বিশ্বরূপ মজুমদার
নিজের কক্ষে বসে মগধের রাজমাতা বৈদেহী। মন একদম ভালো নেই। বেশ বিচলিত। সারা রাজ্যে উৎসব চলছে। রাজবাড়ি সেজে উঠেছে আলোকমালায়। বাজছে মাঙ্গলিক সুর। কিন্তু সেই সুরের মধ্যে যেন ঘোর অমঙ্গলের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন তিনি। ঝলমলে আলোয় অন্ধকারের অশনি সংকেত। অথচ আজ তার খুশি হওয়ার কথা। পুত্র অজাতশত্রু মগধের সিংহাসনে বসেছে। মাতা হিসেবে এদিন তার কাছে আনন্দের। কিন্তু আনন্দিত হতে পারছেন কই? অজানা ভয় আর আতঙ্কে শিহরিত হয়ে উঠছেন।
কক্ষে প্রবেশ করে রানিকে দেখে বিম্বিসার অবাক হন।
‘কী ব্যাপার রানি, তোমাকে এমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন?’
‘আমার মন ভালো নেই।’
‘কেন? আজ তো আনন্দের দিন। ছেলে মগধের সিংহাসনে বসেছে। তুমি খুশি হওনি?’
‘খুশি হতে পারছি না মহারাজ।’
‘কেন? তুমি চাও না অজাতশত্রু রাজা হোক?’
‘আপনি থাকতে থাকতে সে সিংহাসনে বসুক, এটা আমি চাইনি।’
‘দ্যাখো রানি, আমার বয়স হয়েছে। রাজ্য শাসনের ঝামেলা, দুশ্চিন্তা ত্যাগ করে এখন ধর্মেকর্মের কাজে বেশি মনোনিবেশ করতে চাই। অজাতশত্রু রাজ্য চালানোর উপযুক্ত। সে রাজা হয়ে ভালোই হয়েছে।’
‘মহারাজ…’
‘রানি, আমি কিন্তু আর মহারাজ নই।’
‘আমার কাছে আপনি সবসময় মহারাজই থাকবেন।’
বিম্বিসার কিছু বলেন না। বৈদেহী বলে চলেন, ‘যেভাবে অজাতশত্রু রাজা হয়েছে সেটা আমি মানতে পারছি না।’
বৈদেহীর অখুশি হওয়া স্বাভাবিক।
অজাতশত্রুর গুরু বৌদ্ধভিক্ষু দেবদত্ত। তথাগত বুদ্ধ তার গুরুদেব। দেবদত্ত সিদ্ধিলাভ করলেও নির্বাণ লাভ করতে পারেননি। তার মধ্যে জেগে ওঠে ক্ষমতার লোভ। তথাগতের জায়গায় নিজেকে দেখার স্বপ্ন দেখেন তিনি। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু নিজ লক্ষ্যে মরীয়া তিনি। মগধরাজ বিম্বিসার তথাগতর শিষ্য। দেবদত্তের মনে হয় রাজ-আনুগত্য সঙ্গে থাকায় তথাগতর এমন প্রতিপত্তি। তিনি ভাবেন স্বপ্নপূরণ করতে গেলে তারও রাজ-আনুগত্য থাকা দরকার। মগধের যুবরাজ অজাতশত্রু তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। দেবদত্ত তাকে পরামর্শ দেন পিতাকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসার। এক তীরে দুটো লক্ষ্যে আঘাত হানতে চেয়েছিলেন তিনি। অজাতশত্রু রাজা হলে রাজ আনুগত্য তার অনুকূলে থাকবে। আর বিম্বিসারের মৃত্যু হলে তথাগত দুর্বল হয়ে পড়বে।
দেবদত্তের নির্দেশ মেনে পিতাকে হত্যা করার উদ্যোগ নেন অজাতশত্রু। কিন্তু তার অভিসন্ধির কথা জানতে পারেন রাজা বিম্বিসার। স্বেচ্ছায় রাজ সিংহাসন ছেড়ে দেন তিনি।
বিম্বিসার শান্ত কন্ঠে বলেন, ‘ওইসব ব্যাপার নিয়ে বেশি ভেবো না।’
‘ভাবব না! কী বলছেন আপনি! এত বড় অন্যায়! রাজা হয়ে এমন অন্যায় আপনি মেনে নিলেন কী করে!’
‘রানি, রাজা নয়, এক পিতা হিসেবে আমি তোমার কথার জবাব দিচ্ছি। সন্তানেরা অনেক সময় ভুল করে। বাবা-মাকে মাঝে মাঝে ছোটখাটো ব্যাপার ক্ষমার চোখে দেখতে হয়।’
‘এটাকে আপনার ছোটখাটো ভুল মনে হচ্ছে? আপনি যদি স্বেচ্ছায় রাজ্য ছেড়ে দিতেন তাহলে কী হত?’
‘যা হয়নি তা নিয়ে কেন কথা বলছ? এই সমস্যা মিটে গেছে।’
‘আমার তা মনে হয় না।’
‘দ্যাখো, অজাতশত্রু রাজা হতে চেয়েছিল। সেই কারণে সে ভুল পথে গিয়েছিল। এখন সে রাজা হয়েছে। সুতরাং সমস্যা আর কোথায়?’
‘মহারাজ, পুত্র স্নেহে আপনি অন্ধ। আপনি ভুলে যাচ্ছেন অজাতশত্রু আপনাকে হত্যা করতে যাচ্ছিল। যে সাপ একবার ছোবল মারার চেষ্টা করে তাকে কখনও বিশ্বাস করা যায়?’
‘নিজের সন্তান সম্পর্কে এমন কথা বলতে তোমার খারাপ লাগছে না?’
‘না, লাগছে না। আমার খারাপ লাগছে, তাকে আমি গর্ভে ধরেছি। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।’
‘এরকম একদম ভেব না। ছেলে রাজা হয়েছেন আনন্দ করো।’
‘এর মধ্যে আনন্দ করার কিছু নেই। উল্টে আমি ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পাচ্ছি।’
‘তুমি মিথ্যে দুশ্চিন্তা করছ।’
‘না মহারাজ, মিথ্যে নয়। জ্যোতিষীর কথা আমি ভুলিনি। সেটা ভেবে সবসময় ভয়ের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাই।’
বিম্বিসার সে কথার সহসা কোনও জবাব দিতে পারেন না।
* * * * *
সেদিনও ছিল এমন একটা দিন। এক ভয়ঙ্কর বিষণ্ণ প্রহর। গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন বৈদেহী। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই তার জীবনে অন্ধকার মাখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কেন? এ-সন্তান তো অবাঞ্ছিত নয়। বিম্বিসারের ঔরষজাত সে সন্তান। তবুও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মা হয়ে রাক্ষসী হয়ে উঠেছিলেন।
রাক্ষসী! বেশ কিছুদিন ধরে এই শব্দটা ভাবিয়ে তুলেছিল বৈদেহীকে। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতেন সত্যিই তিনি মানবী তো নাকি রাক্ষসী? মানুষ হয়ে কেউ অন্য মানুষের রক্ত পান করতে পারে?
সবে সন্তান গর্ভে এসেছে। রানি খুব খুশি। রাজা বিম্বিসারও। বংশের উত্তরাধিকারীর মুখ দেখার আকাঙ্ক্ষায়, পিতৃত্বের পরিচয়ের অপেক্ষায় আনন্দে আত্মহারা। সবসময় তিনি চেষ্টা করেন রানিকে হাসিখুশিতে রাখার।
এদিকে কয়েকদিন হল বৈদেহীর মনে শান্তি নেই। অস্বস্তি তাকে অস্থির করে রেখেছে। অদ্ভুত একটা সাধ হয়েছে তার মনে। কিন্তু সে কথা কিছুতেই মহারাজকে বলতে পারছেন না। তীব্র মানসিক অস্বস্তিতে কাটতে থাকে তার। মনের সুখ, শান্তি হারিয়ে যায়। বিষণ্ণতা গ্রাস করে তাকে।
বিম্বিসারের চোখে ব্যাপারটা এড়ায় না। একদিন তিনি রানিকে জিজ্ঞেস করেন। ‘রানি, কী হয়েছে তোমার?’
‘কিছু হয়নি মহারাজ।’ বৈদেহী ব্যাপারটা এড়াতে চান।
‘কিছু হয়নি বললে হবে? সবসময় দেখছি তুমি কেমন মনমরা হয়ে থাক। হাসিখুশি ভাব উধাও। সবসময় কিছু চিন্তা করছ। কী হয়েছে? কোনও সমস্যা?’
‘না, মহারাজ, কোনও সমস্যা নয়।’
‘তুমি মিথ্যে বলছ।’
‘বিশ্বাস করুন মহারাজ।’
‘আমার চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না। স্পষ্ট বুঝতে পারছি কোনওকিছু তোমাকে বিচলিত করে রেখেছে। আমার কাছে সত্যটা লুকোচ্ছ তুমি।’
বৈদেহী বুঝতে পারেন তিনি ধরা পড়ে গেছেন। কিন্তু তার মনে যে ভয়ঙ্কর ইচ্ছার কথা রাজাকে বলবেন কী করে? কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে সে কথা বলা সম্ভব নয়। কিছু না বলে চুপ করে থাকেন তিনি।
‘রানী, চুপ করে থেকো না। আমি তোমার স্বামী। তোমাকে আমি ভালোবসি। তোমাকে বিষণ্ণ দেখলে আমি একদম ভালো থাকতে পারি না। কী হয়েছে তোমার বলো।’
রাজার বারংবার অনুরোধে বৈদেহীর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। আমতা আমতা করে বলেন, ‘মহারাজ, আপনি তো জানেন গর্ভাবস্থায় মেয়েদের নানা কিছু খাওয়ার সাধ জাগে। আমারও তেমনই একটা সাধ হয়েছে।’
‘ও এই কথা।’ রাজা মৃদু হেসে বলেন, ‘এর জন্য তুমি মন খারাপ করে বসে আছ? তোমার কী খাওয়ার সাধ হয়েছে বল। আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করব।’
বৈদেহী বলতে পারেন না। তা দেখে মহারাজ বলেন, ‘রানি তোমার মনের কথা তুমি নিঃসঙ্কোচে বলো। না বললে আমি কিছুতেই মানসিক শান্তি পাব না। তুমি কি চাও আমি মানসিক অস্থিরতার মধ্যে কাটাই।’
রাজার আবেগপূর্ণ কথায় মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন বৈদেহী। কিছুক্ষণ সময় নেন মনের সঙ্গে লড়াই করতে। তারপর বেশ কুন্ঠার সঙ্গে বলেন, ‘মহারাজ, আমার সাধটা বড় অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর। আমার ইচ্ছে হয়েছে আপনার বামহাতের রক্ত পান করতে। জানি না কেন এমন অদ্ভুত সাধ হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই আমি এটা দমন করতে পারছি না।’
কথাটা বলে মাথা নিচু করেন বৈদেহী। রাজা মুহূর্তক্ষণ তার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকেন। তারপর মৃদু হেসে বলেন, ‘এই সামান্য কারণে তুমি এত কিন্তু কিন্তু করছ?’
* * * * *
রাজার রক্ত পান করে রানি কিছুতেই মানসিক শান্তিতে থাকতে পারেন না। ভাবেন, একজন সুস্থ মানুষ অন্য মানুষের রক্ত পান করতে পারে! তিনি মানবী তো? নাকি রাক্ষসী?
রাক্ষসী শব্দটি প্রতিনিয়ত তার মাথার মধ্যে ধ্বনিত হতে থাকে। তাকে অস্থির করে তোলে। অপরাধবোধ গ্রাস করে তাকে। কিন্তু কেন এমন সাধ হল? ব্যাপারটা জানার জন্য তীব্র বাসনা জেগে ওঠে মনের মধ্যে। রাজাকে তিনি জানান তার মনের কথা।
বিম্বিসার তার মনের অস্বস্তি দূর করতে রাজ্যের সেরা জ্যোতিষী নিয়ে আসেন। তিনি গণনা করে জানান, বাস্তবে রানি রাজার রক্ত পান করেননি। তার শরীরের মধ্যে আর একটা যে প্রাণ বেড়ে উঠছে সে এই রক্ত পান করেছে। অর্থাৎ পিতার রক্ত পান করেছে পুত্র, তাও জন্ম নেওয়ার আগেই। জ্যোতিষী গণনা করে আরও জানান, এই সন্তান পিতৃহত্যাকারী হবে। জন্মের আগেই থেকে এই সন্তান তার পিতার শত্রু অর্থাৎ অজাতশত্রু।
ভয়ঙ্কর সত্যিটা জানার পর মানসিকভাবে খুব বিচলিত হয়ে পড়েন বৈদেহী। একদিকে স্বামী, অন্যদিকে সন্তান। সন্তান তার মায়ের খুব আদরের, ভালোবাসার। প্রত্যেক মা চায় তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে। ওদিকে রাজা বিম্বিসার। তার স্বামী। স্ত্রী’র কাছে স্বামী দেবতা। কোনও স্ত্রী স্বামীর অমঙ্গল চায় না। গর্ভের সন্তান হবে স্বামীর হত্যাকারী, এ-যে তার নারী জীবনের বিরাট কলঙ্ক। স্বামীর হত্যাকারীকে জন্ম দেবেন তিনি? কোনও নারীর পক্ষে এটা সম্ভব?
ব্যাপারটা ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে বৈদেহীকে। স্বামী না পুত্র—এই ভাবনায় মানসিক টানাপোড়েনে পড়েন তিনি। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন, কোনওমতেই তিনি স্বামীর হত্যার দায়ী হতে পারবেন না। চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। পেটের মধ্যে বাড়তে থাকা শত্রুটাকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই শেষ করে দেবেন।
একদিন সবার অলক্ষ্যে তিনি চেষ্টা করেন গর্ভের শত্রুটাকে শেষ করে দেওয়ার। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই মুহূর্তে বিম্বিসার সেখানে এসে পড়েন। সবকিছু দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান।
‘এ-তুমি কী করতে যাচ্ছিলে রানি?’
‘আমার এটাই ঠিক মনে হয়েছে।’
‘রানি, তোমার গর্ভে যে আছে সে আমার সন্তান। আমাদের সন্তান।’
‘কিন্তু মহারাজ সেই সন্তান হবে আপনার হত্যাকারী। একজন স্ত্রী হয়ে সেটা আমি মানব কী করে?’
‘তুমি মিথ্যা ভয় পাচ্ছ। জ্যোতিষীর কথা সঠিক হবে এমনটা ভেবে নিচ্ছ কেন? ভুল তো হতে পারে?’
‘মহারাজ, আপনি তথাগতের অনুগামী। তার জীবনকথা আপনি জানেন। তার ভাগ্য গণনা করে জ্যোতিষীরা যা বলেছিল তা ফলেনি কি? তার পিতা অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু পেরেছেন কি ভবিষ্যৎটাকে বদলে দিতে?’
বিম্বিসার মুহূর্তক্ষণ চুপ থাকার পর বলেন, ‘জ্যোতিষীর গননা যদি সত্যও হয় তবুও আমি মনেপ্রাণে চাই আমাদের সন্তান পৃথিবীর আলো দেখুক। পিতৃপরিচয়ের সুখ থেকে আমি বঞ্চিত হতে চাই না।’
‘কিন্তু মহারাজ—’
‘রানি, আমি জানি তুমি কী বলতে চাইছ। একটা কথা ভেবে দেখ, জন্মেছি যখন মরতে তো একদিন হবেই। সন্তানহীন জীবন বড়ই বেদনার। না হয় জীবনের কয়েক বছর আয়ু কমে যাবে। কিন্তু সন্তানের মুখ তো দেখতে পাব। তার মুখে পিতা ডাক শুনতে পাব। সন্তানহীন দীর্ঘ্য জীবনের থেকে সন্তান সুখের কয়েক বছরের কম আয়ুর জীবন আমার কাছে অনেক বেশি সুখের।’
বৈদেহী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন।
বিম্বিসার বলে চলেন, ‘রানি, সন্তান যেমনই হোক, সে আমারই ঔরষজাত। আমি চাই সে এই পৃথিবীর আলো দেখুক। তুমি আমাকে কথা দাও, আর কখনওই এমন ভয়ানক কাজ করার কথা ভাববে না।’
বৈদেহী কিছু বলতে পারেন না। তিনি ভেবে পান না আনন্দিত হবেন নাকি দুঃখী। সন্তান আর স্বামী, দুই সুখ যে একসঙ্গে তার কপালে নেই সেটা অনুভব করে মনে মনে শিউরে ওঠেন।
* * * * *
গম্ভীর হয়ে বসে আছেন দেবদত্ত। তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ঘাবড়ে যান রাজা অজাতশত্রু। বুঝে পান না গুরুদেবের এমন অবস্থা কেন।
‘প্রভু, আপনি এমন গম্ভীর হয়ে আছেন কেন?’
দেবদত্ত মুখে কিছু না বলে কঠোর দৃষ্টিতে অজাতশত্রুর দিকে তাকান।
‘কোনও কারণে কি আপনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট?’
‘কোনও শিষ্য যদি গুরুর আদেশ অমান্য করে তাহলে তা গুরুকে আপমান করা হয়।’
শিউরে ওঠেন অজাতশত্রু। ‘এ-আপনি কী বলছেন! আমি আপনার কোন আদেশ অমান্য করেছি?’
দেবদত্ত গম্ভীর কন্ঠে বলেন, ‘মগধের উত্তরাধিকার নিয়ে আপনাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম, আপনি কি পালন করেছেন?’
‘প্রভু, আপনি চেয়েছিলেন আমি মগধের রাজসিংহাসনে বসি।’
‘কিন্তু সেটা বিম্বিসারকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে।’
‘আমি আপনার নির্দেশ অমান্য করিনি। আমি পিতাকে হত্যা করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই পিতা স্বেচ্ছায় রাজ্য ছেড়ে দিয়েছেন। আমার মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছেন।’
‘আর আপনি ভেবে নিলেন আপনি রাজা হয়ে গেছেন?’
‘আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।’ আমতা আমতা করে বলেন অজাতশত্রু। ‘রাজা তো আমি হয়েছি।’
‘কিন্তু সেটা কতদিনের জন্য? কতদিন থাকবে আপনার রাজত্ব?’
‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’
‘রাজা হতে গেলে রাজনীতি জানতে হয়। কূটনীতি জানতে হয়। সেটা আপনি আয়ত্ব করতে পারেননি।’
‘প্রভু, আপনি কী বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন।’
দেবদত্ত ক্ষোভ আর উত্তেজনামাখা সুরে বলে চলেন, ‘বিম্বিসার একজন দক্ষ রাজা। রাজনীতি আর কূটনীতি তিনি ভালো বোঝেন। এই মুহূর্তে আপনার কথা না মানলে তার প্রাণহানি ঘটত। তাই স্বেচ্ছায় রাজ্য ছেড়ে দিয়েছেন। ভাববেন না স্নেহপরবশ হয়ে তিনি এমন করেছেন। এটা আসলে একটা চাল। আপনাকে সাময়িকভাবে প্রতিহত করার জন্য এর থেকে ভালো কৌশল আর কিছু ছিল না। আসলে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য সময় নিয়েছেন। সময় এলে আপনাকে উচিৎ শিক্ষা দেবেন। এই রাজ্যও কেড়ে নেবেন।’
দেবদত্তের কথায় অজাতশত্রুর ভাবনাচিন্তা কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে। তার কথা না পারছেন পুরোপুরি মেনে নিতে, না অস্বীকার করতে।
দেবদত্ত বলে চলেন, ‘ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে যে কেউ এই চাল ধরে ফেলবে। আপনি পিতাকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন। আপনার পিতা একথা জানার পরও হাসিমুখে আপনাকে রাজ্য ছেড়ে দিলেন! একটা কথা ভাবুন, তিনি কেবল আপনার পিতা নন। এই রাজ্যের রাজা। রাজার বিরুদ্ধে এমন ভয়ানক ষড়যন্ত্র করার পরও তিনি আপনাকে ক্ষমা করে দিলেন! কোনও রাজার পক্ষে এটা সম্ভব? কেন তিনি আপনাকে শাস্তি দিলেন না? কেন হাসতে হাসতে রাজ্য ছেড়ে দিলেন? ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয় কী?’
দেবদত্তের কথা নাড়িয়ে দেয় অজাতশত্রুকে। তার মনে হয় কথাগুলো তিনি ভুল বলছেন না।
‘নিজের রাজত্ব স্থায়ী করতে গেলে আপনাকে সিংহাসন নিষ্কন্টক করতে হবে। না হলে মগধের দীর্ঘস্থায়ী রাজত্ব করার বাসনা অচিরেই ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে।’
‘আপনি আমাকে কী করতে বলছেন?’
‘যা আগে বলেছিলাম।’
‘কিন্তু এখন আমি রাজা। কোনও কারণ ছাড়া পিতাকে হত্যা করলে জনমানসে আমার সম্পর্কে বিরূপ ধারনা জন্মাবে।’
দেবদত্ত মুহূর্তক্ষণ ভেবে নিয়ে বলেন, ‘সরাসরি আপনার হত্যা করার প্রয়োজন নেই। এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।’
‘সেটা কীভাবে সম্ভব?’
‘শুনুন, আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে। কোনও অজুহাত দিয়ে বিম্বিসারকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করুন। তাকে অনাহারে রাখুন। বিম্বিসারের বয়স হয়েছে। বেশিদিন অনাহার সহ্য করতে পারবেন না। মারা যাবেন। আপনি মিথ্যে করে প্রচার করে দেবেন যে অসুস্থতার কারণে বিম্বিসার মারা গেছেন। লোকেও কথাটা অবিশ্বাস করবে না। আর সরাসরি পিতাকে হত্যা করার দায় থেকে আপনি মুক্তি পাবেন।’
দেবদত্তের পরিকল্পনা মাথায় ধরে অজাতশত্রুর।
* * * * *
রোজকার মতো কারাগারের ভেতর প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন বৈদেহী। রাজকর্মচারী পথ আগলে দাঁড়ান। ‘মাফ করবেন রাজমাতা, আপনার ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই।’
শিউরে ওঠেন বৈদেহী। ‘এ-তুমি কী বলছ? আমাকে ভেতরে যেতে দাও।’
‘সেটা সম্ভব নয় রাজমাতা।’
আরও কয়েকবার একই কথা বলেন বৈদেহী কিন্তু কর্মচারীর মুখে সেই একই কথা। বৈদেহী বুঝতে পারেন তার ভেতরে যাওয়া দরকার। না হলে তিনি বৃদ্ধ রাজাকে বাঁচিয়ে রাখবেন কী করে? কাতর সুরে বলেন, ‘রক্ষী, আমাকে একবার ভেতের যেতে দাও। আমি তোমাকে অনুনয় করছি।’
‘মাফ করবেন আমাকে। আমি কর্মচারী মাত্র। রাজার নির্দেশ পালন করা আমার কর্তব্য।’
‘কিন্তু কেন আমাকে যেতে দিচ্ছ না?’
কারারক্ষী কারণটা জানেন। সেটা প্রকাশ না করে বলে, ‘আমি জানি না রাজমাতা। আপনি ফিরে যান। কারাগারে আপনি প্রবেশ করতে পারবেন না।’
কথাটা শুনে বৈদেহী আবারও শিউরে ওঠেন। বুঝতে পারেন দেখা করতে না পারলে বিপদ। স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। কতদিন অনাহার সহ্য করবেন বৃদ্ধ মহারাজা? অশ্রুসজল কন্ঠে দ্বাররক্ষীকে বলেন, ‘আমাকে একটিবার ভেতরে প্রবেশ করতে দাও। আমি কয়েকটা কথা বলে চলে আসব।’
‘মাফ করবেন রাজমাতা। সে নির্দেশ নেই। আপনি চলে যান। বারবার অনুরোধ করে আমার অস্বস্তি বাড়াবেন না। আমার পক্ষে রাজার নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব নয়।’
বৈদেহী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তার মাথা ঘোরাতে থাকে। রাজার কথা ভেবে বিচলিত হয়ে পড়েন।
বিম্বিসারকে অনাহার কারদণ্ডের শাস্তি দিয়েছেন অজাতশত্রু। বৃদ্ধ রাজা। অনাহারে থাকলে মারা যাবেন। এভাবে রাজা মারা যান, স্বামী হত্যার কলঙ্ক পরোক্ষে তার ওপরও পড়ুক এটা বৈদেহী চান না। তাছাড়া কোন মহিলা চায় তার সিঁথির সিঁদূর মুছে যাক? তাই তিনি স্থির করেন যে করেই হোক স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রতিদিন একবার স্বামীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মেলে তার। সেটাকেই কাজে লাগান তিনি।
প্রথমে তিনি কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে খাওয়ার নিয়ে যেতেন বিম্বিসারের জন্য। এদিকে বেশ কিছুদিন পার হওয়ার পরও পিতাকে জীবিত দেখে সন্দেহ হয় অজাতশত্রুর। খোঁজখবর নেন তিনি। মায়ের গোপনে খাওয়ার নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার তিনি জানতে পেরে যান। নির্দেশ দেন মাতা কারাগারে গেলে সঙ্গে যেন কিছু না নিয়ে ঢোকেন।
বৈদেহী এরপর মাথার চুলের খোপার মধ্যে খাওয়ার লুকিয়ে নিয়ে যেতেন। একদিন তা ধরা পড়ে যায়। রাজা নির্দেশ দেন মাথার চুল খুলে তাকে কারাগারে প্রবেশ করতে। এরপর বৈদেহী জুতোর মধ্যে খাওয়ার লুকিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। সেটা ধরা পড়ার পর জুতো পরে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ হয়।
নতুন পন্থা নেন বৈদেহী। ভালো করে চান করে গায়ে মধু, ঘি, ক্ষীর মেখে কারাগারে যেতেন। বৃদ্ধ বিম্বিসার তার শরীর চেটে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করতে লাগলেন। এভাবেই দিনগুলি চলছিল। কিন্তু এ-কথাও অজাতশত্রুর কানে চলে যায়। তাই তিনি মায়ের কারাগারে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্বাররক্ষী অনুনয়ের সুরে বলেন, ‘রাজমাতা, আপনি আর এখানে থাকবেন না। চলে যান।’
বৈদেহী বুঝতে পারেন অনুনয় বিনয় করে কোনও লাভ নেই। মানসিকভাবে খুব আঘাত পান তিনি। খুব অসহায় মনে হয় নিজেকে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। নিজেকে সামলে কাতর সুরে রক্ষীকে বলেন, ‘আমি একবার কথা বলতে চাই।’
‘আপনি কেন বুঝতে পারছেন না রাজার আদেশ মানতে আমি বাধ্য।’
বৈদেহী আরও করুণ সুরে বলেন, ‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি। আমি কথা দিচ্ছি, ভেতরে যাব না। এই দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একবার কথা বলব। আমাকে একবার শেষদেখার সুযোগ দাও।’
বৈদেহীর কাতর অনুরোধ এড়াতে পারে না রক্ষী।
* * * * *
লোহার গারদের দু’পাশে দু’জন। কিছুক্ষণ কারও মুখে কোনও কথা নেই। রানির চোখ দিয়ে স্রোতের মতো জল গড়িয়ে পড়ছে। বৃদ্ধ বিম্বিসারের বুকেও কান্না জমে ওঠে। আপ্রাণ চেষ্টা করে সেই কন্নাকে চাপা দিয়ে রেখেছেন তিনি। তবুও চোখ দুটো ছলছল করতে থাকে।
নিজেকে সামলে বিম্বিসার বলেন, ‘চোখের জল ফেলো না রানি।’
‘মহারাজ, কী করে আমি চোখের জলকে আটকে রাখব? আপনার কথা ভেবে নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারছি না। এ-যে আমার কাছে কত যন্ত্রণার।’
‘কষ্ট পেয়ো না। তুমি অনেক করেছ। তা না হলে কবেই মারা যেতাম।’
‘কিন্তু না খেয়ে আপনি বাঁচবেন কী করে?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিম্বিসার বলেন, ‘আমার কথা ভেবো না রানি। আমার যা হওয়ার হবে। তাছাড়া আমার বয়স হয়েছে। মরতে তো একদিন হবেই।’
বৈদেহী চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর কিছুটা ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘সেদিন যদি আপনি আমাকে বিরত না করতেন তাহলে আজ এদিন দেখতে হত না।’
‘অতীতকে ভুলে যাও রানি।’
‘আমি পারছি না। সেদিন যদি গর্ভের শত্রুটাকে শেষ করে দিতাম, তাহলে আজ এই অবস্থা সৃষ্টি হত না। আমাকেও কলঙ্কের ভাগীদার হতে হত না।’
‘নিজেকে ছোট ভেবো না। তোমার কোনও দোষ নেই। সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানো কোনও মায়ের কাছে স্বর্গীয় কাজ। সেই সন্তান যদি কুপুত্র হয় তার দায় মায়ের নয়।’
‘আমাকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।’
‘আমি প্রবোধ দিচ্ছি না। যা সত্যি তাই বলছি।’ একটু থেমে বলেন, ‘আচ্ছা, আমার একটা কথার ঠান্ডা মাথায় জবাব দাও। তুমি গর্ভের সন্তানকে হত্যা করতে চাইছিলেন কেন?’
‘কারণ জ্যোতিষ গণনা করে বলেছিল সে পিতৃহন্তা হবে।’
‘তার মানে তুমি জ্যোতিষের কথা সেদিন বিশ্বাস করেছিলে। তাই তো?’
‘অবশ্যই।’ বৈদেহী কিছুটা অবাক সুরে মাথা নেড়ে বলেন।
‘তাহলে তুমি জ্যোতিষের বাণীকে ভ্রান্ত করতে কী করে? যেটা হবে সেটা রোধ করার ক্ষমতা কী তোমার ছিল?’
বৈদেহী এ-কথার কোনও জবাব দিতে পারে না।
বিম্বিসার বলে চলেন, ‘দ্যাখো রানি, আমি তুমি সব উপলক্ষ মাত্র। যা ঘটবে, তাকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। সেদিন যা ঘটেছে, আজ যা ঘটছে, আর আগামীতে যা ঘটবে সবই সময়ের পাতায় আগে থেকে লেখা আছে। এটাকে আমরা বলি নিয়তি। সেই নিয়তিকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের কারও নেই। তাই নিজেকে শক্ত কর। যা হওয়ার তাকে হতে দাও।’
‘কিন্তু এমনটা কেন হবে?’
‘এ-হয়তো আমার কোনও পাপের শাস্তি। হয়তো এই জন্মের, নয়তো পূর্বজন্মের। একে এড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয় দুজনের। তারপর বিম্বিসার বলেন, ‘রানি, চোখের জল মোছো। তুমি চলে যাও। তুমি থাকলে আমি দুর্বল হয়ে পড়ব। আমি জানি, আমার আয়ু আর বেশিদিন নেই। তবে যে ক’দিন পৃথিবীতে আছি এই কারাগারের নির্জনতায় বসে ভগবান বুদ্ধের সাধনা করে সময় কাটিয়ে দিতে চাই। তিনিই আমাকে উদ্ধার করবেন।’
বৈদেহী কিছু বলতে পারেন না। উদাস বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন স্বামীর দিকে।
* * * * *
খবরটা পেয়ে জোর আঘাত পান অজাতশত্রু। অপরাধবোধের যন্ত্রণা তাকে দগ্ধ করতে থাকে। অথচ আজকের দিনটা তার কাছে সবচেয়ে খুশির দিন হওয়ার কথা। একটা নয় একসঙ্গে দু’-দুটো সুখবর পেয়েছেন তিনি।
রাজসভায় বসেছিলেন অজাতশত্রু। এমন সময় এক কর্মচারী এসে তার হাতে একটা চিঠি দেন। জানতে পারেন তার সন্তান জন্মলাভ করেছে। সন্তানের জন্মের খবরে খুশিতে উদ্বেল হয়ে ওঠেন অজাতশত্রু। পৃথিবীতে নতুন পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। পিতা হওয়ার মধ্যে যে এত খুশি, এত আনন্দ, সেরকমটা আগে কোনওদিন অনুভব করতে পারেননি। খুশিতে প্রায় পাগল হওয়ার অবস্থা।
সহসা একটা ভাবনা নাড়া দেয় তাকে। মাথার মধ্যে ভেসে ওঠে পিতার মুখ। ভাবেন তার জন্মের পরও নিশ্চয়ই এমন খুশি হয়েছিলেন পিতা। তাকে পেয়ে নিশ্চয়ই এমনই আনন্দ বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। আক্রোশ ভুলে মনের মধ্যে ভালোবাসার গভীর আবেগ সৃষ্টি হয়। দেবদত্তর কথা ভুলে যান তিনি। রাজকর্মচারীকে নির্দেশ দেন পিতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসার জন্য।
যে কর্মচারী সন্তান জন্মের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন সে রাজার হাতে আর একটি চিঠি দেয়। সেটা পড়ে চমকে ওঠেন অজাতশত্রু। জানতে পারেন আজই মারা গেছেন পিতা।
এতদিন ধরে এই খবরের জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। পিতাকে হত্যা করার জন্য কত কিছুই না করেছেন। আজ সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। খুশি হওয়ার কথা তার। কিন্তু খুশি হতে পারছেন না একদমই।
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে অজাতশত্রুর। বুঝতে পারেন দেবদত্তের প্ররোচনায় বিরাট অন্যায় করেছেন তিনি। পিতা তাকে স্নেহ করতেন। পিতৃস্নেহের কিছু কথা শুনেছেন মায়ের কাছে। নিজেও উপলব্ধি করেছেন। তাছাড়া তার অন্যায়কে মাফ করে দিয়ে তাকে রাজ্য ছেড়ে দিয়েছেন। কতটা না ভালোবাসলে এতখানি উদারতা দেখানো যায়। সেই মহান, স্নেহময় পিতাকে তিনি তিলে তিলে দগ্ধ করে হত্যা করেছেন। অপরাধবোধের যন্ত্রণা ক্রমশ ভারী হয়ে চেপে বসে থাকে মনের মধ্যে। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারেন না।
সহসা মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। তার প্রতিও তো কম অন্যায় করা হয়নি। মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েন তিনি।
* * * * *
নিজের কৃতকর্মের জন্য মায়ের কাছে বারে বারে মাফ চান অজাতশত্রু। বৈদেহী বুঝতে পারেন না পিতৃহন্তারক সন্তানকে আদৌ মাফ করা যায় কিনা। তাছাড়া স্বামীকে তো আর ফিরে পাবেন না। চুপ করে থাকেন তিনি।
‘মাতা, আমি বুঝতে পেরেছি। বিরাট অন্যায় করেছি। আপনি আমায় ক্ষমা করুন।’
নিজেকে সামলান বৈদেহী। শান্ত কন্ঠে বলেন, ‘আমার মাফ করা বা না করায় কিছু যায় আসে না। যার প্রতি তুমি অন্যায় করেছ, তিনি অনেক আগেই তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন।’
‘সেটা কী করে সম্ভব?’
‘তার মন বড় উদার। ক্ষমাশীল। তা না হলে তুমি এই পৃথিবীর আলোই দেখতে পেতে না।’
‘কী বলতে চাইছেন?’
বৈদেহী কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর গড়গড় করে বলে যান শুরুর সব কথা। শেষে বলেন, ‘আমি মা হয়ে তোমার প্রতি নিষ্ঠুর ছিলাম। কিন্তু তিনি, নিজের ভয়ংকর পরিণতির কথা জেনেও তোমার প্রতি নির্দয় হননি। তিনি আকুলভাবে চেয়েছিলেন তুমি পৃথিবীর আলো দ্যাখো। নিজের জীবনকে মৃত্যুর কাছে বাজি রেখে তিনি তোমার জন্ম এঁকেছিলেন।’
সব শুনে বিস্ময়ে থ্ হয়ে যান অজাতশত্রু। তার বুকের মধ্যেকার যন্ত্রণা তীব্র হয়। নিজেকে আর সামলাতে পারেন না তিনি। মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে কান্নায় ফেটে পড়েন।
.
সৌরভকুমার ভূ্ঞ্যা
বসবাস: গ্রাম – তেরপেখ্যা, পোস্ট – মহিষাদল, জেলা – পূর্ব মেদনীপুর।
পেশা: শিক্ষকতা।
প্রকাশিত লেখা: দেশ, রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, কিশোর ভারতী, নবকল্লোল, শুকতারা, ফেমিনা, তথ্যকেন্দ্র, প্রসাদ, রোজকার অনন্যা, শপিজেন বাংলা, জলফড়িং, গল্পকুটীর, নতুন কবিসম্মেলন, আমার রূপসী বাংলা, কবিমন, সৃজন, সারাক্ষণ, আপনজন, দীনদর্পণ, সুখবর, ছোটোদের রূপকথা, ছোটোদের কলরব, বিচিত্রপত্র, কচিপাতা প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়।
প্রকাশিত গ্রন্থ: আঁধারে আলোর রেখা (গল্পগ্রন্থ), পরশপাথর (গল্পগ্রন্থ), রৌদ্রছায়া (গল্পগ্রন্থ), আলোছায়ার অন্দরমহল (গল্পগ্রন্থ), অন্ধকারে জেগে আছ (কাব্যগ্রন্থ), অক্ষরে আকাশ এঁকেছি (কাব্যগ্রন্থ), বিষাদ রংয়ের স্মৃতি (কাব্যগ্রন্থ), প্রার্থী হলেন ফটিকবাবু (উপন্যাস)।
সম্পাদিত গ্রন্থ: প্রিয় নারী প্রিয় গল্প (গল্প সংকলন), প্রেম ও প্রতিবাদের পদাবলী (কাব্য সংকলন), সাহিত্যের সময় সময়ের সাহিত্য (সাহিত্যের ইতিহাস), জাদু জোনাকির জন্ম (অণুগল্প), মহাজীবনের আলো প্রভৃতি।
সম্পাদিত পত্রিকা: মেঘপালক, সকলের কথা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন