স্বাধীনতার ঘোষণা ও অস্থায়ী সরকার গঠন

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধ কি কোনো ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল? স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এ ধরনের আলোচনা, দ্বিমত, বিভাজন বা তর্ক মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল না। এমনকি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত এ ধরনের কথাবার্তা শোনা যায়নি। এটা শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে। মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারিনি যে ভবিষ্যতে স্বাধীনতার ঘোষণা কোনো বিভ্রান্তি বা মতভেদের বিষয় হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আলোচনা ও মতবিরোধ বা বিতর্ক শুরু হয়। এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যক্তি স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে নানা কথা বলেন। সেগুলো সত্য নাকি অসত্য, তা জানার উপায় নেই। এগুলোর পক্ষে বা বিপক্ষে কেউ কোনো দলিল উত্থাপন করেননি। আমার মনে হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো তাঁদের আবেগপ্রসূত।

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে কাউকে কিছু বলেননি বলেই আমি জানি। অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতে এক হাবিলদারের মারফত চিরকুট পাঠিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আবার বলা হয়, বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। কোথাও কোথাও এমনও উল্লেখিত হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু ইপিআরের বেতারযন্ত্রে বা ডাক ও তার বিভাগের টেলিগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি প্রচার করেন। এগুলোর কোনো যুক্তিসংগত প্রমাণ আমি কোথাও পাইনি। আর যা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তার বিশ্বাসযোগ্যতা খুঁজে পাইনি।

কোন যুক্তিতে বঙ্গবন্ধু চিরকুট পাঠাবেন, যেখানে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণায় তাঁর কোনো বাধাই ছিল না? বলতে গেলে মার্চ মাসের শুরু থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই দেশ চলেছে। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসেও সারা দেশে দু-চারটা সরকারি ভবন ছাড়া কোথাও পাকিস্তানি পতাকা ওড়েনি, বরং সবাই স্বাধীন বাংলার পতাকা অথবা কালো পতাকা উড়িয়েছে। এ ধরনের অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কেন গোপনে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে যাবেন? স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চাইলে তিনি তো জনগণের পাশে থেকেই তা করতে পারতেন। তাঁর মতো সাহসী এবং ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় নেতার স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাতের অন্ধকারের প্রয়োজন হয় না। আমরা যত দিন যুদ্ধ করেছি, তত দিন পর্যন্ত এই চিরকুট পাঠানোর কথা শোনা যায়নি। বরং আমরা সবাই আলোচনা করতাম যে বঙ্গবন্ধু কেন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন না, দিলে কী ক্ষতি হতো ইত্যাদি। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আমি যতটুকু জানি, আমার স্মৃতিতে যতটুকু আছে এবং যুদ্ধের সময় যা ঘটেছে তা নিচে উল্লেখ করলাম।

২৫ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন ঢাকা ছেড়ে চলে যান, তখন একটা চরম সংকটপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। সবাই ভাবতে থাকেন, এখন আমাদের কী করণীয়। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদসহ আরও কিছু নেতা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে সমবেত ছিলেন। সেখানে এক ফাঁকে তাজউদ্দীন আহমদ একটি টেপ-রেকর্ডার এবং স্বাধীনতা ঘোষণার একটা খসড়া বঙ্গবন্ধুকে দেন এবং তাঁকে তা পড়তে বলেন। কিন্তু তিনি তা পড়েননি। এ ঘটনা স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিক ও লেখক মঈদুল হাসানকে বলেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি মে মাসে ভারতে যান। পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্পেশাল এইড হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকবার দিল্লি যান। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। মঈদুল হাসান যখন কলকাতায় থাকতেন তখন প্রতিদিন সকালে তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন। তাঁর নির্দেশে অন্যান্য নানা বিষয়েও কাজ করতেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের জন্য তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করেন। তাজউদ্দীন আহমদের কথাগুলো তখন তাঁর ডায়েরিতে তিনি লিখে রেখেছিলেন। সেই সময় তাঁদের মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা ও ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত নিয়ে যে কথোপকথন হয়েছিল তা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলেই প্রতীয়মান হয়।

কোনো মাধ্যমে বা চিরকুটে পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, ২৫ মার্চ রাতে তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীরা প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন। অথচ তাঁরা কেউ কিছু আঁচ করতে পারবেন না বা জানতে পারবেন না, এটা তো হয় না। তবে কি তিনি তাঁদের বিশ্বাস করতে পারেননি? এটা তো আরও অবিশ্বাস্য। বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেনই, তবে তিনি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় থাকবেনই বা কেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আমিও একদিন তাজউদ্দীন আহমদকে ২৫ মার্চের রাতের ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাজউদ্দীন আহমদ স্বীকার করেছিলেন, সেই খসড়া ঘোষণাটি তাঁর নিজের লেখা ছিল এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে খসড়া ঘোষণাটি পাঠ করার প্রস্তাব করেছিলেন। লেখাটা ছিল সম্ভবত এই রকম : ‘পাকিস্তানি সেনারা আমাদের আক্রমণ করেছে অতর্কিতভাবে। তারা সর্বত্র দমননীতি শুরু করেছে। এই অবস্থায় আমাদের দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম।’ তাজউদ্দীন সাহেব আরও বলেন, এই খসড়া ঘোষণাটা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়ার পর সেটা তিনি পড়ে কোনো কিছুই বললেন না, নিরুত্তর রইলেন। অনেকটা এড়িয়ে গেলেন।

পরবর্তী সময়ে মঈদুল হাসানের কাছ থেকে জানতে পারি, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে। কেননা কালকে কী হবে, যদি আমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়? তাহলে কেউ জানবে না যে আমাদের কী করতে হবে? এই ঘোষণা কোনো গোপন জায়গায় সংরক্ষিত থাকলে পরে আমরা ঘোষণাটি প্রচার করতে পারব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাও করা হবে।’ বঙ্গবন্ধু তখন প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের বিচার করতে পারবে।’ এ কথায় তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে সম্ভবত রাত নয়টার পরপরই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীকালে মঈদুল হাসান এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনিও ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। আবদুল মোমিন বলেন, তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকছিলেন, তখন দেখেন যে তাজউদ্দীন আহমদ খুব রাগান্বিত চেহারায় ফাইলপত্র বগলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আবদুল মোমিন তাজউদ্দীনের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি রেগে চলে যাও কেন?’ তখন তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর কাছে আগের ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একটু ঝুঁকিও নিতে রাজি নন। অথচ আমাদের ওপর একটা আঘাত বা আক্রমণ আসছেই।’

২৫ মার্চ রাতের ওই ঘটনার পর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বাড়িতে ফিরে যান। রাত ১০টার পর ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান। বঙ্গবন্ধু তাঁদের তৎক্ষণাৎ সরে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে কী করবেন, সেটা তাঁদের বলেননি। তাঁরা দুজন যখন ওখান থেকে তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে গেলেন, তখন রাত বোধ হয় ১১টা। ওখানে কামাল হোসেন ও আমীর-উল ইসলাম আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, তাজউদ্দীনকে নিয়ে তাঁরা দুজন অন্য কোথাও চলে যাবেন।

এটাতে ১৯৭২ সালে তাজউদ্দীন আহমদ কথোপকথনের সময় মঈদুল হাসানকে বলেন, ‘আমীর-উল ইসলাম ও কামাল হোসেন যখন এসে বলল যে বাড়ি থেকে এখনই সরে যাওয়া দরকার, তখন আমি ওদের বলিনি, তবে আমার মনে হয়েছিল, আমার কোথাও যাওয়া উচিত নয়।’ তাজউদ্দীন আহমদ মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে সম্ভবত কথাগুলো বলেছিলেন। বিষয়টি তাজউদ্দীন আহমদ পরে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘যেখানে আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা, যাঁকে এতবার করে বলেছি, আজকে সন্ধ্যাতেও বলেছি, তিনি কোথাও যেতে চাইলেন না এবং তাঁকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য যে সংক্ষিপ্ত একটা বার্তা টেপ-রেকর্ডে ধারণ বা ওই কাগজে স্বাক্ষর করার জন্য বলায়, তিনি বললেন, পাকিস্তানিরা তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে পারবে! উনি এতটুকুও যখন করতে রাজি নন, তখন এ আন্দোলনের কী-ই বা ভবিষ্যৎ?’ তাজউদ্দীন আহমদ, আমীর-উল ইসলাম ও কামাল হোসেনের মধ্যে এরকম আলাপ শেষ না হতেই চারদিকের নানা শব্দ থেকে বোঝা গেল, পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাস থেকে বের হয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। এরকম একটি মুহূর্তে কামাল হোসেন ধানমন্ডি ১৪ নম্বর সড়কের দিকে এক অজ্ঞাত উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। অন্যদিকে আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন যান লালমাটিয়ায়। এই কথাগুলো মঈদুল হাসান মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর : কথোপকথন গ্রন্থেও বলেছেন।

অবাক করার বিষয় হলো, পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণার সেই ছোট্ট খসড়াটি, যা তাজউদ্দীন আহমদ তৈরি করেছিলেন, তার প্রায় হুবহু একটি নকল বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের ঘোষণা হিসেবে প্রচার হতে দেখি। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাতেও তাজউদ্দীনের সেই খসড়া ঘোষণার কথাগুলো ছাপা হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের আক্রমণ করে, সেই রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাটি জনসমক্ষে কীভাবে এল? ২৬ মার্চ তারিখে তো সারা দেশেই সান্ধ্য আইন ছিল। আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মী এবং ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে মার্চ মাসে বেশ চাপ দিচ্ছিল। ধারণা করা যায়, সেই সময় তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর খসড়াটি তাঁদের দিয়েছিলেন এবং এঁদের মাধ্যমে যদি এটা স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে প্রচারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমি বিস্মিত হব না।

পরবর্তী সময়ে ঘটনার প্রায় এক বছর পর আরেকটা কথা প্রচার করা হয় যে, ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক আগে শেখ সাহেব ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। এই তথ্যটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমত, সামরিক বাহিনীতে থাকার ফলে আমি জানি যে সিগন্যাল সেন্টার বা বার্তাকেন্দ্র সব সময় অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক দ্বারা পরিচালনা করা হয়। সিগন্যালই কোনো বাহিনীর প্রতিরক্ষা ও আক্রমণের মূল যোগাযোগমাধ্যম। সেখানে তো বিশ্বাসীদের বাদ দিয়ে সন্দেহের পাত্র বাঙালিদের হাতে সিগন্যাল-ব্যবস্থা থাকতে পারে না। বাস্তবেও পাকিস্তানি বাহিনী আগে থেকেই পিলখানায় ইপিআরের বেতারকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছিল। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু যাঁর মারফত এই ঘোষণা ইপিআরের বার্তাকেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও জনসমক্ষে এলেন না কেন। বঙ্গবন্ধুও তাঁর জীবদ্দশায় কখনো সেই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেননি কেন। একইভাবে চট্টগ্রামের ইপিআর বেতার কেন্দ্র থেকে কে, কীভাবে জহুর আহমেদকে বার্তাটি পাঠালেন, তা রহস্যাবৃত্তই থেকে গেছে। কাজেই ইপিআরের বার্তাকেন্দ্র ব্যবহার করে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন—এটা সম্ভবত বাস্তব নয়।

দ্বিতীয়ত, জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এমন কোনো সংবাদ আমরা শুনিনি। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের নেতারা স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে ভারত সরকারকে বেশ চাপ দেওয়া শুরু করেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও অন্য প্রধান নেতাদের জিজ্ঞেস করে, শেখ মুজিবুর রহমান কি স্বাধীনতার প্রশ্নে কাউকে কিছু বলে গেছেন? তারা আরও জানতে চায় যে স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো প্রমাণ, কোনো দলিল, কোনো জীবিত সাক্ষ্য আমাদের কাছে আছে কি না? এ সময় জহুর আহমেদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকেই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু কাউকেই স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলে যাননি। জহুর আহমেদ চৌধুরী নিজে তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে কিছু বলে যাননি।

ইপিআরের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠান—এ দাবিটির প্রচার শুরু হয় ১৯৭২ সালে। এর আগে এটি শোনা যায়নি। অথচ ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব চাইলে শুধু একটি ফোন করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (এখন রূপসী বাংলা) ভিড় করা যেকোনো বিদেশি সাংবাদিককে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানাতে পারতেন। তাহলে মুহূর্তের মধ্যে সেটি সারা পৃথিবীতে প্রচার পেয়ে যেত।

বেশ পরে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে আরেকটি তথ্য প্রকাশ পায়। এতে বলা হয় যে বঙ্গবন্ধু টেলিগ্রামের মাধ্যমে কাউকে কাউকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। সেই ঘোষণার একটি কপি কিছুদিন আগে পত্রিকায় ছাপানো হয়। এই ঘোষণায় পাওয়া বিবৃতি আগের ঘোষণা থেকে পৃথক। ঘোষণা-সংবলিত টেলিগ্রামটি হাতে লেখা এবং প্রাপকের স্ত্রী দাবি করেছেন যে এটি বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা। মিথ্যা প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় সাধারণ বিবেচনা বা জ্ঞানও রহিত হয়ে যায়। টেলিগ্রাম যে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পাঠানো হয় এবং এখানে প্রেরকের হাতের লেখা প্রাপকের কাছে যায় না, তা তারা ভুলে যান।

যাহোক, বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত কথিত স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ বাজারে আছে। এই সংস্করণগুলো সরকারি গ্রন্থ ও আওয়ামী লীগের প্রচারিত গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন জায়গায় কেন এই ভিন্নতা, তার উত্তর কেউ দিতে পারে না। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র ৩য় খণ্ড-তে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাগুলোর একটিকে সংযুক্ত করে। পরে, ২০০৪ সালে, এই ঘোষণাটির দালিলিক কোনো প্রমাণ না থাকার কথা বলে উল্লিখিত বই থেকে তা বাদ দেওয়া হয়।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানের পর ইস্ট পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তারা বেতারের মাধ্যমে কিছু করার পদক্ষেপ নেন। চট্টগ্রামে সান্ধ্য আইনের মধ্যেই তাঁরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে কিছু প্রচার করতে উদ্যোগী হন। সেখানকার বেতার কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে বেতারে কিছু-না-কিছু বলা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাঁরা সবাই মিলে স্বাধীনতা ঘোষণার একটা খসড়া তৈরি করেন। ২৬ মার্চ বেলা দুইটায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়ে তাঁরা সেই খসড়াটি নিজেদের কণ্ঠে প্রচার করেন। পরবর্তী সময়ে সেই ঘোষণা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানও পাঠ করেন। তাঁর ভাষণটি সেদিন সাড়ে চারটা-পাঁচটার দিকে পুনঃপ্রচার করা হয়। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে—এমন কথা বলা হয়েছিল। তবে প্রথম যে ঘোষণাটি পাঠ করা হয়েছিল, তার থেকে পরবর্তী সময়ে পাঠ করা ঘোষণাটি একটু আলাদা ছিল। এ সময় বেতারের কর্মীরা দুটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। প্রথমত, যদি কোনো সামরিক ব্যক্তিকে দিয়ে این কথাগুলো বলানো যায়, তাহলে এর প্রভাব আরও ব্যাপক হবে। দ্বিতীয়ত, নতুন চালুকৃত বেতার কেন্দ্রটির নিরাপত্তা প্রদানের জন্য সামরিক বাহিনীর লোক প্রয়োজন। তাঁরা জানতে পারলেন, সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিকেরা চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ করছেন। তাঁরা খোঁজ নিয়ে আরও জানতে পারেন যে মেজর জিয়াউর রহমান নামের একজন ঊর্ধ্বতন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য কর্মকর্তা, সৈনিকসহ পটিয়ায় রয়েছেন। ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে এসব বেতারকর্মী পটিয়ায় যান। তাঁরা মেজর জিয়াকে বেতার কেন্দ্রের প্রতিরক্ষার জন্য কিছু বাঙালি সেনাসদস্য দিয়ে সাহায্য করার অনুরোধ জানান। মেজর জিয়া সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে সম্মতি দেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে কেউ একজন মেজর জিয়াকে অনুরোধ করে বলেন, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা তিনি পড়তে রাজি আছেন কি না। মেজর জিয়া বেশ আগ্রহের সঙ্গে এই প্রস্তাবে রাজি হন। তিনি পটিয়া থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষণা দিলেন, সেটা ভুলভাবেই দিলেন। কারণ, তিনি প্রথম ঘোষণায় নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করেছিলেন। পরে সংশোধন করে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সেটি টেপে ধারণ করা হয় এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে তা পুনঃপ্রচার করা হয়। আর এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ ঘটল।

রেডিওতে আমি মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনেছি। আমি ওই সময় জিয়াকে চিনতাম না। তবে এই ঘোষণায় আমি স্বস্তিবোধ করলাম এবং আশ্বস্ত হলাম যে অন্তত মেজর পর্যায়ের একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এই যুদ্ধে জড়িত হয়েছেন। আমি পরে শুনেছি, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি শিল্পপতি এম আর সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ঘোষণা সারা বাংলাদেশের মানুষ শুনেছে। আমার ধারণা, আমার মতো অনেকে যাঁরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, এই ঘোষণা শোনার পর তাঁরা আরও উৎসাহিত হন। এবং দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে তাঁরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে যুদ্ধ আমরা আরম্ভ করেছি, তা সফল হবেই। এই ঘোষণা শুনে আমি নিজেও খুব উৎফুল্ল এবং আনন্দিত হয়েছিলাম। তবে এটাও সত্য, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি, স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারকর্মীরা নিজ নিজ মতো করে আগেই দিয়েছিলেন।

এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ উদ্যোগে মেজর জিয়ার কাছে গিয়েছেন এবং তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। মেজর জিয়া নিজস্ব উদ্যোগে তাঁদের কাছে আসেননি। এটা ঠিক, জিয়া তাঁদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তিনি নিজে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগ নেননি। ২৬ মার্চ দুপুরে এম এ হান্নান সাহেব স্বাধীনতার যে ঘোষণাটি পড়েছিলেন এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার দিকে মেজর জিয়া যেটা পড়েন, তার মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। ২৬ মার্চেরটা অনেকে হয়তো শুনতে পাননি। কারণ, সেদিন তো সবাই বিভিন্ন কারণে উদ্বিগ্ন-হতবিহ্বল ছিলেন। তবে হান্নান সাহেবের কথারও একটা মূল্য ছিল, যদিও তিনি বেসামরিক লোক ছিলেন এবং জাতীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন না। অন্যদিকে যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার ছিল।

মেজর জিয়ার ঘোষণাটিকে কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলা চলে না। মেজর জিয়া রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন না। যে ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার থেকে তিনি দিয়েছিলেন, ঠিক একই ধরনের একাধিক ঘোষণা ২৬ ও ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাও দিয়েছিলেন, এমনকি বেতারকর্মীরাও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি প্রচারের ফলে সারা দেশের ভেতরে ও সীমান্তে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সেই সংকটময় মুহূর্তে জিয়ার ভাষণটি বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন জাতিকে কিছুটা হলেও শক্তি ও সাহস জোগায়। যুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুনেছি এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও শুনেছি, মেজর জিয়ার ঘোষণাটি তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে কতটা উদ্দীপ্ত করেছিল। মেজর জিয়ার ঘোষণায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, হ্যাঁ, এইবার বাংলাদেশ সত্যিই একটা যুদ্ধে নেমেছে। হান্নান সাহেব বা অন্য ব্যক্তিদের ঘোষণা ও মেজর জিয়ার ঘোষণার মধ্যে তফাতটা শুধু এখানেই ছিল। মেজর জিয়া যে কাজটি করতে পেরেছিলেন, তা করা উচিত ছিল জাতীয় পর্যায়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের এবং এর জন্য তাঁদের একটা পূর্বপরিকল্পনাও থাকা প্রয়োজন ছিল।

স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে আরেকটি চরম সত্য ও বাস্তব কথা হলো, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর স্বাধীনতার ঘোষণা হলো কি না, তা শোনার জন্য সাধারণ মানুষ কিন্তু অপেক্ষা করেনি। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কোনো ঘোষণা বা কারও আবেদন বা কারও নিবেদনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করেনি। যে মুহূর্তে তারা আক্রমণের শিকার হয়েছে, সেই মুহূর্তে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে, যেমন চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, জয়দেবপুর, ঢাকা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহসহ প্রায় সর্বত্র পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাঙালি সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যসহ সাধারণ মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুতরাং, কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিল বা কখন দিল, সেটা খুব একটা মূল্য রাখে না। স্বাধীনতার ঘোষণা আর ঘোষকের বিষয়টি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে খুব বেশি প্রভাবিত না করলেও পরবর্তী সময়ে অনেক বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। আমি মনে করি, এই বিভ্রান্তির অবসান হওয়া উচিত। জিয়ার ২৭ মার্চের ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যেসব বাঙালি ছিল, তাদের মধ্যে একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, এ সম্পর্কে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবে এই ঘোষণাই কারও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার একমাত্র কারণ নয়। আমার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমি এই কথাগুলো বলছি। আমি যুদ্ধে যাব, সে জন্য কারও ঘোষণার অপেক্ষা করিনি। আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিই যে আমি যুদ্ধে যাব।

২৫ মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাঁচটি বাঙালি পদাতিক ইউনিট এবং কয়েকটি ইপিআর উইং স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। ইউনিট বা উইং বিদ্রোহ করার পর এসব বাঙালি সামরিক ব্যক্তির ফিরে যাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফিরে গেলে কোর্ট মার্শাল এবং মৃত্যু অবধারিত, এটি তাঁদের খুব ভালো করেই জানা ছিল। তবে ফিরে গেলে কোর্ট মার্শাল কিংবা মৃত্যু হবে, এই ভয় থেকেই যে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্যি নয়। আমি বলব, শতকরা ৯৫ ভাগ সৈন্যই দীর্ঘদিনের বৈষম্য আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিবেকের তাড়নায় যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তা ও সেনাদের পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীতে ফিরে যাওয়ার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাঁদের জীবনে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল একমাত্র লক্ষ্য। দেশকে পাকিস্তানের হাত থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা ছাড়া বাঙালি সৈনিকদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। এই কারণেই বিদ্রোহী সৈনিকেরা দ্রুততার সঙ্গে অস্থায়ী সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়তা করেছিল।

এপ্রিলের প্রথম দিকে প্রতিরোধযুদ্ধ আস্তে আস্তে ঢাকা বা বিভিন্ন মফস্বল শহর থেকে সীমান্তের দিকে পিছিয়ে যেতে থাকে। স্বল্প শক্তি আর প্রস্তুতিহীন বাঙালি সেনাদের এর চেয়ে বেশি কিছু করার সামর্থ্যও ছিল না। বিদ্রোহী বাঙালি সেনারা ক্রমেই বুঝতে পারেন যে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য তাঁদের মধ্যে সমন্বয় দরকার এবং স্থানীয় ও বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হওয়া প্রতিরোধযুদ্ধকে একটি একক নেতৃত্বের আওতায় আনা প্রয়োজন। সর্বোপরি যুদ্ধের বৈধতার জন্য রাজনৈতিক সরকার দরকার। এই বোধ এবং ধারণা থেকেই হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে ৪ এপ্রিল বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তাদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এটি ছিল এ ধরনের প্রথম পদক্ষেপ। এ সভায় কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীসহ বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন কয়েকজন বেসামরিক কর্মকর্তা ও ভারতীয় প্রতিনিধিও। সেখানে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটি সরকার গঠন করতে হবে। এই সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবে এবং সেই সরকারের অধীনেই তাদের শুরু করা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হবে। বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধ চালানো এবং স্বাধীন সরকার গঠনের জন্য বাঙালি সৈনিকদের পক্ষ থেকে তখনই একটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থান তৈরি হয়। এ সভায় বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে চারটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে একেকজন একেক অঞ্চলের দায়িত্ব নেন। ৪ এপ্রিল সেনা কর্মকর্তাদের সভায় সরকার গঠনের বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তটি ছিল যুগান্তকারী। এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মেজর খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম, পরে ব্রিগেডিয়ার) উল্লেখ করেছেন, ‘এ ছাড়া তাকে [কর্নেল ওসমানীকে] আরও অনুরোধ করা হয়, আরও নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অতি শীঘ্র আমাদের বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হউক, যাতে আমরা বহির্জগতের স্বীকৃতি পাই এবং যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাই।’ যখন জাতি নেতৃত্বহীন এবং নেতারা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, তখন সেনা কর্মকর্তাদের এ সুপারিশ অস্থায়ী সরকার গঠন ও যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।

২৬ মার্চের পর পাকিস্তান সরকার তার কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার এটাই বোঝানোর চেষ্টা করে যে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সুর মেলায়, ফ্রান্সও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্কসহ মুসলিম দেশগুলো খুব দ্রুত পাকিস্তানের পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। সেন্ট্রাল ইস্টার্ন ট্রিটি অর্গানাইজেশনও (সেন্টো বা সিইএনটিও) এ ব্যাপারে কাউকে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানায়। আরব রাষ্ট্রগুলো, বিশেষত সৌদি আরব, আরব আমিরাত পাকিস্তানের পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। সেই তুলনায় মিসরের ভূমিকা ছিল কিছুটা নিরপেক্ষ। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানায়। ইয়াহিয়া খান জবাবে ভারতের সমালোচনা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। অন্যদিকে চীনও অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে তার সমর্থন ব্যক্ত করে এবং পাকিস্তানকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রাথমিক পর্যায়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে ছিল। পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা ও পাকিস্তানপ্রীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে এ ধরনের একটি বৈরী আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার গঠন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

তাজউদ্দীন আহমদ ৩ বা ৪ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আগে দিল্লিতে তিনি নিজেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি এই পরিচয় দিয়েছেন যাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সাক্ষাৎ দিতে সম্মত হন। এই সাক্ষাতের সময় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘আমি আপনার কাছ থেকে কয়েকটি বিষয় জানতে চাই। আপনারা কি সত্যিকারভাবে স্বাধীনতা চান?’ প্রত্যুত্তরে তাজউদ্দীন পরিষ্কারভাবে বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা চাই।’ তারপর ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘তাহলে আপনাদের অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করতে হবে।’ তাজউদ্দীন বললেন, ‘আমরা করব।’ আলোচনার পর ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনাদের স্বাধীনতার জন্য ভারতের পক্ষে যা সম্ভব, সবকিছু করা হবে।’ যদিও তাজউদ্দীন আহমদ নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন, কিন্তু তখনো বাংলাদেশের কোনো সরকার গঠিত হয়নি।

তাজউদ্দীন আহমদ খুব বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আমি তাঁকে ভীষণ পছন্দ করতাম। তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক নেতা। তিনি ভেবেছিলেন, রাজনৈতিক দিক দিয়ে যদি তিনি ভারতের সমর্থন পান, তাহলে এই যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া অনেক সহজ হবে। সে জন্য দেশের বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাজউদ্দীনসহ রাজনৈতিক নেতারা যখন জানতে পারলেন, বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন, তখন তাঁরা আশ্বস্ত হলেন এই ভেবে যে অন্তত যুদ্ধের জন্য কিছুটা অগ্রসর হওয়া গেছে। সেনা কর্মকর্তাদের এই কাজটি খুবই প্রশংসাযোগ্য ছিল। বিদ্রোহী সেনারা চিন্তা করেন যে তাঁরা যদি রাজনৈতিক সরকারের অধীন একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে যুদ্ধ করে একসময়-না-একসময় তাঁরা দেশকে স্বাধীন করতে পারবেন।

পরবর্তীকালে মঈদুল হাসানের সঙ্গে আলোচনায় জেনেছিলাম, ২৪/২৫ মার্চ কথা প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ শুনেছিলেন যে কোনো বিপদ দেখা দিলে দলের তরুণ নেতারা কলকাতার ভবানীপুরে বরিশালের প্রাক্তন এমপিএ চিত্তরঞ্জন সুতারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ১ এপ্রিল কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার আগে তাজউদ্দীন আহমদ সেই ঠিকানায় তাঁদের খোঁজে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কারও সাক্ষাৎ পাননি। ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে ফিরে এসে তিনি আবারও ভবানীপুরে যান। সেখানে তিনি যুবনেতা ও তাঁদের সমর্থকদের সাক্ষাৎ পান। এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ছাড়া আওয়ামী লীগ এবং যুব ও ছাত্র সংগঠনের আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ভবানীপুরের গাজা পার্কের কাছে রাজেন্দ্র প্রসাদ রোডের একটি বড় বাড়িতে ছিল ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং বা ‘র’-র অফিস ও অতিথি ভবন। কেবল যুবনেতারা নন, তাঁদের সমন্বয়কারী চিত্তরঞ্জন সুতারও সেখানে থাকতেন। জানা যায়, ‘র’-র সঙ্গে চিত্তরঞ্জন সুতারই ছিলেন যোগসূত্র। তাজউদ্দীনের দিল্লি সফরের কথা ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ওখানে গিয়েই তাজউদ্দীন তাঁদের তীব্র বিরোধিতা ও নিন্দার মুখে পড়েন। তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়, যেমন কে তাঁকে দিল্লি যেতে বলেছে, কোন অধিকারে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন ইত্যাদি। জ্যেষ্ঠদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন তাজউদ্দীনের উদ্যোগকে সমর্থন করেন। যুবনেতাদের কটূক্তি ও নিন্দার মুখে উত্তেজিত না হয়ে তাজউদ্দীন তাঁদের জানান, দিল্লিতে সর্বোচ্চ মহলে আলাপ-আলোচনার ফলে একটা সমঝোতায় আসা গেছে। এর ভিত্তিতে স্বাধীনতার পক্ষে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হবে, তা ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীনের বেতার ভাষণের মাধ্যমে আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হবে। সেই যুবনেতারা চিত্তরঞ্জন সুতারের সহায়তায় ভারত সরকারের কাছে তাজউদ্দীন সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তাঁর বেতার-বক্তৃতা বন্ধ করার দাবি পাঠান। কয়েকজন এমএনএ এবং এমপিএ এই দাবিনামায় স্বাক্ষর করেন। তাজউদ্দীন সাহেব এতে বিচলিত না হয়ে সীমানা অতিক্রম করে যেসব সংসদ সদস্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের খুঁজে বের করেন এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টায় ভারত সরকার সহযোগিতা করে। দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা তাঁদের খুলে বলেন। তাজউদ্দীন সংসদ সদস্যদের সমর্থন লাভে সমর্থ হন। আগে উল্লেখিত সেনা কর্মকর্তাদের ৪ এপ্রিলের সভার সিদ্ধান্ত, সংসদ সদস্যদের সমর্থন ও ভারত সরকারের নৈতিক সহযোগিতা যুবনেতা ও চিত্তরঞ্জন সুতারের উদ্যোগকে দুর্বল করে দেয়।

লর্ড সিনহা রোডের ১০ নম্বর বাড়িটি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা রাজনৈতিক নেতাদের থাকার জন্য বরাদ্দ করেছিল ভারত সরকার। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এম মনসুর আলীসহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা এ বাসায় এসে ওঠেন। ভারতীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা নেতাদের জন্য কলকাতায় এ ধরনের আরও কিছু বাসা বরাদ্দ করেছিলেন। ১০ এপ্রিলের আগে (সম্ভবত ৮ এপ্রিল) ১০ নম্বর লর্ড সিনহা রোডে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা, এমএনএ এবং এমপিএ নতুন সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে সভায় বসেন। সভায় সরকার এবং মন্ত্রিসভার কাঠামো নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি করে রাষ্ট্রপতিশাসিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবে। সরকারে চার সদস্যের মন্ত্রিপরিষদ থাকবে। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য থাকবেন এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও খন্দকার মোশতাক আহমদ। কর্নেল এম এ জি ওসমানী মন্ত্রীর পদমর্যাদায় মুক্তিবাহিনী বা বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান, অর্থাৎ প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরে তাঁরা আগরতলায় আরেকটি সভা করেন। সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, কর্নেল ওসমানী, চট্টগ্রামের এম আর সিদ্দিকীসহ কিছু নেতা উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ সরকার গঠনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত এবং কে কোন দপ্তরের দায়িত্বে থাকবেন তা চূড়ান্ত করা হয়।

কলকাতায় প্রথম সভায় তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রকাশ্যে শপথ নেবেন। প্রথমে এর জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল মুক্ত চুয়াডাঙ্গা। কিন্তু এই খবর পাকিস্তানিরা জেনে যায় এবং সেখানে বোমাবর্ষণ শুরু করে। পরে শপথ গ্রহণের স্থান খুব গোপনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা (পরে মুজিবনগর) নির্ধারণ করা হয়। সেখানে ১৭ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা শপথ নেন। এর আগে ১১ এপ্রিল নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেন।

যাহোক, ১৬ এপ্রিলের মধ্যে সরকার গঠনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। রাত প্রায় ১২টার সময় জানা গেল, নতুন রাষ্ট্রের পতাকা তৈরি করা হয়নি। এত রাতে তো দর্জি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অবশেষে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ডেপুটি হাইকমিশনারের বাড়ির কাছে এক দর্জির দোকান আছে। মধ্যরাতে সেই দর্জির ঘুম ভাঙিয়ে তাঁকে বলা হলো, পতাকা তৈরি করে দিতে। লোকটি সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। পতাকা প্রস্তুত হওয়ার পর যখন দর্জিকে তাঁর প্রাপ্য দেওয়ার কথা উঠল, তখন সেই দর্জি দুই হাত জোর করে বললেন, ‘আমাকে মাফ করবেন, এই পতাকা বানানোর জন্য আমি কোনো অর্থ নিতে পারব না।’ কয়েক দিন পর আবার তাঁর প্রাপ্য অর্থ দিতে গেলে তাঁকে আর পাওয়া গেল না। এর পরও চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে নির্বাচিত এমএনএ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউসুফ আলী স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করেন এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ পাঠ করান। বিকেলের মধ্যে শপথ গ্রহণের সব আনুষ্ঠানিকতা নির্বিঘ্নে শেষ হয়। তাজউদ্দীন সাহেবের দূরদর্শিতা এবং দৃঢ়তার ফলে আমরা স্বাধীনতার দিকে বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে যাই। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তাজউদ্দীন আহমদকে যে মূল্যায়ন করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি। ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের পর থেকে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সক্রিয় হন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় এই মন্ত্রিসভার সাহায্যে অস্থায়ী সরকার পরিচালিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা বেসামরিক কর্মকর্তাদের একটা অংশ অস্থায়ী সরকার পরিচালনায় যথেষ্ট সহযোগিতা করে।

১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিব নগরে (বৈদ্যনাথতলা) সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়গুলো ছিল ছড়ানো-ছিটানো। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের অফিস ছিল কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে। থিয়েটার রোডে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি ছোট ঘর ছিল, সেই ঘরে বসেই তাজউদ্দীন সাহেব বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্ম সম্পন্ন করতেন। তিনি অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যেকোনো বিষয় নিয়ে যুক্তিসংগত আলোচনা করতে কোনো ধরনের বাধা ছিল না। এমনকি কাউকে তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা করে কথাও বলতেন না। সবাই তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তাঁর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার জন্য তিনি ভারতীয়দের কাছে একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব নয় মাসের মধ্যে সম্ভবত কোনো একদিন ঘণ্টা দুয়েকের জন্য তাঁর পরিবারকে দেখতে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কোনো সময় তিনি তাঁর পরিবারকে দেখতে গিয়েছিলেন বলে আমার মনে পড়ে না। তিনি কতটা সাধারণ জীবনযাপন করতেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কাজকর্ম মোটামুটিভাবে নিজেই করতেন।

অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অন্য মন্ত্রীরা পরিবারসহ কলকাতায় ডা. সুন্দরী মোহন রোডের (সিআইটি রোড নামে বেশি পরিচিত) একটি অ্যাপার্টমেন্টের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে পরিবারসহ থাকতেন। তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারও এই অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটে ছিল। কিন্তু তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ওই ফ্ল্যাটে এক দিনও থাকেননি। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অন্য মন্ত্রীরা তাঁদের দাপ্তরিক কার্যক্রম সাধারণত এসব বাসস্থানে থেকেই পরিচালনা করতেন। থিয়েটার রোডে প্রত্যেকের জন্য একটি করে কার্যালয় থাকলেও কদাচিৎ তাঁরা এই কার্যালয়ে আসতেন। প্রয়োজনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এখানে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীরা থিয়েটার রোডে নিয়মিতভাবে না আসার কারণে বাইরে থেকে মনে হতো, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যদের মধ্যে খুব একটা আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ ও বৈঠক হয় না। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর কার্যালয় ও আবাসস্থলও ছিল থিয়েটার রোডে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে যাঁদের ওসমানী সাহেবের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হতো, তাঁরা কর্নেল ওসমানীর কার্যালয়-সংলগ্ন ঘরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনা করতেন। ওসমানী সাহেবের অফিসে লোকজন ছিল অত্যন্ত সীমিত। আমি ছিলাম ওসমানী সাহেবের একমাত্র জ্যেষ্ঠ ও সার্বক্ষণিক কর্মকর্তা। আমাদের সঙ্গে সেখানে সেনাবাহিনীর একজন ডাক্তার ও একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। এ ছাড়া কখনো কখনো স্টাফ অফিসার হিসেবে দু-একজন সামরিক অফিসার সাময়িকভাবে আমাদের সঙ্গে থাকতেন। দুজন ভারতীয় কর্মকর্তা নিয়মিতভাবে আমাদের কার্যালয়ে যোগাযোগ রাখতেন।

প্রথম দিকে থিয়েটার রোডের কয়েকটি বড় কামরায় জ্যেষ্ঠ বেসামরিক অফিসারদের কার্যালয় ছিল। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম, প্রতিরক্ষাসচিব এম এ সামাদ, সংস্থাপনসচিব নুরুল কাদের খান, অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান, স্বরাষ্ট্রসচিব নুরুদ্দিন আহমদ অফিস করতেন। উল্লিখিত বেসরকারি কর্মকর্তারা ছাড়া আরও কয়েকজন বেসামরিক কর্মকর্তা থিয়েটার রোডে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আরও কিছু বাঙালি বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারি কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা আলোচনার জন্য এসব সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতেন। অন্য বেসামরিক কর্মকর্তারা বেশির ভাগ সময় পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্থানে, যেখানে অধিকসংখ্যক বাঙালি উদ্বাস্তু থাকত, তাদের দেখাশোনা ও তদারক করতেন।

কলকাতার থিয়েটার রোডে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিস থেকে পরিচালিত হতো। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মোশতাক আহমদ। তাঁর কার্যক্রম সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল না। তিনি বেশি মাত্রায় বিদেশি কূটনীতিক ও গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি হাইকমিশন অফিস এবং নিজের বাসস্থানে দাপ্তরিক কাজকর্ম করতেন। একবার সরকারের কাজে তাঁর আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সন্দেহজনক গতিবিধি ও আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর সফর বাতিল করে দেন। সরকারের পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন মাহবুবুল আলম চাষী।

একটি সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য যত রকমের সুবিধা, অর্থ ও লোকবল থাকা প্রয়োজন, তা না থাকা সত্ত্বেও অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম যথেষ্ট ফলপ্রসূ ছিল। তবে স্বীকার করতেই হবে, পূর্বপরিকল্পনা না থাকায় এবং বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় পরবর্তী সময়ে তাজউদ্দীনকে অস্থায়ী সরকার পরিচালনায় যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও কোন্দল স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশেও বেশ প্রকট ছিল। এসবই হয়েছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন