বিমানবাহিনী

মুক্তিযুদ্ধে বিমানবাহিনী গঠনের ইতিহাস বর্ণনার আগে এই বাহিনী গড়ে তুলতে যাঁরা আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বাঙালি তরুণ কর্মকর্তা এবং বিমানসেনারা সক্রিয়ভাবে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিতে পারেননি বা তা সম্ভবও ছিল না, কিন্তু পরোক্ষভাবে ও গোপনে তাঁরা অনেক কাজ করেছিলেন। সে মুহূর্তে তাঁদের একটি অংশ আমার কাছে তাঁদের করণীয় সম্পর্কে উপদেশ প্রত্যাশা করেছিল। তরুণ কর্মকর্তাদের দুঃসাহসিক অন্তর্ঘাতমূলক কাজে জড়িত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল, এটা আঁচ করতে পেরে আমি এসব কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডে সংযম ও সহনশীলতা আনার চেষ্টা করি। আন্দোলনের বাস্তবতা উপলব্ধি করেই ধীর ও দৃঢ়পদে পরিকল্পিত পন্থায় এগিয়ে যাবার পরামর্শ দিই এবং তাঁদের পেশাগত কাজ বা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে বলি। এ উপদেশ পাওয়ার পরও কিছুসংখ্যক তরুণ কর্মকর্তা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে পাকিস্তানি সরকারের নৃশংস পদক্ষেপের বিরুদ্ধে চরম ও যথার্থ প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সব গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বাঙালি কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়, ফলে বাঙালি বিমানসেনাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় বাঙালি বিমানসেনাদের সামনে মাত্র একটি পথই খোলা থাকে আর তা হলো, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে নেওয়া। বিমানবাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় পালানো খুব একটা সহজ বিষয় ছিল না। পাকিস্তানিদের সজাগ দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে পলায়ন করা ঝুঁকিপূর্ণ ও দুঃসাধ্য ছিল। পাশাপাশি পালানোর পর পাকিস্তানিদের অবর্ণনীয় অত্যাচার থেকে আত্মীয়স্বজনদের রক্ষা করার প্রশ্নটিও উপেক্ষা করা সহজ ছিল না। বিবাহিত বিমানসেনাদের জন্য বিষয়টি ছিল আরও জটিল। তাঁদের বেশির ভাগই থাকতেন ক্যান্টনমেন্টের সবচেয়ে দূরবর্তী কুর্মিটোলা এলাকায়। সেই সময়ে কুর্মিটোলা এলাকার সঙ্গে মূল ঢাকা শহরের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত ছিল না। তাই সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া ছিল আরও দুরূহ। তার পরও বিমানবাহিনীর বহু কর্মকর্তা ও বিমানসেনা তাঁদের সর্বস্ব ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এসব ত্যাগী দেশপ্রেমিককে পাকিস্তানিরা ‘স্বপক্ষত্যাগী’ (ডিফেক্টেড) বলে অভিহিত করে। ঢাকা বিমানঘাঁটি থেকে প্রথম কিছু তরুণ কর্মকর্তা পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগের সাহস দেখান।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পরপরই তারা সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে জয়দেবপুরে মিলিত হয়ে সীমান্তবর্তী মতিনগর এলাকায় সরে যায়। একই সময়ে আরও কিছু অফিসার অন্য পথ ধরে গোপনে সরাসরি ভারতে প্রবেশ করে। বৈমানিকদের মধ্যে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সদরুদ্দিন ও ফ্লাইং অফিসার নুরুল কাদের কুমিল্লার ভেতর দিয়ে ভারতের আগরতলায় পৌঁছান। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এক বন্ধুর গাড়িতে দাউদকান্দি ফেরি পর্যন্ত যান। সেখানে গাড়ি থেকে নামার সময় স্থানীয় কিছু পাকিস্তানি সমর্থক বা তাদের গোয়েন্দা বাহিনীর চর সুলতান মাহমুদের বেশভূষা দেখে সন্দেহ করে এবং তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে। সুলতান মাহমুদের বন্ধু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে গাড়ি নিয়ে সরে পড়েন। কোনো উপায় না দেখে সুলতান মাহমুদ ভরা মেঘনায় ঝাঁপ দেন এবং কপালগুণে জোয়ারের টানে হোমনার দিকে গিয়ে কূলে উঠতে সমর্থ হন। সেখান থেকে নবীনগর হয়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। এভাবে বাঙালি বৈমানিকেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য একাকী বা দল বেঁধে ভারতে পাড়ি জমাতে থাকেন।

১৯৭১-এর মে মাসের মধ্যে আমিসহ পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে উইং কমান্ডার আবুল বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম (বীর উত্তম, পরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন), ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম (বীর উত্তম, পরে স্কোয়াড্রন লিডার) এবং পিআইএ ও অন্যান্য বেসামরিক সংস্থার বৈমানিক ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দীন আহমদ (বীর উত্তম), ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ (বীর উত্তম), ক্যাপ্টেন এ এস এম আবদুল খালেক (বীর প্রতীক, স্বাধীনতার পর বিমান দুর্ঘটনায় নিহত), ক্যাপ্টেন কাজী আবদুস সাত্তার (বীর প্রতীক, আলমগীর সাত্তার নামে পরিচিত), ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম, স্বাধীনতার পর বিমান দুর্ঘটনায় নিহত) প্রমুখ ভারতে পাড়ি জমাই। এসব বৈমানিক মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের পেশাগত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা পরিপূর্ণভাবে নিয়োগ করতে আগ্রহী ছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা স্থলযুদ্ধে মুক্তিসেনাদের বীরোচিত আক্রমণের মুখোমুখি হচ্ছিল। কিন্তু আকাশ থেকে কোনো প্রতিরোধের ভয় তাদের ছিল না। বাঙালি বৈমানিকেরা মুক্তিযুদ্ধকে আকাশেও টেনে নিতে উৎসাহী ছিলেন। তাঁরা চাচ্ছিলেন যে বাংলাদেশের সব গ্রামগঞ্জ, নদীনালা, বনজঙ্গল যেমন পাকিস্তানিদের জন্য অনিরাপদ, আকাশও তাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠুক। এখানেও মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলুক।

আমরা তিনজন জ্যেষ্ঠ বাঙালি বৈমানিক, অর্থাৎ উইং কমান্ডার এম কে বাশার, উইং কমান্ডার (অব.) এস আর মীর্জা ও আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিই। ভুলনামূলকভাবে তরুণ অথচ অভিজ্ঞ বৈমানিকদের মধ্যে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রহিম, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম সদর উদ্দিন, ফ্লাইং অফিসার লিয়াকত আলী খান (বীর উত্তম, পরে স্কোয়াড্রন লিডার। তিনি পাকিস্তানে ছিলেন। সেখান থেকে কৌশলে বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন), ফ্লাইং অফিসার সাখাওয়াত হোসেন, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম, ফ্লাইং অফিসার শামসুল আলম এবং ফ্লাইং অফিসার নুরুল কাদের। তাঁদের সার্বিক আকাঙ্ক্ষা ছিল, পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র সংগ্রামে সক্রিয় সহায়তা প্রদান এবং একটি আকাশযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্র তৈরি করা। মে-জুন মাসের মধ্যে যেসব সামরিক ও বেসামরিক বৈমানিক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের যথোপযুক্ত কোনো দায়িত্ব দেওয়া যাচ্ছিল না। দায়িত্ব না পেয়ে কেউ কেউ সাধারণ সৈনিকের মতো সেক্টরে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর আমাকে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এবং উইং কমান্ডার বাশারকে ৬ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইং অফিসার সাখাওয়াত হোসেন ১ নম্বর সেক্টরে, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের ৪ নম্বর সেক্টরে, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম সদর উদ্দিন ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রহিম ৬ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। ফ্লাইং অফিসার লিয়াকত জেড ফোর্সে এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার নিযুক্ত হন। স্থলযুদ্ধে অনভিজ্ঞ এসব বৈমানিক নিজেদের অসামান্য সাহসী যোদ্ধা হিসেবেই শুধু প্রতিপন্ন করেননি বরং অনেক ক্ষেত্রে সেক্টরে নিজেদের অপরিহার্য করে তুলেছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে বিমানবাহিনী গঠিত হলে এঁদের কেউ কেউ সেক্টর থেকে এসে যোগ দেন বিমানবাহিনীতে।

মে মাসের মাঝামাঝি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনে আমি সর্বোচ্চ ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। তখন থেকেই আমার ধ্যানজ্ঞান সবকিছুই হয়ে ওঠে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন। যদিও তখন সেটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তবু উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্র পেলেই আমি আমার স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেছি। অবশেষে একদিন সত্যি সত্যি আমার যৌক্তিক স্বপ্নের বাস্তবায়ন আমি দেখতে পেয়েছিলাম।

মে মাসে যখন কলকাতা হয়ে দিল্লি যাই, তখন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে বিমানবাহিনী গঠন নিয়ে আলোচনা করি। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে আশ্বস্ত করেন যে এ বিষয়ে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। মে মাসে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি দিল্লি সফর করেন। সেখানে আলোচনা করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কার্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে। আলোচনা-পরবর্তী সময়ে প্রধান সেনাপতি বিভিন্ন বিষয়কে একত্র করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন যে বৈমানিকেরা তাঁদের পেশা থেকে বেশি দিন দূরে থাকলে সমস্যা হবে। প্রধান সেনাপতির মন্তব্য নিচে দেওয়া হলো :

১৯৭১-এর মে মাসে লিখিতভাবে প্রদত্ত চাহিদার পরবর্তী সময়ে শত্রুদের বিমানঘাঁটি থেকে পালিয়ে এসে গ্রুপ ক্যাপ্টেন ও উইং কমান্ডার পদবির দুজন চাকুরিরত জ্যেষ্ঠ অফিসার এবং বেশ কয়েকজন আধুনিক জেট বিমানের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জঙ্গি বৈমানিক এবং প্রায় দুই শত গ্রাউন্ড ক্রু বাংলাদেশ বাহিনীতে (মুক্তিবাহিনী) যোগ দিয়েছেন। দিল্লিতে যাচাই শেষে অফিসারদের বর্তমানে বাংলাদেশ বাহিনীতে মাঠপর্যায়ের স্টাফ অফিসার হিসেবে অপব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়াও প্রাক্তন পিআইএর কিছু ক্যাপ্টেন/বৈমানিক আছেন, যাঁদের ফ্লাইংয়ে নিযুক্ত না রাখলে তাঁরা তাঁদের উপযুক্ততা হারাবেন। শত্রুকে আঘাত হানার জন্য এঁদের আকাশে উড্ডয়নের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

বেশ কয়েক মাস পর, সম্ভবত আগস্ট মাসের প্রথম দিকে হঠাৎ একদিন তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর কার্যালয়ে ভারত সরকারের সচিব কে বি লাল, ভারতীয় বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান ও ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা অশোক রায়কে দেখতে পাই। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘এরা আপনার সাথে বিমানবাহিনী গঠন বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী।’ কে বি লাল বললেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের তো বিমান দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আপনাদের যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমাদের স্কোয়াড্রনের সাথে আপনারা ফ্লাই করতে পারেন।’ উত্তরে আমি বললাম, ‘আপনাদের সাথে ফ্লাই করতে গেলে আমাদের বৈমানিকেরা কোন দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে? কোন দেশের আইন মেনে চলবে? বাংলাদেশের আইন না ভারতের আইন?’ প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘স্বভাবতই ভারতীয় আইন মেনে চলতে হবে।’

আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে বললাম, সবচেয়ে উত্তম সমাধান হবে যদি উনারা আমাদের জন্য কয়েকটি বিমান, কিছু আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য একটি এয়ার ফিল্ডের ব্যবস্থা করেন। আমাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞ বৈমানিক আছে। আমরা নিজেরাই প্রশিক্ষণ এবং অভিযান পরিচালনা করতে পারব। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেদিন এর চেয়ে বেশি আলোচনা হয়নি।

আগস্ট মাসের শেষের দিকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল পি সি লাল কলকাতায় আসেন। তিনি আমাকে তাঁর হোটেলে এক চা-চক্রে নিমন্ত্রণ করেন। চা-চক্রে তাঁর স্ত্রী ইলা লালও উপস্থিত ছিলেন। ইলা লাল ছিলেন বাঙালি। মি. পি সি লাল অত্যন্ত ভদ্রলোক ও বিনয়ী ছিলেন। আলোচনায় মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং গঠন বিষয়ে কথাবার্তা হয়। প্রাথমিকভাবে মি. পি সি লাল বাংলাদেশকে বিমান দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতার কথা তুলে ধরেন। একপর্যায়ে আমি বলি, ‘স্যার, এখন তো পুরোদমে গেরিলাযুদ্ধ চলছে, ভবিষ্যতে আমাদের বিমানও চালাতে হতে পারে। তখন বিমানের প্রথম আক্রমণটি আমরাই করতে চাই।’ শুনে তিনি মৃদু হাসলেন।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় বিমানযুদ্ধে আমাদের প্রশিক্ষিত বৈমানিকদের ব্যবহারের বিষয়টি আলোচিত হতে থাকে। পাশাপাশি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে যুদ্ধবিমান না পাওয়া গেলে নিজস্ব উদ্যোগে যুদ্ধবিমান ক্রয়ের বিভিন্ন প্রস্তাবও অস্থায়ী সরকারের কাছে আসতে থাকে। এসব প্রস্তাব আসে মূলত প্রবাসী বাঙালিদের কাছ থেকে। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসে বাঙালি কূটনীতিক কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর থেকে তাঁরা অনেকে পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। বাঙালি কূটনীতিকেরা যুদ্ধবিমানসহ বিভিন্ন আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের বাজার পর্যালোচনা করে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসে প্রতিবেদন প্রেরণ করতেন। কিন্তু তখনকার বাস্তবতা এই পদ্ধতিতে যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করার জন্য অনুকূল ছিল না, ফলে নিজস্ব উদ্যোগে যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

এর কিছু দিন পর এয়ার মার্শাল পি সি লাল আমাদের প্রশিক্ষিত ও যোগ্য জঙ্গি বিমানের বৈমানিকদের বিষয়ে দুটি প্রস্তাব পাঠান। প্রথম প্রস্তাবটি ছিল বৈমানিকদের ভারতীয় বিমানবাহিনীতে আত্তীকরণের মাধ্যমে ব্যবহার করা এবং দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল দুটি পুরোনো ‘ভ্যাম্‌পায়ার’ যুদ্ধবিমান দিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গড়ে তোলা। প্রস্তাব দুটির কোনোটিই খুব একটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। প্রথম প্রস্তাবটির বিপক্ষে আমি আগেও মত প্রকাশ করেছি। প্রস্তাব দুটির ওপর আমি আমার মতামত দিই, যা সম্ভবত ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছেছিল। প্রস্তাব ও আমার মতামত আমি পরিশিষ্ট ৬-এ তুলে ধরলাম।

সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আমাকে জানানো হয় যে আমাদের বিমানবাহিনী গঠনে ভারতীয়রা সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে। এর পরপরই ভারতীয়রা ভারতের ডিমাপুরে কিলো ফ্লাইটের সদস্যবৃন্দ বাংলাদেশ সরকারকে একটি অটার বিমান, একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং একটি ডিসি-৩ ডাকোটা (সি ৪৭) বিমান হস্তান্তর করে। বিমানগুলো আমাদের ঠিক কবে হস্তান্তর করা হয়েছিল, তা আমার এখন মনে নেই, তবে ২৮ সেপ্টেম্বরের আগেই আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ শুরু করি এই বিমানগুলো দিয়ে। আর ২৮ সেপ্টেম্বর ডিমাপুর এয়ার ফিল্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণের উদ্বোধন করি।

ভারতের দেওয়া বিমান তিনটি যুদ্ধবিমান ছিল না। এগুলো ছিল মূলত বেসামরিক বিমান। আমরা এই তিনটি বেসামরিক বিমানে পরিবর্তন এনে বিমানগুলোকে যুদ্ধের উপযোগী করে তুলি। যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এগুলোতে কিছু সংযোজন আর বিয়োজন করতে হয়েছিল, যা স্বাভাবিক সময়ে অকল্পনীয়। সাধারণ অবস্থায় এই সব বিমানকে যুদ্ধে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। কিন্তু আমাদের তো সাধারণ অবস্থা ছিল না। আমাদের অসাধারণ অবস্থায় এই সব রূপান্তরিত অসাধারণ বিমানকে উড়তে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

বিমানগুলো পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী উদ্যোগ বা তৎপরতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। যেমন কোথায় ও কবে থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হবে, প্রশিক্ষণের জন্য বৈমানিকদের কোথা থেকে কীভাবে পাওয়া যাবে ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিমানসেনাদের ঠিকানা এবং তারা কোন ক্যাম্প বা সেক্টরে যুদ্ধ করছে, সেসব তথ্য আমাদের কাছে ছিল। তাই যুদ্ধরত বৈমানিক ও বাঙালি বিমানসেনাদের দ্রুত খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। ভারতীয় বাহিনী ওই সব বিমানসেনার সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত একত্র করতে এবং ডিমাপুরে উপস্থিত হতে আমাদের সাহায্য করে। এ সময় আমারা জানতে পারি যে বেশ কয়েকজন বেসামরিক বৈমানিক আগরতলায় অবস্থান করছেন, যাঁদের সহজে এবং দ্রুত প্রশিক্ষণে আনা সম্ভব। ফলে বিমানগুলো পাওয়ার পর বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠায় কোনো সময় ক্ষেপণ হয়নি।

অটার বিমানটি ছিল কানাডার ডিহ্যাভিল্যান্ড কোম্পানির তৈরি। ক্ষুদ্রকায় এই অটার বিমানে রকেট নিক্ষেপক সংযুক্ত করে ‘ফাইটার’ বিমানে রূপান্তর করা হয়। বিমানটির উভয় ডানায় ফ্রান্সের তৈরি সাতটি করে মোট চৌদ্দটি অত্যাধুনিক রকেট লঞ্চার সংযুক্ত করা হয়। সঙ্গে ফাইটার বিমানের জন্য অত্যাবশ্যকীয়ভাবে প্রয়োজনীয় মেশিনগানও সংযুক্ত করা হয়। এতে আরও সংযুক্ত করা হয় ২৫ পাউন্ড ওজনের ১০টি বোমা বহন-উপযোগী একটি মঞ্চ। তৃতীয় একজন ক্রু মঞ্চ থেকে বোমাগুলো নিক্ষেপ করবে।

অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টারটি ছিল ফ্রান্সের তৈরি। যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এই হেলিকপ্টারে সংযুক্ত করা হয়েছিল একটি ৩০৩ ব্রাউনিং মেশিনগান এবং দুটি রকেট নিক্ষেপক। দুই আধার থেকে সাতটি করে মোট ১৪টি রকেট নিক্ষেপ করা যেত। শত্রুর গুলি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এর পেট বরাবর পাটাতনে প্রায় এক ইঞ্চি পুরু (২৫ মিলি) লোহার পাত লাগানো হয়েছিল।

ডিসি-৩ · বিমানটি আমেরিকার ম্যাগডোনাল্ড ডগলাস কোম্পানির তৈরি। বিমানটি যোধপুরের মহারাজা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। বিমানটিকে পাঁচ হাজার পাউন্ড বোমা বহনকারী বোম্বার বা বোমাবর্ষণকারী বিমানে রূপান্তর করা হয়। যেহেতু বিমানটিতে বোমা রাখার কোনো জায়গা ছিল না, তাই আমরা বিমানটির পেট বরাবর নিচের দিকের অংশ কেটে বোমাগুলো রাখার ব্যবস্থা করি এবং সেখান থেকেই বোমাগুলোকে বিশেষ কায়দায় নিক্ষেপের উপযুক্ত সরঞ্জাম যুক্ত করি।

এভাবে আমরা বিমানগুলো প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত করে তুলি। প্রতিটি বিমানকে বিভিন্ন সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ এক নতুন ধরনের বিমানে পরিণত করা হয়। তাই সামরিক ও বেসামরিক বৈমানিকদের নতুনভাবে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। সিলেট জেলার নিকটবর্তী ভারতের নাগাল্যান্ড প্রদেশের ডিমাপুরে এই নতুন ধরনের বিমানের সাহায্যে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত একটি বিমানঘাঁটি ছিল। ঘাঁটিটি ছিল প্রায় পরিত্যক্ত এবং এর আশপাশ একেবারে জনবসতিহীন ও জঙ্গলে ঘেরা ছিল। ডিমাপুর বিমানঘাঁটির বাইরে ছোট ছোট জনবসতি ছিল। ডিমাপুরের চারদিকে ছিল ছোট-বড় বেশ কিছু পাহাড়। এখানে ৫ হাজার ফুটের একটি রানওয়ে এবং একটি কন্ট্রোল টাওয়ার ছিল। সেখানে সিভিল অ্যাভিয়েশনের কয়েকজনমাত্র স্টাফ থাকত। প্রায় এক দশক ধরে এখানে বিশেষ কোনো বিমান ওঠানামা করত না। ভারতীয় সিভিল অ্যাভিয়েশনের মাত্র একটি এফ ২৭ বিমান সপ্তাহে একবার এখানে আসত। এই ঘাঁটিটি ভারতীয় বিমানবাহিনীর জোরহাট বেসের (ভারতের সবচেয়ে পুবের বিমানঘাঁটি, চীন-ভারত সীমান্তের কাছাকাছি) নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং তারাই ডিমাপুর বিমানঘাঁটির সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত।

মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের বৈমানিকদের প্রশিক্ষণস্থল হিসেবে এটিকে নির্বাচন করা হয়। কম ব্যবহার হওয়ায় এখানে তেমন কোনো অবকাঠামো না থাকলেও কাজ চালানোর মতো অবস্থায় আনতে খুব একটা সময় লাগেনি বা সমস্যাও হয়নি। সেখানে পরিত্যক্ত কিছু ভবন থাকলেও তার সব বাসোপযোগী ছিল না, সেগুলোতে সবার থাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। বাঙালি বৈমানিক, প্রকৌশলী ও গ্রাউন্ড ক্রুরা বসবাসের জন্য নিজেরাই বাঁশ দিয়ে কিছু ঘর বানিয়ে নেয়। সেই সব বাঁশের ঘরের কাছেই রাখা হতো প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত বিমানগুলোও। প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের খাওয়ার বন্দোবস্ত ডিমাপুর ঘাঁটির ভেতরেই ছিল।

বিমানগুলো ছিল ছোট ও ধীরগতিসম্পন্ন, তাই এইগুলোকে দিনে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল। শত্রুর বিমানবিধ্বংসী কামান অনেক সময় নিয়ে সহজেই আমাদের ধ্বংস বা ভূপাতিত করতে পারত। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, দিনের আলোতে আক্রমণের পরিবর্তে আমরা রাতে ফ্লাই করে টার্গেটে পৌঁছাব। এ কারণে আমাদের প্রশিক্ষণও রাতে হতো, যাতে অভিযান পরিচালনাকালে আমরা শত্রুর পর্যবেক্ষণকে ফাঁকি দিতে পারি। আক্রমণের জন্য বিমানে কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। অর্থাৎ বিমানটি কত উঁচু দিয়ে, কত গতিতে ও কোন দিকে যাচ্ছে, সেগুলো পরিমাপের কোনো যন্ত্র ছিল না। ফলে আমাদের অনুমান করে বিমান চলার উচ্চতা, গতি ও দিক নির্ধারণ করতে হতো। রাতের আঁধারে আলো ও যন্ত্রের অভাবে এসব আনুমানিক হিসাব-নিকাশ করতে হতো মনে মনে। অন্ধকারে এসব কাজ কত কঠিন বা বিপজ্জনক তা সাধারণভাবে প্রকাশ করা যায় না। এর জন্য সত্যিকার সাহসের প্রয়োজন হয়। হিসাব-নিকাশে সামান্য ভুল হলে যেকোনো বিপদ ঘটে যেতে পারে। সব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আমাদের বৈমানিক ও বিমানসেনারা অত্যন্ত সফলভাবে এর ব্যবহার করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হয়।

২৪ অথবা ২৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিমাপুর ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনীর বৈমানিকেরা একত্র হন। আমিও কলকাতা থেকে ডিমাপুরে যাই। এদিন আমি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলমকে সঙ্গে করে বেসামরিক বিমানে আসামের গুহাটি পৌঁছাই। সেখান থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানে চড়ে এসে পৌঁছাই ডিমাপুরে। সেখানে কয়েকজন বাঙালি বৈমানিক আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি তাঁদের কাছে গিয়ে বলি, “আমাদের অপেক্ষার দিন শেষ হয়েছে। আমরা প্রবাসে আমাদের বিমানবাহিনী গড়ে তুলতে যাচ্ছি এবং তোমরাই হবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম অফিসার। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে তোমাদের স্বাগতম।” কিলো ফ্লাইটের প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিমানসেনা সংগ্রহের জন্য ২৭ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে কিছু প্রতিনিধি বিভিন্ন সেক্টরে প্রেরণ করা হয়। তাঁরা যশোর ও আগরতলার নিকটস্থ সেক্টরগুলো থেকে বিমানসেনাদের সংগ্রহ করেন। চূড়ান্তভাবে ৫৮ জন বৈমানিক ও বিমানসেনাকে ডিমাপুরে আনা হয়।

ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে প্রশিক্ষণের জন্য একটি যুদ্ধবিমান দেখছি

২৮ সেপ্টেম্বর ডিমাপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। বৈমানিকেরা ছাড়াও পাকিস্তান বিমানবাহিনী ছেড়ে আসা ৪৯ জন বাঙালি টেকনিশিয়ান আমাদের সঙ্গে ডিমাপুর বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। সেদিনকার অনুষ্ঠানে এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টায় একটা ডাকোটা প্লেনে এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল এয়ার মার্শাল দেওয়ানসহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ ভারতীয় বিমানবাহিনীর অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে ডিমাপুর বিমানবন্দরে পৌঁছান। আমিসহ সব বৈমানিক বিমানবন্দরের টারম্যাক এরিয়ায় পি সি লালকে অভ্যর্থনা জানাই। কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনের ঘোষণা দিই। প্রধান অতিথি হিসেবে এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। আমরা একত্রে সবাই মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিই। এরপর পি সি লাল তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে চলে যান। আমি পরদিন কলকাতায় ফিরে আসি। এই যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠানে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ যোগ দিতে পারেননি; কারণ, তিনি তখন চট্টগ্রামের মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন অভিযানে পায়ে গুলির আঘাত পেয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ নম্বর সেক্টরে অবস্থান করছিলেন। আমি সার্বক্ষণিকভাবে ডিমাপুরে না থাকার কারণে জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা হিসেবে সুলতান মাহমুদই সেখানকার প্রশিক্ষণ ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন।

অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে কর্মরত ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম মুক্তিবাহিনীর এই বিমানবাহিনীকে ‘কিলো ফ্লাইট’ নামে অভিহিত করার প্রস্তাব করেন। মুক্তিবাহিনীতে ইতিমধ্যে ব্যক্তির নামে (জিয়াউর রহমান, সফিউল্লাহ ও খালেদ মোশাররফ নামের আদ্যক্ষর নিয়ে যথাক্রমে ‘জেড’ ‘এস’ ও ‘কে’ ফোর্স) ব্রিগেড গঠন করা হয়েছে, তাই বিমানবাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে আমার প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ আমার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে (খন্দকারের ‘কে’) বিমানবাহিনীর নাম কিলো ফ্লাইট রাখার অভিমত দেওয়া হয়। এতে একদিকে আমাকে যেমন সম্মানিত করা হবে, তেমনি মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের কার্যক্রমকেও ছদ্মনামের আড়ালে রেখে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবটা যথার্থ হওয়ায় সেটা গৃহীত হয়।

৪ অক্টোবর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নামকরণ হয় ‘কিলো ফ্লাইট’। বিমানবাহিনী গঠনের যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুতেই, সেটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়, বলতে গেলে, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষলগ্নে, অবশ্য একেবারে মোক্ষম সময়ে। ২৮ সেপ্টেম্বর আমরা বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণের সব কার্যক্রম শুরু করার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতাউত্তর সময়ে ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখটিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে পালন করা হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে আলাদাভাবে বিমানবাহিনীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন না করে সব বাহিনীর জন্য যৌথভাবে ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেন।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে কিলো ফ্লাইটের যাত্রা শুরুর লগ্নে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন : স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম, বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন, বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত, বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ, বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দীন আহমেদ এবং বেসামরিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন কাজী আবদুস সাত্তার। কিলো ফ্লাইটের জন্মলগ্নে ডিমাপুরে যে নয়জন বৈমানিক উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ মাত্র তিনজন ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এবং অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ছয়জনই ছিলেন বেসামরিক বৈমানিক। এই ছয়জন বেসামরিক বৈমানিকের চারজন ছিলেন পিআইএর এবং অবশিষ্ট দুজনের একজন ছিলেন উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের, আর অপরজন উদ্ভিদ সংরক্ষণসংশ্লিষ্ট হলেও তিনি ছিলেন কীটনাশক ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি সিবা গেইগীর। তিন ধরনের তিনটি উড়োজাহাজ পাওয়ার প্রেক্ষিতে ওই নয়জন বৈমানিককে তিন ভাগে বিভক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রত্যেক ভাগেই ছিল তিনজন করে বৈমানিক। প্রশিক্ষণের ব্যাপ্তি ছিল প্রায় দুই মাস।

কয়েক দিনের প্রশিক্ষণের পর বিমানগুলো জঙ্গি বিमाने রূপান্তরের জন্য বিভিন্ন ওয়ার্কশপ ও ঘাঁটিতে পাঠানো হয়। ১১ অক্টোবর অটার বিমানটি জঙ্গি বিमाने রূপান্তরিত হয়ে ডিমাপুর ফেরত আসে। এরপর বাকি দুটি বিমান ও রূপান্তরিত হয়ে ডিমাপুরে ফেরত আসে এবং নতুন করে বৈমানিকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণে ভারতীয় প্রশিক্ষকেরা অংশ নেন। এঁদের মধ্যে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষাল (অটারের জন্য), ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সিনহা (সি৪৭-এর জন্য) এবং স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী (অ্যালুয়েটের জন্য) অন্যতম।

সেই বছর প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকত বেশির ভাগ সময়। বিশেষ করে ডিমাপুর অঞ্চল প্রায় সব সময়ই মেঘাচ্ছন্ন থাকত। কিছুই দেখা যেত না। ঘন বৃক্ষরাজিতে পূর্ণ পাহাড়ি এই অঞ্চল ছিল অত্যন্ত দুর্গম, ফলে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের প্রশিক্ষণ লোকচক্ষুর অন্তরালে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হতে এটা ছিল যেমন সহায়ক, তেমনি ছিল পাকিস্তান বিমানবাহিনীরও নাগালের বাইরে। এখানকার বন এতই ঘন ছিল যে বিমান থেকে কোনো বৈমানিক প্যারাসুটের সাহায্যে লাফিয়ে পড়লে তাঁর পক্ষে মাটিতে পড়া ছিল অসম্ভব, তাঁকে গাছের ডালেই ঝুলে থাকতে হতো। বিমান নিয়ে একটু দূরে গেলেই আর এয়ার ফিল্ড দেখা যেত না। এই রকম একটি এয়ার ফিল্ডে রাতে প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল খুবই কঠিন। যাঁরা বিন্দুমাত্র ফ্লাইং করেছেন, তাঁরা ধারণা করতে পারবেন যে এখানে রাত্রিকালে এই বিমানগুলো চালানো কতটা বিপজ্জনক ছিল। তবু আমরা অন্ধকারে প্রশিক্ষণ করতাম। সাধারণত ফ্লাইং শুরু হতো রাত ১২টার পর। প্রশিক্ষণকালে ডিমাপুরের পাহাড়গুলোতে রকেট ও বন্দুকের গোলার শব্দ প্রতিধ্বনি হতো। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা ফ্লাই করে পাহাড়ের উচ্চতা থেকে আরও ওপরে উঠে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতাম। কম উচ্চতায়ও আমাদের উড্ডয়ন করতে হতো। রাতের অন্ধকারে খুব নিচু দিয়ে ফ্লাই করে শত্রুর ওপর আঘাত হানার জন্য প্রয়োজন ছিল অতি উঁচুমানের ফ্লাইং ও ফায়ারিংয়ের প্রশিক্ষণ। তাই প্রশিক্ষণে বিশেষ জোর দেওয়া হতো গাছের শীর্ষ বরাবর ফ্লাইংয়ের ওপর।

পাহাড়ের ওপরে বা গাছের সঙ্গে সাদা প্যারাসুট রেখে আমরা লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তার প্রতি বোমা, গ্রেনেড, গান দিয়ে লক্ষ্যভেদের (টার্গেট শ্যুটিং) অনুশীলন করতাম। প্রশিক্ষণের সময় বৈমানিকদের খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হতো। এভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ কিংবা বিমান চালানো কত যে বিপজ্জনক তা একমাত্র যাঁরা বিমান চালান, তাঁরাই বুঝতে পারবেন। কিন্তু আমাদের এটা করতে হতো, কারণ এর কোনো বিকল্প ছিল না। প্রথম প্রথম ২৫ মাইল দূরে জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট একটা পাহাড়ের টিলায় প্যারাসুটটি খুঁজে পাওয়াটাই ছিল দুরূহ। আর হালকা হওয়াতেই অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার আর অটার বিমান যেন নেচে উঠত। যতই দিন গেল, হাত হলো পাকা, চোখ হলো শার্দুলের, বিশ্বাস হলো দৃঢ়তর।

প্রশিক্ষণ বেশ কিছু অগ্রসর হওয়ার পর হঠাৎ একদিন দেখা গেল যে প্রতি সর্টির পর হেলিকপ্টারের টেইল রোটারে কিছু আঁচড় লাগছে। পরীক্ষানিরীক্ষার পর বোঝা গেল, ৫৭ মিলিমিটার রকেটগুলোর টেইল ফিউজের তারগুলো খুব নাজুক হওয়ায় ফায়ারিংয়ের পর সেগুলো ছুটে গিয়ে টেইলে আঘাত করছে। পরে সেগুলো পরিবর্ধন করা হয়। বেসামরিক বৈমানিকেরা এর আগে কখনো যুদ্ধজাহাজে ফ্লাই করেননি, তবু অতি অল্প সময়ে ফ্লাইং ও ফায়ারিং, দুই-ই তাঁরা রপ্ত করে ফেলেন। এটা নিশ্চয়ই তাঁদের দৃঢ় মনোবল ও অদম্য সাহসের বহিঃপ্রকাশ। আমিও মাঝেমধ্যে প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে ককপিটে বসে লক্ষ করতাম কীভাবে তাঁরা ডাইভ দিচ্ছেন, কত দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানছেন ইত্যাদি। এসব দেখে আমি তাঁদের মাঝেমধ্যে পরামর্শ দিতাম কীভাবে আরও নিপুণতার সঙ্গে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা যায়। বিমানসেনারা দিনের বেলায় বিমান তিনটিকে সার্ভিসিং করত যাতে রাতে সেগুলো সচল থাকে। এভাবে আমাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও মহড়া চলতে থাকে। কলকাতা থেকে ডিমাপুরে প্রশিক্ষণ তদারকি এবং পরিদর্শনের জন্য গিয়ে বৈমানিকদের নিয়ে আমার বিচি ধরনের সব অভিজ্ঞতা হয়। এঁদের কারও মনে কোনো ভয় ও সংশয় ছিল না। যদিও তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বেসামরিক বৈমানিক এবং বিমানগুলোও ছিল পুরোনো বেসামরিক বিমানকে রূপান্তর করা সামরিক বিমান। বৈমানিকেরা সব সময় খুব উৎফুল্ল থাকতেন এবং কখন সরাসরি আক্রমণে যাবেন সে বিষয়ে উৎসুক থাকতেন। তাঁরা দিনরাত কাজ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না।

বৈমানিকেরা স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণেই রাতের আঁধারে আধুনিক দিগ্‌দর্শন যন্ত্র ছাড়া বিমান চালানোর কৌশল রপ্ত করে ফেলেন। এ ছাড়া কেমন করে প্রতিপক্ষ দলের বিমানের মোকাবিলা করতে হয়, কত দূর থেকে রকেট ছুড়তে হয়, কখন ও কীভাবে নিশানা লক্ষ্য করে বোমা ফেলতে হয়, কত কোণে ঝাঁপ (ডাইভ) দিতে হয়, কখন ও কীভাবে নিশানা স্থির করে মেশিনগান থেকে গুলি ছড়তে হয়, ইত্যাদি বিষয়েও তাঁরা প্রশিক্ষিত হন। প্রশিক্ষণ স্বল্পমেয়াদি হলেও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার অভিপ্রায়ে সবাই ছিলেন উদ্‌গ্রীব আর তাই প্রশিক্ষণে সব বিষয়ে পারদর্শী হতে তাঁদের সময়ের স্বল্পতা কোনো বাধাই হতে পারেনি, বরং এই স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণে সবাই হয়ে ওঠেন একেকজন দুর্ধর্ষ বিমানসেনা।

প্রশিক্ষণে অস্ত্র চালানো ছাড়া শত্রুর রাডার ফাঁকি দিয়ে কীভাবে সফল অভিযান করে নিরাপদে ফিরে আসা যায়, তার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। কোনো বিমানকে রাডার দিয়ে চিহ্নিত করার জন্য নির্দিষ্ট উচ্চতার প্রয়োজন হয়। বিমানটি যত উচ্চতায় থাকবে, রাডার তত দ্রুত বিমানটির অবস্থান শনাক্ত করতে পারবে। সে জন্য প্রশিক্ষণের সময় আমরা ঠিক গাছের ওপর দিয়ে (অর্থাৎ খুব নিচু হয়ে) উড়ে যেতাম, যাতে অভিযানের সময় আমাদের বিমানটি রাডারের আওতায় না পড়ে। অন্ধকারে ম্যানুয়ালি হিসাব-নিকাশ করে ঠিক গাছের ওপর দিয়ে ফ্লাই করতে হতো। এটা ছিল খুবই রোমাঞ্চকর।

কিছু দিন পর ভারতীয় বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং আমাকে জোরহাটে তাঁদের অপারেশন রুমে নিয়ে যান। সেখানে তিনি আমাকে আমাদের বিমানবাহিনী কোন কোন লক্ষ্যবস্তুতে কীভাবে আক্রমণ করবে তা দেখান। আমাদের লক্ষ্যবস্তুগুলো ডিমাপুর থেকে অনেক দূরে দূরে ছিল। তাই তিনি বলেন যে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগে বেশ কয়েকটি জায়গায় আমাদের রিফুয়েল করতে হবে। তারপর ফাইনাল ফ্লাইটে লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমণ করতে হবে। আক্রমণের পর যে স্থান থেকে শেষ ফুয়েল নিয়েছে, সেখানে ফিরে আসবে এবং আগের পথ ধরে বেজ ক্যাম্পে ফিরে যাবে। তাঁর পরামর্শমতো আমরা নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ইএসএসও বার্মার তেলের ডিপো ও চট্টগ্রামে ইস্টার্ন রিফাইনারির তেলের ডিপোতে প্রথম আক্রমণের পরিকল্পনা করি। কে কোন অভিযান পরিচালনা করবেন, সেটাও স্থির করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে অটার বিমানের সাহায্যে চট্টগ্রামের তেলের ডিপো আক্রমণ করব। আর হেলিকপ্টারের সাহায্যে আক্রমণ করব নারায়ণগঞ্জের তেলের ডিপো। আরও সিদ্ধান্ত হয় যে ডাকোটার সাহায্যে ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক ও ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার আলমগীর ঢাকার তেজগাঁওস্থ বিমানবন্দর আক্রমণ করবেন।

সবকিছুই যখন প্রায় মোটামুটি ঠিক, তখন হঠাৎ করে ডাকোটার অভিযানটি বাতিল করা হয়। তাতে ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন খালেক ও ক্যাপ্টেন সাত্তার অত্যন্ত হতাশ হন। ডাকোটার মিশন বাতিল করার কারণ, এতে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের কারণে ইঞ্জিনের পেছন দিক দিয়ে যে ধোঁয়া বের হয়, তাতে বেশ কিছু অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয় যা রাতের আঁধারে অনেক দূর থেকেও সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। এ অবস্থায় ডাকোটার সাহায্যে কোনো অভিযান পরিচালনা করা নিরাপদ ছিল না। এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ শত্রুবাহিনী খুব সহজে চিহ্নিত করে ডাকোটাকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। তাই এই বিমানের সাহায্যে সব ধরনের সামরিক অভিযান বাতিল করা হয়। চূড়ান্তভাবে যুদ্ধে বা হাওয়াই হামলার জন্য অনুপযুক্ত বিবেচনা করায় ডাকোটা বিমানটিকে পরিবহন বিমান হিসেবে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে তাঁর ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন দুর্গম এবং অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে চলাচল এবং সরঞ্জামাদি পরিবহনেও এটি ব্যবহার করা হয়।

ডিমাপুরে প্রশিক্ষণ শেষে হেলিকপ্টার এবং অটারের বৈমানিকেরা তাঁদের অভিযান পরিচালনার জন্য চলে আসেন ভারতের কৈলাশহর বিমানবন্দরে। এটি বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি। এ কারণে এখান থেকে বিমান অভিযান পরিচালনা করা সুবিধাজনক হবে বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই বিমানবন্দরের যে পর্যবেক্ষণ চৌকি ছিল, সেটার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, বিশেষত সিলেট অঞ্চলে, যেকোনো সেনা চলাচলের সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পৌঁছে যেত। ফলে মুক্তিবাহিনীর বৈমানিকেরাও তাঁদের বিরুদ্ধে ত্বরিত আক্রমণে যেতে পারতেন। পরবর্তী সময়ে হেলিকপ্টারটি আরও অগ্রবর্তী ঘাঁটি, অর্থাৎ আগরতলায় আনা হয় এবং সেখান থেকে কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় এই হেলিকপ্টারের সাহায্যে অভিযান পরিচালনা করা হতো।

৩ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের সাহায্যে প্রথম আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে প্রলম্বিত বর্ষায় দীর্ঘস্থায়ী হয় বন্যা। বর্ষায় সেনা ও ট্যাংক চলাচলে অসুবিধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপর্যাপ্ত সমর প্রস্তুতির কারণে ৩ নভেম্বরের বিমান আক্রমণ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। বিমান হামলার নতুন তারিখ স্থির করা হয় ২৮ নভেম্বর। মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের যেকোনো আক্রমণে পাকিস্তান বিমানবাহিনী প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানও বিমানের সাহায্যে ভারতের অভ্যন্তরে আক্রমণ করতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ওই দিন দমদম বিমানঘাঁটি থেকে ভারতীয় সব বিমানকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। অবশ্য ভারত সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ার কারণে সেদিনের আক্রমণটিও স্থগিত করা হয় শেষ মুহূর্তে। পাঁচ দিন পিছিয়ে পুনরায় অভিযানের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৩ ডিসেম্বর। ঘটনাক্রমে তারিখটি আবার ভারত-পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুর দিন হয়ে যায়। ১ ডিসেম্বর সকালে আক্রমণকারী বৈমানিকদের জোরহাটে নেওয়া হয় ব্রিফিংয়ের জন্য। চন্দন সিং সেখানে ম্যাপ ও চার্টের ওপর বৈমানিকদের লক্ষ্যবস্তু ও অভিযান পরিচালনার বিষয়গুলো ব্রিফ করেন।

৩ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের বৈমানিকেরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানিদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় প্রথম আক্রমণ করে। তাই ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙালি বৈমানিকদের একদল অটারের সাহায্যে চট্টগ্রামের তেল ডিপো এবং অপর দল হেলিকপ্টারের সাহায্যে নারায়ণগঞ্জের তেলের ডিপোতে অভিযান পরিচালনা করে। দুটি অভিযানই শতভাগ সফল হয়। লক্ষ্যবস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ভিন্নমত ছিল, তাঁরা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন চট্টগ্রামের ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি’ যা পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র তেল শোধনাগার ছিল। মুক্তিযোদ্ধা বৈমানিকেরা এতে দ্বিমত পোষণ করেন, তাঁরা যুক্তি দেখান যে তেল শোধনাগার ধ্বংস করে দিলে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারবে না। কাজেই এই স্থাপনাটি কিছুতেই ধ্বংস করা যাবে না, বরং সাময়িকভাবে জ্বালানি তেলের অভাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলতে ওখানকার তেলের আধারগুলো নষ্ট করাই হবে উত্তম।

উল্লিখিত তেলের ডিপো দুটি বেছে নেওয়ার আরও কিছু কারণ ছিল। বিমান উড্ডয়নের জন্য বিশেষ একধরনের জ্বালানি (জেট-এ-১) তেলের প্রয়োজন হয়, এই জ্বালানি তেল রাখা হতো ওই দুটি বিশেষ তৈলাধারে। তৈলাধারগুলো যদি ধ্বংস করে দেওয়া যায়, তবে যুদ্ধাবস্থায় ওই বিশেষ তেল খুব সহজে বহির্বিশ্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পরিবহন করে পূর্ব পাকিস্তানে আনা সম্ভব হবে না। ফলে পাকিস্তানিদের সামরিক এবং বেসামরিক বিমান পরিবহনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে এবং নিশ্চিতভাবে অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে অকার্যকর করে রাখা সম্ভব হবে।

অটার বিমানের সাহায্যে চট্টগ্রামের আক্রমণটি পরিচালনা করেছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ। অভিযানে যাওয়ার অভিপ্রায়ে তাঁরা সমস্ত সরঞ্জামসহ কমলপুর বিমানঘাঁটিতে চলে আসেন। কমলপুর শমসেরনগরের কিছুটা দক্ষিণে অবস্থিত ভারতের একটি ছোট শহর। তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়, লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণটা যেন ঠিক মাঝরাতের পরপরই করা হয়, তাই কমলপুর থেকে ৩ ডিসেম্বর আনুমানিক রাত নয়টায় অটার নিয়ে তাঁরা চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁদের আরও নির্দেশ দেওয়া হয় যে তাঁরা যেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের আগরতলা থেকে ২৫ মাইল পূর্বে তেলিয়ামুড়া বিমানবন্দরের কাছ দিয়ে যান। বিমানবন্দরের কাছে উপস্থিত হলে তাঁরা যেন তাঁদের বিমানের বাতিগুলো পরপর কয়েকবার জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে দেন। এতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারবে যে অটার বিমানটি সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। প্রত্যুত্তরে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সবুজ রঙের মশাল জ্বালিয়ে বিমানটিকে তাঁদের অবস্থান জানিয়ে দেবে, যাতে বৈমানিকেরা নিজেরাই সঠিকভাবে তাঁদের চলার পথ ও দিক নির্ধারণ করতে পারেন। আর যদি প্রয়োজন হয় বা কোনো বিভ্রান্তি দেখা দেয়, তবে বিমানবন্দরে প্রজ্বলিত মশালের আলো লক্ষ্য করে অটার পথ ও দিক সংশোধন করে নেবে।

যথাস্থানে এবং যথাসময়ে অটার সংকেত আদান-প্রদান করে নিশ্চিত হয় যে সঠিকভাবেই তারা তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলছে। ঘণ্টা তিনেক উড্ডয়নের পর তারা চট্টগ্রামের উপকূল বরাবর এসে পৌঁছায়, এরপর উপকূলরেখা বরাবর উড়ে তেলের ডিপোগুলোকে আক্রমণ করে। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী অটার লক্ষ্যবস্তুতে শুধু একবার আক্রমণ করে ঘাঁটিতে ফিরে আসার কথা। কিন্তু পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া বা প্রতি-আক্রমণ না আসায় অত্যন্ত আস্থাবান এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে দুই বৈমানিক লক্ষ্যবস্তুর পাশাপাশি থাকা তেলের অন্য ডিপোগুলোর ওপর আরও তিনবার আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের সব রকেট নিঃশেষ করেন। ডিপোগুলো ইতিমধ্যে প্রচণ্ড শব্দে প্রজ্বলিত ও বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। পাকিস্তানিরাও ততক্ষণে গুলিবৃষ্টি শুরু করে। ইত্যবসরে বৈমানিকদ্বয় ফেরার পথ অনুসরণ করে নির্বিঘ্নেই কুণ্ডিগ্রাম ঘাঁটিতে ফিরে আসতে সক্ষম হন। বিমানে জ্বালানি তেলের স্বল্পতার কারণে তাঁদের কুণ্ডিগ্রামে যাত্রাবিরতি করতে হয়। পরদিন তাঁরা আবার তাঁদের মূল ঘাঁটি কৈলাশহরে ফিরে যান।

চট্টগ্রামের পথে অটার যখন তেলিয়ামুড়ার আকাশ অতিক্রম করছিল, অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারটি তখন সেখানকার হেলিপ্যাডেই অপেক্ষা করছিল আর ক্রুরা নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে আঘাত হানার জন্য তাঁদের মিশন প্ল্যানটা শেষবারের মতো ভালো করে দেখে নিচ্ছিলেন। চাঁদের আলো আর ঘন কুয়াশা পরিবেশকে স্বপ্নপুরীতে পরিণত করে রেখেছিল। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন ভীতিকর রাতে আকাশে হেলিকপ্টার উড্ডয়ন একরকম অসম্ভবই ছিল, কোনো জটিল এবং বিপজ্জনক অভিযান পরিচালনা তো দূরের কথা। উপরন্তু মধ্যরাতে তেলিয়ামুড়ার জঙ্গলঘেরা ছোট্ট পাহাড়ের চূড়া থেকে ভরা জ্বালানি তেল আর অ্যামুনিশন নিয়ে টেক অফ করাটাও ছিল অতি বিপজ্জনক। তবু হেলিকপ্টারের বৈমানিক ও বিমানসেনারা নিজ দেশের ভূমিকে ঠিকই চিনবে বলে মিশন সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। অ্যালুয়েটের অভিযান পরিচালনা করেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম। শত্রুর রাডারকে ফাঁকি দেওয়া এবং সহজে পথ চিহ্নিত করার জন্য তাঁরা খুব নিচু দিয়েই উড়ে যেতে মনস্থির করেন।

কিছুদূর এগোনোর পর আখাউড়া এলাকা পেরোনোর সময় মনে হলো যেন চারদিকে খই ফোটা শুরু হয়েছে। এ ছিল ফায়ারিংয়ের শব্দ। দিন দশেক আগে ভারতীয় বাহিনী সীমান্তে হামলা করায় আখাউড়াব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকাসহ পুরো এলাকায় পাকিস্তানিরা ‘রেড অ্যালার্ট’ অবস্থায় ছিল। গোপনীয়তা রক্ষার্থে এ মিশন সম্পর্কে নিজ বাহিনীকেও কিছু জানানো নিষেধ ছিল। কোন দিক থেকে ফায়ারিং হচ্ছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল না। ট্রেসার উড়ছিল চারদিক থেকে। অতি নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টারকে বসে থাকা পাখি (সিটিং ডাক) মনে করে বোধ হয় দুই দলই ঝাল মেটাচ্ছিল।

শান্ত প্রকৃতির কো-পাইলট বদরুল আলম সুলতান মাহমুদের উদ্দেশে প্রায় চিৎকার করেই বলে উঠলেন, ‘স্যার, কোথায় নিয়ে এলেন? আপনি না বলেছিলেন টার্গেটে পৌঁছানো পর্যন্ত বসে থাকো এবং আরাম করো। চোখ খোলা রেখে যাত্রাপথের দিকে লক্ষ রাখো।’ কিছুই বলার ছিল না, একবার তাঁর দিকে তাকিয়েই স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান আবারও মনোযোগ দিলেন সামনে—তাঁর দৃষ্টি আর চিন্তায় শুধুই লক্ষ্যবস্তু। অন্য সবকিছু তাঁর ভাবনাচিন্তার বাইরে। কয়েক সেকেন্ড পর হেলিকপ্টার ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে চলে গেলে নিচ থেকে ফায়ারিংয়ের আওয়াজও আস্তে আস্তে পেছনে সরে গেল। নিচে ঘন কুয়াশা থাকায় ফ্লাইং করতে হচ্ছিল কিছুটা ইনস্ট্রুমেন্টের ভরসায় আর বাকিটা চোখে যতটুকু দেখা যায় তার ওপর ভরসা করে। সময়মতোই তাঁরা ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কে ইলিয়টগঞ্জের কাছে যুদ্ধের শুরুতে ভেঙে যাওয়া একটি ব্রিজের ওপর পৌঁছান। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে টার্ন নিয়ে আঁকাবাঁকা সড়ককে অনুসরণ করে তাঁরা এগোতে লাগলেন নারায়ণগঞ্জের দিকে। ঘন কুয়াশার কারণে পর্যবেক্ষণের সুবিধার্থে তাঁদের প্রায় গাছের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যেতে হচ্ছিল। মনে মনে সবাই প্রার্থনা করছিলেন যেন টেলিফোন আর বৈদ্যুতিক তারের খাম্বাগুলোর ধাক্কা থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। আল্লাহর কৃপায় তাঁরা দাউদকান্দির কাছে মাইক্রোওয়েভ পোল এবং তারপর দুটো নদী ক্রস করা উঁচু বৈদ্যুতিক তারের খাম্বার সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। কুয়াশা আর রাডার ডিটেকশনের ভয়ে তাঁরা ওপরে উঠতে পারছিলেন না। এইভাবেই তাঁরা ডেমরার ক্রসিংয়ের কাছাকাছি পৌঁছালেন। শীতলক্ষ্যায় পৌঁছেই দক্ষিণমুখী টার্ন নিয়ে নদীর ওপর দিয়ে চলার কথা। হেলিকপ্টার টার্ন করামাত্র সার্জেন্ট শহীদুল্লাহ (বীর প্রতীক) প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। খোলা দরজা দিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখেন যে তাঁরা পানির সামান্য ওপর দিয়ে আর অন্ধকারে না দেখা বৈদ্যুতিক তারের নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছেন। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তাঁরা আবারও বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন।

আক্রমণের জন্য নির্ধারিত স্থানে পৌঁছেই তাঁরা তেলের ডিপোগুলো লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করতে শুরু করেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে। প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার কারণে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওপরে উঠে সারা আকাশ আচ্ছাদিত করে ফেলে। এই কালো ধোঁয়া ও বহ্নিশিখা অনেক দূর থেকেও দৃষ্টিগোচর হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষকে এ দৃশ্য একদিকে যেমন অনুপ্রাণিত করে, তেমনি বহির্বিশ্বেও বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পায়।

ফেরার পথে আখাউড়া এলাকা পার হওয়ার সময় আবারও তাঁরা গোলাগুলির হালকা রিসেপশন পেলেন। সাফল্যের আনন্দে এবার নিচের গোলাগুলির আওয়াজ তাঁদের আর বিচলিত করতে পারল না। ফেরার পথে খুব সতর্কতার সঙ্গে তাঁদের নেভিগেশন করতে হয়েছিল। দীর্ঘ তিন ঘণ্টার মিশনের পর হেলিকপ্টারে আর মাত্র ১২ থেকে ১৫ মিনিটের তেল অবশিষ্ট ছিল। অরণ্যঘেরা পাহাড়ি চূড়ায় কোনো নেভিগেশন যন্ত্র ছাড়া ঘাঁটি খুঁজে বের করা ভীষণ কষ্টকর ব্যাপার ছিল। একটু ভুল হলে বা ঠিক সময়ে হেলিপ্যাড খুঁজে না পেলে ঘন অরণ্যের মধ্যেই তেল ফুরিয়ে যেত এবং হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় পতিত হতো। এভাবেই ১৯৭১-এর ৪ নভেম্বরের প্রথম রাতে পাকিস্তানি যুদ্ধদানবদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আত্মত্যাগী, তেজোদীপ্ত ও নির্ভীক পাইলটদের প্রথম সফল অভিযান সমাপ্ত হয়।

পাকিস্তান যখন ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যার সময় ভারতের কয়েকটি এয়ার ফিল্ডে আক্রমণ চালায়, তখন ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় ছিলেন। তিনি দিল্লিতে গিয়ে পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশন ডাকেন এবং সে রাতেই ৯-১০টার দিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যুদ্ধের এই ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের বিমানবাহিনীর সদস্যরা প্রথম আক্রমণ করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অবদান নিয়ে লেখা বই ইগলস ওভার বাংলাদেশ-এ-ও এই সত্যতার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। চন্দন সিংয়ের বরাত দিয়ে ওই বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে মুক্তিবাহিনীর বৈমানিকেরাই বাংলাদেশে প্রথম শত্রুর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর বিমানবাহিনীর সদস্যদের অদম্য দেশপ্রেম, সুউচ্চ পেশাগত জ্ঞান ও একনিষ্ঠতার ফলে এমন ঝুঁকিবহুল অপারেশনগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। এ দুটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সফল আক্রমণের পর দিন ভোরে বেজে ওঠে মিত্রবাহিনীর রণদামামা। মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সার্থকভাবে পরিচালিত বাংলাদেশি বৈমানিকদের এ দুটো বিমান হামলা পরবর্তী মাত্র ১২ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনকে ত্বরান্বিত করে। এই ১২ দিনের মধ্যে অ্যালুয়েট এবং অটার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বহু অভিযান পরিচালিত করে। সে অভিযানগুলো কুমিল্লা এবং সিলেট এলাকায় পলায়নমুখী পাকিস্তানি সৈন্যদের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঢাকা অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যালুয়েটের ক্রুরা তাঁদের ঘাঁটি কৈলাশহর থেকে আগরতলায় সরিয়ে নিয়ে আসেন। আগরতলা থেকে তাঁরা কুমিল্লা, নরসিংদী, দাউদকান্দি এবং অন্যত্র পশ্চাদপসরণের কালে পাকিস্তানিদের ওপর বহু আক্রমণ পরিচালিত করেন। অভিযানগুলো পরিচালনার সময় হেলিকপ্টার বহুবার শত্রুর বুলেটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর অনেকগুলোই ছিল মূল রোটর ব্লেডে। সেসব বিপজ্জনক আঘাত থেকে হেলিকপ্টার ও অটার ক্রুরা রক্ষা পান বলতে গেলে অলৌকিকভাবেই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভৈরব সেতুটি ধ্বংস করে দিলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অগ্রাভিযান নদীর ওপারে থমকে যায়, তারা ছত্রীসেনা অবতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ ধরনের একটি অভিযানে পাকিস্তানি আক্রমণে ভারতীয় এক বৈমানিক তাঁর আক্রান্ত বিমান থেকে নরসিংদীতে ‘বেল আউট’ করতে বাধ্য হন। ভারতীয় এই বৈমানিককে উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাহায্য কামনা করা হয়। তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এগিয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত ওই ভারতীয় বৈমানিককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রাজাকাররা ওই বৈমানিককে আটক এবং পরে হত্যা করে।

মাত্র ১২ দিনের ব্যাপ্তিকালে আমাদের বিমানসেনারা চল্লিশটির মতো হাওয়াই অভিযান পরিচালনা করেন। মাত্র দুটি উড়োজাহাজের সাহায্যে এতগুলো আক্রমণ পরিচালনা করতে পারা ছিল সত্যিই এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। এই বিরামহীন আক্রমণের সময় তাদের ভারতীয় বিমানবাহিনীকেও কখনো কখনো সাহায্য করতে হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপরিচিত জায়গায় (পথপ্রদর্শকের ভূমিকা এবং উদ্ধার অভিযানের জন্য) ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশে বিমানবাহিনীর সহায়তা নিত। ১২ দিনের যুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী সিলেট, শায়েস্তাগঞ্জ, শমসেরনগর, মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, নরসিংদী, রায়পুরা, কুমিল্লা, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দাউদকান্দি, ইলিয়টগঞ্জ, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও প্রভৃতি স্থানে সফলতার সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করে।

এখানে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে যুদ্ধের শুরুতেই তেজগাঁও বিমানবন্দরটি ব্যবহারের অনুপযোগী করে দেওয়া হয়েছিল। এ সময় বিমানবন্দরে হেলিকপ্টার ছাড়া আর কোনো বিমান অবতরণ করা সম্ভব ছিল না। ভারতীয় ফিক্সড উইং বিমান তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে মেরামত করার পর এখানে অবতরণ শুরু করেছিল। কিন্তু ফ্লাইং অফিসার শামসুল আলম তাঁর ফিক্সড উইং অটার বিমানটির সাহায্যে খুব ঝুঁকি নিয়ে ১৭ ডিসেম্বরই তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের হাতে রানওয়ে আর ঘাঁটি এলাকাকে বোমা ও মাইনমুক্ত করেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে পরিষ্কার করেন এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক নেতাদের প্রবাস থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করেন।

নানা সীমাবদ্ধতা, যুদ্ধের সাজসরঞ্জামের অপ্রতুলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক দীনতা থাকলেও বিমানসেনাদের প্রবল মনোবল ও অসীম সাহস তাঁদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ছিল। তাঁদের এ দৃঢ়তার পেছনে ছিল মরণপণ দেশপ্রেম।

বিরল ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অটল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এসব বিমানসেনা ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। এঁদের অতুলনীয় সাহস, অগাধ আত্মবিশ্বাস এবং ইমানের দৃঢ়তার কাছে অস্ত্র ও সাজসরঞ্জামের অভাব আদৌ কোনো বাধা হতে পারেনি।

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র বিমানবাহিনী ছিল। এই বাহিনীর মাত্র দুটি যুদ্ধবিমান ছিল আর তৃতীয় বিমানটি ছিল একটি পরিবহন বিমান। এই দুটি বিমান দিয়েই ৩ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ দিনে বহু অভিযান পরিচালনা করা হয়। অটারের সাহায্যে শেষ বিমান আক্রমণটি করা হয়েছিল ১২ ডিসেম্বর। কার্যত এরপর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আর কোনো অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন হয়নি। সুনির্দিষ্টভাবে অভিযানের সংখ্যা আমার মনে নেই, তবে দিনে আমরা চারপাঁচটি করে অভিযান পরিচালনা করেছি। আমাদের একেকটি সফল আক্রমণে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী দিশাহারা হয়ে পড়ত আর মুক্তিযোদ্ধারা হতো অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপ্ত।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন