৫৬. জীবনের মাপকাঠি

জগদীশচন্দ্র বসু

এখন দেখা যাইক, জীবন্ত অবস্থার কোনোরূপ মাপকাঠি আছে কি না। জীবিত ও মৃতের কি প্রভেদ? যে জীবিত তাহাকে নাড়া দিলে সাড়া দেয়। কেবল তাহাই নহে; যে অধিক জীবন্ত সে একই নাড়ায় অতি বৃহৎ সাড়া দেয়। যে মৃতপ্রায় সে নাড়ার উত্তরে ক্ষুদ্র সাড়া দেয়। যে মরিয়াছে সে একেবারেই সাড়া দেয় না।
সুতরাং আঘাত দিয়া জীবন্ত ভাবের পরিমাণ করিতে পারি। যে তেজস্বী সে অল্প আঘাতেই পূর্ণ সাড়া দিবে। আর যে দুর্বল সে অনেক তাড়না পাইয়াও নিরুত্তর থাকিবে। মনে করুন, কোনোপ্রকারে আমার অঙ্গুলির উপর বার বার আঘাত পড়িতেছে। আঘাত পাইয়া অঙ্গুলি আকুঞ্চিত হইতেছে এবং তজ্জন্য নড়িতেছে। অল্প আঘাতে অল্প নড়ে এবং প্রচণ্ড আঘাতে বেশি নড়ে। শুধু চক্ষে তাহার পরিমাণ প্রকৃতরূপে লক্ষিত হয় না। আকুঞ্চনের মাত্রা ধরিবার জন্য কোনোপ্রকার লিখিবার বন্দোবস্ত করা আবশ্যক। সম্মুখে যে পরীক্ষা দেখানো হইয়াছে তাহা হইতে কলের আভাস পাওয়া যাইবে। স্বল্প আঘাতের পরে স্বল্প আকুঞ্চন; কলমটা উপরের দিকে অল্প দূর উঠিয়া যায়, আকুঞ্চনরেখাও স্বল্প-আয়তনের হয়। বৃহৎ আঘাতে রেখাটা বড়ো হয়।
কেবল তাহাই নহে। আঘাতের চকিত অবস্থা হইতে আমার পুনরায় প্রকৃতিস্থ হই; সংকুচিত অঙ্গুলি পুনরায় স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হয়। আঘাত দিলে সংকুচিত অঙ্গুলির টানে লিখিত রেখা হঠাৎ উপর দিকে চলিয়া যায়। প্রকৃতিস্থ হইতে কিছু সময় লাগে; ঊর্ধ্বোত্থিত রেখা ক্রমশঃ নামিয়া পূর্ব স্থানে আসে। আঘাতের বেদনা অল্প সময়েই পূর্ণ মাত্রা হইয়া থাকে; কিন্তু সেই বেদনা অন্তর্হিত হইতে সময় লাগে। সেইরূপ আকুঞ্চনের সাড়া অল্প সময়েই হইয়া থাকে; তাহা হইতে প্রকৃতিস্থ হইবার প্রসারণ-রেখা অধিক সময় লয়। গুরুতর আঘাতে বৃহত্তর সাড়া পাওয়া যায়; প্রকৃতিস্থ হইতে দীর্ঘতর সময় লাগে। বেদনাও অনেক কাল স্থায়ী হয়। যদি জীবিত পেশী একই অবস্থায় থাকে এবং একইবিধ আঘাত তাহার উপর বার বার পতিত হয়, তাহা হইলে সাড়াগুলি একই রকম হয়। কিন্তু জীবিত পেশী সর্বসময়ে একই অবস্থায় থাকে না; কারণ বাহ্য জগৎ এবং বিগত ইতিহাস আমাদিগকে মুহূর্তে মুহূর্তে নূতন রূপে গড়িতেছে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রকৃতি মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হইতেছে। কখনও বা উৎফুল্ল, কখনও বা বিমর্ষ, কখনও বা মুমূর্ষ। এই সকল ভিতরের পরিবর্তন অনেক সময় বাহির হইতে বুঝা যায় না। যিনি দেখিতে ভালোমানুষটি তিনি হয়তো কোপনস্বভাব, অল্পেতেই সপ্তমে চড়িয়া বসেন; অন্যকে হয়তো কিছুতেই চেতানো যায় না। ব্যক্তিগত পার্থক্য, অবস্থাগত পরিবর্তন, তদ্ভিন্ন জীবনের অনেক ইতিহাস ও স্মৃতি আছে যাহার ছাপ অদৃশ্যরূপেই থাকিয়া যায়। সে সকল লুপ্ত কাহিনী কি কোনোদিন ব্যক্ত হইবে? প্রথমে মনে হয়, এই চেষ্টা একেবারেই অসম্ভব। দেখা যাউক, অসম্ভবও সম্ভব হইতে পারে কি না। কি করিয়া লোকের স্বভাব পরখ করিব? সাচ্চা ও ঝুটার প্রভেদ কি? টাকা পরখ করিতে হইলে বাজাইয়া লইতে হয়; আঘাতের সাড়া শব্দরূপে শুনিতে পাই। সাচ্চা ও ঝুটার সাড়া একেবারেই বিভিন্ন; একটাতে সুর আছে, অন্যটা একেবারে বেসুর। মানুষের প্রকৃতিও বাজাইয়া পরখ করা যায়। অদৃষ্ট দারুণ আঘাত দিয়া মানুষকে পরীক্ষা করে; সাচ্চ ও ঝুটার পরীক্ষা কেবল তখনই হয়।
হয়তো এইরূপে জীবের প্রকৃতি ও তাহার ইতিহাস বাহির করা যাইতে পারে- আঘাত করিয়া এবং তাহার সাড়া লিপিবদ্ধ করিয়া। সাড়া-লিপি তো রেখা মাত্র; কোনোটা একটু বড়ো কোনোটা কিছু ছোটো। দুইটি রেখার সামান্য বিভেদ হইতে এমন অব্যক্ত, এমন অন্তরঙ্গ, এমন রহস্যময় ইতিহাস কিরূপে ব্যক্ত হইবে? কথাটা যত অসম্ভব মনে হয়, বাস্তবিক তত নয়। গ্রহবৈগুণ্যে হয়তো আমাদিগকে কোনোদিন আসামীরূপে আদালতে উপস্থিত হইতে হইবে। সেখানে আসামীর বাগাড়ম্বর করিবার অধিকার নাই। কৌসুলির জেরাতে কেবল ‘হাঁ’ কি ‘না, এইমাত্র উত্তর দিতে হইবে; অর্থাৎ কেবলমাত্র দুই প্রকার সাড়া দিতে পারিব-শিরের ঊর্ধ্বাধঃ অথবা দক্ষিণ-বামে আন্দোলন দ্বারা। যদি আসামীর নাকের উপর কালি মাখাইয়া সম্মুখে একখানি অতি শুভ্র স্ট্যাম্প-কাগজ ধরা যায় তাহা হইলে কাগজে দুই রকম সাড়া লিখিত হইবে। ইহার প্রকৃত নাকে-খৎ এবং এই দুইটি রেখাময়ী সাড়া দ্বারা স্বয়ং ধর্মাবতার বিচারপতি আমাদের সমস্ত জীবন পরীক্ষা করিবেন। সেই বিচারের ফলেই আমাদের ভবিষ্যৎ বাসস্থান নিরূপিত হইবে-কলিকাতায় কিংবা আন্দামানে, ইহলোকে কিংবা পরলোকে।
এতক্ষণ মানুষের কথা বলিলাম। গাছের কথা ও তাহার গূঢ় ইতিহাসের কথা এখন। গাছের পরীক্ষা করিতে হইলে গাছকে কোনো বিশেষরূপে আঘাত দ্বারা উত্তেজিত করিতে হইবে এবং তাহার উত্তরে সে যে সংকেত করিবে তাহা তাহাকে দিয়াই লিপিবদ্ধ করাইতে হইবে। সেই লিখনভঙ্গী দিয়াই তাহার বর্তমান ও অতীত-ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইবে। সুতরাং এই দুরূহ প্রযত্ন সফল করিতে হইলে দেখিতে হইবে-

১. গাছ কি কি আঘাতে উত্তেজিত হয় এবং কিরূপে সেই আঘাতের মাত্রা নিরূপিত হইতে পারে?
২. আঘাত পাইয়া গাছ উত্তরে কিরূপ সংকেত করে?
৩. কি প্রকারে সেই সংকেত লিপিরূপে অঙ্কিত হইতে পারে?
৪. সেই লেখার ভঙ্গী হইতে কি করিয়া গাছের ইতিহাস উদ্ধার হইতে পারে?
৫. গাছের হাত, অর্থাৎ ডাল কাটিলে গাছ কি ভাবে তাহা অনুভব করে?

সকল অধ্যায়

১. ০১. কথারম্ভ
২. ০২. যুক্তকর
৩. ০৩. আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ
৪. ০৪. উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু
৫. ০৫. মন্ত্রের সাধন
৬. ০৬. অদৃশ্য আলোক
৭. ০৭. আলোর সাধারণ প্রকৃতি
৮. ০৮. আলোর বিবিধ বর্ণ
৯. ০৯. মৃত্তিকা-বর্তুল ও কাচ-বর্তুল
১০. ১০. সর্বমুখী এবং একমুখী আলো
১১. ১১. বক-কচ্ছপ সংবাদ
১২. ১২. তারহীন সংবাদ
১৩. ১৩. পলাতক তুফান
১৪. ১৪. অগ্নি পরীক্ষা
১৫. ১৫. ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে
১৬. ১৬. বিজ্ঞানে সাহিত্য
১৭. ১৭. কবিতা ও বিজ্ঞান
১৮. ১৮. বিজ্ঞানে সাহিত্য – অদৃশ্য আলোক
১৯. ১৯. বৃক্ষজীবনের ইতিহাস
২০. ২০. বৃক্ষের দৈনন্দিন ইতিহাস
২১. ২১. ভারতে অনুসন্ধানের বাধা
২২. ২২. গাছের লেখা
২৩. ২৩. উপসংহার
২৪. ২৪. নির্বাক জীবন
২৫. ২৫. তরুলিপি
২৬. ২৬. গাছ লাজুক কি অ-লাজুক
২৭. ২৭. অনুভূতি কাল নিরূপণ
২৮. ২৮. সাড়ার মাত্রা
২৯. ২৯. বৃক্ষে উত্তেজনাপ্রবাহ
৩০. ৩০. স্বতঃস্পন্দন
৩১. ৩১. বনচাঁড়ালের নৃত্য
৩২. ৩২. মৃত্যুর সাড়া
৩৩. ৩৩. নবীন ও প্রবীণ
৩৪. ৩৪. দলাদলি
৩৫. ৩৫. পরিষদ-গৃহে বক্তৃতা
৩৬. ৩৬. বোধন
৩৭. ৩৭. জীবনসংগ্রাম
৩৮. ৩৮. লোকসেবা
৩৯. ৩৯. শিল্পোদ্ধার
৪০. ৪০. মানসিক শক্তির বিকাশ
৪১. ৪১. বিফলতা
৪২. ৪২. মনন ও করণ
৪৩. ৪৩. রানী-সন্দর্শন
৪৪. ৪৪. নিবেদন
৪৫. ৪৫. পরীক্ষা
৪৬. ৪৬. জয়-পরাজয়
৪৭. ৪৭. পৃথিবী পর্যটন
৪৮. ৪৮. বীরনীতি
৪৯. ৪৯. বিজ্ঞান-প্রচারে ভারতের দান
৫০. ৫০. আশা ও বিশ্বাস
৫১. ৫১. আবিষ্কার এবং প্রচার
৫২. ৫২. অর্ঘ্য
৫৩. ৫৩. দীক্ষা
৫৪. ৫৪. আহত উদ্ভিদ
৫৫. ৫৬. জীবনের মাপকাঠি
৫৬. ৫৭. গাছের উত্তেজনার কথা
৫৭. ৫৮. গাছের লিপিযন্ত্র
৫৮. ৫৯. গাছের লেখা হইতে তাহার ভিতরকার ইতিহাস উদ্ধার
৫৯. ৬০. পাত্রাধার তৈল
৬০. ৬১. আহতের সাড়া
৬১. ৬২. আঘাতে অনুভূতি-শক্তির বিলোপ
৬২. ৬৩. জন্মভূমি
৬৩. ৬৪. স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা-প্রবাহ
৬৪. ৬৫. স্বতঃস্পন্দন ও ভিতরের শক্তি
৬৫. ৬৬. ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কিরূপে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য হইবে?
৬৬. ৬৭. বাহিরের শক্তির প্রতিরোধ
৬৭. ৬৮. বৃক্ষে স্নায়ুসূত্র
৬৮. ৬৯. আণবিক সন্নিবেশে উত্তেজনা-প্রবাহের হ্রাস-বৃদ্ধি
৬৯. ৭০. পরীক্ষা
৭০. ৭১. ভিতর ও বাহির
৭১. ৭২. হাজির
৭২. ৭৩. বৃক্ষের অঙ্গভঙ্গী
৭৩. ৭৪. সবিতার রথ
৭৪. ৭৫. ছাত্রসমাজের প্রতি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন