঃস্নানের পরে সূর্যপ্রণাম করা তার অভ্যাস। আজ করাগারের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে নির্গত অল্প সূর্যালোকেই তিনি স্তব পাঠ শুরু করলেন। বাদী অবাক ও ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে গেলেন।
লোকারণ্য রাজপথ। কালাচাঁদকে শূলে চড়ানোর দিন। সজ্জন বীর হিসেবেই কালাচাঁদের খ্যাতি। সকল অধিবাসী এমন মানুষের মৃত্যুদণ্ডের কথা শুনে অবাক। কেউ কেউ অবশ্য নানান খবর রটাতেও খামতি দেয়নি। কালাচাঁদ উপস্থিত হলেন শূল মঞ্চে। উপস্থিত কারুর চোখে কৌতূহল, কারুর চোখ বেদনাতুর। কালাচাঁদ অবিচল সত্যের পথে। হঠাৎ সকলকে চমকে দিয়ে মঞ্চে উঠে এলেন একজন মহিলা। স্বর্নালংকারে ভূষিতা, সুন্দরী, মার্জিতা এক কন্যা। প্রজাদের গুঞ্জরণে কালাচাঁদ বুঝল কন্যাটি আর কেউ নয়, স্বয়ং বাদশাহ দুহিতা। কালাচাঁদের বুকের ভেতর কী এক আলোড়ন তৈরী হল। মেয়েটির বহিরঙ্গ পেলব হলেও, তার অন্তরমহল যে সাংঘাতিক দৃঢ় ও অচল তা সে এক নজরেই বুঝতে পেরেছে। শাহজাদি ঘাতকের সামনে এসে দাঁড়ায়। দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, যেহেতু তার দোষে কালাচাঁদ রায়ের মতো সজ্জনকে শূলে নিক্ষেপ করার মতো পাপ তার পিতা করছেন তাই সেই একই শাস্তির ভাগিদার তিনি নিজেও। সে হুকুম দেয়, দু’জনকে যেন একই সঙ্গে শূল বিদ্ধ করা হয়। যদি তা না হয় তবে ঘাতকেরও প্রাণ সংশয়। সকল মন্ত্রী, উজির পড়ল মহা সমস্যায়। সঙ্গে সঙ্গে খবর ছুটল বাদশাহের কাছে। তিনি সব শুনে সোজা হয়ে বসলেন। একবার নিজের কন্যার উপর তার প্রচণ্ড রাগ হল। আবার ভীষণ করুণাও হল। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে তিনি আদেশ দিলেন কালাচাঁদকে মুক্তি দেওয়ার।
* * * * *
“আমি কী করব বিপ্লব? তুমিই বলে দাও।” সুমনার প্রশ্নে বিপ্লবের হৃদয়ে একটা ঢেউ উঠল। কিন্তু সেই ঢেউয়ের তরঙ্গ ও দোলা সে একাই অনুভব করতে পারল। সুমনাকে সে কিছুই বুঝতে দিল না। অস্তমিত সূর্যের দিকে চেয়ে রইল সে একপলকে। সুমনা এমনিতে ধৈর্যশীলা। কিন্তু আজ তার অন্তরে বিষম ঝড় উঠেছে। বিপ্লবের উদাসীনতা, নৈঃশব্দ তার বেদনা আরও বাড়িয়ে তুলল। সুমনা অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়াল। গঙ্গা ঘাটের সিঁড়িতে কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করে আবার ফিরে তাকাল বিপ্লবের দিকে। বিপ্লব তখনও চুপ। কোনও উত্তর খোঁজার তাগিদও যেন নেই তার। সুমনা আর পারল না। ব্যাগের চেন খুলে একটা সুদৃশ্য বিয়ের কার্ড বের করে বিপ্লবের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে শ্লেষাত্মকভাবে বলল, “দামী উপহার দেওয়ার ক্ষমতা তো তোমার নেই। তাই এক কাজ করো, দু’বেলা পেট ভরে খেয়ে যেও। আমার হবু বর বিরাট ডাক্তার তো। একটা এক্সট্রা প্লেট আশা করি আমার বাবা সেই আনন্দে অ্যাফোর্ড করতে পারবে।” বিপ্লব তাকাল সুমনার দিকে। না, তার চোখে কোনও গ্লানি নেই, ব্যথা নেই। সে শুধু তাকাল সুমনার অন্তর বোঝার জন্য। তার কণ্ঠের কম্পন আর হৃদয়ের যন্ত্রনা অনুভব করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে সুমনা অনেক অনেক দূরে চলে গেছে। কনে দেখা আলোয় আজ পৃথিবী বড়ই সাদা-কালো বিপ্লবের কাছে।
বেকারত্ব, দলাদলি আর স্বজন পোষণের এই যুগে বিপ্লব বিয়ের যোগ্য চাকরি জোটাতে পারল না। এদিকে সুমনার বাড়ি থেকেও মানতে নারাজ। মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের বয়স পঁচিশ পেরোলেই বাবা-মায়ের কপালে ভাঁজ পড়ে। কারুর কারুর তার আগে থেকেই। সুমনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। অতএব তার মর্জির বিরুদ্ধেই বিয়ের দিন ঠিক হল। কার্ড ছাপা হল। আসলে সুমনাও যে খুব বাধা দিয়েছিল তা নয়। কার ভরসায় বা কীসের জোরেই বা সে বাধা দেবে? মাঝে মাঝে, জীবনে নিজের ও অপরের ভালোর জন্য কঠোরতম সিদ্ধান্ত নিতেই হয়। সুমনার ক্ষেত্রেই সেটাই হল। নিজের এবং বাবা মা, কিছুটা বিপ্লবের খাতিরেও সে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। তবু শেষবারের মতো বিপ্লবের কাছে আঁচল পাততে গিয়েছিল সে। শূন্য হাতে ফেরার আশা ছিল প্রবল কিন্তু উদাসীনতা বড্ড বেশি অপমানজনক।
বিপ্লব সুমনার চলে যাওয়া দেখল এক মনে। কেউ দেখল না তার গাল গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা জল তার হৃদয় পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে ফেলল। অসহায়তা বড় নিষ্ঠুর করে তোলে মানুষকে। সুমনাও তাকে পাষান, অযোগ্য, প্রতারক ভেবেই কাটিয়ে দেবে সারাটা জীবন। তাই দিক তবে ও যেন সুখে থাকে। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে সুমনার মঙ্গল প্রার্থনা করে সে উঠে দাঁড়াল। আর তখনিই তার মনে হল এই বেদনার মুহূর্ত, এই অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা সে আগেও পেয়েছে।
* * * * *
কালাচাঁদ ও শাহজাদির বিবাহ সম্পন্ন হলেও, কালাচাঁদ অবধারিতভাবে সমাজচ্যুৎ হলেন। যে সমাজ তাকে একসময় মাথায় তুলে রাখত। যে সমাজ তাকে সৎ, চরিত্রবান আখ্যা দিয়েছিল সেই সমাজই তাকে এখন পায়ে ঠেলছে। কালাচাঁদ নিজ ধর্ম অপরিবর্তিত রেখেই বিবাহ করলেন। নিঃস্বার্থ, নির্ভীক প্রেমের কাছে কোনও যুক্তি তর্কই টিকতে পারল না সেদিন। কালাচাঁদ রায়, পাঠান সেনার ফৌজদার, দোর্দণ্ডপ্রতাপ, বীর কালাচাঁদ রায় নির্দ্বিধায় নত হলেন শাহজাদির পায়ে। কিন্তু প্রেমের গভীরতা বোঝা সকলের সাধ্য নয়। কালাচাঁদ গ্রামে ফিরে গেলেন। ফৌজদার কালচাঁদ এখন সেনাপতি। তার প্রতি সরাসরি বিক্ষোভ হল না ঠিকই, বরং তাকে পরামর্শ দেওয়া হল প্রায়শ্চিত্তের। কালাচাঁদ বিনাবাক্যে সেই আদেশ মাথা পেতে নিলেন। যতই হোক, মনে মনে সে তো এই সমাজ, এই ধর্মের অংশ হতেই চেয়েছে। একটি প্রায়শ্চিত্ত যদি সে’সব ফিরিয়ে দেয় তবে মন্দ কী?
পরামর্শ মতো তিনি হাজির হলেন শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামে। কিন্তু ভাগ্য সঙ্গ দিল না। বিধর্মী কাউকে মন্দিরের গর্ভ গৃহে প্রবেশের অনুমতিই দিলেন না পুরোহিত মন্ডলী। কালাচাঁদ অনাহারে পড়ে রইলেন দরজায় তবু তাকে ঢুকতে দেওয়া হল না। অপমানিত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট, পরাজিত পাঠান সেনাপতি গৌড়ে ফিরে এলেন। তবে চুপ করে রইলেন না। কিছুদিন পরেই পাঠান সেনা নিয়ে আক্রমণ করলেন উড়িষ্যা রাজ্য। প্রবল পরাক্রমী পাঠান সেনার কাছে টিকতে পারল না মুকুন্দদেবের সেনাবাহিনী। কালাচাঁদ আবার এসে পৌঁছলেন শ্রীক্ষেত্রে। গম্ভীরা থেকে বের করে আনলেন বিগ্রহ। সমুদ্র তীরে নিয়ে এসে আগুনে নিক্ষেপ করলেন জগন্নাথ বিগ্রহ। সকলে রে রে করে উঠলেও বাধা দেওয়ার সাহস পেল না। কালাচাঁদ বক্র হেসে মনে মনে ভাবলেন, এই বিগ্রহ, এই মূর্তি নাকি সকলের রক্ষাকর্তা? তার নিজের রক্ষাকবচ কোথায়? কে রক্ষা করছে তাকে? কালাচাঁদের রোষানল থেকে মুক্তি পেল না অন্যান্য পীঠস্থানও। তিনি হানা দিলেন, কামরূপ। সেখানে মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করে তিনি তার শিবির নিয়ে হাজির হলেন বারানসীর তীরে। সেনাদের প্রতি আদেশ হল মন্দির ধ্বংসের। তৎক্ষণাৎ মুক্ত কৃপান পাঠান সেনার পদশব্দে কাঁপতে শুরু করল গোটা বারানসী। ধূলিস্যাৎ হল সুপ্রাচীন মন্দির ও বিগ্রহ। কালাচাঁদের অন্তরের জ্বালা জুড়ালো। জাত, ধর্ম, গোত্র, উচ্চ-নীচ ভেদাভেদের ধামাধারী ধর্ম ব্যবসায়ীদের চরম শাস্তি দিয়ে তার ভেতরের অপমানের জ্বালা ধীরে ধীরে প্রশমিত হল। যে মন্দিরের দ্বারের সামনে তাকে দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হয়েছে শুধুমাত্র এক ঝলক দর্শনের আশায়, সেই মন্দির, সেই বিগ্রহ আজ তার কাছে পরাজিত। আত্মতৃপ্তিতে ভরে গেল তার হৃদয়। পরমুহূর্তেই গ্লানি আর অবসাদের মেঘ ঘনিয়ে এল তার চোখে। এ কী করে ফেললেন তিনি! রাগ, অপমান ও প্রত্যাখানের জ্বালায় পুড়তে পুড়তে কত দূর এগিয়ে এলেন তিনি? প্রজাদের হাহাকার তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে হৃদয়কে বিদীর্ণ করে তুলল। চন্দ্রালোকে ভেসে যাচ্ছে গঙ্গাবক্ষ। রূপালি আলোয় প্রকৃতি মোহময়ী। এই প্রকৃতির পূজারীকে অহংকার ও ক্রোধের মোহজাল সংহারক করে তুলেছে। কালাচাঁদ ধীর পায়ে শিবির ছেড়ে ঘাটের সিঁড়িতে এসে দাঁড়ায়। তার কপোল বেয়ে নেমে আসে নোনতা জল। নদীর কাছে, আরও কাছে এগিয়ে যান তিনি। তার গলা পর্যন্ত গঙ্গার শীতল, স্বচ্ছ জল। ধীরে ধীরে সেই শীতল স্বচ্ছতা তাকে গ্রাস করল। পরদিন সকালে লোকমুখে প্রচারিত হল, কালাচাঁদ, পাহাড় প্রমাণ পাঠানসেনার সেনাপতি কালাচাঁদ রায় অন্তর্হিত হয়েছেন।
* * * * *
বিপ্লবের এখন আর অসুবিধা হয় না। একটা অজানা, রহস্যময় অতীতের সঙ্গে তার বোঝাপড়া হয়ে গেছে। সেই অতীত মাঝে মাঝেই ফিরে আসে তার বর্তমানে। তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। আবার সময়মতো ফিরে যায় নিজের জায়গায়। তবে বিপ্লব এটা বুঝতে পারে যে তার অতীত ও বর্তমানের মধ্যে খুব বেশ তফাত নেই।
এ.সি সিদান গাড়িটির পিছনের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো বিপ্লব। একটি বড় কোম্পানির খুব দামী কর্মচারী সে। মালিকপক্ষ বেশ খাতির যত্ন করে। তার নখদর্পনে বিরোধী পক্ষের সমস্ত হালচাল। সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোতে বিপ্লব লাহিড়ী খুব ভাল করে জানে। সহজ পথের জীবন যাপন বিপ্লবের কপালে জোটেনি আসলে। তাই বাঁকা পথে চোরা হীরা মাফিয়াদের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে সে। টাকা? নাহ, অভাব নেই এখন। যে টাকার অভাবে অপমানিত হতে হয়েছে, যে টাকার অভাবে সুমনাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে আজীবনের জন্য সেই টাকা আজ তার হাতের ময়লা। কিন্তু অগাধ টাকার সমুদ্রে হারিয়ে যায় তার নিজস্ব সত্তা। দিনের শেষে চুলে বিলি কাটার কেউ থাকে না। অথবা দিন থেকে রাত নামাও বুঝে উঠতে পারে না। বিপ্লব সমাজের এক বিরাট অংশের কাছে জিতে গেছে। যারা অর্থ উপার্জনের মাপকাঠি দিয়ে সম্মানের দাঁড়িপাল্লার মান বিচার করে। মনের গহীনে প্রথিত করে এক অলীক ধারণা—সঙ্গেই সকলকে হারিয়ে দিয়েছে বিপ্লব। তবু কোথায় যেন নিঃশেষিত হয়ে গেছে।
আসলে সমাজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আমরা প্রত্যেকেই কখন যেন একেকজন কালাপাহাড় হয়ে উঠি। সমাজ নির্ধারিত মাপকাঠি অনুযায়ী নিজেদের উত্তীর্ণ করতে করতে কখন যেন নিজেদেরই হারিয়ে ফেলি। তবু জিতে যাওয়ার নেশা ছাড়তে পারি না। প্রত্যাখ্যানের জ্বালা জুড়াতে আমরা যখন মরিয়া হয়ে উঠি তখন ঠিক ভুল বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে আমরা সকলেই একেকজন প্রতিষ্ঠান বিরোধী ‘কালাপাহাড়’ হয়ে উঠি।
.
কেয়া চ্যাটার্জী
জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। আপাদমস্তক বাংলা মিডিয়ামের শিক্ষার্থী। অনেক বাধা পাওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। কয়েক বছর শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে বর্তমানে এক পুত্র সন্তানের জননী হওয়ায় কর্মজীবন স্থগিত রয়েছে। লেখালেখির থেকেও পড়তে বেশি ভালোবাসেন। মানুষের মনের কথা ও ছোটদের রঙিন জীবন নিয়ে লিখতে বেশি পছন্দ করেন। ভালো লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন প্রতি মুহূর্তে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন