২০. বৃক্ষের দৈনন্দিন ইতিহাস

জগদীশচন্দ্র বসু

বৃক্ষের আভ্যন্তরিক পরিবর্তন আমরা কি করিয়া জানিব? যদি কোনো অবস্থাগুণে বৃক্ষ উত্তেজিত হয় বা অন্য কোনো কারণে বৃক্ষের অবসাদ উপস্থিত হয় তবে এইসব ভিতরের অদৃশ্য পরিবর্তন আমরা বাহির হইতে কি করিয়া বুঝিব? তাহার একমাত্র উপায়– সকল প্রকার আঘাতে গাছ যে সাড়া দেয়, কোনো প্রকারে তাহা ধরিতে ও মাপিতে পারা।
জীব যখন কোনো বাহিরের শক্তি-দ্বারা আহত হয় তখন সে নানারূপে তাহার সাড়া দিয়া থাকে– যদি কণ্ঠ থাকে তবে চীৎকার করিয়া, যদি মূক হয় তবে হাত পা নাড়িয়া। বাহিরের ধাক্কা কিংবা ‘নাড়া’র উত্তরে ‘সাড়া’ নাড়ার পরিমাণ অনুসারে সাড়ার পরিমাণ মিলাইয়া দেখিলে আমরা জীবনের পরিমাণ মাপিয়া লইতে পারি। উত্তেজিত অবস্থায় অল্প নাড়ায় প্রকাণ্ড সাড়া পাওয়া যায়। অবসন্ন অবস্থায় অধিক নাড়ায় ক্ষীণ সাড়া। আর যখন মৃত্যু আসিয়া জীবকে পরাভূত করে তখন হঠাৎ সর্বপ্রকারের সাড়ার অবসান হয়।
সুতরাং বৃক্ষের আভ্যন্তরিক অবস্থা ধরা যাইতে পারিত, যদি বৃক্ষকে দিয়া তাহার সাড়াগুলি কোনো প্ররোচনায় কাগজ-কলমে লিপিবদ্ধ করাইয়া লইতে পারিতাম। সেই আপাততঃ অসম্ভব কার্যে কোনো উপায়ে যদি সফল হইতে পারি তাহার পরে সেই নূতন লিপি এবং নূতন ভাষা আমাদিগকে শিখিয়া লইতে হইবে। নানান দেশের নানান ভাষা, সে ভাষা লিখিবার অক্ষরও নানাবিধ, তার মধ্যে আবার এক নূতন লিপি প্রচার করা যে একান্ত শোচনীয় তাহাতে সন্দেহ নাই। এক লিপি-সভার সভ্যগণ ইহাতে ক্ষুণ্ণ হইবেন, কিন্তু এই সম্বন্ধে অন্য উপায় নাই। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, গাছের লেখা কতকটা দেবনাগরীর মতো– অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিতের পক্ষে একান্ত দুর্বোধ্য।
সে যাহা হউক, মানস-সিদ্ধির পক্ষে দুইটি প্রতিবন্ধক– প্রথমত, গাছকে নিজের সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিতে সম্মত করানো, দ্বিতীয়তঃ গাছ ও কলের সাহায্যে তাহার সেই সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা। শিশুকে দিয়া আজ্ঞাপালন অপেক্ষাকৃত সহজ, কিন্তু গাছের নিকট হইতে উত্তর আদায় করা অতি কঠিন সমস্যা। প্রথম প্রথম এই চেষ্টা অসম্ভব বলিয়াই মনে হইত। তবে বহু বৎসরের ঘনিষ্ঠতা নিবন্ধন তাহাদের প্রকৃতি অনেকটা বুঝিতে পারিয়াছি। এই উপলক্ষে আজ আমি সহৃদয় সভ্যসমাজের নিকট স্বীকার করিতেছি, নিরীহ গাছপালার নিকট হইতে বলপূর্বক সাক্ষ্য আদায় করিবার জন্য তাহাদের প্রতি অনেক নিষ্ঠুর আচরণ করিয়াছি। এই জন্য বিচিত্র প্রকারের চিম্‌টি উদ্ভাবন করিয়াছি– সোজাসুজি অথবা ঘূর্ণয়মান। সূচ দিয়া বিদ্ধ করিয়াছি এবং অ্যাসিড দিয়া পোড়াইয়াছি। সে সব কথা অধিক বলিব না। তবে আজ জানি যে, এই প্রকার জবরদস্তি দ্বারা যে সাক্ষ্য আদায় করা যায় তাহার কোনো মূল্য নাই। ন্যায়পরায়ণ বিচারক এই সাক্ষ্যকে কৃত্রিম বলিয়া সন্দেহ করিতে পারেন।
যদি গাছ লেখনী-যন্ত্রের সাহায্যে তাহার বিবিধ সাড়া লিপিবদ্ধ করিত তাহা হইলে বৃক্ষের প্রকৃত ইতিহাস সমুদ্ধার করা যাইতে পারিত। কিন্তু এই কথা তো দিবা-স্বপ্ন মাত্র। এইরূপ কল্পনা আমাদের জীবনের নিশ্চেষ্ট অবস্থাকে কিঞ্চিৎ ভাবাবিষ্ট করে মাত্র। ভাবুকতার তৃপ্তি সহজসাধ্য; কিন্তু অহিফেনের ন্যায় ইহা ক্রমে ক্রমে মর্মগ্রন্থি শিথিল করে।
যখন স্বপ্নরাজ্য হইতে উঠিয়া কল্পনাকে কর্মে পরিণত করিতে চাই তখনই সম্মুখে দুর্ভেদ্য প্রাচীর দেখিতে পাই। প্রকৃতিদেবীর মন্দির লৌহ-অর্গলিত। সেই দ্বার ভেদ করিয়া শিশুর আবদার এবং ক্রন্দনধ্বনি ভিতর পৌঁছে না; কিন্তু যখন বহুকালের একাগ্রতা-সঞ্চিত শক্তিবলে রুদ্ধ দ্বার ভাঙিয়া যায় তখনই প্রকৃতিদেবী সাধকের নিকট আবির্ভূত হন।

সকল অধ্যায়

১. ০১. কথারম্ভ
২. ০২. যুক্তকর
৩. ০৩. আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ
৪. ০৪. উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু
৫. ০৫. মন্ত্রের সাধন
৬. ০৬. অদৃশ্য আলোক
৭. ০৭. আলোর সাধারণ প্রকৃতি
৮. ০৮. আলোর বিবিধ বর্ণ
৯. ০৯. মৃত্তিকা-বর্তুল ও কাচ-বর্তুল
১০. ১০. সর্বমুখী এবং একমুখী আলো
১১. ১১. বক-কচ্ছপ সংবাদ
১২. ১২. তারহীন সংবাদ
১৩. ১৩. পলাতক তুফান
১৪. ১৪. অগ্নি পরীক্ষা
১৫. ১৫. ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে
১৬. ১৬. বিজ্ঞানে সাহিত্য
১৭. ১৭. কবিতা ও বিজ্ঞান
১৮. ১৮. বিজ্ঞানে সাহিত্য – অদৃশ্য আলোক
১৯. ১৯. বৃক্ষজীবনের ইতিহাস
২০. ২০. বৃক্ষের দৈনন্দিন ইতিহাস
২১. ২১. ভারতে অনুসন্ধানের বাধা
২২. ২২. গাছের লেখা
২৩. ২৩. উপসংহার
২৪. ২৪. নির্বাক জীবন
২৫. ২৫. তরুলিপি
২৬. ২৬. গাছ লাজুক কি অ-লাজুক
২৭. ২৭. অনুভূতি কাল নিরূপণ
২৮. ২৮. সাড়ার মাত্রা
২৯. ২৯. বৃক্ষে উত্তেজনাপ্রবাহ
৩০. ৩০. স্বতঃস্পন্দন
৩১. ৩১. বনচাঁড়ালের নৃত্য
৩২. ৩২. মৃত্যুর সাড়া
৩৩. ৩৩. নবীন ও প্রবীণ
৩৪. ৩৪. দলাদলি
৩৫. ৩৫. পরিষদ-গৃহে বক্তৃতা
৩৬. ৩৬. বোধন
৩৭. ৩৭. জীবনসংগ্রাম
৩৮. ৩৮. লোকসেবা
৩৯. ৩৯. শিল্পোদ্ধার
৪০. ৪০. মানসিক শক্তির বিকাশ
৪১. ৪১. বিফলতা
৪২. ৪২. মনন ও করণ
৪৩. ৪৩. রানী-সন্দর্শন
৪৪. ৪৪. নিবেদন
৪৫. ৪৫. পরীক্ষা
৪৬. ৪৬. জয়-পরাজয়
৪৭. ৪৭. পৃথিবী পর্যটন
৪৮. ৪৮. বীরনীতি
৪৯. ৪৯. বিজ্ঞান-প্রচারে ভারতের দান
৫০. ৫০. আশা ও বিশ্বাস
৫১. ৫১. আবিষ্কার এবং প্রচার
৫২. ৫২. অর্ঘ্য
৫৩. ৫৩. দীক্ষা
৫৪. ৫৪. আহত উদ্ভিদ
৫৫. ৫৬. জীবনের মাপকাঠি
৫৬. ৫৭. গাছের উত্তেজনার কথা
৫৭. ৫৮. গাছের লিপিযন্ত্র
৫৮. ৫৯. গাছের লেখা হইতে তাহার ভিতরকার ইতিহাস উদ্ধার
৫৯. ৬০. পাত্রাধার তৈল
৬০. ৬১. আহতের সাড়া
৬১. ৬২. আঘাতে অনুভূতি-শক্তির বিলোপ
৬২. ৬৩. জন্মভূমি
৬৩. ৬৪. স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা-প্রবাহ
৬৪. ৬৫. স্বতঃস্পন্দন ও ভিতরের শক্তি
৬৫. ৬৬. ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কিরূপে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য হইবে?
৬৬. ৬৭. বাহিরের শক্তির প্রতিরোধ
৬৭. ৬৮. বৃক্ষে স্নায়ুসূত্র
৬৮. ৬৯. আণবিক সন্নিবেশে উত্তেজনা-প্রবাহের হ্রাস-বৃদ্ধি
৬৯. ৭০. পরীক্ষা
৭০. ৭১. ভিতর ও বাহির
৭১. ৭২. হাজির
৭২. ৭৩. বৃক্ষের অঙ্গভঙ্গী
৭৩. ৭৪. সবিতার রথ
৭৪. ৭৫. ছাত্রসমাজের প্রতি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন