নৌ-কমান্ডো

মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জলপথে হানাদার বাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম স্থানান্তর এবং পাকিস্তান থেকে খাদ্যসামগ্রী ও সেনাসদস্যদের পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার জন্য নৌ-কমান্ডো গঠন করা হয়। এ ছাড়া যুদ্ধের শুরু থেকে পাকিস্তানি সামরিক সরকার দাবি করে আসছিল যে দেশের পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে না। তার জবাবে বাংলাদেশের বন্দরগুলোতে একটি বড় ধরনের অভিযান চালিয়ে অনেকগুলো জাহাজ ডুবিয়ে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া দরকার ছিল যে বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে। নৌ-কমান্ডোরা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন নদী ও সমুদ্রবন্দরকে অকার্যকর করার জন্য অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করে। তাদের অভিযানগুলোর প্রায় সবগুলোই খুব সফল হয় এবং পাকিস্তান বাহিনীকে নদীপথ ব্যবহারে খুব বেকায়দায় ফেলে দেয়।

নৌ-কমান্ডো বাহিনী গড়ে উঠেছে মূলত পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে লুকিয়ে আসা আটজন বাঙালি সাবমেরিনারকে কেন্দ্র করে। ১৩ মে নৌকমান্ডো বাহিনী গঠন করা হয়। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এই নৌকমান্ডোদের প্রশিক্ষণ ও অভিযান পরিচালিত হতো। গোপনীয়তার প্রয়োজনে নৌ-কমান্ডোদের সংবাদ মাত্র পাঁচ-ছয়জন ব্যক্তির মধ্যে সীমিত থাকত। আমি তাদের মধ্যে একজন ছিলাম। সফলতার বিচারে মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডোদের অবদান অনেক বেশি। তারা সংখ্যায় ছিল মাত্র ৫০০ জনের কাছাকাছি। অথচ আগস্ট মাস থেকে পরিচালিত তাদের অভিযানগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের নৌপথ প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নৌ-কমান্ডোদের নির্বাচন, প্রশিক্ষণ ও অভিযানের পুরোটাই ভারতীয়রা এককভাবে করেছে। তবে এই বাহিনীর সফলতার জন্য যা যা সাহায্য ও সহযোগিতা করা সম্ভব ছিল, তা আমরা করেছি। মুক্তিযুদ্ধে এই নৌ-কমান্ডোদের অবদান বিশেষ স্বীকৃতির দাবি রাখে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করে ফ্রান্স থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া কয়েকজন সাবমেরিনারের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি যে কীভাবে তারা ফ্রান্স থেকে লুকিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করেছে। আমার নিজের সম্পৃক্ততা এবং নৌ-কমান্ডোদের কাছ থেকে তাদের বর্ণনার ভিত্তিতে এই বাহিনীর শুরু ও প্রথম একটি অভিযানের বর্ণনা দিলাম।

১৯৭০-৭১ সালে পাকিস্তান ফ্রান্স থেকে একটি সাবমেরিন ক্রয় করে। সাবমেরিনটির নাম ছিল ম্যানগ্রো। এটি ১৯৭০ সালের ৫ আগস্ট ফ্রান্সে কমিশন হয়। সাবমেরিনটি মার্চ মাসে ফ্রান্সের তুলোঁ বন্দরে অবস্থান করছিল। সাবমেরিন ম্যানগ্রোতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর মোট ৫৭ জন নাবিক প্রশিক্ষণরত ছিল, যার মধ্যে বাঙালি ছিল ১৩ জন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চে প্রশিক্ষণ শেষ করে ১ এপ্রিল সাবমেরিনটি পাকিস্তানের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল।

বিদেশি গণমাধ্যম ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞের সংবাদ গুরুত্বসহকারে প্রচার করে। এই সংবাদ শুনে তুলোতে অবস্থানরত বাঙালি নাবিকেরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানে ফেরত আসার বিষয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। তারা বিদেশি গণমাধ্যমের সাহায্যে জানতে পারে, পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক জনসাধারণ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ শুরু করেছে। অপর দিকে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সাধারণ জনগণ সীমানা অতিক্রম করে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। ২৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণ শুনে তাদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু একটা করার কথা চিন্তা করে। প্রথমে তারা সাবমেরিনটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তারা আলোচনার মাধ্যমে এই পরিকল্পনা পরিবর্তন করে জাহাজ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পেছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ফ্রান্সের মাটিতে পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করলে বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের বিপক্ষে যাবে, উপরন্তু জাহাজ ধ্বংস করার জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক ও অন্যান্য সরঞ্জাম এত অল্প সময়ে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। আর যদি সাবমেরিনটি ধ্বংস করেই ফেলে, তবে তাদের বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা নির্ঘাত ধরা পড়বে এবং বিচারে তাদের ফাঁসি হবে। দ্বিতীয়ত, লুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তারা পাকিস্তানকে নাজেহাল করতে পারবে।

সাবমেরিনে প্রশিক্ষণরত ১৩ জন বাঙালি নাবিকের মধ্যে ৯ জন গাজী মো. রহমতউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাকি ৪ জন সাবমেরিনারের পরিবার পাকিস্তানে থাকায় তারা পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। কিন্তু তারা প্রতিজ্ঞা করে, পাকিস্তান পক্ষত্যাগী দলটির গন্তব্য কোথায় তা তারা কিছুতেই ফাঁস করবে না। ৯ জন নাবিকের মধ্যে আবদুল মান্নান পথ ভুল করে লন্ডনে চলে যায়। বাকি ৮ জন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্পেনের মাদ্রিদ থেকে বিমানে রোম হয়ে ভারতে এসে উপস্থিত হয়। পাকিস্তান নৌবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৮ জন দুঃসাহসী সাবমেরিনার হলো :
ক. গাজী মো. রহমতউল্লাহ (বীর প্রতীক, পরে লেফটেন্যান্ট), চিফ রেডিও আর্টিফিসার;
খ. সৈয়দ মো. মোশাররফ হোসেন, ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার;
গ. আমিন উল্লাহ শেখ (বীর বিক্রম), ইলেকট্রিক আর্টিফিসার;
ঘ. বদিউল আলম (বীর উত্তম), ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্যাল;
ঙ. আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (বীর উত্তম, পরে কমোডর), রেডিও অপারেটর;
চ. আহসানউল্লাহ (বীর প্রতীক), ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্যাল;
ছ. আবদুর রকিব মিয়া (বীর বিক্রম, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক; এবং
জ. আবিদুর রহমান (বীর বিক্রম), স্টুয়ার্ড।
এই দলটিই ছিল বিদেশে অবস্থানরত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রথম এবং বড় আকারের একটি সামরিক দল। এই সাবমেরিনারদের সহযোগিতায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় নৌবাহিনীর সমরবিদেরা একটি নৌ-কমান্ডো দল গঠন করে। নৌ-কমান্ডোরা মুক্তিযুদ্ধে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নৌপথকে পাকিস্তানিদের জন্য অনিরাপদ করে তোলে। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা এই ৮ জন বাঙালি নাবিককে ঘিরে প্রায় ৪০০ জনের নৌ-কমান্ডো দল গঠন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।

সাবমেরিনাররা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ফ্রান্স থেকে ভারত পর্যন্ত চলে আসার যে লোমহর্ষ বর্ণনা আমাকে দেয়, তা সত্যই শিহরণ জাগানোর মতো। তাদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ম্যানগ্রোতে প্রশিক্ষণরত বাঙালি নাবিকেরা বিবিসির সংবাদে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার কথা জানতে পারে। সংবাদ শোনার পর বাঙালি নাবিকদের চোখেমুখে উদ্বেগ আর প্রতিশোধের দাবানল দানা বাঁধে। এ সময় সাবমেরিনে অবস্থানরত অবাঙালি নাবিকেরা বাঙালিদের সান্ত্বনাসূচক বক্তব্য দেয়, যা বাঙালি নাবিকদের কাছে আরও বিরক্তিকর মনে হয়। এর পর বাঙালি নাবিকেরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু করে তারা। একাধিক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে তারা মতবিনিময় করে এবং একে অপরের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে। বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তুলোঁ ঘাঁটি থেকে যেকোনো উপায়ে লুকিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। প্রথমেই তাদের ফ্রান্স ত্যাগ করে অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাতে হবে। এরপর সুবিধামতো সময়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে পৌঁছাবে। এ সিদ্ধান্তের কথা পাকিস্তানিরা যাতে বুঝতে না পারে সে জন্য তারা যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করত এবং কাজকর্ম ও আচার-আচরণে স্বতঃস্ফূর্ততা বজায় রাখত।

২৭ মার্চ বিকেল পাঁচটায় নিত্যদিনকার কর্তব্য শেষে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ জন বাঙালি নাবিক পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য গোপনে মিলিত হয়। সাবমেরিনটি তুলোঁ ঘাঁটি ত্যাগ করার দুদিন আগেই বাঙালি নাবিকেরা তাদের সব মালপত্র নেভাল মেস থেকে সাবমেরিনে উঠিয়ে দেয়। বাঙালি নাবিকদের প্রতি পাকিস্তানিদের আস্থা দৃঢ় করা ও বাঙালি নাবিকদের পলায়নের পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনো প্রকার সন্দেহ যেন না হয়, তার জন্যই তারা এই কাজটি করে। নাবিকদের পাসপোর্ট ও কিছু অর্থ জাহাজের একটি লকারে গচ্ছিত ছিল। আবদুর রকিব মিয়া ও আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী জাহাজের কি-বক্স থেকে লকারের চাবি নিয়ে অর্থ ও পাসপোর্টগুলো নিজেদের সংগ্রহে নিয়ে নেয়। কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তারা সাহসের সঙ্গে তা সম্পন্ন করে। তারা জানত, এই কাজে ধরা পড়লে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার স্বপ্ন পূরণ হবে না, তার পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা তাদের এতটা উদ্বুদ্ধ করে যে মৃত্যুর আশঙ্কাও তাদের এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। পরদিন অন্য কারণ দেখিয়ে বদিউল আলম ও আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী জাহাজ থেকে ছুটি নেয়। আসল উদ্দেশ্য বিমানের টিকিট কেনা। পরে নিরাপত্তার অভাব হতে পারে বিবেচনা করে বিমানের পরিবর্তে তারা রেলপথে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ধ্যায় আবার মিলিত হয় তারা। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, সাবমেরিন ম্যানগ্ৰো ফ্রান্স থেকে পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগের দিন, অর্থাৎ ৩১ মার্চ রাত এগারোটার ট্রেনে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশে তারা তুলো থেকে যাত্রা করবে। ৩১ মার্চ সন্ধ্যায় ৯ জন বাঙালি নাবিক কেনাকাটার কথা বলে একজন একজন করে সাবমেরিন ত্যাগ করে। ঘাঁটি ত্যাগের পূর্বমুহূর্তে বাঙালি নাবিকেরা তাদের সিদ্ধান্তের কথা তুলোতে অবস্থানরত কিছু আফ্রিকান বন্ধুর কাছে প্রকাশ করলে তারা বাঙালি নাবিকদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। দক্ষিণ আফ্রিকান নাবিক-বন্ধুদের সহায়তায় প্রত্যেকে ছোট একটি ব্যাগ বন্দরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। বাঙালি নাবিকেরা বিভিন্ন পথ ধরে তুলো শহরের পূর্বনির্ধারিত একটি স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে মিলিত হয়। সেখান থেকে ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনে চড়ে বিচ্ছিন্নভাবে তুলোঁ থেকে এক শ কিলোমিটার দূরে ফ্রান্সের অপর শহর মারর্শে এসে পৌঁছায়। মারশেঁতে বাঙালি নাবিকদের পৌঁছে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বন্ধুরা ফিরে যায়।

রাত এগারোটার দিকে মারর্শে রেলস্টেশনে পৌঁছার পর নৌসেনাদের প্রত্যেকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তুলোঁ ঘাঁটি থেকে পলায়ন খুব ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তারা এতে সফল হয়েছে। পরবর্তী গন্তব্য সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের উদ্দেশে যাত্রার আগে তারা লক্ষ করে যে তাদের দলের সাবমেরিনার আবদুল মান্নান মারর্শে পৌঁছায়নি। তার অনুপস্থিতি নিয়ে সবার মধ্যে একটা উদ্বেগের জন্ম নেয়। মান্নান ধরা পড়েছে না অন্য কোনো সমস্যা হয়েছে তারা বুঝতে পারছিল না। এ ধরনের সংকটময় মুহূর্তে কারও জন্য অপেক্ষা করা বা কারও খোঁজ নেওয়ার মতো সময় তাদের ছিল না।

রাত এগারোটায় ট্রেন। সময় নেই বললেই চলে। ট্রেন ছাড়ার হুইসেল বেজে ওঠে। ৮ জন বাঙালি নাবিক ট্রেনের কামরায় চড়ে বসে। দেখতে দেখতে ট্রেন ছেড়ে দেয়।

জেনেভা শহর তুলোঁর নিকটতম সীমান্ত শহর। ১ এপ্রিল সকাল আটটায় তারা জেনেভা শহরসংলগ্ন সীমান্তে এসে পৌঁছায়। গাড়ি থেকে নেমে সীমান্ত পার হয়ে জেনেভা শহরে প্রবেশ করতে হয়। বাঙালি নাবিকদের কাছে আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট ছিল, কিন্তু সুইজারল্যান্ডে প্রবেশের ভিসা না থাকায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের জেনেভায় ঢুকতে বাধা দেয়। কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন রকম যুক্তি উপস্থাপন করে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে তারা বোঝাতে চেষ্টা করে যে তারা সাময়িকভাবে জেনেভায় ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। নৌবাহিনীর শিক্ষানবিশ হওয়াতে তাদের ভিসা দেওয়া হয়নি। এসব যুক্তিতে কোনো কাজ হলো না। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের প্রবেশের অনুমতি দিল না। এদিকে তারা সত্য কথা, অর্থাৎ সাবমেরিন ছেড়ে পালিয়ে আসার কথাও বলতে পারছিল না। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বাঙালি নাবিকদের চেকপোস্ট-সংলগ্ন একটি কামরায় আটকে রাখে। এর মধ্যে আবার তাদের পাসপোর্টগুলোও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে। এ সময় তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। জেনেভা পুলিশ যদি কোনোভাবে তাদের বক্তব্যে সন্দেহ করে এবং পালানোর বিষয়টি টের পায় অথবা কোনো কিছু না ভেবে স্বাভাবিক নিয়মেই সুইজারল্যান্ড বা ফ্রান্সে পাকিস্তান দূতাবাসকে অবহিত করে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরিকল্পনাই যে কেবল ব্যর্থ হবে তা নয়, তাদের জীবনও বিপন্ন হয়ে উঠবে। দুশ্চিন্তায় তারা চারদিকে অন্ধকার দেখতে থাকে। সবাই বিচলিত হয়ে ওঠে।

কিছুক্ষণ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কাটানোর পর একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা পাসপোর্টগুলো নাবিকদের ফিরিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জানায় যে তাদের পুনরায় ফ্রান্সে ফিরে যেতে হবে; কারণ, ভিসা ছাড়া কাউকেই জেনেভায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। এই মুহূর্তে পুলিশের কাছে তাদের পরিচয় প্রকাশ হওয়ার চেয়ে ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে তারা ভেতরে ভেতরে খুব আনন্দিত হয়।

১ এপ্রিল বিকেল পাঁচটায় পলাতক দলটি ফ্রান্সের প্যারিস শহরে ফিরে আসে। প্যারিসে এসে তারা গোপনে পাকিস্তান দূতাবাসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে সাবমেরিনটিকে বিদায় জানাতে দূতাবাসের সবাই তুলো গেছে। নাবিকেরা নিশ্চিত হলো যে ম্যানগ্রো তুলো বন্দর ত্যাগ করছে। এ সময় তারা ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তারা ভাবে যে বেশি সময় প্যারিসে থাকা নিরাপদ নয়। তাই তারা ফ্রান্সের অপর শহর লিয়নে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। লিয়ন ফ্রান্সের একটি বড় শহর। শহরে লোকসংখ্যাও অপেক্ষাকৃত বেশি। তারা ধরে নেয় যে এখানে আত্মগোপন করা তাদের জন্য সহজ হবে। পরদিন তারা লিয়নের উদ্দেশে যাত্রা করে।

সাবমেরিন তুলোঁ ঘাঁটি ছেড়ে যাওয়ার আগেই বাঙালি নাবিকদের পলায়নের বিষয়টি পাকিস্তানি কর্মকর্তারা জানতে পারে। কিন্তু তারা তাদের যাত্রা বিলম্বিত করেনি। পাকিস্তানিদের শঙ্কা হয় যে বিষয়টি জানাজানি হলে ফরাসি কর্তৃপক্ষ সাবমেরিন হস্তান্তর বা বন্দর ত্যাগে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই পাকিস্তানি দূতাবাসের কর্মকর্তারা বিষয়টি গোপন রাখে। ১ এপ্রিল ম্যানগ্রো তুলোঁ ঘাঁটি ছেড়ে স্পেনের একটি বন্দরে পৌঁছালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ৯ জন বাঙালি নাবিকের পলায়নের ঘটনা ফ্রান্স কর্তৃপক্ষকে জানায়। ৯ জন বাঙালি নাবিকের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও স্পেনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পলাতক বাঙালি নাবিকদের খুঁজে বের করার জন্য জোর তৎপরতা চালায়। পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তান দূতাবাসের লোকজনও হন্যে হয়ে জাহাজ ত্যাগকারী বাঙালি নৌসেনাদের খুঁজতে থাকে।

নাবিকেরা এক দিন এক রাত পর লিয়ন শহরে এসে পৌঁছায়। তিনটি হোটেলে ৮ জন সাবমেরিনার ভারতীয় ভ্রমণকারী পরিচয় দিয়ে কামরা ভাড়া নেয়। পুলিশ তাদের খুঁজছে এই সংবাদ জানতে পেরে তারা পরবর্তী কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। প্রত্যেক হোটেলে তখন ফরাসি গোয়েন্দাদের তল্লাশি শুরু হয়ে গিয়েছে। হোটেলমালিক সন্দেহের বশে নৌসেনাদের পরিচয়পত্র দেখাতে বলে। তারা পরিচয়পত্র দেখাতে না পারায় হোটেলমালিক তাদের হোটেল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এই হোটেল ছেড়ে অন্য হোটেল খোঁজার সময়ও হোটেলমালিকেরা তাদের পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও ভিসা দেখতে চায়।

কোথাও তারা আশ্রয় পায় না। তারা খুব শঙ্কিত হয়ে পড়ে। নাবিকেরা বুঝতে পারে যে ফ্রান্সে থাকা আর মোটেই নিরাপদ নয়। অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর লিয়ন শহরতলিতে এক মহিলার মালিকানাধীন দুটি অখ্যাত হোটেলে তারা অবস্থান নেয়। নাবিকদলটি হোটেল কর্তৃপক্ষকে তাদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য অনুরোধ করে। আর এ জন্য হোটেলের ভাড়া হিসেবে তাদের অনেক বেশি টাকা দিতে হয়। তারা দিনের বেলায় হোটেলে থাকত আর রাতের বেলায় তিন-চার ভাগে বিভক্ত হয়ে ফ্রান্স থেকে অন্য দেশে যাওয়ার পথ খুঁজতে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করত। গোয়েন্দা বিভাগের হাতে সবাই যেন একসঙ্গে ধরা না পড়ে সে জন্য তিন-চার ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা শহরে ঘুরে বেড়াত।

গাজী মো. রহমতউল্লাহ লিয়নের এক টুরিস্ট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে স্পেন সরকার তিন মাসের জন্য কেবল পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা ছাড়া স্পেনে প্রবেশের একটি ঘোষণা দিয়েছে। নোটিশটিতে লেখা ছিল, “শুধু পাকিস্তানিরা তিন মাসের জন্য ভিসা ছাড়া স্পেনে প্রবেশ করতে পারবে”। সে হোটেলে ফিরে এসে বিষয়টি দলের অন্যদের অবহিত করে। হোটেলে ফেরার সময় সে স্পেনের একটি পর্যটক গাইড এবং একটি ম্যাপ কিনে নিয়ে আসে। তার এই সংবাদ বাঙালি নাবিকদের কিছুটা স্বস্তি দেয়। তারা সময় নষ্ট না করে স্পেনের উদ্দেশে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

পরের দিন সকালে তারা স্পেনের সীমান্তে পোর্টবো রেলস্টেশনে এসে পৌঁছায়। এখানকার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট দেখাতেই তারা নাবিকদের কোনো বাধা না দিয়ে স্পেনে ঢোকার অনুমতি দেয়। নাবিকেরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে শহরের কম পরিচিত একটি হোটেলে আশ্রয় নেয়, যাতে তাদের অবস্থান সম্পর্কে কেউ জানতে না পারে। পোর্টবো থেকে তারা বার্সেলোনা যাওয়ার উদ্দেশে রেলস্টেশনে আসে। সেখান থেকে প্রায় একই সময়ে দুটি ট্রেন বার্সেলোনার উদ্দেশে রওনা হয়। নাবিকেরা ভুলবশত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই ট্রেনে উঠে বসে এবং বার্সেলোনার উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। তারা বার্সিলোনা শহরে পৃথক পৃথক সময়ে এসে পৌঁছায়। একে তো অন্য দেশ, তার ওপর ভাষার সমস্যা, অপর দিকে আবার ধরা পড়ারও ভয়। বার্সেলোনা এসে তারা হোটেলের সন্ধান করতে গিয়ে বুঝতে পারে যে এই শহরটিও তাদের জন্য নিরাপদ নয়। বহু স্থানে ঘোরাঘুরি করে পৃথক হয়ে যাওয়া দল দুটি বিভিন্ন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে। দুদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর নাবিকেরা একে অন্যের সন্ধান পায় এবং এক হোটেলে একত্র হয়। হোটেলটিতে স্পেনের পুলিশ ও পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তারা খুঁজতে এলে হোটেলমালিক তাদের জানায় যে নাবিকেরা হোটেলে রাত্রিযাপন করে সকালে চলে গেছে। তল্লাশির খবর নাবিকেরা জানার পরপরই তারা দ্রুত মাদ্রিদে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

পরদিন তারা মাদ্রিদে এসে পৌঁছায়। গাজী মো. রহমতউল্লাহ এবং সৈয়দ মো. মোশাররফ হোসেন ভারতীয় দূতাবাসে যায়। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অনুপস্থিত থাকায় নাবিকেরা চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মি. বেদির সঙ্গে দেখা করে। নাবিকেরা মি. বেদিকে তাদের পরিচয় ও পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগের কথা জানায়। তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে মি. বেদির সহযোগিতা কামনা করে। মি. বেদি উত্তরে বলেন, ‘আমরা তো অনেক আগেই আপনাদের সাক্ষাৎ প্রত্যাশা করেছিলাম। আপনারা ইচ্ছা করলে প্যারিসেই ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নিতে পারতেন।’ তার এমন কথা শুনে নাবিকেরা আবেগে কোনো কথা বলতে পারছিল না। আসলে মি. বেদির কাছ থেকে ইতিবাচক ও বন্ধুসুলভ আচরণে তারা অবাক না হয়ে পারেনি। একটি অনিশ্চিত যাত্রার পথ এত সহজে সমাধান হয়ে যাবে, তারা তা কল্পনাও করতে পারেনি। দূতাবাসের কর্মকর্তারা ইতিবাচক সমর্থন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা হোটেলে ফিরে এসে দলের অন্যদের নিয়ে বিকেলে পুনরায় দূতাবাসে যায়।

বাঙালি নাবিকদের ডুবোজাহাজ ম্যানগ্রো থেকে পলায়নের সংবাদ ইউরোপীয় বেতার মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত সরকার ইউরোপে অবস্থিত সব ভারতীয় দূতাবাসে গোপন তারবার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেয় যে পলাতক সাবমেরিনারদের সন্ধান পাওয়ামাত্রই যেন তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ভারতের মাদ্রিদ দূতাবাসেও এই বার্তা পৌঁছে যায়। মি. বেদি নাবিকদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেন এবং প্রত্যেককে ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে পৃথক পৃথক আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁর কাছ থেকে পরবর্তী কোনো সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত তিনি নাবিকদের হোটেলের অভ্যন্তরেই আত্মগোপন করে থাকতে বলেন। স্প্যানিশ পুলিশ ও গোয়েন্দা এবং পাকিস্তান দূতাবাসের লোকেরা তাদের যে খুঁজে বেড়াচ্ছে, এ কথাও মি. বেদি তাদের জানিয়ে দেন। দূতাবাসের কাজ সম্পন্ন করে নৌসেনাদল পুনরায় হোটেলে ফিরে আসে। ভারত সরকার বাঙালি নাবিকদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি হওয়ায় ভারতীয় পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য তারা পাকিস্তানি পাসপোর্টগুলো ভারতীয় দূতাবাসের কাছে সমর্পণ করে। মাদ্রিদ ত্যাগ করার আগে তাদের আরও দুই-একদিন একই হোটেলে থাকতে হয়।

বিদ্রোহী নাবিক দলটিকে বিমানে তুলে দেওয়ার পরপরই ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিনিধিরা মাদ্রিদ বিমানবন্দরে একটি সাংবাদ সম্মেলন করেন। সম্মেলনে তাঁরা পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগকারী বাঙালি নাবিকদের ভারত সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার কথা প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেন। সাংবাদিকদের তাঁরা এ খবরও জানিয়ে দেন যে বিদ্রোহীরা বিমানে করে ভারতের উদ্দেশে রোমের পথে রওনা হয়ে গিয়েছে। চাঞ্চল্যকর এই সংবাদটি বিবিসি বিশেষ বুলেটিনের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়। খবরটি শোনার পর রোমের গণমাধ্যম-কর্মী ও পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তারা তৎপর হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী নাবিকদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য সাংবাদিকেরা রোম বিমানবন্দরে আসে। আর বিদ্রোহী নাবিকদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাকিস্তানি দূতাবাসের কর্মীরাও উপস্থিত হয় বিমানবন্দরে। অন্যদিকে নাবিকদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আসেন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা। রোম বিমানবন্দরে সৃষ্টি হয় নাটকীয় পরিবেশের।

রোমে অবতরণের পরপরই বিদেশি সাংবাদিকেরা নাবিকদের ঘিরে ধরে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে একজন বিদ্রোহী নাবিক সত্য প্রকাশ করে। সে বলে, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্যই ভারত হয়ে বাংলাদেশে যাব। মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করব।’ এ সময় সেখানে উপস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তারা পাকিস্তানি নাগরিক দাবি করে নাবিকদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে একরকম জোর করে গাড়িতে ওঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ত্বরিত হস্তক্ষেপে তারা বিমানবন্দর-সংলগ্ন একটি হোটেলে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং দূতাবাসের অনুরোধে হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য কড়া পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থা করে। পাকিস্তানি দূতাবাস ইতালি সরকারকে জানায় যে ভারতীয় দূতাবাসের লোকেরা কয়েকজন পাকিস্তানিকে জোর করে ভারতে নিয়ে যাচ্ছে; তারা এসব নাবিককে উদ্ধার করে পাকিস্তানি দূতাবাসে হস্তান্তর করার জন্য অনুরোধ করে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় দূতাবাসের লোকজন অতি দ্রুত সুইস এয়ারলাইনসের টিকিট সংগ্রহ করে ৮ জন নাবিককে পুলিশের প্রহরায় বিমানে তুলে জেনেভার পথে রওনা করিয়ে দেয়। সুইস এয়ারলাইনসের বিমানটি জেনেভা হয়ে বোম্বে যাচ্ছিল।

জেনেভা বিমানবন্দরে নামার পর সেখানকার ভারতীয় দূতাবাসের লোকেরা নাবিকদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে যায়। এর আগে পলাতক নাবিকেরা জেনেভা প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু এবারের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। তখন তাদের পরিচয় ছিল পাকিস্তানি নাগরিক এবং মনে ছিল ধরা পড়ার আশঙ্কা। এবার এসেছে বাঙালি পরিচয় নিয়ে এবং তাদের ভেতর কোনো সংশয় ছিল না। যদিও অনিবার্য কারণে তাদের সঙ্গে ভারতীয় পাসপোর্ট ছিল। এখানে নাবিকদের নিরাপত্তার ত্রুটি না থাকলেও অল্পক্ষণেই কয়েকজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা উপস্থিত হয়ে তাদের ফিরিয়ে নিতে সম্ভাব্য সব রকম উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তানিদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ নাবিকেরা বাংলাদেশে ফেরত আসার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। সুইস বিমানে ওঠার সময় ভারতীয় কর্মকর্তারা নাবিকদের সতর্ক করে বলে যে পাকিস্তানিরা তাদের গতিরোধ করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। সুতরাং লাউঞ্জ থেকে বিমানে ওঠা পর্যন্ত তারা যেন অপরিচিত কারও সঙ্গে কথাবার্তা না বলে। তাদের দুজন দুজন করে চারটি দলে বিভক্ত হয়ে বিমানে ওঠার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিদ্রোহী নাবিকদলটি সব বাধা এবং পাকিস্তানিদের অনুরোধ ও প্রলোভন উপেক্ষা করে বিমানে যার যার আসনে গিয়ে বসে পড়ে। বিমানটি মুহূর্তেই উড্ডয়ন করে। এখন তাদের সামনে শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার স্বপ্ন।

৮ এপ্রিল বিমানটি বোম্বের মাটি স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহী নাবিকদলটির তুলোঁ নৌঘাঁটি থেকে অনিশ্চিত যাত্রাপথের অবসান হয়। ৮ জন বাঙালি নাবিকের পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সংবাদ সারা বিশ্বে প্রচারিত হওয়ায় বিষয়টি পাকিস্তান সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। এই দলের সদস্যদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার বিরাট অঙ্কের পুরস্কারের ঘোষণা দিলেও তা ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে বিদ্রোহী নাবিকদের অবর্তমানে সামরিক আদালতে বিচার করে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়।

৮ এপ্রিল বিকেলে আটজন নাবিক বোম্বে থেকে নয়াদিল্লিতে এসে পৌঁছায়। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তাদের দিল্লির হোটেল রণজিতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। হোটেল রণজিতেই বিদ্রোহী নাবিকদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার মি. শর্মার সঙ্গে। মি. শর্মা ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন দক্ষ এবং বিচক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও কৌশলী। তিনি ৮ জন নাবিকের থাকা-খাওয়াসহ সব রকম সুযোগ-সুবিধার নির্দেশ দেন। এখানে ভারতীয় সামরিক ও নৌবাহিনীর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নাবিকদের বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। দিল্লিতে আমাকেসহ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অন্য সদস্যদের পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করার কারণ এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দারা যেভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, ঠিক একই পদ্ধতিতে পালিয়ে আসা নাবিকদেরও ভারতীয় গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করে। ভারতীয় গোয়েন্দারা নৌসেনাদের কাছ থেকে পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগের কারণ ও লক্ষ্যের কথা জানতে চায়। তারা যুদ্ধপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কী করতে চায়, এ কথাও জেনে নেয়। জিজ্ঞাসাবাদে ভারতীয় গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয় যে বাঙালি নাবিকেরা গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে ভারতে আসেনি। তারা যে তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার ব্রত এবং অদম্য সাহস বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়ার জন্যই সংকল্পবদ্ধ, জিজ্ঞাসাবাদের পর এ ব্যাপারে ভারতীয়দের আর সন্দেহ থাকে না।

নৌবাহিনীর ৮ জন সদস্যের ভারতে এসে পৌঁছানো এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর চিন্তা শুরু হয় যে কীভাবে এদের ব্যবহার করা যায়। নাবিকদের মনোবল, একাগ্রতা ও দেশের প্রতি অদম্য ভালোবাসা দেখে ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার মি. শর্মা একটি নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য গাজী মো. রহমতউল্লাহকে নির্দেশ দেন। ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এস এম নন্দা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা রায় চৌধুরী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী কমান্ডার শর্মার কমান্ডো বাহিনী তৈরির পরিকল্পনায় উৎসাহ দেখান।

বিদ্রোহী নাবিকদলটির সঙ্গে আরও কিছুসংখ্যক মুক্তিসেনা নিয়ে নৌকমান্ডো গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি নৌবাহিনীতে চাকরিরত আরও আটজন বাঙালি সদস্য পালিয়ে এসে নৌ-কমান্ডো দলে যোগ দেয়। নৌ-কমান্ডো গঠনের পরিকল্পনা ভারতীয়রা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে কার্যকর করে। প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশিদের মধ্যে বিষয়টি শুধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, কর্নেল ওসমানী জানতেন। পরবর্তী সময়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহমেদ রেজা ও আমি জানতাম। সিদ্ধান্ত হয় যে আমরা নৌ-কমান্ডো গঠন করে জ্বালানিবাহী পাকিস্তানি নৌজাহাজ আক্রমণ করব এবং জাহাজে ধারণকৃত জ্বালানি তেল ধ্বংস করে দেব। এতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে। এটা ছিল আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু। পরবর্তী সময়ে নৌ-কমান্ডোদের জন্য আরও অনেক লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা হয়েছিল। নৌ-কমান্ডোদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির গঠনের আগে, এই ৮ জন সাবমেরিনারকে দিল্লিসংলগ্ন যমুনা নদীতে দুই সপ্তাহের ডুবুরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

মুর্শিদাবাদের পলাশীতে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী একটি জনশূন্য দুর্গম এলাকায় নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। জায়গাটি ছিল ঘন জঙ্গল আর সাপের রাজ্য। সাপের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য নৌ-কমান্ডোরা ক্যাম্পের চারপাশে নালার মতো গর্ত করে এতে কাঁটাযুক্ত গাছের ডালপালা ফেলে রাখত। এতে সাপের উপদ্রব কিছুটা কমে আসে। ক্যাম্পের আশপাশে কোনো লোকালয় ছিল না। নৌ-কমান্ডো ট্রেনিং ক্যাম্পের সাংকেতিক নাম ছিল সি-২-সি। ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার এম এন সামন্ত নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ এবং অভিযানের সমন্বয়ক ছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ক্যাম্পের সার্বক্ষণিক পরিচালক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জি মার্টিস। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা নৌকমান্ডো শিবিরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কিছুদিনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা ছাড়া তাদের আর কিছু করার ছিল না। কারণ ক্যাম্পের চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা। আমি নৌ-কমান্ডোদের কর্মতৎপরতা ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে কমান্ডার এম এন সামন্তের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম এবং নিয়মিতভাবে কমান্ডোদের খোঁজখবর নিতাম।

নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও বিপজ্জনক। প্রথমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো দীর্ঘ সময় সাঁতার কাটার। এরপর তাদের দীর্ঘ সময় পানির নিচে ডুবে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। তাদের প্রতিদিনই এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হতো। এরপর কয়েক দিন কেবল ফিনস পায়ে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। পরবর্তী ধাপে প্রত্যেক কমান্ডোকে শরীরের সঙ্গে গামছা দিয়ে চার-পাঁচ কেজি ওজনের মাটির ঢিবি বা ইট বেঁধে সাঁতার কাটতে হতো। সাঁতার কাটার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে পানির নিচে বিস্ফোরক স্থাপন ও বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, তা তাদের শেখানো হতো। বিস্ফোরক প্রশিক্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষণ। পানির ভেতর কোনো বিস্ফোরণ ঘটলে ৫০০ গজের মধ্যে অবস্থানরত যেকোনো প্রাণীর (মাছ, মানুষ, জলজন্তু ইত্যাদি) ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড ফেটে যেতে পারে। তাই কমান্ডো দলের এই প্রশিক্ষণ চলত অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে ও যত্নসহকারে। বিস্ফোরক ব্যবহারের যথাযথ বিধিবিধান রপ্ত করতে না পারলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এর ব্যবহার রপ্ত করার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। নৌ-কমান্ডোদের অস্ত্র চালানো, গ্রেনেড ও বিস্ফোরক চার্জ করা সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রথম দিকে প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন যুব শিবির থেকে ২০০ জনের মতো প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন করা হয়। তারপর ক্রমশ এর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত তিন ব্যাচে মোট ৪৯৯ জন সাঁতারুকে নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ ছাড়া দলটিতে আগে থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৮ জন সাবমেরিনার এবং ৮ জন বাঙালি নাবিক ছিল। ফলে নৌ-কমান্ডোদের মোট সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ৫১৫ জনে।

মুর্শিদাবাদের পলাশীতে প্রশিক্ষণরত বাংলাদেশি নৌ-কমান্ডো

১৩ মে শপথবাক্য পাঠের মাধ্যমে নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। নৌ-কমান্ডোদের বেশির ভাগ ছিল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এদের বেশির ভাগ এসেছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, মাদারীপুর, বরিশাল ও চাঁদপুর অঞ্চল থেকে। এরা আগে থেকেই সাঁতারে দক্ষ ও অসমসাহসী ছিল। নৌকমান্ডোদের বিশেষ পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ২০-২৫ মাইল সাঁতার কাটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডোরা যে বিস্ফোরক বা মাইন ব্যবহার করত, তার নাম ছিল লিমপেট মাইন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য যুগোস্লাভিয়া মাইনগুলো তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মাইনগুলো অব্যবহৃত ছিল। নৌ-কমান্ডোদের ব্যবহারের জন্য ভারত এ ধরনের দুই হাজার মাইন কেনে যুগোস্লাভিয়া থেকে। প্রতিটি মাইনের মূল্য ছিল এক হাজার দুই শ ইউএস ডলার। পানির নিচে ব্যবহারের জন্য ভারতীয় বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা মাইনগুলোর কাঠামোগত কিছুটা পরিবর্তন করেন। যেমনটি করা হয়েছিল ভারত থেকে প্রাপ্ত বেসামরিক বিমানগুলোকে সামরিক বিমানে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে। মাইনগুলোর প্রতিটির ওজন ছিল পাঁচ কেজি। নৌ-কমান্ডোরা একটি বা দুটি মাইন পৃথক পৃথকভাবে গামছার সাহায্যে পেট অথবা বুকের সঙ্গে বেঁধে অন্ধকারের মধ্যে সাঁতার কেটে শত্রু-জাহাজের গায়ে অথবা যেকোনো লোহার কাঠামোর সঙ্গে স্থাপন করার কৌশল রপ্ত করে।

নৌ-অভিযানের সময় কমান্ডোদের সঙ্গে অস্ত্র বলতে থাকত একটি করে ছোরা বা বড় চাকু। এটা তাদের নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত হতো না। বরং এটা অভিযানের অন্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো। জাহাজের একটি অংশ যেহেতু পানির নিচে থাকত, তাই এই অংশে অনেক শেওলা জমে যেত। মাইন লাগানোর আগে জাহাজের গায়ে জমে থাকা শেওলা পরিষ্কার করার জন্য ধারালো চাকু বা ছোরার প্রয়োজন পড়ত। মাইন লাগানোর পর সেফটিপিন খুলে নৌ-কমান্ডোরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করত। নৌ-কমান্ডোদের হিসাব করে মাইন দেওয়া হতো। মাইন দেওয়ার সময় বলে দেওয়া হতো যে সেফটিপিন খুলে নিয়ে আসার জন্য। এতে প্রমাণিত হতো যে কমান্ডো সত্যি সত্যি মাইনটি ব্যবহার করেছে। ফলে সব নৌ-কমান্ডো সেফটিপিনটি নিয়ে আসার বিষয়ে সতর্ক থাকত। নৌ-কমান্ডো জানত যে অভিযানে বিভিন্নভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে। যেমন, জাহাজে মাইন লাগাতে গিয়ে শত্রুর হাতে ধরা পড়া, মাইনের বিস্ফোরণের আওতায় পড়ে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের ক্ষতিসাধন হওয়া, ঘূর্ণমান প্রবল স্রোতের তোড়ে ছিটকে পড়া কিংবা জলে হিংস্র প্রাণীর আক্রমণে মৃত্যু হওয়া। এসব কারণে তাদের অভিযান পরিচালনায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হতো।

অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে নৌ-কমান্ডোদের অভিযানের পরিকল্পনা করা হতো। অভিযানকারীদের লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত পথকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হতো এবং একেকটি অংশের জন্য একজন করে পথপ্রদর্শক থাকত। এই পথপ্রদর্শকেরা জানত না যে অভিযানকারীদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল কোথায়। পরবর্তী গন্তব্যের জন্য ভিন্ন একজন পথপ্রদর্শক থাকত। সে জানত না অভিযানকারীরা কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে অথবা পূর্ববর্তী পথপ্রদর্শক কে ছিল। সর্বোচ্চ সতর্কতার ফলে শত্রু ও অন্য কারও পক্ষে অভিযানকারীদের লক্ষ্যবস্তু এবং গতিপথ জানা সম্ভব হতো না। এভাবে খুব গোপনে নৌ-কমান্ডোরা অভিযান পরিচালনা করত।

নৌ-কমান্ডোদের আক্রমণ শুরু হয় ১৫ আগস্ট। প্রথম অভিযানে পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে বিভিন্ন নদী ও সমুদ্রবন্দরে একযোগে অভিযান চালানো হয়েছিল। প্রথম অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। পলাশীতে নৌকমান্ডোদের প্রশিক্ষণ চলাকালে অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা এবং কার্যকরের দায়িত্ব ছিল ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিংয়ের ওপর। মধ্য জুলাই থেকে বাংলাদেশের নদীবন্দরের অবস্থা, শত্রুসৈন্যের অবস্থান ও শক্তি, বন্দরে পৌছানোর সম্ভাব্য নিরাপদ পথ, আশ্রয়স্থল, নদী ও সমুদ্রবন্দরের টাইডাল চার্ট, মানচিত্র, সাংকেতিক নির্দেশনা, কমান্ডোদের চলাচল ও নিরাপত্তার জন্য সাহায্যকারী দল এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ঠিক করে রাখা হয়। সব বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার পর অপারেশনের চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারিত হয় ১৪ আগস্ট। এই দিন ছিল পাকিস্তানের জাতীয় দিবস। পাকিস্তানি প্রশাসন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, ফলে নৌঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা কিছুটা শিথিল থাকবে। বিষয়টি অন্যভাবেও চিন্তা করা যেতে পারে, অর্থাৎ পাকিস্তানি বাহিনী ১৪ আগস্টে আক্রমণের আশঙ্কা বিবেচনা করে কঠোর নিরাপত্তাও নিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ঘটেছিলও তা-ই। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সম্ভাব্য গেরিলা আক্রমণের আশঙ্কায় পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, স্থান ও বন্দরগুলোতে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং নদীপথে টহল জোরদার করা হয়। তাই এদিন অপারেশন চালানো ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে অপারেশনের তারিখ পরিবর্তন করে ১৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। এই পরিবর্তন করা হয়েছিল একেবারে শেষ মুহূর্তে, যখন কমান্ডোরা সবাই লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে ১৬ আগস্ট আক্রমণ চালানো হয়।

অপারেশন জ্যাকপটে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৬০ জন নৌকমান্ডোকে ছয়টি দলে বিভক্ত করা হয়।
ক. প্রথম দল গঠিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর আক্রমণের জন্য, যার সদস্য ছিল ৬০ জন।
খ. দ্বিতীয় দল গঠিত হয় চাঁদপুর বন্দর আক্রমণের জন্য, যার সদস্যসংখ্যা ছিল ২০;
গ. তৃতীয় দল গঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ বন্দর অভিযানের জন্য, যার সদস্য ছিল ১২ জন;
ঘ. চতুর্থ দল গঠিত হয় মংলা বন্দর আক্রমণের জন্য, যার সদস্য ছিল ৪৮ জন;
ঙ. পঞ্চম দল গঠিত হয় দাউদকান্দি ফেরিঘাট আক্রমণের জন্য, যার সদস্যসংখ্যা ছিল ৮; এবং
চ. ষষ্ঠ দল গঠিত হয় হিরণ পয়েন্ট আক্রমণের জন্য, যার সদস্য ছিল ১২ জন।

অপারেশন জ্যাকপটের গোপন ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলো অবহিত করার জন্য প্রতিটি দলের দলপতিকে বিশেষ বিমানযোগে দিল্লিতে নেওয়া হয়। দলপতিদের চূড়ান্ত পরিকল্পনা অবহিত করার পর ১ আগস্ট তাদের একইভাবে বিশেষ বিমানযোগে কলকাতা হয়ে পলাশীতে ফেরত নিয়ে আসা হয়। ১ আগস্ট শেষরাত থেকে কমান্ডো দলগুলো নিজ নিজ অপারেশন এলাকার উদ্দেশে পলাশী ক্যাম্প ত্যাগ করতে থাকে।

অপারেশন জ্যাকপট কার্যকর করতে নৌ-কমান্ডোরা ভারতীয় সীমান্তরেখা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের পর কোন দল কোন পথে যাবে, যাত্রাপথে কোথায় কোথায় অবস্থান নেবে, কোথায় কাদের সঙ্গে মিলিত হবে এবং অপারেশনের সময় নিকটবর্তী কোন নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নেবে তা সব সদস্যকে সবিস্তারে জানিয়ে দেওয়া হয়। অপারেশনের সময় কিংবা আগে-পরে কেউ হারিয়ে গেলে অথবা দলছুট হয়ে পড়লে সে ক্ষেত্রে কী করণীয় এবং সর্বোপরি অপারেশন শেষে ফিরতি যাত্রায় কীভাবে কোন পথ ধরে পলাশী পর্যন্ত আসতে হবে, তা-ও সুনির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া হয়। অভিযানের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় পথপ্রদর্শক ও সহায়কশক্তি হিসেবে নৌ-কমান্ডোদের প্রতিটি দলের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন গেরিলা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সংগীত বা গানের মাধ্যমে অভিযানের সিগন্যাল পাওয়ার জন্য প্রতিটি কমান্ডো দলের দলনেতাকে একটি করে ছোট রেডিও বা ট্রানজিস্টার দেওয়া হয়। শুধু দলনেতাকে জানানো হয় যে নির্ধারিত রেডিও স্টেশন থেকে কমান্ডো আক্রমণের আগে সাংকেতিক দুটি গান বাজানো হবে। গানগুলো নির্দিষ্ট দিনে আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্রের সকালবেলার অধিবেশনে বাজানো হবে। এই গানকে দলনেতা আক্রমণের নির্দেশ বা গানটি যথাসময়ে বাজানো না হলে আক্রমণ থেকে বিরত থাকার বার্তা হিসেবে গণ্য করবে। প্রথম গানটি ছিল পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান/ তার বদলে আমি চাইনি কোনো দান’। এই গানের মর্মার্থ ছিল যে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন সম্পন্ন করার সব প্রস্তুতি নিতে হবে, আর দ্বিতীয় গানটি শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। দ্বিতীয় গানটি ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি/ ওরে, তোরা সব উলুধ্বনি কর।’ এর অর্থ ছিল যে এখন থেকে ঠিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টার্গেটে আঘাত হানতে হবে। তবে প্রথম গানটি বাজানোর ২৪ ঘণ্টা পর যদি দ্বিতীয় গানটি বাজানো না হয়, তাহলে কমান্ডোরা অভিযানে যাওয়া থেকে বিরত থাকবে এবং পরবর্তী নির্দিষ্ট সময়ে দ্বিতীয় গানটি শোনার জন্য অপেক্ষা করবে।

নৌ-কমান্ডোরা অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে বিস্মিত করে দিয়েছিল। বিশেষ করে, চট্টগ্রাম বন্দরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৫ আগস্ট রাতে ১০টি লক্ষ্যবস্তু সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস বা পানিতে নিমজ্জিত হয়। ওই রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ৫৫ হাজার টন দ্রব্যসামগ্রীসহ কয়েকটি জাহাজ প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় এবং চারদিকে আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ে। নৌ-কমান্ডো দলের চট্টগ্রাম বন্দর আক্রমণের কিছু কথা প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে উল্লেখ করছি।

২ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর আক্রমণের জন্য তৈরি দলটি সামরিক বাহিনীর দুটি ট্রাকে পলাশী প্রশিক্ষণ ঘাঁটি ত্যাগ করে। দলে মোট কমান্ডো ছিল ৬০ জন। এদের কমান্ডার ছিলেন সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। রাত নয়টার দিকে ট্রাকগুলো ব্যারাকপুর সেনানিবাসে এসে পৌঁছায়। কমান্ডো দলটি এখানে রাত্রি যাপন করে। পরের দিন ভোরবেলা সামরিক বাহিনীর ডাকোটা বিমানে তাদের নিয়ে আসা হয় ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায়। এখানে এক গভীর জঙ্গলের ভেতরে গোপন বিমানঘাঁটিতে তাদের বিমান থেকে নামানো হয়। তখনো তারা জানে না যে তাদের গন্তব্য কোথায়। এখানে তাদের অভ্যর্থনা জানান ভারতীয় অফিসার মেজর রায়। আগরতলা শহর থেকে পাঁচ-সাত মাইল উত্তরে শালবন এলাকায় আগে থেকেই তাঁবু খাটিয়ে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে ‘নিউ ক্যাম্প’ নামের একটি ট্রানজিট শিবির তৈরি করা হয়, যার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল বিএসএফ।

নিউ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম, দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর অভিযানের জন্য মনোনীত নৌ-কমান্ডোদের জন্য। এ ক্যাম্পের কাছাকাছি দূরত্বেই একটি বিএসএফ ক্যাম্প ছিল। ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রানজিট ক্যাম্পও ছিল সেখানে। বাংলাদেশে নৌঅভিযান শুরু হওয়ার পর পরবর্তী সময়ে নিউ ক্যাম্প নৌ-কমান্ডোদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়। কমান্ডো অভিযান শেষে ফিরতি পথেও তারা এই ক্যাম্পে একত্র হতো। এখানেই তারা অপারেশনের সাফল্যব্যর্থতা যাচাই করত। অপারেশনে কোনো সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছে কি না, কিংবা দলের সবাই ভারতে ফিরে আসতে পেরেছে কি না, তা যাচাইয়ের নিরাপদ কেন্দ্র ছিল নিউ ক্যাম্প। প্রথম দিকে কমান্ডোরা অপারেশন শেষে নিউ ক্যাম্প হয়ে পলাশীতে ফিরে এলেও পরবর্তী সময়ে কমান্ডোরা নিউ ক্যাম্প কিংবা পলাশীতে ফিরে আসত না। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জলসীমায় নিরবচ্ছিন্নভাবে অভিযান চালাত, তাই তাদের আর ভারতে যেতে হতো না। নিউ ক্যাম্পের অধিনায়ক ছিলেন ২ নম্বর সেক্টরের মেজর এ টি এম হায়দার (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)।

৬ আগস্ট অপারেশন জ্যাকপটের দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং কমান্ডো দলগুলোকে বিদায় জানাতে নিউ ক্যাম্পে আসেন এবং অপারেশনের ব্রিফিং দেন। নিউ ক্যাম্পে দলগুলোকে চূড়ান্ত পরিকল্পনা জানানো হয়। দুদিন পর্যন্ত নিউ ক্যাম্পে কমান্ডোদের সব রকম প্ল্যানিং, ব্রিফিং, সমন্বয়, নদীগুলোর গতিপথ ও ম্যাপ, জোয়ার-ভাটার সময়, স্রোতের গতি এবং আরও অসংখ্য তথ্য অবহিত করা হয়। তা ছাড়া যাত্রাপথে কোথায় কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, কিংবা লক্ষ্যবস্তুতে প্রহরীরা কোথায় কীভাবে পাহারার ব্যবস্থা করেছে, তা-ও জানিয়ে দেওয়া হয়।

আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর চারটি গানবোটসহ বেশ কয়েকটি টহল নৌযান। বন্দরে শতাধিক কর্মকর্তা, ২ হাজার নাবিক ও ক্রু কর্মরত ছিল। বন্দরের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিমাংশে নিয়োজিত করা হয় ৯৭ পদাতিক ব্রিগেডের ১ কোম্পানি সৈন্য।

এই অভিযানের সার্বিক গোপনীয়তা এবং পরিকল্পনা অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের তৎকালীন বাঙালি সচিব মিসবাহ উদ্দিন খানের মাধ্যমে বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্রবন্দরের টাইডাল চার্ট আগেই সংগ্রহ করা হয়েছিল, যা অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনায় বেশ সাহায্য করে। অভিযানের লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত চলাচলের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদান করে ১ নম্বর সেক্টর।

নৌ-কমান্ডোরা যখন নিউ ক্যাম্প থেকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ লক্ষ্যবস্তুর দিকে রওনা হয়, তখন তাদের বিদায় জানাতে আমি আগরতলা গিয়েছি। ৮ আগস্ট নিউ ক্যাম্প ছেড়ে চট্টগ্রাম অভিযানের পুরো দল সামরিক ট্রাকে হরিণা ক্যাম্পে এসে পৌঁছায়। এখানে কমান্ডো গ্রুপের দলনেতা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি ও সামরিক সরঞ্জাম বুঝে নেন। ছোট দলে চলাচলের সুবিধা ও গোপনীয়তার কথা বিবেচনা করে ৬০ জনের কমান্ডো দলকে ২০ জন করে ৩টি উপদলে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি দলে একজন করে কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। নিশ্চিত সাফল্যের কথা ভেবে নৌ-কমান্ডোদের মধ্যে সবচেয়ে চৌকস কমান্ডোদের পাঠানো হয় চট্টগ্রাম অভিযানে।

১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে সকালে কাঙ্ক্ষিত প্রথম গানটি প্রচারিত হলো—‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান/ তার বদলে আমি চাইনি কোনো দান।’ গান শোনার পর দলনেতা আক্রমণের সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। এরই মধ্যে নৌ-কমান্ডোদের পুরো দল বিভিন্ন পথ ধরে গোপনে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি তাদের গোপন আস্তানায় এসে অবস্থান নিয়েছে। ১৪ আগস্ট দ্বিতীয় গানটি বাজানোর কথা থাকলেও তা বাজানো হয়নি। জানা যায়, পাকিস্তানিরা জাতীয় দিবস উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে। তাই অপারেশন জ্যাকপটের চূড়ান্ত আক্রমণের সময় ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়। ১৫ আগস্ট সকালে আকাশবাণীর ‘খ’ কেন্দ্রের নিয়মিত অনুষ্ঠানে ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি/ ওরে, তোরা সব উলুধ্বনি কর’ গানটি বাজানো হয়। নৌ-কমান্ডোরা ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে বন্দরে অভিযান পরিচালনা করে কর্ণফুলী নদীর ওপারে চলে যায়। আগে থেকেই কয়েকজন বিশ্বস্ত ও নির্বাচিত গ্রামবাসীকে জানানো হয়েছিল যে ১৫ আগস্ট রাতে তাদের গ্রামে কিছু লোক আসবে, তারা যেন তাদের (কমান্ডোদের) থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে। গ্রামবাসী সেটা যথাযথভাবে পালন করে। সৌভাগ্যবশত ওই অভিযানে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। ১৫ আগস্টে নৌ-কমান্ডোদের সফল অভিযানের পরপরই ১ নম্বর সেক্টর থেকে গোপনে অভিযানের ফলাফল ও পাকিস্তানিদের প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করা হয় এবং ২৩ আগস্ট তারবার্তার মাধ্যমে ভারতীয় বাহিনীর ডেলটা সেক্টর ও আগরতলায় কর্নেল রবের দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারবার্তাটি পাঠকের কৌতূহল নিবারণের জন্য পরিশিষ্ট ৫ হিসেবে সংযুক্ত করেছি।

নৌ-কমান্ডোদের অভিযানে চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে বন্দরে নোঙর করা বিদেশি জাহাজগুলো চলে যেতে আরম্ভ করে। এই ঘটনার পর অন্যান্য দেশের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করতে ভয় পেত। ফলে বন্দরে বিদেশি জাহাজ আসা কমে যায়। যারা বন্দরে আসার জন্য রাজি হতো, তারা এত বেশি ভাড়া দাবি করত যে পাকিস্তানের পক্ষে তা পরিশোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত। এতে পাকিস্তানি সৈন্যদের যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহ বিঘ্নিত হয়, ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যুদ্ধের ওপর।

একই দিন একই সময়ে, অর্থাৎ ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে চট্টগ্রামসহ মংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর এবং ১৬ আগস্ট দাউদকান্দি নদীবন্দরে সমন্বিত অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানগুলোতে মোট ২৬টি জাহাজ, টাগ, গানবোট, ফেরি নিমজ্জিত হয়, যা পৃথিবীর যুদ্ধ-ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।

অপারেশন জ্যাকপটের মংলা বন্দর অভিযানের দলনেতা ছিলেন আহসানউল্লাহ বীর প্রতীক, চাঁদপুর বন্দর অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন বদিউল আলম বীর উত্তম, নারায়ণগঞ্জ বন্দর অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন আবেদুর রহমান বীর বিক্রম। বিজয় অর্জন পর্যন্ত মোট ১৫০টি অভিযান চালিয়ে নৌকমান্ডোরা ১২৬টি জাহাজ/টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে নৌ-কমান্ডো দলের সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নদীপথে তাদের আক্রমণের পরিধি বিস্তৃত করে এবং কার্যকর অভিযান পরিচালনা করে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন