৩ ডিসেম্বর শেষ রাতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী একত্র হয়ে যৌথভাবে আক্রমণ শুরু করার পর পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর যে কয়টি যুদ্ধবিমান ছিল, সেগুলো তারা যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেনি। ভারতীয় বিমানবাহিনী সেগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ করে বেশির ভাগই অকেজো করে দেয়, অথবা এগুলো ব্যবহার করার জন্য যে রানওয়েগুলো ছিল, তা ধ্বংস করে ফেলে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শত্রুর কোনো কার্যকর বিমানবাহিনী ছিল না। যৌথ নেতৃত্বের অধীনে যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানিরা তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তারা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো পরিত্যাগ করে পেছনে সরে যেতে থাকে। পরাজয়ের গতি ত্বরান্বিত হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনীকে ‘পুল ব্যাক’ করে ঢাকার কাছাকাছি আসতে নির্দেশ দেন। ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করলে পাকিস্তানিরা খাবারের টেবিলে খাবার ফেলে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়। এদের একাংশ দক্ষিণেও সরে পড়ে। সম্ভবত নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তারা দক্ষিণে গিয়েছিল। ওদের একটি ধারণা ছিল যে হয়তো দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে তাদের উদ্ধারের জন্য আমেরিকার জাহাজ আসতে পারে। আর আমেরিকান জাহাজে করে তারা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে নিরাপদে পাকিস্তানে চলে যেতে পারবে।
তাদের যুদ্ধ করার মনোবল বেশ আগেই ভেঙে গিয়েছিল। তারা জানত যে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত জনগণ তাদের বিরুদ্ধে। ৯ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করার কথা কয়েকবার উঠেছিল, তবে চূড়ান্তভাবে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে তারা আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্যে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী নিয়োগ, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব, আত্মসমর্পণের জন্য আলোচনা ইত্যাদি বিষয়ে সময় ক্ষেপণ চলছিল। পাকিস্তানি সেনারা রণক্ষেত্রে টিকে থাকতে পারছিল না। তারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পড়ে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে তারা ভয় পাচ্ছিল। পাকিস্তানিরা পরাজয়ের একদম দ্বারপ্রান্তে চলে আসে। ভারতীয় বাহিনী তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। কিন্তু ইয়াহিয়া তখন পর্যন্ত আমেরিকার হস্তক্ষেপ আশা করছিল। এই আশায় ইয়াহিয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ শেষ মুহূর্তে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য মাত্র ১৩ দিনের চূড়ান্ত যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
৬ ডিসেম্বর সকালে ভুটান ও বিকেলে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতির এই খবর শুনে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে খুব আনন্দ-উল্লাস হয়। তাদের স্বীকৃতির এই আনন্দ শুধু সদর দপ্তরে নয়, সারা যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে যায়। তাদের স্বীকৃতি প্রদানের অর্থ হলো, দেশ প্রায় স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। দেশের স্বাধীনতা অর্জন অনেকাংশে নিশ্চিত হয়ে যায়। তাদের এই স্বীকৃতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশকেও প্রভাবিত করবে, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। বাস্তবেও তা-ই হলো। এই ঘোষণার পূর্বে সব দেশই হয়তো ভাবত, পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ এবং পূর্ব পাকিস্তান তার একটি প্রদেশ। তাই অন্যান্য দেশ এই যুদ্ধে কোনো মন্তব্য করতে কিংবা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকে।
৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক যুদ্ধবিরতির জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে একটা আবেদন করেন। ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশও নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধ বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাদের সরিয়ে নেওয়ার একটা বন্দোবস্ত করার জন্য পুনরায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে একটি বার্তা পাঠায়। এদিন ভারতীয় বিমানবাহিনীর মিগ-২১ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর বেশ কয়েকবার আক্রমণ করে। ৯ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজি, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর আত্মসমর্পণ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। ১৩ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এদিন জেনারেল নিয়াজি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘ঢাকা রক্ষার জন্য আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ তিনি সম্ভবত মার্কিন সপ্তম নৌবহরের কথা বিবেচনা করে এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা যুদ্ধের শুরু থেকেই মনে করত, এই যুদ্ধে আমেরিকা কিংবা চীন কিংবা উভয়েই তাদের সাহায্য করবে অথবা কোনো প্রকার মধ্যস্থতা করে যুদ্ধ বন্ধ করতে সহায়তা করবে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা তাদের সেই আশা জাগিয়ে রেখেছিল।
১৪ ডিসেম্বর বিকেল চারটায় ভারতীয় বিমানবাহিনী গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় আক্রমণ করে। গভর্নর ডা. মালিক ভীত হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে রূপসী বাংলা হোটেল) গিয়ে রেডক্রসের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময় পাকিস্তানিদের মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। নিয়াজি আত্মসমর্পণ করতে নারাজ থাকলেও এ ঘটনার পর আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠালেও ভারত আশ্বস্ত ছিল এই ভেবে যে ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৬টি যুদ্ধজাহাজ (যার মধ্যে পাঁচ-ছয়টি সাবমেরিন)সহ তাদের ষষ্ঠ নৌবহর অবস্থান করছিল। ফলে আমেরিকার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা খুব সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত মার্কিন নৌবহরের পাকিস্তানিদের সহায়তা না করার পেছনে সম্ভবত অন্যান্য কারণের মধ্যে এটি ছিল প্রধান।
ভারতীয়দের পক্ষ থেকে বারবার আত্মসমর্পণের কথা প্রচার করা হচ্ছিল। যুদ্ধে পাকিস্তানিরা যখন পরাজয়ের খুব কাছে চলে আসে, তখন ভারতীয় সর্বোচ্চ নেতৃত্ব লিফলেট ও বেতারের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের বার্তা প্রচার করতে থাকে। পাকিস্তানিদের তারা আহ্বান করে, ‘আত্মসমর্পণ করো। যুদ্ধে তোমরা আর টিকে থাকতে পারবে না। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য সময় থাকতেই তোমরা আত্মসমর্পণ করো। তোমাদের আমরা নিরাপত্তা দেব। তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান আর হবে না।’ ১৫ ডিসেম্বর খুব জোরালোভাবে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের কথা শোনা যায়। জেনারেল মানেকশ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা পর্যন্ত আত্মসমর্পণের জন্য সময় বেঁধে দেয়। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়। একই সময়ে ভারতীয় বাহিনী তাদের বহর নিয়ে শহরের উপকণ্ঠে এসে পৌঁছে যায়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল আটটার দিকে জেনারেল নিয়াজি ভারতীয় সেনাবাহিনী-প্রধানের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য সময়ের মেয়াদ আরও ছয় ঘণ্টা বাড়ানোর অনুরোধ করেন এবং তাঁদের নিরাপদে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা চান। এরপর বেতারে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর প্রচারিত হয়।
ভারতীয় সামরিক বাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল পি দাস অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ফারুক আজিজ খানের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে অনুষ্ঠেয় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর জানান। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারেন যে কর্নেল ওসমানী, ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত (ভারতীয় বাহিনী) এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব মুক্ত এলাকা পরিদর্শনে সিলেট গেছেন। কর্নেল ওসমানী ১৩ ডিসেম্বর সিলেটের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের পরিকল্পনা করেন। যাত্রার আগে তাঁকে আমি বলেছিলাম, ‘স্যার, আপনার এখন কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। দ্রুতগতিতে যুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।’ কর্নেল ওসমানী তাঁর পরিকল্পনা পরিবর্তন না করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।
কর্নেল ওসমানীর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিকেল চারটায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমি বাংলাদেশ বাহিনীর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করব। এ সময় আমি সম্ভবত কমল সিদ্দিকীসহ কয়েকজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখার জন্য গিয়েছিলাম। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যোগদানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর ড. ফারুক আজিজ খান এবং প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি লিয়াজোঁ অফিসার মেজর নূরুল ইসলাম আমাকে চারদিকে খুঁজতে শুরু করেন। এঁদের সঙ্গে আমার নিউ মার্কেটের কাছে দেখা হয়। তাঁরা আমাকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদানের বিষয়টি জানান। তাঁরা আরও জানান যে তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে সরাসরি দমদম বিমানবন্দরে যেতে বলেছেন। সে সময় আমার পরনে বেসামরিক পোশাক, অর্থাৎ একটা শার্ট আর সোয়েটার ছিল, আমি এগুলো বদলে সামরিক পোশাক পরারও সময় পেলাম না। এ অবস্থাতেই আমি দমদম বিমানবন্দরের দিকে রওনা হই। মেজর নূরুল ইসলাম, ড. ফারুক আজিজ খান ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা আমাকে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন। সেখানে গিয়ে দেখি যে একটি সামরিক যাত্রীবাহী বিমান দাঁড়ানো আছে।
আমি আমার সফরসঙ্গীদের বিদায় জানিয়ে টারমাকে দাঁড়িয়ে থাকা সামরিক বিমানে আরোহণের জন্য বিমানের দু-তিন সিঁড়ি ওঠার পর লক্ষ করলাম, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি জিপ বিমানের দিকে আসছে। জিপের পতাকা ও তারকা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে আরোহী কোনো উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হবেন। জিপটি সিঁড়ির কাছে এসে থামলে লক্ষ করলাম, মিত্রবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং মিসেস বান্তি অরোরা গাড়ি থেকে নামছেন। জেনারেল অরোরার পরনে ছিল ধূসর রঙের ফুলপ্যান্ট ও জামা, মাথায় শিখদের ঐতিহ্যবাহী পাগড়ি; মিসেস অরোরার পরনে ছিল বেগুনি রঙের শাড়ি। আমি সিঁড়ির মধ্যে কিছুটা সরে গিয়ে তাঁদের জন্য জায়গা করে দিলাম, যাতে তাঁরা বিমানে উঠতে পারেন। জেনারেল অরোরা আমার পিঠে হাত দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। আপনি আগে যাবেন।’
বিমানের মধ্যে ঢুকে দেখলাম ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগেই আসন গ্রহণ করেছেন এবং আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা দমদম বিমানবন্দর থেকে প্লেনে রওনা হয়ে ঢাকার ওপর দিয়ে আগরতলা বিমানবন্দরে এসে নামি। তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে যুদ্ধে খুব খারাপভাবে বিধ্বস্ত হওয়ায় সেখানে কোনো ফিক্সড উইং বিমান ওঠানামা করা সম্ভব ছিল না। সেখানে একমাত্র হেলিকপ্টারই ওঠানামা করছিল। এ কারণে আমদের সরাসরি ঢাকার বদলে আগরতলা যেতে হয়েছিল। আগরতলা পৌঁছে দেখি, বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ইতিমধ্যে ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আলোচনার জন্য দুপুর একটার দিকে হেলিকপ্টারযোগে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী এবং জাতিসংঘের ঢাকা প্রতিনিধি জন কেলি তাঁকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান। ব্রিগেডিয়ার বাকের জেনারেল জ্যাকব ও কর্নেল খারাকে (ভারতীয় নিয়ে পূর্বাঞ্চল (পাকিস্তান) বাহিনীর সদর দপ্তরে পৌঁছান। এয়ার কমোডর পুরুষোত্তম বিমানবন্দরে থেকে যান জেনারেল অরোরাসহ আমাদের অভ্যর্থনার আয়োজন করতে।
জেনারেল নিয়াজির অফিসে এসে জেনারেল জ্যাকব লক্ষ করেন যে নিয়াজি আর জেনারেল নাগরা পাঞ্জাবি ভাষায় পরস্পরকে একটার পর একটা স্কুল আদিরসাত্মক কৌতুক উপহার দিচ্ছেন। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ খান, রিয়ার এডমিরাল শরিফ ও এয়ার ভাইস মার্শাল ইনাম উল হক। নিয়াজির সঙ্গে আলোচনার আগে জ্যাকব জেনারেল জি সি নাগরাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয়-সংখ্যক ভারতীয় সৈনিক ঢাকায় আনার নির্দেশ দেন এবং ঢাকার নিরাপত্তা, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি যেমন, গার্ড অব অনার, টেবিল-চেয়ার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পাঠিয়ে দেন।
এরপর দুই পক্ষের মধ্যে আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পিনপতন নীরবতার মধ্যে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান এবং খসড়া কপিটি জেনারেল নিয়াজিকে দেন। পাকিস্তানিরা ধারণা করেছিল যে আত্মসমর্পণ নয়, যুদ্ধবিরতি হবে। আত্মসমর্পণের সংবাদ পেয়ে তারা বেশ হতাশ হয়ে পড়ে। জেনারেল ফরমান আলী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বিরোধিতা করেন, তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পক্ষে মত দেন। জেনারেল নিয়াজি দলিলটি অন্যদের দেখার জন্য দেন। কেউ কেউ কিছু পরিবর্তনের কথা বলেন। দলিলে পাকিস্তানিদের পক্ষে বেশ কিছু শর্ত ছিল, যেমন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করা হবে এবং সার্বিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হবে। এমনকি পাকিস্তানপন্থী সব বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তার বিষয়ও দলিলে উল্লেখ ছিল, যা আগে কখনো কোনো আত্মসমর্পণের দলিলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পাকিস্তানিরা আরও কিছু সময় নেওয়ার পর আত্মসমর্পণের দলিলে সম্মতি দেয়।
এরপর আত্মসমর্পণের পদ্ধতি নিয়ে আলাপ শুরু হয়। জেনারেল জ্যাকব জানান, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে প্রথমে ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মিলিত দল জেনারেল অরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এরপর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর হবে এবং শেষে জেনারেল নিয়াজি তাঁর অস্ত্র ও পদবির ব্যাজ খুলে জেনারেল অরোরাকে হস্তান্তর করবেন। আত্মসমর্পণ পদ্ধতির কিছু কিছু ব্যবস্থায় জেনারেল নিয়াজি গররাজি ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান তাঁর অফিসেই হোক। শর্তগুলোর বিষয়ে জেনারেল জ্যাকবের অনড় অবস্থানের কারণে শেষে জেনারেল নিয়াজি সবই মেনে নেন, তবে আত্মসমর্পণের পরও নিরাপত্তার জন্য তাঁর অফিসার ও সৈনিকদের ব্যক্তিগত অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি চান। জ্যাকব তা মেনে নেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সাধারণত বিজিত সেনাপতি বিজয়ী সেনাপতির সদর দপ্তরে গিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর দেন ও অস্ত্র সমর্পণ করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এটির ব্যতিক্রম ঘটানো হয়। এখানে বিজয়ী সেনাপতি বিজিত সেনাপতির এলাকায় গিয়ে জনসমক্ষে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। বাঁদিকে জেনারেল অরোরার পেছনে আমি
হেলিকপ্টারে করে পড়ন্ত বিকেলে আমরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করি। অবতরণ করার সময় দেখি হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল নিয়াজি, জেনারেল জ্যাকব এবং আরও কিছু পাকিস্তানি ও মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তা আমাদের অভ্যর্থনা জানান। এরপর জিপে করে আমরা রমনা রেসকোর্স ময়দানে রওনা হই। রেসকোর্সে আমি জেনারেল অরোরার সঙ্গে তাঁর জিপে ভ্রমণ করি। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, মানুষজন উৎফুল্ল, সবার মুখে হাসি এবং প্রশান্তির ছায়া। রমনার চারপাশে মানুষের ব্যাপক ভিড়। এমন পরিস্থিতিতে ভিড় ঠেলে আমরা উপস্থিত হলাম রমনা ময়দানের সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে। অনুষ্ঠানটি ছিল অনাড়ম্বর এবং এটি অল্প সময়ে শেষ হয়। অনুষ্ঠানে মাত্র দুটি চেয়ার আর একটি টেবিল ছিল। একটি চেয়ারে জেনারেল নিয়াজি ও অন্যটিতে জেনারেল অরোরা বসলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি খুব সুশৃঙ্খলভাবে হয়নি। মানুষের ভিড়ে অতিথিদের দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন ছিল। আমি, ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান রিয়াল এডমিরাল এস এম নন্দা ও পূর্বাঞ্চল বিমানবাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর পাশেই ছিলেন পূর্বাঞ্চল সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এফ আর জ্যাকব। আমি জেনারেল অরোরার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অশোক রায় আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন, যদিও ভিড়ের চাপে আমরা আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছিলাম না।
আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আসা হলো। প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান জেনারেল নিয়াজি এবং পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা দলিলে স্বাক্ষর করলেন। স্বাক্ষরের জন্য নিয়াজিকে কলম এগিয়ে দেন অরোরা। প্রথম দফায় কলমটি দিয়ে লেখা যাচ্ছিল না। অরোরা কলমটি নিয়ে কিছু ঝাড়াঝাড়ি করে পুনরায় নিয়াজিকে দেন। এ দফায় কলমটি আর অসুবিধা করেনি। পরে জেনেছি, ওই দিন শুধু আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার জন্যই অরোরা কলকাতা থেকে কলমটি কিনে এনেছিলেন। স্বাক্ষর শেষ হলে উভয়েই উঠে দাঁড়ান। তারপর আত্মসমর্পণের রীতি অনুযায়ী জেনারেল নিয়াজি নিজের রিভলবারটি কাঁপা কাঁপা হাতে অত্যন্ত বিষণ্নতার সঙ্গে জেনারেল অরোরার কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের কর্ডন করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।
আত্মসমর্পণের পর ঢাকায় নয় মাস ধরে অবরুদ্ধ থাকা জনতা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে; কয়েকজন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আমরা কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না। আবেগে সবাই বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর অনেকে বলল, ‘আহ! আজ থেকে আমরা শান্তিতে, নির্ভয়ে ঘুমাতে পারব।’
আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমরা জিপে করে বিমানবন্দরে চলে আসি। সেখান থেকে হেলিকপ্টারযোগে আমরা আগরতলা হয়ে কলকাতায় যাই। কলকাতা যখন পৌঁছাই, তখন রাত হয়ে গেছে। তখন নিজেকে খুব নির্ভার মনে হচ্ছিল। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, যুদ্ধ শেষ হয়েছে, আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেলাম, দেশের মানুষ এখন শান্তিতে থাকবে, মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি পাবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন