৭০. পরীক্ষা

জগদীশচন্দ্র বসু

উত্তেজনা-প্রবাহ সংযত করিবার সমস্যা কিরূপে পূরণ করিতে সমর্থ হইব তাহা স্থুলভাবে বর্ণনা করিয়াছি। এ সম্বন্ধে যাহা মনে করিয়াছি তাহা পরীক্ষা-সাপেক্ষ। তবে কি উপায়ে আণবিক সন্নিবেশ ‘সমুখ’ অথবা ‘বিমুখ’ হইতে পারে? এরূপ দেখা যায় যে, বিদ্যুৎ-প্রবাহ এক দিকে প্রেরণ করিলে নিকটের চুম্বক-শলাকাগুলি ঘুরিয়া একমুখী হইয়া যায়; বিদ্যুৎ-প্রবাহ অন্য দিকে প্রেরণ করিলে শলাকাগুলি ঘুরিয়া অন্যমুখী হয়। বিদ্যুৎ বাহক জলীয় পদার্থের ভিতর দিয়া যদি বিদ্যুৎ-স্রোত প্রেরণ করা যায় তবে অণুগুলিও বিচলিত হইয়া যায় এবং অণু-সন্নিবেশ বিদ্যুৎ-স্রোতের দিক অনুসারে নিয়মিত হইয়া থাকে।
স্নায়ুসূত্রে এই উপায়ে দুই প্রকারে আণবিক সন্নিবেশ করা যাইতে পারে। প্রথম পরীক্ষা লজ্জাবতী লইয়া করিয়াছিলাম। আঘাতের মাত্রা এরূপ ক্ষীণ করিলাম যে, লজ্জাবতী তাহা অনুভব করিতে সমর্থ হইল না। তাহার পর আণবিক সন্নিবেশ ‘সমুখ’ করা হইল। অমনি যে আঘাত লজ্জাবতী কোনোদিনও টের পায় নাই এখন তাহা অনুভব করিল এবং সজোরে পাতা নাড়িয়া সাড়া দিল। ইহার পর আণবিক সন্নিবেশ ‘বিমুখ’ করিলাম। এবার লজ্জাবতীর উপর প্রচণ্ড আঘাত করিলেও লজ্জাবতী তাহাতে ভ্রুক্ষেপ করিল না; পাতাগুলি নিস্পন্দিত থাকিয়া উপেক্ষা জানাইল।
তাহার পর ভেক ধরিয়া পুর্বোক্ত প্রকারে পরীক্ষা করিলাম। যে আঘাত ভেক কোনোদিনও অনুভব করে নাই স্নায়ুসূত্রে ‘সমুখ’ আণবিক সন্নিবেশে সে তাহা অনুভব করিল এবং গা নাড়িয়া সাড়া দিল। তাহার পর ‘কাটা ঘায়ে নুন’ প্রয়োগ করিলাম। এবার ব্যাঙ ছট্‌ফট্ করিতে লাগিল। কিন্তু যেমনই আণবিক সন্নিবেশ ‘বিমুখ’ করিলাম অমনি বেদনাজনক প্রবাহ যেন পথের মাঝখানে আবন্ধ হইয়া রহিল এবং ব্যাঙ একেবারে শান্ত হইল।
সুতরাং দেখা যায় যে, স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা-প্রবাহ ইচ্ছানুসারে হ্রাস অথবা বৃদ্ধি করা যাইতে পারে। এই হ্রাস-বৃদ্ধি আণবিক সন্নিবেশের উপর নির্ভর করে। একরূপ সন্নিবেশে উত্তেজনার প্রবাহ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, অন্যরূপ সন্নিবেশে উত্তেজনার প্রবাহ আড়ষ্ট হইয়া যায়। আরও দেখা যায়, এই আণবিক সন্নিবেশ এবং তজ্জনিত উত্তেজনা-প্রবাহের হ্রাস বৃদ্ধি বাহিরের নির্দিষ্ট শক্তি প্রয়োগে নিয়মিত করা যাইতে পারে। ইহা কোনো আকস্মিক কিংবা দৈবঘটনা নহে, কিন্তু পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক সত্য। ইহাতে কার্য-কারণের সম্বন্ধ অকাট্য।
বাহিরের শক্তি দ্বারা যাহা ঘটিয়া থাকে ভিতরের শক্তি দ্বারাও অনেক সময়ে তাহা সংঘটিত হয়। বাহিরের আঘাতে হস্ত-পেশী যেরূপ সংকুচিত হয়, ভিতরের ইচ্ছায়ও হস্ত সেইরূপ সংকুচিত হয়। উল্টা রকমের হুকুমে হাত শ্লথ হইয়া যায়। ইহাতে দেখা যায় যে, স্নায়ুসূত্রে আণবিক সন্নিবেশ ইচ্ছাশক্তি দ্বারা নিয়মিত হইতে পারে। তাহা হইলে ভিতরের শক্তিবলেও স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা-প্রবাহ বর্ধিত অথবা সংযত হইতে পারিবে। তবে এই দুই প্রকার আণবিক সন্নিবেশ করিবার ক্ষমতা বহু দিনের অভ্যাস ও সাধনা-সাপেক্ষ। শিশু প্রথম প্রথম হাঁটিতে পারে না; কিন্তু অনেক দিনের চেষ্টা ও অভ্যাসের ফলে চলাফেরা স্বাভাবিক হইয়া যায়।
সুতরাং মানুষ কেবল অদৃষ্টেরই দাস নহে, তাহারই মধ্যে এক শক্তি নিহিত আছে যাহার দ্বারা সে বহির্জগৎ-নিরপেক্ষ হইতে পারে। তাহারই ইচ্ছানুসারে বাহির ও ভিতরের প্রবেশদ্বার কখনও উদ্ঘাটিত, কখনও অবরুদ্ধ হইতে পারিব। এইরূপে দৈহিক ও মানসিক দুর্বলতার উপর সে জয়ী হইবে। যে ক্ষীণ বার্তা শুনিতে পায় নাই তাহা শ্রুতিগোচর হইবে, যে লক্ষ্য সে দেখিতে পায় নাই তাহা তাহার নিকট জাজ্বল্যমান হইবে। অন্যপ্রকারে সে বাহিরের সর্ব বিভীষিকার অতীত হইবে। অন্তররাজ্যে স্বেচ্ছাবলে সে বাহিরের ঝঞ্চার মধ্যেও অক্ষুব্ধ রহিবে।

সকল অধ্যায়

১. ০১. কথারম্ভ
২. ০২. যুক্তকর
৩. ০৩. আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ
৪. ০৪. উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু
৫. ০৫. মন্ত্রের সাধন
৬. ০৬. অদৃশ্য আলোক
৭. ০৭. আলোর সাধারণ প্রকৃতি
৮. ০৮. আলোর বিবিধ বর্ণ
৯. ০৯. মৃত্তিকা-বর্তুল ও কাচ-বর্তুল
১০. ১০. সর্বমুখী এবং একমুখী আলো
১১. ১১. বক-কচ্ছপ সংবাদ
১২. ১২. তারহীন সংবাদ
১৩. ১৩. পলাতক তুফান
১৪. ১৪. অগ্নি পরীক্ষা
১৫. ১৫. ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে
১৬. ১৬. বিজ্ঞানে সাহিত্য
১৭. ১৭. কবিতা ও বিজ্ঞান
১৮. ১৮. বিজ্ঞানে সাহিত্য – অদৃশ্য আলোক
১৯. ১৯. বৃক্ষজীবনের ইতিহাস
২০. ২০. বৃক্ষের দৈনন্দিন ইতিহাস
২১. ২১. ভারতে অনুসন্ধানের বাধা
২২. ২২. গাছের লেখা
২৩. ২৩. উপসংহার
২৪. ২৪. নির্বাক জীবন
২৫. ২৫. তরুলিপি
২৬. ২৬. গাছ লাজুক কি অ-লাজুক
২৭. ২৭. অনুভূতি কাল নিরূপণ
২৮. ২৮. সাড়ার মাত্রা
২৯. ২৯. বৃক্ষে উত্তেজনাপ্রবাহ
৩০. ৩০. স্বতঃস্পন্দন
৩১. ৩১. বনচাঁড়ালের নৃত্য
৩২. ৩২. মৃত্যুর সাড়া
৩৩. ৩৩. নবীন ও প্রবীণ
৩৪. ৩৪. দলাদলি
৩৫. ৩৫. পরিষদ-গৃহে বক্তৃতা
৩৬. ৩৬. বোধন
৩৭. ৩৭. জীবনসংগ্রাম
৩৮. ৩৮. লোকসেবা
৩৯. ৩৯. শিল্পোদ্ধার
৪০. ৪০. মানসিক শক্তির বিকাশ
৪১. ৪১. বিফলতা
৪২. ৪২. মনন ও করণ
৪৩. ৪৩. রানী-সন্দর্শন
৪৪. ৪৪. নিবেদন
৪৫. ৪৫. পরীক্ষা
৪৬. ৪৬. জয়-পরাজয়
৪৭. ৪৭. পৃথিবী পর্যটন
৪৮. ৪৮. বীরনীতি
৪৯. ৪৯. বিজ্ঞান-প্রচারে ভারতের দান
৫০. ৫০. আশা ও বিশ্বাস
৫১. ৫১. আবিষ্কার এবং প্রচার
৫২. ৫২. অর্ঘ্য
৫৩. ৫৩. দীক্ষা
৫৪. ৫৪. আহত উদ্ভিদ
৫৫. ৫৬. জীবনের মাপকাঠি
৫৬. ৫৭. গাছের উত্তেজনার কথা
৫৭. ৫৮. গাছের লিপিযন্ত্র
৫৮. ৫৯. গাছের লেখা হইতে তাহার ভিতরকার ইতিহাস উদ্ধার
৫৯. ৬০. পাত্রাধার তৈল
৬০. ৬১. আহতের সাড়া
৬১. ৬২. আঘাতে অনুভূতি-শক্তির বিলোপ
৬২. ৬৩. জন্মভূমি
৬৩. ৬৪. স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা-প্রবাহ
৬৪. ৬৫. স্বতঃস্পন্দন ও ভিতরের শক্তি
৬৫. ৬৬. ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কিরূপে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য হইবে?
৬৬. ৬৭. বাহিরের শক্তির প্রতিরোধ
৬৭. ৬৮. বৃক্ষে স্নায়ুসূত্র
৬৮. ৬৯. আণবিক সন্নিবেশে উত্তেজনা-প্রবাহের হ্রাস-বৃদ্ধি
৬৯. ৭০. পরীক্ষা
৭০. ৭১. ভিতর ও বাহির
৭১. ৭২. হাজির
৭২. ৭৩. বৃক্ষের অঙ্গভঙ্গী
৭৩. ৭৪. সবিতার রথ
৭৪. ৭৫. ছাত্রসমাজের প্রতি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন