গৌড়বঙ্গ ত্রাতা জয়নাগ – কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

বিশ্বরূপ মজুমদার

গৌড়বঙ্গ ত্রাতা জয়নাগ – কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

কথামুখ: শশাঙ্ক৷ ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বরূপ, বহু কিংবদন্তীর নায়ক৷ গৌড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কদেব ছিলেন প্রাচীন বঙ্গের গৌড় সাম্রাজ্যের সার্বভৌম নৃপতি, প্রথম স্বাধীন রাজা। তিনি বাংলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্রিত করে গৌড় জনপদ গড়ে তোলেন। খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে তিনি রাজত্ব করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কারও কারও মতে তিনি ৬০০ হতে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ৷

এ কাহিনির সূত্রপাত শশাঙ্ক প্রয়াণের পরবর্তী অধ্যায়ে৷ এক ক্ষমতা দখলের, এক জটিল রাজনৈতিক ইতিহাসের৷

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মানব বা মানবাদিত্যের পক্ষে গৌড়বঙ্গের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব রক্ষা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে দাঁড়ায়৷ শুধু গৌড়বঙ্গ নয় শশাঙ্কের সাম্রাজ্য ছিল সুবিশাল৷ তিনি বাংলার বাইরে উড়িষ্যা বা উৎকল, আসাম বা কামরূপ ও মধ্যপ্রদেশ, বিহারের কিয়দংশ সাম্রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত করেছিলেন অসীম সাহসিকতায়৷ কোনও কোনও ঐতিহাসিক বজ্র নামক শশাঙ্কের এক নাতির কথা বললেও তার ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায়নি৷

শশাঙ্কর রাজ্য বঙ্গ থেকে ভুবনেশ্বর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল এবং পূর্বদিকে কামরূপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মানব বা মতান্তরে মানবাদিত্য মাত্র আট মাস রাজ্যশাসন করেছিলেন৷ কিন্তু করলে কী হবে যাঁর পিতা শশাঙ্ক অসীম ক্ষমতা বলে উত্তর-পশ্চিমে কনৌজ আর দক্ষিণ-পশ্চিমে উৎকল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তা রক্ষা করা মানবাদিত্যের পক্ষে ছিল অসম্ভব৷ একদিকে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর প্রতিহিংসা নিতে তৎপর পুষ্যভূতি বংশীয় সম্রাট হর্ষবর্ধন গ্রাস করে নিলেন মগধ৷ অন্যদিকে হর্ষবর্ধনের পরম মিত্র কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মা অধিকার করলেন কর্ণসুবর্ণ৷ দু’দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে পর্যুদস্ত হলেন মানবাদিত্য৷ স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হল গৌড়বঙ্গের৷ তারপর…

এ কাহিনি এক বীরের যিনি গৌড়বঙ্গ পুনরুদ্ধারে সমর্থ হয়েছিলেন৷ রূপকথার মতোই বড় অদ্ভুত সেই কাহিনি৷

॥ ১ ॥

পশ্চিমাকাশে সূর্যের শেষ রক্তিম আভা৷ যুদ্ধক্ষেত্রের অনতিদূরে শিবিরে বসে আছেন রণক্লান্ত বঙ্গেশ্বর মানবাদিত্য৷ সারা শরীরে আঘাত৷ অজস্র ক্ষতচিহ্ন এক ক্ষত্রিয়ের গর্বের চিহ্নও বটে৷ না! আর সম্ভব নয়! বিনাযুদ্ধে সন্ধিস্থাপন মানবাদিত্যের অভিধানে নেই৷ এর থেকে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য শত্রুর হাতে রণক্ষেত্রে প্রাণবিসর্জন অনেক গৌরবের৷ শিবিরের চারপাশে আহত সৈন্যদের যন্ত্রণাকাতর হাহাকার৷ বাজবৈদ্যরা ক্ষতের উপর ঔষধের প্রলেপ দিচ্ছেন৷ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে স্বজন হারানোর ব্যথায়৷ আহত মানবাদিত্য ইশারায় ডাকলেন প্রিয় সহচর সেনাপ্রধান জয়নাগকে৷

“জয়নাগ, তুমি আমার শেষ আশা বা ইচ্ছাপূরণের চাবিকাঠি৷ দ্যাখো আমি নিঃসন্তান আর তুমি ছাড়া এই মুহুর্তে কোনও সুহৃদ বা মিত্র অবশিষ্ট নেই৷ পারবে না আমার কথা রাখতে…”

অশ্রুসজল মানবাদিত্য তাকালেন সেনাপ্রধান জয়নাগের দিকে৷

“বলুন প্রভু৷ আমার জীবন বাজি থাকল৷ যা বলবেন তাই করব৷ আমি সারাজীবন পাশে ছিলাম, আজও আছি আর ভবিষ্যতেও থাকব৷ বলুন কী করতে হবে৷ আমি জীবনের পরোয়া করি না দেশের জন্য আমার সম্রাটের জন্য৷”

জয়নাগের কথার উত্তরে হাসলেন মানবাদিত্য৷ বড় বিষণ্ণ, যন্ত্রণাক্লীষ্ট সেই হাসি৷

“দ্যাখো জয়নাগ, কামরূপরাজের কাছে আমাদের পরাজয় নিশ্চিত৷ কিন্তু আমি ধরা দেব না৷ সবাই আজ বিপদে আমাদের ছেড়ে গেছে৷ যে ক’জন বীর বিশ্বস্ত যোদ্ধা আছে আমি তাদের নিয়েই লড়ব তবে জানি এ অসম লড়াই৷ আমি তোমাকে একটা বড় দায়িত্ব অর্পন করে যেতে চাই৷ এই নাও মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কের খড়্গ৷ এটা তোমার হাতে তুলে দিলাম৷ তুমি এর মর্যাদা রাখবে৷ আমার মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ দেশের জন্য, মাতৃভূমির জন্য রণক্ষেত্রে প্রাণবিসর্জন একজন ক্ষত্রিয়র পরম প্রাপ্তি৷ তুমি আমাকে কথা দাও এই গৌড়বঙ্গ, এই কর্ণসুবর্ণ তুমি উদ্ধার করবে৷ সমুচিত শিক্ষা দেবে প্রাগজ্যোতিষপতি ভাস্করবর্মাকে৷ বলো! কথা দাও…”

জীবনের শেষ লড়াই করলেন মানবাদিত্য৷ সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত৷ তীরের আঘাতে রক্তপাত হচ্ছে অবিরাম৷ তবুও পরম শৌর্যে শত্রুসৈন্য সংহার করছেন দ্রুত৷ কিন্তু না! সহযোদ্ধার সংখ্যা বড় কম৷ নিজের তলোয়ার কোষবদ্ধ করে মানবাদিত্যের পাশেই সেই মহাপরাক্রমী শশাঙ্কের বিজয় খড়্গ নিয়ে লড়তে লাগলেন জয়নাগ৷

অন্য সৈন্যরা ছত্রখান হয়ে গেছে৷ এ বড় অসম যুদ্ধ৷ অবশেষে মানবাদিত্য আর পারলেন না৷ দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণত্যাগ করলেন৷ রক্তে ভিজে যাচ্ছে মাটি৷ তার উপর পড়ে আছেন বঙ্গাধিপ মানবাদিত্য৷ অদূরেই প্রচণ্ড আহত ও অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছেন জয়নাগ৷ তাঁর শরীরে ঢাকা পড়ে গেছে রাজাধিরাজ শশাঙ্কের নামাঙ্কিত খড়্গ৷

যথাসময়ে খবর গেল কামরূপরাজের কাছে৷ বঙ্গাধিপ মানবাদিত্য নিহত৷ সৈন্যদের কাছে হুকুম গেল মানবাদিত্যের দেহ তুলে এনে রাজকীয় মর্যাদায় সৎকার করার৷ বীরধর্ম বোধহয় একেই বলে৷ মৃত্যুতেই শত্রুতা শেষ৷ যতই হোক মানবাদিত্য রাজা তো বটেই৷

কিন্তু রণক্ষেত্রে পড়ে থাকা অজস্র সাধারণ সৈনিকদের মৃতদেহ? তাদের ভবিষ্যৎ কী? তাদের দেহ অনাদরেই পড়ে থাকে রণক্ষেত্রে৷ দু’-তিনদিন পর সময় হলে শত্রুসৈন্যরা সেই দেহ তুলে নিয়ে মাটি কেটে বিরাট গর্ত তৈরী করে তাতে দেহগুলো ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দেয়৷ নাহলে পচা গলা লাশের দুর্গন্ধে যে বসবাস কঠিন হয়ে যাবে৷

হাজার সৈনিকের মধ্যে মৃতবৎ পড়ে আছেন জয়নাগ৷ সাধারণ সেনানীদের দিকে ফিরেও তাকায় না শত্রুসেনা৷ একদিক দিয়ে শাপে বরই হল জয়নাগের৷ অস্ত্রর উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন৷ ইচ্ছে করে শ্বাস বন্ধ করছেন৷ শত্রুসৈন্যরা নিকটবর্তী হলেই শ্বাস বন্ধ করে ফেলছেন জয়নাগ৷ একবার জানতে পারলে অর্ধ্বমৃত জয়নাগকে তুলে নিয়ে যাবে শত্রুসেনা৷ প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাজসমীপে পেশ করা হবে তাঁকে৷ কামরূপরাজের দরকার শশাঙ্কের গুপ্তধনের সন্ধান৷ কাজেই অত্যাচার বাড়বে সেক্ষেত্রে জয়নাগের উপর৷ স্বীকারোক্তি আদায়, লুকোনো ধনসম্পত্তি, কোষাগারের হদিশ যে ভীষণ জরুরি৷ নির্জন রণক্ষেত্রে রাত নামে৷ তারা ঝলমল করে৷ শত্রু শিবিরে আমোদ প্রমোদ চলছে৷ বিজয়োল্লাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে দূর থেকে৷ জয়নাগের শরীরে ক্লান্তি নামছে৷ আর পারছেন না তিনি৷ ঘুম নামছে দু’চোখে৷ চারদিক হঠাৎই অন্ধকার হয়ে গেল জয়নাগের৷

এভাবেই মৃত সৈনিকরা পড়ে থাকে রণক্ষেত্রে। দু’দিন তিনদিন পর কখন কামরূপরাজের সেনারা এসে সে দেহ সরাবে তার প্রতীক্ষায়৷ আকাশে শকুনের ঝাঁক ঘুরতে থাকে৷ খাদ্যের সন্ধান পেয়েছে তারা৷

ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় জ্ঞান ফিরে আসে জয়নাগের৷ ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে উঠে বসার চেষ্টা করেন৷ মাথা ঘুরছে৷ মনে হচ্ছে শরীরের শেষ শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই৷ আস্তে আস্তে উঠে বসলেন জয়নাগ৷ ওঠার ক্ষমতা নেই৷ সারা শরীর রক্তাক্ত৷ পোষাক ছিন্ন ভিন্ন৷ চোখের উপরের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে৷ চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন জয়নাগ৷ না! শত্রুসৈন্য ধারেকাছে নেই৷ এখন দুটি কর্তব্য তাঁর৷ প্রথমত এখান থেকে পালানো শত্রুসৈন্যের চোখ এড়িয়ে৷ শশাঙ্কের নামাঙ্কিত খড়্গকে লুকিয়ে পালাতে হবে৷ কিন্তু এতবড় খড়্গ কীভাবে লুকোবেন৷ এ খড়্গ উপরে তুলতে যে কোনও বলশালী বীরের পক্ষেও ভীষণ কঠিন কাজ৷ দ্বিতীয়ত তার পোষাক! এই রক্তমাখা সৈন্যের পোষাক! সহজেই যে শত্রুসেনার চোখে পড়ে যাবেন৷

না! পালাতে হবেই জয়নাগকে৷ জয়নাগ দ্রুত চিন্তা করতে থাকেন৷ চিন্তাশক্তি এখনও জয়নাগের সঠিক পথনির্দেশ করছে৷ হ্যাঁ! পশ্চিমের সবুজ বনানী৷ এখানেই তাকে যেতে হবে৷ সেই মতো রণক্লান্ত আহত শরীরটাকে নিয়ে বস্ত্রের আড়ালে খড়্গকে যথাসম্ভব লুকিয়ে হাঁটতে থাকেন৷ স্বাভাবিক চলা আর এই চলায় অনেক পার্থক্য আছে৷ শরীর চলে না, প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর মানবাদিত্যকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এখন তার চালিকা শক্তি৷

ওই তো দূরের বনাঞ্চল ক্রমশ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে৷ জয়নাগ এসে পড়েছেন নিরাপদ স্থানে৷ বিশাল এক গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিতে থাকেন জয়নাগ৷ অযুত সহস্র মৃত সৈনিকের ভিড়ে একটি সৈন্য যে নিখোঁজ তার সন্ধান শত্রুদের অজানা এ ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত তিনি৷

এখন দ্বিপ্রহর৷ এ বনে প্রচুর ফলের গাছ আছে৷ আর উত্তর পশ্চিমদিকে রাজা শশাঙ্ক খনন করিয়েছিলেন বিশালাকার এক পুষ্করিণী৷ সারাবছর তাতে জল থাকে৷ জলে নামতেই অনেকটা ভালো লাগতে থাকে জয়নাগের৷ সারা শরীরের ক্ষতস্থান থেকে চুঁয়ে পড়া রক্ত ধুয়ে ফেলেন৷ বস্ত্রও ভালো করে ধুয়ে ফেললেন জয়নাগ৷ খড়্গের রক্তের দাগ জলে মিশে যায়৷ খড়্গ এখন আবার নতুনের মতো চকচক করতে থাকে৷ যার হাতলে সোনার লিখনে জ্বলজ্বল করছে দেবনাগরী ভাষায় মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কের নাম নীচে তার প্রতীক ‘বাংলার বাঘ’৷

বনের ফলমূল খেয়ে কিছুটা ক্ষুধানিবৃত্তি হয়৷ কিন্তু সে তো সাময়িকভাবে৷ জীবনধারণের জন্য যে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের স্বাভাবিক প্রয়োজনের চাহিদা অপরিসীম৷ এখানে বেশ কিছু ঔষধি গাছ ও গুল্ম আছে৷ ক্ষতস্থানে তা লাগালে যন্ত্রণার অনেক উপশম হয়৷ সেই গুল্ম পেয়েও গেলেন জয়নাগ৷ একটি বড়গাছের উপর আশ্রয় নিলেন জয়নাগ৷ নিজেকে বেঁধে রাখেন ডালের সঙ্গে৷ শশাঙ্কের খড়্গ এবং নিজের তলোয়ার লুকিয়ে রাখেন গাছের পেছনে পাতার স্তূপে৷ আজ রাতটা এভাবেই কাটাতে হবে৷ সকালে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে হবে৷ প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে ফেলতে হবে৷ শত্রুর চোখ এড়িয়ে যা কিছু করণীয় তা করতে হবে জয়নাগকেই৷

॥ ২ ॥

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পাখির ডাকে জয়নাগের ঘুম ভেঙে যায়৷ শরীরটা অনেকটা বিশ্রামে সুস্থ৷ ঔষধী গুল্মের প্রলেপ লাগিয়েছেন ক্ষতের উপর৷ সেই কারণে অপেক্ষাকৃত সুস্থ লাগছে৷ আস্তে আস্তে নেমে পড়েন গাছ থেকে জয়নাগ৷

দক্ষিণ দিকে গঙ্গা৷ নদীর তীরে পৌঁছে যদি নৌকা করে পালানো যায়৷ ওদিকে শত্রুসৈন্য না আসার সম্ভাবনা বেশি৷ মনে ভীষণ কষ্ট হয় কর্ণসুবর্নর জন্য৷ না জানি প্রজাদের উপর কী অত্যাচার শুরু করেছেন কামরূপরাজ! এ ভয়ানক দুষ্কর কাজ৷ চোয়াল শক্ত হয়৷ এখন মূল সমস্যা নিজের অস্ত্র আর শশাঙ্কের খড়্গ এই দুটি নিয়ে হাঁটা তাও শত্রুসৈন্যর চোখ এড়িয়ে৷ অস্ত্র এবং রক্তমাখা বস্ত্র দুই শত্রুর চোখে পড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়৷ মা ভবানীকে প্রণাম করে হাঁটতে থাকেন জয়নাগ৷ বহু ক্রোশ পথ এভাবেই হাঁটতে থাকেন৷ পথশ্রমে ক্লান্ত হন, বিশ্রাম নেন, আবার হাঁটতে থাকেন৷ রক্তে ঘামে মাটি ভিজে পিচ্ছিল হয়ে ওঠে৷ ভগবান বোধহয় সাহসীদের সঙ্গ দেন৷ এ সাক্ষাৎ দৈবী কৃপা৷ জয়নাগ এসে পড়েছেন কাঙ্ক্ষিত স্থানে৷

ওই যে কুলুকুলু নদীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ কল্লোলিনী পূণ্যতোয়া গঙ্গাকে দেখতে পাচ্ছেন জয়নাগ৷

আরে! ওটা কী? একটা জেলে নৌকা না?

তাড়াতাড়ি করে কাছি দিয়ে বাঁধা নৌকাটির দিকে অগ্রসর হন জয়নাগ৷ পা থেকে রক্ত ঝরছে আবার অনেক ক্ষত থেকেও রক্ত পড়ছে৷ এতক্ষণের পথশ্রম জয়নাগকে ভীষণ দুর্বল করে দিয়েছে৷ প্রবাদেই আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়৷ গলুইয়ের মধ্যে মাঝির পোষাক পেয়েছেন ভাগ্যক্রমে জয়নাগ৷ একনিমেষে নিজের পোষাক খুলে গলুইয়ের মধ্যে রেখে মাঝির পোষাক পরে নিলেন৷ উর্ধ্বাঙ্গ তার এখন অনাবৃত৷

ঠিক সেই সময়ই দু’জনের কথা শুনতে পেলেন জয়নাগ৷ সর্বনাশ! দুই শত্রুসৈন্য আসছে এই দিকেই৷ তাদের গল্প করার বিষয়বস্তু অনুধাবন করতে পারছেন জয়নাগ৷ রণক্ষেত্রের পরাক্রমের কথা তারা বীরদর্পে বলাবলি করছে৷ জয়নাগ ভাবতে থাকেন কী করবেন৷ হাতে দুটি অস্ত্র৷ এই অস্ত্র নিয়ে ভরা গঙ্গায় সাঁতার কাটা মূর্খামি৷ আবার অস্ত্রদুটি ফেলে জলে লাফ মারাও সমীচীন নয়৷ এ দুটি তার প্রাণাধিক প্রিয়৷ অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে৷ তা ছাড়া মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কের নামাঙ্কিত খড়্গ! এটাই তার কাছে রাজদণ্ড স্বরূপ৷ হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়৷ নিজের পোষাকের সঙ্গে অস্ত্রদুটিও নৌকার খোলের ভিতর লুকিয়ে ফেলেন জয়নাগ৷ এটি জেলে নৌকা৷ কাজেই মাছ ধরার উপকরণও নিশ্চিত আছে৷

হ্যাঁ! ভাগ্য সুপ্রসন্ন৷ মাঝির জালটাও সহজে পেয়ে যান৷ এবার জেলে সাজার অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে৷ নৌকায় উঠে বসে কাছি খুলে বৈঠা বাইতে থাকেন৷

নদীর তীরের সৈন্যরা বুঝতে পারে এক জেলে নৌকা নিয়ে মাছ ধরছে৷ চিৎকার করে বলে,

“কী কর্তা, মাছ কিছু পেলে? কতদিন বড় মাছ খাই না গো৷ সেই যবে বড় নদী ছেড়ে এসেছি তবে থেকে৷ দিয়ো কিন্তু বড় মাছ পেলে…”

জয়নাগ বোঝেন বড় নদী বলতে ওরা ব্রহ্মপুত্রকে বোঝাচ্ছে৷ বুদ্ধি করে স্রোতের উজানে যেতে যেতে দেহাতি ভাষায় জয়নাগ উত্তর দেন

“দিমু আগে তো পাই…”

নৌকা চলেছে৷ জয়নাগের পেট জ্বলে যাচ্ছে খিদেয়৷ আচ্ছা জেলে নৌকাতে মাঝিরা অনেকসময় খাবার রাখে৷ এখানে খাবার নেই?

জয়নাগ খোলের ভিতর হাত দিয়ে খুঁজতে থাকেন৷ যদি চিড়ে, মুড়ি বা অন্যকিছুও পাওয়া যায়!

আরিব্বাস! একটা হাঁড়ি পেয়েছেন জয়নাগ৷ তারমধ্যে হ্যাঁ অন্তত দিনতিনেক তো হবেই পুরোনো ভাত জল দিয়ে রাখা যা আসলে পান্তা৷ একটু টকটক গন্ধও বের হচ্ছে৷ তাতে কী! এই জলভাতই এখন জয়নাগের কাছে অমৃত৷

জয়নাগ গোগ্রাসে সেই অমৃতরূপী পান্তা খেতে থাকেন৷ খিদের নিবৃত্তি অনেকসময় শরীরের ক্লান্তি দূর করে৷ সাবধানে দেখে নেন নৌকার খোলের ভিতর তার তলোয়ার আর রাজাধিরাজ শশাঙ্কের খড়্গ পাশাপাশি রয়েছে৷ যাক! নিশ্চিন্ত৷ ঠান্ডা গঙ্গাজল আঁজলা করে তুলে চোখে মুখে ঝাপটা দেন জয়নাগ৷ টানটান করে শরীরটা গলুইয়ের উপর রেখে শুয়ে পড়েন৷ এখন একজন দেহাতী মাঝি ছাড়া তাকে কিছু মনে হচ্ছে না৷ জেলে নৌকা নিয়ে যে মাছ ধরতে বের হয়েছে৷ ঠান্ডা হাওয়ায় চোখের পাতা বুঁজে আসে৷ নৌকা ভাসতে থাকে স্রোতের উজানে৷

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় জয়নাগের৷ শত্রুর হাত থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছেন তিনি৷ যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্ব তো বটেই কিন্তু মনের ভিতর খটকাটা দূর হচ্ছে না কিছুতেই৷ মহারাজাধিরাজের গৌড় ছেড়ে জয়নাগকে পালাতে হবে এ কথা জয়নাগ ভাবতেও পারেন না৷ মানবাদিত্য যে সেই খড়্গের সঙ্গে অঘোষিত রাজপাটও দিয়ে গেছেন জয়নাগকে৷ একজন তুচ্ছ নগন্য সেনানী জয়নাগ, তাকে বিশ্বাস করেছেন গৌড়অধিপতি স্বয়ং৷ এ বিশ্বাস এ প্রতিজ্ঞার মান তাকে যে কোনও মূল্যেই রাখতে হবে৷

পান্তাভাতে সর্বগ্রাসী খিদের আংশিক প্রশমন হয়েছে বটে৷ কিন্তু জয়নাগের এখন দরকার উপযুক্ত বস্ত্র, শিরস্ত্রান, সেনাদলের৷ এরজন্য অর্থ দরকার৷ কিন্তু তিনি নিজেই পলায়নরত৷ মাতৃভূমি গৌড় আজ প্রাগজ্যোতিষপতি ভাস্করবর্মার করায়ত্ত৷ শশাঙ্কের গুপ্ত ধনভান্ডার লুন্ঠন ভাস্করবর্মার জীবনের এখন মূলমন্ত্র৷ এই বিপদের দিনে কে জয়নাগকে সাহায্য করবে? আজ জয়নাগ বড় একা৷ দরকার তার বিশ্বস্ত সৈন্যদলের৷

॥ ৩ ॥

সন্ধ্যা নামে গঙ্গাবক্ষে৷ কালো আকাশের বুকে একটি দুটি তারা ফুটে উঠতে থাকে৷ হঠাৎ জয়নাগের চোখে পড়ে দূরে কতগুলি আলোক বিন্দু গঙ্গাবক্ষে৷ তার মানে ওইদিকে আরও নৌকা আছে৷ আনন্দ হয় জয়নাগের৷ আনন্দে উচ্ছসিত জয়নাগ নিজের নৌকার মুখ সেদিকে ঘুরিয়ে দেন৷ নৌকা সেই আলোর দিকে তরতর করে এগিয়ে চলে৷ যখন আলোকবিন্দুর নিকটবর্তী হয়েছে জয়নাগের জেলে নৌকা হঠাৎ জয়নাগকে বিস্মিত করে আলোকবিন্দুগুলো নিভে গেল৷ চারিদিক এখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার৷

জয়নাগ বিস্মিত হন৷ এ আবার কী! এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধতা বিরাজ করে৷ হঠাৎ জয়নাগ খেয়াল করেন তিন-চারটে ছিপনৌকা তার নৌকার পাশে এসে লেগেছে৷

ছিপ নৌকা থেকে প্রশ্ন আসে – “কে রে…”

জয়নাগ বুঝতে পারেন এরা ডাকাত৷ দেশের অরাজকতার সুযোগে এরা নদীতে ঘোরে আর ডাকাতি করে৷ এমনি শশাঙ্কের মৃত্যুর পর নদীতে জলদস্যুর উপদ্রব বেড়েছে৷ মানবাদিত্য চেষ্টা করেও তা দমন করতে পারেননি৷ সওদাগরী নৌকার জিনিসপত্র লুন্ঠন, নদীতীরবর্তী গঞ্জে হঠাৎ রাতের আঁধারে আক্রমণ চালিয়ে সর্বস্ব লুঠ করে এরা৷

হঠাৎই মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো চিন্তা খেলে যায়৷ আচ্ছা! এরা ডাকাত হলে কী হয় এরা বীর যোদ্ধাও তো বটে! এরকম যোদ্ধারই তো এইসময়ে প্রয়োজন তাঁর৷

নিজের কর্তব্য ঠিক করে নেন জয়নাগ৷ চিৎকার করে বলেন – “আমি তোদের সর্দার…”

ওপাশ থেকে কোনও আওয়াজ আসে না৷ বেশ কিছুক্ষণ পর একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ জয়নাগের কানে আসে – “তু সর্দার আছিস?”

অন্যপ্রান্তে সন্দেহের মেঘ উঁকি দিচ্ছে৷ আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ৷ হঠাৎ ছিপ নৌকার মধ্যে ক্যানেস্তারা চাপা মশাল জ্বলে উঠল৷

এই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় ছিলেন জয়নাগ৷ নৌকার খোলের ভিতর থেকে মহারাজ শশাঙ্কের নামাঙ্কিত খড়্গ নিয়ে নিজে লাফ মারলেন ডাকাতদের ছিপ নৌকায়৷ জয়নাগের বিক্রম দেখে ডাকাতরা একটু দমে গেছে৷ কিন্তু সম্মেলিত আক্রমন করতে কতক্ষণ?

মনস্তাত্ত্বিক একটা লড়াই চালাতে হবে – ভাবলেন জয়নাগ৷ গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন – “তোমাদের মধ্যে কেউ পড়ালেখা জানা আছে?”

দৈব যেন সাথ দিচ্ছিল জয়নাগের৷ সবই মা ভবানীর কৃপা৷ এই ডাকাত দলে যে একজন ছোটবেলায় টোলে সংস্কৃত পড়া ব্রাহ্মণ থাকবেন এ তো জয়নাগের স্বপ্নেরও অতীত৷

ব্রাহ্মণ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছেন৷ অন্য ডাকাত সঙ্গীরা তাকে পথ করে দিচ্ছে৷ মশালের আলোয় ব্রাহ্মণের দিকে জয়নাগ খড়্গের হাতলটা ধরে দেখালেন৷ এই মশালের আলোয় ব্রাহ্মণের চোখে যুপপৎ বিষ্ময় আর আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখছেন জয়নাগ৷

শুধু ব্রাহ্মণ বলে উঠল – “মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কদেব…”

ব্রাহ্মণের দু’চোখে এখন জলের ধারা৷ নতজানু হয়ে বসে আছেন জয়নাগের পদপ্রান্তে৷ অন্য ডাকাতদের মধ্যেও ভাবান্তর হয়েছে৷ সমস্বরে সবাই বলে উঠেছে – “শশাঙ্কদেব!”

“এ অস্ত্র তুমি কোথায় পেলে?” জিজ্ঞাসা করলেন ব্রাহ্মণটি৷

এরপরের ঘণ্টাখানেক পুরোটাই বোধহয় জয়নাগের৷ নির্জন গঙ্গাবক্ষে তিনি সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন ডাকাতদের৷ তার বক্তব্যে দেশপ্রেম, নাগরিক কর্তব্যের কথা, শশাঙ্কর শেষ উত্তরাধিকারী মানবাদিত্যের কথা, তাঁর শেষ ইচ্ছা, জয়নাগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া কোনও কিছুই বাদ থাকল না৷

ডাকাত দলের সবাই একমনে শুনে যাচ্ছে জয়নাগের ভাষণ৷ ভাষণান্তে যখন ডাকাতদলের মুখনিঃসৃত উল্লাসধ্বনি “জয় শশাঙ্কদেবের জয়” শুনতে পাচ্ছিলেন জয়নাগ তখন বুঝলেন ওষুধে কাজ হয়েছে৷ তার প্রথম পদক্ষেপ সফল৷ এখন তিনি একা নন৷ যুদ্ধ করার মত অতি অল্প পরিমাণে হলেও তার একটা দল আছে৷ ওই ছিপ নৌকার ডাকাতদের উল্লাসধ্বনি শুনে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এল অজস্র ডাকাতদের ছিপনৌকা৷ কোনও নৌকায় পঁচিশ, কোথাও তিরিশ এরকম সব দল জয়নাগকে এখন ঘিরে আছে৷ শুনছে তার দেশাত্মবোধে ভরপুর জ্বালাময়ী ভাষণ৷

রাত শেষ হবার আগেই জয়নাগের চারপাশে আষাঢ়ে গল্প শোনালেও এটা ভীষণ বাস্তব, ডাকাতের সংখ্যা পাঁচশো ছাড়াল৷ আর ঠিক এক মাসের মধ্যে জয়নাগ হয়ে উঠেছেন প্রায় পাঁচহাজার সৈন্যদলের সেনানায়ক৷ প্রান্তিক চাষী, মজুর, জেলে সবাই আসছে এই স্বাধীনতা যুদ্ধে সামিল হতে৷ শুধু ডাকাতরাই নয় গ্রাম গঞ্জের সাধারণ প্রান্তিক মানুষরাও সর্বাধিনায়ক মেনে নিয়েছেন জয়নাগকে৷ তার উপর সবার অটুট বিশ্বাস৷

জয়নাগের বাহিনী শুধু নৌবাহিনী৷ তারা বন্দরে যায় না৷ গঞ্জ বা শহর লুন্ঠন করে না৷ শুধু নদীবক্ষে তাদের অতন্দ্র পাহারা৷ কামরূপরাজের নৌবাহিনী নেই৷ কোনও কালেই ছিল না৷ ডাঙা বা ভূখন্ড থেকে ভাস্করবর্মার সেনাদের পক্ষে জলে থাকা জয়নাগের সঙ্গে যুদ্ধ করা অসম্ভব৷ তারপর এই সুবিশাল নদীবক্ষে কোথায় কখন যে জয়নাগের নৌবাহিনী লুকিয়ে বসে আছে কেউ জানে না৷

ভাস্করবর্মা পড়েছেন মহাসংকটে৷ মানবাদিত্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্রচুর সৈন্যহানি হয়েছে৷ সৈন্যসংখ্যা এখন প্রায় অর্ধেক৷ আরও সৈন্যর প্রয়োজন৷ তা আনতে হবে কামরূপ থেকে৷ কিন্তু খবর দেবেন কীভাবে? জলপথ ছাড়া গতি নেই খবর পাঠানোর৷ অথচ জয়নাগের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে জলপথে সৈন্য পাঠানো অসম্ভব৷ ভাস্করবর্মা বেশ বুঝছেন তিনি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন৷ গৌড় থেকে কোনও খবর যেমন কামরূপে যাচ্ছে না তেমনি কামরূপের কোনও খবর পাচ্ছেন না ভাস্করবর্মা৷

দেশপ্রেমের জোয়ার একেই বলে৷ আপামর গৌড়বঙ্গ বাসীরা, সাধারণ মানুষরা জয়নাগের ছাতার তলায় দাঁড়িয়েছেন৷ জয়নাগের সৈন্যসংখ্যা এখন বিশহাজার প্রায়৷

সুযোগ খুঁজছেন জয়নাগ৷ এবার সরাসরি আক্রমণের সময় উপস্থিত৷ হলও তাই৷ এক দ্বিপ্রহরে ভাস্করবর্মা এক গোপন পরামর্শ সভা ডাকলেন৷ সবাই একমত জলপথের দখল নিতে হবেই জয়নাগের হাত থেকে৷ সেই শলা-পরামর্শ মতো কাজ শুরু করলেন অমাত্য পরিষদ৷ জলপথের দখল নেওয়ার জন্য গঙ্গাবক্ষে বিরাট হস্তীবাহিনী নামিয়ে দিলেন ভাস্করবর্মা৷ হাতির দল জলের মধ্যে৷ জয়নাগের নির্দেশে ডাকাতদল তীর বর্ষণ করতে লাগল৷ হাতির শুঁড়ে পায়ে বিঁধল তীর৷ হাতিরা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে এদিক ওদিক জলের স্রোতে ভেসে গেল৷ মাহুত ও সেনাদের অবস্থাও তথৈবচ। চারদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমনে শত্রুসৈন্যদের প্রাণান্তকর অবস্থা৷

প্রচুর ক্ষতি হল ভাস্করবর্মার৷ শুল্ক বা কর পর্যন্ত দিচ্ছে না প্রজারা৷ কোথায় বা আছে শশাঙ্কের বহুমূল্য রত্নপেটিকা, বিশাল ধনসামগ্রী৷ বহু খুঁজেছেন তিনি৷ সুকৌশলে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে তার হদিশ পাচ্ছেন না৷

এরকমই একদিনে ভাস্করবর্মা খবর পেলেন তিনি অবরুদ্ধ৷ চারদিক ঘিরে ফেলেছে জয়নাগ বাহিনী৷ অসহায় ভাস্করবর্মা প্রমাদ গুনছেন৷ পত্র গেল প্রিয় সুহৃদ হর্ষবর্ধনের কাছে৷ সাহায্য চেয়েছেন বিপদের দিনে পরম মিত্র হর্ষবর্ধনের কাছে৷ কিন্তু হর্ষবর্ধন এখন অনেক পরিবর্তিত৷

অবলোকিতেশ্বরের চরণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন৷ অহিংসার পথ শ্রেষ্ঠ পথ বলে আজ বিশ্বাস হর্ষের৷ বন্ধুকে পত্র দিলেন – ‘হানাহানিতে দরকার কী? আপনি দেশে ফিরে যান৷ ধর্মাচরণে মন দিন৷ লোভ মানুষের ক্ষতি করে৷ মানবধর্ম রক্ষাই রাজার কর্তব্য৷ অহিংসা পরম ধর্ম৷’

ভাস্করবর্মা হার স্বীকার করলেন জয়নাগের কাছে৷ জয়নাগের সমস্ত শর্ত মানতে আজ বাধ্য কামরূপরাজ৷

“অস্ত্র, সম্পদ হাতি ঘোড়া সব দিয়ে চলে যান নিজের দেশে৷ কথা দিচ্ছি আপনার কোনও ক্ষতি হবে না৷”

ভাস্করবর্মা বাধ্য হলেন সে শর্ত মানতে৷ মাথা নিচু করে সব শর্ত মেনে কামরূপ ফিরতে হল ভাস্করবর্মাকে৷

গৌড়বঙ্গের সিংহাসনে এখন জয়নাগ৷ না, জয়নাগ মানবাদিত্যের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা রাখতে পেরেছেন৷ জয়নাগ পরবর্তীতে ভূমিসংস্কার, নতুন মুদ্রার প্রবর্তন করেছিলেন৷ উপাধি নিয়েছিলেন প্রকাণ্ডযশাঃ৷ তবে একথাও ঠিক তার স্বল্প সময়ের শাসনের পরই বঙ্গে মাৎস্যন্যায় শুরু হয়েছিল৷ তা আমাদের এ কাহিনির বিবেচ্য নয়৷

(কিছু কথা: রমেশ মজুমদারের মতো স্বনামধন্য ঐতিহাসিক জয়নাগের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন৷ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই মত পোষণ করেছেন৷ স্বনামধন্য ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ও জয়নাগকে মাৎস্যন্যায় যুগের স্বল্প সময়ের জন্য রাজা হওয়ার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন৷ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পতেও জয়নাগের অস্তিত্ব আছে৷ অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন জয়নাগ জয়গুপ্ত নাম নিয়েছিলেন৷ কিন্তু যে সমস্যাটা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু তা হল জয়নাগ শশাঙ্কের পূর্ববর্তী না পরবর্তী৷ ঐতিহাসিক রাধাগোবিন্দ বসাক বলেছেন শশাঙ্কের পূর্ববর্তী ছিলেন জয়নাগ৷ জয়নাগের অধীনস্থ সামন্ত ছিলেন শশাঙ্ক৷ এ কথা অনস্বীকার্য জয়নাগ কর্ণসুবর্ণের জয়াস্কন্ধাবার থেকে ভূমিদান করেছিলেন প্রজাদের৷ আমরা অধ্যাপক মজুমদার ও আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পর তত্ত্বের উপর গুরুত্ব দিয়েছি৷)

.

কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

পেশায় কলেজ গ্রন্থাগারিক। শখ লেখালেখি। কবিতা লেখা দিয়ে শুরু। পরে “মরীচিকা”, “নির্মাল্য”, ‘শব্দলেখা’, “অক্ষর সংলাপ”, “প্রয়াস”, “এই সময়” সহ বিভিন্ন শারদীয়াতে লিখেছেন। অনেক পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে  একটি একক ছোটগল্পের সংকলন পলান্ন প্রকাশনী থেকে ‘রামধনুর রাগবিস্তার’ এবং একটি রহস্য গল্পের সংকলন ‘দুঃস্বপ্নের খুনিরা’ দ্য কাফে টেবল থেকে। অনেক লেখকের সঙ্গে অলৌকিক ও রহস্য গল্পের সংকলনও প্রকাশিত হবে আগামীতে। প্রকাশিত হতে চলেছে কবিতার সংকলনও। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে বিদ্যানন্দ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘ভূতোপনিষদ’-এও সংকলিত হয়েছে গল্প।
 

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন