১১. বক-কচ্ছপ সংবাদ

জগদীশচন্দ্র বসু

মনে কর, দুই দল জন্তু মাঠে চরিতেছে– লম্বা জানোয়ার বক ও চেপ্‌টা জীব কচ্ছপ। সর্বমুখী অদৃশ্য আলোকও এইরূপ দুই প্রকারের স্পন্দনসঞ্জাত। দুই প্রকারের জীবদিগকে বাছিবার সহজ উপায়, সম্মুখে লোহার গরাদ খাড়াভাবে রাখিয়া দেওয়া। জন্তুদিগকে তাড়া করিলে লম্বা বক সহজেই পার হইয়া যাইবে; কিন্তু চাপ্‌টা কচ্ছপ গরাদের এ-পাশে থাকিবে। প্রথম বাধা পার হইবার পর বকবৃন্দের সম্মুখে যদি দ্বিতীয় গরাদ সমান্তরালভাবে ধরা যায়, তাহা হইলেও বক তাহা দিয়া গলিয়া যাইবে। কিন্তু দ্বিতীয় গরাদখানাকে যদি আড়ভাবে ধরা যায়, তাহা হইলে বক আটকাইয়া থাকিবে। এইরূপে একটি গরাদ অদৃশ্য আলোর সম্মুখে ধরিলে আলো একমুখী হইবে। দ্বিতীয় গরাদ সমান্তরালভাবে ধরিলে আলো উহার ভিতর দিয়াও যাইবে, তখন দ্বিতীয় গরাদটা আলোর পক্ষে স্বচ্ছ হইবে। কিন্তু দ্বিতীয় গরাদটা আড়ভাবে ধরিলে আলো যাইতে পারিবে না, তখন গরাদটা অস্বচ্ছ বলিয়া মনে হইবে। যদি আলো একমুখী হয় তাহা হইলে কোনো কোনো বস্তু একভাবে ধরিলে অস্বচ্ছ হইবে; কিন্তু ৯০ ডিগ্রি ঘুরাইয়া ধরিলে তাহার ভিতর দিয়া আলো যাইতে পারিবে। পুস্তকের পাতাগুলি গরাদের মতো সজ্জিত। বিলাতে রয়্যাল ইন্‌স্টিটিউসনে বক্তৃতা করিবার সময় টেবিলের উপর একখানা রেলের টাইম-টেব্‌ল, অর্থাৎ ব্রাড্‌শ ছিল, তাহাতে ১০ হাজার ট্রেনের সময়, রেল-ভাড়া এবং অন্যান্য বিষয় ক্ষুদ্র অক্ষরে মুদ্রিত ছিল। উহা এরূপ জটিল যে, কাহারও সাধ্য নাই ইহা হইতে জ্ঞাতব্য বিষয় বাহির করিতে পারে। আমি পুস্তকের তমসাচ্ছন্নতা কিছু না মনে করিয়া পরীক্ষার সময় দেখাইয়াছিলাম যে, বইখানাকে এরূপ করিয়া ধরিলে ইহার ভিতর দিয়া আলো যাইতে পারে না; কিন্তু ৯০ ডিগ্রি ঘুরাইয়া ধরিলে পুস্তকখানা একেবারে স্বচ্ছ হইয়া যায়। পরীক্ষা দেখাইবামাত্র হাসির রোলে হল্‌ প্রতিধ্বনিত হইল। প্রথম প্রথম রহস্য বুঝিতে পারি নাই। পরে বুঝিয়াছিলাম। লর্ড রেলী আসিয়া বলিলেন যে, ব্রাড্‌শর ভিতর দিয়া এ পর্যন্ত কেহ আলোক দেখিতে পায় নাই। কি করিয়া ধরিলে আলো দেখিতে পাওয়া যায়, ইহা শিখাইলে জগৎবাসী আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ রহিবে। আমার বৈজ্ঞানিক লেখা পড়িয়া কেহ কেহ স্তম্ভিত হইবেন, দন্তস্ফুট অথবা চক্ষুস্ফট করিতে সমর্থ হইবেন না। তাহা হইলে বইখানাকে ৯০ ডিগ্রি ঘুরাইয়া ধরিলেই সব তথ্য একবারে বিশদ হইবে।
আলো একমুখী করিবার অন্য এক উপায় আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। যদিও এলোমেলোভাবে আকাশস্পন্দন রমণীর কেশগুচ্ছ প্রবেশ করে, তথাপি বাহির হইবার সময় একবারে শৃঙ্খলিত হইয়া থাকে। বিলাতের নরসুন্দরদের দোকান হইতে বহু জাতির কেশগুচ্ছ সংগ্রহ করিয়াছিলাম। তাহার মধ্যে ফরাসী মহিলার নিবিড় কৃষ্ণকুন্তল বিশেষ কার্যকরী। এ বিষয়ে জার্মান মহিলার স্বর্ণাভ কুন্তল অনেকাংশে হীন। প্যারিসে যখন এই পরীক্ষা দেখাই তখন সমবেত ফরাসী পণ্ডিতমণ্ডলী এই নূতন তত্ত্ব দেখিয়া উল্লসিত হইয়াছিলেন। ইহাতে বৈরী জাতির উপর তাহাদের প্রাধান্য প্রমাণিত হইয়াছে, ইহার কোনো সন্দেহই রহিল না। বলা বাহুল্য, বার্লিনে এই পরীক্ষা প্রদর্শনে বিরত হইয়াছিলাম। যে সব পরীক্ষা বর্ণনা করিলাম তাহা হইতে দেখা যায় যে, দৃশ্য ও অদৃশ্য আলোর প্রস্তুতি একই. আমাদের দৃষ্টিশক্তির অসম্পূর্ণতা হেতু উহাদিগকে বিভিন্ন বলিয়া মনে করি।

সকল অধ্যায়

১. ০১. কথারম্ভ
২. ০২. যুক্তকর
৩. ০৩. আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ
৪. ০৪. উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু
৫. ০৫. মন্ত্রের সাধন
৬. ০৬. অদৃশ্য আলোক
৭. ০৭. আলোর সাধারণ প্রকৃতি
৮. ০৮. আলোর বিবিধ বর্ণ
৯. ০৯. মৃত্তিকা-বর্তুল ও কাচ-বর্তুল
১০. ১০. সর্বমুখী এবং একমুখী আলো
১১. ১১. বক-কচ্ছপ সংবাদ
১২. ১২. তারহীন সংবাদ
১৩. ১৩. পলাতক তুফান
১৪. ১৪. অগ্নি পরীক্ষা
১৫. ১৫. ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে
১৬. ১৬. বিজ্ঞানে সাহিত্য
১৭. ১৭. কবিতা ও বিজ্ঞান
১৮. ১৮. বিজ্ঞানে সাহিত্য – অদৃশ্য আলোক
১৯. ১৯. বৃক্ষজীবনের ইতিহাস
২০. ২০. বৃক্ষের দৈনন্দিন ইতিহাস
২১. ২১. ভারতে অনুসন্ধানের বাধা
২২. ২২. গাছের লেখা
২৩. ২৩. উপসংহার
২৪. ২৪. নির্বাক জীবন
২৫. ২৫. তরুলিপি
২৬. ২৬. গাছ লাজুক কি অ-লাজুক
২৭. ২৭. অনুভূতি কাল নিরূপণ
২৮. ২৮. সাড়ার মাত্রা
২৯. ২৯. বৃক্ষে উত্তেজনাপ্রবাহ
৩০. ৩০. স্বতঃস্পন্দন
৩১. ৩১. বনচাঁড়ালের নৃত্য
৩২. ৩২. মৃত্যুর সাড়া
৩৩. ৩৩. নবীন ও প্রবীণ
৩৪. ৩৪. দলাদলি
৩৫. ৩৫. পরিষদ-গৃহে বক্তৃতা
৩৬. ৩৬. বোধন
৩৭. ৩৭. জীবনসংগ্রাম
৩৮. ৩৮. লোকসেবা
৩৯. ৩৯. শিল্পোদ্ধার
৪০. ৪০. মানসিক শক্তির বিকাশ
৪১. ৪১. বিফলতা
৪২. ৪২. মনন ও করণ
৪৩. ৪৩. রানী-সন্দর্শন
৪৪. ৪৪. নিবেদন
৪৫. ৪৫. পরীক্ষা
৪৬. ৪৬. জয়-পরাজয়
৪৭. ৪৭. পৃথিবী পর্যটন
৪৮. ৪৮. বীরনীতি
৪৯. ৪৯. বিজ্ঞান-প্রচারে ভারতের দান
৫০. ৫০. আশা ও বিশ্বাস
৫১. ৫১. আবিষ্কার এবং প্রচার
৫২. ৫২. অর্ঘ্য
৫৩. ৫৩. দীক্ষা
৫৪. ৫৪. আহত উদ্ভিদ
৫৫. ৫৬. জীবনের মাপকাঠি
৫৬. ৫৭. গাছের উত্তেজনার কথা
৫৭. ৫৮. গাছের লিপিযন্ত্র
৫৮. ৫৯. গাছের লেখা হইতে তাহার ভিতরকার ইতিহাস উদ্ধার
৫৯. ৬০. পাত্রাধার তৈল
৬০. ৬১. আহতের সাড়া
৬১. ৬২. আঘাতে অনুভূতি-শক্তির বিলোপ
৬২. ৬৩. জন্মভূমি
৬৩. ৬৪. স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা-প্রবাহ
৬৪. ৬৫. স্বতঃস্পন্দন ও ভিতরের শক্তি
৬৫. ৬৬. ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কিরূপে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য হইবে?
৬৬. ৬৭. বাহিরের শক্তির প্রতিরোধ
৬৭. ৬৮. বৃক্ষে স্নায়ুসূত্র
৬৮. ৬৯. আণবিক সন্নিবেশে উত্তেজনা-প্রবাহের হ্রাস-বৃদ্ধি
৬৯. ৭০. পরীক্ষা
৭০. ৭১. ভিতর ও বাহির
৭১. ৭২. হাজির
৭২. ৭৩. বৃক্ষের অঙ্গভঙ্গী
৭৩. ৭৪. সবিতার রথ
৭৪. ৭৫. ছাত্রসমাজের প্রতি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন