অনবগুন্ঠিতা – ৩

আশাপূর্ণা দেবী

খুলে গেছে বন্ধ দরজা।

জানাজানি হয়ে গেছে মন।

অন্য সকলের জগৎ থেকে পৃথক হয়ে গেছে দুজনায়।

এ এক অনাস্বাদিত স্বাদ!

কেউ জানে না নবজন্ম ঘটেছে এদের।

অলক্ষ্যে যে দৃষ্টিপ্রদীপ জ্বলে উঠে আরতি করে পরস্পরকে, সেকথা আর কেউ টের পায় না। সবার মাঝখানে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ছুঁয়ে যায় একটু আঙুলের ডগা, জাগিয়ে দিয়ে যায় একটু শিহরণ, সে কেউ ধরতে পারে না।

সহজ কথাগুলোর মধ্যেই যে লুকোনো থাকে কত অর্থ, সে কথাই বা বুঝবে কে?

যদি ওদের হঠাৎ চেনা জানা হতো, যদি ওরা যৌবনের আবেগে সহসা কাছাকাছি আসতো, তা’হলে ধরা পড়তো। তা’হলে লোকে ওদের মুখের হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলোর অর্থ আবিষ্কার করতে বসতো!

কিন্তু তা তো নয়।

ওরা চেনার জগতের।

ওদের কাছাকাছিত্ব দেখে দেখে অন্যের চোখ অভ্যস্ত। ওদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বরাবরের, তাই সেটা সন্দেহের বাহক নয়।

যবে থেকে আকর্ষণ, সেই বয়সে কি প্রেম করতে বসেছিল ওরা?

অবশ্যই নয়, অথচ ভালবাসা রয়েছে। অতএব ‘ভাই বোনের মত’!

অতএব ভেবে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়, অনেকগুলো বোনটোন ছেড়ে এসেছে চানু, তাই চম্পাটাকে মায়া করে।

আর—দেবুটা বড্ড উৎপাত করে বলে ভালমানুষ চানুকে ভাইয়ের মতো ভালবাসে চম্পা।

আছেই তো সেই ভালবাসা।

নতুন করে আবার চোখ ফেলতে যাবে কে ওদের ওপর?

মামী থেকে থেকে বলেন, ‘তুই যখন বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবি চম্পা, দেখিস দেবু তোকে সাতজন্মেও দেখতে যাবে না, যেতে হলে ওই চানুই যাবে।’

তবে মামা একদিন একটা বেফাঁস কথা বলে বসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এক গোত্র না হলে, সুষিকে বলতাম, চম্পাটাকে তুইই বৌ করে নে, ভাল মানুষ শাশুড়ীর হাতে পড়তো মেয়েটা!’

মামী তাড়াতাড়ি ”থাবা” দিলেন।

বললেন, ‘কী যে বল! সেই ছোট্ট থেকে ভাই বোনের মত একসঙ্গে মানুষ হচ্ছে! তবে বল না কেন আমিই চম্পাকে বৌ করি?’

অকাট্য এই যুক্তিটি প্রয়োগ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন মামী।

চানুর সঙ্গে বিয়ে!

বাবা, সেই ভেড়ার গোয়ালে!

ননদের বাড়িতে একবেলার জন্যে গেলেই তো প্রাণ হাঁপিয়ে আসে তাঁর!

চম্পাকে তিনি ভাল বিয়ে দেবেন। কৃতী ছেলে, স্বাধীন সংসার! টাকা আছে চম্পার বাবার, মেয়ের বিয়ের নামে লাইফ ইনসিওরেন্স। দু’বছরের মেয়ে যখন, তখনই করেছিল লোকটা। হেসেছিল চম্পার মা, বলেছিল, ‘দিদি, দেখছিস কী দূরদর্শী ব্যক্তি, এখন থেকে মেয়ের বিয়ের ভাবনা ভাবছে।’

কিন্তু পরে দেখা গেল দূরদর্শীই বটে। সেই টাকা বিয়ের সময় তুলবে মাসী, ভাল করে বিয়ে দেবে।

চানু ভাল ছেলে।

চানু দেখতে সুন্দর।

চানুর প্রাণে মায়ামমতা আছে।

চানু মেয়েটাকে স্নেহ করে। কিন্তু বিয়ে দেওয়া চলে না চানুর সঙ্গে। আহা চানু যদি ওই গোয়ালের ছেলে না হতো! তাছাড়া এক গোত্র তো বটে? সেটা মামীর পক্ষে অনুকূল।

মামার প্রস্তাবে ফুটে উঠছিল দুটি আলোর ফুল, মামীর ঝঙ্কারে নিভে গেল, অন্ধকারে ডুবে গেল।

তারপর আবার আস্তে আস্তে জ্বলে উঠলো!

সংকল্পের আলোয় জ্বলা সেই দুটি ফুল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসি হয়ে উঠলো।

মামী কি জানে? মামী কি বোঝে?

মামী কি বুঝেছে, মামীর চোখের সামনেই একটা প্রেমের ঘটনা ঘটছে? বুঝেছে কি, দুটো প্রাণ নতুন জন্ম নিয়ে জ্বলে উঠেছে?

মামী কি জেনেছে, ওরা কোনো এক অবসরে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে, ‘আমি তোমার, তুমি আমার!’

আর এ কথাই কি জেনেছে, ঠিক করে ফেলেছে ওরা, ওই এক গোত্রটোত্র মানবে না তারা। দরকার হয় বাড়ি ছাড়বে!

বাড়ি ছেড়ে শুধু দুজনে দুজনকে ভালবেসে ঘর বাঁধবে।

হ্যাঁ, এ প্রতিজ্ঞা হয়ে গেছে ওদের।

অবশ্য ভাষাগুলো খুব কাব্যিক হয়নি।

চম্পা বলেছে, ‘থাক তোমাকে আর দিব্যি গালতে হবে না! খবর রাখো, এক গোত্র আর তার মানে কি? বেটাছেলেদের আর কি, দুম করে একটা প্রতিজ্ঞা করে বসলেই হয়ে গেল।’

চানু ভুরু কুঁচকে বলেছিল, ‘সত্যি, এক গোত্র জিনিসটা কি?’

চম্পা দুঃখের হাসি হেসেছে, ‘কিছুই জানো না চানুদা, শুধু বড় বড় কথা বল। ওসব প্রতিজ্ঞাটতিজ্ঞা রাখো! কিছুই হবে না।’

‘হবে না?’

চানু ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছিল, ‘হবে না মানে? চন্দ্রভূষণকে চেনো না তুমি, তাই ওকথা বলছো। হইয়ে ছাড়বো! বলবো ওসব আমি মানি না।’

‘সবাই যদি তোমার ওপর রাগ করে?’

‘করুক! তুই না করলেই হলো। বল এখনো। তুই করবি রাগ?’

তা’ মুখ ফসকে ‘তুই’টা বেরিয়ে যায় বৈকি মাঝে মাঝে। বাইরে তো ‘তুই’টাই বাহাল আছে। বাইরের ঠাট বজায় রাখতে ‘তুই’ করেই তো কথা কইতে হয় সকলের সামনে।

চম্পা মুখ নেড়ে বলে, ‘আহা! রাগ করবো?’

‘ওতেই হবে, ব্যস! তোকেই চিরকাল বৌ ভেবে এলাম, এখন এক গোত্র দেখাতে এসেছে!’

‘চিরকাল ভেবে এলে! বানিয়ে বানিয়ে বাজে কথা বোলো না বলছি।’

‘বানিয়ে বানিয়ে বাজে কথা?’

‘তা’ না তো কি? আমি যে চিরকাল তোমার জন্যে মরেছি, টের পেতে?’

‘টের পাইনি একথা কে বললে? মনে মনে পেয়েছি।’

‘হুঁ। তাই কলকাতায় গিয়ে সবাইকে চিঠি দেওয়া হলো, আর—’

‘ওঃ সেইদিনের রাগ?’

চন্দ্রভূষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর গালে একটা টোকা দেয়। বলে, ‘ভাগ্যিস দিইনি! তাই না সেদিন—!’

‘আহা যেন জেনে জেনে—’

‘জেনে না হোক অজানায়, তবু সেই রাগেই তো খুলে গেল বন্ধ দরজাটা?’

‘এবার কিন্তু গিয়ে চিঠি দেবে।’

ভাষার নমুনা এই!

কিন্তু এবার মানে কি?

এবারটা নিয়েই তো ভাবনা।

এবার যে বি.এ. পরীক্ষা হয়ে যাবে চন্দ্রভূষণের! তারপর আর রাজশাহীতে আসার প্রশ্ন কোথায়? এম.এ. যদি পড়ে তো কলকাতায় পড়বে। না পড়ে তো কলকাতায় চাকরি—বাকরি খুঁজবে।

অথচ দেবু এখনো আই.এ. ফার্ষ্ট ইয়ার, দেবু পড়তেই থাকবে।

আর চম্পা ম্যাট্রিক দেবে এবার। শোনা যাচ্ছে মামীমা ওকে কলেজে পড়াতে চান। তা’ছাড়া বিয়ের খোঁজও করছেন। যেটা আগে লেগে যায়। বিয়ে হয়ে গেলে পড়তে যাবে না।

কিন্তু ওদের যা ব্যবস্থাই হোক, চন্দ্রভূষণের আর আসবার প্রশ্ন রইলো না।

তা’হলে?

তা’হলে আর কিছু নয়। যে কটা দিন না বি.এ. পরীক্ষা হয়।

তারপর?

তারপর রইলো বিশ্বাস।

রইলো দৃঢ়তা।

‘জোর করে কেউ কাউকে বিয়ে দিতে পারে?’ চন্দ্রভূষণ বলে, ‘আমায় কেউ দিক দিকি? কেটে ফেললেও করব না।’

চম্পা আবেগে দুঃখে হতাশায় বিচলিত ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, ‘তুমি আর ওকথা বলবে না কেন? মেয়েমানুষ তো নও?’

‘মেয়েমানুষ তো কি? মেয়েমানুষ মানুষ নয়? নিজেদেরকে অমানুষ ভেবে ভেবেই তোমাদের এই দশা!’

‘শুধু ভেবে?’ চম্পা উত্তেজিত হয়। ‘মেয়েমানুষের ওপর সবাই যত জোর ফলায়, তোমাদের ওপর তা’ ফলায়?’

‘জোর করে প্রতিবাদ করলে, কার সাধ্য আর দ্বিতীয়বার জোর ফলায়? তেমন জোর করা চাই। বলবি অন্য সম্বন্ধ করলে বিষ খাব। তারপর আর বলবে কেউ কিছু? তা তো নয়, তোদের কেবল ভাবনা লোকে নিন্দে করবে! আরে বাবা, করলই বা নিন্দে? গায়ে ফোস্কা পড়বে? তবে যদি আর কোনো সুন্দরকান্তি সুপাত্র জুটে যায়, আর তোমার বাসনা হয়—’

‘ভাল হবে না বলছি। ওসব কথা বললে—’

‘ঠিক আছে। সত্যি যদি তোমার মধ্যে ভালবাসা থাকে, কেউ টলাতে পারবে না তোমার মনকে।’

যদি ভালবাসা থাকে!

হঠাৎ এক ঝলক জল এসে পড়ে বেচারার চোখে।

‘যদি থাকে?’

‘আচ্ছা আচ্ছা, বলা ভুল হয়েছে। বলছি তোমার এই ভালবাসার জোরেই লড়তে পারবে তুমি।’

হঠাৎ মামা ওদিকের বারান্দা দিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন, বললেন, ‘লড়ালড়ির কথা কি হচ্ছে রে?’

ওদিকটা বাগানের ওঁচা দিক, ওদিক থেকে কারো আসার কথা নয়, হঠাৎ মামা ওদিকে! চানু অবাক হলো। তাড়াতাড়ি বললো, ‘চম্পিটাকে বলছিলাম, মনের জোর বাড়ানো দরকার। মনের জোর প্রচুর থাকলে তবেই জীবনের পথে লড়তে পারবে তুমি।’

মামা ওর পিঠ ঠুকে দিয়ে বললেন, ‘ঠিক বলেছিস! এই হচ্ছে আসল কথা! এই দেখ দেবুটা বোকা নয়, কিন্তু পাশ করবোই এই মনের জোর নিয়ে পড়ে না বলে ভেস্তে যায়।’

কিন্তু মনের জোরই কি সব?

পৃথিবী কি এখনো এমন সভ্য হয়েছে যে মনের জোরই নিয়ন্ত্রণ করবে সে পৃথিবীকে? আর কোনো জোর নেই? গায়ের জোর? পশুশক্তির জোর?

এই সময় ওদের বাড়িতে ‘জামির’ নামের একটা ছেলে আসতে শুরু করলো। দেবুই তাকে অন্দরের দরজা চেনালো। কারণ দেবুর অন্তরঙ্গ বন্ধু সে। খেলার মাঠের বন্ধুত্ব প্রাণের মধ্যে আসন গেড়েছে।

মামীও ছেলের বন্ধুকে ছেলের মতো দেখতেন, আদর করে খেতে দিতেন, আর বলতেন, ‘কী শান্ত সভ্য ভদ্র ছেলে! কে বলবে আমাদের ঘরের নয়!’

মামা বলে উঠতেন, ‘এ কথায় আমি আপত্তি করছি রুবি! আমাদের ঘরের ছেলে হলেই শান্ত সভ্য ভদ্র হবে, নচেৎ নয়?’

মামী হাসতেন, ‘আহা তাই কি বলছি? বেশ সৎ শান্ত, সেই কথাই হচ্ছে।’

হতো সেই কথা!

সৎ শান্ত, সভ্য ভদ্র।

জামির নামের সেই ছেলেটা।

দেবুর প্রাণের বন্ধু।

কিন্তু চন্দ্রভূষণ প্রথম থেকেই তাকে দু’চক্ষের বিষ দেখতো।

বলতো, ‘বন্যজন্তুকে আদর করে বাড়িতে ডেকে আনাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় দেবু!’

দেবু রেগে উঠতো।

বলতো, ‘তোমার চোখ ঈর্ষার চোখ! ও যে চম্পির সঙ্গে কথা বলে তাতেই তোমার মাথা খারাপ! বুঝি তো তোমার ইয়ে—’

‘বোঝো? শুনে খুশী হলাম। বোঝাই মঙ্গল। অতএব আমি চাই না ওই বুনো বাঁদরটা চম্পার সঙ্গে কথা কয়।’

দেবু আরও রেগে উঠতো, ‘তা বলে চম্পা তোমার হারেমের বেগম নয়!’

আহত চন্দ্রভূষণ ঠিক করলো, এ পথে হবে না। ওই পাজীটাকেই শায়েস্তা করতে হবে।

কিন্তু সত্যই কি পাজী মনে হতো জামিরকে?

সুকুমার মুখ, ভদ্র বিনীত ভঙ্গী।

চন্দ্রভূষণ যখন তাকে সমঝে দেবে বলে ঠিক করে এগিয়ে যায়, ও হয়তো হাস্যমুখে এসে বলে, ‘চানুদাকে তো দেখাই যায় না, খুব পড়ছেন, তাই না?

চন্দ্রভূষণ ভুরু কোঁচকায়।

জামির সেটা বুঝতে পারে না।

তেমনি আহ্লাদভরা গলায় বলে, ‘উঃ ভেবে দিশেহারা হয়ে যেতে হয় চানুদা, আপনি আমার থেকে মাত্র এক বছরের বড় অথচ বি.এ. পড়ছেন! আর আমি? এখনো ইস্কুলে ঘষটাচ্ছি!’

কথাটা মিথ্যা নয়।

দেবুর সঙ্গে খেলার মাঠে বন্ধুত্ব, সহপাঠিত্বের সূত্রে নয়।

চন্দ্রভূষণের ভুরুটা সরল হতো।

চন্দ্রভূষণের মনে হতো, যা ভাবি তা বোধহয় নয়। নেহাৎই গবেট একটা! কিন্তু চম্পার সঙ্গে কথা কইতে দেখলেই যে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে!

অতএব ঝালটা এসে পড়ে চম্পার উপর।

‘খুব যে আড্ডায় মত্ত? তোমারও যে ‘পরীক্ষা’ বলে একটা জিনিস আছে সেটা বোধহয় মনে নেই?’

‘কে বললে মনে নেই?’

‘আছে মনে? তবু ভাল! যে রকম আড্ডার বহর দেখি। জামির এলে তো জ্ঞান থাকে না—’

চম্পা আরক্ত হয়।

চম্পা বোধকরি অপমানিতও হয়।

বলে, ‘মুখে যতই প্রগতির কথা বল চানুদা, মনটা তোমার সেই জেঠামশাইদের মতই। তবে জেনে রেখো, আড্ডা আমি দিই না। দেবুদার বন্ধু জামির অঙ্কে খুব ওস্তাদ, ওর কাছে অঙ্ক শিখে নিই।’

চন্দ্রভূষণ গম্ভীর হয়। বলে, ‘দুই আর দুইয়ে চার, এটাই অঙ্কের প্রথম পাঠ, বুঝলে?’

চম্পা প্রথমটা বোকার মত তাকায়, তারপর লাল হয়। বলে, ‘অকারণ রাগ করছো তুমি!’

‘অকারণ হলেই মঙ্গল। তবে বলে দিচ্ছি, ওই জামিরটি একটি ঘুঘু!’

‘ও ঘুঘু?’ হেসে ওঠে চম্পা। বলে ‘ওই অঙ্ক ছাড়া আর সব বিষয়ে একের নম্বরের বোকা!’

‘শুনি তো কবিতাও লেখেন।’

‘তা লেখে—’ চম্পা হাস্যমুখে বলে, ‘কবিতা বললে কবিতা, পদ্য বললে পদ্য। দেবুদা ওইতেই মোহিত। ডেকে নিয়ে গিয়ে মেজমাসিকে শোনায়।’

চন্দ্র বিরক্তির সঙ্গে কথা বলে, ‘তা মেজমাসিও বোধহয় মোহিত?’

‘ধেৎ, মেজমাসি তেমনি বোকা নাকি?…শুনবে তবে কবিতার নমুনা?…

 ‘ঊষার রক্তিম আভা ফুটেছে আকাশে,

 শাদা শাদা মেঘগুলি সে আকাশে ভাসে!

 লালের পরশ পেয়ে শাদা হয় লাল,

 এ শোভা মিলাবে হায় রবে ক্ষণকাল।

চম্পা হাসতে থাকে।

‘এই হলো কবিতার নমুনা!’

চন্দ্রভূষণ কিন্তু হাসে না।

গম্ভীর মুখে বলে, ‘তবু তো মুখস্থ করে ফেলেছ!’

ভাবে, সত্যিই তো! মুখস্থ করে তো বসে আছে। তার মানে আমার সামনে যত হাসছে, তত খারাপ ভাবে না। কে জানে, সব কবিতাই এরকম নিরামিষ না আমিষও আছে।…হয়তো প্রেমের কবিতা লিখে লিখে চম্পাকে উপহার দেয়। হয়তো চম্পা সেইগুলোও মুখস্থ করে!

চন্দ্রভূষণ কি মামাকে সাবধান করে দেবে?

বলবে, ‘একগোত্র ছেলে থেকে তুমি মন সরিয়ে নিচ্ছ, অথচ সম্পূর্ণ অগোত্র ওই ছেলেটাকে তোমার অন্তঃপুরে প্রবেশাধিকার দিচ্ছ—’

বলবে ভাবে, বলা হয় না।

জামিরের প্রতি ওঁদের স্নেহের আধিক্য মূক করে রাখে চন্দ্রভূষণকে। জামিরে বিগলিত ওঁরা।

জামির এমন বিবেচক যে, নিজেদের বাগানের ফল এনে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ধুয়ে নেবেন মাসিমা!’

জামির এমন নিরহংকার যে, জলতেষ্টা পেলে হাত পেতে জল খায়, কিছুতেই গ্লাসে খেতে চায় না।

জামিরের এত হুঁশ যে, কদাচ উঠোনে শুকোতে দেওয়া কাচা কাপড়গুলো ছোঁয় না, কদাচ কুয়োতলার দিকে যায় না।

এসব কী সোজা গুণ?

হিন্দু নয় বলে নিজেকে নীচু ভাবার যুগ আর আছে নাকি?…অথচ জামির তা’ ভাবে।

অতএব বিরক্তিকণ্টক উৎপাটিত হয় না।

কণ্টকবিদ্ধ মন নিয়েই বি.এ. পরীক্ষা দেওয়া হয়। এবং সর্বস্ব এখানে রেখে চলেও যেতে হয়।

মা বাপ চিঠির উপর চিঠি লিখছেন।

তা’ছাড়া আর এখানে থাকার যুক্তি কি?

যাবার আগে হঠাৎ একটু নিষ্ঠুরতা করে চন্দ্রভূষণ। নিভৃত একটু দেখা হবার জন্যে বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না। বরং চম্পার চেষ্টাটা এড়ায়। কারণ চম্পা সে চেষ্টা করে বেড়াচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। চম্পা হয়তো অকারণেই বলে উঠলো, ‘এই সেরেছে! ছাতের কাপড়গুলো বোধ হয় শুকিয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে—’

বলে টুক করে উঠে গেল ছাতে।

তারপর নেমে আসতে এতটা সময় ব্যয় করলো সেই তুচ্ছ কাজটাতে, যেটা স্বাভাবিকের গণ্ডির অনেক ওপারে। তার মানে, কোনো এক প্রত্যাশায় অপেক্ষা করেছে, এবং অবশেষে হতাশ হয়ে নেমে এসেছে।

চন্দ্রভূষণ এই সময়ক্ষেপণের হিসেবটা রেখেছে, চন্দ্রভূষণের মনটা সহস্র বাহু নিয়ে ছাতের সিঁড়ির দিকে ধাবিত হয়েছে। তবু চন্দ্রভূষণ এক নিষ্ঠুর উল্লাসে মেতে নিজেকে আটকে রেখেছে।

চম্পা এসে চোখে চোখে তাকাতে চেষ্টা করেছে, হয়তো মনটা একটু নরম হয়ে এসেছে, আর হঠাৎ হয়তো সেই মহামুহূর্তে শনির মত এসে উদয় হয়েছে জামির, ছ্যাবলার মত বলে উঠেছে, ‘কি চানুদা, যাবার জন্যে তোড়জোড় লাগিয়েছেন তো? দেখবেন যেন আমাদের ভুলে টুলে যাবেন না।’

ব্যস, মেজাজের পারা চড়াৎ করে শেষ সীমায় উঠে বসেছে, মনটা হিংস্র হয়ে উঠেছে। তাই চোখাচোখির চেষ্টাটা ব্যর্থ হয়েছে চম্পার।

তবু চম্পা আশে—পাশে ঘুরঘুর করে বেড়িয়েছে, খামোকা চানুকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাগানের দিকে চলে গেছে, এবং তাতেও ছাতের ব্যাপারেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

অথচ চন্দ্রভূষণ অবোধের ভানে ‘সরল মুখ’ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে।

মামী কোনোদিনই সন্দেহবাতিক নয়, কাজেই এতটুকু ইচ্ছে করলেই একবার নির্জনে দেখা হতে পারতো! কতই তো অমন হয়েছে এযাবৎ, কিন্তু সে ‘ইচ্ছে’কে দমন করেছে চন্দ্রভূষণ। আর এ পর্যন্ত এই চন্দ্রভূষণই করেছে সুযোগ সংগ্রহ।

পরস্পর যে ‘জীবনে মরণে আমরা এক’ বলে বাক্যবদ্ধ হয়েছে, সে কি মামার কানের গোড়ায়, না মামীর সামনে?

কিন্তু এখন চন্দ্রভূষণ অবোধের ভানে মামার বৈঠকখানাতেই আড্ডা গাড়ছে। আবার ঠিক গাড়ছেও না। চঞ্চল হয়ে মাঝে মাঝেই উঠে যাচ্ছে। ঘুরে আসছে এঘর ওঘর, আর যেই চম্পাকে দেখতে পাচ্ছে, না দেখার মত করে চলে আসছে।

করেছে, দিনের পর দিন এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করেছে চন্দ্রভূষণ।…পরে সেই কথা ভেবে নিজেকে নিজে মারতে ইচ্ছে হয়েছে চন্দ্রভূষণের, তবু তখন করেছে সেই ব্যবহার।

এটা করতে কি বুক ফেটে যাচ্ছিলো না চন্দ্রভূষণের?

যাচ্ছিলো।

তবু করছিল।

যেন একটা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে।

কিন্তু হঠাৎ সেই রাত্রে ঘটলো এক ঘটনা।

ভয়ংকরই মনে হয়েছিল সে ঘটনাকে চন্দ্রভূষণের। ভোরবেলা যাত্রা, শেষরাত্রি থেকে ঘুম ভেঙে গেছে, এবং গত ক’দিনের অবিমৃষ্যকারিতার জন্যে ছটফট করছে নিরুপায় মন। এমন সময়, সেই রাত্রির অন্ধকারে ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে চম্পা এসে ঘরে ঢুকলো।

হ্যাঁ, সত্যিকার চম্পা। স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, স্রেফ রক্তমাংসের।

চন্দ্রভূষণ তবে হাতে স্বর্গ পেল?

তাই পাওয়াই তো উচিত ছিল।

কিন্তু তা হলো না।

চন্দ্রভূষণ হাতে স্বর্গ পেল না, ভয় পেল।

রুদ্ধ গলায় বললো, ‘এর মানে?’

চম্পা বসে পড়লো একটা ট্রাঙ্কের উপর।

বললো, ‘কী করবো? তুমি তো—’

‘তাই বলে এই সময়? না না, ছি ছি, শীগগির ঘরে যাও।’

চম্পা রেগে উঠলো।

বললো, ‘ঘরে যাব না তো কি তোমার সঙ্গে কলকাতায় যাবার জন্য আবদার করবো? শুধু জানতে এসেছি, যাবার সময় এরকম করলে কেন?’

চন্দ্রভূষণ ভাঙা ফ্যাকাশে গলায় বললো, ‘কি রকম?’

‘জানো না কি রকম? একটা কথা কইতে সুযোগ দিলে না—’

শেষরাত্রে উঠে ঘড়ি দেখবে বলে একটা হ্যারিকেন জ্বালা ছিল ঘরে, যতটা সম্ভব মৃদু শিখায়। জানলার বাইরে তখনো ঊষার রক্তিম আভা ফোটেনি।

এই প্রায়ান্ধকার ঘরে এই বিদায়ের মুহূর্তে চম্পা কেন দেখা দিতে এলো?

চন্দ্রভূষণ কি করে নিজেকে সংযত রাখবে? চন্দ্রভূষণ কেন ওই প্রিয় দেহটাকে কাছে টেনে নিতে যাবে না?

হ্যাঁ, চন্দ্রভূষণ সেই মানবিক রীতিরই অনুসরণ করতে যাচ্ছিলো, চন্দ্রভূষণ ওকে দু’হাতে কাছে টেনে নিয়ে আবেগের গলায় বলে উঠেছিল, ‘চম্পা চম্পা, আমি একটা গাধা, একটা জানোয়ার—’

তারপর?

তারপর কি একটা জানোয়ারের মতোই ব্যবহার করতো চন্দ্রভূষণ? মার্জিতবুদ্ধি ভদ্র চন্দ্রভূষণ? তা হয়তো অসম্ভবও ছিল না। আর হয়তো নিজে সে তখন নিজেকে জানোয়ার না ভেবে দেবদূতই ভাবতো। কারণ চম্পা সেই মুহূর্তে উচ্ছ্বসিত হয়ে কেঁদে উঠে ভেঙে পড়েছিল তারই গায়ের উপর। কিন্তু ঠিক সেই সময় নিষ্ঠুর বিধাতা তীব্র একটা পরিহাস করলেন।

অথবা দয়াময় বিধাতা কল্যাণের হাত বাড়িয়ে—

না, অবশ্যই ঠিক সেই মুহূর্তে বিধাতাকে দয়াময় ভাবেনি ওরা, কারণ বিধাতা চন্দ্রভূষণের মামার গলায় বলে উঠেছিলেন, ‘ওরে চানু, উঠেছিস নাকি? আর তো সময় হয়ে এলো—’

বলা বাহুল্য চানুর সাড়া পেলেন না।

কারণ চানু তখন ‘গভীর ঘুমে’ আচ্ছন্ন।

মামা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন, চটির শব্দে টের পাওয়া গেল সেটা, তারপর মামার স্বগতোক্তি শোনা গেল, ‘বেদম ঘুমোচ্ছে! আচ্ছা ঘুমোক, আরও মিনিট পনেরো ঘুমিয়ে নিক।

মামার চটির শব্দ আবার উঠলো, মিলিয়ে গেল।’

কিন্তু সেই মেয়েটা?

সেটা মিলিয়ে গেল কোথায়?

তাকে কি আর দেখতে পাওয়া গেল?

না, চন্দ্রভূষণ অন্ততঃ তাকে আর দেখতে পায়নি।

চোখ বুজে ‘ঘুমিয়ে পড়া’র পর অনুভব করেছিল চন্দ্রভূষণ, বাগানের দিকের ছোটো দরজাটা খুলে নেমে গেল সে।

ব্যস!

আর দেখা হলো না!

যাত্রাকালে নয়, সগোত্র বিয়েতে বাড়ির সম্মতি আদায় করে ফিরে এসে নয়! সারা জীবনে আর কবে কোথায়?…

হ্যাঁ, সগোত্র বিয়েতে সম্মতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল চন্দ্রভূষণ ওপরওলাদের।

তর্কাতর্কি করে, নির্লজ্জতার চূড়ান্ত করে।

কিন্তু সে তো পরে।

সেদিন? সেদিন ট্রেনে যখন চাপলো, মামার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যখন একা হলো, তখন চন্দ্রভূষণ যেন ভয়ে ভয়ে সাবধানে সেই অদ্ভুত ঘটনাটাকে বন্ধ বাক্স থেকে বার করলো।

আচ্ছা, ঘটনাটা কি সত্যিই ঘটেছিল?

চন্দ্রভূষণের একাগ্র বাসনার স্বপ্ন নয় তো?

কিন্তু স্বপ্ন যদি তো কেন চন্দ্রভূষণের সমস্ত স্নায়ু শিরায়, রক্তে মাংসে, অস্থি মজ্জায় স্পর্শের এমন রোমাঞ্চ স্বাদ?

কেন চন্দ্রভূষণের সমস্ত চেতনায় এমন তীব্র আক্ষেপের আছড়ানি?

আচ্ছন্নের মতই সারা রাস্তাটা কাটলো।

তারপর সংকল্পে দৃঢ় হলো চন্দ্রভূষণ।

ভাবলো, দেরি নয়, দেরি নয়! এখনই বাড়ি গিয়ে—

চন্দ্রভূষণদের আমলে বি.এ. পাসের সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ের নজীর ছিল। তাই ভাবাটা হাস্যকর হলো না। চন্দ্রভূষণ ভাবলো, শেষ পর্যন্ত ব্যবহারটা জানোয়ারের মত হলো। শেষকালে দেখা করে এলাম না।

কী ক্ষতি হতো, যদি সাহস করে বলতো পারতো, ‘মামা, আমি চম্পিকে বিয়ে করতে চাই।’ বলতে পারেনি, এটুকুও বলতে পারেনি, ‘কই চম্পিকে দেখছি না?’

না, সে সাহস হয়নি তার।

নিতান্ত কাপুরুষের ভূমিকা অভিনয় করেছে সে।

তার কারণ তখনো রক্তের মধ্যে তোলপাড় করছিল একটা অনাস্বাদিত স্বাদের ঢেউ। আর নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগছিল।

ক্রমশঃ বাড়ির পথে আসতে আসতেই সংকল্পে দৃঢ় হলো।…’সগোত্র’ কথাটার মতে একটা তুচ্ছ কথা নিয়ে জীবনকে এলোমেলো করবে না চন্দ্রভূষণ!

বলবে, আরো তিন ভাই আছে চন্দ্রভূষণের, কুল শীল গোত্র গাঁই মিলিয়ে বিয়ে দেবেন তাদের, চন্দ্রভূষণকে যেন তাঁরা মুক্তি দেন।

মনে মনে তো ঠিক করাই আছে, অধ্যাপনার কাজই করবে সে। মোটামুটি আন্দাজও করে রেখেছে কোন দিকে করবে।

কলকাতায় নয়, কলকাতায় কাজ করলেই তো এই ‘অচলায়তনে’র মধ্যে মাথা গুঁজতে হবে! চলে যাবে বাইরে। পূর্ববঙ্গে, উত্তরবঙ্গে অথবা বিহারে, উত্তর ভারতে, যেখানে হোক।

যেখানে হোক!

চম্পাকে নিয়ে একটি সুখের নীড় বাঁধবার জন্যে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় এতটুকু একটু বাসা! শুধু এই বৃহৎ পরিবারের মধ্যে নয়। এখানে চম্পা হাঁপিয়ে উঠবে।

হ্যাঁ, এইরকমই ভেবেছিল সেদিন যুবক চন্দ্রভূষণ।

অথচ আজ যখন প্রৌঢ় চন্দ্রভূষণের ভাই বলতে এলো, ‘দাদা, বাইরে একটা অফার পাচ্ছি, বেশ ভবিষ্যৎ আছে মনে হচ্ছে, ভাবছি ওখানে একটা অ্যাপ্লাই করি,’ চারিদিক শূন্য দেখলেন যেন চন্দ্রভূষণ।

যেন মনে হলো পৃথিবীতে এমন অনিয়ম হয় না।

বাইরে চাকরী!

তার মানে ভিটে ছেড়ে চলে যাওয়া!

না না, তা হয় না।

‘ভিটে’ নামক বস্তুটার কি একটা আত্মা আছে? তাই সেই চন্দ্রভূষণ ভিটেয় বাস করতে করতে এখন ভিটেটার মায়ায় মরছেন।

যুবক চন্দ্রভূষণের আবেগ ছিল অন্যত্র। তাই ভেবেছিল, এ বাড়িতে নয়। ভেবেছিল, বাবার তো আরো তিন ছেলে আছে।

আর সেই ভাবনা থেকেই নির্লজ্জের চূড়ান্ত হয়ে সগোত্র বিবাহে সম্মতি আদায় করেছিল ওদের ওই গোঁড়া বাড়ি থেকে!

কিন্তু ঠিক সম্মতিই কি? অনেকটা যেন হার মেনে ছেড়ে দিয়েছিল সংসার।

প্রথমে তো জেঠামশাই বলেছিলেন, ‘সগোত্র কন্যা বিবাহ, সহোদরা বিবাহের তুল্য পাতক।’

বলেছিলেন, ‘ওতে আয়ুক্ষয় হয়।’

চন্দ্রভূষণ জেঠাইমার মারফত বললো, ‘আয়ুক্ষয়ের কথা ভাবি না। ওটা অবান্তর। তবে প্রশ্ন করছি, সাতপুরুষের দূরত্ব হয়ে গেলেই তো গোত্রের বন্ধন শিথিল হয়ে যায় তোমাদের, মরে গেলে অশৌচ লাগে না, তবে? এ তো কোনো পুরুষে সংস্রবই নেই।’

‘তবু বিবাহ নিষিদ্ধ, কারণ কোনো এককালে একরক্ত ছিল।’

‘কিন্তু এই যে দেখি ‘দত্তক’ নেওয়া হয়, তাতে তো গোত্রান্তর ঘটে, তাদের বেলায় কি হয়? গোত্রান্তর ঘটে, কিন্তু রক্তান্তর তো হয় না?’

‘একে বলে কুতর্ক!’

জেঠামশাই রেগে বলেছিলেন, ‘ইচ্ছে হয় খ্রীষ্টান মুসলমান যা খুশি বিয়ে করগে না, অনুমতি নেওয়ার থিয়েটারটা কেন?’

বাবা বলেছিলেন, ‘মামা যে কেন অত আগ্রহের আড়ম্বর করে ভাগ্নেকে নিয়ে ঘরে পুষেছিলেন, তা’ বোঝা যাচ্ছে এখন। একটা লভ ঘটিয়ে শালীর মেয়েটাকে পার করার ফন্দী! মামা মহৎ, মামা হিতৈষী, দেখ এখন!’

মা কপাল চাপড়ে বললেন, ‘এত বুদ্ধি ধরিস তুই, আর এই ফাঁদে পা দিলি? বুঝতে পারলি না, এ তোর মামীর কারসাজি! নইলে এতদিনে ওর বিয়ের চেষ্টা করে না?’

চন্দ্রভূষণ বললো, ‘মামী এর বিরুদ্ধে! মামীও সগোত্র বলে মূর্ছা যাচ্ছে।’

মা বিশ্বাস করেননি সে কথা।

মা তাঁর স্বভাববহির্ভূত গলায় বলেছিলেন, ‘বকিসনে খোকা! বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাতে আসিসনে?’

পিসি বললেন, ‘গুণ তুক করেছে কিছু, এ আমাদের আগেই বোঝা উচিত ছিল। দেখতে না, ইদানীং ছুটিতে বাড়ি এসেও ছেলে যেন রাতদিন তাদের ভাবেই বিভোর, তাদের চিন্তোয় উন্মুখ!’

শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রভূষণ। আশ্চর্য তো!

ভেবেছিল, মনস্তত্ত্বের ছাত্রী না হয়েও পিসিমা তো ও বিদ্যেটায় কাঁচা নয় দেখছি।

চন্দ্রভূষণ তো নিজের সেই উন্মনা ভাবটা নিজে বুঝতে পেরে, ধরা পড়বার ভয়ে যতদূর সম্ভব হইচই করেছে, যতটা পেরেছে সহজ হয়েছে। রাজশাহীর নাম মুখে আনেনি এদের কাছে, তবু পিসিমা এমন এক মোক্ষম কথা বলে বসলেন!

ঠাকুমাও মেয়ের কথায় সায় দিলেন।

বললেন, ‘গুণ তুক ছাড়া আর কি? দেখছ না, নিজেরা একটা পত্তর লিখে প্রস্তাব করলো না, ওই বেহায়া ছোঁড়াটাকে দিয়েছে লেলিয়ে! জানে ওতেই কাজ হবে, নিজেরা হেঁট হবে কেন?’

চন্দ্রভূষণ হেসে বলেছিল, ‘এই কথাটাই খাঁটি ঠাকুমা, ছোঁড়াটা বেহায়া! নইলে বিশ্বাস কর, তাঁদের মনোভাব তোমাদের থেকে কিছু কম কড়া নয়।’

‘তা’ তুই হতভাগাই বা এত বেহায়া হতে গেলি কেন? আমরা কোথায় চারদিকে ঘটক পাঠাচ্ছি সুন্দর মেয়ে খুঁজতে, ইত্যবসরে তুই কিনা নিজেই নিজের কনে ঠিক করে বাপ জেঠার মুখের ওপর বলছিস, ‘শাস্তরে থাকুক না থাকুক ওকেই আমি বিয়ে করব!’

‘তা’ তোমরাই তো বল ঠাকুমা, যার সঙ্গে যার মজে মন—’ চন্দ্রভূষণ ঠাকুমার ন্যাড়ামাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

ঠাকুমা হেসে ফেলে বলেন, ‘তা মনকে এত সাততাড়াতাড়ি মজাবার কী দরকার ছিল? বয়েস কি পেরিয়ে যাচ্ছিলো? তা’ছাড়া—সেই কচি খুকীটা থেকে দেখলি মেয়েটাকে, এখন তাকে নতুন করে ভাল লাগছে?’

চন্দ্রভূষণ হেসে উঠে বলে, ‘ঠাকুমা, তোমারও তো শুনেছি ন’বছরে বিয়ে হয়েছিল, ঠাকুর্দাও অতএব সেই কচি খুকীটাকে দেখেছিলেন? তারপর ‘নতুন করে’ ভাল লাগেনি?’

ঠাকুমা আরো হেসে ফেলেছিলেন।

বলেছিলেন, ‘দূর হ হতভাগা ছেলে! কিসের সঙ্গে কি! শুভদৃষ্টির পরিবার আলাদা জিনিস, বুঝলি?’

‘বুঝলাম না। নাপিত ব্যাটা ‘ধরে ভদ্র ঘটিয়ে’ শুভদৃষ্টি করিয়ে দিলেই তবে শুভদৃষ্টি হবে, নচেৎ হবে না, একথা আমার বুদ্ধির বাইরে।’

‘তাহোক যাই বলিস, এ বিয়েয় সুখ নেই। সাধ—আহ্লাদ হবে না, নতুন একটা কুটুম্ববাড়ি হবে না, সেই পচা পুরনো মামার বাড়িটাই হবে শ্বশুরবাড়ি, ছিঃ! মামীর বুনঝির সঙ্গে বিয়ে নতুন কথা নয়, কিন্তু মামীর কাছে মানুষ হওয়া মেয়ে তো মামীরই মেয়ের তুল্যি!’

এখানটায় একটু বিচলিত হয়েছিল চন্দ্রভূষণ। ভেবেছিল, তা বটে। সেই বাড়িতে জামাই সেজে চম্পাকে নিয়ে বাসরে বসবো! ব্যাপারটা আদৌ লজ্জার নয়, একথা বলা যায় না।

তা’ সে ভাবনাকে দাঁড়াতে দিল না।

চেনা জানার মধ্যে বিয়ের অনেকগুলো নজীর চোখের সামনে মেলে ধরে মনকে ঠিক করে নিল।

অবিরতই যে চোখের সামনে ছায়া ফেলে ফেলে চলেছে, সেই একখানা প্রায়ান্ধকার ঘর, সেই একখানা ক্রন্দনাকুল নারীসত্তা!….. চোখে দেখতে পায়নি, শুধু স্পর্শ অনুভব করেছিল। তাই সেই নারীদেহটুকু দেহের স্থূলতা অতিক্রম করে একটি সত্তায় বিকশিত হয়ে উঠেছিল।

চম্পা যদি দিনেরবেলা এসে কাঁদতে বসতো, মায়া হতো, এমন হতো না। শুধু মনে হতো চম্পা কাঁদছে। কিন্তু এমন একটা অদ্ভুত সময়ে এলো চম্পা, সে যেন শরীরিণী রইলো না, যেন একটা আকুলতার রূপ হয়ে অনুক্ষণ শুধু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগলো!

* * *

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন