আশাপূর্ণা দেবী
চন্দ্রভূষণের জীবনের প্রারম্ভে যে বিদারণ রেখা পড়েছিল, তা’ হয়তো মুছে যেতো, যদি অপদার্থ দেবুটা হঠাৎ সত্যবাদী হয়ে না উঠতো!
কিন্তু দেবু সত্যবাদী হলো।
তাই চম্পা নামের সেই ছোট্ট মেয়েটা তার উপর ঢেলে দেওয়া কালি মুছে ফেলে পরিশুদ্ধ হয়ে জেগে রইলো এক আলোকমণ্ডলে।
সত্যি—চম্পাকে তরুণ চন্দ্রভূষণ যতখানি ভালবেসেছিল, তার চেয়ে অনেকখানি বেশী ভালবাসতে শুরু করলেন প্রৌঢ় চন্দ্রভূষণ স্মৃতির চম্পাকে।
চম্পা তার দুর্ভাগ্যের সম্বলে ক্রমশই অধিকার করে বসলো চন্দ্রভূষণের সমগ্র সত্তাকে। চম্পা যেন একটা ধ্রুব—তারার মত জ্বলতে থাকলো চন্দ্রভূষণের অলক্ষ্য আকাশে।
তারপর সেই চম্পা মূর্তি ধরে এসে দাঁড়ালো।
চন্দ্রভূষণ ভাবলেন স্বর্গ এসে হাতের মুঠোয় ধরা দিল।
চন্দ্রভূষণ ভাবলেন, আপন হাতেগড়া স্বর্গের পরিমণ্ডলে বাস করবেন, আর সেই পূর্ণ হৃদয়ের আবেগ আর আনন্দ নিয়ে দণ্ড দুই এসে বসবেন হাতে আসা স্বর্গের দরজায়। আর কী চাইবার আছে?
আশ্চর্য!
চন্দ্রভূষণ নাকি একদা বুদ্ধিমান ছিলেন!
চন্দ্রভূষণ নাকি উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন!
চন্দ্রভূষণ নাকি জীবনের কর্ম শুরু করেছিলেন অধ্যাপনা দিয়ে!
অথচ চন্দ্রভূষণ অবিরত এক অবাস্তব বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়ে এলেন। চন্দ্রভূষণ ভাইদের মানুষ করতে আর বিধবা মাকে সান্ত্বনা দিতে, অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে দোকানী হতে এলেন সংস্কৃতির জীবন ত্যাগ করে। অতএব বোকা হয়ে গেলেন চন্দ্রভূষণ।
জীবনের একটা অবাস্তব নকশা এঁকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রইলেন।
তাই যখন তাঁর বিদ্যায় খাটো ছোট ভাই শান্ত স্থিরতায় ঘোষণা করলো ‘যা করতে হবে তা আইনসংগতভাবেই করতে হবে,’ তখন উত্তেজিত হলেন। হারানো মেজাজে উত্তেজিত গলায় বলে উঠলেন, ‘না হবে না। ভিটে ভাগ করা হবে না। সিন্ধুর যা টাকার দরকার, তা’ আমি পাঠিয়ে দেব, ব্যস!’
ইন্দু এবার অবহিত হয়।
ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
ইন্দু তাই আর একটু ধারাল ছুরি বার করে। বলে, ‘ওঃ! ওর পাতিলেবু পাঠানোর মত হাজার পঞ্চাশ টাকাটাও তুমি নিজের ক্যাশ থেকেই পাঠিয়ে দেবে? উত্তম কথা! তা’ আমাদের তো আর অতটা ভাগ্য হবে না, আমাদের ভাগের কী হবে?’
চন্দ্রভূষণের উত্তেজিত কণ্ঠে আকৃষ্ট হয়ে, অথবা স্বামীদের পাঠিয়ে দিয়ে, শেফালী আর সুনন্দা এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।
শেফালী ঘরের দরজায়, আর সুনন্দা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলো এবার।
কারণ সুনন্দা অন্ততঃ আর তার স্বামীর উপর আস্থা রাখতে পারছে না। চিরদিনের জবরদস্ত ভাসুর জবরদস্তির জোরে কি না কি করে বসবেন কে জানে!
হয়তো বলে বসবেন, ‘কারুর কোনো ভাগ নেই, বাড়ি একা আমার।’
বলতে পারেন জিদের মাথায়। দলিলটলিল তো চিরকাল ওঁরই কাছে। ভালমানুষ ভাইরা কোনোদিন বলেওনি ‘দেখি একবার।’
তা’ উনিও ভাল ছিলেন। কিন্তু এখন তো আর নেই! এখন তো মোহিনী মায়ার কবলে পড়ে কিম্ভূত হয়ে বসে আছেন। আগের সেই প্রকৃতির কী বিকৃতিই ঘটেছে! ছোট ছেলেগুলো ছিল প্রাণতুল্য, এখন যেন তাকিয়েও দেখেন না।
হাসিখুশির পাট নেই, সকাল থেকে বুঝভোম্বল হয়ে বসে আছেন, মুখে তালাচাবি লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, খাচ্ছেন, কাজে যাচ্ছেন, আর সন্ধ্যেটি হলেই সেই বাইজী বোষ্টুমীর মন্দিরে গিয়ে উঠছেন!
ছি ছি!
কী মানুষের কী পরিণতি!
তা’ এই যখন অবস্থা, তখন আর ওঁকে বিশ্বাস কি? দলিল এই বেলা বার করে নেওয়াই সমীচীন।
আর সেই জন্যেই রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করা সমীচীন।
নতুন রান্নাঘরে রান্না করা ইস্তক সুনন্দাকে আর বড় বেশী দেখতে পাচ্ছিলেন না চন্দ্রভূষণ। আজ পেলেন। ঘরের মধ্যে এসে নিজেই কথা বললো সে, ‘আমিও সেই কথা জানতে চাইছিলাম বড়দা, আমাদের কী হবে? ভেতরের বন্ধন যখন আলগা হয়ে গেছে, তখন আর বাইরে একত্র থাকার ‘শো’তে লাভই বা কি?’
খুবই অবশ্য নরম করে প্রশ্নটা করলো সুনন্দা, তবু চন্দ্রভূষণ নিজেকে যেন আক্রমিত মনে করলেন। আর এ আক্রমণটা নিতান্তই অপ্রত্যাশিত।
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন, আবার বসে পড়ে বললেন, ‘তা’হলে আমাকে কি করতে বল তোমরা?’
সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ, আর একটু পরেই দেবু দোকান বন্ধ করে খেতে আসবে, আজ আর এলেন না তা’হলে চন্দ্রভূষণ।
না, এত রাত করেন না কোনদিন।
একটু দেরি হয়ে গেলে, বৃষ্টিবাদল হলে, চম্পা হয়তো বলে, ‘এত কষ্ট করে আজ আর না এলেই হতো—’
চন্দ্রভূষণ হেসে উঠে জবাব দেন, ‘অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বলছো?’
‘কেন বলবো না? তোমার মত আমার অমন নেশাসক্তি নেই।’
চন্দ্রভূষণ বলেন ‘অপমানিত হচ্ছি কিন্তু!’
‘হ’লে তো বয়ে গেল! সত্যিকথা বলছি! অমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, কক্ষনো এইরকম বৃষ্টি বিদ্যুৎ বজ্রপাতের দিন শুধু মুখ দেখতে ছুটে আসতাম না। তোমার এটা স্রেফ নেশা!’
চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘শক্তি থাকলে তবে নেশাসক্তি, বুঝলে? দামী নেশা ‘যে—সে’ লোকের জন্যে নয়।’
চম্পা চা এনে জুৎ করে বসে।
চম্পার মুখের চারপাশ ঘিরে রুক্ষ চুল ওড়ে।
চন্দ্রভূষণ চৌকিতে বসে পা দোলাতে দোলাতে ঘরটায় চোখ বুলোন।
কী ছোট্ট ঘরটা চম্পার, কী ছোট ছোট জানলা দরজা!… মনে পড়ে যায় নিজের ঘরটার কথা।
সাবেক কালের চকমিলানো বাড়ি, তার ঠাটকাঠামোই আলাদা। কী উঁচু উঁচু দরজা, কত বড় বড় শার্সি খড়খড়িদার জানলা, দেড় হাত দু’হাত চওড়া কার্নিস! আর ঘরের মাপই বা কত বড়!
দেয়ালের রং বিবর্ণ হয়ে গেছে সত্যি, জানলা দরজা অনুজ্জ্বল, তবু মরা হাতী লাখ টাকা!
এ বাসা যেন পায়রার খোপ!
এখানে কি চম্পাকে মানায়?
কি করবেন, তখন তাড়াতাড়ি দেবুর ওই দোকান—ঘরটার ওপরই—আর শেষকালে সেটাই কায়েমী হল!
চন্দ্রভূষণ ভেবেছিলেন পরে ভাল দেখে বাসা খুঁজবেন, তা হয়নি। চম্পার এটাই পছন্দ।
চম্পা বলেছিল, ‘ছোট মানুষের ছোট ঘরই ভাল। কেন, ঘরটা কি বিচ্ছিরী লাগে তোমার?’
চন্দ্রভূষণ তাই মাঝে মাঝে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। এতটুকু ঘরে কেমন পরিপাটি করে সব গুছিয়ে রেখেছে চম্পা! দেখলে চোখ জুড়োয়! চন্দ্রভূষণের অতবড় ঘরটাতেও যেন কোনো শ্রী নেই। বিচ্ছিরি বললে সেটাকেই বলতে হয়।
চন্দ্রভূষণ হাসেন, ‘বিচ্ছিরী?’
চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘একটা ঘরের মধ্যে সব রেখেও কেমন সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছ চম্পা, আমার বাড়ির বৌমাদের দেখাতে ইচ্ছে করে।’
চম্পা হাসে। বলে, যারা জন্মাবধি অনেকখানি পাচ্ছে, তারা আর পাওয়ার মূল্য কী বুঝবে বল? ওরা গোড়া থেকেই অট্টালিকা পেয়েছে—’
চন্দ্রভূষণ সহসাই হয়তো প্রসঙ্গান্তরে চলে যান, বলেন, ‘চম্পা, তুমি চুল বাঁধ না কেন?’
চম্পা বলে, ‘সময় অত বাজে খরচ করতে ইচেছ করে না। কেন খুব খারাপ দেখায় বুঝি?’
‘খারাপ?’ চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘খারাপ দেখানো কথাটার মানে জানি না চম্পা, আমি শুধু তোমাকে দেখি, আর—’
চম্পা বলে, ‘শুধু দেখো এটা তো বড় খাসা কথা গো, তারপরও ‘আর’ কি?’
‘আর ভাবি বিধাতার এ এক অদ্ভুত অপচয়ের নমুনা!’
চম্পা মুখটা অন্যদিকে ফেরায়।
চম্পা বোধকরি চোখের জল বস্তুটাকে আয়ত্তে আনবার চেষ্টা করে।
চন্দ্রভূষণ তারপরই হয়তো বলে বসেন, ‘জানো চম্পা, আমি যখন কুচবেহার কলেজে পড়াতাম, তখন প্রতিদিন ভাবতাম হঠাৎ যদি তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, কি কি ধিক্কার দেব তোমায়, কোন কোন কটু কথা বলবো।’
চম্পা বলে, ‘ও হরি শুধু এই? শুধু কটু কথা? ছোরা নয়। বন্দুক নয়, নিদেন একটা থানইঁটও নয়, কেবল দুটো কটু কথা? কিন্তু কেন বল তো? নবদ্বীপের আখড়ার ছোট ললিতার ওপর এত রাগই বা কেন তোমার?’
তখনো যে চম্পা রহস্যের আবরণে থাকতে চাইতো।
তাই ও কথা বলতো।
চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘তখন বুঝতে পারতাম না, এখন বুঝতে পারি, নিজের অক্ষমতাই নিজেকে অহরহ পীড়ন করতো, আর সেটাই তোমার উপর উদ্যত হয়ে থাকতো।’
চম্পা বলে, ‘ওসব কথা থাক, তোমার মার কথা একটু শুনি বল।’
চন্দ্রভূষণের মার কথা!
চম্পার সে কথায় উৎসাহ কেন?
হয়তো চম্পা বুদ্ধিমতী বলে।
চম্পা জানে ওটাই চন্দ্রভূষণের প্রিয় প্রসঙ্গ।
চন্দ্রভূষণ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন ওর কথায়। শুরু করেন, ‘আগে বাবার আওতায় আচ্ছন্ন মাকে ঠিক ধরতে পারতাম না চম্পা, কত সময় তার জন্যে মায়ের উপর কত অবিচার করেছি। পরে দেখলাম—’
মায়ের গুণপনা, মায়ের বুদ্ধিমত্তা, মায়ের ধৈর্য, সহ্য, স্থৈর্য্য, বলতে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন চন্দ্রভূষণ।
আর উদাহরণগুলো শুনে শুনে হাসে চম্পা।
অতি সাধারণ আর জোলো জোলো উদাহরণ।
চম্পা বোঝে এ মহিমা অনেকটাই আরোপিত।
যে পুরুষের ‘সমীহর চোখ’ ভাগ হয়ে যায়নি, মা তার কাছে ষড়ৈশ্বর্যবতী!
মার কথা থেকে বোনেদের কথা, ভাইদের কথা, সংসারের কথা।
বৃষ্টির শব্দে চম্পা ব্যস্ত হয়, বলে, ‘ওঠো আর গল্প নয়, ভীষণ অবস্থা আকাশের—’
চন্দ্রভূষণ সহসা বদলে যান।
চন্দ্রভূষণ সহসা যুবকের গলায় বলে ওঠেন, ‘আমারও আজ ভীষণ অবস্থা—’
‘ওমা কেন?’
‘ইচ্ছে হচ্ছে পাদমেকং ন গচ্ছামি—তোমার এই ছোট্ট ঘরটাই বৈকুণ্ঠ মনে হচ্ছে—’
চম্পা রেগে ওঠার ভঙ্গিতে বলে, ‘বৈকুণ্ঠ কেন, বৃন্দাবন বল! যখন পাদমেকং ন গচ্ছামি! লোভ দেখিও না বলছি, ভাল হবে না।’
‘লোভ? তোমার? হুঁঃ!’
চন্দ্রভূষণ উঠে পড়েন।
বলেন, ‘এই জলে ঝড়ে তাড়িয়ে দিচ্ছ তো?’
চম্পা অপলকে তাকিয়ে বলে, ‘দিচ্ছি।’
চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘দেখো কাল আর আসব না।’
চম্পা বলে, ‘দেখো কাল আসতে হয় কিনা।’
চম্পার কথাই ফলেছে, আসতে হয়েছে।
চন্দ্রভূষণের নেশা ছুটিয়ে এনেছে তাঁকে ভবানীপুর থেকে বেলেঘাটায়।
কিন্তু আজ সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো। আজ ওই সরু সিঁড়িটায় চন্দ্রভূষণের পা পড়লো না।
অসুখ?
তা’ছাড়া আর কি!
লোহার মত অটুট শরীর বলেই যে হঠাৎ কিছু হতে পারে না, তা’ তো নয়। কী অসুখ? কে জানে খুব বেশী কি না!
চম্পা কি নেমে যাবে? দোকানে গিয়ে বলবে, ‘শুনুন খবরটা একবার নিতে পারেন? রোজ আসেন ভদ্রলোক?
দেবুদা কী ভাববে?
দেবুদা যদি বলে, ‘কী আশ্চর্য, একদিন মানুষের কাজ থাকতে পারে না?’
সত্যি, অসুখই বা ভাবছে কেন চম্পা, কাজ থাকতে পারে না মানুষের?
কিন্তু মনকে বাঁধা বড় শক্ত।
চম্পার ভাঙা ভাগ্যের মন অবিরত ভাঙতে থাকে চম্পাকে। চম্পা জানলার ধারে এসে দাঁড়ায়। আকাশে নক্ষত্রের মেলা…চম্পা ওইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দূর অতীতের একটা মেলার ভিড়ে হারিয়ে যায়।
কিসের মেলা?
জন্মাষ্টমীর বুঝি?
মাসী বলেছিল, ‘আমার হাতটা একবারও ছাড়বিনা চম্পি, খুব সাবধান!’
চম্পি তবু হাত ছেড়ে দিয়েছিল।
চম্পি ইচ্ছে করে অসাবধান হয়েছিল।
কারণ মাসীর ছেলে আস্তে ওর কাঁধে একটা টোকা মেরে চুপি চুপি বলেছিল, ‘এই শোন, জবর একটা খবর আছে—’
জবর খবর!
সেই খবরের উৎসাহে টুক করে মাসীর হাত ছেড়ে দিয়েছিল, মাসীর ছেলের সঙ্গে চলে এসেছিল। ওঃ তারপর সে কী ভয়, কী আগ্রহ!
ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান, সব জানা যাবে। সে কী সোজা রোমাঞ্চ! মাসী মেসোর ভয় ভেসে গেল।…চম্পা নদীতে ভাসতে এলো।
কিন্তু চম্পা কি নদীতে ভাসলো?
ভাসলো না।
চম্পা মরুভূমির বালুতে আছাড় খেল। কোথা দিয়ে কারা সব যেন এলো, কেমন করে যেন একখানা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়িতে তাকে তুললো…কোথায় যেন নিয়ে গেল সেই বোকা মেয়েটাকে।
জ্ঞান হলে বলে উঠেছিল সে, ‘জামিরদা, তুমি এই?’
জামির পিশাচের মুখে হেসে বলেছিল, ‘এই না হলে তোমায় পাবার উপায় কি ছিল বল?’
কিন্তু ক’দিনের জন্যেই বা পাবার গরজ ছিল তার? চম্পাকে বেচে কিছু পয়সা যদি পাওয়া যায়, সেটা বরং তার লাভ।
তারপর কতবারই বেচাকেনা হলো চম্পাকে নিয়ে! নবদ্বীপের আখড়াধারী মহারাজও তো পয়সা দিয়ে কিনেছিলেন তাকে!
চম্পা ক্রুদ্ধ গলায় বলেছিল, ‘আপনি তো দেখছি তেলককাটা বৈষ্ণব, আমি মুসলমানের উচ্ছিষ্ট তা’ মনে রাখবেন।’
বাবাজী হেসে বলেছিলেন, ‘নারী, স্বর্ণ আর ভূমি, এ কখনো উচ্ছিষ্ট হয় না রে পাগলী!’
তখনো চম্পা ভবানীপুরের একটা জানা ঠিকানায় একটা চিঠি লিখতে পারেনি। অথচ সে ঠিকানা খোদাই করা ছিল তার বুকে। এখনো রয়েছে। এখনও পারে চম্পা সেই ঠিকানাটা খুঁজে বার করতে।
দেবুদা কি টের পাবে?
একটা ট্যাক্সির গিয়ে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগে? চম্পা মনে মনে এগোতে থাকে।
চম্পার সে বাড়ির চেহারাটা শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে।
চম্পা তাদের দরজা দিয়ে ঢুকলো।
তারপর?
তারপর যাদের দেখতে পেল, তারা?
কিন্তু তাদের চেহারাই কি মুখস্থ হতে বাকি আছে? কে সুনন্দা, কে শেফালী, কে ইন্দু, আর কে বিন্দু, ঠিক বুঝে নেবে।…আচ্ছা বুঝে নেবার পর?
চম্পা মনকে খাড়া করে, কি আর? জিগ্যেস করবো, ‘চন্দ্রভূষণবাবু কেমন আছেন?’
চম্পাকে কি মারবে?
চম্পাকে কি পুলিসে ধরিয়ে দেবে?
করবে না তো ওসব কিছু, তবে? তবে কিসের ভয়? বড়জোর বলবে, ‘তুমি কে? তুমি কি সাহসে—’
তখন কী উত্তর দেবে চম্পা?
তার চাইতে চম্পা চিরতরে মুছে যাকনা!
চম্পাই তো সকল সমস্যার মূল!
তবে কেন চম্পা নিজেকে মুছে দেবে না?
হ্যাঁ, আজকের এই সুবর্ণ সুযোগে পালিয়ে যাবে চম্পা!
নিঃশব্দে নেমে গিয়ে একবার শেয়ালদা স্টেশন পর্য্যন্ত পৌঁছতে পারলেই তো নিশ্চিন্ত। না, বিশেষ কোনো জায়গার উদ্দেশে শেয়ালদা স্টেশনের কথা ভাবছে না চম্পা, ওটাই কাছাকাছি তাই! ট্রেনে একবার চড়ে পড়তে পারলে গয়া, কাশী, বৃন্দাবন, যেখানে হোক যাওয়া যাবেই। জংশনে নেমে বদল করে।
তা’ ওতে চম্পা পোক্ত আছে।
পালানোটা তো আজকের নতুন নয়। বরং পালানোটাই পেশা। কতবারই পালালো!…
কখনো দিনের আলোয়, কখনো রাতের অন্ধকারে, কখনো পাশের লোকের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মুহূর্তে ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে।…
কিন্তু পালিয়ে গিয়ে খেয়া নৌকায় চড়ে বসতে পেরেছে কবে? স্রোতে ভেসে ভেসে একটু এগিয়েই হয়তো বালির চড়ায় আছাড় খেয়েছে, হয়তো কুমীরের দাঁতে পড়েছে।
আশ্চর্য্য, তবু মরতে পারেনি চম্পা।
কোন পরম প্রাপ্তির আশায় যে ওই পালানোর পেশা নিয়ে সাত ঘাটের জল খাচ্ছে কে জানে! মনে হয়েছিল নবদ্বীপের সখীকুঞ্জের ছোট ললিতা বুঝি টিকে গেল। হয়তো শেষ পর্য্যন্ত ওই নামগান করতে করতেই চুলে পাক ধরবে, দেহে ভাঙন ধরবে, আর কোনো একদিন ওর উঠোনের তুলসীমঞ্চের নীচে শেষশয্যা বিছোবে।
তা’ সেটা হলেই তো উদ্ধার হতিস চম্পা!
তোর সেই শেষশয্যাকে ঘিরে নিশ্চয়ই খোল করতালের সমারোহ বসতো, নিশ্চয়ই তোর প্রাণবায়ুটা উচ্চতানের ধাক্কায় ধাক্কায় উচ্চলোকে উঠে যেত!
কিন্তু অমন আকাঙিক্ষত পরিণাম, যা নাকি মনুষ্যজন্মে দুর্লভ, তা তোর পছন্দ হল না, তুই তোর মালিককে ঠকিয়ে গেরুয়ার ভেক নিয়ে আবার কেটে পড়লি অকূলের উদ্দেশে।
কি হল এসে?
বল কি হল?
ছাইচাপা আগুনকে বাতাস দিয়ে উস্কে নিজে পুড়লি, আর একজনকে পোড়ালি! তোর এই বে—আইনি অনুপ্রবেশের ফলেই তো লোকটার সর্বস্ব গেল।
মান গেল, সম্ভ্রম গেল, সংসারের স্নেহ ভালবাসা শ্রদ্ধা সমীহ সব গেল, এখন কে জানে প্রাণটাও যায় কিনা!
এই তো নিত্য নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো!
কে বলতে পারে, হঠাৎ কোনো শক্ত অসুখ কিনা, রাস্তায় কোনো এ্যাকসিডেন্ট কিনা! না না, চম্পা আর ভাবতে পারে না। আর ভয়ঙ্কর কিছু শুনতেও পারবে না। এখানে এসে অনেক পেয়েছে চম্পা, সেই ‘পাওয়া’র পূর্ণতাখানি নিয়ে, তার পেশামত কাজটাই করবে আবার!
সিঁড়িটায় বসে পড়লো।
পিছন দিকে ঘরের দরজার পানে তাকালো একবার। তারপর যেন নিজেকে নিজে ব্যঙ্গ করে হেসে উঠলো।
গোছগাছ?
পালাবার আবার গোছগাছ কি?
কবে আবার গুছিয়ে গাছিয়ে পালিয়েছে চম্পা?
তবু এবার গুছিয়ে নিয়েছিল একটু।
ঠাকুরের ছবি, হরিনামের মালা, তিলকমাটি, গেরুয়া, গামছা! আবার কি সেইগুলো সম্বল করে পথে ভাসবে?
গেরুয়ার একটা সুবিধে।
গেরুয়ার আবরণে নিজেকে ঢেকে বেড়ালে চারিদিকের সহস্র চক্ষু তেমন প্রশ্নে মুখর হয়ে ওঠে না। একটা গেরুয়া মোড়া জীব পথে পথে ঘুরবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে!
পথই তো ঘর ওদের!
ছোট সেই ঘরখানায় এসে দাঁড়ালো।
একখানি যুগলমূর্তির ছবি, একটা পেতলের ঘটি। একটা দড়ির আলনায় একপাশে পরিত্যক্ত হয়ে ঝুলে আছে সেই রক্ষাকবচের পোষাক।
পরে নিল স্বপ্নাচ্ছন্নের মত, প্রেতে পাওয়ার মত।
যেন চম্পা নয়, যেন আর কেউ।
যেন চুরি করতে এসে ভুলে ভুলে যাচ্ছে কি করতে এসেছে।
টাকা নিতে হবে।
টাকা ছাড়া পথে গতি নেই।
মনে মনে বললো, তোমার টাকা, তোমার বিশ্বাস, তোমার সুখ সব চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছি। তুমি আমায় ধিক্কার দেবে? ঘৃণা করবে? মন থেকে মুছে ফেলবে?
তাই ভাল!
তাই ভাল!
দেবুদা কাল দোকানের টাকা রেখে গেছে আমার কাছে, নিলাম সে টাকা। দেবুদা ব্যঙ্গের হাসি হাসবে। বলবে, ‘হুঃ! জানতাম! পথের ‘কুকুরকে মন্দিরে উঠতে দিলেই কি সে তার স্বভাব ছাড়ে?’
দরজাটা ভেজিয়ে দিল।
সিঁড়িটার মাথাটায় দাঁড়িয়ে রাস্তাটার দিকে যতদূর চোখ চলে দেখল।
এখন রাত হয়ে গেছে। এসব রাস্তা এখন জনবিরল। যদি একটা বোষ্টুমী ভিখিরি যায়ই, বড়ো কারো চোখে পড়বে না।
সিঁড়িতে নামতে গিয়ে একবার বসে পড়ল চম্পা, কে জানে কি ভেবে সিঁড়ির ধুলোতে একটু হাত ঠেকিয়ে মাথায় ঠেকালো। তারপর আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল।
রাস্তায় পড়লো।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সেই আশ্চর্য দৃশ্যটা দেখতে পেল।
চন্দ্রভূষণ হতাশ গলায় বললেন, ‘তা’হলে আমাকে কী করতে বল তোমরা?’
ওরা একটু ইতস্ততঃ করলো, তারপর কাঠখোট্টা ইন্দুই ভার নিল, ‘করবার তো একটাই রাস্তা পড়ে আছে। এ বাড়িকে সেপারেট চারটে ভাগে ভাগ করা অসম্ভব। যেমন প্ল্যানের শ্রী, তেমনি ব্যবস্থা জমি ‘ওয়েষ্ট’ করবার একটা দৃষ্টান্তস্বরূপ! সে যাক, বাড়ি ভাগ যখন সম্ভব নয়, তখন বিক্রি করে টাকাটা ভাগ করে নেওয়াই বেষ্ট!’
বিক্রি করে!
বাড়িটা বিক্রি করে!
সেই হাতুড়িটা যে এবার সমস্ত স্নায়ুর উপর দমাস দমাস করে ঘা মারছে।
সেই আঘাতে চন্দ্রভূষণের প্রশ্নটা শিথিল হয়ে গেল, ‘কী? কী বললি?’
‘ভয়ঙ্কর অদ্ভুত কিছু বলিনি দাদা! বাড়িটা বিক্রির কথা বলছি।’
চন্দ্রভূষণ আস্তে বলেন, ‘এই বাড়িতে মা বাবার বিয়ে হয়েছিল ইন্দু, এ বাড়িতে আমরা সবাই জন্মেছি। এ বাড়িতে আমাদের মায়ের পুজোর ঠাকুর, লক্ষ্মীর কাঠা!’
ইন্দু এই ভাবপ্রবণতার দিকে ব্যঙ্গদৃষ্টি হেনে বলে, ‘সাবেকী বাড়িতে ওসব থেকেই থাকে। খুব একটা অভাবনীয় কিছুই নয়। তবু বাড়ীবিক্রি বলে একটা কথাও আছে। বহু অসুবিধের মধ্যেই কাটাতে হচ্ছে আমাদের। ওসব সেন্টিমেন্ট ধুয়ে জল খেয়ে লাভ নেই।’
‘অসুবিধের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে? এই বাড়িতে অসুবিধেয় কাটাতে হচ্ছে তোমাদের?’ স্বর আরো শিথিল, আরো স্খলিত—
যেন চন্দ্রভূষণকেই অক্ষমতার অপবাদ দিয়েছে কেউ।
ইন্দু তার স্বভাবসিদ্ধ কাঠিন্যের সুরে বলে, ‘তা’ হচ্ছে বৈকি! তোমার আর কি! তোমার না আছে বৌ, না আছে ছেলে, তুমি কী বুঝবে?’
তা’ যদি বৌ ছেলে না থাকলে বোঝা না যায়, নাচার। চন্দ্রভূষণ বুঝলেন না। চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘বেশ তো, যা যা অসুবিধে ঠিক করে নাও না? রাজমিস্ত্রী, ছুতোরমিস্ত্রী, কি চাই বল।’
সুনন্দা ভয় পায়, শেফালী ভয় পায়। কে জানে হঠাৎ আবার কোন দানপত্রে সই পড়ে যায়। দাদার সামনে পড়লেই তো অন্যরকম হয়ে যান লক্ষ্মণভাইরা। তবু আজ তো একটু—
সুনন্দা বলে ওঠে, ‘এই তিনপুরুষের ভাঙা পুরনো বাড়িকে ঠিক করে নেবার ইচ্ছে আর নেই বড়দা, বড়বাড়ির মোহ ঘুচে গেছে। সামান্য টাকায় ছোট্ট একটু বাড়ি করে অবস্থা অনুযায়ী চলতে চাই।’
অবস্থা অনুযায়ী চলতে চাই! নিজেরা নিজেদের চালাতে চাই!
এই ওদের ইচ্ছে।
এরপর আর কী বলবার আছে চন্দ্রভূষণের? আবারও কি বলবেন, ‘বেশ তো তাই চল না, অসুবিধেয় পড়লে আমি আছি।’
তা’ এটাই তো অভ্যস্ত কথা।
বরাবর তো এই কথাই বলে এসেছেন চন্দ্রভূষণ, ‘ভাবছিস কেন, আমি তো আছি!’ ছেলেদের অসুখে, চাকরির গোলমালে, সর্বদা ওই অভয়বাণী যুগিয়েছেন ছোট ভাইদের।
‘ভাবছিস কেন, আমি তো আছি।’
সিন্ধু দূর থেকেও লিখেছে সেকথা, ‘অসুবিধে কি, তুমি তো আছ।’
কিন্তু আজ এদের সামনে সেই অভ্যস্ত কথাটা বলতে পারলেন না চন্দ্রভূষণ। শুধু বললেন, ‘নেহাৎ দুঃখের দশায় না পড়লে কেউ তিনপুরুষের ভিটে বেচে না সেজবৌমা!’
সেজবৌমা আরো নরম গলায় বলে, ‘এটা একটা কুসংস্কার বড়দা! মানুষের জন্যেই বাড়ি, বাড়ির জন্যে মানুষ নয়। এ বাড়িটার দামই আছে, সৌন্দর্য সুবিধে কিছুই নেই। এর বিনিময়ে যদি অনেক ভালভাবে থাকা যায়, থাকব না কেন?’
চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘তার মানে এর মধ্যে ভাগ করে নিয়ে স্বতন্ত্র হয়ে থাকাতেও তোমাদের আনন্দ নেই, কি বল? চিরকালের আশ্রয়কে রাস্তার একটা লোকের হাতে তুলে ধরে দিতে পারলেই তোমাদের শান্তি?…বিন্দু ইন্দু, তোদেরও তা’হলে তাই মত?’
ওরা দুজনেই বলে ওঠে, ‘তা’ সেটাই যখন সহজ ব্যবস্থা! ভাগ করতে গেলেও তো সুবিচার হয় না। কে দক্ষিণ নেবে, কে পশ্চিম নেবে? এই যে আমি বরাবর উত্তর ধারের ঘরে থাকি, অথচ বাড়িতে দক্ষিণখোলা ভাল ঘরও আছে।’
চন্দ্রভূষণ সহসা স্তব্ধ হয়ে যান।
চন্দ্রভূষণের চোখের সামনে তাঁর নিজের ঘরের বড় বড় দুটো জানলা যেন দক্ষিণের খোলা হাওয়ায় আছড়ে পড়ে।
বাড়ির মধ্যে সবসেরা ঘরটাই চন্দ্রভূষণের।
সুষমাই বড় ছেলেকে সবচেয়ে ভাল আর বড় ঘরটা দিয়ে রেখেছিলেন, ভারী ভারী পুরনো আসবাবপত্র সমেত। যেটা নাকি তাঁর নিজের ছিল। আর সব ভাইদের বিয়ে হয়েছে, নতুন খাট আলমারি আরশি হয়েছে, চন্দ্রভূষণ সেই সাবেকী গুলোর মধ্যেই নিমজ্জিত আছেন। তার মানে সব থেকে বেশী সুবিধে নিচ্ছেন। এর যে রদবদল সম্ভব ভাবেননি কখনো।
কী স্বার্থপরতা!
কী নির্লজ্জতা!
আর এই নির্লজ্জ স্বার্থপরতার দিকে চিরদিন তাকিয়ে থেকেছে চন্দ্রভূষণের ছোটভাইরা।
চন্দ্রভূষণ আস্তে বলেন, ‘বেশ, তোমরা যা ভাল বোঝ কর।’
‘ঠিক আছে—’ ইন্দুর কাঠখোট্টা গলাও কিঞ্চিৎ উৎফুল্ল শোনায়। হয়তো ইন্দু ভাবেনি এত সহজে অনুমতি পাওয়া যাবে। ‘জয়েণ্ট প্রপার্টির’ জ্বালা যে অনেক! একজন আপত্তি তুললেই তো বিক্রী নাকচ।
আপত্তি রইলো না, ইন্দু তাই উৎফুল্ল গলায় বললো, ঠিক আছে। সিন্ধুকে তা’হলে সেটাই লিখে দিই? বলি একটা পার্টি ঠিক করে ফেলে তোমাকে খবর দিচ্ছি, যথাসময়ে চলে এসো এবং—’
চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘লিখতে পারো, তবে টাকাটা ওকে আজই পাঠাতে হবে, লিখেছে খুব তাড়াতাড়ি দরকার—’
বিন্দু হঠাৎ অনুচ্চ একটু হেসে ওঠে।
সেই হাসির সঙ্গে মৃদু ব্যঙ্গের একটু মন্তব্য, ‘আপনিও যেমন, তাই ওই শেয়ার কেনার কথা বিশ্বাস করছেন! ওটা একটা প্যাঁচ! এ বুঝছেন না? হঠাৎ বাড়ি বেচার কথা বলতে ইয়ে হয়েছে।’
চন্দ্রভূষণ সেই ‘প্যাঁচ’ বুঝে ফেলা মুখটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তারপর নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ঈশ্বর যে আমায় বুদ্ধি কম দিয়েছেন, তার জন্যে ধন্যবাদ!…যাক আরো প্রস্তাব তোমাদের আমি দিচ্ছিলাম—সিন্ধুর টাকাটা যখন যোগাড় করাই হয়ে গেছে, পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর আমিও স্থির করছি—বিজনেস ছেড়ে দিয়ে সামান্যভাবে কোথাও গিয়ে থাকবো, কাজেই এ বাড়ির ভাগে আমার প্রয়োজন নেই। শুধু তোমরা দুই ভাই যদি থাকো, সুবিধে করে নিতে পারবে না? অবশ্য বিক্রি না করে!’
বিন্দু ভুরু কুঁচকে বলে, ‘তার মানে তুমি স্বত্ব ত্যাগ করছো?’
‘ধরে নাও তাই!’
যুগপৎ দুই দুই চার জোড়া চোখের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায়, ওঃ বোঝা গেছে রহস্য! এইবার পাকাপাকিভাবে ‘সেইটার’ বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকবেন! কিন্তু টাকার ব্যাপারটা—
বিন্দু হয়তো এটাতে খুব লোকসান মনে করছিল না, ইন্দুও না। কিন্তু সহসা ঘোমটার অন্তরাল থেকে একটি নীরব কণ্ঠস্বর বেজে উঠলো, ‘বটঠাকুরকে জানিয়ে দাও সেজঠাকুরপো, তা’ হয় না। এটা হচ্ছে দান গ্রহণ! আমাদের গুরুদেবের শিক্ষার প্রধান নিষেধ ‘দান গ্রহণ’ না করা!’
বটঠাকুরকে অবশ্য আলাদা করে জানাতে হলো না। তিনি বললেন, ‘ওঃ আচ্ছা! ঠিক আছে।’
বিন্দুর মনে হলো প্রস্তাবটার গোড়ায় বড় চট করে কোপ পড়লো। মেজগিন্নীর সর্দারীটা বড় বেশী। ধর্মের ধ্বজা একেবারে!…বললো, ‘তা’ তোমার এতে তো লাভ হচ্ছে না কিছু!’
চন্দ্রভূষণ বললেন, ‘বড় টায়ার্ড লাগছে বিন্দু, আমি একটু বিশ্রাম করবো।’
অর্থাৎ চলে যাও ঘর থেকে।
আর কি!
বিন্দু এবং ইন্দু দুজনেই শেফালীর দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যায়। ভাবপ্রবণ দাদা ঝোঁকের মাথায় করে বসেছিলেন একটা বড় দানপত্রে সই, হলো না ওর সর্দারীর জন্যে! আড়ালে একটা পরামর্শ করবি তো?—
সুনন্দা অবশ্য ক্ষুব্ধ হয় না।
সুনন্দা আর এই পুরনো বাড়ির ভারী দেওয়ালের খাঁজে আটকে থাকতে চায় না।
আর এখানে থাকা মানেই তো সর্ববিধ ঠাট বজায় রাখা! সেই গৃহদেবতা, সেই লক্ষ্মী, ষষ্ঠী, মনসা, মাকাল, উঃ! এর আওতা থেকে বেরিয়ে না পড়লে মুক্তি নেই।
আজকের এই ঘরভাঙা ঝড়ওঠা উত্তাল যুগে কে তার পিতামহীর মত সন্ধ্যাবেলায় গলায় আঁচল দিয়ে তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে বসছে?…কে ভোরবেলা উঠে তার বালিকা কন্যাদের নিয়ে ‘পুণ্যিপুকুর’ ব্রতের পুণ্যি অর্জন করাতে যাচ্ছে? কে সেই সহস্র নীতি নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে থেকে আবহমানের ধারা রক্ষা করছে?
কেউ না।
হয় না তা’।
অথচ এইরকম সাবেকী বাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন সেই ধারা রক্ষার অনুশাসন নিঃশব্দ ভঙ্গিতে তর্জনী তুলে শাসাচ্ছে।
এই ইঁট কাঠের শাসন থেকে পালানো চাই।
পালানো চাই বড়ভাসুরের ভাবপ্রবণতার কবল থেকে। পুরনো ধারার নিজে তিনি হন্তারক, শুনতে পাওয়া যায় এ সংসারে যে সামান্যতম আধুনিকতা প্রবেশ করেছে, তা’ তিনিই এনেছেন। অথচ তিনিই হঠাৎ হঠাৎ বলে বসবেন, ‘আচ্ছা মেজবৌমা, আগে সেই মা যে ‘অরন্ধন’ না কি করতেন, সে তোমরা কর না আর?…আচ্ছা মেজবৌমা, এ বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো হয় না কেন বল তো? আমাদের ছেলেবেলায় সত্যনারায়ণ পুজো রীতিমত একটা উৎসব ছিল। তোমাদের ছেলেমেয়েরা সেসব কিছুই দেখলো না!’
যেন আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে আর কোনো আমোদ প্রমোদের আয়োজন নেই!
যেন ওরাও তোমাদের মত সত্যনারায়ণ পুজোকে একটা উৎসব ভাববে!
এই অবাস্তববুদ্ধি মানুষটির জন্যেই আরো—
বাস্তবিকই অবাস্তববুদ্ধি!
অথচ চন্দ্রভূষণ নিজে টের পান না সে খবর। চন্দ্রভূষণ একদিকে একান্নবর্তী সুখী পরিবারের স্বপ্ন দেখেন, আর অপর একদিকে হারানো—প্রেমকে খুঁজে ফিরিয়ে পেয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করবার স্বপ্ন দেখেন।
চন্দ্রভূষণ ভাবেন, আমি যদি যথাসময়ে বিয়ে করতে পেতাম, চম্পা কি এ সংসারের ‘একজন’ হতো না?
এখনই বা তবে হবে না কেন?
যদি আমার বিবাহিতা স্ত্রীই ভাগ্যবিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশ থাকতো? ফিরে এলে ফিরে নিতাম না?
বিবাহিতাই যদি বলি।
আকাশের চন্দ্র সূর্য সাক্ষী করে কি একদিন প্রতিজ্ঞা করিনি আমরা—তুমি আমি এক!
হতে পারে সে কৈশোরের উচ্ছ্বাস, তবু তা’ সত্য!
আমার পিসির বিয়ে হয়েছিল ন’ বছর বয়সে, দশ বছর না পুরতেই পিসি বিধবা হয়েছিল। সেই বৈধব্যকেই তো পিসি ‘পরম সত্য’ বলে আঁকড়ে থেকেছে ঊনষাট বছর বয়েস পর্যন্ত।
সে যে শুধুই সামাজিক শাসনে খাওয়া পরায় বঞ্চিত থাকা নয়, সে যে মনেপ্রাণে অনুভব করা—’আমার সব শেষ হয়ে গেছে, আমি একদা উৎসর্গীকৃত’, তা’ কি বোঝা যেত না?
কিসের এই হৃদয়ের বন্দীত্ব?
শুধু একটা অনুষ্ঠানের স্মৃতি, এই তো? আজীবন কৌমার্য নিয়েও পিসি জানতেন তিনি বিবাহিতা, জানতেন তিনি একজনের সম্পত্তি। মালিক তাঁকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে বলেই যে তিনি মুক্ত তা’ নয়।
শুধু তাই নয়। পিসির শ্বশুরবাড়ির কি কি কুলপ্রথা, কি কি নীতি নিয়ম, তা’ তাঁর জ্ঞাতিগোত্রকে জিগ্যেস করে করে জেনে নিয়ে, সেই প্রথা নিয়মের মধ্যে চলতেন পিসি।
জীবনে কখনো শ্বশুরবাড়ির ভাত খাননি, ‘অপয়া’ বলে তারা ঘরে নেয়নি, তবু পিসি যখন তখন বলতেন, ‘আমার শ্বশুরবাড়ির এই নিয়ম।’
এ বন্ধন ‘সত্যে’র মূল্যবোধের বন্ধন!
চন্দ্রভূষণও বাঁধা পড়ে আছেন সেই মূল্যবোধের বন্ধনে। চন্দ্রভূষণের ধারণা ছিল চম্পা নেই, চম্পা হয়তো আত্মহত্যা করেছে। তবু চন্দ্রভূষণ আর বিয়ের কথা ভাবেননি, ভাবতে পারেননি।
এখন চন্দ্রভূষণ জানলেন, চম্পা আছে। আছে পতিত হয়ে, কলঙ্কিত হয়ে, অপবিত্র অশুচি হয়ে।
কিন্তু চন্দ্রভূষণ একথা বললেন না, ‘কেন তুমি মূর্তি হয়ে এলে, রহিলে না ধ্যান ধারণায়’!
চন্দ্রভূষণ কৃতার্থ হলেন। চন্দ্রভূষণ ভাবলেন, ভাগ্য ওকে যেখানেই এনে ফেলুক, ও তো নিজে অশুচি নয়।
চন্দ্রভূষণ প্রগতিশীলতার পরাকাষ্ঠা দেখালেন—যে চন্দ্রভূষণ তাঁর ভাদ্র—বৌদের বলেন, ‘তোমাদের মেয়েরা ভোরবেলা সেই ব্রতট্রত করে না মেজবৌমা? এসব আর তোমরা মানো না বুঝি?’
হ্যাঁ, এ প্রশ্নও করেন চন্দ্রভূষণ।
মেজবৌমা মায়ের আমলের বৌ, তাই মেজবৌমার কাছেই সব প্রশ্ন।
অথচ নিজেকে এ প্রশ্ন করেন না, ‘তুমি এত সংস্কার—মুক্ত হলে কি করে হে বাপু?’
চন্দ্রভূষণ হয়তো একটা আশ্চর্য ‘উল্টোপাল্টা’র সমষ্টি! চন্দ্রভূষণ তাই অনায়াসেই অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটাতে পারেন।
যার ফলে চন্দ্রভূষণের বড় বড় ছোটভাইরা লজ্জায় মাথা হেঁট করে, আর মুখ বাঁকিয়ে বলে, ‘জানতাম শেষ পর্যন্ত এইরকমই হবে।’
বলে, ‘কত রাত অবধি তো বসেছিলেন, গেলেনই বা কখন? ছি ছি এত কদর্য নেশা! একটা দিন বন্ধ করতে পারেন না?’
চম্পা যখন দেবুর দোকানঘরের সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছিল, দেবু তখন দোকান বন্ধ করবে বলে পিছন ফিরে জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল, দেখতে পেল না চম্পাকে।
চম্পা একবার ডাকতে চেষ্টা করেছিল, গলাটা কেমন শুকনো শুকনো আর ক্ষীণ হয়ে গেল।
দেবুর কানে পৌঁছলো না।
চম্পা আর চেষ্টা করেনি।
চম্পা ভাবতে চেষ্টা করেছিল, এত উতলা হবার কোনো মানে হয় না।
সত্যিই তো কত কারণ থাকতে পারে। ওর অসুখ করেছে, ও অ্যাকসিডেণ্ট ঘটিয়েছে, এত সব ভাবতে বসছি কেন?
তারপরই ভাবলো, এই অবস্থাটা অবাস্তব। এরকম চলতে দেওয়া উচিত নয়। আমি চলে যাব।
আমি চলে যাব।
ওকে না জানিয়ে চলে যাব। আমি আমার দুর্ভাগ্যের পসরা নিয়ে ওর জীবনকে আর পীড়িত করবো না।
কিন্তু যাওয়া হল কই? সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটলো যে তখুনি!
চন্দ্রভূষণ আসছেন।
সহজ সুস্থ চন্দ্রভূষণ!
এর থেকে আর আশ্চর্য্যের কি হতে পারে?
চম্পা যে ক্ষণপূর্বে হরিরলুট মানত করেছিল, এ কি তার ফল? চম্পা যে চলে যাচ্ছিল, চম্পার যে পরনে সেই গেরুয়া, সেকথা ভুলে গেল চম্পা। শুধু ভাবল, কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! আমি যে একটু আগে হরিরলুট মেনেছিলাম এ তারই ফল! তারপর ভাবলো…
কিন্তু পায়ে হেঁটে কেন?
চম্পা শুধু সেই প্রশ্নটাই করে বসে, ‘গাড়ী কি হলো?’
চন্দ্রভূষণ হঠাৎ হেসে উঠে বলেন, ‘কেন, গাড়ীবিহীনকে আর ভালবাসবে না?’
হাসিটা যেন জোরকরা।
তারপরই হঠাৎ যেন ছিটকে উঠলেন, বললেন, ‘এর মানে?’
‘ওমা, অমন বিদ্যুৎ খাওয়ার মতো চমকে উঠলে কেন? হলো কি?’
আবার এই ন্যাকড়াটাকে পরেছ মানে?’
চম্পা কি সত্যি ভুলে গিয়েছিল, না ভুলে যাওয়ার ভান করলো? চম্পাই জানে সে কথা। অথবা চম্পাও জানে না। তাই চম্পা হঠাৎ মনে পড়ার মত বলে উঠলো, ‘ওমা তাইতো! দেখে ফেললে তুমি? আমি তো আবার বৈরাগিনী হয়ে চলে যাচ্ছিলাম গো!’
চন্দ্রভূষণ সন্দিগ্ধ গলায় বলেন, দেখ তোমার ধরনধারণ ভাল লাগছে না আমার। এখানা টেনে পরেছ কেন?’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন