প্রাক-কথন

মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা লেখার আগে আমার নিজের পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি। ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এক বৈরী সম্পর্কের ভেতর আমি বেড়ে উঠেছি। মূল কথার আগে সেই পরিবেশ-পরিস্থিতির বিষয়ে একটু আলোচনা করব, যাতে পাঠক সামগ্রিক বিষয়ে একটি ধারণা লাভ করতে পারেন।

১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি রংপুরে আমার জন্ম। পৈতৃক নিবাস ছিল পাবনা জেলার পুরানভারেঙ্গা ইউনিয়নে। আমাদের বাড়িটি ছিল নগরবাড়ি ঘাটের কাছে। একসময় এ ঘাটে মাঝারি গোছের নৌযান নোঙর করত। আমার বাবা খন্দকার আবদুল লতিফ ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে সরকারের প্রশাসনিক বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৫০ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। আমার মা আরেফা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। সরকারি চাকরিজীবী বাবা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি হতেন। ফলে আমি বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছি ও বেড়ে উঠেছি এবং আমার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী ও মালদহ শহরে পড়াশোনা করেছি। ছোটবেলায় যেসব স্কুলে পড়াশোনা করেছি, সেসব স্থানের পরিবেশ ছিল চমৎকার, আমার খুব ভালো লাগত।

নওগাঁ মিউনিসিপ্যাল স্কুলে আমার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৪২ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। বাবা মালদহে বদলি হওয়ায় আমি মালদহ স্কুল থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করি। মালদহে আমার সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে। এখানে আমার অনেক বন্ধু ছিল।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ভাগের সময় আমার বাবা পরিবারসহ মালদহ থেকে মেদিনীপুরের কাঁথিতে চলে যান। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ করে আমিও কাঁথিতে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হই। কাঁথি খুবই সুন্দর একটি শহর ছিল। দেশভাগের পর বাবা পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে বদলি হয়ে আসেন। বাবা চলে আসার পরও মাস খানেক আমরা কাঁথিতে ছিলাম। তারপর পৈতৃক নিবাস পাবনায় চলে আসি। কিছুদিন পর এখান থেকে বাবার চাকরিস্থল ঠাকুরগাঁওয়ে যাই।

বাল্যকালে আমি জীবনকে গভীরভাবে জানতে ও উপলব্ধি করতে পছন্দ করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমি মৃদুভাষী। আমি কোনো কাজে আগ্রহী হলে, কোনো কাজ করব বলে ঠিক করলে, আগে ওই কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করতাম। অর্থাৎ, কোনো কিছু শুরুর আগেই আমি কী করতে যাচ্ছি, তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করতাম।

বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ও বঙ্গভঙ্গ রদের (১৯১১) পর বাংলায় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বার্থের টানাপোড়েন তৈরি হয়। রোপিত হয় সন্দেহের বীজ। এই ঘটনাগুলোর কারণে পিছিয়ে থাকা বাংলার মুসলমানরা ভাবত, হিন্দু নেতারা তাঁদের স্বার্থের প্রতি যত্নশীল নন। একইভাবে বেশির ভাগ হিন্দু তাদের গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে মুসলিম সম্প্রদায়কে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। মুসলমানদের নিজেদের কাতারে আনতেও তারা সক্ষম হয়নি। বিশ শতকের চল্লিশের দশকের শুরুতে মুসলমানরা উপলব্ধি করে যে, তারা হিন্দুদের কাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্রমেই তাদের এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে।

মালদহে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি সমগ্র বাংলায় হিন্দুমুসলমানের মধ্যে সদ্ভাবের অভাব লক্ষ করতাম। মুসলমানরা তখন ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র চাইতে শুরু করে। এই অনুভূতি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয়, সমাজের ভেতরেও একইভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু ধর্ম যে একটা রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না, সেটা বুঝতে আমাদের কিছুটা সময় লেগে গিয়েছিল। আমার ধারণা, এই ভুল-বোঝাবুঝির জন্য হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ দায়ী ছিল।

মনে পড়ে, আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন খাজা নাজিমউদ্দিন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি পুরস্কার প্রদানের জন্য মালদহে আমাদের স্কুলে আসেন। স্কুলের কয়েকজন হিন্দু ছাত্র পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। একজন মুসলিম মন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নেবে না বলে পুরস্কার বিতরণের দিন তারা স্কুলেই আসেনি। দেশভাগের সময় মালদহ বা কাঁথিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখিনি। এসব এলাকার মানুষ বেশ আন্তরিক ছিল। হিন্দুরাও খুব বন্ধুসুলভ ছিল। মালদহে আমাদের পাশের বাড়িতে কয়েকটি হিন্দু পরিবার ছিল, তারা খুবই অমায়িক ছিল। আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাদের একটা সুসম্পর্ক ছিল। আমার বাবাকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করত।

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি রাজশাহী সরকারি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হই। ১৯৪৯ সালে এইচএসসি পাস করে ওই বছরই ঢাকা আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট) ভর্তি হই এবং আবাসিক ছাত্র হিসেবে কলেজের হোস্টেলে থাকতে শুরু করি। এ সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের একটি দল ওই বাহিনীর জন্য বৈমানিক নির্বাচন করার লক্ষ্যে ঢাকায় আসে। ছোটবেলা থেকেই আমি ফ্লাইংয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলাম। তাদের আগমনের খবর পেয়ে আমি নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই।

আমি যখন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট

বিমানবাহিনীর এই নির্বাচনীমূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিএ-এমএ উত্তীর্ণ ছাত্রও ছিলেন। একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম, যখন দেখলাম ৪৩ জনের একটি ব্যাচের মধ্যে শুধু আমিই নির্বাচিত হয়েছি। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে নির্বাচনের পরপর আমি প্রশিক্ষণে যোগ দিতে পারিনি। প্রশিক্ষণে যোগ দিতে আমাকে পরবর্তী ব্যাচের রিক্রুটমেন্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অবশেষে ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে আমি ক্যাডেট পাইলট হিসেবে বিমানবাহিনীতে যোগদান করি এবং ওই মাসেই প্রশিক্ষণের জন্য পেশোয়ারের রিসালপুরে চলে যাই। রিসালপুরে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একাডেমিতে (পিএএফ একাডেমি) পাইলটদের মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আমি সেখানে ক্যাডেট হিসেবে এক বছর নয় মাসের প্রশিক্ষণ নিই এবং ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমিশনপ্রাপ্ত হই। আমার সঙ্গে আরও দুজন বাঙালি ক্যাডেট ছিলেন, তবে একমাত্র আমিই বৈমানিক হিসেবে কমিশন পেয়েছিলাম। এর পর চাকরির বদৌলতে ১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আমি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম।

কমিশন পাওয়ার পরপরই আমি ফাইটার বিমানের বৈমানিকের প্রশিক্ষণ নিতে করাচির মৌরিপুরে যাই। সেখানে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে পেশোয়ারের পঞ্চম ফাইটার স্কোয়াড্রনে যোগ দিই। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আমি ওই স্কোয়াড্রনে চাকরি করে রাওয়ালপিন্ডির কাছে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের চাকলালা স্টেশনে ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টরের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এই প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষক হিসেবে পুনরায় রিসালপুরে পিএএফ একাডেমিতে যোগ দিই। ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি রিসালপুর থেকে চাকলালা ফ্লাইং স্কুলে প্রশিক্ষক হয়ে আসি। ফ্লাইট কমান্ডার হিসেবে জেট ফাইটার কনভার্সন স্কোয়াড্রনে বদলি হয়ে আসি ১৯৫৯ সালে। এ স্কোয়াড্রনটি করাচির মৌরিপুরে অবস্থান করছিল। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আমি প্রশিক্ষক হিসেবে এখানে জেট ফ্লাইং ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ দিই।

এখানে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। তখন আমি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। আমার মৌরিপুরে অবস্থানকালে, সম্ভবত ১৯৫৯ সালে, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন এয়ার মার্শাল আসগর খান। সিদ্ধান্ত হয়, আমি তাঁকে খারাপ আবহাওয়ায় বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দেব। আসগর খান পেশোয়ারে বিমানবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে থাকতেন। আমি মৌরিপুর থেকে পেশোয়ারে এসে আসগর খানকে খারাপ আবহাওয়ায় বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দিই। প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে প্রায় চার-পাঁচটি মিশনে তিনি আমার সঙ্গে ফ্লাই করেন। আমি ভেবেছিলাম, পেশোয়ারে এই ফ্লাইংয়ের রেকর্ড রাখা হবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি, ফ্লাইংয়ের রেকর্ড রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। মৌরিপুর থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পেশোয়ারে আসা এবং ফ্লাইং শেষে মৌরিপুরে ফিরে যাওয়া, মাঝে বিমানবাহিনীর প্রধানকে নিয়ে ফ্লাই করা—সব মিলিয়ে তখন আমাকে ব্যাপক কাজের চাপ সহ্য করতে হয়। আমি কত তারিখ, কখন থেকে কখন পর্যন্ত বিমানবাহিনীর প্রধানকে নিয়ে ফ্লাই করতাম, তা লিখে রাখতাম। এই দিনলিপিগুলো (ডায়েরি) আমি মৌরিপুরে নিয়ে যেতাম। দুঃখের বিষয়, এই দলিলগুলো আমি হারিয়ে ফেলি। স্বাধীনতার পর আসগর সাহেব যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন তাঁকে বলেছিলাম, ‘স্যার, আপনি হয়তো ভুলে গেছেন যে আমি আপনাকে খারাপ আবহাওয়ায় বিমান উড্ডয়নের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। আমার মনে আছে। কারণ, আমি বিমানের একজন সাধারণ বৈমানিক হিসেবে বিমানবাহিনীর প্রধানকে জেট এয়ারক্রাফট খারাপ আবহাওয়ায় চলানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম, যেটা আমার জন্য খুবই সম্মানের ছিল। তবে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছিল যে প্রতিটি ফ্লাইংয়ের পর আপনি আমাকে বলতেন, “খন্দকার, এটি তোমার একান্ত আন্তরিকতা। আর তুমি আমার জন্য অনেক পরিশ্রম করছ।”” আমি আরও বললাম, ‘স্যার, খারাপ আবহাওয়ায় আপনি যে ফ্লাইং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তার দলিলপত্রগুলো কি আপনার কাছে আছে?’

উত্তরে তিনি বললেন, ‘না, নেই।’

১৯৬০ সালে আমি স্কোয়াড্রন লিডার পদে পদোন্নতি লাভ করি। ১৯৬১ সালে পুনরায় পিএএফ একাডেমিতে যোগ দিই। সেখানে আমি ক্যাডেট পাইলটদের প্রশিক্ষণ দিতাম। ওই বছরই পিএএফ একাডেমি থেকে আমি করাচির মৌরিপুরে জেট ফাইটার কনভার্সন স্কোয়াড্রনের স্কোয়াড্রন কমান্ডার পদে বদলি হই। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমি এই দায়িত্ব পালন করি। এরপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর স্টাফ কলেজ থেকে আমি পিএসএ ডিগ্রি লাভ করি। পিএসএ ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৬৬ সালে পিএএফ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শাখার কমান্ডিং কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিই। সে বছরই উইং কমান্ডার পদে পদোন্নতি লাভ করি। পিএএফ একাডেমিতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পিএএফ ফ্লাইং বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করি। এই পদে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যত রকম নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হবে, তা পরীক্ষা করে দেখা, অর্থাৎ নতুন স্টেশন নির্মাণের স্থান, উচ্চমাত্রার রাডার ও নতুন অস্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা ইত্যাদি।

যখন স্কোয়াড্রন লিডার

একজন অভিজ্ঞ বৈমানিক হিসেবে আমার ওপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর আস্থা ছিল। খারাপ আবহাওয়া বা ঝড় ও বৃষ্টির সময় সবাইকে বিমান উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়া হতো না। যাঁরা কিছুটা দক্ষ বৈমানিক, খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও তাঁদের একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় বিমান উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়া হতো। অর্থাৎ, মেঘ যদি একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় থাকে, বাতাসের গতি যদি সেই অনুপাতে থাকে, বৃষ্টি বা কুয়াশার মধ্যে যদি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত দেখা যায়, তাহলে একজন বৈমানিক ফ্লাই করার অনুমতি পেতেন। উচ্চপর্যায়ের একটি পরীক্ষক দল এসব দিক পরীক্ষা করত। ওই পরীক্ষক দলকে বলা হতো ইন্সট্রুমেন্ট ফ্লাইং এক্সামিনারস। অর্থাৎ, কোনো কিছু না দেখে ইন্সট্রুমেন্টের ওপর নির্ভর করে আকাশে উড়তে হতো। ইন্সট্রুমেন্ট ফ্লাইং এক্সামিনাররা কতটুকু দক্ষ, তা নির্ণয়ের জন্য সমগ্র পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে চিফ ফ্লাইং ইন্সট্রুমেন্ট এক্সামিনারের একটি মাত্র পদ ছিল, যাকে বলা হতো ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইন্সস্ট্রুমেন্ট ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর’। আমি সেই পদটি অর্জনের মর্যাদা লাভ করি। কম্পিউটার নিউমেরিক্যাল কন্ট্রোলের (সিএনসি) সাহায্যে খারাপ আবহাওয়ায় বিমান চালাতে হতো এবং খারাপ আবহাওয়ায় বিমান চালানোর জন্য ফ্লাইং রেটিং থাকত। একটু খারাপ আবহাওয়ার জন্য এক রকম রেটিংয়ের বৈমানিক থাকতেন, আবার খুব খারাপ আবহাওয়ার জন্য প্রয়োজন হতো উচ্চতর রেটিংয়ের বৈমানিক। বৈমানিকেরা ফ্লাইংয়ে দক্ষ কি না, তা আমি কম্পিউটার নিউমেরিক্যাল কন্ট্রোলের (সিএনসি) সাহায্যে পরীক্ষা করে অনুমোদন করতাম। এটা ছিল মূল দায়িত্বের বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্ব। এই পদে আমি কাজ করি ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় আমি পাকিস্তানের ড্রিগ রোডের বিমানঘাঁটিতে ছিলাম। এই যুদ্ধে আমি ছিলাম স্যাবর জেট জঙ্গি বিমানের বৈমানিক। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ চলেছে ১৭ দিনের মতো। এ যুদ্ধে ভারত পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে আক্রমণ করেনি। আমার মনে হয়, দুটি কারণে ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি। একটি সামরিক এবং অন্যটি রাজনৈতিক। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো সামরিক স্থাপনা ছিল না। সম্ভবত এ কারণে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আক্রমণ চালায়নি। এ ছাড়া তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতা দেখে আমার ধারণা হয়, ভবিষ্যৎ রাজনীতির পরিকল্পনা হিসেবে ‘৬৫ সালের যুদ্ধে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ না করে বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব দেখিয়েছে এবং আমি নিশ্চিত, আমার ধারণাটি ভুল নয়। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে বিমানবাহিনীর অস্ত্র ও সরঞ্জাম এত অল্প ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কোনো কারণ ছিল না। তাই যুদ্ধটা ছিল সাধারণভাবে একপক্ষীয়। আমি যত দূর জানি, ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে বোমা, রকেট কিছুই ছোড়েনি। তারা অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অস্থিতিশীল অবস্থার কথা অনুমান করতে পেরেছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী যেকোনো সময় পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কিছু নেই। উপরন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতকে আক্রমণ করা হয়নি বরং ভারতকে আক্রমণ করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। ভারতের এই রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত পরবর্তী সময়ে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে।

আমার বাবা-মা বাংলাদেশে থাকলেও বেশির ভাগ সময় পাকিস্তানে থাকার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে আমার যাওয়া-আসা একটু কমই হতো। তাই পারিবারিক জীবন শুরু করতেও আমার একটু দেরি হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে আমি উইং কমান্ডার সাইফুর রহমান মীর্জার ছোট বোন ফরিদা মীর্জার (জেসমিন) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই এবং পারিবারিক জীবন শুরু করি। উইং কমান্ডার মীর্জা ১৯৫০ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে বৈমানিক হিসেবে কমিশন পান এবং ১৯৬৯-এ চাকরি থেকে অবসর নেন। তিনি বর্তমান ঠাকুরগাঁও জেলার অধিবাসী ছিলেন। সাইফুর রহমান মীর্জা মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত যুব শিবিরের প্রধান ছিলেন। স্বাধীনতার পর কিছুদিন সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমার দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। বর্তমানে সবাই অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা। অস্ট্রেলিয়ায় তাদের স্থায়ীভাবে থাকার প্রধান কারণ, ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় বছর আমি অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলাম। এ পর্যন্ত আমিই একমাত্র বাংলাদেশি যে ‘ডিন অব দ্য ডিপ্লোম্যাটিক কোর’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

১৯৫১ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮ বছর পাকিস্তানে অবস্থানকালে আমি পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পেয়েছি। পশ্চিম পাকিস্তানে আমার অনেক ভালো বন্ধুও ছিলেন। তাঁরা সব সময় আমার ও আমার পরিবারের প্রতি খুব যত্নবান ছিলেন। যেমন, রাতে বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছি, হঠাৎ খবর এল ফ্লাইংয়ে যেতে হবে। ব্যস, অফিসের কাজে বের হয়ে যেতাম। এ সময় আমার স্ত্রী একদম একা থাকত। কিন্তু আশপাশের পরিবারগুলো ছিল অত্যন্ত বন্ধুসুলভ। তারা আমার স্ত্রীর দেখাশোনা করত; সব সময় খেয়াল রাখত, যেন আমার অনুপস্থিতিতে ওর কোনো অসুবিধা না হয়, যেন ভয় না পায়।

১৯৬৯ সালের ৪ মার্চ আমি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটিতে উইং কমান্ডার হিসেবে বদলি হয়ে আসি। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬ ৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে যেসব ঘটনা ঘটছিল, বিশেষত উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, পশ্চিম পাকিস্তানে থাকার ফলে আমি তা জানতে পারিনি। কারণ, প্রথমত, পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানের খবরাখবর বিস্তারিতভাবে আসত না। তা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে সংবাদপত্রগুলো ছিল মূলত মুসলিম লীগের মুখপত্র। সেসব গণমাধ্যমে পাকিস্তানপন্থী সংবাদ প্রকাশিত হতো। সত্য খবরগুলো জানা যেত না। ফলে ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ তেমন কিছু জানতে পারতাম না। দ্বিতীয়ত, ১৯৬৯ সালের শুরু থেকে আমি বদলি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাই যথাযথভাবে সবকিছুর খবর নিতে পারতাম না। তবে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের মনে যে প্রচণ্ড রকমের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, তা বুঝতে পারছিলাম। মার্চ মাসের শুরুতে এখানে এসে দেখি, ঢাকা তথা সমগ্র বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে।

১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। নতুন সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান মনে করলেন, আইয়ুব খানের সামরিক জান্তা হিসেবে দুর্নাম রয়েছে। সুতরাং, তিনি অন্তত এমনভাবে দেশ চালাবেন, যাতে লোকে বুঝতে পারে, তিনি আইয়ুব খানের মতো স্বৈরশাসক নন। তিনি দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। সেই লক্ষ্যে তিনি গোয়েন্দা বিভাগের দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। সামরিক বাহিনীতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণে গোয়েন্দা বিভাগের কাজ সম্পর্কে আমি জানি। গোয়েন্দাদের স্বাভাবিক চরিত্র গড়ে উঠে এমনভাবে যে তাঁরা সেই কথাটিই বলবেন, যা শুনলে শাসকগোষ্ঠী খুশি হবে। গোয়েন্দা বিভাগ থেকে ইয়াহিয়া খানকে আশ্বস্ত করা হলো যে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ জয়ী হতে পারবে না এবং সরকার গঠনও করতে পারবে না। নির্বাচন ও তার ফলাফলে কী ঘটতে পারে সে সম্পর্কে গোয়েন্দা বিভাগ ইয়াহিয়া খানকে সম্পূর্ণ ভুল চিত্র দিয়েছিল। গোয়েন্দা বিভাগ ইয়াহিয়া খানকে জানায়, পাকিস্তানে এমন কোনো দল নেই, যারা মুসলিম লীগকে পরাজিত করে দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে। নির্বাচনে কিছু আসন আওয়ামী লীগ পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে মুসলিম লীগ জয়লাভ করবে।

নির্বাচন হলো। ফলাফল দেখা গেল গোয়েন্দা বিভাগের দেওয়া চিত্রটির উল্টো। শুধু ইয়াহিয়া খানকে খুশি করার জন্য গোয়েন্দা বিভাগ ভুল তথ্য দিয়েছিল। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের বিজয়ী হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। প্রথমত, আইয়ুব খানের সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিভিন্ন দিক থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ১৯৭০ সালে নির্বাচনের ঠিক পূর্বমুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় হয়, এ দুর্যোগে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়। এ সময় ইয়াহিয়া খান চীন সফর করছিলেন। সফর শেষে তিনি ঘূর্ণিঝড়-আক্রান্ত পূর্ব পাকিস্তানে না এসে সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। এতে পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তখন তিনি খুবই সংক্ষিপ্ত সফরে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন এবং বিমানে করে কিছু উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করেন। অথচ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি একটি দিনের জন্যও বিমান থেকে নেমে দেখলেন না যে ঘূর্ণিঝড়ে দেশটার কী অবস্থা হয়েছে। এটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে মারাত্মক ভুল। কারণ, বাঙালিরা তখন উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালিদের স্বার্থ সম্পর্কে উদাসীন। সত্তর সালের জাতীয় নির্বাচন ছিল বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের একটি ক্রান্তিলগ্ন। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ (ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি) নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানের ৩০০টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের ১৬৭টিতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ পরাজিত হওয়ার প্রধান কারণ, মুসলিম লীগের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের জনগণ চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানে ছিলাম এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিই।

১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হই।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেছিল। পাকিস্তান সরকারের উচিত ছিল অল্প সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা তার ধারেকাছে না গিয়ে টালবাহানা শুরু করেন। পাকিস্তান সরকার যখন ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে বিজয়ী আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করল না, তখন সংবাদপত্রগুলোতে নানা রকম লেখালেখি শুরু হয় এবং একধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয় জনসাধারণের মধ্যেও। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আন্দোলন করছিল ঠিকই, কিন্তু আমার মনে হয়, সরকার ভেতরে ভেতরে কী মতলব করছিল, তা আওয়ামী লীগের নেতা বা সাধারণ মানুষ জানতে পারেনি।

পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারাও নির্বাচনে বিজয়ী পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসক হিসেবে গ্রহণ করতে চাননি। পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো চেয়েছিলেন যেকোনোভাবেই হোক বাঙালি বা আওয়ামী লীগের হাতে যেন ক্ষমতা না যায়। তিনি পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পরিকল্পনা করেন। এই উদ্দেশ্যে বাঙালিবিরোধী পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভুট্টো সাহেব একটি আঁতাত করেন। ভুট্টো সাহেব সেনা কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। তোমরা বাঙালিদের ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তান শাসন করার সুযোগ দিয়ো না।’

অধ্যায় ১ / ১৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন