আশাপূর্ণা দেবী
সামান্য একটু বকুনি খাবার ভয়ে ধর্মাধর্ম জলাঞ্জলি দিয়েছিল সে। তার উপর আবার নীচতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল চম্পার নামে ঘৃণ্য অপবাদ দিয়ে।
অথচ সেই দেবুই পরে বাপের বাক্স ভাঙলো, নেশা করলো, উচ্ছন্ন গেল। কই তখন তো বকুনি খাবার ভয় করল না? খুব বেশী পরের কথা তো নয় সেটা!
দেবু বলে, ‘মনের গ্লানি ভুলতে নেশা ধরেছিলাম ভাই—’
তা’ অমন কথা সব নেশাখোরেই বলে থাকে।
মনের গ্লানি ভুলতে তুমি ভগবান না ধরে মদ ধরতে গেলে! তা’ গ্লানি ভুলতেই বোধ হয় বাপমার বুকে শেল মারলে, সর্বস্বান্ত করলে তাঁদের, দুর্গতির চরম করলে! মনের কষ্টে কষ্টেই মরে গেল মানুষ দুটো!
চন্দ্রভূষণ জানেন না সে সব?
তবু চন্দ্রভূষণের দয়া উথলে উঠলো।
‘মাতুল ঋণ’ শোধ করতে দেবুকে আশ্রয় দিতে গেলেন।
আশ্চর্য!
আশ্চর্য্যই বৈকি।
লোকে যে ভাবে চন্দ্রভূষণের ওই কলঙ্কনায়িকার জন্যেই বেলেঘাটায় দোকানের ছল, সেটা ভুল। দেবুকে যখন দোকান করে দিয়েছিল তখন কোথায় কলঙ্ক? তখন তো চন্দ্রভূষণ নিষ্কলঙ্ক চাঁদ।
কাজেই আশ্চর্য ওই দেবুকে সাহায্য করা!
মা বাপ মরার পরে অনেক দিন কোনো পাত্তা ছিল না বাউণ্ডুলে দেবুর। কে জানে মরেছে কি বেঁচে আছে।
হঠাৎ একদিন এসে উদয় হলো!
নির্লজ্জের মতো বললো, ‘খেতে পারছি না রে চন্দর, মাইরি বলছি আজ তিন চার দিন চায়ের দোকানে চেয়ে চিন্তে দু’বেলা একটু একটু চা খেয়ে কাটাচ্ছি।’
বাড়িতে আসতে সাহস করেনি, চন্দ্রভূষণের কারখানায় গেছে।
চন্দ্রভূষণ ওই ভিক্ষুকের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, জরাজীর্ণ একখানা র্যাপার গায়ে, ময়লা ছেঁড়া একটা ধুতি। র্যাপারের নীচে সার্টের চিহ্ন নেই, খুব সম্ভব শুধু ছেঁড়া গেঞ্জি।
মুখে বেশ কয়েক দিনের দাড়ি, এবং মুখের রেখায় রেখায় দৈন্যের নির্লজ্জ রেখা।
ওই মূর্তিটার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলেছিলেন চন্দ্রভূষণ, ‘তবু মরতে পারনি?’
‘কই আর পারলাম?’ দেবু হতাশ গলায় বলেছিল, ‘মরলে প্রায়শ্চিত্ত করবে কে?’
চন্দ্রভূষণ সেই চাপা গলাতেই তীব্র হয়েছিলেন, ‘আছিস কোথায়?’
‘বেলেঘাটার একটা বস্তিতে।’
‘বেলেঘাটায়? আছে কে সেখানে?’
‘কেউ না। ওখানে একটা লোহা লক্কড়ের দোকানে কাজ করতাম, ওই অঞ্চলেই ছিলাম, তা একদিন চাকরীটা গেল—’
‘চাকরীটা গেল?’ চন্দ্রভূষণ ব্যঙ্গের গলায় বলে উঠেছিলেন, ‘তা তো যাবেই! মহাপুরুষ বোধহয় তাদের মাল সরিয়ে বেচে দিয়েছিলেন?’
দেবু মাথা হেঁট করেছিল।
চন্দ্রভূষণ একটুক্ষণ থেমে বলেছিলেন, ‘অনেক তো হলো, এবার ক্ষ্যামা দাও না। বংশের মুখে আর কত কালি মাখাবে? … বস্তিতে! বেলেঘাটার বস্তিতে! ছি ছি! কার ছেলে তুই, একথা মনে পড়ে না দেবু? লেখাপড়াও তো শিখেছিলি কিছু। একটু সৎভাবে থাকতে ইচ্ছে করে না?’
দেবুর হেঁট হয়ে যাওয়া মুখের চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল। বলেছিল, ‘ইচ্ছে হলেই বা উপায় কোথা? অসৎদের সঙ্গে মিশে মিশে সৎরাস্তার ঠিকানা ভুলে গেছি।’
‘ঠিক আছে’—চন্দ্রভূষণ বলেছিলেন, ‘আমি তোমায় একবার চান্স দেব। নিজের দোকান করে দেব তোমায় একটা। অবশ্য ছোট্টই। তবে যে দোকানে কাজ করতিস সেই ধরনের দোকানই ভাল। জানা জিনিস। আমার এই ফার্ণিচারের দোকান থেকেই দেখছি তো—তুচ্ছ ওই স্ক্রু, পেরেক, কব্জা, চাবির কল থেকে কী লাভটা মারে! ওরই একটা দোকান—’
দেবু কাতর গলায় বলেছিল, ‘তার থেকে তোর এই দোকানেই একটা কাজ দে না! যা হোক কাজ। ধুলো ঝাড় দিতেও রাজী। তার বদলে দুবেলা দুমুঠো ভাত আর একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই। সাত মাস ঘর ভাড়া বাকি পড়ে আছে, বাড়িওলা তিনবেলা দূর দূর করছে।’
‘না!’
চন্দ্রভূষণ গম্ভীর হয়েছিলেন।
বলেছিলেন, ‘না। নিশ্চিন্তের আশ্রয়, আর পেটের ভাত পেলেই তুমি আবার উচ্ছন্নর রাস্তা ধরবে। তোমায় খাটতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। নিজের দোকান হোক। তার থেকে তো আর চুরি করতে পারবি না?’ বলে এবার একটু হেসেছিলেন।
তারপর বলেছিলেন, ‘বিয়ে করেছিস?’
দেবু হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়েছিল।
চন্দ্রভূষণ বলেছিলেন, ‘যাক এই একটা পুণ্যেই তোর পাপের লাঘব। আবার যে বংশে তোর ধারা রেখে যাচ্ছিস না এটাই বোধ করি মামার কপালে সোনার আঁচড়। … তা’ হলে আশ্রয়েরও সমস্যা নেই, দোকানেই থাকবি।’
এই হল দেবুর দোকানের ইতিহাস।
বেলেঘাটার একটা সরু রাস্তার মোড়ে ওই দোকান ঘরটা। দোকানের পাশ দিয়ে রাস্তা থেকে সরু সিঁড়ি উঠে গিয়ে তার দোতলায় দেড়খানা ছোট্ট ঘর। জোগাড় করে ফেলেছিলেন চন্দ্রভূষণ কম দিনের মধ্যেই।
কিন্তু বেলেঘাটায় কেন?
নিজের কাছাকাছি নয় কেন?
তা সেটা হয়তো উদার চন্দ্রভূষণেরও সঙ্কীর্ণতা!
ভেবেছিলেন হয়তো, নাম ডোবানো আত্মীয়, দূরে থাকাই মঙ্গল। ভাইদের কাছে প্রকাশও করেননি তখন। ভেবেছিলেন, দেখি ওর ভাব গতিক। মুখটা আর বেশী হাসাব না।
কিন্তু দেবু বদলে গিয়েছিল, দেবু মুখ হাসায়নি তার দয়ালু আর মহৎ পিসতুতো ভাইয়ের।
চন্দ্রভূষণের ভাইরা এতদিনের ইতিহাস জানে না। ওদের কানে এসে পৌঁছেছে ইদানীং। কাজেই ওরা ধরে নিয়েছে চন্দ্রভূষণের বুড়োবয়সের দুর্মতির অধিনায়িকার জন্যই দোকান।
আর ধরে নিয়েছে দেবুটাই এই সব দুর্মতির প্ররোচক, দাদাকে ওই প্রলোভন দেখিয়ে বেশ কিছু হাতাচ্ছে, বেশ কিছু বাগাচ্ছে।
কিন্তু দাদার নিশ্চয় বুদ্ধি ফিরবে।
আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
বিন্দুভূষণ পুরুষমানুষ, তাই ওকথা ভাবে। ভাবতে পারে, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। একবার বেঠিক হয়ে যাওয়া সংসার যে আর ‘ঠিক’ হয় না একথা ওর জানা নেই।
বেঠিকটা ঠিক হয় গল্পে, উপন্যাসে, সিনেমার ছবিতে, সাজানো রঙ্গমঞ্চে।
একটা মহামুহূর্তকে অবলম্বন করে যেখানে যবনিকাপাত করা হয়।
সত্যকার জীবনে ওই মহামুহূর্তটি তো আর স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না! আবার আসে অগ্নিমুহূর্ত!
তাই ঠিক হবার উপায় আর নেই।
চন্দ্রভূষণ যদি মোহমুক্ত হয়ে ফিরে এসে গঙ্গাস্নান করে আবার সংসারে বসেনও, সুনন্দা আর শেফালীতে যে মুখোমুখি ঝগড়াটা হয়ে গেল সেদিন, তার দাগ কি মিলোবে? শেফালীর বড় মেয়েটা যে সেদিন সেজকাকার কথা না শুনে নাকের ওপর দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল, তার জ্বালা কি একেবারে ঠাণ্ডা হবে?
হয় না।
হয়তো স্বার্থ এবং সুবিধার প্রয়োজনে, হয়তো বা সাময়িক এক টুকরো শুভবুদ্ধির বশে, ভাঙা টুকরোগুলো আবার একত্র হবার চেষ্টা করতে রাজী হয়, কিন্তু তার অসঙ্গতিটা ধরা পড়ে প্রতিমুহূর্তে, তার অগ্নিমুহূর্তগুলো ধ্বংস করে বসে সভ্যতা, ভব্যতা, শালীনতা, সম্ভ্রম।
হবেই তো।
বাইরের ঘটনাগুলো যে নিমিত্তমাত্র, ভাঙছে তো ‘কাল’! ভাঙাই যার কর্তব্য কর্ম, ভাঙাই যার চাকরি। বিধাতা—নির্দিষ্ট এই চাকরিতে কর্তব্যকর্মে ত্রুটি নেই তার কখনো। অহরহ এগিয়ে চলেছে সে তার চক্রের আঘাত হানতে হানতে।
‘ঘটনাগুলো শুধু তার চক্রোৎক্ষিপ্ত ধুলোমাত্র। যদি একদার ‘একবৃন্তে’র মানুষগুলো দূরে দূরে থাকে, তা’হলে শুধু ওই ধুলোটা ওড়ে না। কিন্তু ‘কালে’র কাজ অব্যাহত থাকে। নিঃশব্দে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা।
কর্তব্যনিষ্ঠ ‘কালে’র সেই চক্রের ঘায়ে ভাঙছে সমাজ, ভাঙছে রাষ্ট্র, ভাঙছে যুগযুগান্ত সঞ্জাত মূল্যবোধ, ভাঙছে বহুসাধনাপুষ্ট ধর্মবিশ্বাস!
মানুষ আবার গড়তে বসছে নতুন নকশা।
শেফালী সুনন্দা উদিতা, ওরা যদি ওদের নিজ নিজ নকশায় ঘর বাঁধতে চায়, যদি চন্দ্রভূষণের মায়ের নকশার খাঁজের ইঁট হয়ে থাকতে না চায়, ওদের দোষ দেওয়া চলে না।
ওরা তা’ চাইছিল।
ওরা সেই চাওয়ায় উত্তাল হচ্ছিল, অসহিষ্ণু হচ্ছিল, অস্থির হচ্ছিল, শুধু দুর্গপ্রাকারের কোনখানটা কমজোরি, কোনখানটা ভেঙে বেরোনো যাবে, তাই খুঁজে পাচ্ছিল না।
চন্দ্রভূষণ দেখিয়ে দিলেন সেই জায়গাটা।
চন্দ্রভূষণ ওদের উপকার করলেন।
চন্দ্রভূষণ যদি এখন ওদের বেরিয়ে যাওয়া দেখে পাঁজরের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করেন, সেটা হবে পাগলামি।
চন্দ্রভূষণের নিজের জীবনের নকশাও কি বদলায়নি?
তবে চন্দ্রভূষণ ভাবছেন না বদলাচ্ছি।
তা’ কেই বা ভাবে, আমি বদলে যাচ্ছি, আমি আমার নকশা বদলাচ্ছি! সবাই ভাবে, ‘ওরা বদলাচ্ছে।’ ভাবে, বদলাচ্ছে পারিপার্শ্বিকতা, বদলাচ্ছে দিন রাত্রির রং, আমিই শুধু ঠিক আছি, অবিকল আছি।
হ্যাঁ, তাই ভাবে সবাই, আমি যেমন ছিলাম তেমনিই আছি। আমার পরিবর্তন দেখে যে অন্যরা চমকে যাচ্ছে তা’ ভাবছি না।
চন্দ্রভূষণও তাই ছোট ললিতাকে নিয়ে ‘সংসার সংসার খেলা’র শখ মেটাতে বসেও টের পাচ্ছেন না, তাঁর জীবনের নকশা বদলে গেছে।
টের পাচ্ছেন না, কারণ দিনের কাজগুলো তো চলছেই প্রায় যথানিয়মে। সেই তো সক্কালবেলা উঠেই বাজার যাচ্ছেন, ঝাঁকামুটের মাথায় চাপিয়ে দিয়ে আসছেন প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় বস্তুর ভার। তার সঙ্গে নিত্য নিয়মে বাড়ির ক্ষুদে সদস্যদের জন্যে কিছু না কিছু খেলনা।
বাজার থেকে ফিরে ওটাই আমোদ চন্দ্রভূষণের। বাচ্চাদের নিয়ে খানিকক্ষণ হইচই। তারপর বৌমাদের ডেকে ডেকে রান্নার গল্প, বাজারের গল্প।
‘বুঝলে সেজবৌমা, যা ফার্স্টক্লাস কাঁকড়া দেখলাম বাজারে, ইচ্ছো হলো সবগুলো কিনে আনি, বেবিটার পেট ভাল নয় বলে আর আনলাম না। …বুঝলে ছোটবৌমা, ইলিশের জোড়াটা নিল ষোলো টাকা, কি আর করা যাবে, সব জিনিসের দামই তো আগুন, ওটা কিন্তু বামুনঠাকুরকে ছেড়ে দিও না বাপু, তুমি তোমার সেই তেলঝালের স্টাইলে রান্না করবে। …মেজবৌমা, তুমি কিন্তু বাপু আজ রেগে যাবে, মোচা এনে বসেছি। …তা’ এক কাজ করলে পারো, তোমাদের ওই ঝিটাকে দিয়ে কুটিয়ে নিলে পারো।’
এই সব কথা বাজারফেরত চন্দ্রভূষণের।
এ সময় ভাইরা ব্যস্ত থাকে স্নানে, দাড়ি কামানোয়, খবরের কাগজে, হয়তো বা ঘুমেও।
এরপর তারা এসে খেতে বসে।
অফিসের বাবুর রীতি অনুযায়ী সুটকোট এঁটে এক মিনিট মাত্র সময় হাতে রেখে। খাওয়াটাকে নিতান্ত বিরক্তিকর কাজের মত সেরে নেয়। চন্দ্রভূষণ তাদের খাওয়ার টেবিলের ধারে এসে বসেন, এবং অনুযোগ করতে থাকেন খাওয়ার পদ্ধতি এবং পরিমাপ নিয়ে।
বলেন, ‘অত তাড়াতাড়ি খাসনে সিন্ধু, হজম হবে না। খাওয়ার জন্যে আর একটু সময় হাতে রাখতে পারিস না?’ …বলেন ‘মাছ ভাজাটা ফেলে যাচ্ছিস যে বড় ইন্দু? কীরে? একখানা ভাজা মাছ খেতে কতক্ষণ যায়? …আর বিন্দু, নাঃ তুই দেখছি এই বুড়োবয়সে কানমলা খাবি। হয়ে গেল খাওয়া? সব ভাতই তো পড়ে রইলো… মেজবৌমা, দাও দিকি ওকে আর দুখানা ঝালের মাছ, কেমন ভাত ফেলে যায় দেখি! কী আশ্চর্য, আমি যে তোদের ডবল খাই!’ দোকানী মানুষ। খান গুছিয়ে—গাছিয়ে, সেটা মিথ্যে নয়।
নিজে বেরোন বেলায়, ওই অফিসের বাবু কটাকে পার করে দিয়ে তবে স্নান করতে যান। অতএব বৌদের আর কোনোদিন স্বামীদের পাতের কাছে বসে ‘এটা খাও’ ‘ওটা খাও’ বলার সুযোগ হয় না। কাজেই রাগ হয়।
নিজ নিজ পকেট ভেঙে, এবং নিজে খেটেখুটে যোগাড় করতে হলেও যে সে সুযোগ বেশী আসে না, তা’ অবশ্য বুঝতে পারে না। বুড়ো ভাসুরটি সামনে বসে থেকে আর ঘ্যান ঘ্যান করে কেবলমাত্র ওদের বিরক্তিই উৎপাদন করেন, এই ভেবে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয় তারা। বিরক্তিকর এই ঘ্যানঘ্যানানি। বুড়ো ভাসুরের উপকারিতাটুকু বুঝতে পারে না।
তবু কিছুদিন আগে পর্যন্তও ঠাট বজায় ছিল।
বৌমারা বলতো, ‘বাঃ একজন খাবে না বলে আনবেন না? কাঁকড়া আমরা কী ভীষণ ভালবাসি!’
বলতো, ‘ইলিশ মাছ আমি বামুনঠাকুরের হাতে ছেড়ে দেব? কী যে বলেন বড়দা?’
শেফালী সেকালের রীতিতে ভাসুর সমক্ষে নীরব থাকে, তবু একে ওকে দিয়ে বলাতো, ‘রাগ করবো কী বলুন, আপনি মোচা ভালবাসেন, আর আমি রাগ করবো?’
আজকাল আর তেমন উত্তর জোটে না।
আজকাল হয়তো বা উত্তরই জোটে না।
ভাইরাও প্রায় তদ্রূপ।
হয়তো একই ধরনের কথা শুনে শুনে সত্যিই ঘ্যানঘ্যানানি মনে হয়, হয়তো বা অলক্ষ্যে একজন উষ্ণ হচ্ছে ভেবে সংকুচিত হতে থাকে, তাই খোলামেলা উত্তর দিতে পারে না। আর হয়তো বা চন্দ্রভূষণের আকাঙক্ষা অনুযায়ী খাওয়া সম্ভব নয় জানে বলেই গ্রাহ্য করে না আর।
তবু বিন্দু সিন্ধু মেজদা ইন্দুর মত অতটা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেনি। তবু তারা হয়তো বলে, ‘আমাদের মত নটার সময় খেতে হলে তুমিও কেমন খেতে বুঝতাম!’
হয়তো বলে, ‘তোমার মনের মত খেয়ে ওঠা আমার কর্ম নয় দাদা!’
সেই বলার মধ্যে আগের মত ভালবাসায় গদগদ মধুর সুরটি ফোটে না। অন্তরহীন যন্তর থেকে উত্থিত শব্দের মত লাগে, তবু অভ্যাসটা থাকে।
ইন্দু চিরদিনই একটু কাঠখোট্টা।
ইন্দু চিরদিনই কথা বলে খটখটে শুকনো। কিন্তু এখনকার মত বিদ্রূপাত্মক কথা বলতো না কখনো।
আজকাল বলে।
তীব্র ব্যঙ্গের মুখে বলে, ‘বাজারটা তোমার, কিন্তু পেটটা আমার। তুমি ষোলো টাকার মাছ কিনতে পারো বলেই যে আমাদের সেটা খেতেই হবে, তার মানে নেই।’
বলে, ‘একগাদা খাওয়াই পরমার্থ নয়। বেশী খাওয়া অসংযমের জন্মদাতা!’
এই সূত্র ধরে বুঝি চন্দ্রভূষণের অসংযমের ইঙ্গিত করে।
কিন্তু চন্দ্রভূষণ সেটা বিশ্বাস করেন না।
চন্দ্রভূষণ ভাবেন, ইন্দুটা দিন দিন আরো কাঠখোট্টা হচ্ছে। হবেই। মেজবৌমাটির মধ্যে তো কোমলতার প্রাচুর্য নেই।
মেয়েরা যে শক্তির মূর্তি, তা’ ধরা পড়ে এইসব নমুনা থেকেই। বয়সে আট দশ বছরের ছোট একটা মেয়ে আস্ত একটা পুরুষকে কাদার ডেলার মত ভেঙে নিজের ছাঁচে গড়ে ফেলতে পারে।
সহসাই আবার উন্মনা হয়ে যান।
অন্য কত কি ভাবেন। আবার একসময় ভাবেন, এরা বড় বদলে যাচ্ছে!
চন্দ্রভূষণের চরিত্রহীনতা যে ওদের সেই বদলকে ত্বরান্বিত করে আনলো, সেইটাই শুধু বুঝতে পারেন না।
ওটা যে চরিত্রহীনতা সেটাই বুঝতে পারেন না বলে নাকি কে জানে!
হঠাৎ মনে করেন, যা ভাবছি তা’ নয়। সবাই ঠিক আছে। বাড়িতে অনেকদিন আমোদ আহ্লাদের আয়োজন হয়নি বলেই হয়তো ঝিমিয়ে যাচ্ছে। তখনই বেরিয়ে যান বোনেদের নেমন্তন্ন করতে। হয়তো বা ভাইদের শ্বশুরবাড়িতেও যান।
কিন্তু সেদিন ছন্দপতন হলো।
চন্দ্রভূষণ যেই বললেন, ‘এদের তো সব বলে এলাম। মাছ দুরকম কিনেছি, মাংস কতটা লাগবে বল তো সেজবৌমা?’
সেজবৌমা নির্লিপ্তগলায় বললে, ‘ঠিক বলতে পারছি না। তা’ছাড়া আমি তো থাকছি না আজ।’
আমি তো থাকছি না আজ!
এ আবার কি ভাষা!
সেজবৌমা না থাকলে সবদিক ম্যানেজ করবে কে?
চন্দ্রভূষণ বিমূঢ়ের মত বলেন, ‘তুমি থাকছ না?’
‘না।’
‘কোথায় যাবে?’
‘রিষড়েয় দিদির বাড়ি।’
‘কেন? সেখানে কি?’
চন্দ্রভূষণ বিস্ময়ের গলায় বলেন।
সেজবৌমা এ বিস্ময়কে আমল দেন না। অবহেলা ভরে বলেন,
‘কিছু না, অনেকদিন থেকে একবার বেড়াতে যেতে বলছেন দিদি—’
‘ওঃ কোনো অকেশান নয়?’ চন্দ্রভূষণ যেন অকূলে কূল পান, ‘তাহলে কাল পরশু যেও, আজ ওরা আসছে—’
সেজবৌমা আরো নির্লিপ্তের সুরে বলে, ‘আজ যাব বলে ঠিক করেছি। বদলে লাভ কি? সকলে তো রইলো, আমি একা না থাকলেই বা?’
আমি একা!
‘একা যাবে তুমি?’ চন্দ্রভূষণ আর একবার বিস্ময়াহত হন। সুনন্দা ভুরু কুঁচকে বলে, ‘আমি মানে আমাদের কথাই বলছি।’
ওঃ।
‘আমাদের’ মানেই ছেলে মেয়ে বাড়ী সমেত যাত্রা!
অথচ ভেটকির ফ্রাই ভালবাসে বিন্দু। যেটা আজ হচ্ছে।
আর সেজবৌমার ছোট ছেলেটা রাবড়ি দেখলে সবটা খেতে চায়। যা নাকি অধিক করে অর্ডার দিয়ে আনা হয়েছে।
তবু চন্দ্রভূষণ চেষ্টা করেন।
বলেন, ‘আজ বাড়িতে ভোজ, ছেলে মেয়েরা চলে যাবে?’
সুনন্দা মৃদু হেসে বলে, ‘মাসির বাড়ি যাচ্ছে যখন, খাবেই যাহোক।’
আর কি বলবেন?
উৎসবের বুকের উপরই তো একটা বিদারণ রেখা পড়লো। সেজবৌমারই তো সন্তানসংখ্যা সর্বাধিক। তারাই যদি না থাকলো!
আশ্চর্য, যাচ্ছেও তো ছেলেমেয়েগুলো বেশ হাসতে হাসতে!
জানে, বাড়িতে আজ পিসিরা আসবে, আসবে পিসতুতো ভাই বোনেরা—
ওই পিসিরা আর পিসতুতো ভাই বোনেরা চন্দ্রভূষণের কাছে যতখানি মূল্যবান, ততটা যে ওদের কাছে নয়, বোনেরা এলে চন্দ্রভূষণ উৎসবের যে রূপটি দেখতে পান, তা’ চন্দ্রভূষণের ভাদ্রবৌদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়, তা’ খেয়াল করেন না চন্দ্রভূষণ।
মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে আসছিলেন, হঠাৎ কোন ঘর থেকে যেন আওয়াজটা এলো, ‘শখের মধ্যে কতকগুলো বাজার করা আর বোনেদের গুষ্ঠীবর্গকে ডেকে খাওয়ানো! হাড় জ্বলে যায়! আর কারুর কিচ্ছু থাকবে না, খালি ওঁরই সব থাকবে! কেন বাবা, আরো তো নতুন নেশা হয়েছে, আর এসব কেন?’
চন্দ্রভূষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন। চন্দ্রভূষণ যেন বুঝতে পারলেন না এ কণ্ঠস্বর কার? চন্দ্রভূষণের সম্পর্কে এই ভাষা ব্যবহার করছে বিন্দুর বৌ!
চন্দ্রভূষণ পাথর হলেন।
কিন্তু তাঁর ভাদ্রবৌকে কি সত্যিই খুব দোষ দেওয়া যায়?
একটা বুদ্ধিমান লোক যখন অবিরত অবোধের মত কাজ করে যায়, আঘাত তাকে পেতে হবে বৈকি!
সারাদিন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কাটালেন।
ছোটবোন বললো, ‘দাদার কি শরীর ভালো নেই?’
চন্দ্রভূষণ বললেন, ‘আছে তো!’
মেজবোন বললো, ‘দাদা, তুমি আজ একেবারে কিছু খেলে না কেন বল তো?’
চন্দ্রভূষণ বললেন, ‘কই? খেলাম তো!’
ওরা অবশ্য আগের মতই নাকে মুখে চোখে গল্প করলো, কিন্তু এ কথা কি স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন চন্দ্রভূষণ, ওরা বোনেরা মজলিশ করে বসে দাদার ‘অধঃপতনে’র আলোচনা করছে, দাদার ‘বিমনা’ ভাবের কারণ নির্ণয় করে হাসাহাসি করছে!
হাসাহাসিই করে।
বৌদের মত অত গাত্রদাহ হয় না ওদের, তাই হাসাহাসি করতে পারে।
ওরা বলে, ‘নিজের ওই নতুন ভাব গোপন করতে দাদার কী চেষ্টা দেখেছিস? যেন কিছুই হয়নি, যেন যেমনটি ছিলেন তেমনটি আছেন। অথচ সর্বদাই মন উন্মনা।’
ছোটবোনের বরই সংবাদদাতা, কাজেই সে সব থেকে বেশী জানে। সে বলে, ‘যাই বল, এ ওই দেবুদা পাজীটার শয়তানীর ফল। নইলে এ তো বলেছিল, আশেপাশের কোথা থেকে যেন খবর জোগাড় করেছে, দেখতে নাকি একেবারে বাজে। একটা বাচ্চা চাকর রেখেছেন ‘মহিলা’, তাকে একটা টাকা ঘুষ দিয়ে খবর বার করে নিয়েছে ও, প্রত্যহ সন্ধ্যাবেলা নাকি হাজরে দেওয়া চাইই চাই।’
বড়বোন হেসে বলে, ‘মহিলা! মাগী বল। আগে নাকি তেলককাটা গেরুয়াপরা বোষ্টুমী ছিল, এখন সাদা কাপড় পরে।’
মেজবোন হেসে গড়ায়, ‘তা, সেটা না করে দাদা নিজেই তেলক কণ্ঠী ধারণ করে কণ্ঠিবদল করে নিলে পারতো! তাতে ধর্মের কাছে মুখোজ্জ্বল থাকতো।’
বড়বোন শখের ধমক দেয়, ‘থাম বাবু, আবার মুখোজ্জ্বল! বুড়ো বয়সের কেলেঙ্কারী! সারাজীবন সৎপথে থেকে—শেষে কিনা একটা বোষ্টুমী!
‘আহা বুঝছিস না মেজদি’, ছোট বোন হি হি করে, ‘দুর্ভিক্ষের খিদেয় লোকে কাঁচা কচুর ডাঁটা খায়, মরুভূমির তেষ্টায় কাদা জল খায়—’
‘কি জানি বাবা, বিয়ে না করা লোকও তো দেখেছি ঢের। এই তো আমারই পিসতুতো ভাসুর—’
‘আরে বাবা, পিসতুতো ভাসুর! কী জানো তুমি তার? দেখগে যাও খোঁজ নিয়ে কোন বেলেঘাটা কি আঘাটায় ডুবতে যাচ্ছেন!’
এমনি কথার স্রোত বহায় ওরা। যেটা নাকি স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না চন্দ্রভূষণ।
তবু আবার এই তিন বোনের মজলিশে এ কথাও ওঠে, ‘তা মরুকগে বাবু, বাইরে বাইরে যা করে করুকগে! বুড়ো বয়সে যে একটা বিয়ে করে গিন্নী এনে ঘরে ঢোকায়নি, এই আমাদের পরম লাভ। তাহলে আর বাপের বাড়িতে এসে একদিনের জন্যে দাঁড়াতে হত না। দাদা যাই আছে, তাই তবু এখনো এসে দাঁড়াতে পাচ্ছি।’
মতিগতি খারাপ হয়েছে বটে লোকটার, তবে স্নেহ মমতাটা কমেনি। অতএব দুর্বলতা ক্ষমা করা যায়। বরং বরেরা যখন হাসে, তখন তাদের সঙ্গে তর্কও করা যায়, ‘তা করা যাবে কি? রক্ত মাংসের মানুষ তো? সময়ে জোর করেছে, প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে!’
কিন্তু সত্যিই কি প্রকৃতির প্রতিশোধ?
চন্দ্রভূষণের যা ভঙ্গী, সেটা কি কারো প্রতিশোধ নেওয়ার ফল?
চন্দ্রভূষণ সারাদিন কাজ করেন আগের মতই অটুট উৎসাহ আর যুবকের কর্মক্ষমতা নিয়ে। চন্দ্রভূষণ সংসারের কি আছে নেই, কোন দিকে জল পড়ছে—অতএব কোনদিকে ছাতি ধরতে হবে, সে চিন্তায় সর্বদা তৎপর। চন্দ্রভূষণ নিত্য কাজে এতটুকু ঢিলে দেন না, শুধু চন্দ্রভূষণ সন্ধ্যারতির সময় দেবমন্দিরে গিয়ে বসার মত নিত্য অভ্যাসে সেখানে গিয়ে খানিক বসেন।
আর চন্দ্রভূষণের সারাদিনের সমস্ত কর্মের পিছনে আবহ সঙ্গীতের মত একটি মধুর আবেগময় সুর মৃদুমূর্ছনায় ধ্বনিত হতে থাকে—’গিয়ে বসবো!’
অ—ধরাকে ধরে বসে আছেন চন্দ্রভূষণ।
শুকনো চাঁপার ডালের মধ্যে নব চম্পকের সৌরভ আবিষ্কার করে বিভোর হয়ে আছেন।
এ যদি প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়া হয় তো তাই।
কিন্তু ওরা এত কথা জানে না।
ওরা হাসাহাসি করে। ওরা বলে ‘দাদা একটা দেখালো বটে!’
দিনটা কাবার হয়, ওরা চলে যায় আপন আপন বাড়িতে। রাতে থাকা বহুদিন বন্ধ হয়ে গেছে। জায়গা থাকলেও, বিছানাপত্তরের হ্যাঁপা সামলায় কে?
সে তো আর বাজার থেকে ঝাঁকা—মুটে দিয়ে কিনে আনবার নয়।
করতে হলে বৌরা।
কত আর পারবে তারা? ওই ননদরা একদা এ বাড়িতে জন্মেছিল বলেই যে মাথা কিনেছে তার মানে নেই।
ছিল একজন, হয়েছে এক ডজন, তবে?
বড়দার নাহয় পয়সা আছে, খরচ করছেন বোনেদের জন্যে। আনছেন, শাড়ি কিনে দিচ্ছেন, ওদের ছেলেদের খেলনা দিচ্ছেন, কিন্তু গতর খরচটি করে কে? নিজের তো গিন্নী নেই বাপু যে এত শখ চালাচ্ছ!
সর্বদা এই কথাই বলে ওরা।
অতএব বাপের বাড়িতে রাত্রিবাসের সৌভাগ্য বোনেদের হয় না।
অতএব ওরা চলে গেল!
চন্দ্রভূষণ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন দাঁড়িয়ে। বেচারারা বাপের বাড়িতে একটা রাতও কাটাতে পায় না।
দোকানঘরের পাশ দিয়ে সিঁড়িতে উঠে গেলেন চন্দ্রভূষণ। আস্তে জুতোটা খুললেন। দাঁড়ালেন।
সামনের ঘর থেকে বেরিয়ে এল একখানা হাস্যোৎফুল্ল মুখ, ‘কী? ঠকাতে পারলে?’
চন্দ্রভূষণকে ক্লিষ্ট দেখালো একটু। তবু হাসলেন।
বললেন, ‘কই আর পারলাম? কাকেই বা পারছি? নিজেই ঠকছি শুধু।’
‘নিজেই ঠকছো?’
ছোট ললিতা রেগে উঠে বলে, ‘নিজেই ঠকছো? অপমানিত হচ্ছি কিন্তু এ কথা শুনে।’
চন্দ্রভূষণ হাসেন।
হাসিতে আহ্লাদটা কম দেখা যায়।
বলেন, ‘চম্পা, শেষ পর্যন্ত দেখছি আমি একটা বোকা।’
ছোট ললিতা হেসে ওঠে। বলে, ‘শেষ পর্যন্ত দেখতে হলো? তা’হলে স্বীকার করতেই হবে বোকা।’
তারপর বললো, ‘চায়ের জল চারবার ঠাণ্ডা হয়েছে আজ।’
‘চা? নাই বা খেলাম আর। এইমাত্র—’
‘ঠিক আছে, আমি মরি মাথা ধরে।’
‘এই, আরে না না। বানাও তবে—’ চন্দ্রভূষণ বসে পড়েন চৌকির উপর।
‘মনটা যেন ভাল নেই মনে হচ্ছে?’
‘ঠিকই বলেছ, আজ বড় ধাক্কা খেয়েছি।’
‘ধাক্কা?’
হ্যাঁ, তা’ ধাক্কাই।’ ধীরে ধীরে সকালের সেই কথাটা বলেন চন্দ্রভূষণ। বিন্দুর বৌ তাঁর ‘নতুন নেশা’র কথা উল্লেখ করে ধিক্কার দিয়েছে।
কিন্তু ছোট ললিতা এ দুঃখে সহানুভূতি দেখালো কই?
ও যে হেসে একেবারে খানখান হলো।
চন্দ্রভূষণ অপ্রতিভভাবে বলেন, ‘অত হাসছো যে?’
‘হাসছি কি আর সাধে? হাসছি তোমার বুদ্ধি দেখে। এত বুদ্ধিমান ছিলে আগে, এত বোকা হয়ে গেলে কি করে বল তো? বুদ্ধির গোড়ায় বৌ না থাকলেই এই দশা হয়।’
হঠাৎ চন্দ্রভূষণ ঐ হাস্যবিধুরার দুই বাহুমূল চেপে ধরেন, রুদ্ধগলায় বলেন, ‘আগের কথা স্বীকার করলে তা’হলে এতদিনে?’
ছোট ললিতা তাড়াতাড়ি হাসি থামিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে, ‘ওমা শোনো কথা!… আগের কথা আবার কি? স্বীকার করাই বা কি?’
‘এই আগে চিনতে আমাকে! স্বীকার করনি কোনোদিন—এ পর্যন্ত শুধু রহস্যের আবরণেই রয়ে গেছো।’
কথাটা সত্যি।
কথাটা ঊনপঞ্চাশ বছরের তরুণ প্রেমিক চন্দ্রভূষণের কবিত্ব মাত্র নয়।
স্বীকার করে না ও। স্বীকার করেনি।
যেদিন রেলগাড়িতে চন্দ্রভূষণ সেই গেরুয়াধারিণীর সামনে গিয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘কে আপনি?’ সেদিন তো নয়ই, এখনো পর্যন্ত নয়।
‘তুমি চম্পা!’
‘চম্পা!’ ও হেসে উঠে বলেছিল, ‘কী মুশকিল! সেটা আবার কে?’
‘চাপা দিতে চেষ্টা কোরো না—’ চন্দ্রভূষণ সামনের সিটে বসে পড়ে নিজে চাপা উত্তেজিত গলায় বলেছিলেন, ‘আমাকে ঠকাতে পারবে না তুমি, গেরুয়া পরেও নয়। স্বীকার কর তুমি চম্পা।’
কিন্তু এত সাহস হয়েছিল কি করে চন্দ্রভূষণের, দুঃসাহসই বলা যায় যাকে? … ওই গেরুয়াধারিণী যদি একবার চেঁচিয়ে উঠে বলতো, ‘কাকে কী বলছেন?’ গাড়িসুদ্ধ লোক পিটিয়ে পাট করে ফেলতো না চন্দ্রভূষণকে?
কিন্তু চেঁচিয়ে ওঠেনি ও।
বোধকরি ওর চোখের দৃষ্টিতে ছিল প্রশ্রয়।
ওই গেরুয়াটা যে ওর ছদ্মবেশ মাত্র, সে কথা যেন মুহূর্তে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই দৃষ্টি। তাই ওর সামনের সিটে বসতে ভয় পাননি চন্দ্রভূষণ।
গাড়ির কেউ গ্রাহ্য করেছিল, কেউ করেনি।
নাকে রসকলি আঁকা পুঁটলি কাঁখে বৈষ্ণবী এমন একটা দুর্লভ দৃশ্য নয় যে, তাকিয়ে দেখবে লোকে।
হয়তো ভেবেছিল চেনাশোনা।
হয়তো বা ভেবেছিল, লোকটা গেরুয়ার প্রতি আকর্ষণশীল।
কেউ গ্রাহ্য করেনি।
গেরুয়া নিজেও নয়।
অবহেলার মত করেই বলেছিল, ‘হঠাৎ আপনাকেই বা ঠকাতে যাব কেন? আপনি কোথায়, আমি কোথায়, রাজশাহীটাই বা কোথায়?’
‘কোথায় সেটা যদি ভুলে গিয়ে থাকো, মনে পড়িয়ে দেব’, চন্দ্রভূষণ বলেছিলেন, ‘এখন কোথা থেকে আসছো?’
‘পৃথিবীর কোনো একখান থেকে।’
‘ওঃ তাই বুঝি। পৃথিবীর! তবু ভালো! প্রেতলোক থেকে নয়তো? ঠিক আছে। যাচ্ছ কোথায়?
‘জানি না।’
‘জানি না।’
‘ঠিক তাই। রেলগাড়িতে উঠে বসেছি, যেখানে ওর মর্জি নিয়ে যাবে।’
হেসে হেসেই বলে।
রেগে রেগে বলে না—’আমাকে খামোকা ‘তুমি’ করে কথা বলবার মানে? কে দিল এ অধিকার?’
বলে না।
তাই চন্দ্রভূষণই রেগে বলেন, ‘বাজে কথা বোলো না। টিকিট কেটেছ কোথাকার?’
বৈষ্ণবী বৈষ্ণবীর মর্যাদা ভাসিয়ে দিয়ে হেসে খানখান হয়ে বলেছিল, ‘টিকিট? গেরুয়া পরলে আবার টিকিট কাটতে হয় নাকি? ভারতবর্ষের এই মহান ব্যবস্থা, রেল কোম্পানির এই বদান্যতা জানা নেই আপনার?
চন্দ্রভূষণ অভিভূতের মত তাকিয়ে থেকেছিলেন সেই মুখের দিকে।
গাড়ির গতি পিছিয়ে পড়ছিল সেই নির্নিমেষ দৃষ্টির অন্তরালে উত্তাল উদভ্রান্ত মনটার থেকে। রেলগাড়ির চেয়ে দ্রুত ছুটছে সেই মন, ফেলে আসা লাইন ধরে।
রাজশাহীটা আবার কোথায়, বললেই কি ভোলাতে পারবে ও চন্দ্রভূষণকে?
একদিনই শুধু ভোলাতে পেরেছিল একজন। পেরেছিল ঠকাতে। সে হচ্ছে লক্ষ্মীছাড়া দেবু।
সবাইকে ঠকিয়েছিল। মিথ্যা কথা সাজিয়ে—
কিন্তু বেশীদিন ধরে রাখতে পারেনি সেই মিথ্যাকে।
হঠাৎ একদিন হাউমাউ করে কেঁদে বলে ফেলেছিল, ‘আমি মহাপাপী রে চানু, আমার পাপের ক্ষমা নেই! আমার দোষেই চম্পি—’
চানু নামের সেই বাইশ তেইশ বছর মাত্র বয়সের ছেলেটা ওর ঘাড়টা চেপে ধরতে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘বল কী বলতে যাচ্ছিলি? চম্পা কি?’
‘চম্পির সর্বনাশের কারণ আমিই রে চানু—আমার নরকেও ঠাঁই হবে না। তবু বিশ্বাস কর ভাই, আমি বুঝতে পারিনি, আমি শয়তানটাকে চিনতে পারিনি—’
সত্যিই পারেনি চিনতে। সত্যিই ঠকেছিল সে।
জামির যখন সেই জন্মাষ্টমীর মেলার দিনে বলেছিল, ‘এই দেবু, নদীর ওপারে এক ফকির এসেছে, ভূত ভবিষ্যৎ সব বলতে পারে, যাবি সেখানে?’
তখন দেবু উৎসাহে লাফিয়ে উঠেছিল, ভাবেনি এটা একটা শিকারের জাল।
কী করে ভাববে? জামির তো তার মত বয়সেরই একটা ছেলে মাত্র, কিন্তু জামির সেই জাল পেতেছিল। সরল আর স্নেহময় মুখ করে বলেছিল, ‘চম্পাকেও নিয়ে গেলে হয়! পরে শুনে হয়তো হায় হায় করবে।’
‘চম্পিকে মা ছাড়বে না।’
দেবু অমোঘ বাক্য উচ্চারণ করেছিল।
তবু শয়তান ছাড়েনি।
বলেছিল, ‘ছাড়বে না সে তো জানা কথা। গোলমালের মধ্যে থেকে চুপিচুপি বার করে আনবি, এই আর কি! কতক্ষণই বা লাগবে? যাব আর আসবো। যেতে আসতে বড়জোর মিনিট কুড়ি।’
‘ফকির যদি বসিয়ে রাখে এক ঘণ্টা?’
‘দূর! সে তো মুখ দেখেই বলে দেয় সব।’
মুখ দেখে ভূত ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে, এমন সাধু ফকির যে কখনো না দেখেছে দেবু, তা’ নয়, তাই অবিশ্বাস করেনি। শুধু মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘মা ঠিক জানতে পারবে, বকবে।’
‘তবে থাক।’ বড় যেন মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে এইভাবে বলেছিল জামির, তবে থাক! পরে শুনলে আপসোস করবে মেয়েটা, তাই—’
জামিরের ওই সহানুভূতির পরিচয়ে চম্পার নিজের ভাই দেবু লজ্জিত হয়েছিল, ভেবেছিল আমার থেকে ওর মমতাটা বেশী হচ্ছে। তাই বলেছিল, ‘আচ্ছা আনছি ডেকে।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন