যৌথ নেতৃত্ব গঠন

মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের নিজস্ব যুদ্ধ। আমাদের যদি এককভাবে যুদ্ধ করার সামর্থ্য থাকত, তাহলে যুদ্ধ করতে ভারত বা অন্য কোনো দেশের সাহায্যের প্রয়োজনই হতো না। একার পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না বলেই ভারতীয়দের সহযোগিতা আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যুদ্ধের প্রারম্ভে আমরা ভারত থেকে স্বল্প মাত্রায় হলেও অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেয়েছি। প্রথমে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী আর পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলাম। পরবর্তী পর্যায়ে ভারত থেকে অধিক মাত্রায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেয়েছি এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতাও পেয়েছি। এক কথায় শুরু থেকেই ভারত মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্তরে আমাদের সঙ্গেই ছিল। তাই সামগ্রিক যুদ্ধ-পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ভারতীয় বাহিনীগুলোর সঙ্গে প্রথম থেকেই সমন্বয় জরুরি ছিল। বিবিধ কারণে যুদ্ধের প্রথম দিকে এই সমন্বয়ের কাজটি হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশের অভাবে মাঠপর্যায়ে সমন্বয়ে বেশ দুর্বলতা ছিল। আমাদের দিক থেকেও আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো উৎসাহ দেখাননি। ফলে সেক্টর পর্যায়ে এই সমন্বয়ের কাজটি হয়ে ওঠেনি। দুই পক্ষের মধ্যে এই ধরনের সমন্বয়হীনতা, বিভেদ ও দূরত্ব অক্টোবর মাস পর্যন্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধটা আমাদের হলেও অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয়রা এককভাবে বা আমাদের এড়িয়ে অনেক অভিযান পরিচালনা করত, যা পরবর্তী সময়ে আমাদের জন্য অনেক ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করত। এ বিষয়ে আমি কিছু বর্ণনা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি। প্রয়োজনটা যেহেতু আমাদের, তাই যৌথ পরিকল্পনা করার জন্য প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল আমাদের পক্ষ থেকে। ভারতীয় বাহিনীকে আমাদের বলা উচিত ছিল যে যৌথভাবে যুদ্ধ করতে হলে আমাদের একসঙ্গে বসে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে হবে এবং উভয়ে মিলেই সেই পরিকল্পনা কার্যকর করতে হবে। কিন্তু আমাদের দিক থেকে সেই প্রচেষ্টার অভাব ছিল। যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের উদ্যোগে উভয়ের মধ্যে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ফলে এ সমস্যার সমাধান হয়।

যৌথ নেতৃত্ব না থাকায় শুধু যে মাঠপর্যায়েই সমস্যা হচ্ছিল তা নয়, বরং এর অভাবে জাতীয় পর্যায়েও সমস্যার আশঙ্কা ছিল। যদি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের উদ্যোগে যৌথ নেতৃত্ব সৃষ্টি না হতো, তাহলে ভারতীয় বাহিনী এককভাবেই যুদ্ধ বিজয়ের সব কৃতিত্ব নিতে পারত। আত্মসমর্পণের দলিলে কেবল ভারতীয়দের কথাই উল্লেখ থাকত। এটা শুধু ভারতীয়দের বিজয় হিসেবেই ইতিহাসে চিহ্নিত হতো।

কূটনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য কারণে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার ওপর বাধানিষেধ ছিল। সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ফিরে আসেন এবং অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর তৎপরতা ও সীমান্ত অতিক্রম বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা অনেকটা শিথিল করেন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধী সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন যে যদি ঘটনার চাপে সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়, তাহলে তা তারা করতে পারবে।

অক্টোবর মাস থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা বাড়তে থাকে। এর আগে তারা বড় আক্রমণে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা দিলেও তা ছিল নামমাত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানের আগে বা অভিযান চলাকালে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলা ছুড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলত বা লক্ষ্যবস্তুকে বিপর্যস্ত করে দিত। কামানের গোলায় যখন শত্রু বা লক্ষ্যবস্তু অনেক দুর্বল হয়ে পড়ত তখন মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুকে চূড়ান্ত আক্রমণ করে তাদের উদ্দেশ্য সফল করে তুলত। কখনো কখনো আমাদের সেক্টর বা ব্রিগেড তাদের লক্ষ্যবস্তু নিজস্ব শক্তি দিয়ে যথাযথভাবে ধ্বংস করতে পারত না বা তাদের আয়ত্তের মধ্যে থাকত না। আবার কখনো আক্রমণ করতে গিয়ে সেক্টর বা ব্রিগেড নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে পড়ত। এরকম পরিস্থিতি দেখা দিলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে মুক্তিবাহিনীর অভিযানে সাহায্যের নির্দেশ দেওয়া হতো। ইন্দিরা গান্ধীর ওই নির্দেশের পর অক্টোবর মাসের ১২ তারিখ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধে অংশ নিতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে মাঠপর্যায়ে পাশাপাশি দুটি সামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। একটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এবং অন্যটি আমাদের ব্রিগেড ও সেক্টরের নেতৃত্ব। অথচ যুদ্ধ ছিল একটাই। একই রণাঙ্গনে দুটি আলাদা নেতৃত্ব থাকলে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মাঠপর্যায়ের সেনাদলের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে অনেক সময় আত্মঘাতী ঘটনা ঘটে যাওয়ার যেমন আশঙ্কা থাকে তেমনি আশঙ্কা থাকে ভুলবোঝাবুঝি হওয়ারও। ক্রমাগত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির মুখে যৌথ কমান্ড বা যৌথভাবে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত যৌথ নেতৃত্বের পক্ষে ছিলেন না কর্নেল ওসমানী। তিনি সব সময় বাংলাদেশ বাহিনীর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে নিশ্চিতভাবে ভারতীয় বাহিনীর প্রাধান্য থাকবে এবং বাংলাদেশ বাহিনী থাকবে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের অধীনে। কর্নেল ওসমানী এ বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারছিলেন না, যদিও বাস্তব অবস্থা কর্নেল ওসমানীর চিন্তাভাবনার অনুকূল ছিল না। যাহোক, ভারতের পক্ষ থেকেই প্রথম সমন্বয় বা যৌথ নেতৃত্বের প্রস্তাব আসে।

যুদ্ধপরিস্থিতি চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে গেলে রাজনৈতিক পর্যায়ে এই যৌথ সামরিক নেতৃত্ব গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘যৌথ নেতৃত্ব ছাড়া আমাদের যুদ্ধ তো আটকে গেছে। বাংলাদেশের সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীকে যদি দুর্বল করে ফেলা না যায়, তাহলে ভারত তার সেনাবাহিনীকে ভেতরে পাঠানোর ঝুঁকি নেবে না। এটা যুদ্ধ-পরিকল্পনার অন্তর্গত। কাজেই রণক্ষেত্রে সামরিক নেতৃত্বের পূর্ণ সমন্বয় থাকা অপরিহার্য।’ কর্নেল ওসমানী প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তিনি বাংলাদেশ বাহিনীকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নেতৃত্বের আওতায় রাখতে চান। একপর্যায়ে তিনি জানান যে যদি যৌথ নেতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন। তাজউদ্দীন আহমদও কিছুটা শক্ত অবস্থান নিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি চান যৌথ সামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক।

আলোচনারত কর্নেল ওসমানী, জেনারেল মানেকশ ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

কর্নেল ওসমানী সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করতে রাজি ছিলেন না। তিনি আলাদা আলাদা কমান্ডে যুদ্ধ করতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ বাহিনীর গুরুত্ব কমে যাবে এবং যুদ্ধটা ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে বা এটি মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত হবে।

আমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যেও ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে একধরনের অনীহা ছিল। নিজেদের তারা ভারতীয় বাহিনীর তুলনায় অধিক পারদর্শী ও যোগ্য মনে করত। আমাদের সেনাসদস্যদের ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগের সীমা ছিল না। যেমন, ‘ভারতীয়রা পরিমাণমতো সমরসম্ভার ও রেশন দিচ্ছে না’, ‘ভারতীয়রা এটা করছে না’, ‘ভারতীয়রা ওটা পারছে না’ ইত্যাদি। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে আমাদের সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকগুলো অভিযোগের মধ্যে সত্যতা ছিল। এ ছাড়া ভারতীয় বাহিনী অনেক সংকটময় মুহূর্তে ইউনিট বা সেক্টর অভিযানে যথাযথ সহযোগিতা না দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। এই ভারতবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিও যৌথ নেতৃত্ব গঠনকে বিলম্বিত করে।

যৌথ নেতৃত্ব যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে তাগাদা দিচ্ছে, তখনো কর্নেল ওসমানী অনড় থাকেন। যুদ্ধের এই চূড়ান্ত ও সংকটজনক পর্যায়ে কর্নেল ওসমানী মৌখিকভাবে পদত্যাগের কথা বলার পর তাজউদ্দীন সাহেব কর্নেল ওসমানীকে লিখিত পদত্যাগপত্র দাখিল করতে বলেন। তাজউদ্দীন সাহেব বেশ শক্ত করেই তাঁকে বলেন যে তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন। শেষ পর্যন্ত কর্নেল ওসমানী লিখিত পদত্যাগপত্র জমা দেননি। এই ঘটনার পর বলা যায় যে কর্নেল ওসমানী দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তিনি কোনো বিষয়ে বিশেষ উৎসাহ দেখাতেন না, যদিও যুদ্ধের গতি অসম্ভব রকম বেড়ে যাচ্ছিল।

তাজউদ্দীন আহমদ ভারত-প্রস্তাবিত যৌথ সামরিক নেতৃত্ব বিষয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন। তিনি বলেন, ‘কর্নেল ওসমানী এটা চাইছেন না, আপনি কী বলেন?’ আমি তাঁকে বলেছি, এটি বাস্তবসম্মত এবং এই উদ্যোগে আমাদের সাড়া দেওয়া উচিত। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আমিও মনস্থির করে ফেলেছি, আমি এটা করব।’ যৌথ নেতৃত্ব হলেই যে একজনকে আরেকজনের নিচে কাজ করতে হবে, এমন কথা বাস্তবভিত্তিক নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যৌথ সামরিক নেতৃত্বের উদাহরণ দেখা যায়। এই যুদ্ধে কয়েকটি দেশ মিলে মিত্রবাহিনী গড়ে তুলেছিল। মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে জার্মানির নেতৃত্বে আর একটি যৌথ বাহিনী ছিল, যাকে অক্ষ বাহিনী বলা হতো। এই যুদ্ধের কোনো এক রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনী মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল, আবার অন্য রণাঙ্গনে মার্কিন বাহিনী মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল। সুতরাং এটা কোনো লজ্জার বিষয় নয়। প্রয়োজনের তাগিদে, আমাদের স্বাধীনতার স্বার্থে এটা করতে হয়েছিল। যৌথ বাহিনী সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে ধন্যবাদ জানাই। বস্তুত তাঁর দৃঢ় অবস্থানের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল। যৌথ সামরিক নেতৃত্ব হওয়ার ফলেই অনেক সংশয় ও সমস্যার অবসান ঘটে।

যুদ্ধের শুরু থেকেই তাজউদ্দীন সাহেব ও কর্নেল ওসমানীর মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিত। তাঁদের দুজনের মধ্যে দূরত্বের জন্য তাজউদ্দীন সাহেব আমাকেই ডেকে পাঠাতেন। আমার সঙ্গে আলাপ করতেন; ফোর্ট উইলিয়ামে আলোচনার জন্যও আমাকে পাঠাতেন। ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে এলে তাঁদের সঙ্গে আমাকে আলোচনা করতে হতো। বাংলাদেশ বাহিনী ও যুদ্ধ পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে আমার সঙ্গে তাজউদ্দীন সাহেবের মতের মিল হতো। তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে মতের মিল থাকার কারণে আমি কোনো সময় কর্নেল ওসমানীর বিরোধিতা বা অসম্মান করতাম না। কর্নেল ওসমানী শুনলে মনঃক্ষুণ্ণ হবেন, সেরকম কোনো কথা আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে বলতাম না। তবে তাজউদ্দীন সাহেব কোনো বিষয়ে আমার মতামত জানতে চাইলে আমি আমার যুক্তিসম্মত এবং বাস্তবভিত্তিক চিন্তা অকপটে তাঁকে বলতাম।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনার জন্য একসময় ডি পি ধর আমাদের দিল্লিতে আমন্ত্রণ করেন। এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীর কোনো উদ্যোগ না দেখে আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবকে জিজ্ঞেস করি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে দিল্লি যাওয়ার অনুমতি দেন এবং করণীয় বিষয় সম্পন্ন করার কথা বলেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি দ্বিতীয়বারের মতো দিল্লিতে যাই। সেখানে ডি পি ধরের সঙ্গে আমার দেখা ও কথা হয়। দিল্লিতে ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়। তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারি যে যুদ্ধ প্রায় আসন্ন।

২৮ সেপ্টেম্বর যৌথ নেতৃত্ব বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়। সেখানে আমাদের প্রতিরক্ষাসচিব ও আমি উপস্থিত ছিলাম। কর্নেল ওসমানী ওই দিন যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনে কলকাতার বাইরে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে একই বিষয়ে ৫ অক্টোবর ভারতের পূর্বাঞ্চল কমান্ডারের সঙ্গে আমাদের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা হয়। ওই সভাতেও কর্নেল ওসমানী উপস্থিত থাকতে পারেননি, তবে আমি উপস্থিত ছিলাম। সভায় যৌথ নেতৃত্ব বিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৬ অক্টোবর সিদ্ধান্তগুলো ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের অবহিত করা হয়। কর্নেল ওসমানী তাঁর সফর থেকে ফিরে এসে সেই সিদ্ধান্তগুলো খুঁটিয়ে দেখেন এবং সামান্য কিছু পরিবর্তন করে ১১ অক্টোবর তা বাংলাদেশ বাহিনীর সব সেক্টর ও ব্রিগেডকে পাঠিয়ে দেন। যৌথ নেতৃত্ব বিষয়ে এই পত্রটির গুরুত্ব বিবেচনা করে পরিশিষ্ট ৭ হিসেবে যুক্ত করলাম। এই চিঠির সূত্র ধরে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে যৌথ পরিকল্পনা ও অভিযান পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টর ও ফোর্সকে বিভিন্ন ভারতীয় ফর্মেশনের অধীনে ন্যস্ত করে ২২ নভেম্বর একটি চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠিতে ‘এস ফোর্সে’র জন্য প্রযোজ্য অংশটি নিচে দেওয়া হলো :

১৫. অনতিবিলম্বে অভিযান ও দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহের প্রয়োজনে আপনাকে ৫৭ মাউনটেন ডিভিশনের অধীন ন্যস্ত করা হলো। এই আয়োজনের পরিসমাপ্তি বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আপনাকে এবং সহায়তাকারী বাহিনীর সদর দপ্তরের ফর্মেশনকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
১৬. বাংলাদেশ সেক্টর
২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টর, যাদের বাংলাদেশ ফর্মেশনের (কে, এস এবং জেড ফোর্স) অধীন ন্যস্ত করা হয়েছিল, তারা এখন থেকে আর ওইসব ফর্মেশনের অধীন থাকবে না। সব বাংলাদেশ সেক্টর এই নির্দেশাবলির প্রাধিকারে নির্দেশে উল্লিখিত নির্দিষ্ট সহায়তাকারী বাহিনীর অধীনে থেকে অভিযান পরিচালনা করবে।
সদর দপ্তর বাংলাদেশ বাহিনী, পত্র নং ০০১৮ জি, তারিখ ২২ নভেম্বর ১৯৭১

যৌথ সামরিক নেতৃত্বের বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদে আলোচনার মাধ্যমে অনুমোদিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে তাঁর নিজের ক্ষমতাবলে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন; কিন্তু সেভাবে তিনি তা করেননি। এটা করা হয়েছিল মন্ত্রিপরিষদের সবার মতামতের ভিত্তিতে। কর্নেল ওসমানী বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মেনে নেন। যৌথ সামরিক নেতৃত্ব বলতে যৌথ সামরিক পরিকল্পনা, যৌথ সামরিক তৎপরতা বোঝায়, যেটা যুদ্ধের শুরুতেই হওয়া উচিত ছিল। যুদ্ধের শুরুতেই এটা করতে পারলে যুদ্ধের ফল আরও ইতিবাচক হতো। এটা আরও বেশি ফলপ্রসূ ও কার্যকর হতো।

যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে যুদ্ধক্ষেত্রের সব সামরিক বাহিনী এই নেতৃত্বের অধীনে যুদ্ধ করে। এটা অতীতের বিভিন্ন বহুজাতিক ও বহু রাষ্ট্রীয় যুদ্ধের ইতিহাসে লক্ষ করা গেছে। কেবল আমাদের বেলায় যে এটা নতুন একটা কিছু, তা নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে পৃথিবীর সব বহুজাতিক যুদ্ধেই একই আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে যৌথ সামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা যৌথ নেতৃত্ব পরিচালনার দায়িত্ব পান। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সামরিক নেতৃত্ব গঠন করার পর দেখা গেল ভারতীয় ফরমেশন অধিনায়কেরা আমাদের ব্রিগেড ও সেক্টর অধিনায়কদের চেয়ে অনেক জ্যেষ্ঠ। তাঁরা কেউ ব্রিগেডিয়ার বা জেনারেলের নিচে নন। তাই স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বের দায়িত্ব ভারতীয় সামরিক অধিনায়কেরা পেলেন। এতে যৌথ নেতৃত্বের কোনো সমস্যা হতো না। যৌথ নেতৃত্ব চালু হওয়ার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা অধিনায়কেরা বাংলাদেশি সেনা অধিনায়ক ও জোয়ানদের ওপর আলাদা কোনো কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করেননি বরং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। যৌথ নেতৃত্ব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছিল। ফলে পাকিস্তানিরা এককভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে নয়, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।

৩ নভেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হয়, যা ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ৪ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যদিও তখন যুদ্ধ ঘোষণার গুরুত্ব তেমন ছিল না, কারণ যুদ্ধ তো অঘোষিতভাবে বেশ আগেই শুরু হয়ে গেছে। যৌথ নেতৃত্ব হওয়ার পরে ভারতীয় ও বাংলাদেশি সেনাবাহিনী একসঙ্গে অভিযান পরিচালনা শুরু করে। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে কামালপুরের যুদ্ধে যৌথ বাহিনী শত্রুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। চৌগাছার যুদ্ধেও যৌথ বাহিনী একই ফল লাভ করে। জকিগঞ্জ সীমান্তে যৌথ বাহিনী বেশ কটি জায়গায় যুদ্ধ করে। সালদানদী অঞ্চলের যুদ্ধ সম্পর্কে মেজর জেনারেল বি এন সরকার বেশ গর্বের সঙ্গে আমাদের ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার হালদারের (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী) প্রশংসা করেন। আমাদের সেক্টর ও ব্রিগেডের গেরিলারা যৌথ বাহিনীর আওতায় থেকে সমান তালেই যুদ্ধ করে দক্ষতা আর সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন