বীরত্বসূচক খেতাব

২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা হয় শত্রুকে আক্রমণ করত, আর না-হয় শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করত। দুটি ক্ষেত্রেই মুক্তিযোদ্ধাকে সাহসের পরিচয় দিতে হতো। সাহসের কারণেই অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও তারা বিজয় ছিনিয়ে আনত অথবা ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে নিজেদের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করত। সাহসকে পুঁজি করে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি জয় করত। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসের স্বীকৃতি দেওয়া বা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেওয়ায় উদ্বুদ্ধ করতে কর্নেল ওসমানী বীরত্বসূচক খেতাব প্রবর্তন করতে আগ্রহী হন।

কর্নেল ওসমানী খেতাবের বিষয়ে একটি প্রস্তাব মে মাসের প্রথম দিকে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করেন। মন্ত্রিসভাও এটিকে যৌক্তিক বিবেচনা করে ১৬ মে অনুমোদন দেয়। বাংলাদেশ বাহিনী সদর দপ্তর থেকে বীরত্বসূচক খেতাবের বিষয়টি সব সেক্টর ও সহায়তাকারী ভারতীয় বাহিনীর সেক্টরকে অবহিত করা হয়। সদর দপ্তর থেকে সবাইকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বা বীরত্বপূর্ণ কাজের বর্ণনা দিয়ে সুপারিশ পাঠানোর নির্দেশও দেওয়া হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়, অর্থাৎ প্রতিরোধযুদ্ধ কেবল শেষ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তী পর্যায়ের জন্য গুছিয়ে উঠতে শুরু করেছে। সেক্টরগুলো গঠিত হলেও এর প্রশাসনিক বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে শুরু হয়নি। এ সময়ে সেক্টর সদর দপ্তরগুলোতে দাপ্তরিক কাজকর্ম পরিচালনা করার মতো জনবল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বেশ অভাব ছিল। ফলে জুলাই মাস পর্যন্ত সেক্টরগুলো থেকে বীরত্বসূচক খেতাবের বিশেষ কোনো সুপারিশ সদর দপ্তরে পৌঁছায়নি। তবে এই সময়কালে ভারতীয় বাহিনী থেকে কয়েকজনের জন্য বিভিন্ন ধরনের পুরস্কারের সুপারিশ করা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়েক মাস আমাদের অনেক সৈনিক ভারতীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিত।

সুপারিশের সংখ্যা খুব বেশি না হওয়ায় কর্নেল ওসমানী সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলনের পর ৩০ জুলাই একটি বিস্তারিত নির্দেশাবলি প্রকাশ করেন। সেই নির্দেশাবলিতে খেতাবের বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে আবারও সব সেক্টর ও পদাতিক ব্যাটালিয়নকে খেতাবের জন্য সুপারিশ পাঠাতে বলেন। এই চিঠির সঙ্গে সুপারিশ পাঠানোর জন্য একটি সুপারিশনামা সংযুক্ত করেন। চিঠিতে খেতাবের ধরন, যোগ্যতা, আর্থিক সুবিধাসহ অন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি উল্লেখ ছিল। তবে এ সময় খেতাবগুলোকে চার স্তরে ভাগ করলেও এর নামকরণ করা হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। বীরত্বপূর্ণ খেতাবের নির্দেশাবলিটি পরিশিষ্ট ৮ হিসেবে যুক্ত করলাম। এই নির্দেশাবলিতে উল্লেখ ছিল, মাঠপর্যায় থেকে যেসব সুপারিশ সদর দপ্তরে আসবে, তা একটি নিরীক্ষা পর্ষদ যাচাই-বাছাই করে প্রধান সেনাপতির কাছে তাঁর মতামতের জন্য উপস্থাপন করবে। নিরীক্ষা পর্ষদের প্রধান করা হয় চিফ অব স্টাফকে। পর্ষদের প্রধান বিষয়ে আরও উল্লেখ ছিল, চিফ অব স্টাফ অনুপস্থিত থাকলে অথবা জরুরি ভিত্তিতে কোনো খেতাবের সুপারিশ নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হলে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিরীক্ষা পর্ষদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধকালে নিরীক্ষা পর্ষদের প্রধানের দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হয়। অক্টোবর মাসে সদর দপ্তর থেকে নিরীক্ষা পর্ষদের প্রধান হিসেবে আমার নামে আদেশও জারি করা হয়। এই পর্ষদে আমার সঙ্গে ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এম এ মঞ্জুর এবং মেজর এম এ ওসমান চৌধুরীকে সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধকালে খুব বেশিসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার সুপারিশনামা সদর দপ্তরে আসেনি। আমার যত দূর মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন সেক্টর থেকে খুব বেশি হলে ৭০-৮০টি সুপারিশনামা আমাদের কাছে জমা পড়েছিল। এগুলোর বেশির ভাগই এসেছিল জেড এবং কে ফোর্স এবং ৩, ৪, ৭ ও ১১ নম্বর সেক্টর থেকে। আমাদের নিরীক্ষা পর্ষদ অক্টোবরের শেষের দিকে প্রথমবারের মতো একত্র হয়। কিন্তু সুপারিশনামার স্বল্পতার কারণে ওই সভায় কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আমরা ১৭ নভেম্বর পুনরায় একত্র হই। সেদিন আমরা প্রায় ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন ধরনের খেতাব দেওয়ার সুপারিশ করে প্রধান সেনাপতির কাছে উপস্থাপন করি। প্রধান সেনাপতি আমাদের সুপারিশের ওপর সম্মতি দিয়ে ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে এগুলো প্রতিরক্ষামন্ত্রী (একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী) তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে পাঠান। এ সময় যুদ্ধ চরম মুহূর্তে এসে পৌঁছায়। যুদ্ধের তীব্রতা এত বেড়ে যায় যে মাঠপর্যায় থেকে আর কোনো সুপারিশনামা সদর দপ্তরে পৌঁছায়নি। ১৭ নভেম্বর আমরা যে ৪৩ জনকে খেতাবের জন্য সুপারিশ করেছি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তাঁর সদর দপ্তর কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের আগেই তা অনুমোদন করেন। তবে এঁদের গেজেট প্রকাশিত হতে বেশ বিলম্ব হয়। তাঁদের গেজেট প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে। মুক্তিযুদ্ধকালে আরও কিছু খেতাবের সুপারিশ এলেও শুধু এই ৪৩ জনের বিষয়ে সব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছিল। বিভিন্ন প্রতিকূলতার জন্য বাকি কয়েকজনের খেতাবের প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হয়নি।

দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর খেতাবের বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় আসে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সেক্টর অধিনায়কদের সভায় বিষয়টি আলোচিত হয়। এ সময় সার্বিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বীরত্ব, নেতৃত্ব, সহযোগিতা ইত্যাদির বিবেচনায় বিভিন্ন ধরনের খেতাবের পৃথক সুপারিশ আসতে থাকে। আমার যত দূর মনে পড়ে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে খেতাবের বিষয়ে কর্নেল ওসমানীও খুব সুন্দর একটি প্রস্তাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করেন, যা বাস্তবায়ন করলে পরবর্তী সময়ে সংগঠিত খেতাবের অনেক ত্রুটি এড়ানো সম্ভব হতো। কিন্তু ওসমানীর প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়ায় খেতাবের বিষয়টি কিছুটা জটিল রূপ নেয়। সরকার আগের, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মে মাসের সিদ্ধান্তকেই বলবৎ রাখে।

মুক্তিযুদ্ধকালে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা, সার্বক্ষণিকভাবে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকা, প্রতি মুহূর্তে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অবস্থান বদলে যাওয়া এবং সর্বোপরি সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা খুব দুর্বল থাকায় সেক্টর থেকে খেতাবের বিষয়ে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে সেক্টর অধিনায়কদের সভায় খেতাব দেওয়ার বিষয়টি চালু করার জন্য নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখনো যেহেতু সেক্টরগুলো ভেঙে দেওয়া হয়নি, তাই সেক্টর ও সাব-সেক্টর অধিনায়কদের কাছে নতুন করে খেতাবের সুপারিশ চাওয়া হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেক্টরগুলোর বিলুপ্তি ঘটে এবং নিয়মিত বাহিনীর আদলে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে ওঠে। এতে করে খেতাবের সুপারিশগুলো পাঠাতে পুনরায় বিলম্ব হতে থাকে। ১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে প্রাপ্ত সুপারিশনামা নিরীক্ষার জন্য আমাকে প্রধান করে আবারও আরেকটি নিরীক্ষা পর্ষদ গঠন করা হয়। আমার সঙ্গে সেনাবাহিনীর কর্নেল মীর শওকত আলী (বীর উত্তম ও পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল) ও কর্নেল এম এ মঞ্জুরকে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

খেতাবের জন্য সব ধরনের সুপারিশ প্রথমে সেনাবাহিনীর কাছে একত্র করা হয়েছিল। সেক্টর ও সাব-সেক্টরগুলোর অধিকাংশ অধিনায়ক সেনা অফিসার হওয়ায় সুপারিশনামা তাঁরা প্রক্রিয়া করে ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসের শুরুতে আমার কাছে উপস্থাপন করেন। আমি ও পর্ষদের অন্য সদস্যরা মার্চ মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে এসব সুপারিশ যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান সেনাপতির কাছে পাঠিয়ে দিই। ঠিক কতজনকে আমরা নিরীক্ষা করেছিলাম বা কতজনকে নির্বাচিত করেছিলাম, তা এই মুহূর্তে মনে না পড়লেও নির্বাচিতদের সংখ্যা ৭০০-র বেশি ছিল না। এর পরের ধাপে প্রধান সেনাপতির সুপারিশ বা সম্মতির পর প্রতিরক্ষামন্ত্রী চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেন। অনুমোদিত খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত তালিকায় ৫৪৬ জনের নাম ছিল। এই তালিকায় আগের গেজেটে উল্লেখিত ৪৩ জনের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বীরত্বসূচক খেতাবের পদক যথাক্রমে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক

পত্রিকায় নাম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের মধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তালিকাটি ত্রুটিপূর্ণ মনে করেন এবং বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া ও অভিযোগ উত্থাপন করেন। প্রতিক্রিয়া ও অভিযোগগুলোকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে ছিলেন সেসব মুক্তিযোদ্ধা, যাঁরা মনে করেছিলেন তাঁদের খেতাব পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু পাননি। দ্বিতীয় ভাগে ছিলেন সেসব মুক্তিযোদ্ধা, যাঁরা মনে করেছিলেন তাঁদের যে স্তরের খেতাব পাওয়ার কথা, তা তাঁরা পাননি। আর তৃতীয় প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ ছিল যে, একই ব্যক্তির নাম একাধিকবার উল্লেখ হয়েছে, এক বাহিনীর সদস্যকে অন্য বাহিনীতে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ নাম ও পরিচয় না থাকায় সুনির্দিষ্টভাবে প্রাপককে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না ইত্যাদি। এই প্রতিক্রিয়াগুলো সরকারকে বেশ বিব্রত করে। ফলে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আগে প্রকাশিত খেতাবের তালিকা প্রত্যাহার করা হয় এবং বিস্তারিত পরীক্ষা শেষে পুনরায় নতুন তালিকা প্রকাশের কথা উল্লেখ করা হয়।

এর মধ্যে খেতাবের বিষয়ে সব নথিপত্র প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসা হয় এবং মন্ত্রণালয়ে এগুলো নতুনভাবে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা শেষে মন্ত্রণালয় খেতাবের তালিকায় তিনটি গরমিল খুঁজে পায়। এই গরমিলগুলো ছিল প্রথমত একই ব্যক্তির নাম একাধিকবার উল্লেখিত হওয়া; দ্বিতীয়ত, তালিকায় কোনো কোনো প্রাপকের খেতাবের ধাপ পরিবর্তন হয়ে যাওয়া এবং তৃতীয়ত, কিছু নাম অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও প্রকাশিত তালিকায় সংযুক্ত থাকা। এই গরমিলগুলো সংশোধনের জন্য পুনরায় মন্ত্রণালয় থেকে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার কাছে পাঠানো হয়। আমি কর্নেল মঞ্জুরকে সঙ্গে নিয়ে খুব দ্রুততার সঙ্গে ১১ ডিসেম্বর খেতাব তালিকার সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের সুপারিশসহ আবারও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করি। এ দফায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উত্থাপিত গরমিলগুলো যতটা সম্ভব ঠিক করার চেষ্টা করি। প্রধানমন্ত্রী (প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে) খেতাবের চূড়ান্ত তালিকা অনুমোদন করেন। এটি ১৫ ডিসেম্বর গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত গেজেটটিতে বেশ কিছু অসম্পূর্ণতা থেকে যায়, যা পরে ২০০৪ সালে নতুন করে প্রকাশিত বাংলা গেজেটে কিছুটা কমিয়ে আনা হয়। এই গেজেট অনুযায়ী খেতাবের সারাংশ নিম্নরূপ :

বাহিনী/সেক্টরবীরশ্রেষ্ঠবীর উত্তমবীর বিক্রমবীর প্রতীকমোট
নিয়মিত বাহিনী     
সেনাবাহিনী৪২৮৪১৫৯২৮৮
নৌবাহিনী১৭
বিমানবাহিনী২৪৩৩
বিডিআর২৩৪০৭৩
পুলিশ বাহিনী  
মোজাহিদ/ আনসার বাহিনী   
গণবাহিনী     
১ নম্বর সেক্টর ১৫
২ নম্বর সেক্টর ৩৯৪৭
৩ নম্বর সেক্টর  ৩৫৪২
৪ নম্বর সেক্টর ৩৭৪৪
৫ নম্বর সেক্টর  ১০১১
৬ নম্বর সেক্টর  
৭ নম্বর সেক্টর ৩৯৪৮
৮ নম্বর সেক্টর ৪৯৫৯
৯ নম্বর সেক্টর  ২৫২৬
১০ নম্বর সেক্টর     
১১ নম্বর সেক্টর ২৩২৯
অন্যান্য*  ১৫১৭
মোট৬৮১৭৫৪২৬৬৭৬
  • অন্য ১৭ জন কোনো বাহিনী বা সেক্টরের সদস্য ছিলেন না বা কারও অধীনে যুদ্ধ করেননি।

যেকোনো যুদ্ধে সৈনিককে বীরত্বসূচক খেতাব দেওয়া হয় তাঁর বীরত্ব প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। তাই বীরত্ব প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গেই খেতাব দেওয়া সম্ভব হয়নি। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর আমাদের কাছে সবচেয়ে জরুরি বিষয় ছিল দেশ পুনর্গঠন করা। তাই খেতাব দেওয়ার বিষয়টি খুব বেশি প্রাধান্য পায়নি। ফলে খেতাবের প্রক্রিয়া শেষ করতে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এ ছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধকালের সামরিক কাঠামো ভেঙে নতুন সামরিক কাঠামো ও নেতৃত্ব গঠনের ফলে খেতাব দেওয়ার প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হয়। মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো পর্যায়েই খেতাব দেওয়ার বিষয়টি ঠিক যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন, গণবাহিনীর সদস্যরা কেন এত কম খেতাব পেয়েছেন। আমি স্বীকার করি, গণবাহিনীর আরও অনেক সদস্যেরই খেতাব পাওয়া উচিত ছিল। তাঁদের অনেকেই বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ অথবা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ তাঁরা তাঁদের বীরত্বের কোনো স্বীকৃতি পাননি। এ ধরনের ঘটনা ঘটার কিছু কারণ ছিল, যার কিছু ব্যাখ্যা আমি আগে দিয়েছি। যেমন প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামরিক কাঠামোর পরিবর্তন, অগ্রগণ্যতায় খেতাবের বিষয়টি পিছিয়ে থাকা ইত্যাদি। তবে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল খুব স্বল্পমেয়াদি। এ সময়ে গণবাহিনীর সদস্যরা কেবল প্রশিক্ষিত হতে শুরু করেছিল এবং ধীরে ধীরে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করছিল। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তারা ধীরে ধীরে নেতৃত্ব, পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হতে পারত। তাদের অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে তারাই বাংলাদেশের বাহিনীপ্রধান ও মূল শক্তিতে রূপান্তরিত হতো। কিন্তু বিষয়টি ওই পর্যায়ে আসার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন বাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সৈনিকেরাই পূর্বপ্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার কারণে যুদ্ধকালে বেশি তৎপর ছিল এবং মাঠপর্যায়ে সফল নেতৃত্ব দেয়। স্বভাবত তারাই খেতাবপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পায়।

আর একটি বড় বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে গণবাহিনীর কোনো সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। গণবাহিনীর সদস্যরা ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মিলিশিয়া বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ওই বাহিনী বিলুপ্ত করা হলে তাদের আর কোনো সাংগঠনিক পরিচয় থাকে না। তারা সবাই তাদের আগের পেশা বা অবস্থানে চলে যায়। এ কারণে গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তালিকাও করা সম্ভব হয়নি বা তাদের কোনো নাম-ঠিকানাও রাখা যায়নি। খেতাবের বিষয়েও তাদের জন্য পৃথক কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়নি। সেক্টর ও সাব-সেক্টর অধিনায়কেরা সুপারিশনামা তৈরি করেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার বেশ পরে। সে সময় গণবাহিনীর অনেক সদস্যের নাম-ঠিকানা তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন। ফলে সেক্টর কমান্ডাররা যাদের বীরত্বের কথা স্মরণে রাখতে পেরেছিলেন, শুধু তাদের খেতাবের জন্য সুপারিশ করেন।

আমি আরও একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বসূচক খেতাব প্রদানের সিদ্ধান্তে সব সেক্টর অধিনায়ক একমত ছিলেন না। কয়েকজন সেক্টর অধিনায়ক মনে করতেন, খেতাবের বিষয়টি পেশাদার সৈনিকদের জন্য প্রযোজ্য। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খেতাব অবমাননাকর বা অপ্রয়োজনীয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে দেখা হয়। খেতাবের বিষয়ে এই মতপার্থক্যের কারণেও সব সেক্টর থেকে যথোপযুক্ত-সংখ্যক সুপারিশ করা হয়নি। খেতাবের বিষয়ে আমার শেষ কথা হচ্ছে, খেতাব প্রদানের বিষয়ে আমরা আরও উদারতা দেখাতে পারতাম; সরকারও খেতাবের বিষয়ে আরও বাস্তবসম্মত নীতিমালা গ্রহণ করতে পারত। একই সঙ্গে সে সময়ের ফোর্স, সেক্টর ও সাব-সেক্টর অধিনায়কেরা আরও বিচক্ষণতার সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বাচিত করতে পারতেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন