পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষপাতী ছিল না। সংগত কারণে তারা সত্তর সালের নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করেনি। তারা এই ফলাফল মেনে নিলে বাঙালিরা ক্ষমতায় আসবে এবং ছয় দফা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে। এটি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অপরিসীম ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। সুতরাং, বাঙালির দাবিকে তারা কোনোভাবেই কার্যকর করতে প্রস্তুত ছিল না। পাকিস্তানিদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই আমার মনে সন্দেহ হয় যে, পাকিস্তানিরা আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এই কারণে তারা গোপনে প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতে শুরু করে। আমার সন্দেহের বিষয়টি আমি আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়মিত অবহিত করতাম। তাঁদের বলতাম, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, তারা একটি অশুভ ও খারাপ লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। মার্চ মাসের প্রথম থেকেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে, রাজনৈতিক সমাধানের নামে আমরা কোনো মরীচিকার পেছনে ছুটছি কি না। চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে পাকিস্তানিদের কর্মকাণ্ড স্পষ্টতই প্রমাণ করছিল যে তারা আন্তরিক নয়। আমার এই সন্দেহ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও ঘনীভূত হচ্ছিল। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে অপ্রস্তুত ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। মুক্তিযুদ্ধ হবে এবং এতে আমি অংশগ্রহণ করব, এমন ভাবনা আমি প্রথম থেকেই লালন করছিলাম। কিন্তু আগে উল্লেখিত ২৭ মার্চে নাখালপাড়ার মর্মান্তিক ঘটনা ও পাকিস্তানি জুনিয়র অফিসারের মন্তব্যের পর কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকি।
আমি ঢাকায় সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ছিলাম। আমার পদবির কারণে আমি সব সময় বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকদের কাছে পৌঁছাতে পারতাম না এবং তাদের সঙ্গে সবকিছু নিয়ে আলোচনাও করতে পারতাম না। এ বিষয়ে আমি উইং কমান্ডার এম কে বাশারসহ কয়েকজনকে বিশ্বাস করতাম এবং তাদের সাহায্য নিতাম। বাশার আমার ছাত্র ছিল, আমি তাকে ফ্লাইং শিখিয়েছি। সে আমাদের গোপন আলোচনার প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করত। সীমান্ত অতিক্রমের আগ পর্যন্ত আমি ঢাকায় ছিলাম। এই সময়ে আমি কোনো রাজনৈতিক নেতার খোঁজখবর পাইনি। সংগত কারণেই তাঁরা গা-ঢাকা দিয়েছিলেন কিংবা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই সময় তাঁদের কোনো রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা দেখা যায়নি এবং তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব ছিল না। এই এক মাস আমি অফিসেও যাইনি। ইতিমধ্যে জেনে গেছি, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে জানতে পারছিলাম যে মুক্তিযুদ্ধে তারা সর্বাত্মক সাহায্যও করছে। আমাদের আলোচনায় বাশার ছাড়া ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজাও যোগ দিত। এসব গোপন আলোচনায় কীভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব এবং কীভাবে ভারতে যাব, তা প্রাধান্য পেত। বাশারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার কী মত?’ ও বলল, “আমি প্রস্তুত, স্যার।’ আমি বললাম, ‘প্রস্তুত হলেই তো হবে না। আমাদের যাওয়ার নিরাপদ পথ ও সময় ঠিক করতে হবে।’ আলোচনা শুরু হলো, কে কে যাব, কবে যাব, কোনো দিক দিয়ে যাব ইত্যাদি।
পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তান বিমানবাহিনী সম্পর্কে দু-একটি কথা উল্লেখ করছি। ১৯৭১ সালের আগে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র দুটি এয়ারবেস ছিল—একটি ঢাকায় এবং অপরটি চট্টগ্রামে। এ ছাড়া বিমান ওঠানামার জন্য আরও কয়েকটি বিমানবন্দর ছিল, যা মূলত বেসামরিক বিমান চলাচলে ব্যবহৃত হতো। ঢাকায় তখন এক স্কোয়াড্রন জঙ্গি বিমান ছিল। আর ছিল কয়েকটা পরিবহন বিমান। সেনাবাহিনীর একটা অ্যাভিয়েশন স্কোয়াড্রন ছিল, যা তারা নিজেরা পরিচালনা করত। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বিমানবাহিনীর প্রায় ১ হাজার ২০০ সদস্য ছিল, যার অর্ধেকের কিছু বেশি ছিল বাঙালি।
সম্ভবত ১৯৬৯ কিংবা ১৯৭০ সালের মাঝামাঝিতে বেসামরিক বৈমানিকেরা ‘ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইনস পাইলট ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পাকিস্তান সরকার এই উদ্যোগে কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিল না। বাঙালি বৈমানিকেরা আদালতের আশ্রয় নেন। আদালত তাঁদের পক্ষে রায় দেন। আমার ধারণা যে বেসামরিক বৈমানিকেরা ভবিষ্যতে পরিস্থিতি যে খুব বেশি ভালো থাকবে না বা বাঙালির অনুকূলে থাকবে না, তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যাতে সরকারের সব কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ ও সরকারের কাছে বৈমানিকদের দাবিগুলো উপস্থাপন করা যায়। দেশে প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে পাইলটদের যেন বহিষ্কার করতে না পারে, তা-ও লক্ষ রাখা এ সংগঠনের একটি উদ্দেশ্য হতে পারে। বেসামরিক বৈমানিকদের আলোচনাগুলো হতো ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইনস পাইলট ফোরামের অফিসে। অফিসটি ছিল ঢাকার তেজকুনি পাড়া আওলাদ হোসেন মার্কেটের কাছে। কখনো-বা আলোচনা হতো তাঁদের কারও বাড়িতে। আমি বাঙালি বেসামরিক বৈমানিকদের কথা এ জন্য বর্ণনা করলাম যে পরবর্তী সময়ে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয় এবং বিমানবাহিনী গঠনে আমাকে সাহায্য করে।
অপর পক্ষে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বাঙালি সামরিক অফিসারদের মধ্যে আমি, উইং কমান্ডার বাশার, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আলোচনার জন্য বেছে নিতাম বিভিন্ন চায়নিজ রেস্তোরাঁ বা পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান। আমাদের গোপন আলোচনার বিষয়গুলো আমরা অন্য সমমনা বাঙালি বৈমানিকদেরও অবহিত করতাম। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ (বীর উত্তম, পরে এয়ারভাইস মার্শাল ও বিমানবাহিনীর প্রধান), ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম সদর উদ্দিন (বীর প্রতীক, পরে এয়ারভাইস মার্শাল ও বিমানবাহিনীর প্রধান), ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নুরুল কাদের (পরে স্কোয়াড্রন লিডার)। এ সময় জানতে পারলাম, কিছু কিছু জায়গায় বাঙালিরা সীমান্তের কাছাকাছি গিয়ে কিংবা কিছু স্থানে সীমান্ত অতিক্রম করে একত্র হওয়ার চেষ্টা করছে, যাতে তারা যুদ্ধ করতে পারে।
২৮ মার্চ আমি দুই সপ্তাহ ছুটির জন্য আবেদন করি এবং যুদ্ধের এ পরিস্থিতিতেও কর্তৃপক্ষ আমার এত লম্বা ছুটি মঞ্জুর করে। কারণ, পাকিস্তানিরা চাইছিল যে অফিসে ওরা কী করছে এবং ওদের কী পরিকল্পনা, এসব গোপনীয় বিষয় যাতে আমরা জানতে না পারি। আমার জ্যেষ্ঠতার কারণে, আমি অফিসে থাকলে স্বভাবত ওদের সব খবর আমি জানব। সে জন্য যখন আমি নিজে থেকে ছুটির আবেদন করলাম, তখন তারা খুব খুশিমনে ছুটি মঞ্জুর করে দেয়। ছুটির ১৫ দিন আমি আমার কার্যালয় কিংবা ক্যান্টনমেন্টে যাইনি। আমি তাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে চাইনি। এতে ওরা আমাকে সন্দেহ করতে পারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করে দিতে পারে। আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিলে আমার আর ফিরে আসা হবে না এবং যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না। এ সময় তারা বিবৃতি দিত, ‘আমরা দেশের বন্ধু, দেশের পরিবেশ শান্ত আছে।’ রেডিও, টেলিভিশনে সারাক্ষণ এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণা চালাত। কখনো একটি দোকানকে জোর করে খুলিয়ে টিভিতে প্রচার করত, ‘এই তো সব দোকান খোলা। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।’ সরকারের এসব কর্মকাণ্ড আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম। বুঝতে পারতাম, দেশের মানুষ এদের শাসন সমর্থন করছে না। আমরা যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি, তার সংগত কারণ আছে। প্রায় সময়েই আমরা যুদ্ধে যাওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা করতাম।
২৮ বা ২৯ মার্চ আমরা দেশত্যাগের প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করি। আমার পুরো পরিবার, আমার স্ত্রীর বড় বোন ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মারগুবের পরিবারসহ আমরা সবাই সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য ডেমরা থেকে শীতলক্ষ্যা নদী ধরে নৌকায় রওনা হই। পথে রাত হয়ে গেলে আমরা মারগুবের এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিই, জায়গাটার নাম এখন আর মনে নেই। পরদিন সকালবেলা যাত্রা করে বিকেলের দিকে আমরা ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের ট্যাঙ্গাবর নামের একটি জায়গার কাছাকাছি এলে চরে ধাক্কা লেগে আমাদের নৌকার পাটাতন ছিদ্র হয়ে যায় এবং নৌকায় পানি উঠতে থাকে। আমরা ট্যাঙ্গাবরে থেমে যাই। এ সময় স্থানীয় অনেক লোক সাহায্যের জন্য আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। আমি লোকগুলোর চালচলন দেখে ভরসা পেলাম না। এদের ওপর বিশ্বাস হলো না আমার। এতগুলো পরিবার নিয়ে এদের আশ্রয়ে রাতে কি নিরাপদে থাকতে পারব? আমার মন সায় দিচ্ছিল না। তাই এখানে আমাদের নৌকা মেরামত করে পুনরায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। নৌকার পাটাতন ছিদ্র হওয়ার পরই মারগুবের বোন, ভাই, বাবা ট্যাঙ্গাবর থেকে সীমান্ত অতিক্রমের উদ্দেশ্যে চলে যায়। পরে জানতে পারি, তারা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেনি। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মারগুবকে পরে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করে দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশে ফেরত আসে। ১৯৭২ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় মারগুব নিহত হয়।
ট্যাঙ্গাবর থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বেশ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে আমরা টোক নামের একটি জায়গায় নদীর কিনারে এসে নৌকা নোঙর করি। অন্য বড় বড় নৌকার মাঝখানে আমাদের ছোট্ট নৌকাটি রাখি, যাতে ঝড়ে ডুবে না যায়। এখান থেকে নৌকার মাঝির সঙ্গে কর্দমাক্ত পথে আমরা এক অজানা পথে হাঁটতে শুরু করি। রাত ১১টা নাগাদ আমরা কাঞ্চন নামক এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাসায় পৌঁছাই। মাঝি চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার, এই লোকটি ভালো। তাঁকে আমি জানি। আপনারা রাতটা এখানে থাকতে পারেন।’
আমরা ওই রাতে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। লোকটি খুবই চমৎকার ছিলেন। তিনি আমাদের একটি ছোট্ট ঘরের অর্ধেক ছেড়ে দিলেন। আমরা সবাই খিচুড়ি খেয়ে ওই ছোট্ট ঘরটিতে ঘুমিয়ে পড়ি। এই বাড়িতে আমার পরিবার ছাড়াও ঢাকা থেকে আসা আরও অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা সম্ভবত আগে এসেছিল। পরদিনও আমরা ওই বাড়িতে ছিলাম। আমি চারদিকের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রমের কোনো বন্দোবস্ত করা যায় কি না, কিংবা কোন পথে আমাদের যাওয়াটা নিরাপদ হবে, তা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। লক্ষ করলাম, কেউ কোনো দিকে যাচ্ছে না। তাই তৃতীয় দিন ঠিক করলাম, আমরা ঢাকায় ফিরে যাব এবং ঢাকায় এসে ভালো করে জেনে-বুঝে পুনরায় সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করব। এদিন সকালে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। ফেরার পথে নৌকায় নদী পার হওয়ার সময় খুব সাবধানে থাকি। কারণ, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা ছিল। নদী পার হয়ে ঘাটে এসে দেখি, একটি বাস দাঁড়ানো অবস্থায় আছে। আমরা ওই বাসে করে আজিমপুরে আমার স্ত্রীর বোনের বাসায় গিয়ে উঠলাম।
প্রথমবার পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমি ১৮ বা ১৯ এপ্রিলে অফিসে এসে যোগদান করি। গিয়ে দেখি, আমার স্থলে অন্য একজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন বদলি হয়ে এসেছে পাকিস্তান থেকে। জানতে পারলাম, তখনো আমার কোথাও বদলি হয়নি, কিংবা তারা আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ-ও বলেনি যে আমার জায়গায় আরেকজন অফিসার এসেছে। ২৬ মার্চের পর এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন বাঙালিকে বহাল রাখা সম্ভবপর ছিল না, তা আমি নিজেও বুঝতাম। অফিসে এসে পুনরায় যোগদান করেছি সত্য, কিন্তু অফিসে তেমন যেতাম না। কদাচিৎ গেলেও বসতাম অন্য রুমে। আমার রুমে বসত পাকিস্তান থেকে আসা নতুন গ্রুপ ক্যাপ্টেন। অফিসে কোনো কাজ করতাম না। যখন ওদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার প্রয়োজন হতো, তখন দেখতাম ওরা বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব অস্বস্তিবোধ করতাম।
আমি আজিমপুরে থাকা অবস্থায় ওরা আমাকে ফোন করলে আমি আমার সত্যিকার ঠিকানা দিতাম না, বলতাম, আমি ধানমন্ডিতে থাকি। আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলে ওরা যেন আমাকে সহজে খুঁজে না পায়। চাকরিতে যোগদান করার দিন দশেকের মধ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল এ রহিম খান ঢাকায় আসেন। তিনি আসার পর আমি আবার ছুটির দরখাস্ত করি। আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আমি ক’দিনের ছুটি চাই? আমি বললাম যে আমার কমপক্ষে তিন মাসের ছুটি লাগবে। তারা আমার ছুটি অনুমোদন করল। ছুটিতে আমি আজিমপুরে আমার স্ত্রীর বোনের বাসাতেই বেশির ভাগ সময় থাকতাম। মাঝেমধ্যে এক-আধ দিনের জন্য অন্য বাসায় থাকতাম। ওখান থেকে অন্যান্য বাঙালি অফিসার, যেমন উইং কমান্ডার বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। এদের সঙ্গে সব সময় আমার সরাসরি কথা হতো না, অনেক ক্ষেত্রে আমি রেজার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। আমারা আবারও সীমান্ত পেরোনোর উদ্যোগ নিলাম এবং ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা বাঙালিদের অসন্তোষ বা মুক্তিযুদ্ধকে কোনো গুরুত্ব দিত না। মার্চ-এপ্রিল মাসের সাময়িক সাফল্যে তারা মনে করেছিল, বাঙালিরা আর কখনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না, মুক্তিযুদ্ধ তো অনেক দূরের কথা। এপ্রিল মাসে একদিন আমি মাঠে দাঁড়িয়ে আছি, সেই সময় এয়ারফোর্স ইন্টেলিজেন্সের চিফ আমাকে দেখে—যেহেতু আমি বাঙালি—একটু খোঁচা মেরে বলল, ‘আমি চট্টগ্রাম থেকে আসলাম, আগামী ২৫ বছর বাঙালি আর স্লোগান দেওয়ার সাহস পাবে না!’
আমরা আবার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করি এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। এবার আরিচা ফেরি পার হয়ে উত্তর বাংলা দিয়ে সীমান্ত পেরোনোর ইচ্ছা। সকাল ১০টার দিকে পরিবারসহ ঢাকা থেকে আরিচার পথে রওনা হই। আমাদের পরিকল্পনা ছিল পদ্মা নদী পার হয়ে রাজশাহী দিয়ে সীমান্ত পার হব। আরিচা যাওয়ার পথে অনেক পথচারী আমাদের সাবধান করে দেয়। তারা বলে, ‘আপনারা আরিচা যাবেন না। আরিচায় অনেক পাকিস্তানি সেনা টহল দিচ্ছে।’
আরিচা পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়। আরিচা যাওয়ার পথে কোনো ব্রিজ ছিল না, বেশ কয়েকটি ফেরি পার হতে হতো। আরিচা পৌঁছে দেখি সেখানে প্রচুর পাকিস্তানি সেনা টহল দিচ্ছে। আরিচা ঘাট পেরোনো প্রায় অসম্ভব। এবারও সীমান্ত অতিক্রম করার উদ্যোগ সফল হলো না। আবার ঢাকায় ফিরে আসতে হলো।
ফিরে এলাম বটে, তবে আমাদের মধ্যে নতুন করে আবারও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সলাপরামর্শ শুরু হয়। আমাদের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, আমরা সবাই একসঙ্গে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেব না, বরং আলাদা আলাদাভাবে সীমান্ত অতিক্রম করব। ধরা পড়লে যাতে পাকিস্তানিরা আমাদের সবাইকে একসঙ্গে না পায়, অন্তত একটি অংশ যেন সীমান্ত অতিক্রম করে যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। আমরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কোন পথ নিরাপদ হবে বা কোন পথ দিয়ে আমরা সীমান্ত অতিক্রম করব, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়। সীমান্ত পেরোনোর নিরাপদ পথ খুঁজে বের করা আর সরেজমিনে তা পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নুরুল কাদেরকে পাঠালাম। ও ফিরে আসার পর আমরা সবাই তার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে যাত্রা করব।
নুরুল কাদের প্রথমে আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। এরপর সে আমাদের নেওয়ার জন্য ঢাকা রওনা দেয়। পথে সে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আটক হয়। সৌভাগ্যবশত সে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানিদের হাত থেকে ছাড়া পায়। নুরুল কাদের ঢাকায় এসে আমাদের জানায়, ‘পথ পরিষ্কার আছে। আমরা যেতে পারব।’ আমি বেশিসংখ্যক জঙ্গি বৈমানিক সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করি। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে বিমানবাহিনী গড়ে উঠলে এরা বৈমানিক হিসেবে কাজ করতে পারবে। ফলে আমার পরিকল্পনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত হয়েছিল, তারা সবাই বৈমানিক ছিল এবং প্রত্যেকেরই যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা ছিল।
দেশ ত্যাগের জন্য তৃতীয় ও শেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করি ১২ মে। আমরা সকালে দুটো গ্রুপে রওনা হই। সিদ্ধান্ত ছিল, ঢাকা থেকে প্রথমে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে ঘোড়াশালে পাটের মিলে উঠব। সেখানে গিয়ে ঠিক করব কোথায় যাব। পাটের মিল বেছে নেওয়ার কারণ, জুট করপোরেশনে চাকরির সুবাদে এখানকার মিলগুলোতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজার কর্তৃত্ব ছিল। রেজা এখানে আমাদের এক বা দুই দিন আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিতে পারবে। কিন্তু এই পথ দিয়ে আমরা যেতে পারিনি। কারণ, নরসিংদী বাজারের কাছে পৌঁছে শুনি, পাকিস্তানি সেনারা বাজারটি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমাদের পথপ্রদর্শক সুরাত আলী বলল, ‘এই পথ দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। অন্য পথ দিয়ে যেতে হবে।’
সুরাত আলী আগে সৈনিক ছিল এবং যুদ্ধের আগে সে রেজার অধীনে জুট মিলে চাকরি করত। আমরা কুমিল্লা হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য রওনা হই। রাতে কোনো এক গ্রামে আশ্রয় নিই। সকালে খাওয়াদাওয়া সেরে সীমান্তের উদ্দেশে যাত্রা করি। একটা খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় পার্শ্ববর্তী সড়কে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ির একটি বিশাল বহর দেখতে পাই। দেখেই সবাই ধানখেতের আলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ি। আমার পরিবার, রেজার পরিবার, বাশারের পরিবার, বদরুল আলম, সুরাত আলীসহ আমরা সম্ভবত সতেরো জনের একটি দল ছিলাম। আমি সবাইকে দৌড়াদৌড়ি না করে স্থির ও স্বাভাবিক থাকতে বলি। পাকিস্তানি সেনাদলটি গাড়ির বহর থামিয়ে আমাদের কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে। তারপর চলে যায়। আমরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। পুনরায় সীমান্তের পথে অগ্রসর হই।
১৪ মে সন্ধ্যায় আমরা কালীর বাজার নামের একটি জায়গায় এসে পৌঁছাই। শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। কোথায় যাব, রাতে কোথায় থাকব, এ নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত। এ সময় ওই এলাকার একজন ডাক্তার এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে বলেন, ‘স্যার, এই লোককে জিজ্ঞেস করেন। তিনি আপনাদের জন্য কিছু করতে পারেন।’ তিনি একজন কৃষক। তিনি বললেন, ‘স্যার, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’ লোকটি আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। পথ ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। এদিকে বিরামহীন বৃষ্টি পড়ছে। আমরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজে গেছি। সারা দিন হাঁটার পর আমরা এমনিতেই খুব ক্লান্ত। কৃষকের বাড়ি পৌঁছাতে আরও দেড়-দুই মাইল হাঁটতে হলো।
কৃষকের ঘরের মেঝে খড় দিয়ে ঢাকা। সেখানে আমাদের বিশ্রামের জায়গা করে দেওয়া হলো। আমরা খুব ক্লান্ত আর দুর্বল ছিলাম। লোকটির পরিবারের সদস্যরা কোথায় থাকবে, তা জানার মতো অবস্থা আমাদের ছিল না। দরজাটা বন্ধ করে আমরা সবাই ওই মেঝেতে শুয়ে পড়ি এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি।
রাত দুইটার দিকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আমরা ঘুম থেকে উঠে বসলাম। সবাই আতঙ্কিত। ভাবছি পাকিস্তানি বাহিনী এসে গেছে। ঠিক করলাম, কিছুতেই দরজা খোলা যাবে না। একজন তো বলে ফেলল, ‘আমরা গুলি চালাব।’ আমি বললাম, আস্তে, ধৈর্য ধরো। সেনাবাহিনী এসে থাকলে কিছু করার নেই। দু-একটা গুলি চালিয়ে কিছু করা যাবে না। দরজা আমাদের খুলতেই হবে। বরং দরজা খুলে দেখি কে এসেছে।’
দরজা খুলে দেখা গেল সেই কৃষক। তিনি বললেন, ‘স্যার, আপনাদের জন্য অল্প খাবার তৈরি করেছি, আপনারা যদি খেয়ে নিতেন।’ আমাদের মধ্য থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘এখন খাব না। এখন আমরা ঘুমাব।’ আমি বললাম, ‘খেতে হবে। এই রাতে এত কষ্ট করে লোকটা আমাদের জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছে। তা না খেয়ে আমরা ঘুমাতে পারি না। আমাদের খেতে হবে।’ আমরা খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবার শুয়ে পড়লাম।
গরিব মানুষ, ছোট্ট একটি ঘর; সম্পদ বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই নেই। লোকটি এই রকমই নিঃস্ব ও দরিদ্র ছিলেন। তাঁর হয়তো একটি বা দুটি মুরগি ছিল। তার মধ্যে একটি জবাই করে গভীর রাতে রান্না করে আমাদের আপ্যায়ন করেছিলেন। যুদ্ধের সময় কলকাতায় এই লোকটির সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়। তখন তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানি সেনারা ওঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেবার আমি তাঁকে কিছু অর্থ দিয়েছিলাম। যুদ্ধের পর আমি তাঁর খবর নেওয়ার জন্য বহু চেষ্টা করেছি। এমনকি ওই গ্রামেও লোক পাঠিয়েছি, কিন্তু তাঁর কোনো সন্ধান পাইনি। দেশের জন্য এ ধরনের সবকিছু উজাড় করে দেওয়া মানুষগুলোর কোনো খবর কি আমরা রাখি? তাঁরা কি স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পারছে? মাঝেমধ্যে নিজেকে এ ধরনের প্রশ্ন করি, কিন্তু কোনো জবাব পাই না। দেশের জন্য সব ত্যাগ করা এই লোকগুলো প্রতিদানের আশায় কখনো কারও কাছে যাননি। তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে দেশকে ভালোবেসেছেন আর তাঁদের সামান্য যা ছিল, তা দেশের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। আমি এ ধরনের দেশপ্রেমিককে জানাই সালাম।
যাহোক, ১৫ মে সকাল ১০টায় আমরা সবাই নিরাপদে আগরতলার কাছাকাছি মতিনগর বিএসএফ ক্যাম্পে পৌঁছালাম। প্রাথমিকভাবে সেখানে আমরা কেউ আমাদের সত্যিকার পরিচয় দিইনি বা আমরা যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোক, তা বলিনি। সেখানে আমরা ছদ্মনাম ব্যবহার করি এবং নিজেদের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিই। আমি নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম কাপড়ের ব্যবসায়ী হিসেবে। অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ হয়ে যায় এবং আমাদের পরিচয় প্রকাশ পায়। ওখানে মেজর খালেদ মোশাররফসহ কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমরা সেখানে রাজনীতিক তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ বাহিনী বা মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুর রবের (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) দেখা পাই।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব আগরতলায় সর্বজ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে প্রথম দিকে তিনি আমাদের সবার সঙ্গে দেখা করতে অনীহা প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে উইং কমান্ডার বাশারের চাপে তিনি আমাদের সাক্ষাৎ দিতে রাজি হন। যত দূর মনে পড়ে, ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন মেহবুবুর রহমানও (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) সেখানে উপস্থিত ছিল। এরপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা আমাদের নাম কী, আমরা কী করি, আমাদের সঙ্গে কোনো অস্ত্রশস্ত্র আছে কি না ইত্যাদি কিছু মামুলি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। আমরা সবাই সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করি। এরপর আমরা আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের নাম লেখাই। আমাদের সবার থাকার ব্যবস্থা করা হয় আগরতলা ডাকবাংলোয়।
এদিন, অর্থাৎ ১৫ মে রাতে হঠাৎ জানতে পারি, এক লোক আমাকে খুঁজছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, পরের দিন আমাকে ভারতীয় জেনারেল কালকাৎ সিংয়ের সঙ্গে কলকাতায় যেতে হবে। ১৬ মে খুব ভোরে আমি আগরতলা বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হই। সেখানে কালকাৎ সিং ও ২ নম্বর সেক্টরের মেজর শাফায়াত জামিলের (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল) সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। কিছু সময় পর একটি ডিসি থ্রি বিমানে আমরা তিনজন কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করি। সন্ধ্যা হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছাই। আমি আর শাফায়াত জামিল একটি ছোট্ট হোটেলে যাই। হোটেলে আমাদের একটি ছোট কক্ষ দেওয়া হয়। সেই কক্ষে মাত্র একটি খাট। শাফায়াত জামিল আমার চেয়ে বয়সে ছোট এবং পদবিতেও কনিষ্ঠ ছিল। সে আমাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত। তাই সে বিনয়ের সঙ্গে আমাকে বলল, “স্যার, আপনি খাটে থাকেন, আমি নিচে থাকি।’ বিকল্প না থাকায় এভাবেই ওই রাতে সে নিচে থাকে।
পরদিন ১৭ মে আমরা বালিগঞ্জে যাই। সেখানে বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক এবং কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করি। বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয় থিয়েটার রোডে স্থানান্তর হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের কর্মকাণ্ড এখান থেকে পরিচালিত হয়েছিল। সেদিন তাজউদ্দীন সাহেব আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করেন। আমি তাঁকে বলি, ‘স্যার, আমরা বিমানবাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একসঙ্গে ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছি। আমরা সবাই দক্ষ বৈমানিক; অনেকের যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। আমাদের অনেক এয়ারম্যানও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, যারা প্লেন রক্ষণাবেক্ষণে অভিজ্ঞ। আমাদের সবার উদ্দেশ্য হলো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। যদিও আমরা বৈমানিক, তবে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যে কাজ দেওয়া হবে, আমরা সে কাজই করব। বর্তমান সময়ে যেকোনো যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে শেষ পর্যন্ত বিমানযুদ্ধ আবশ্যক হয়ে পড়ে। বিমানবাহিনী ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ করাটা কঠিন। তাই আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধেও একদিন না একদিন বিমান ও বৈমানিকদের প্রয়োজন হবেই। সেই সময় যদি আমাদের নিজস্ব কিছু বিমান থাকে এবং একটি এয়ারফিল্ড পাওয়া যায়, তাহলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারব।’ সাক্ষাতের সময় আমি এভাবেই তাঁকে কিছু জঙ্গি বিমান সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তার কথা বলি। তাজউদ্দীন সাহেব আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলেন এবং বললেন, ‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’
একটু আগেই উল্লেখ করেছি, ভারতে কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে ১৭ মে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। কর্নেল ওসমানীকেও ঢাকার পরিস্থিতি, স্বতন্ত্র বিমানবাহিনী ও বিমানযুদ্ধ সম্পর্কে আমার পরিকল্পনার কথা বলেছিলাম। আমি ওসমানী সাহেবকে বলি, ‘এই অবস্থায় যদি কিছু বিমান পাই, তাহলে আমরা পাকিস্তানিদের সাংঘাতিক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলতে পারব।’ উনি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করলেও তখনই বিমান পাওয়া এবং এই উদ্যোগ কার্যকর করা যে সম্ভব নয়, তা উল্লেখ করেন। আমি নিজেও জানতাম যে এত তাড়াতাড়ি বিমান পাওয়া সম্ভব নয়, তবে বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের অবহিত করাটা আমার খুব জরুরি মনে হয়েছিল।
কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরে যে দৃশ্য দেখলাম, তা আমাকে একটু অবাকই করল। এটা তো সত্যি যে, আমরা একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি এবং সেই যুদ্ধ জয়ের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও দৃঢ় সংকল্পের প্রয়োজন। অথচ অস্থায়ী সরকারের মধ্যে আমি সেসবের সাংঘাতিক অভাব লক্ষ করলাম। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, অথচ যুদ্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই। আরও দেখলাম, একই বিষয় নিয়ে সবাই যে যার মতো আলোচনা করছেন। বাঙালির জীবন-মরণ সমস্যা তাঁদের কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। কর্নেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাকে পরিষ্কারভাবে তেমন কিছু বলেননি। কতজন বাঙালি সৈনিক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, কতজন মুক্তিযোদ্ধা নতুনভাবে যোগ দিয়েছে, কতজন প্রশিক্ষণ নিচ্ছে প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে তিনি আমাকে একটি কথাও বলেননি। আমার মনে হলো, তখন পর্যন্ত আমাদের ওপর তাঁর সন্দেহ দূর হয়নি। তিনি হয়তো ধারণা করছিলেন যে আমরা পাকিস্তানের চর হয়ে এসেছি। যদিও আমার সঙ্গে কর্নেল ওসমানীর বহুদিনের পরিচয়। তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেনজানতেন। তবু আমাকে তিনি কিছু বলেননি। আবার এ-ও হতে পারে যে, তিনি নিজেও পুরো বিষয়টি ভালোভাবে জানতেন না। ফলে সে সময় আমি যুদ্ধের সম্পূর্ণ চিত্রটা পাইনি। এরই মধ্যে ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল খারা আমাকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন।
কলকাতায় দুই দিন থাকার পর কর্নেল ওসমানী বলেন, ভারতীয় বিভিন্ন বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে আমাকে দিল্লি যেতে হবে। আমি কলকাতায় আসার পর সম্ভবত আমার উপস্থিতি সম্পর্কে দিল্লিতে খবর পাঠানো হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন বাদামি আমাকে দিল্লি নিয়ে যেতে কলকাতায় আসেন। ২০ কিংবা ২১ মে বাদামির সঙ্গে আমাকে দিল্লি পাঠানো হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন বাদামি ভারতের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি তখন আমাকে কিছু বলেননি, আর আমিও আগ বাড়িয়ে তাঁর পরিচয় জানতে চাইনি। তাঁর পদবিটা আমি পরে জানতে পারি। দিল্লিতে গিয়ে বাদামি সাহেব একটা বিরাট বাংলোয় আমার থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে আমি একটা কামরায় একাই থাকতাম।
দিল্লিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের কর্মকর্তারা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন। তাঁরা পাকিস্তান বিমানবাহিনী সম্পর্কে জানতে চান। আমার অগোচরে আগরতলা থেকে উইং কমান্ডার বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নুরুল কাদেরকেও দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়। তাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে প্রশ্ন করা হয়। সম্ভবত তাঁরা আমার বিবৃতির সঙ্গে তাদের বিবৃতি মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। আমাদের আনুগত্য, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি পরীক্ষা এবং গোয়েন্দা-বিষয়ক সংবাদ গ্রহণের জন্য ভারতীয়রা এই কাজটি করে থাকতে পারে। তারা যখন দেখল, আমার বিবৃতির সঙ্গে তাদের বিবৃতির কোনো পার্থক্য নেই, তখন তারা আমাদের ওপর আস্থা আনতে পারল। আমি পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে ভারতে এসেছি এবং তাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কাজ করব, তাই আমাদের যাচাই-বাছাই করে নেওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। মূলত এ জন্যই আমাদের সবাইকে দিল্লি যেতে হয়েছিল।
দিল্লিতে আমাদের নিয়ে যাওয়ার পেছনে আমাদের উদ্দেশ্য যাচাই করা ছাড়াও এর সঙ্গে আরেকটি কারণ ছিল। সেটা হলো, পাকিস্তান সম্পর্কে আমাদের কাছ থেকে যতটা সম্ভব বিভিন্ন তথ্য জেনে নেওয়া। দিল্লিতে থাকা অবস্থায় ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা আমাদের কাছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা সম্পর্কে জানতে চান। যেমন পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর অফিসগুলো কোথায়, বিমানগুলো কোথায় রাখা হয় ইত্যাদি। আমরা যারা সামরিক বাহিনীর লোক ভারতে গিয়েছিলাম, তারা ভারতীয় বাহিনীকে পাকিস্তানিদের সম্পর্কে যতটা সামরিক তথ্য দিয়েছি, ভারত তা পঞ্চাশ বছরেও জানতে পারত না। এ ছাড়া আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর সত্যিকার চিত্র, অর্থাৎ তাদের দক্ষতা, ভারত সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনা ও যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে ভারতীয়দের তথ্য দিয়েছিলাম। যুদ্ধের সময় গোয়েন্দা তথ্য খুব বেশি দরকার হয়। এমনকি তারা পরিষ্কারভাবে জিজ্ঞেস করত, ‘আমরা যদি পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করি, তবে তার প্রতিক্রিয়া কীরূপ হবে।’ একটি অফিসে ২০-৩০ বছর চাকরি করলে অফিসের কর্মকর্তাদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটা জানা যায়। শত্রু বাহিনীকে কাবু করার জন্য এ ধরনের তথ্য ভীষণ জরুরি। আমার মনে হয়, আমাদের প্রদত্ত তথ্য ভারতীয় বাহিনীকে যুদ্ধকৌশল অবলম্বনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। আলোচনার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর দুর্বল দিক এবং কীভাবে সহজে দ্রুত বাংলাদেশকে স্বাধীন করা যায়, তা ভারতীয়রা আমাদের লিখিত আকারে উপস্থাপন করতে বলে। আমরা তা-ই করলাম।
দিল্লিতে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের ধ্যানধারণা বা চিন্তাভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়। আলোচনার সময় বলি যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য এসেছি, তাই যুদ্ধের জন্য আমরা যেকোনো কাজ করতে প্রস্তুত। আমরা যদি যুদ্ধ করি, তাহলে কোন পরিকল্পনায় যুদ্ধ করব, তারও একটি খসড়া ভারতীয়রা আমাদের কাছে চেয়েছিল, যা আমরা দিয়েছিলাম। দিল্লিতে আমি ভারতীয় বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে মুক্তিবাহিনী, মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত বিষয় এবং বিমানবাহিনী গঠন সম্পর্কে আলোচনা করি। আমরা তুলনামূলকভাবে বেশিসংখ্যক জঙ্গি বিমানের বৈমানিক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম, তাই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু জঙ্গি বিমান প্রদানের কথা বলেছিলাম।
দিল্লিতে আমার সঙ্গে উচ্চপদস্থ যেসব সামরিক কর্মকর্তার কথা হয়, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডিরেক্টর অব এয়ার ইন্টেলিজেন্স, ডিরেক্টর অব এয়ার অপারেশন্স, ডিরেক্টর অব নেভাল ইন্টেলিজেন্স, ডিরেক্টর অব আর্মি ইন্টেলিজেন্স প্রমুখ। অশোক রায় নামে একজন ভারতীয়ের সঙ্গে সেখানে আলাপ হয়। তিনি সম্ভবত ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারি, তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ে দেখাশোনা করছেন। অশোক রায়ের সঙ্গে বিদেশি সাহায্য কতটা পাওয়া যেতে পারে এবং ভারতীয়রা কতটা সাহায্য করতে পারে, সে বিষয়ে আমার আলোচনা হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় ভারত সরকারের মনোভাব জানা সম্ভব ছিল না। তবু দিল্লিতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন কর্তাব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করে এবং সেখানকার সার্বিক পরিবেশ দেখে আমার মনে হয়েছিল, ভারতীয়রা আমাদের পক্ষে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কি না, কিংবা আমাদের কতটুকু সহায়তা করবে ইত্যাদি বিষয়ে তখনো তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তার পরও আমার ধারণা হয়েছিল, ভারত সরকার এমন একটা পদক্ষেপ নেবে, যাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আর পাকিস্তান যাতে ভবিষ্যতে ভারতের জন্য শক্ত প্রতিপক্ষ বা বড় ধরনের হুমকি হতে না পারে, তা-ও এই সুযোগে সে নিশ্চিত করবে। প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে দুর্বল করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্যমান রাজনৈতিক বিষয়টি তাদের জন্য একটা সুযোগ, পাশাপাশি আরেকটা সুযোগ হলো বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার প্রশ্নে সহায়তা করা। দুটো সুযোগই একটা জায়গায় এসে মিলেছে। এই সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্নই আসে না। আমার ধারণা হয়েছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করা এবং বাংলাদেশ যাতে স্বাধীন হয়, সে সম্পর্কে একটা অলিখিত কিংবা বেসরকারি সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল।
দিল্লি সফরে আমি বুঝতে পারি, ভারত সরকার আমাদের যুদ্ধে সাহায্য করবে কি না, সেটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। এটা কোনো সামরিক সিদ্ধান্তের বিষয় ছিল না। সুতরাং, আমি এ বিষয়ে ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাদের কোনো পীড়াপীড়ি করিনি। বুঝতে পারছিলাম, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো ক্ষমতা তাঁদের নেই। তবে একটি বিষয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, যা আমি একটু আগেও বলেছি, ভারত সরকার যুদ্ধের বিষয়ে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত না নিলেও পাকিস্তানকে চিরদিনের জন্য দুর্বল করার যে সুযোগটা তাদের সামনে এসেছে, তা তারা হাতছাড়া করবে না। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে সাহায্য করার মাধ্যমে তারা একটি মানবিক দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
আমি সত্যি যুদ্ধ করতে এসেছি না পাকিস্তানের চর বা অন্যের চর হিসেবে এসেছি, সে ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, আমার কাছ থেকে পাকিস্তানের সামরিক তথ্য যত বেশি সম্ভব তারা জানার চেষ্টা করে। তৃতীয়ত, এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে কী কী করা সম্ভব, তা-ও তারা আমার কাছে জানার চেষ্টা করে।
আমি ১৮ মে থেকে কয়েক দিন দিল্লিতে ছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদের পর দিল্লিতে এম কে বাশার, সুলতান মাহমুদ আমার সঙ্গে যোগ দেয়। ওখান থেকে আমরা সবাই একত্রে রওনা দিয়ে ৩১ মে আগরতলায় এসে পৌঁছাই। সেখানে কিছুদিন থেকে ৪ জুন আমি আমার পরিবারসহ কলকাতায় চলে আসি। উইং কমান্ডার বাশারও তার পরিবারসহ আমাদের সঙ্গে কলকাতায় আসে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন বাদামিও প্রায় সর্বক্ষণ আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
কলকাতায় আসার পর লিটন হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন বাদামিই থাকার ব্যবস্থা করেন। এরপর আমি প্রতিদিন সকালে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সদর দপ্তর ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে যাওয়া শুরু করি। কর্নেল ওসমানী চাইতেন আমি যেন নিয়মিত সেখানে যাই এবং তাঁর সঙ্গে কার্যালয়ে বসি। এ সময় সবার মধ্যে একটা অনিশ্চিত ভাব ছিল। ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে কেউ জানত না। ভারত তখন পর্যন্ত আমাদের পর্যাপ্ত অস্ত্র দিচ্ছিল না। কর্নেল ওসমানী বলতেন, তাঁর বিশ্বাস, ইন্দিরা গান্ধী অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন। তার পরও যেহেতু আমরা অস্ত্র পাচ্ছি না, তাই সবার মতো কর্নেল ওসমানীর মধ্যেও মাঝেমধ্যে একটা হতাশার ভাব লক্ষ করেছি। আমি কলকাতায় গিয়ে দেখলাম, যোগাযোগব্যবস্থা, বিশেষ করে বেতার যোগাযোগের অভাবে সদর দপ্তর থেকে সেক্টর কিংবা সেক্টর কমান্ডারদের কাছে কোনো নির্দেশনা যায় না। সেক্টর কমান্ডারদের ওপর সদর দপ্তরের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাঁদের ভেতর কোনো ধরনের সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। কলকাতায় আসার পর থেকে আমি লক্ষ করেছি, যা সত্যের খাতিরে আমার বলা উচিত, অনেকে মুক্তিযুদ্ধকে সত্যিকারভাবে যুদ্ধ হিসেবে না নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা মনে করতেন। তাঁদের ধারণা ছিল, ভারত তো যুদ্ধে নামবেই এবং তারাই আমাদের হয়ে পাকিস্তানিদের উৎখাত করে দেবে। তাদের মধ্যে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার অভাব ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ লম্বা চুল-দাড়ি রেখে সৈনিক বুট পরে সিগারেট হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। এসব দৃশ্য আমাকে ভীষণ আহত করত। তাদের ভেতর পেশাদারির ছাপ ছিল না। অর্থাৎ, তাদের ভেতর যুদ্ধ করার কোনো একাগ্রতা ছিল না। এ ধরনের আচরণ আমি মূলত নেতৃত্ব পর্যায়ের কারও কারও মধ্যে লক্ষ করেছি, সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের আচরণ ছিল ভিন্ন।
হোটেলে কিছুদিন থাকার পর আমার স্ত্রী-সন্তানদের বাংলাদেশি উদ্বাস্তু ক্যাম্পের পাশে কল্যাণীতে একটি বাসায় পাঠিয়ে দিই। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের পরিবারগুলোর বসবাসের জন্য কল্যাণণীর আবাসিক এলাকায় এ ধরনের বেশ কয়েকটি বাড়ি বরাদ্দ করেছিল। আমি চলে আসি কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে। প্রথম দিকে কর্নেল ওসমানী ও আমি একই কামরায় থাকতাম। পরবর্তী সময়ে আমি অন্য কামরায় চলে যাই। এই কামরায় আমরা তিনজন থাকি। আমি ছাড়া এই কামরায় একজন ডাক্তার ও একজন অফিস সহকারী থাকতেন। মশার উপদ্রবে রাতে ঘুমানো যায় না। একসময় স্ত্রীকে একটি মশারি পাঠাতে বলতে বাধ্য হই। এখানে আরেকটা বড় সমস্যা, ঘুমালে শরীরের ওপর দিয়ে বড় বড় ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করে। কামরায় ছিল একটিমাত্র শৌচাগার। ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের অফিসের সমস্ত লোক এই শৌচাগার ব্যবহার করে। প্রতিদিন আমাদেরই শৌচাগারটি পরিষ্কার করতে হয়।
আমার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে কল্যাণীতে থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৮টি উদ্বাস্তু শিবির দেখাশোনা করতেন। সারাটা সময় নার্স হিসেবে উদ্বাস্তু শিশুদের সেবা ও শিক্ষা কার্যক্রম চালাতেন। এর জন্য তিনি কোনো সম্মানী নিতেন না। কলকাতা থেকে ক্যাম্পের দূরত্ব প্রায় ৪৬ মাইল। যুদ্ধ চলাকালে আমি পরিবারের সঙ্গে সাকল্যে মাত্র তিনবার সাক্ষাৎ করতে পেরেছি। এমনও হয়েছে, পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আর তখনই এমন একটি কাজ এল, রাত একটা পর্যন্ত অফিসেই থাকতে হলো। ফলে পরিবারের কাছে আর যাওয়া হলো না। এ জন্য আমার স্ত্রীর কোনো অভিযোগও ছিল না।
কলকাতায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে থাকি, কবে আমাকে যুদ্ধে পাঠানো হবে। কর্নেল ওসমানীকে বললাম, ‘স্যার, আমাদের কাজের সুযোগ করে দিন। বিমানবাহিনীতে ছিলাম বলে আমরা যুদ্ধে যেতে পারব না? ২১-২২ বছর পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে চাকরি করেছি, যুদ্ধও করেছি, অথচ স্বদেশের জন্য যুদ্ধে কোনো কাজই আমার নেই। একেবারে কাজ ছাড়া বসে থাকব, তা তো হয় না।’ দেখলাম, তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। আরও লক্ষ করলাম, বাংলাদেশ থেকে আসা সিএসপি অফিসার, শিক্ষক, ডাক্তার, ছাত্ররা যুদ্ধে যোগদান করতে চায়, কিন্তু তাদের নেওয়া হচ্ছে না।
এখানে প্রাসঙ্গিক না হলেও সেই সময়ে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। কলকাতায় গিয়ে একটা বিষয় জানতে আমার বেশ আগ্রহ হয়েছিল। সেটা হলো, ওখানকার মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কী ভাবছে বা শহরে কোনো প্রকার দেয়াললিখন কিংবা পোস্টার আছে কি না। আমি সত্যি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, বিভিন্ন জায়গায় বা বিভিন্ন দেয়ালে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অনেক কথা লেখা আছে। এতে আমার ধারণা হলো, সারা ভারতের কথা বলতে না পারলেও, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ স্বভাবত মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন