মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করার আগে আমি মুক্তিবাহিনীর বিষয়ে আমাদের সরকারি অবস্থান তুলে ধরব। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের অধীন, আর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সশস্ত্র বাহিনীকে ‘বাংলাদেশ বাহিনী’ বলা হলেও মুক্তিবাহিনী’ হিসেবে এটি বেশি পরিচিত ছিল। কখনো কখনো এই বাহিনীকে ‘মুক্তিফৌজ’ও বলা হয়েছে। বাংলাদেশ বাহিনীর রূপ কেমন হবে, এর সদস্যদের কাজ কী হবে, এদের নেতৃত্ব-কাঠামো কেমন হবে, এর অঙ্গসংগঠনগুলো কী হবে, ভারতীয় বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে এদের সম্পর্ক কেমন হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ২৮ জুন বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে একটি বিস্তারিত নির্দেশাবলি দেওয়া হয়। এই নির্দেশাবলি জানা থাকলে আমার লেখা বুঝতে পাঠকের সুবিধা হবে। সে কারণে পরিশিষ্ট ১-এ তা মুদ্রিত হলো।

নির্দেশনাবলিতে উল্লেখ আছে যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠবে নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনীর সমন্বয়ে। যেসব মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি বাহিনীর সদস্য ছিলেন, তাঁদের নিয়মিত বাহিনীর সদস্য বলা হবে। আর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশা থেকে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের অনিয়মিত বা গণবাহিনীর সদস্য বলা হবে। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি তাঁর সদর দপ্তরের মাধ্যমে এই মুক্তিবাহিনীকে পরিচালনা করবেন। বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি মুক্তিবাহিনীর অভিযান, সংগঠন, প্রশাসন, সাজসরঞ্জাম, সদস্যদের ব্যক্তিগত বিষয়াদির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকবেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রপাতি, যানবাহন, যোগাযোগ, বদলি, পদবি, মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মকানুন, নির্দেশনাবলি ইত্যাদি প্রস্তুত করবেন এবং কার্যকর করবেন। প্রধান সেনাপতি তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সেক্টর অধিনায়কদের কাছে ন্যস্ত করতে পারবেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বিএসএফের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী কীভাবে কাজ করবে, বা কতটুকু সহযোগিতা পাবে, তা-ও বলা হয়েছে এই নির্দেশনাবলিতে। অভিযান পরিচালনার কিছু মৌলিক নীতিমালাও এই নির্দেশনাবলির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। অভিযান পরিচালনার নীতিমালা ও নির্দেশনাবলি সময়, পরিস্থিতি, নতুন যোদ্ধা এবং অস্ত্রসম্ভার প্রাপ্তি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে পরবর্তী সময়ে পরিবর্তন করা হয়।

যত দূর মনে পড়ে, ২৮ জুনের আগে বিভিন্ন বিষয়ে পৃথক নির্দেশনা প্রচার করা হলেও ২৮ জুন দেওয়া এই নির্দেশনাই ছিল যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ে প্রথম লিখিত ও অনেকাংশে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনাবলি। আগেই উল্লেখ করেছি, ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর আলোকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং একটি সাংগঠনিক রূপ পেয়েছিল। এই সম্মেলনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ বাহিনী গঠন, নেতৃত্ব নির্ধারণ, সমন্বয় সাধন ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর জন্য যা অত্যন্ত জরুরি ছিল। পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় তিন মাস পর, জুলাই মাসে। তেলিয়াপাড়া সম্মেলনের বিষয়ে কিছু তথ্য আগে উল্লেখ করেছি। পাঠকের সুবিধার জন্য নিচে কিছুটা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরলাম।

দ্বিতীয় ও চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ ও সমন্বয় সাধনের জন্য ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে উপস্থিত হন। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে সেখানে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাঙালি অফিসাররা ব্রিগেডিয়ার পান্ডের কাছ থেকে কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, কর্নেল ওসমানীসহ ওই এলাকার সব সামরিক অফিসার ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় মিলিত হয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করবেন। ব্রিগেডিয়ার পান্ডের মাধ্যমে আগরতলায় কর্নেল ওসমানীকে আর রামগড়ে ৮ ইস্ট বেঙ্গলের অফিসারদের আলোচনার সংবাদ জানানো হয়।

৪ এপ্রিল সকাল ১০টায় তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোয় সামরিক কর্মকর্তাদের সভা শুরু হয়। এখানে উপস্থিত হন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাহউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা (পরে কর্নেল, সালাহউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও তাঁকে মুক্তিবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান), মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর (অব.) কাজী নুরুজ্জামান (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল), মেজর নুরুল ইসলাম (পরে মেজর জেনারেল), মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল), ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন (বীর প্রতীক, পরে ব্রিগেডিয়ার) প্রমুখ। এ ছাড়া বৈঠকে বিএসএফের ব্রিগেডিয়ার পান্ডে, আগরতলার (ত্রিপুরা) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দীনও (বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার) উপস্থিত ছিলেন।

সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতির সার্বিক মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশ সরকার গঠন না হলেও বাস্তবতার প্রয়োজনে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসারের সদস্য এবং সাধারণ সশস্ত্র জনতাকে নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হবে। কর্নেল ওসমানী মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ বা প্রধান সেনাপতি থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধের সুবিধার্থে বাংলাদেশকে মোট চারটি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করা হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন মেজর জিয়াউর রহমান–চট্টগ্রাম অঞ্চল, মেজর কে এম সফিউল্লাহ-সিলেট অঞ্চল, মেজর খালেদ মোশাররফকুমিল্লা অঞ্চল এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)—কুষ্টিয়া অঞ্চল। সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, ভারী অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদের অভাব মেটানোর জন্য তাঁরা অবিলম্বে ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করবেন। এই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার গঠনেরও আগে এবং সভার কোনো লিখিত কার্যবিবরণী রাখা হয়নি। তবে মৌখিকভাবে বাহিনীর সংগঠন, নেতৃত্ব ও যুদ্ধ পরিচালনার যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পায়। ১১ এপ্রিল নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণে এই সভার সিদ্ধান্তের কিছু অংশ উচ্চারিত হয়েছিল। পরে এই সভার সিদ্ধান্তগুলোকে পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংশোধন, সংযোজনের মাধ্যমে আরও সময়োপযোগী করে তোলা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটলে তেলিয়াপাড়ার সভায় নির্দেশিত চারটি সামরিক অঞ্চলকে জুন মাসের মধ্যে নয়টি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। অঞ্চল কমান্ডাররা নিজেরাই মাঠপর্যায়ে আলোচনা করে অঞ্চলের সীমা নির্ধারণ করে নেন। অঞ্চলের কোনো সুনির্দিষ্ট নাম না থাকলেও তাঁরা যে এলাকায় দায়িত্বরত ছিলেন, সেই এলাকার নামে অঞ্চলগুলো পরিচিত হয়। যেমন চট্টগ্রাম অঞ্চল, সিলেট অঞ্চল, রাজশাহী অঞ্চল ইত্যাদি। বাংলাদেশের এই অঞ্চলগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য ভারতীয় বাহিনী আটটি সেক্টর গঠন করে। এগুলোর নাম ছিল ইংরেজি বর্ণের ক্রমানুসারে, যেমন এ, বি, সি, ডি, ই, ই(১), এফ, জে সেক্টর। বাংলাদেশের অঞ্চলগুলো ভারতীয় সেক্টরের সহযোগিতায় তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড এবং অভিযান পরিচালনা করত। ভারতীয় সেক্টরগুলো আমাদের অঞ্চলগুলোর সমান্তরাল সংগঠন হলেও আমরা প্রায় সবকিছুর জন্যই তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকতাম। কালক্রমে বাংলাদেশ বাহিনীর অঞ্চলগুলোও সেক্টর হিসেবে পরিচিতি পায় এবং সংখ্যানুসারে তাদের নামকরণ হয়। যেমন ১ নম্বর সেক্টর, ২ নম্বর সেক্টর ইত্যাদি।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে দিল্লি থেকে আগরতলা হয়ে কলকাতায় ফিরে আসার পর আমি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রী এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে দিল্লিতে ভারতীয়দের সঙ্গে আলোচনার বিষয়গুলো অবহিত করি। তাঁদের জানাই যে ভারত আমাদের সাহায্য করার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। আরও জানাই, যদি ভারত আমাদের সাহায্য করে, তাহলে কতখানি সাহায্য প্রয়োজন হবে, তার একটি সম্ভাব্য রূপরেখা তাদের দিয়ে এসেছি। তাদের আমি এ-ও বলেছি, পাকিস্তানি বাহিনী উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। আমাদের পক্ষে তাদের বিরুদ্ধে গতানুগতিক বা প্রথাগত যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রথমে আমাদের গেরিলাযুদ্ধ দিয়ে শুরু করতে হবে। ভবিষ্যতে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে কোনো এক পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হবে এবং গেরিলাযুদ্ধ প্রথাগত যুদ্ধে রূপান্তরিত হবে। তখন যুদ্ধের অংশ হিসেবে বিমানও ব্যবহার করতে হতে পারে। সেটা কখন সম্ভব হবে, তা এখনই বলা যাবে না। এ মুহূর্তে আমাদের গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।

মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার আলাদাভাবে কথা হয়েছিল। তখন তাজউদ্দীন আহমদকেও একই কথা বলেছিলাম যে আমাদের প্রথম দিকে গেরিলাযুদ্ধই চালাতে হবে। কারণ, সম্মুখযুদ্ধ চালানোর মতো জনবল, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ইত্যাদি আমাদের নেই। প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে এগুলো ছাড়া প্রথাগত যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না। মনে হয়েছিল, তাজউদ্দীন আহমদ আমার মতামত বুঝতে পেরেছিলেন এবং আমার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন।

ভারত সরকার যুদ্ধের শুরু থেকেই আমাদের বাছাই করা যুবকদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জানায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) আমাদের ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়; এই সময়ে যুব অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়। এই শিবিরগুলোকে ইয়ুথ ক্যাম্পও বলা হতো। যেসব সাধারণ যুবক সীমান্ত অতিক্রম করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে আসত, তাদের এসব ক্যাম্পে রাখা হতো। আমাদের এমএনএ এবং এমপিএরা এসব শিবির তদারকের দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁরা এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরও নির্বাচন করতেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এসব যুব শিবিরে আসা যুবকদের দেখাশোনা করত। ভারতীয়রা ক্যাম্পে থাকা যুবকদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা করত।

যুব শিবির থেকে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতারা, বিশেষ করে, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব ও তোফায়েল আহমেদ শুধু নিজেদের সমর্থক এবং ছাত্রলীগের ছেলেদের গেরিলা হিসেবে রিক্রুট করা শুরু করেন। বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরে দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি চেয়েছিলাম, আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের সদস্য ছাড়াও অন্যান্য যুবক, যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করে ভারতে এসেছে, তাদের সবাইকে যুদ্ধ করার সুযোগ দেওয়া হোক। আমি কর্নেল ওসমানীসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের অবহিত করেও বিশেষ ফল পাইনি। প্রথম দিকের মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল প্রকট। এই অবস্থা চলতে থাকে প্রায় আগস্ট মাস পর্যন্ত। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হয়।

মাঠপর্যায়ে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব ছিল সেক্টর অধিনায়কদের। তাঁরা তাঁদের এলাকায় অভিযানের লক্ষ্যবস্তুগুলো ঠিক করতেন। এরপর গেরিলাদের লক্ষ্যবস্তু আক্রমণ এবং ধ্বংস করার দায়িত্ব দিতেন। গেরিলারা সঠিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত না হলে যে সেক্টর অধিনায়কেরা তাঁদের কাছ থেকে ভালো ফল পাবে না এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। যুব শিবির রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছিল, তা সেক্টর অধিনায়কেরাও আমাদের অভিহিত করেন। জুলাই মাসে সেক্টর অধায়কদের সম্মেলনে বিষয়টি উত্থাপিত হলে বিশেষ কোনো আলোচনা ছাড়াই তা এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং নিচের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯. যুব শিবির যুব শিবির সংগঠনটি বাংলাদেশ বাহিনীর অধীন নয়। প্রধান সেনাপতি অথবা সেক্টর অধিনায়কেরা যুব শিবিরের কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট নন, যদিও সংগঠনটি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে আসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীন। নিজস্ব বাহিনীর ঘাটতি পূরণ এবং জরুরি সম্প্রসারণের চাহিদা মেটানোর পর, যথাসময়ে যুব শিবিরে গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। ইতিমধ্যে কেন্দ্র যুব শিবিরে কোনো প্রশিক্ষক সরবরাহ করবে না, যদি না বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সদর দপ্তর বাংলাদেশ বাহিনী পত্র নম্বর ০০১০ জি, তারিখ ৫ আগস্ট ১৯৭১

বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরে যোগ দেওয়ার পর কথা প্রসঙ্গে গেরিলাযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন ও প্রশিক্ষণের কথা ওঠে। কর্নেল ওসমানী আমাকে জানান, শুধু আওয়ামী লীগের এমপিএ এবং এমএনএরা আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের যুবকদের মধ্য থেকে গেরিলাযোদ্ধা নির্বাচন করবেন। এ বিষয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করি এবং কর্নেল ওসমানীকে বলি, ‘স্যার, শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থকদের প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না। যদি এটা করা হয়, তাহলে অত্যন্ত ভুল হবে। বহু ছাত্র, সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ভারতে এসেছেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশকে স্বাধীন করার জন্য। তাঁরা রাজনীতি করেন না। আমি নিজেও রাজনীতি করি না। সুতরাং, যাঁরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য এসেছেন, তাঁদের যুদ্ধে না নেওয়াটা হবে অত্যন্ত অন্যায়। তাঁদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং যুদ্ধে যেতে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে দলীয়করণ করলে তা যুদ্ধকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’ আমি তাঁকে আন্তরিকভাবে অনুরোধ করেছিলাম, মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচনের বিষয়টি যেন মন্ত্রিসভায় তোলা হয় এবং জরুরিভাবে এটি পুনর্বিবেচনা করা হয়। তিনি এ বিষয়ে তখন কোনো উত্তর দেননি। শুধু বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত এখনই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কারণ এটি মন্ত্রিপরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি তখন তাঁর সঙ্গে বা মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। আমরা যারা যুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েছি, তাদের অনেকে তখন আওয়ামী লীগ করতাম না বা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম না। হাজার হাজার যুবক সবকিছু ত্যাগ করে দেশকে স্বাধীন করার জন্য ভিনদেশে এসেছে। তাদের আমরা যুদ্ধ করতে দেব না, প্রশিক্ষণ নিতে দেব না, এটা তো যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই অন্যায়। এই কথাগুলো আমি কর্নেল ওসমানীকে বলেছি। আমি খুব আশা করেছিলাম, ওসমানী সাহেব এ বিষয়ে কিছু একটা করবেন এবং একটি ইতিবাচক উত্তর দেবেন। এগুলো শুধু আমার কথা ছিল না, বরং তাতে সমস্ত বাঙালি যুবকের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল। তাদের এই আকাঙ্ক্ষাকে দুর্বল করে দেয় মন্ত্রিসভার ওই সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাড়া যুদ্ধে নেওয়া হবে না। বিষয়টি তরুণদের মধ্যে খুব অসন্তোষের সৃষ্টি করে। যুবকেরা দেশ থেকে পালিয়ে সীমান্তে যুব শিবিরে আসতে থাকে, আর সেখানে তারা প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। অথচ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ তারা পেল না।

একদিন মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচনের বিষয়ে ওসমানী সাহেবের ঘরে আলোচনা হচ্ছিল। দেখলাম, কয়েকজন এমপিএ এবং এমএনএ যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচনের জন্য। আমি কর্নেল ওসমানীকে বললাম, ‘স্যার, আমার মনে হয়, ওনারা ঠিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করতে সক্ষম হবেন না। ওনাদের তো এসব কাজের অভিজ্ঞতা নেই। যুদ্ধ বা যোদ্ধা বিষয়ে ওনারা বিশেষ কোনো জ্ঞান রাখেন না। যারা যুদ্ধ করবে, সে গেরিলাই হোক আর নিয়মিত সৈন্যই হোক, তাদের যুদ্ধ করার মতো মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা থাকতে হবে। জনপ্রতিনিধিরা যোগ্যতা নির্ধারণের এই কাজটি সঠিকভাবে করতে সক্ষম হবেন না।’ আমি আরও বলেছিলাম, ‘স্যার, সামরিক বাহিনীর যেসব অফিসারকে কাজে লাগানো হচ্ছে না বা যেসব বেসামরিক কর্মকর্তা, শিক্ষক, ডাক্তার দেশ ছেড়ে এখানে এসেছেন, আপনি এঁদের গেরিলা নির্বাচনের দায়িত্ব দিন। তাঁদের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে অথবা অন্যদের চেয়ে এ বিষয়ে তাঁদের ধারণা বেশি।’ এখানে বলে রাখা ভালো, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেক দিন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবীকে কোনো সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁরা কলকাতা বা আগরতলায় অলসভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন।

অন্য একদিন আমি কর্নেল ওসমানীকে দেখলাম, গেরিলা রিক্রুট করার দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন এমএনএকে ব্রিফ করছেন। সেদিন আমি বলেছিলাম, ‘স্যার, একজন এমএনএর ব্যাকগ্রাউন্ড কী? কেউ হয়তো উকিল ছিলেন, কেউ হয়তো ব্যবসায়ী ছিলেন, আবার কেউ হয়তো ঠিকাদার ছিলেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের যোগ্যতা ভিন্ন। তাঁরা জনগণের কাছাকাছি থাকবেন এবং তাঁদের কল্যাণে কাজ করবেন। কিন্তু যুদ্ধের জন্য সৈন্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। এ কাজটি খুব সচেতন এবং যত্নশীলভাবে করতে হয়। এমএনএ হলেই যে তিনি একজন শক্ত, সমর্থ, যোগ্য যোদ্ধা বাছাই করতে সক্ষম হবেন, তা সঠিক নয়। গেরিলা রিক্রুট করার জন্য এককভাবে শুধু এমএনএদের দায়িত্ব দেওয়া একটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এর জন্য ভোগান্তি হবে সেক্টর অধিনায়কের।’ আমার বক্তব্য তাঁর কাছে গুরুত্ব পেল না। তিনি বলেন, ‘এটা উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত।’ আমি আর কিছু বলতে পারলাম না, চুপ হয়ে গেলাম।

মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচনের এই দুর্বলতা যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যন্ত ছিল। আগস্ট মাসের পর থেকে আমাদের রিক্রুটমেন্ট খুব গতি লাভ করে। কিন্তু এমএনএদের দুর্বলতার কারণে মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। আমি এমএনএদের সম্পৃক্ততা অক্ষুণ্ণ রেখে মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন আরও গতিশীল এবং কার্যকর করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি প্রস্তাব উত্থাপন করি। (দেখুন পরিশিষ্ট ২)। প্রস্তাবটি লক্ষ করলে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবে না যে মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচনে এমএনএ এবং এমপিএদের সম্পৃক্ততা আমাদের জন্য কী সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। আমার এই প্রস্তাব মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কার্যকর করা হয় এবং এমএনএ ও এমপিএদের সহযোগিতার জন্য পৃথক কর্মকর্তা দেওয়া হয়, যাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে ইয়ুথ ক্যাম্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

অনেক পরে রাজনৈতিক পরিচয়, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ-বহির্ভূত সাধারণ যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণের পর অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তারাও কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানার ছাড়াই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং সফল হয়। এভাবে ক্রমে সর্বস্তরের মানুষকে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করা হয়। যুদ্ধের শুরুতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার পরিবর্তে আলাদা আলাদা উদ্যোগ আমাদের যুদ্ধের জন্য খুব ভালো ছিল না। সাধারণ মানুষ যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসেছিল, তারা এটা চায়নি। তারা চেয়েছিল, দেশত্যাগী প্রতিটি মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে এবং এই অধিকার তাদের রয়েছে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক ছাড়াও নানা রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর লোক এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। এভাবে দেশের সব দল ও মতের মানুষের অংশগ্রহণে আমরা পাকিস্তানকে দ্রুত পরাস্ত করতে পেরেছিলাম।

যেকোনো কাজের জন্য মোটিভেশন বা উদ্বুদ্ধকরণ বা প্রেষণা বা প্রণোদনা দরকার। যদি কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল বা দেশের মধ্যে প্রণোদনার অভাব থাকে, তবে সেই ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল বা দেশের দ্বারা কৃত কোনো কাজের সুফল পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়ার জন্য অসংখ্য ছাত্র, কর্মচারী, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য আসে। যুদ্ধক্ষেত্রে নেওয়ার আগে এসব যোদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা সঠিকভাবে তৈরি করে নেওয়া একান্তভাবে প্রয়োজন ছিল। রণাঙ্গনে যদি কোনো ব্যক্তির দেশপ্রেম, আত্মমর্যাদা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, ধৈর্য ইত্যাদি গুণাবলি সঠিক পরিমাণে না থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির কাছ থেকে যুদ্ধে ভালো কোনো ফল আশা করা যায় না। তাই মুক্তিযুদ্ধে প্রণোদনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইয়ুথ ক্যাম্পে যুবকদের মানসিকতা সঠিকভাবে তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রণোদনা টিম গঠন করা হয়। বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে যুবকদের প্রশিক্ষণে পাঠানোর আগে তাদের মনোবল বাড়ানোর জন্য প্রচারপত্র তৈরি করা হয়, যাতে তারা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই মহৎ কাজটি করতে গিয়ে একটি বড় ধরনের ভুল হয়। যেখানে দল ও মতের ঊর্ধ্বে একজন যোগ্য, দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য বা ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ দেওয়া উচিত ছিল, সেখানে তা না করে শুধু দলীয় বিবেচনায় প্রণোদনার প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব প্রশিক্ষকের সিংহভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নেতার রণাঙ্গনে প্রণোদনা প্রদানের যোগ্যতা ও গুণাবলির যথেষ্ট অভাব ছিল। এই নেতারা এ কাজে কোনো শ্রম দিতেন না এবং নতুন যোদ্ধাদের সুন্দরভাবে উদ্বুদ্ধ বা মোটিভেশন করতেন না। তাই নতুন যোদ্ধারা প্রণোদনার দিক দিয়ে যুদ্ধের উপযোগী হতো না। আমার দৃষ্টিতে সঠিকভাবে প্রণোদনার কাজটি প্রায় হয়নি বললেই চলে। তবে যুদ্ধের শেষের দিকে প্রণোদনার জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োজিত করা হয়েছিল। তত দিনে যে ক্ষতি হওয়ার, সেটা হয়ে গিয়েছিল। আমি শুধু ফরিদপুরের এমএনএ ওবায়দুর রহমানকে এই কাজে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে দেখেছি।

প্রশিক্ষণে মোটিভেশন বা উদ্বুদ্ধকরণের বিষয়টি যে গুরুত্ব পাচ্ছে না বা অলক্ষ্যে থেকে যাচ্ছে, তা আমাদের বেশ চিন্তিত করে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক বিষয় নিয়ে সদর দপ্তরে একটি ‘পজিশন পেপার’ লেখা হয়, তাতেও এই উদ্বুদ্ধকরণের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। নিচে আমি সেই প্রতিবেদনের কিছু অংশ তুলে ধরলাম।

জুলাই মাস থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণে প্রবেশিত সংখ্যা ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার এবং আগস্টে ৮ হাজার থেকে ১২ হাজারে বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমানে প্রতি তিন সপ্তাহে কুড়ি হাজারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই বিশাল পরিমাণ গেরিলা ভর্তির কারণে তাদের আনুগত্য, সাহস এবং আত্মোৎসর্গের মতো ব্যক্তিগত গুণাবলির প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি। এটি কাকতালীয় যে, কিছু পরিমাণ ছেলে প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন। ফলে রিক্রুটদের অধিকাংশই হয় প্রণোদিত নয় অথবা গেরিলা হওয়ার যোগ্যতা নেই। এতে ফল দাঁড়িয়েছে :
ক. কিছু গেরিলা ভেতরে গিয়েছে মূলত অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, যেমন লুট, হত্যা, ডাকাতি ইত্যাদি এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রচণ্ড ক্ষতি করেছে।
খ. কিছু দল ভেতরে গিয়ে প্রায়ই তাদের অস্ত্রগুলো ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য রেখে দিচ্ছে এবং কোনো অভিযান পরিচালনা করছে না। ছেলেদের একটি বড় অংশ একেবারে তাৎপর্যহীন কিছু কাজ করছে, যা যুদ্ধে কোনো সাহায্য করছে না, যেমন টেলিফোনের তার কেটে দেওয়া।
গ. শতকরা মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ ছেলে সত্যিকার অর্থে যথাযথ অভিযান পরিচালনা করছে। তবু ভেতরের সংগঠন ও নেতৃত্বের অভাবে এর সার্বিক প্রভাব প্রায় নগণ্য।
ঘ. চূড়ান্ত বিচারে ভেতরের কিছু গেরিলা অভিযানে আংশিকভাবে হলেও উল্টো ফল হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে।

গেরিলাযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণা, গোপনে গাছের আড়াল থেকে একটি বা দুটি গুলি ছুড়লেই গেরিলাযুদ্ধ হয়ে যায়। আসলে তা নয়। গেরিলাযুদ্ধ হলো খুবই সংগঠিত ও বিশদ পরিকল্পনার সাহায্যে পরিচালিত যুদ্ধ। গেরিলাযুদ্ধের প্রধানত দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, যুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে গেরিলারা পরিকল্পিত ও ঝটিকা আক্রমণে শত্রুবাহিনীকে বিধ্বস্ত করবে। দ্বিতীয়ত, গেরিলাদের মূল লক্ষ্যবস্তু থেকে শত্রুর দৃষ্টি অন্যদিকে ব্যস্ত রাখবে, চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে শত্রুকে সব সময় ব্যস্ত রাখবে, শত্রুর যোগাযোগের পথ ও মাধ্যমকে ধ্বংস করবে, তাদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবে, শত্রুর বিপক্ষে নৈতিক প্রচারণা চালাবে ইত্যাদি। গেরিলাযুদ্ধের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, গেরিলারা তাদের সকল কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ বা স্থানীয়দের সহায়তায় গোপনে থেকে বা স্থানীয়দের মধ্যে মিশে গিয়ে দ্রুত ও অতর্কিত আক্রমণ করে শত্রুকে নাজেহাল করবে এবং আক্রমণের পরপরই স্থান ত্যাগ করবে।

গেরিলাযুদ্ধ হলো একটি বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল। যুদ্ধের ময়দানে গেলাম, কয়েকটি গুলি ফোটালাম আর ফিরে এলাম—এটাকে যুদ্ধ বলা যায় না। শত্রুকে ঘায়েল করাই হলো যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য। তবে যুদ্ধের ময়দানে একজন যোদ্ধাকে কৌশলগতভাবে খুব সতর্ক আর তীক্ষ্ণ হতে হয়। যুদ্ধে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে যেমন বিজয়ী হওয়া যায়, তেমনি নিজেরও পরাজিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যুদ্ধ হচ্ছে একটি কৌশলনির্ভর অভিযান বা আক্রমণ, যেখানে প্রতিটি ছোটখাটো বিষয় এবং প্রতিটি মুহূর্তকে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ, যুদ্ধ নিছক শক্তি আর অস্ত্রের ব্যবহার নয়, বরং আরও বেশি কিছু। যুদ্ধের সময় একজন যোদ্ধার বুদ্ধি, দূরদর্শিতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং অস্ত্রের সঠিক ব্যবহারের সম্মিলন ঘটাতে হয়। তা না হলে শত্রুকে সহজে ঘায়েল করা যায় না। গেরিলাযুদ্ধে যোদ্ধাদের অনেক কিছু লক্ষ রাখতে হয়। যেমন তেলের ডিপো যদি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়, তাহলে ওই তেলের ডিপোতে কতজন সৈন্য পাহারা দিচ্ছে, ডিপোটি কী পরিমাণ মজবুত, এটাকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া সহজ কি না, একে ধ্বংস করতে গেলে আমরা শত্রুর কাছে ধরা পড়ব কি না ইত্যাদি। সফল অভিযান পরিচালনার জন্য এসব তথ্য গেরিলাদের বিস্তারিতভাবে জানতে হয়।

যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় প্রশিক্ষণ ও অভিযানের বিষয়ে ভারতীয় বিএসএফ সব ধরনের সমন্বয় সাধন করত। মুক্তিযুদ্ধে যথাযথভাবে পরিকল্পনা না করেই গেরিলাদের অভিযানে পাঠানো হতো। অনেক সময় অভিযান শুরু হওয়ার আগেই তারা ধরা পড়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে গেরিলা অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি যে পরিমাণ দরকার হতো, তা ভারতীয়দের কাছ থেকে পাওয়া যেত না। আমার মনে পড়ে, অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও সরঞ্জামের ২০-২৫ শতাংশের বেশি ভারত থেকে পাওয়া যেত না। যেমন ব্রিজ ডিমোলিশন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের যে ধরনের বা যেরকম বিস্ফোরক দেওয়া হতো, তা দিয়ে ব্রিজ তো দূরের কথা, একটা টেলিফোন পোস্টও ওড়ানোও সম্ভব ছিল না। প্রয়োজনের তুলনায় অস্ত্র ও সরঞ্জামের অপ্রতুলতার বিষয়টি জেনেও ভারতীয়রা কোনো-না-কোনো অজুহাতে তা কম সরবরাহ করত।

বিএসএফ পর্যাপ্ত অস্ত্র সরবরাহ না করার কারণ তাদের হয়তো অস্ত্র ছিল না অথবা তারা সরকারের অনুমতি পায়নি। আমার মনে হয়েছিল, ভারতীয়রা প্রথম দিকে যুদ্ধটি শুধু টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, কোনো কিছু অর্জন করতে চায়নি। তখন পর্যন্ত ভারতীয়দের সহযোগিতার কথা বলতে গেলে বলব, তারা সীমান্তে কতগুলো সামরিক ঘাঁটি তৈরি, মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু লজিস্টিক সহায়তা ও কিছু হালকা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার অতিরিক্ত বিশেষ কিছু করেনি। শুনেছি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ (পরে ফিল্ড মার্শাল) বিএসএফের প্রধান কে এফ রুস্তামজিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সীমান্তে তাঁরা ততটুকু তৎপরতা চালু রাখবেন, যতটা পাকিস্তানিরা সহ্য করতে পারে এবং পাকিস্তান যেন সেটিকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে পরিণত করতে না পারে। ভারতীয়দের সে সময়ের সহযোগিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। ভারতীয় বাহিনী জুলাই মাস পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সিগন্যাল সরঞ্জাম দেয়নি। জুলাইয়ের পর তারা অল্প কিছু সিগন্যাল সরঞ্জাম দেয়। অথচ সিগন্যাল সরঞ্জাম ছাড়া যুদ্ধ কল্পনাই করা যায় না। জুলাই মাস পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বার্তা আদান-প্রদানের জন্য নিকটস্থ ভারতীয় সেনাবাহিনী বা বিএসএফের সিগন্যাল-ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। এর ফলে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় অথবা বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ খুব বিঘ্নিত হতো।

গেরিলাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যেও মতভেদ ছিল। জেনারেল মানেকশ চাইতেন, অল্প কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে হাজার হাজার গেরিলা সৃষ্টি করা হোক। বিপরীতে পূর্বাঞ্চল কমান্ডের সিজিএস মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল) চাইতেন, স্বল্পসংখ্যক গেরিলাকে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হোক। যাহোক, মে মাস থেকে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার করে গেরিলাযোদ্ধা প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করার সিদ্ধান্ত হয়। আগেই বলেছি, যোদ্ধাদের বাছাই করা হতো বিভিন্ন যুব শিবির থেকে। আমাদের এমএনএ এবং এমপিএরা এই কাজটি করতেন। প্রশিক্ষণের জন্য কর্মসূচি ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত। সময়ের কথা ভেবেই এটা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। সময়সীমা ছিল মাত্র দুই থেকে চার সপ্তাহ। অথচ একজন গেরিলাকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে কমপক্ষে তিন মাস সময়ের প্রয়োজন ছিল। যুদ্ধ-পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে কিছুটা ঘাটতি থেকেই যায়। এসব যুবকের অধিকাংশই যেহেতু আন্তরিকভাবে যুদ্ধ করতে চেয়েছিল, তাই প্রশিক্ষণের এই ঘাটতি খুব বড় হয়ে দেখা দেয়নি। প্রথম দল বেরিয়ে আসে জুন মাসের মাঝামাঝি।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হয়, তখন বাঙালি যোদ্ধারা অস্ত্র ব্যবহার করতে জানুক বা না জানুক, তাদের প্রত্যয় ছিল, তারা যুদ্ধ করবে। তাদের এ ধরনের প্রত্যয় বা দৃঢ়তা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। পাশাপাশি উপলব্ধি করেছি, তাদের দৃঢ়তা বা সদিচ্ছা আছে, সাহসও আছে, কিন্তু চিন্তায় গভীরতা বা পরিপক্বতার অভাব রয়েছে। এই অবস্থা দূর করা যেত, যদি তাদের গেরিলাযুদ্ধের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হতো। তারা যদি কিছুদিন বেশি প্রশিক্ষণ নিতে পারত, তারা যদি শিখতে পারত যে যুদ্ধের সময় আড়ালে থেকে শত্রুকে কীভাবে আক্রমণ করতে হবে বা এ-জাতীয় অন্যান্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারত, তাহলে তারা নিজেদের আরও নিরাপদে রেখে যুদ্ধ করতে পারত। সেটাই হতো গেরিলাযুদ্ধের সার্থকতা। কিন্তু অনেক ছেলে এসব দিক বিবেচনা না করে বা সঠিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ ধরনের অজ্ঞতার ফলে কত মুক্তিযোদ্ধা যে মারা গেছে, তার অন্ত নেই। তারা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে। এভাবে প্রথম দিকে আমাদের অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। প্রশিক্ষণের দুর্বলতা সেক্টর অভিযানগুলোকে অনেকাংশে অকার্যকর করে দিত। এই দুর্বলতার জন্য সেক্টর অধিনায়কেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। তাঁরা অনেক সময়ই এই দুর্বলতাগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর বা প্রধান সেনাপতিকে অবহিত করতেন। এখানে ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এম রফিকুল ইসলামের (বীর উত্তম, পরে মন্ত্রী) একটি মন্তব্য তুলে ধরছি। ২৯ সেপ্টেম্বর প্রধান সেনাপতির কাছে আরও কয়েকটি মন্তব্য ও সুপারিশের সঙ্গে এটি তিনি প্রেরণ করেছিলেন।

প্রধান সেনাপতির জন্য পয়েন্ট
৮. গেরিলাদের প্রশিক্ষণ
ক. এটা স্পষ্ট যে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গেরিলাযুদ্ধের ওপর কোনো পাঠদান করছে না, বিশেষত গেরিলাঘাঁটি এবং কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে। ফলে গেরিলাদের নিয়োগের পর তারা গুরুতর প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পতিত হচ্ছে।
খ. গেরিলাদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তা অধিক মাত্রায় প্রথাগত ধারার এবং অনমনীয় স্বভাবের। গেরিলাদের ধারণা, কোনো অ্যামবুশ বা রেইড প্লাটুনের নীচ এবং এলএমজি ছাড়া পরিচালনা করা যায় না। এ ধরনের অনমনীয়তা গেরিলা অভিযানে কাম্য নয়।
১ নম্বর সেক্টর, পত্র নম্বর XXXX, তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

প্রথম দিকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা গেরিলাদের ভারতীয় বাহিনীর অধীনে রাখা হতো। কেন এটা করা হতো, আমি নিজেও বুঝিনি। এমনকি প্রশিক্ষণের পর গেরিলাদের যেসব অঞ্চলে, অর্থাৎ ভারতীয় সেক্টর এলাকায় পাঠানো হতো, তা আমাদের সদর দপ্তর জানতে পারত না। ভারতীয়রা এটা সম্পূর্ণভাবে গোপন রাখত। অনেক সময় ভারতীয় বাহিনীর কাছে মজুত থাকা নিজস্ব গেরিলা বা মুক্তিযোদ্ধাদের সেক্টর অধিনায়কেরা ব্যবহার করতে পারতেন না। ফলে সেক্টরে অভিযান পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেত অথবা অভিযানের সংখ্যা কমে আসত। সেক্টর অধিনায়কেরা নিয়মিত তাঁদের এই সমস্যার কথা আমাদের অবহিত করতেন। এ ধরনের একটি সমস্যার কথা উল্লেখ করে সদর দপ্তরে প্রেরিত একজন সেক্টর অধিনায়কের চিঠির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছে।

১. ওপরে বর্ণিত আপনার বার্তার সারমর্ম বুঝতে পেরেছি। আপনাকে লেখা আমার ব্যক্তিগত পত্র অনুযায়ী সহায়তাকারী সেক্টর অধিনায়ক তাঁদের উপরস্থ সদর দপ্তরের নির্দেশে আমাদের প্রশিক্ষিত গেরিলা এবং সেক্টর সেনাদল ফেরত দেননি। সহায়তাকারী সেক্টর অধিনায়ক তাঁদের পরিচালনা ও নিয়োগ করছেন। আপনার অনুমোদিত কর্মসূচির একটি নকল সাহায্যকারী সেক্টর অধিনায়ককে দেওয়া হয়েছে।
২. আপনাকে অনুরোধ করা যাচ্ছে যে মিত্রবাহিনীর উপরস্থ কর্তৃপক্ষের কাছে ঘটনাটি উপস্থাপন করা হোক, যাতে তারা প্রশিক্ষিত গেরিলা ও সেক্টর সেনাদলকে আমাদের নিকট হস্তান্তর করে।
সদর দপ্তর ১ ব্রিগেড, পত্র নম্বর ১০১/১/জি, তারিখ ২৯ জুলাই ১৯৭১

ভারতীয় কর্মকর্তারা গেরিলাদের লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন করে বাংলাদেশের ভেতরে অভিযানে পাঠাত। ভারতীয় কর্মকর্তাদের বাংলাদেশের ভেতরে লক্ষ্যবস্তুর ভৌগোলিক অবস্থান ও শত্রু সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য ও ধারণা থাকত না। ফলে অনেক জায়গায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ সফল হতো না। মুক্তিযুদ্ধে এর প্রভাব খুব একটা ভালো হয়নি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের আমাদের সেক্টরের অফিসাররা যেভাবে সঠিক ও কার্যকর নির্দেশ দিতে পারতেন, তা কোনো ভিনদেশির পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেক্টর অফিসার ও গেরিলারা একে অন্যকে যতটা ঘনিষ্ঠভাবে বুঝতে পারবেন, ভিনদেশির পক্ষে তা সম্ভব নয়। সেক্টর অফিসারদের জন্য গেরিলাদের যোগ্যতা বোঝা ও তাদের জন্য দায়িত্ব নির্ধারণ করা সহজ হতো। কারণ, তারা উভয়েই একই অঞ্চল বা দেশ থেকে এসেছে, তারা উভয়েই একই পরিবেশ, একই আবহাওয়া ও একই সংস্কৃতিতে বড় হয়েছে। এ ছাড়া তারা একই ভাষায় কথা বলেন। তারা জানত, তাদের অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনায় কী সুবিধা বা অসুবিধা আছে। ২০ আগস্ট ভারতীয় সেনাপ্রধান ও পূর্বাঞ্চল কমান্ডারের সঙ্গে আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর অন্যতম ছিল গেরিলাদের অভিযান প্রসঙ্গ। সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশি সেক্টর অধিনায়কেরা গেরিলাদের অভিযানগুলো পরিচালনা করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর না হওয়ায় যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়, তা ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে অবহিত করা হয়। বর্ণিত সমস্যার অংশবিশেষ নিচে বর্ণিত হলো :

গেরিলাদের পরিচালনা : চিফ অব স্টাফ [মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব] ও আর্মি অধিনায়কের [জেনারেল অরোরা] সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, সেক্টর অধিনায়কেরা গেরিলাদের পরিচালনা করবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, এখনো সহায়তাকারী বাহিনীর অফিসাররা গেরিলাদের পরিচালনা করছেন, যাঁরা এলাকা এবং জনগণ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান রাখেন না, অথচ অভিযানের সফলতার জন্য তা অত্যন্ত জরুরি। কখনো কখনো মানচিত্রের সূত্রে পূর্বনির্ধারিত এলাকায় ঘাঁটি স্থাপনের জন্য গেরিলাদের বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কৌশলগত চাহিদা অনুযায়ী ঘাঁটি নির্ধারণ করা যায় না। এগুলো স্থানীয় জনসাধারণের সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতায় গড়ে তুলতে হয়। ফলে বেশ বড় সংখ্যক গেরিলা হয় ফেরত চলে আসছে এবং অন্য সেক্টরে যোগ দিচ্ছে অথবা পুরোপুরি হতাশ হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

গেরিলা অভিযানের ক্ষেত্রে ৮ বা ১০ জনের একটি গেরিলাদলকে দেওয়া হতো দু-একটি পিস্তল এবং কয়েকটি গ্রেনেড। অভিযানের কোনো বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকত না বা গেরিলাদের কোনো ব্রিফও করা হতো না। পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও টাকাপয়সা ছাড়াই তাদের অভিযানে পাঠানো হতো। এভাবে এক-আধটা পিস্তল আর কয়েকটি গ্রেনেড দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কী আর হতো? দু-একটা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে মুক্তিযুদ্ধকে কত দূর আর নেওয়া যায়? এটি ছিল খুব অপেশাদার একটি কাজ। এভাবে যারা অভিযানে যেত, তাদের মধ্যে কেউ কেউ অ্যাকশনের আগেই ধরা পড়ত, কেউ কেউ ধরা পড়ত ভেতরে গিয়ে অ্যাকশন চলাকালে। যারা বুদ্ধিমান, তারা কোনো কিছু ব্যবহার না করেই ফিরে আসত। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে দেশের ভেতরে এসে দু-একটি জায়গায় আঘাত করে পাকিস্তানি বাহিনীকে কতটুকুই বা বিপর্যস্ত করতে সক্ষম হবে? তাই দেশের ভেতরে প্রথম দিকে যে গেরিলাদলগুলো পাঠানো হয়েছিল, তার ফলাফল খুব খারাপ হয়েছিল। কয়েকটি গ্রেনেড আর একটি পিস্তল দিয়ে প্রকৃত গেরিলাযুদ্ধের ধারেকাছে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। সে জন্য জুন-জুলাই পর্যন্ত যারা দেশের অভ্যন্তরে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই আর ফিরে আসেনি। গেরিলাদলের কয়েকজন নিহত হলে বাকিরা পুনরায় যুদ্ধে যেতে সাহস হারিয়ে ফেলত।

সেক্টর সদর দপ্তর থেকে আমরা জানতে পারি যে দেশের ভেতরে পাঠানো গেরিলাদের অনেকেই তার গ্রেনেডটি প্রকৃত লক্ষ্যবস্তুতে ব্যবহার না করে ভয়ে যেখানে-সেখানে ছুড়েছে বা ফেলে দিয়েছে। গ্রেনেড নিয়ে অথবা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে গিয়ে ১০ জনের ৮ জনই শত্রুর গুলিতে প্রাণ দিয়েছে। এভাবে অকার্যকর অভিযান বা দলের অধিকাংশ গেরিলার প্রাণহানির সংবাদে আমরা ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে পড়ি। গ্রেনেড দিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করতে হলে শত্রুর বেশ কাছাকাছি, অর্থাৎ ২০-২৫ গজের মধ্যে পৌঁছাতে হয়। এ ছাড়া গ্রেনেড যথাযথভাবে নিশানায় ফেলার জন্য যথেষ্ট প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। দুই-চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণে বা প্রশিক্ষণে দুই-একটা গ্রেনেড ছুড়েই এ ধরনের উৎকর্ষ লাভ করা যায় না। পেশাগত সৈনিকদেরও এই গুণ অর্জনে বেশ সময় লাগে। অপর পক্ষে এ ধরনের স্বল্পপ্রশিক্ষিত গেরিলাদের জন্য পিস্তলও কার্যকর অস্ত্র ছিল না। পিস্তলও শত্রুর খুব কাছে গিয়ে ব্যবহার করতে হয়। এই কারণে প্রথম দিকে গ্রেনেড ও পিস্তল নিয়ে অভিযানে পাঠানোর সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। এতে হিতে বিপরীত হয়েছিল। দুর্বল প্রশিক্ষণ এবং গ্রেনেড ও পিস্তল নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার আরেকটি নেতিবাচক দিক আমি লক্ষ করেছি। গেরিলারা তাদের অভিযানের সীমাবদ্ধতা ঢাকার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে কার্যকর অভিযান পরিচালনার বদলে নিরীহ সাধারণ মানুষ, যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়নি বা নিরস্ত্র পাকিস্তানপন্থীদের অহেতুক হত্যা করা শুরু করে। এটিকেই তারা সামরিক অভিযান মনে করতে শুরু করে। গেরিলাযুদ্ধের এই ত্রুটি ও গেরিলাদের অহেতুক আত্মদান সম্পর্কে গেরিলাযোদ্ধা এ কাইয়ুম খানের (মুক্তিযুদ্ধকালে কমিশনপ্রাপ্ত এবং পরে মেজর) অভিজ্ঞতা এখানে উল্লেখ করলাম :

শিবির এবং এর বাসিন্দাদের সঙ্গে যত ঘনিষ্ঠ হতে থাকলাম, আমরা আবিষ্কার করলাম যে সদ্য প্রশিক্ষিত বিক্রুটদের ছোট ছোট দলে দেশের অভ্যন্তরে ক্ষতি সাধনের জন্য প্রেরণ করা হচ্ছে। আমরা তাদের অনেকের সঙ্গে পরিচিত হই। তাদের বেশির ভাগই গ্রামের ছেলে, যারা পিস্তল ও গ্রেনেড বিষয়ে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তাদের দলে তিন-চারজন সদস্য থাকত এবং তারা প্রত্যেকে দুটো করে গ্রেনেড বহন করত। দলপতির কাছে পিস্তল থাকত। তাদের দায়িত্ব থাকত বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি শিবির খুঁজে বের করা এবং গ্রেনেড দিয়ে তাতে আক্রমণ পরিচালনা করা। যেইমাত্র তারা তাদের গ্রেনেড ব্যবহার করে ফেলত, তাদের এলাকা পরিত্যাগ করতে হতো। তারা আর কোনো ধরনের লড়াইয়ে জড়াত না। আমরা এ ধরনের শুরুর মুক্তিবাহিনী যোদ্ধাদের সম্পর্কে খুব কম জানি। তাদের বেশির ভাগই হয় মৃত্যুবরণ করত আর না হয় ধরা পড়ত এবং তাদের হত্যা করার আগে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হতো।
বিটার সুইট ভিক্টরি : আ ফ্রিডম ফাইটার্স টেল,
এ কাইয়ুম খান, ইউপিএল, ঢাকা, পৃ. ৫৪-৫৫

মাঝেমধ্যে আমাদের কাছে সংবাদ আসত যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু নিম্নপদস্থ কমান্ডারের নির্দেশে কিছুসংখ্যক গেরিলা লুটপাটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ভারতীয় কমান্ডাররা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে গেরিলাদের সেখান থেকে সোনা, মূল্যবান বস্তু, বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে আসার আদেশ দিত। বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, কিছু গেরিলা তাদের কথায় স্বাধীনতাবিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা ব্যক্তিদের কাছ থেকে সরাসরি বা তাদের ব্যবসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থসম্পদ লুট করত। গেরিলারা এসব লুটপাটের অর্থ ও মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রীর সিংহভাগ ভারতীয় কমান্ডারদের হস্তান্তর করত, আর বাকিটা নিজেরা রাখত। এমনকি আমাদের কাছে এ সংবাদও আসত যে গেরিলারা অভিযানের নামে বিভিন্ন জলাশয়ে গ্রেনেড দিয়ে মাছ মারছে। গেরিলাদের এসব অনৈতিক কাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিত। একদিকে পাকিস্তানিদের নির্যাতন, অপর দিকে গেরিলাদের পীড়ন তাদের বিভ্রান্ত করত। এ বিষয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের নিচের মন্তব্যটি লক্ষণীয় :

অভিযোগ পাওয়া গেছে যে ওই সেক্টরে (চট্টগ্রাম) অতীতের সাধারণ দুর্বলতা ছাড়াও সৈনিকদের দুর্নীতি এবং স্থানীয় উপজাতীয় জনসাধারণের প্রতি বৈরী আচরণ ছিল অবাধ। এগুলি মুক্তিবাহিনী এবং স্থানীয় জনসাধারণের নৈতিকতায় প্রভাব ফেলছে। এ ধরনের সাধারণ বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে চরমপন্থীরা তাদের অবস্থান সুসংহত করছে। এখনই যদি এগুলি প্রতিহত করা না হয়, তবে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে খুব কঠিন হয়ে পড়তে পারে। অতীতে দুর্বল পরিচালনার ফলে মতভিন্নতাও দেখা দিয়েছিল।
সদর দপ্তর ২ নম্বর সেক্টর, পত্র নং বিডি/০০২২/জি, তারিখ ৯ আগস্ট ১৯৭১

গেরিলারা যেখানে-সেখানে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী ওই সব এলাকা বা গ্রামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং গেরিলা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার আর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার ফলে পরবর্তী সময়ে কোনো গেরিলাদল সামান্য গ্রেনেড হাতে গ্রামে প্রবেশ করলেই গ্রামবাসীদের বাধার সম্মুখীন হয়। সেই সময় গেরিলাদের কার্যকলাপে গ্রামবাসী উৎসাহিত হওয়ার পরিবর্তে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে থাকে। গ্রামবাসী প্রথম প্রথম মুক্তিবাহিনীকে যে আশ্রয় ও সাহায্য দিয়েছে, পরে তা কমতে থাকে। কিছু কিছু এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে জনমত গড়ে ওঠে এবং আত্মরক্ষার জন্য তারা বিপরীত দিকে চলে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় জুন-জুলাই মাসে গেরিলারা দেশের ভেতরে খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এ অবস্থা আগস্টের প্রথম পর্যন্ত চলে। এই ঘটনা ঢালাওভাবে দেশের সব জায়গায় হয়েছে তা নয়, বরং কিছু জায়গায় গেরিলাযোদ্ধারা বীরত্বের পরিচয়ও দিয়েছে। যেসব জায়গায় গেরিলারা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পেরেছে, সেসব জায়গায় আমরা স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্য-সহানুভূতি পেয়েছি।

আমাদের সেক্টর অধিনায়কেরা গেরিলাদের প্রাথমিক দুর্বলতার এই বিষয়গুলো জানতেন। গেরিলাদের এভাবে প্রাণহানি ঘটুক বা চারিত্রিক স্খলন হোক সেটা তাঁরা চাইতেন না। বিভিন্ন সময়ে সেক্টর অধিনায়কদের কাছ থেকে আমি এ ব্যাপারে অনেক অভিযোগ পেয়েছি। গেরিলাদের সঠিকভাবে ব্যবহার না করার বিষয়ে আমাদের সেক্টর অধিনায়কেরা যা বলতেন আমি তা সমর্থন করেছি। ভারতীয় সেক্টর অধিনায়ক বা তাঁদের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা অভিযানের জন্য গেরিলাদের ভেতরে পাঠাতেন। এই অভিযানগুলো সম্পর্কে আমাদের সেক্টর অধিনায়কেরা অনেক সময় জানতে পারতেন না। অভিযানের পর যখন আমরা খবরগুলো পেতাম, তখন বিশ্লেষণ করে দেখতাম যে অভিযানের কোনো প্রভাব শত্রুর ওপর পড়ছে না; বরং আমাদের জনসাধারণের মধ্যে গেরিলাযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নেতিবাচক ধারণার জন্ম নিচ্ছে।

গেরিলাদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের অভিযানে নিয়োগের সমস্যা নিয়ে সেক্টর থেকে আমাদের যে সরকারি চিঠি পাঠানো হতো, তা নিজস্ব যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে ভারতীয় সেক্টরের মাধ্যমে পাঠাতে হতো। ধারণা করা যায় যে কখনো কখনো ভারতীয়রা আমাদের সেক্টরের চিঠি সেন্সর করত। ফলে কিছু কিছু বিষয়ে ভারতীয় যোগাযোগব্যবস্থা এড়িয়ে আমাদের সেক্টর অধিনায়ক বা সাব-সেক্টর অধিনায়কেরা আধা সরকারি বা ব্যক্তিগত চিঠির মাধ্যমে প্রধান সেনাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। এখানে গেরিলা প্রশিক্ষণ এবং অভিযান বিষয়ে ৭ নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাব-সেক্টর থেকে প্রধান সেনাপতির কাছে পাঠানো ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দীন আহমেদ চৌধুরীর (বীর বিক্রম, পরে ব্রিগেডিয়ার) গোপনীয় আধা সরকারি চিঠি থেকে অংশবিশেষ তুলে ধরলাম :

গ. গত তিন মাসে এই সাব-সেক্টরকে চাকুলিয়ায় গেরিলা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে গণবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবক প্রেরণের জন্য কোনো আসন বরাদ্দ করা হয়নি। এই কারণে ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক দীর্ঘ দিন ধরে এই শিবিরে আটকা পড়ে আছে এবং আবাসনের অভাবে নতুন কোনো ব্যক্তিকে ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। সত্যিকার অর্থে অভিযানের জন্য নামমাত্র গণবাহিনীর প্রশিক্ষিত ব্যক্তি মজুত আছে।
ঘ. উপরন্তু যে সমস্ত তরুণ আগে চাকুলিয়া থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেছে, তাদের [গেরিলাদের] স্থানীয় [ভারতীয়) আর্মি কমান্ডাররা পরিচালনা করছেন, যেহেতু তাঁরা [ভারতীয়] তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো নির্দেশ পাননি, তাঁরা এসব সৈনিককে আমার কাছে হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
জি কোম্পানি ৭ নম্বর সেক্টর, ডিওপত্র নং ১০২/১/xX/জিএস(এসডি)
তারিখ ১২ আগস্ট ১৯৭১

জুন-জুলাই পর্যন্ত আমাদের নিজস্ব উৎস ও ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য এবং বাংলাদেশে গেরিলা তৎপরতার প্রভাব পর্যালোচনা করে বুঝতে পারি যে গেরিলাদের কাছ থেকে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল, তা তারা পূরণ করতে পারছে না। এসব সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে একটা হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে ওঠে। দেশের ভেতরের মানুষের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছিল, আবার দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আসা গেরিলাদের মধ্যেও হতাশা বিরাজ করছিল। তখন আমাদের মনে প্রকটভাবে একটা প্রশ্ন দেখা দেয়—আমরা কী করছি, আমরা তো শত্রুকে কিছুই করতে পারছি না। বরং এসব করে দেশের মানুষকে আমরা আরও খেপিয়ে তুলছি।

এসব অসামরিক, হতাশাব্যঞ্জক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড গেরিলাদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। গেরিলাদের যুদ্ধের মনোবল কমে যেতে থাকে এবং তারা দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। পুরো গেরিলাযুদ্ধ হুমকির সম্মুখীন হয়। অনেক গেরিলা হতাশাগ্রস্ত হয় এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। সামান্য অস্ত্র দিয়ে ভেতরে পাঠানো এবং কিছু কিছু জায়গায় লুটপাটের জন্য ভারতীয় বাহিনী সম্পূর্ণভাবে দায়ী ছিল। গেরিলাদের যদি সত্যিকারভাবে যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা যেত, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে তারা একটি কার্যকর বাহিনী হতে পারত। কিন্তু ভারতীয়রা সেটা করতে পারেনি। গেরিলাদের যদি প্রথম থেকেই সরাসরি আমাদের নেতৃত্বে দেওয়া হতো, তাহলে গেরিলা অভিযানে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতি হতো। গেরিলারা আমাদের নেতৃত্বে থাকলে আমরা যে তাদের খুব ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারতাম, তা-ও সঠিক নয়। বরং অভিযানে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যেত যদি বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনা অধিনায়কদের সমন্বয়ে যোদ্ধা নির্বাচন, প্রশিক্ষণ ও অভিযানের বিষয়ে যৌথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতো। গেরিলাদের প্রথম দিকের ব্যর্থতা ঠেকানোর জন্য যৌথভাবে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল। এটা হয়নি বলেই আগে বর্ণিত সমস্যাগুলো মুক্তিযুদ্ধে প্রকট হয়ে উঠেছিল।

মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যাশিত সাফল্য না আসায় আমাদের নিয়মিত বাহিনীর সদস্যসহ অনেকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি ভারত-বিদ্বেষী মনোভাবের জন্ম নেয়। বাংলাদেশের সেক্টর অধিনায়কেরা কিছুই জানেন না অথচ গেরিলারা ভেতরে যাচ্ছে এবং অসহায়ভাবে নিহত হচ্ছে। ফলে গেরিলাযুদ্ধ থিতিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সেক্টর অধিনায়ক, সামরিক কর্মকর্তা এবং সদর দপ্তরের আমরা সবাই নিরাশ, হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি এই ভেবে যে, কেন এরকম হবে। আমরা উপলব্ধি করলাম, এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না বা এভাবে চলা উচিত নয়। এর জন্য একটা সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। আমি নিজেও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে একাধিকবার গেরিলা তৎপরতা-সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর আশু সমাধানের অনুরোধ জানিয়েছি।

গেরিলাযোদ্ধাদের আমাদের নিয়ন্ত্রণে দেওয়ার বিষয়ে শুরু থেকেই ভারতীয় বাহিনীর আপত্তি ছিল। গেরিলাদের আমাদের অধীনে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আমরা ভারতীয় বাহিনীকে খুব চাপ দিতে থাকি। গেরিলাদের অপরিকল্পিতভাবে ও স্বল্প অস্ত্রে সজ্জিত করে দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ এবং ব্যাপক হারে গেরিলাযোদ্ধাদের মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সরকারের কাছে জোরালোভাবে উত্থাপন করে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় যে গেরিলাযোদ্ধাদের বাংলাদেশি নেতৃত্বে না দিলে গেরিলা অভিযান সফল হবে না। গেরিলাযোদ্ধাদের ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে রাখা, তাদের দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের সেক্টর অধিনায়কেরা যে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত, সে কথাও আমরা তাদের সামনে তুলে ধরি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছেও একাধিকবার এই বিষয়গুলো উত্থাপন করা হয়। এ বিষয়গুলো নিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার আমাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, কর্নেল ওসমানী, আমিসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলাম। সেসব সভায় গেরিলাযুদ্ধ ও যুদ্ধবিষয়ক সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছিল। অবশেষে অনেক আলোচনা আর দেনদরবার শেষে সেপ্টেম্বর মাসে গেরিলাযোদ্ধাদের আমাদের সেক্টর অধিনায়কদের অধীনে দেওয়া হয়।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষে গেরিলাযোদ্ধারা আমাদের সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে আসার পর সংশ্লিষ্ট সেক্টর অধিনায়কেরা গেরিলাদের জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অভিযানের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ ও এর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র প্রদান করতেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ কাজ বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে কেন করা হলো না? আসলে গেরিলাযুদ্ধের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন হয়। সদর দপ্তর থেকে সেক্টর অধিনায়কদের গেরিলাযুদ্ধের বিস্তারিত নির্দেশ প্রদান বাস্তবসম্মত ছিল না। সেক্টর অধিনায়কেরা যুদ্ধের মাঠে থাকেন। তাঁদের এলাকার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁরাই ভালো জানেন। কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করা বা এর প্রকৃত অবস্থা সদর দপ্তরের জানা সম্ভব ছিল না। তাই গেরিলাযুদ্ধে অধিক কার্যকর ও সন্তোষজনক ফল লাভের জন্যই সেক্টর অধিনায়কদের ওপর অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

গেরিলাযুদ্ধ বিকেন্দ্রীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ যোগাযোগ সরঞ্জামাদির অভাব। যুদ্ধের সময় সদর দপ্তর থেকে সেক্টর এবং এক সেক্টর থেকে অন্য সেক্টরের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত ছিল না। এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে অবস্থানরত ভারতীয় বাহিনীর সেক্টরগুলোর সহায়তা নিতে হতো। আমাদের সদর দপ্তর থেকে মুক্তিবাহিনীর সেক্টরে কোনো সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা নিকটবর্তী ভারতীয় সেক্টরকে অনুরোধ করতাম। তারা তাদের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে সংবাদটি নির্দিষ্ট সেক্টর বা আমাদের সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দিত। এভাবে সংবাদ পেতে দেরি হতো, ক্ষেত্রবিশেষে সংবাদটি পথের মধ্যে হারিয়েও যেত। ফলে যখন যে কাজ করা প্রয়োজন, তখন হয়তো সে কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না। যুদ্ধের সময় আমাদের এসব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অসুবিধাগুলো দূর করার জন্য সেক্টর অধিনায়কদের অভিযান পরিচালনায় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা জানতেন তাঁদের কী করা উচিত। তাই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। সংকটময় অবস্থায় সেক্টর অধিনায়কেরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও বিবেচনাবোধ দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারতেন।

প্রথম দিকে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে কিছু কিছু নির্দেশ দেওয়া হলেও পরে আমরা সদর দপ্তর থেকে সরাসরি নির্দেশ দিতাম না। সেক্টর অধিনায়কেরা তাঁদের এলাকায় অভিযানের পুরো পরিকল্পনা নিজেরাই করতেন। তবে কখনো কখনো সদর দপ্তর থেকে সেক্টরের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বা আন্ত-সেক্টর সমন্বয়ের অংশ হিসেবে বিশেষ বিশেষ লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে দেওয়া হতো। জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে এ যুদ্ধ পরিচালিত হলেও প্রকৃত অর্থে মাঠপর্যায়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন সামরিক ব্যক্তিরা। রাজনৈতিক নেতারা যুদ্ধের কোনো বিষয়ে অযথা হস্তক্ষেপ করেননি। আমার ধারণা, রাজনৈতিক নেতারা মাঠের অধিনায়কদের ওপর আস্থাশীল ছিলেন।

শুরুর দিকে প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলারা যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার সময় খুবই স্বল্প পরিমাণে যুদ্ধসরঞ্জাম পেত। ফলে যুদ্ধের ফলাফল আশানুরূপ হতো না। শুরুতে স্বল্প পরিসরে অস্ত্র পাওয়ার কারণ কিছুটা আঁচ করা যায়। হাজার হাজার যুবককে দ্রুত অস্ত্র এবং লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে ভারতীয়দেরও হয়তো সময় লেগেছে। এ ছাড়া তাদের অন্য কোনো পরিকল্পনা বা সীমাবদ্ধতা থেকে থাকতে পারে যা আমরা জানতে পারিনি। কলকাতা, আগরতলাসহ বিভিন্ন সীমান্ত শহরে আমাদের শরণার্থীদের থাকার জন্য তারা জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করেছে ভারতের সাধারণ মানুষও।

এপ্রিল ও মে মাসের মধ্যে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গোলন্দাজ ও সাঁজোয়াসহ পাঁচটি সামরিক ডিভিশন মোতায়েন করতে সক্ষম হয়। প্রাথমিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পর মে মাসের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি করে এবং ধীরগতিতে সারা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে। অপর দিকে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে থাকি। যেকোনো যুদ্ধের সাফল্য নির্ভর করে কার্যকর নেতৃত্ব ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রসম্ভার পাওয়ার ওপর। আগেই উল্লেখ করেছি যে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর তিন মাস পেরোনোর পরও ভারতীয় বাহিনী বা অন্য কোনো জায়গা থেকে প্রত্যাশিত অস্ত্রশস্ত্র এবং লজিস্টিক না পাওয়ায় যুদ্ধপরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। নিজস্ব বেতারযন্ত্র না থাকায় বাংলাদেশি সেক্টরগুলো সংশ্লিষ্ট ভারতীয় সেক্টরের মাধ্যমে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। বেতারযন্ত্রের অভাবে যুদ্ধ চলাকালে সেক্টরগুলোর ওপর কেন্দ্রের কার্যকর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়নি, প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সেক্টরগুলো কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। এ ছাড়া সেক্টরগুলো নিজেদের মধ্যেও সমন্বয় করতে পারছিল না। মুক্তিবাহিনীর জন্য নতুন যোদ্ধা সংগ্রহ, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে সেক্টর ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সেক্টরগুলোর যোগাযোগ, লেনদেন ইত্যাদি বিষয় স্বচ্ছ না থাকায় মাঝেমধ্যেই ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছিল। বাংলাদেশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেশের ভেতরে ও ভারতে বেশ কিছু সশস্ত্র দল বা বাহিনী গজিয়ে উঠতে থাকে এবং তাদের তৎপর হতে দেখা যায়। এসব বাহিনী সেক্টরগুলোর সঙ্গে তাদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কোনো সমন্বয় করত না। এদের অনেকে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশও অমান্য করতে থাকে। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল, সশস্ত্র বাহিনী, অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা, অবিশ্বাস ইত্যাদি বাড়তে থাকে। সমন্বয় ও নীতিমালার অভাবে আন্ত-সেক্টর সম্পর্কের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা শুরু হয়। মোট কথা, যুদ্ধের প্রথম ৯০ দিন গত হয়ে যাওয়ার পরও আমরা নিজেদের গুছিয়ে উঠতে পারিনি। সবকিছুই কেমন খাপছাড়াভাবে চলছিল, অথচ কারোরই আন্তরিকতার অভাব ছিল না।

এরকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বাহিনীর জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের নীতিমালা, বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা ও নেতা নির্ধারণ, যুদ্ধের জন্য অস্ত্র ও অন্যান্য সমরসম্ভার সংগ্রহ, সর্বোপরি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে। এ ধরনের চিন্তাভাবনা থেকে সেক্টর অধিনায়কদের নিয়ে একটি সম্মেলনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। বিষয়টি জুন মাসের মন্ত্রিসভায় আলোচিত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, সেক্টর অধিনায়ক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে একটি সম্মেলন আয়োজন করা হবে। সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১১ থেকে ১৫ জুলাই।

সম্মেলনে প্রায় সব সেক্টর অধিনায়ক, জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা এবং সেক্টর-সংশ্লিষ্ট বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আমিও উপস্থিত ছিলাম। সম্মেলনে সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ, দায়িত্ব বণ্টন, নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী বা গেরিলাবাহিনী গঠন, অস্ত্র ও চিকিৎসাব্যবস্থা এবং আন্তসেক্টর যোগাযোগ-পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ১১ জুলাই সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও যুদ্ধ পরিষদ বা ওয়ার কাউন্সিল গঠন নিয়ে একটি বিতর্কের ফলে ওই তারিখে সম্মেলন শুরু করা সম্ভব হয়নি। ১১ জুলাইয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা আমি পরে উল্লেখ করব। ১২ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে সম্মেলন শুরু হয়। ওই দিন মুক্তিবাহিনীর সকল সেক্টর অধিনায়ক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা ও শপথ গ্রহণ করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকাকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিটি সেক্টরকে একটি ভৌগোলিক সীমানার মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়। সেক্টরকে রক্ষা করা, কার্যকর রাখা এবং পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সেক্টর অধিনায়কদের।

১০ নম্বর সেক্টর ছিল একটু ব্যতিক্রমী এবং এর কোনো ভৌগোলিক সীমানা ও অধিনায়ক নির্ধারণ করা হয়নি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একটি বিবেচনা ছিল এরকম যে বাংলাদেশের ভেতরে কোনো একটি জায়গা আমরা দখল করে নেব এবং সেটিকে আমাদের দখলে রেখে মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলব। মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন চালু থাকবে। আমরা যদি এ ধরনের মুক্তাঞ্চল গঠন করতে পারি, তবে সেখানে আমাদের সম্ভাব্য রাজধানী স্থাপন করব এবং সেটি ১০ নম্বর সেক্টরের তত্ত্বাবধানে থাকবে। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনীর যেসব ইউনিট কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় সীমিত না থেকে দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করবে, তারাও ১০ নম্বর সেক্টরের আওতায় থাকবে। যেমন, বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ হতো ডিমাপুরে (ভারতের নাগাল্যান্ড প্রদেশে)। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বিমানবাহিনী দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করবে। এটি ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকবে। নৌকমান্ডোদের প্রশিক্ষণ হতো মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীর পাশে পলাশীর একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে, আর এর অভিযান চলত দেশজুড়ে। এটাও ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকার কথা ছিল।

অর্থাৎ যেসব বিভাগ কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে—যেমন সম্ভাব্য রাজধানী, সামরিক সদর দপ্তর, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, নৌ-কমান্ডো ইত্যাদি—সেগুলো ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকবে। এগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কোথাও লিখিত না থাকলেও ১০ নম্বর সেক্টর সম্পর্কে আমরা এই ধারণাটিই পোষণ করতাম। অনেকগুলো কারণে এই মুক্তাঞ্চল বা ‘লজমেন্ট এরিয়া’ স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত ছিল না। প্রথমেই প্রশ্ন দেখা দেয় যে এটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী হবে? আমরা যদি মুক্তাঞ্চল গঠন করি তাহলে পাকিস্তান তাদের বিরাট পদাতিক, গোলন্দাজ ও সাঁজোয়া বাহিনী এবং বিমানবাহিনী নিয়ে এই মুক্তাঞ্চলকে আক্রমণ করবে। এ ধরনের আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাংলাদেশের ছিল না। আর যদি ভারতকেই আমাদের সাহায্যের জন্য তার সেনা, বিমান আর নৌবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়, তবে এটি সরাসরি পাক-ভারত যুদ্ধে রূপ নেবে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণে ভারত এ ধরনের পরিস্থিতি কখনোই চাইবে না, উপরন্তু সে সময় ভারত এর জন্য প্রস্তুতও ছিল না। অন্যদিকে এর ফলে বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনৈতিক সত্তা ও স্বাতন্ত্র্য বৃহত্তর পাক-ভারত যুদ্ধের মধ্যে হারিয়ে যেত। মুক্তাঞ্চল রক্ষা করার মতো শক্তি, সম্পদ বা অর্থ আমাদের না থাকার কারণে এটি গঠন নিয়ে আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

সেক্টর অধিনায়কদের সভায় যা আলোচনা হয়েছিল, তা পরে সভার কার্যবিবরণী এবং একাধিক নির্দেশিকা ও নীতিমালার সাহায্যে প্রচার করা হয়। সভায় অনেক বিষয় আলোচনা হলেও সবগুলোকে কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় ২৭টি বিষয় কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় (সদর দপ্তর বাংলাদেশ বাহিনী, পত্র নং ০০১০জি, তারিখ ৬ আগস্ট ১৯৭১)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি :

  • সেক্টরগুলোর সীমানা নির্ধারণ করা হয়। নির্দেশ দেওয়া হয় যে এক সেক্টর অপর সেক্টর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করবে না।
  • অনেকগুলো কোম্পানি নিয়ে একটি সেক্টর গঠিত হবে। সেক্টরের এলাকা ও দায়িত্বের ভিত্তিতে সেক্টরের কোম্পানিসংখ্যা নির্ধারণ করা হবে।
  • সেক্টরের দায়িত্ব ও অভিযান-পদ্ধতিগুলো সভায় নির্ধারণ করা হয়।
  • মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা বিমান, নৌ, গোলন্দাজ, সিগন্যাল বাহিনীতে কাজ করেছে বা সেসব বিষয়ে পারদর্শী, তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এদের দ্বারা ওই সব বাহিনী গঠন করা যায়।
  • ইয়ুথ ক্যাম্পের সঙ্গে বাংলাদেশ বাহিনীর কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না। ইয়ুথ ক্যাম্প সরকারের ভিন্ন সংস্থা পরিচালনা করবে।

১৯৭১-এর জুলাই মাসে কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলন

গণবাহিনী বা গেরিলাদের গঠন, কর্মপন্থা, প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ২৫ জুলাই গণবাহিনীর সংগঠন, অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক, রণকৌশল, আত্তীকরণ-সম্বন্ধীয় ১০ পৃষ্ঠার পত্র জারি হয় (সদর দপ্তর, বাংলাদেশ বাহিনী, পত্র নং ০০০৯জি, তারিখ : ২৫ জুলাই ১৯৭১)। এই পত্রে প্রেরিত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাবলির অতিরিক্ত আরও কিছু সিদ্ধান্ত ২৭ ও ৩১ জুলাই পৃথক পত্রের মাধ্যমে প্রচার করা হয়।

  • সদর দপ্তর ও সেক্টরের মধ্যে বেতার যোগাযোগ ভারতীয় সেক্টরের মাধ্যমে রক্ষা করা হবে। ভারতীয় সেক্টর সদর দপ্তর ও বাংলাদেশি সেক্টর সদর দপ্তর এক স্থানে না থাকলে তাদের মধ্যে বেতার যোগাযোগব্যবস্থা থাকবে।
  • লজিস্টিকস ও প্রশাসনিক বিষয়গুলোর মধ্যে মুক্তিবাহিনীর বেতন, পোশাক, রেশন, চিকিৎসা বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলনে অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও সেক্টর অধিনায়ক এবং জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা যুদ্ধ পরিচালনা বিষয়ে নীতিগত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলন শুরুর আগেই বিভিন্ন সেক্টর অধিনায়ক ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে একটা গুঞ্জন ওঠে যে তাঁরা যেভাবে যুদ্ধ চালাতে চান, কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি রেখে সেটা সম্ভব হবে না। যুদ্ধকে গতিশীল করার জন্য সেক্টর অধিনায়কেরা যুদ্ধ পরিষদ বা ওয়ার কাউন্সিল গঠন করার পক্ষে মত দেন। সম্মেলনে সেক্টর অধিনায়কদের পক্ষ থেকে সর্বসম্মতভাবে কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি ওঠে, শুধু খালেদ মোশাররফ এ বিষয়ে আপত্তি জানান। অধিকাংশ সেক্টর অধিনায়কের যুক্তি ছিল, কর্নেল ওসমানী অত্যন্ত প্রবীণ এবং গেরিলাযুদ্ধের রীতিনীতি বিষয়ে অনভিজ্ঞ; এ ছাড়া মতামত গ্রহণ ও প্রদানের ব্যাপারেও তিনি অত্যন্ত অনমনীয়। সেক্টর অধিনায়কেরা তাঁকে দেশরক্ষামন্ত্রীর মতো একটা সম্মানজনক পদে রাখার পক্ষে মত দেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে এই যুদ্ধ পরিষদের প্রধান করার প্রস্তাব করা হয়। মেজর খালেদ মোশাররফ এই মতামতের বিরোধিতা করেন। তিনি কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির পদে রেখে সব সেক্টর অধিনায়ককে নিয়ে যুদ্ধ পরিষদ বা ওয়ার কাউন্সিল গঠন করে তাঁদের হাতে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করার পক্ষে মত দেন। যুদ্ধ পরিষদ বা ওয়ার কাউন্সিলের ধারণাটির সূত্রপাত করেছিলেন মেজর জিয়া এবং অধিকাংশ সেক্টর অধিনায়কের কাছে প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন। কর্নেল ওসমানী বিষয়টি জানামাত্র প্রধান সেনাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার কথা বলে আবেগের পরিচয় দেন ও রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করেন।

মেজর জিয়াসহ অধিকাংশ সামরিক কর্মকর্তা যুদ্ধ পরিষদের প্রধান হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করায় আমি বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাই। কর্নেল ওসমানীকে আমি কোনোভাবেই খাটো করতে চাইনি। সত্যিকার অর্থে সেই সময় আমি বিষয়টি নিয়ে বিশেষ কোনো চিন্তাও করিনি। আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল, যেকোনো মূল্যে যুদ্ধ শেষ করে স্বাধীনতা অর্জন করা। যুদ্ধ পরিষদ গঠন করার ব্যাপারে জিয়াউর রহমান ও খালেد মোশাররফের অবস্থান ছিল বিপরীতমুখী। তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ বিশ্বাস থেকেই এটা করেছিলেন। মেজর জিয়াসহ বেশির ভাগ সেক্টর অধিনায়কই চেয়েছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধে গতিশীলতার জন্য আমাকে প্রধান করে একটা যুদ্ধ পরিষদ গঠন করা হোক। এ ব্যাপারে তাঁরা বেশ সোচ্চার ছিলেন। বিপরীতে খালেد মোশাররফও সোচ্চার ছিলেন কর্নেল ওসমানীর পক্ষে। কর্নেল ওসমানী নিজেও যুদ্ধ পরিষদের ধারণাকে সমর্থন করেননি। তাজউদ্দীন সাহেবও আমাকে যুদ্ধ কাউন্সিলের প্রধান করতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি পরে আমাকে জানিয়েছিলেন যে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমাকে প্রধান করার বিষয়ে বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, বিমানবাহিনীর লোক কীভাবে যুদ্ধ কাউন্সিলের প্রধান হবেন? সেনাবাহিনীর প্রধান ছাড়া আর কোনো যোগ্য ব্যক্তি যুদ্ধের প্রধান অথবা গেরিলা প্রধান অথবা যুদ্ধ কাউন্সিলের প্রধান হতে পারবেন না, বিষয়টি আমার কাছে খুব গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। পদাতিক বা সামরিক বাহিনীর না হয়েও নিয়মিত বাহিনী অথবা গেরিলাযুদ্ধের প্রধান হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে। যেমন ইংল্যান্ডে প্রতিবছর তিন বাহিনীর সমন্বয়ে যে কাউন্সিল গঠিত হয় সেখানে পর্যায়ক্রমে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রধানগণ কাউন্সিলের প্রধান হয়ে থাকেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে জেনারেল গিয়াব সামরিক বাহিনীর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও গেরিলাযুদ্ধের প্রধান হয়েছিলেন। ওই সময় এই ঘটনা সেনাবাহিনীর উচ্চস্তরে একটি অসন্তোষের সৃষ্টি করলেও তা মাঠপর্যায়ে যুদ্ধের ওপর প্রত্যক্ষভাবে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলেনি।

সেক্টর অধিনায়ক ও অন্য সামরিক কর্মকর্তাদের প্রস্তাবিত যুদ্ধ পরিষদের ধারণায় কর্নেল ওসমানী ক্ষুব্ধ হয়ে সম্মেলনের প্রথম দিনে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করার কথা বলেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি অবশ্য বেশ কয়েকবার পদত্যাগের হুমকি দেন, যদিও লিখিতভাবে তিনি কখনো পদত্যাগপত্র দেননি। কর্নেল ওসমানীর পদত্যাগের হুমকিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেশ বিচলিত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে হয়েছিল, যুদ্ধের সংকটময় অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি পদত্যাগ করলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তাজউদ্দীন আহমদ কর্নেল ওসমানীকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে পদত্যাগ করা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হন। এভাবেই সম্মেলনের প্রথম দিনটি যুদ্ধ পরিষদ বিতর্ক, প্রধান সেনাপতির পদত্যাগ, মান-অভিমান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চলে যায়। ফলে ১১ জুলাই সেক্টর অধিনায়কেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি। প্রকৃত অর্থে সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১২ জুলাই। সেদিন সকালে উদ্ভূত পরিস্থিতির সুষ্ঠু সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সম্মেলনে একটি আবেগময় বক্তৃতা দেন। এ বক্তৃতায় তিনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য ও সমঝোতার আহ্বান জানান। যুদ্ধ পরিষদ বিষয়টি পরে সম্মেলনে আর আলোচিত হয়নি। কর্নেল ওসমানীও প্রধান সেনাপতির পদ থেকে আর পদত্যাগ করেননি।

তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের পর সভার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং বাকি সময় সম্মেলন ঠিকমতো চলে। সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় যে গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যখন পাকিস্তানি বাহিনীকে দুর্বল করে ফেলব এবং দেশ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে, তখন সম্মুখসমরের প্রয়োজন হতে পারে। সেই সময়ে শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য ব্রিগেডের প্রয়োজন হবে। এই ব্রিগেডগুলো শুধু সম্মুখসমরের জন্যই নয়, বরং এগুলোর ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন দেশের নতুন সেনাবাহিনী গড়ে উঠবে। তাই এই সম্মেলনের শেষের দিকে কর্নেল ওসমানী ঠিক করলেন যে গেরিলাযুদ্ধের পাশাপাশি প্রথাগত যুদ্ধের জন্য ব্রিগেড গঠন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় গেরিলাযুদ্ধের মতো একটি প্রতিষ্ঠিত কৌশলকে পাশ কাটিয়ে কর্নেল ওসমানীর ব্রিগেড গঠন করার সিদ্ধান্তটি সুবিবেচনাপ্রসূত বা বাস্তবসম্মত ছিল না। একটি শক্তিশালী ব্রিগেড গঠন করার জন্য অনেক দক্ষ সেনা, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ এবং প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হয়। আমাদের সেই সময়ে ব্রিগেড গঠনের মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোকবল, অস্ত্র ও রসদ ছিল না। ভারতও মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করতে পারছিল না। আমাদের স্বল্প সম্পদ ও লোকবল দিয়ে ব্রিগেড গঠন কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। আমাদের উচিত ছিল গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুকে দুর্বল করার পর অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ব্রিগেড গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা। জুলাইয়ের সম্মেলনেই মেজর জিয়ার তত্ত্বাবধানে প্রথম ব্রিগেড বা ‘জেড ফোর্স’ গঠন করে তাঁকে এই ফোর্সের কমান্ডার করা হয়। জেড ফোর্স নামটি জিয়াউর রহমানের নামের আদ্যক্ষর ‘জেড’ থেকে নেওয়া। সাধারণত ব্রিগেডের এ ধরনের নাম হয় না, বরং নম্বর হয়। কিন্তু ওসমানী সাহেব জেড ফোর্স নাম দিয়ে এটিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে আসেন। তাঁর এই পদক্ষেপ আমার পছন্দ হয়নি। তবে এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করিনি।

তেলিয়াপাড়ার সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি করার সিদ্ধান্ত জুলাইয়ের সম্মেলনেও বহাল রাখা হয়। সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রবকে চিফ অব স্টাফ বা প্রধান সেনাপতির মুখ্য সহকারী নির্বাচন করা হয়। চিফ অব স্টাফের কাজ হচ্ছে সেনাবাহিনীর অভিযান, প্রশিক্ষণ, প্রশাসনসহ সব বিষয়ে প্রধান সেনাপতিকে পরামর্শ দেওয়া এবং প্রধান সেনাপতি গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা। জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকেই কর্নেল ওসমানীর নির্দেশে আমি মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। জুলাই মাসের সম্মেলনে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়। একজন চাকুরিরত জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত কনিষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাকে এভাবে চিফ অব স্টাফ নিয়োগ দেওয়াটা সঠিক ছিল বলে আমি মনে করি না। এটি সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠিত চর্চার ব্যতিক্রম ছিল। আমি কর্নেল ওসমানীকে বলেছিলাম, ‘স্যার, পদমর্যাদায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব আমার কনিষ্ঠ, তবু তাকে স্যালুট বা সম্মান প্রদর্শনে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি সবকিছু ফেলে পদ ও পদবির জন্য এখানে আসিনি। আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে এসেছি।’

কলকাতার থিয়েটার রোডে আমি তাজউদ্দীন সাহেবের পাশের রুমে থাকতাম। বারান্দায় দেখলে অনেক সময় আমাকে তিনি ডেকে নিয়ে রুমে বসাতেন; যুদ্ধের নানা বিষয় ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন। তাজউদ্দীন সাহেব নিজেই একদিন আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন, ‘খন্দকার সাহেব, আমি আপনাকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি তা করতে পারিনি, কারণ আমাকে বলা হয় যে এ বিষয়ে সেনাসদস্যদের কয়েকজন বিরোধিতা করতে পারে।’

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব খুব ভদ্র ও সুন্দর মনের মানুষ ছিলেন। তিনি আমার কনিষ্ঠ পদবির ছিলেন। শুধু আওয়ামী লীগের এমএনএ হওয়ার কারণে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে উচ্চপদ দেওয়া হয়। রব সাহেব নিজে তাঁর দুর্বলতা স্বীকার করে আমার কাছে বলেছিলেন যে তিনি এই সব যুদ্ধ বিষয়ে অভিজ্ঞ নন এবং কোনো অভিযানও পরিচালনা করেননি। তিনি খোলামেলাভাবেই আমাকে এই সব কথা বলেছিলেন। কর্নেল রব সাপ্লাই কোরে (আর্মি সার্ভিসেস কোর) দীর্ঘদিন কাজ করেন, তাই অপারেশনাল কোনো বিষয়ে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। রব সাহেব যুদ্ধের শুরু থেকেই আগরতলায় অবস্থান করছিলেন। চিফ অব স্টাফ হিসেবে তাঁকে আমি কখনো থিয়েটার রোডে দায়িত্ব পালন করতে দেখিনি। সদর দপ্তরে না থাকায় প্রধান সেনাপতিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেওয়ার সুযোগই পাননি। চিফ অব স্টাফের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়েও তাঁকে কেন সার্বক্ষণিকভাবে আগরতলায় রাখা হয়েছিল, তা-ও আমার বোধগম্য হয়নি। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ বাহিনীর চিফ অব স্টাফের সব দায়িত্ব যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত আমাকেই পালন করতে হয়।

আমি একজন মোটামুটি অভিজ্ঞ যোদ্ধা হিসেবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগেও আমি যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। যুদ্ধে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে বোমা ফেলেছি, মেশিনগান দিয়ে আক্রমণ করেছি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় আমি যুদ্ধের ময়দানে ছিলাম। যুদ্ধের সময় বৈমানিকদের দুই ঘণ্টা পরপর ককপিটে বসে থাকতে হয়। শত্রুবিমান এলে সে যেন দ্রুততার সঙ্গে যুদ্ধবিমান নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে পারে। এভাবে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানের ককপিটে বসে কাটিয়েছি। তাছাড়া বিমানবাহিনীতে যে প্রশিক্ষণ হয় তা প্রকৃত যুদ্ধের মতো। যেমন, প্রশিক্ষণকালে যুদ্ধের সব সরঞ্জামসহ বিমান নিয়ে উড্ডয়ন করতাম। এরপর লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আক্রমণ করতাম। ফিরে আসার পর অভিযানের সবদিক পর্যবেক্ষণ মনিটরে নিরীক্ষা করা হতো। সফলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছি কি না অথবা লক্ষ্যবস্তু থেকে কত দূরত্বে আঘাত হেনেছি—এসব পর্যবেক্ষণ করে দেখা হতো। দিনের পর দিন আমাদের এই ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হতো। যুদ্ধের সময় ওই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করা হতো। যুদ্ধ যেকোনো সময় সংঘটিত হতে পারে, তখন আর প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় থাকে না। তাই সামগ্রিকভাবে বৈমানিকের প্রশিক্ষণ যুদ্ধের সমতুল্য ছিল। এ ছাড়া সমগ্র পাকিস্তানে বাঙালিদের মধ্যে মাত্র দুজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন ছিল। একজন আমি এবং অন্যজন পাকিস্তানে অবস্থানরত এম জি তাওয়াব।

মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানী ও চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব সেনা কর্মকর্তা হলেও দুজনই ছিলেন রাজনৈতিক তথা আওয়ামী লীগের নেতা ও এমএনএ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের অধীন আমার দায়িত্ব পালনে কোনো অসুবিধা বা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়নি। তবে যুদ্ধ চলাকালে আমার কাজে যতখানি স্বাধীনতা থাকা দরকার ছিল, কর্নেল ওসমানী ঠিক ততটা স্বাধীনতা শুধু আমাকে নয়, অনেককেই দিতেন না। যেমন, আমি হয়তো কোনো সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ড পরিদর্শনে গিয়েছি, পরিদর্শন শেষ করার আগেই তিনি চলে আসার জন্য টেলিগ্রাম পাঠাতেন। আমি যে কিছু দেখব, যোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলব, তাদের সুবিধা-অসুবিধা বোঝার চেষ্টা করব, সে সুযোগ পেতাম না। আবার হয়তো বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ দেখতে ডিমাপুরে গেছি বা তাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ বিমানে ফ্লাই করছি, ঠিক এই সময় তিনি সংবাদ পাঠাতেন, ‘তোমার জরুরি প্রয়োজন, তুমি ইমিডিয়েটলি চলে আসো।’ ফেরত এসে দেখতাম বিশেষ কোনো কাজ নেই। এভাবে আমার বা আমাদের কাজ বাধাগ্রস্ত হতো।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের সদর দপ্তর ছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। আমার জানামতে, কর্নেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধান সেনাপতি হিসেবে ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়েছিলেন মাত্র একবার। আমাকে কিন্তু বেশ কয়েকবার সেখানে যেতে হয়েছে। ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন, তাই তাঁরা আলোচনার জন্য সেখানে আমাকে ডেকে নিতেন। তাজউদ্দীন সাহেবও ফোর্ট উইলিয়ামে যাওয়া ও ভারতীয়দের সঙ্গে সমন্বয় বিষয়ে আমাকেই বলতেন। তাজউদ্দীন সাহেবের পরামর্শে বা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আহ্বানে আলোচনার জন্য হয়তো আমি রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় কর্নেল ওসমানী বলতেন, ‘তুমি যেয়ো না। তোমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।’ তিনি নিজেও গেলেন না বা যেতে চাইলেন না, আবার আমাকেও যেতে দিলেন না। তিনি প্রায় পুরোটা সময়ই থিয়েটার রোডে তাঁর অফিসঘরের ভেতর বসে থাকতেন। ফলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় সাধনে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো। যুদ্ধের পুরোটা সময়ই এ ধরনের সমস্যা হয়েছে। আমার ধারণা, তিনি কিছুটা আস্থাহীনতায় ভুগতেন অথবা তাঁর পদ, পদবি ও জ্যেষ্ঠতা বিষয়ে তিনি অতিরিক্ত সচেতন ছিলেন।

আমার অভিজ্ঞতা ও বিবেচনার ওপর আস্থা রেখে বলতে পারি যে যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ বাহিনীর সঠিক নেতৃত্ব নির্ধারণে সক্ষম হয়নি। প্রথমত, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া উচিত ছিল এমন একজনকে যাঁর গেরিলাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে কিংবা একজন কমবয়সী সেনা কর্মকর্তাকে যিনি গেরিলাযুদ্ধের জন্য পেশাগতভাবে উপযুক্ত। সরকার তা না করে সশস্ত্র বাহিনীতে একটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়। কর্নেল ওসমানী ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব দুজনই ছিলেন বয়স্ক এবং গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনার মতো যোগ্যতা ও মানসিকতা তাঁদের ছিল না। এঁদের সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া মোটেই সমীচীন হয়নি। এটাও একটা কারণ, যার জন্য সেক্টর অধিনায়কেরা বাংলাদেশ বাহিনী সদর দপ্তর বা কর্নেল ওসমানীর ওপর খুব একটা আস্থা রাখতে পারতেন না। যুদ্ধরত একটি বাহিনী যদি প্রথম থেকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব না পায়, তাহলে যুদ্ধের ময়দানে সুফল পাওয়া দুরূহ হয়ে যায়।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নির্দিষ্ট কোনো চরিত্র ছিল না। কখনো এটি গেরিলাযুদ্ধের রূপ নিয়েছে, কখনো আবার রূপ নিয়েছে প্রথাগত যুদ্ধের। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল যে আমরা কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। প্রাথমিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক নির্দেশনা ছিল না। খুব উচ্চপর্যায়ের ছিল না মুক্তিযোদ্ধাদের প্রণোদনাও। আমাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ নির্ভর করত অন্যের ওপর। যুদ্ধের জন্য যে ধরনের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল আমাদের তা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের একটি মূলধারা থাকলেও অনেকগুলো উপধারা বা বাহিনী ছিল, যারা সব সময় একে অপরের সম্পূরক না হয়ে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার পরও বলব, দেশের আপামর জনগণের ইচ্ছা, সক্রিয় সহযোগিতা আর অকাতরে প্রাণদান মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্তভাবে সফল করে তুলেছে।

এদিকে সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলন শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মেজর খালেদ মোশাররফ কলকাতায় থেকে যান। তিনি ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন এবং তাঁর সেক্টর এলাকাটি তুলনামূলকভাবে বেশ বড় ছিল। বড় হওয়ার কারণে তাঁর এলাকায় কর্মকাণ্ডও অনেক বেশি হতো। সেখানে সেক্টর অধিনায়ক হিসেবে তাঁর উপস্থিতির খুব প্রয়োজন ছিল। আমি এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে কথা বলি এবং তাঁকে জানাই যে খালেদ মোশাররফের দ্রুত তাঁর সেক্টর এলাকায় যাওয়া উচিত। খালেদ মোশাররফ সেই সময় দুইতিন সপ্তাহ কলকাতায় থেকে যান এবং তাঁর নামে অপর একটি ব্রিগেড গঠনের চেষ্টা চালাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত কর্নেল ওসমানী ২ নম্বর সেক্টরেও একটি ব্রিগেড গঠনে সম্মত হন, যার নাম দেওয়া হয় ‘কে ফোর্স’। কর্নেল ওসমানী একই সঙ্গে উপলব্ধি করেন যে খালেদ মোশাররফের নামে কে ফোর্স গঠন করলে মেজর কে এম সফিউল্লাহ বিষয়টিকে সহজভাবে নেবেন না। কারণ, মেজর সফিউল্লাহ খালেদ মোশাররফের চেয়ে জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তাই সফিউল্লাহর নামেও একটি ব্রিগেড অর্থাৎ ‘এস ফোর্স’ গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। ব্রিগেড দুটো গঠনের বিষয়ে সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলনে কোনো আলোচনা হয়নি বা হওয়ার সুযোগ ছিল না। এ সিদ্ধান্তগুলো সম্মেলনের পর কর্নেল ওসমানী নিজেই নিয়েছিলেন। ব্রিগেডগুলোর নামকরণ বিষয়ে সিদ্ধান্তও ছিল কর্নেল ওসমানীর।

সদর দপ্তরে যোগ দেওয়ার পর আমাকে প্রধানত বাংলাদেশ বাহিনীর অপারেশন এবং প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর রিক্রুটমেন্ট, প্রশিক্ষণ শেষে তাদের বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো ও তাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করার বিষয়টিও আমাকে দেখতে হতো। চিকিৎসা ও ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর কখনো মিত্রবাহিনীর সম্পদ থেকে কখনো নিজস্ব সম্পদ থেকে ব্যবস্থা নিত। আমি এসবের মূল সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করতাম। প্রশিক্ষণের বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলা প্রয়োজন যে প্রশিক্ষণ কাদের দেওয়া হবে, কতজনকে দেওয়া হবে, কখন থেকে দেওয়া হবে, সেটা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক নেতৃত্বই এ সিদ্ধান্ত নিতেন। প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমরা সেখানে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারতাম না। মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানের ব্যাপারেও বেশ কিছু দুর্বলতা ছিল। যুদ্ধ করতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার দরকার হয় এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। প্রথম দিকের অভিযানগুলো ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকায় খুব একটা ভালো ফল পাওয়া যায়নি। পরে আমাদের সেক্টর অধিনায়কেরা কিছুটা তৎপর হলেও সদর দপ্তরে সার্বিক কোনো যুদ্ধ পরিকল্পনা না থাকায় এসব তৎপরতা থেকে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। লক্ষ করতাম যে সরকার ও বাংলাদেশ বাহিনীর মধ্যে, বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরের অভ্যন্তরে, বাংলাদেশ বাহিনী ও সেক্টরের মধ্যে বা সেক্টরগুলোর নিজেদের মধ্যে সমন্বিত সিদ্ধান্ত কমই নেওয়া হতো। সেক্টরগুলোর সঙ্গে সদর দপ্তরের কোনো যোগাযোগ ছিল না। কোনো বেতারযন্ত্র বা সে রকম যোগাযোগব্যবস্থা চালু ছিল না। যুদ্ধে কী ধরনের অগ্রগতি হচ্ছে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না মন্ত্রিপরিষদেরও।

কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে আমি হয়তো কারও নিন্দা করছি। প্রকৃত অর্থে আমার লেখায় কিছুটা সমালোচনাসূচক কথা এসেই যাচ্ছে। কিন্তু আমি কাউকে শুধু নিন্দা করার স্বার্থে নিন্দা করছি না। আমি যা-ই বলছি তা সত্য ও বাস্তব। জুলাইয়ের সম্মেলনের পর খালেদ মোশাররফের চাপে অথবা কর্নেল ওসমানীর দুর্বলতার কারণে দুটি ব্রিগেড গঠন করা হলো। তাঁরা উপলব্ধি করলেন না যে লোকবল নেই, অস্ত্রশস্ত্র নেই, কী দিয়ে ব্রিগেডগুলো গঠিত হবে? সেই সময় ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। এ কথা কর্নেল ওসমানীকে বলতে আমি দ্বিধা করিনি। জেড ফোর্স, এস ফোর্স ও কে ফোর্স গঠন করে যুদ্ধে লোকবলের অপচয় করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব ব্রিগেড যুদ্ধে তেমন একটা ব্যবহৃত হয়নি। ব্রিগেড গঠনের ফলে ভালো যোদ্ধা ও ভারী অস্ত্রগুলো সেক্টর থেকে চলে গেলে সেক্টরে জনবল ও অস্ত্রের ঘাটতি পড়ে যায় আর গেরিলাযুদ্ধের গতিও সাংঘাতিকভাবে কমে যায়। সেক্টর থেকে প্রশিক্ষিত সৈনিকদের ব্রিগেডগুলোতে বদলি করার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হলো, তা সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি পজিশন পেপারে উল্লেখ করা হয় এভাবে :

প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ মে, জুন ও জুলাই মাসের একাংশে সেক্টরের সৈনিকেরা যুক্তিসংগতভাবে ভালোমতো সক্রিয় ছিল। যাহোক, ব্রিগেড গঠনের জন্য সেক্টরের সবচেয়ে ভালো ইপিআর, মুজাহিদ ও আনসারদের নিয়ে যাওয়ায় সেক্টরগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং তাদের কার্যকারিতা কমে গেছে। সেক্টর এখন যে পরিমাণে অভিযান পরিচালনা করছে তা আগের থেকে অনেক কম এবং ফলপ্রসূও হচ্ছে স্বল্প মাত্রায়।

অস্ত্র ও দক্ষ সেনাবাহিনীর অভাবে আমাদের যুদ্ধ যেখানে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল, তখন আমরা ব্রিগেড গঠন করে কী করব? আমাদের সব কটি ব্রিগেড মিলে প্রশিক্ষিত, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং অভিজ্ঞ পাকিস্তানি বাহিনীকে কতটুকু প্রতিরোধ করতে পারত? এই ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য ছিল অন্তর্ঘাততুল্য। আমি তখন কর্নেল ওসমানীকে বলেছি, ‘স্যার, আমি আপনার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। ব্রিগেড গঠন করলে আমাদের যুদ্ধাস্ত্র ও লোকবলের অপচয় হবে। তা ছাড়া স্বল্প সময়ে একটি কার্যকর ব্রিগেড গঠন করা শুধু অসম্ভবই নয়, অবাস্তবও। পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন সেপাই নিয়ে আপনি কত দিন প্রশিক্ষণ করবেন? কত দিনে আপনি ওদের সম্মুখযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করবেন? স্মরণ রাখা উচিত, আমরা একটি দক্ষ ও আধুনিক অস্ত্রসংবলিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছি।’

একটা ব্রিগেড গঠন করতে যেরকম যুদ্ধসামগ্রী, দক্ষ সৈন্য, প্রশিক্ষণ এবং সময় লাগে আমাদের তা ছিল না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা ছিল, বাংলাদেশ যদি এই প্রক্রিয়ায় ধীরগতিতে সৈন্য জোগাড় করে সেনাবাহিনী গঠন করে এবং তারপর যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করে, তবে ভারত হয়তো মাসের পর মাস অপেক্ষা না-ও করতে পারে। কর্নেল ওসমানীর সিদ্ধান্তে আমার বিরোধিতার জন্য তিনি ভাবতেন যে আমি বোধ হয় ভারতীয়দের পক্ষে কথা বলছি। আসলে তা মোটেই সঠিক ছিল না। আমি বোঝাতে চেষ্টা করতাম যে আমরা এখানে খেলা করতে বা সময় অপচয় করতে আসিনি। আমরা এসেছি আমাদের জীবন-মরণের সমস্যা সমাধান করতে এবং সেটা করতে হবে যতটা সম্ভব কম সময়ে। ব্রিগেড গঠন ও প্রথাগত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার বিষয়টি যে সঠিক ছিল না তা অক্টোবর মাসের অপারেশন প্লানে মূল্যায়ন করা হয় :

এই যুদ্ধে আমরা মুখোমুখি হয়েছি এমন এক শত্রুর, যারা খুব ভালোভাবে প্রশিক্ষিত, সুসজ্জিত ও শক্তিধর। প্রথাগত যুদ্ধে শত্রুকে ধ্বংস করতে আমাদের ১৫ ডিভিশন সৈন্যের প্রয়োজন হবে। এটা অবাস্তব এবং অধিক বিবেচনার দরকার নেই। তাই, প্রাথমিকভাবে অপ্রচলিত যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধের রণনীতি হওয়া প্রয়োজন। এই কারণে গেরিলা অভিযানকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। সাধারণত গেরিলা অভিযান শুরু হয় স্বল্পসংখ্যক একনিষ্ঠ, নিবেদিত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। স্পষ্ট কারণে আমাদের স্বল্প সময়ের মধ্যে এই যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে যেতে হবে। তাই আমাদের ক্ষেত্রে, গেরিলা আর নেতৃত্ব আমাদের বরণ করে নিতে হবে।
বিটার সুইট ভিক্টরি : আ ফ্রিডম ফাইটার্স টেল
এ কাইয়ুম খান, ইউপিএল, ঢাকা, পৃ. ২৪৩

এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যখন বিদ্রোহ করে দেশ ছেড়ে আসে, তখন তাদের জনবল অনেক কম ছিল। অনেকে আসতে পারেনি, অনেকে হতাহত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সময় প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের জনবল ছিল প্রায় ৩০০ আর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের জনবল ছিল ৩৫০। অন্য তিনটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থা এর চেয়ে খুব ভালো ছিল না। এ ছাড়া ব্যাটালিয়নগুলো তাদের ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলোও সঙ্গে আনতে পারেনি। তখন ব্যাটালিয়নগুলোর যে সামরিক শক্তি ছিল, তা দিয়ে তিনটি ব্রিগেড তো দূরের কথা, একটি ব্রিগেডও গঠন করা সম্ভব ছিল না। একটি ব্রিগেড গঠন করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন হয় প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা, সৈনিক ও অন্যান্য জনবলের। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব থাকলে নতুন জনবলকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। আর এর জন্য সময় লাগে। লোকবলের অভাবে এক-তৃতীয়াংশ সদস্য দিয়ে নতুন ব্রিগেডগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন ব্রিগেডের এই এক-তৃতীয়াংশ সদস্যদের মধ্যে সেনাবাহিনীর সৈন্যরা ছাড়া আনসার, মুজাহিদ, ইপিআর, সিভিল ডিফেন্স ও পুলিশের লোকও ছিল। বিভিন্ন বাহিনী থেকে বিভিন্ন মানের সৈনিকেরা প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে একই পর্যায় বা স্তরের ছিল না বলে ব্রিগেডগুলো তাদের অভিযানে কার্যকর ফল লাভ করতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে এই অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের মূল্য দিতে হয়েছে। যে সৈনিকদের নিয়ে ব্রিগেড গঠন করা হয়, তারা ব্রিগেড গঠনের আগে সেক্টর পরিচালিত গেরিলাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিত বা অংশ নিত। তারা গেরিলাযুদ্ধ থেকে চলে আসার পর গেরিলাযুদ্ধ স্তিমিত হয়ে পড়ে। সেক্টর থেকে চলে আসার আগে এসব প্রশিক্ষিত সৈনিক গেরিলাযুদ্ধে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। সেক্টর থেকে তাদের এভাবে সরিয়ে ব্রিগেড গঠন করার ফলে আমরা গেরিলাযুদ্ধে পিছিয়ে পড়ি এবং গেরিলাযুদ্ধে আমাদের সাফল্য ব্যাহত হয়। ‘এস’ ও ‘কে’ ফোর্স গঠনের জন্য তিনটি নতুন পদাতিক ইউনিট যথা নবম, দশম ও একাদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। এই তিনটি ব্যাটালিয়ন গঠনের জন্য যে সরকারি আদেশ প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে এই ইউনিটগুলোর জনবল কীভাবে সংগ্রহ করা হবে তা উল্লেখ করা হয়। আমি আদেশের সেই অংশটি তুলে ধরলাম। এটি পাঠ করলে কারও বুঝতে অসুবিধা হবে না যে এই ফোর্সগুলো সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হয়েছিল।

সৈনিকের সংস্থান
জেসিও এবং এনসিও (সম্ভাবনাময় এনসিওসহ)
দ্বিতীয় ও চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল এবং ১ থেকে ৩ নম্বর সেক্টরের সৈনিকদের মধ্য থেকে (১ নম্বর সেক্টর থেকে সবচেয়ে কম) জেসিও এবং এনসিওর চাহিদা পূরণ করতে হবে। সংগ্রহের ক্ষেত্রে শতকরা ৩০ ভাগ বর্তমান পদে অধিষ্ঠিতদের মধ্য থেকে এবং গঠিতব্য ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের সঙ্গে আলোচনা করে পদের জন্য যোগ্যদের মধ্য থেকে বাকি শতকরা ৭০ ভাগ নির্বাচিত করতে হবে।
সেপাই
২৫% সৈনিক গ্রহণ করতে হবে দ্বিতীয় ও চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল এবং সংশ্লিষ্ট সেক্টরের প্রশিক্ষিত সৈনিকদের মধ্য থেকে। এতে সমানুপাতিক হারে প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞরাও থাকবে। বাড়তি ৭৫% পূরণ করা হবে প্রশিক্ষিত নবীন সৈনিক দ্বারা, যাদের অতি শীঘ্রই ভর্তি করা হবে (নিচের উপঅনুচ্ছেদ জি লক্ষ করুন [এখানে উল্লেখ করা হয়নি])। গঠিতব্য ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের সঙ্গে আলোচনা করে [নবীন সৈনিক] নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।
বাংলাদেশ বাহিনী সদর দপ্তর, পত্র নং ০০০২জি, তারিখ ২৩ আগস্ট ১৯৭১

ব্রিগেডগুলো মুক্তিযুদ্ধকালে প্রথাগত যুদ্ধ করেনি, যদিও তাদের সৃষ্টি হয়েছিল সে কারণেই। ব্রিগেডগুলোতে নতুন ও পুরোনো ইউনিট ছিল আটটি। এগুলোর বেশির ভাগই ইউনিট হিসেবে যুদ্ধ করেনি। যে দু-তিনটি ইউনিট যুদ্ধ করেছিল, তাদের সাফল্যও খুব একটা উল্লেখযোগ্য ছিল না। বরং প্রথাগত যুদ্ধ করতে গিয়ে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথাগত যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ায় আমাদের কী ক্ষতি হয়েছিল, তার একটি বর্ণনা দিলাম।

৩১ জুলাই জেড ফোর্স প্রথম বর্তমান জামালপুর জেলার কামালপুর বিওপি আক্রমণ করে। আক্রমণে অংশ নেয় জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এই আক্রমণে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সফল হয়নি। উল্টো তাদের বহু সৈনিক শহীদ হয়। ওসমানী সাহেব যুদ্ধের ফলাফলে প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ হন। তিনি জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াকে ব্রিগেড থেকে অপসারণ করতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁকে শান্ত করি। মনে করলাম যে আমাদের সেনা সংগঠনটি ছোট হলেও বাংলাদেশের ভেতরে এর একটি ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। এখনই যদি আমরা এই ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বকে অপসারণ করতে শুরু করি তাহলে আমাদের ভেতর ভুল-বোঝাবুঝি ও হতাশার সৃষ্টি হবে। দেশের মানুষ ভাবতে আরম্ভ করবে যে এরা কী যুদ্ধ করবে? এরা তো নিজেদের মধ্যে রেষারেষি শুরু করেছে। এ ছাড়া ব্রিগেড গঠন ও প্রথাগত বা কনভেনশনাল লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ তো কর্নেল ওসমানীরই পরিকল্পনা ছিল। মেজর জিয়া তো শুধু সেটি কার্যকর করতে গিয়েছিলেন। ব্যর্থতার দায়ভার তো কর্নেল ওসমানীকেও নিতে হবে। যাহোক, পরে মেজর জিয়াকে সতর্ক করে দেওয়া ছাড়া তিনি আর কোনো পদক্ষেপ নেননি।

কামালপুর বিওপি ছিল শত্রুর একটি শক্ত ঘাঁটি। সেখানে এক কোম্পানির অধিক সৈন্য সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা নিয়ে অবস্থান করছিল। এ ছাড়া তাদের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য বকশীগঞ্জে আরও সৈন্য ছিল। এ ধরনের অবস্থানে শত্রুকে আক্রমণ করতে হলে একই মানের তিন গুণ সৈন্যের দরকার ছিল। আমরা তা না করে পুনর্গঠিত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করলাম। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। আমরা সেখানে শত্রুর কী ক্ষতি করতে পারলাম তা জানি না। কিন্তু আমাদের তো ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেল। ১১ নম্বর সেক্টরকে নিয়ে মেজর তাহেরও এই কামালপুর বিওপি আক্রমণ করে সুবিধা করতে পারেননি। তিনিও ব্যর্থ হন। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হওয়ার পর কামালপুর দখল করতে ভারতীয় বাহিনীকেও বেশ বেগ পেতে হয়। এ ধরনের কনভেনশনাল যুদ্ধ আমাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। দৃঢ়ভাবে প্রতিরক্ষায় থাকা শক্তিশালী শত্রু অবস্থান গেরিলাযুদ্ধের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে সঠিক নয়। আমরা তা ভুলে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছি। কামালপুর ছাড়াও নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে ব্রিগেডের ইউনিটগুলো বেশ কয়েকটি আক্রমণ রচনা করেছে। দু-একটি ছাড়া কোনোটাতেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত ব্রিগেডগুলো যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি।

আমি ওসমানী সাহেবকে কয়েকবার অনুরোধ করেছিলাম যেন প্রথাগত যুদ্ধে আমরা না জড়াই, বরং আমরা ব্রিগেড যুদ্ধ ভুলে গিয়ে গেরিলাযুদ্ধের পদ্ধতিতে ফিরে আসি। মুক্তিযোদ্ধারা আগে যুদ্ধ করতে শিখুক। শত্রুকে চারদিক থেকে ছোট ছোট চোরাগোপ্তা আক্রমণের সাহায্যে নাজেহাল করতে থাকুক। সারা শরীর থেকে এভাবে রক্তক্ষরণের পর যখন শত্রু দুর্বল হয়ে পড়বে, তখন তাকে সরাসরি আক্রমণ করে ধ্বংস করে ফেলা হবে। সেই পর্যায়ে আমরা ব্রিগেড যুদ্ধের কথা ভাবব। তিনি রাজি হলেন না।

প্রথাগত যুদ্ধে ব্রিগেডগুলোর অংশগ্রহণ বিষয়ে খোদ ব্রিগেড বা ফোর্স অধিনায়কেরা সম্মত ছিলেন না। বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রথাগত যুদ্ধের অনুকূল নয় বলে মত দিয়েছেন তাঁরা নিজেরাও। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথাগত যুদ্ধের জন্য লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা হলে জেড ফোর্সের অধিনায়ক ভিন্নমত পোষণ করেন এবং এই ব্যাখ্যাটি উপস্থাপন করেন :

৫. আমাদেরটাসহ যেকোনো মুক্তিযুদ্ধের তিনটি স্তর থাকে, প্রথম স্তরে সংঘাতের শুরু, দ্বিতীয় স্তরে ভারসাম্য আনা এবং তৃতীয় স্তরে আক্রমণে যাওয়া। আমরা এখনো প্রথম স্তরের সংঘাত শেষ করতে পারিনি। এই স্তর তখনই সম্পন্ন হবে যখন আমাদের ঘাঁটির তৎপরতা যথেষ্ট কার্যকর হবে, ঘাঁটির সেনারা পরিপক্ব ও আত্মবিশ্বাসী হবে এবং যখন ঘাঁটির সেনাদের কর্মকাণ্ড ও চলাচলের ওপর আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্ভাগ্যজনক যে এই মুহূর্তে ঘাঁটির তৎপরতা অপর্যাপ্ত এবং আরও কিছু বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে। সাধারণত নিয়মিত ইউনিট ও ফর্মেশনসহ প্রথাগত পদ্ধতিতে নিয়মসিদ্ধ যুদ্ধ শুরু হয় দ্বিতীয় স্তরের শেষে অথবা তৃতীয় স্তরে। যাহোক, আমাদের সময়ের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে আমরা সর্বোচ্চ প্রথম স্তর সমাপ্তির পর প্রচলিত যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারি।
৬. বাস্তবতা এই যে আমরা কেবল প্রথম স্তরের কর্মতৎপরতা শুরু করেছি এবং আমরা নিশ্চিত নই যে এই ব্রিগেড নিয়ে আক্রমণ শুরুর সময় ঘাঁটির সেনাদের প্রস্তুত করতে সক্ষম হব কি না, যদিও আমরা তা চাচ্ছি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ সপ্তাহে ব্রিগেডের প্রচলিত যুদ্ধ শুরু করাটা প্রায় আত্মঘাতী হবে।
জেড ফোর্স, পত্র নং ১০৩/১/জি, তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

জুলাই-আগস্ট মাসে গেরিলাযুদ্ধের গতি কমে যায়, বলা যেতে পারে যে প্রায় স্তিমিত হয়ে পড়ে। ফলে গেরিলাযুদ্ধের জন্য একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমি কর্নেল ওসমানীর অনুমতি নিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করি। পরিকল্পনাটিতে উল্লেখ ছিল যে আমাদের লোকবল, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রের অভাব আছে, তাই ব্রিগেড গঠন করে খুব ভালো ফল পাওয়া যাবে না। বরঞ্চ আমরা যদি গেরিলাযুদ্ধ করি, তাহলে ভালো ফল লাভ করতে পারব। আমার এই পরিকল্পনার কথা ওসমানী সাহেব মন দিয়ে শোনেন এবং বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন। তত দিনে উনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রিগেডগুলো থেকে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। মাস দুয়েক পর, অর্থাৎ অক্টোবরের শেষের দিকে বাধ্য হয়ে ব্রিগেডগুলোকে প্রথাগত যুদ্ধের বদলে গেরিলাযুদ্ধের পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার জন্য নতুন ‘সামরিক পরিকল্পনা’ গ্রহণ করতে হয়; সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে, ‘এখন থেকে ব্রিগেডের সৈন্যরা সাধারণ গেরিলাদের মতো যুদ্ধ করবে।’ এই সিদ্ধান্ত চিঠিতে উল্লেখ করে আমার স্বাক্ষরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এই চিঠিতে ব্রিগেডকে বিলুপ্ত না করলেও তাদের যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলাযুদ্ধে ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্রিগেডের নতুন ভূমিকা বা গেরিলাযুদ্ধ বিষয়ে সিদ্ধান্তটি ছিল নিম্নরূপ :

ব্রিগেডসমূহ
যেহেতু বর্তমানে ব্রিগেড ও ব্যাটালিয়নের উপযোগিতা খুব সীমিত, তাই এসব নিয়মিত সৈনিক কোম্পানি ও প্লাটুন গ্রুপে বিন্যস্ত গেরিলা অভিযানের মূল অংশ হিসেবে কাজ করবে। এই সমস্ত নিয়মিত ইউনিট অবশ্যই বেতার যোগাযোগের আওতায় থাকবে, যাতে অল্প সময়ের মধ্যে তাদের পুনরায় একত্র করা সম্ভব হয়। বেতার যোগাযোগের মাধ্যমে গেরিলা তৎপরতারও সমন্বয় সাধন করা হবে।
বিটার সুইট ভিক্টরি : আ ফ্রিডম ফাইটার্স টেল
এ কাইয়ুম খান, ইউপিএল, ঢাকা, পৃ. ২৪৫

সরকার বা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্রিগেড গঠন বা এর প্রভাব বিষয়ে খুব একটা ভূমিকা রাখেননি। তাজউদ্দীন সাহেব হয়তো কর্নেল ওসমানীকে অসন্তুষ্ট করতে চাননি বা ব্রিগেড গঠনে মুক্তিযুদ্ধে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তা বুঝতে পারেননি। তাই ব্রিগেড গঠন বিষয়ে তিনি কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। ডিসেম্বর মাসে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে গেরিলাযুদ্ধের আর কোনো প্রয়োজন ছিল না। তখন আমাদের ব্রিগেডগুলো মিত্রবাহিনীর অধীনে চূড়ান্ত যুদ্ধে যোগ দেয়।

অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের সঠিক ধারণা ছিল না। যুদ্ধ চলাকালে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুদ্ধ বিষয়ে একজনের ওপরই নির্ভরশীল ছিলেন, তিনি কর্নেল ওসমানী। যুদ্ধের শুরুতেই কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। কনভেনশনাল যুদ্ধ বিষয়ে পূর্ব ধারণা থাকলেও তাঁর চিন্তাধারা গেরিলাযুদ্ধের জন্য সহায়ক ছিল না। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রধানত গেরিলাযুদ্ধ-নির্ভর। গেরিলাযোদ্ধারা জনগণের মধ্যে মিশে থেকে যুদ্ধ করবে, তিনি এই ধারণার প্রতি খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না। মাঠপর্যায়ের কমান্ডাররা গেরিলাযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এবং তাঁদের কাছে এর কোনো বিকল্পও ছিল না। তাঁরা জানতেন যে প্রথাগত যুদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। ফলে কর্নেল ওসমানী না চাইলেও বা অপছন্দ করলে ও কমান্ডাররা তাঁদের মতো করেই গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে যান। এতে কর্নেল ওসমানী মাঠপর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি মূলত প্রশাসন বিষয়ে বেশি নজরদারি করতেন। যেমন, অমুককে ওই স্থান থেকে বদলি করা, এক সেক্টর থেকে অন্য সেক্টরে কাউকে নিযুক্ত করা, কারও পদোন্নতি বা পদভ্রংশ করা, বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করা ইত্যাদি। তিনি যুদ্ধের কলাকৌশল নিয়ে বিশেষ কোনো নির্দেশ দিতেন না। প্রধান সেনাপতি হলেই যে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হবে তা ঠিক নয়। তবে তিনি যুদ্ধে বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ প্রদান করতে পারতেন এবং এগুলোর প্রভাব লক্ষ করতে পারতেন, যা তিনি খুব একটা করেননি। যুদ্ধ মূলত সেক্টর অধিনায়কদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কর্নেল ওসমানী যুদ্ধের সময় সরাসরি কমান্ড না দিয়ে একদিক দিয়ে ভালোই করেছিলেন। আমার মনে হয়, তিনি তা করলে তাঁর এবং সেক্টর অধিনায়কদের মধ্যে সম্পর্কের সংকট দেখা দিত।

যাহোক, সম্ভবত আগস্ট মাসের শেষের দিকে তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে দিল্লিতে ডি পি ধরের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ডি পি ধরের বাসায় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। আগেই বলেছি, যুদ্ধ করার সময় আমাদের যেসব অস্ত্র, সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ প্রয়োজন ছিল, তা ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে যুদ্ধ ও যোদ্ধাদের মধ্যে হতাশার ভাব চলে আসে। বিষয়টি ডি পি ধরকে জানালাম। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের (ভারতীয়দের) কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসুবিধা রয়েছে। তোমাদের যেরকম সাহায্য দরকার, তেমনি আমাদের দিকেও কিছু প্রস্তুতির দরকার রয়েছে।’ খুব বন্ধুসুলভ পরিবেশে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। ডি পি ধরের কাছে আমাদের সমস্যা ও দাবিগুলো আমি খুব যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরি। আমি বলেছি, ‘আপনারা সাহায্য করছেন। আমরা এর জন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনারা আমাদের অনুভূতিটা বিবেচনায় নেবেন না।’ ডি পি ধর আমার সব কথা শুনে বলেছিলেন, ‘আপনি সবকিছু বেশ ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আপনাকে দেখে মনে হয় না যে আপনি প্রয়োজনে এই রকম শক্ত অবস্থান নিতে পারেন।’ এইভাবেই আমাদের ভেতর আলোচনা চলেছিল। আলোচনার শেষে ডি পি ধর একটি কথা বলেছিলেন, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন, আমরা এই যুদ্ধে আপনাদের জয়লাভের জন্য আমাদের সামর্থ্যে যা কিছু আছে, তার সবটুকু ব্যবহার করছি এবং করব। আপনারা আমাদের কাছ থেকে সব রকম সহায়তা পাবেন।’

তাজউদ্দীন আহমদ ও ভারতীয় কর্মকর্তারা যুদ্ধসম্পর্কিত আলোচনায় কর্নেল ওসমানীর চেয়ে আমাকে বেশি ডাকতেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা এবং মেজর জেনারেল জ্যাকব বিভিন্ন সময় আমার সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলতেন বা আলোচনা করতেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে যখন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার মিটিং হতো তখন হয় কর্নেল ওসমানী আমাকে সঙ্গে নিতেন, নয়তো তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে সঙ্গে থাকতে বলতেন, আর না হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাকে আসতে বলত। ফলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সঙ্গে প্রায় প্রতিটি মিটিংয়ে আমিও উপস্থিত থাকতাম। এসব মিটিংয়ে প্রধানত যুদ্ধের বিভিন্ন দিক, যুদ্ধের কৌশল, যুদ্ধের পরিকল্পনা ও অস্ত্র প্রদানের পরিমাণ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে মতানৈক্য হতো। অনেক সময়ই তাঁরা আমাদের সমস্যা বা চাহিদা উপলব্ধি করতে পারতেন না। তবে আমাদের মধ্যে কখনো অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। আমরা উভয়েই প্রয়োজনে ছাড় দিয়ে একটা সমাধানে পৌঁছে যেতাম।

আগেই উল্লেখ করেছি যে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান ও লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করত। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের হলে পূর্বাঞ্চল কমান্ড অভিযানের তালিকা তৈরি করত আর আঞ্চলিক পর্যায়ের হলে ভারতীয় সেক্টর সদর দপ্তর থেকে তা নির্ধারণ করা হতো। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তরে মুক্তিবাহিনীর অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ডিরেক্টর অব অপারেশনস মেজর জেনারেল বি এন সরকার। লক্ষ্যবস্তুগুলো জেনারেল সরকারের কার্যালয় থেকে ঠিক করা হলেও মাঝেমধ্যে আমাদের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতেন। এ পরামর্শ কিন্তু যুদ্ধের কৌশলগত ছিল না। তিনি আসলে দেশের অভ্যন্তরের কোনো জায়গা বা নদী বা স্থানীয় মানুষজনের মনোভাব সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চাইতেন। সেপ্টেম্বর মাসে যুদ্ধের গতি বৃদ্ধি পেলে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে আমাদের সম্পৃক্ততা কিছুটা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে কয়েকটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও পাটকল ছিল। জুলাই মাসের মধ্যে পরিস্থিতি পাকিস্তান সরকারের আংশিক নিয়ন্ত্রণে যাওয়ায় কিছু কিছু পাটকল চালু হয় এবং পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি শুরু হয়। এ সময়ে জেনারেল বি এন সরকার অভিযান বিষয়ে একটি আলোচনা সভায় এই বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ও পাটকলগুলো গেরিলাদের মাধ্যমে ধ্বংস করার প্রস্তাব করেন। তিনি পরিকল্পনা দেন যে গেরিলারা বোমা মেরে এগুলো অকেজো করে দেবে। আলোচনায় আমি উল্লেখ করি যে দেশ যখন স্বাধীন হবে, তখন এসব শিল্পকারখানা তো আমাদেরই হবে। এগুলো এভাবে ধ্বংস করলে চূড়ান্তভাবে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। তাই এই প্রস্তাবের সঙ্গে আমি একমত হতে পারছিলাম না। ওই সভায় ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুর (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভীষণভাবে আমার মতের বিরোধিতা করে বলেন যে, এগুলো অত্যন্ত অসামরিক কথা। তিনি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো আঘাত করে পাকিস্তানিদের দুর্বল করার পক্ষে মত দেন। আমি বলেছি, গুরুত্বপূর্ণ কোনো অর্থনৈতিক কেন্দ্র বা কোনো কৌশলগত স্থাপনা বা যোগাযোগকেন্দ্র যেমন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, ভৈরব সেতু, আদমজী পাটকল ইত্যাদিতে আক্রমণ করতে হলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে। যেসব স্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে বা যা ধ্বংস হলে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে, সেসব স্থাপনায় আক্রমণ করার জন্য রাজনৈতিক অনুমোদন থাকা প্রয়োজন। শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পাটকলে আর আক্রমণ করা হয়নি। পরিবর্তে এমন কিছু জায়গাকে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা হয়েছিল, যেখানে গেরিলা বা মুক্তিযোদ্ধাদের যাওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল। জেনারেল সরকার বাঙালি ছিলেন, তাই বাংলাদেশের যুদ্ধকে তিনি নিজের যুদ্ধ মনে করতেন। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হতো। বিভিন্ন সময় যুদ্ধের কৌশল ও লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণের জন্য জেনারেল সরকার আমাকে এবং কলকাতার কাছাকাছি ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মঞ্জুরকে ডাকতেন।

আগস্ট মাসে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ইউএসআরআর নামে কোনো দেশ নেই। বর্তমান রাশিয়া ও পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকটি দেশ নিয়ে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং এর মূল কর্তৃত্ব ছিল রাশিয়ার) মধ্যে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির ফলে ভারত তখনকার অন্যতম এই বৃহৎ শক্তির কাছ থেকে সামরিক সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়। উপরন্তু ভারত কোনো শত্রুরাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে এই চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই শত্রুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। উল্লেখ্য, চীনের সঙ্গে ভারতের আগে থেকেই একটা বৈরী সম্পর্ক ছিল। ১৯৬২ সালে চীন ভারত আক্রমণ করে ভারতের অনেক ক্ষতি সাধন করে। এদিকে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। তাই ভারত যদি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করে, তাহলে চীন কর্তৃক ভারত আক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে। চুক্তির আওতায় ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে ব্যাপক অস্ত্র পেতে আরম্ভ করে। এ সময় ভারতও আমাদের প্রচুর অস্ত্র দিতে শুরু করে। অস্ত্র পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় আমরাও বেশিসংখ্যক গেরিলাকে প্রশিক্ষণে পাঠাতে শুরু করি। মে মাসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি মাসে মাত্র ৫ হাজার গেরিলা প্রশিক্ষণ পাচ্ছিল। ভারত-সোভিয়েত চুক্তির পর এ সংখ্যা বেড়ে প্রতি মাসে ২০ হাজারে উন্নীত করা হয়। এতে যুদ্ধের গতিও ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। তবে এসবই হয় সেপ্টেম্বর মাসের পর এবং এর সুফল পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় অক্টোবরের প্রায় মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।

সোভিয়েত-ভারত চুক্তির ফলে আমরা যখন প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেতে শুরু করি ঠিক তখনই পূর্বে গঠিত তিনটি ব্রিগেড (জেড, এস ও কে ফোর্স) থেকে অধিকসংখ্যক প্রশিক্ষিত যোদ্ধা এসে আমাদের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী গেরিলাযুদ্ধে যোগদান করে। ভারত থেকে পাওয়া অস্ত্র নিয়ে আমাদের প্রশিক্ষিত গেরিলারা ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করে। আমাদের যুদ্ধের গতি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এ আক্রমণের ফলে যৌথ বাহিনীর জন্য যুদ্ধজয় একটা সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

রণাঙ্গনে পাকিস্তান বড় ধরনের চাপে পড়ে যায় এবং বাধ্য হয় যুদ্ধের গতি পরিবর্তন করতে। সে জন্য পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভারতের সামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। যাতে করে জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ বিরতি করে একটি সমঝোতায় পৌঁছুতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের এ উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন