আশাপূর্ণা দেবী
বাড়িটা বেচে ফেললে, ফেলে ছড়ে দুলাখ! যে যার ভাগ নিয়ে সরে পড়তে পারলে বেহালায় কি গড়িয়ায়, দমদমে কি পাতিপুকুরে ছোট্ট একটু সুন্দর ছবির মত বাড়ি করা যায়।
সেই ছবির ছবি এঁকে দিয়ে যান ওঁরা চকিতের জন্যে।
কী সুন্দর সেই ছবি!
এই মোটা মোটা থামওলা দালান, উঠোনের উপর বুকচাপা এক বিরাট পাঁচিল, কাঠের কড়ি বরগা দেওয়া স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠা সিলিং, তিনতলা একতলা করে কাজ করা, সবটাই তো কষ্টের!
অথচ এ কষ্টের লাঘব করা যায়।
তা’ছাড়া—
স্বাধীনতা যে একা বড় ভাসুরই খর্ব করছেন তাও তো নয়। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের করছে। উদিতার রুচি পছন্দর সঙ্গে সুনন্দার মেলে না, সুনন্দার সঙ্গে মেলে না শেফালীর, অথচ সেই অমিল নিয়েই মিলের অভিনয় করে চলতে হচ্ছে।
সিনেমা দেখতে, শুধু নিজের বরটির সঙ্গে ইভনিং শোতে যাওয়ার যে সুখ, তা আর পায় না কেউ। হয় একজনের বর তিনজনকে, হয়তো বাড়তি দু’একটা বোনকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে, রীতিমত একটি বাহিনীর মত, নয়তো তিন জায়ে গলদঘর্ম হয়ে ম্যাটিনি শোতে যাও।
সে যেন ক্ষুধার অন্ন গলাধঃকরণ, তার মধ্যে শৌখিন খাবারের স্বাদ কোথা?
ছেলে মেয়ে, জামা জুতো, এটা সেটা টুকিটাকি, সব নিয়েই তো অস্বস্তি! অনেক জোড়া চোখের সামনে দিয়ে ব্যবহার করতে হবে সেগুলোকে। কেউ দাম জিজ্ঞেস করে বলবে, ‘উঃ এতো!’ কেউ কটাক্ষের মধ্যেই উচ্চারণ করবে, ‘উঁঃ এতো!’
সে জিনিস ব্যবহারে সুখ আছে?
কত সময় বরের দেওয়া উপহারকে লুকিয়ে হাত ঘুরিয়ে এনে বলতে হয়, ‘বাবা দিয়েছেন।’
অথচ এই সব কিছু নিয়ে চোখের আওতার বাইরে চলে যাওয়া যায়।
কিছুই না, শুধু একটু সাহসের ওয়াস্তা!
শুধু একবার বলে ফেলা, ‘দাদা, এতবড় এক পুরোনা বাড়ি রেখে কি লাভ? বেচে ফেলা হোক।’
তারপর দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।
কিন্তু সেই সাহসটুকু সঞ্চয় করতে পারছে না ইন্দু, সিন্ধু, বিন্দু। বলে কিনা ‘দাদার সামনে ওই কথা উচ্চারণ করবো? অসম্ভব!’
আবার এদিকে বৌরা যদি বলছে, ‘বেশ, আমরাই বলছি’, হাঁ হাঁ করে বারণ করে।
বলে, ‘দাদার সামনে পারবে উচ্চারণ করতে?’
পুরুষ এত কাপুরুষ?
যত দুঃসাহস একজনের!
তিনি বড় বড় বিবাহিত ভাইদের স্বচ্ছন্দে বলেন, ‘তুই একটা গাধা!’
বলেন, ‘তোর মাথাটায় কী আছে বল তো? কয়লার গুঁড়ো?’
বলেন, ‘বুড়োবয়সে কানমলা খাবার সাধ হয়েছে দেখছি।’
অথচ?
অথচ সেই মুখ নিয়েই তক্ষুণি ছুটবেন ‘সেখানে।’
এর থেকে দুঃসাহস আর কি হতে পারে?
ভাদ্রবৌরা ঠোঁট উলটে বলে, ‘এসব কেলেঙ্কারি করার থেকে বিয়ে করা ঢের ভাল। এখনো করলে করতে পারেন, চল্লিশ বছরের আইবুড়ো মেয়েরও অভাব নেই।’
বলে, ‘বয়েসকালে বিয়ে না করে—’
কিন্তু সত্যি, বিয়ে কেন করেননি চন্দ্রভূষণ?
এত মাতৃভক্ত ছেলে, অথচ মায়ের কথা রাখেননি, দুঃখ দিয়েছেন তাঁকে, আশ্চর্য!
কারণ কি?
সাধু নয়, বৈরাগী নয়, দেশোদ্ধারী নয়, শৌখিন ফুর্তিবাজ ভোগী মানুষ, তাঁর পক্ষে এই চিরকুমারব্রত নেওয়াটা আশ্চর্য্য বৈকি!
কারণ? তা’ সে কারণ অনুসন্ধান করতে হলে অনেকটা দূর পিছিয়ে যেতে হয়।
যেতে হয় সেই দেশে, যে দেশটা এখন নাকি ভারতছাড়া হয়ে গেছে।
সেখানে উঁকি দিতে পারলে দেখতে পাওয়া যাবে, একটা বছর চোদ্দর ছেলে ভেড়ার গোয়াল থেকে পালিয়ে মামার বাগানে চরে বেড়াচ্ছে!
সঙ্গে মামার ছেলে দেবু, আর মামার শালীর একটা বছর আট নয়ের মেয়ে। খিদমদগারের পোস্টটা পেয়েছে সে। মা বাপ মরা মেয়ে মাসীর কাছে মানুষ হচ্ছে, মাসীর কাছ থেকে যত আদর খায়, তার চতুর্গুণ কানমলা খায় মাসীর ছেলের কাছ থেকে।
হ্যাঁ, বড় চাকুরে বাবার একমাত্র ছেলে দেবুর মেজাজটা ছিল একটু প্রভুত্বপ্রিয়।
আর হাতের কাছেই যখন অধস্তন একজনকে পাওয়া যাচ্ছে, কেন নেবে না হাতের সুখ করে?
কিন্তু রাশিচক্র গ্রহনক্ষত্র, এগুলো ভারী মজার বস্তু। ওদের খেয়ালে কিংবা নীতিতে অঘটন ঘটনা অনায়াসে ঘটে। তাই ভেড়ার গোয়াল থেকে পালিয়ে যাওয়া ‘চানু’ মামার বাড়িতে গিয়েই দু’দিনে দলপতির পদটা অর্জন করে ফেললো, এবং ‘শরণাগত দীনার্ত পরিত্রাণ পরায়ণে’ মন্ত্রের অনুসরণে চম্পাকে তার মাসতুতো দাদার হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিল।
সবেমাত্র ভাই বোনেদের মধ্যে থেকে চলে গেছে, তাই হয়তো তার মনের মধ্যে মমতা রয়েছে ভরা। আর হয়তো বা তার প্রাণটাই মমতার প্রাণ!
প্রাণটা মমতার প্রাণ, কিন্তু কথাবার্তা মমতায় বিগলিত নয়। বরং উলটোই। যাকে শাসন করে তাকে যে স্বরে বলে, ‘এই দেবু, খবরদার বলছি চম্পার কানে হাত দিবি না! কান দুটো ওর বেওয়ারিস নাকি?’ ঠিক সেই স্বরেই যাকে রক্ষা করে, তাকে বলে, ‘এই চম্পা, খবরদার বলছি দেবাটার কথা শুনবি না। তুই ওর ঝি নাকি?’
কৃতজ্ঞতায় বিগলিত চম্পা অতএব তার রক্ষাকর্তারই দাসী বনে বসে তাকে। চানুদা মরতে বললে মরতে পারে সে, বাঁচতে বললে বাঁচতে পারে।
চানুদার পায়ে পায়ে ঘোরে, তার একটু কাজ করতে পেলে কৃতার্থ হয়।
দেবুরই বাড়িতে দেবুর পদমর্যাদা খাটো হতে হতে যেন শূন্যে পৌঁছচ্ছে।
দেবু ডাকে, ‘এই চম্পি, একটু জল নিয়ে আয়।’
চম্পা নির্ভয়ে বলে, ‘আমি এখন চানুদার মার্বেলগুলো সাবান দিয়ে ধুচ্ছি।’
দেবু বলে, ‘আমার কাজটা আগে করে দিয়ে যা বলছি—’
চম্পা সতেজে বলে, ‘হিংসুটের কাজ আমি করি না।’
কে বলতে পারে কেন আর চম্পার দেবুর হাঁকডাক শুনে বুক কাঁপে না!
দেবু চেঁচায়, ‘জল দিলি না তো? আর—জন্মে চাতক পাখী হবি বলছি—’
চম্পা চেঁচায়, ‘চানুদা বলছে, ‘এ—জন্ম’ ‘আর—জন্ম’ সব বাজে কথা! শুধু মানুষকে শাসনে রাখবার কৌশল!’
দেবু গলা আর এক কাঠি চড়ায়, ‘মা, চম্পা বলছে ভগবান টগবান কিছু নেই!’
চম্পা রক্তমুখে বলে, ‘মিথ্যুক মিথ্যুক! কখন আবার বললাম ওকথা? দেখ মেজমাসী, দেবুদা মিথ্যে কথা বলছে।’
‘আমি মিথ্যে কথা বলছি?’ দেবু বীরদর্পে বলে, ‘নিজে বলে আবার অন্যকে দোষ দেওয়া? বলিসনি এ—জন্ম আর—জন্ম বলে কিছু নেই?’
চম্পা এহেন কূট প্রশ্নের সদুত্তর দেবার আগেই চানু হাল ধরে। বলে, ‘বোকার মত কথা বলিস না দেবু! ভগবান আর কুসংস্কার এক জিনিস নয়।’
‘কুসংস্কার মানে?’
‘মানে? মানে হচ্ছে এই তুমি যাতে বিভোর। ‘এ—জন্ম! আর—জন্ম।’ এ—জন্মে জল না দিলে আসছে জন্মে চাতক পাখী হবি, এ জন্মে তেল না দিলে আসছে জন্মে তেলাপোকা হবি—’
‘তেলাপোকার কথা বলেছি আমি?’ দেবু প্রায় ছিটকে ওঠে, ‘তেলাপোকার কথা কখন হলো?’
‘হলেই হলো!’ চানু অবজ্ঞাস্বরে বলে, ‘আসছে জন্মটা যখন কেউই দেখতে পাবে না, যা ইচ্ছে বললেই হলো।’
‘মা চানুটা আমায় ভ্যাঙাচ্ছে—’
দেবুর মাকে অগত্যাই হাতের উপন্যাসখানা মুড়তে হয়। বলেন, ‘সবসময় ঝগড়া করিস কেন দেবু?’
‘চানুটাই তো ঝগড়া করছে।’
‘মোটেই না!’ চানু জোরের সঙ্গে বলে, ‘আমি শুধু বলেছি কুসংস্কার আর ভগবান এক জিনিস নয়।’
‘তার মানে তুই শাস্ত্র মানিস না!’
ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে দেবু।
দেবুর মা হাসি গোপন করে বলেন, ‘অ্যাঁ বলিস কি? শাস্ত্র মানে না? চানুর তো তা’হলে নরকেও ঠাঁই হবে না।’
চানু এবার মামীকেই একহাত নেয়, ‘ওটাও তোমার ঠিক বলা হলো না মামী! নরক বলে কিছু নেই।’
মামী আরো চমকে বলেন, ‘ওমা বলিস কি চানু, নরক বলেও কিছু নেই?’
‘না।’
‘সর্বনাশ! তা’হলে আমরা কোথায় যাব রে!’
চানু মামীর মুখের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, ‘ওঃ ঠাট্টা করা হচ্ছে!’
মামীকে ভারী ভাল লাগে চানুর।
কী উজ্জ্বল, কী সুন্দর, কী হাসিখুশী!
চানুর কাকীমার মতই তো বয়েস, কিন্তু কত যেন ছোট লাগে! যেন নিজেদের সমবয়সী বন্ধুর মত মনে হয়।
প্রত্যেকটি কথা এমন হাসির সুরে বলা, এ দৃশ্য চানু তাদের কলকাতার বাড়িতে দেখেনি। নেহাত সাধারণ কথারও যেন একটা আলাদা মূল্য আছে! মামার বাড়িতে এসে এত মন বসে গেছে হয়তো ওই মামীমার জন্যেই।
মামীমার মধ্যে যেন মহিলা জাতির একটা আদর্শ খুঁজে পায় চানু। ঠিক এইরকমটি বুঝি চায় সে।
অথচ ওদের বাড়ির কেউ এমন নয়।
বাড়িটা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলে যে কত ভাল লাগে, একথা কেনই যে বোঝে না চানুর মা, কাকীমা, জেঠিমা? মা অথচ এ বাড়িরই মেয়ে।
একথা বোঝবার বয়েস চানুর তখন হয়নি—লোকসংখ্যাই সব সৌন্দর্যকে ধ্বংস করে। চানুদের বাড়ির মত যদি দিন দুবেলা তিরিশটা করে পাত পাড়াতে হতো চানুর মামীকে, এই রুচি সৌন্দর্য সুষমার কতটুকু অবশিষ্ট থাকতো?
ওটা তখনও ভেবে দেখতে জানতো না চানু, তাই ভাবতো, বাড়িটা একটু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলে—
কিন্তু পরে যখন বুঝতে শিখেছিল কথাটা, তখনও ভাবতো অন্ততঃ কথাটা সুন্দর করে বললে কী হয়? ওতে তো পয়সা খরচ হয় না! হয় না বটে, পয়সা খরচ হয় না, কিন্তু বাড়িতে ভিড় থাকলে সে রুচিও যে থাকে না, তাও জানতো না চানু। অন্য এক ধরনের হলেও, পিসি বরং সুন্দর করে কথা বলে কিছুটা। যেমন ছেলেপুলেকে ঘুম ভাঙাতে হলে বলে, ‘ওহে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, দয়া করে গাত্রোত্থান করুন। আপনার খানা প্রস্তুত!’ বলতো, ‘কালে ভবিষ্যতে লাট হবি তোরা, এই আমার নিয্যস বিশ্বাস। এখন থেকে অভ্যেসটা রপ্ত করছিস!’
ভাজেদের ডাকতো, ‘ওগো বড়লোকের গিন্নীরা, ‘আজ কি আর নীচে নামা হবে না?’
মামীর মত সুন্দর কথা না হলেও শুনতে একরকম ভাল লাগে।
আর জেঠাইমা?
সক্কালবেলাই শুরু করে দেন, ‘এই লক্ষ্মীছাড়া বাঁদর ছেলে, এখনো ঘুম মারছো? বলি লেখাপড়া নেই?’
শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অথচ সেই তো মানুষের মুখ, সেই তো বাংলা ভাষা! আর মামীমার কথা? যেন আলাদা এক জগতের! মামীমার শাড়ি পরার ধরনটি চমৎকার, মামীমার গায়ে সর্বদা জামা, মামীমা বাইরে বেরোতে হলে চটি পায়ে দেন। এ মামীতে মুগ্ধ হবে না ওই বয়সের ছেলেটা?
তবে বোকা হাবা তো আর নয় চানু যে, সেই মুগ্ধভাবটা ব্যক্ত করবে? করে না। কথা বলে সহজ ভাবেই। তাই বললো ‘ওঃ ঠাট্টা করা হচ্ছে!’
মামী যেন আকাশ থেকে পড়েন।
বলেন, ‘ঠাট্টা কি রে? এতবড় একটা জীবনমরণ সমস্যা, তাই নিয়ে ঠাট্টা করবো? এখন না হয় ভাগ্যিক্রমে তোর মামার এই বাগানওলা দিব্যি খাসা বাড়িটিতে রয়েছি, মরার পর কোথায় ঠাঁই হবে, ভাবতে হবে না সেকথা?’
চানু চট করে বলে বসে, ‘তা স্বর্গ নরক যদি থাকে, তুমি নিশ্চয়ই স্বর্গে যাবে!’
‘স্বর্গে!’
মামীমা হেসে উঠলেন, ‘একেবারে স্বর্গের টিকিট রেডি!…. ওগো শুনছো, মরার পর আর তোমার সঙ্গে ঘর করা হবে না আমার! তুমি তো নির্ঘাৎই নরকগামী হবে?’
সবটাই ঠাট্টা, তা বোঝে চানু।
মামাও যে বলেন, ‘দেখ, আবার তুমি কুসংস্কারে নিমজ্জিতের মত কথা বলছো? জানো চানু ওসব ভালবাসে না!’ সেটাও যে ঠাট্টা তাতে আর সন্দেহ কি?
কিন্তু তবু কেমন চমৎকার!
বড়রা বিনা কাজে কথা বলছে, এ দৃশ্য কবে দেখেছে চানু? কাজের কথা বলবে বড়রা, আর রেগে রেগে বলবে, এটাই তো বিধি।
হঠাৎ সংকল্প করে বসতো চানু, সে যখন বড় হবে বৌয়ের সঙ্গে অমনি শুধু শুধু কথা বলবে। অমনি হেসে হেসে।
বৌ?
সে জিনিসটা সম্পর্কে অবশ্য তখন কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না, তবু ‘বৌ’ শব্দটা ছিল অনুভূতির মধ্যে, বাসনার ঘরে।
যেমন থাকে এতটুকু মেয়ের মধ্যেও ‘বরে’র চেতনা।
এই তো চানুর নিজের ছ বছরের বোনটাই তো বলে, ‘বড় হয়ে আমি কেমন চন্নন পরবো, মালা পরবো, গয়না পরবো। লাল কাপড় পরে বরের সঙ্গে চতুর্দোলায় চেপে চলে যাব।’
চেতনাটা প্রকৃতির দেওয়া, কল্পনার রূপটা গঠিত হয় পারিপার্শ্বিকতার উপাদানে। উৎসবের রাজা উৎসব যে বিয়ে, রূপের মধুরতর রূপ যে বরকনের মূর্তি, আর জীবনের পরমতম পরিণতি যে বৌ নিয়ে বা বর নিয়ে ঘর করা, এটা ধরে ধরে শিক্ষা দিতে হয় না!
তাই শিশু মেয়েটিও ভাবে, ‘আমার যখন বিয়ে হবে’, কিশোর বালকটিও ভাবে, ‘আমার যখন বিয়ে হবে।’
তা’ সবাই ভাবে কি না কে জানে, চানু অন্ততঃ ভাবতো।
ভাবতো ‘আমার যখন বৌ হবে—’
ক্রমশঃ বুঝি সেই ‘বৌ’ নামক শব্দটা কল্পনার বাষ্পপুঞ্জ থেকে একটা অবয়ব নিচ্ছিল!…. একবার করে ছুটিতে কলকাতায় আসতো চানু, ভাল নাম যার চন্দ্রভূষণ, আর ছুটির শেষে ফিরে গিয়ে যেন সেই বাষ্পপুঞ্জকে একটা গড়ন নিতে দেখতো!
দেবুরা ছুটিতে এখান ওখান বেড়াতে যেত, হয়তো দার্জিলিঙে, হয়তো বা কাশীতে পুরীতে। চম্পাও অতএব যেত। আর সেই বেড়ানোর সূত্রেই বুঝি এক ডিগ্রি করে ‘বড়’ হয়ে যেত চম্পা।
দেবুও আর তত উৎপীড়ন করতো না তাকে অধস্তন ভেবে, হয়তো বা চম্পার ব্যক্তিত্ব, চম্পার আভিজাত্য তাকে সে সাহস থেকে নিবৃত্ত করতো। অতএব চম্পাকে পক্ষপুটে আশ্রয় দেবার কাজটা কমে যাচ্ছিল চানুর।
এখন আর দেবুকে তীব্র তিরস্কারে ধিক্কৃত করতে হয় না, ‘এই দেবু, চম্পার মা নেই তা জানিস? মা বাবা ভাই বোন কেউ?’ পুনঃ পুনঃ প্রশ্ন।
অগত্যাই দেবুকে স্বীকার করতে হতো, নেই কেউ চম্পার।
‘তবে?’ চানু আরও ঘৃণা হানতো, ‘এ জ্ঞান থাকতেও তুই ওকে ওইরকম উৎপাত করিস! মারিস, বকিস, চুল টানিস!’
‘আর ও একেবারে ভালমানুষের রাজা!’ দেবু ফেটে পড়তো, ‘একটা কথা শুনতে চায় আমার?’
‘ভালভাবে বললেই শুনতো। তোমার যেমন বিচ্ছিরী করে হুকুম করা! কই আমার অবাধ্য তো হয় না কখনো!’
দেবু বলে, ‘তোর? হুঁঃ! তুই তো ওর গুরুদেব! তোর অবাধ্য হবে?’
‘গুরুদেব হয়ে জন্মাইনি আমি ওর’, বলতো চানু, ‘ভাল ব্যবহার করলে বনের পশুও বশ হয় জানিস?’
‘জানি না! তুই এত কথা জানলি কি করে?’
‘কি করে আবার! মানুষ সব কিছু জানে কোথা থেকে? বই পড়ে।’
‘তোর মতন এত বই কে পড়তে যাবে?’
চানু গম্ভীরভাবে বলতো, ‘মানুষমাত্রেই পড়বে। আর পড়লেই এ জ্ঞান আসবে, যে মানুষ তোদের বাড়ি রয়েছে, দায়ে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে, তাকে এরকম কষ্ট দেওয়া কত খারাপ! ভেবে দেখ দিকি, ওর মত তোকে ওইরকমভাবে পরের বাড়ি থাকতে হচ্ছে, আর তাদের ছেলে তোকে—’
না, এসব কথা ক্রমশঃ আর বলতে হচ্ছিল না। যখন চম্পা ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে, তখন থেকে দেবু সমীহর দৃষ্টিতে দেখছে ওকে।
তা’ছাড়া জীবন তখন এগিয়ে যাচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে, স্কুলের সীমানা ছাড়িয়ে কলেজে ভরতি হয়েছে দুজন। চম্পাও স্কুলের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে।
পুজোর ছুটির পরে ফিরে সেবার প্রথম দেখলো চন্দ্রভূষণ, ‘চানুদা’ বলে একগাল হাসি নিয়ে ছুটে এলো না চম্পা। অথচ বোঝা যাচ্ছে আছে ভিতরে, অতএব জানতে পেরেছে।
আর না পারবেই বা কেন?
স্টেশনে স্বয়ং মামা গিয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে আনতে।
তাজা তরুণ চন্দ্রভূষণ এ অবহেলায় বড় বেশী আহত হলো। ভাবলো ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে বলে অহংকার হয়ে গেল নাকি চম্পির?
এই তো যাবার সময়ও কাছে এসে গায়ে হাত দিয়ে ঠেলে বলেছে, ‘যাও, মায়ের বাছা মায়ের কাছে যাও!’
মামী বলেছেন, ‘তাতে ঠাট্টার কি আছে? সত্যিই তো মায়ের বাছা!’
‘চানুদার মায়ের আরও কত ‘বাছা’ আছে। চানুদার জন্যে তো ঘুম হচ্ছে না তাঁর! মনেই থাকে না হয়তো চানুদার কথা।’
মামী হেসে উঠেছিলেন।
‘আরো অনেক বাছা আছে বলে ভুলেই যাবে? বড় হ, বাচ্চাকাচ্ছা হোক, তখন বুঝবি।’
‘বুঝে দরকার নেই আমার! আমি তো বড় হয়ে ডাক্তার হবো।’
চন্দ্রভূষণ হেসে উঠেছিল, ‘তা’ মন্দ নয়! ভাল প্রফেশনই বেছেছিস! রুগীদের আর বেশীদিন ভুগতে হবে না।’
‘ভাল হবে না বলছি চানুদা!’ বলে উঠেছিল চম্পা, মুখে রাগ ফুটিয়ে।
চন্দ্রভূষণ গাড়িতে উঠেছিল।
সেই চম্পা হঠাৎ এই দু’মাসে এত কি লায়েক হলো যে, চানুদা এলো তা দৃকপাতই নেই!
ঠিক আছে, চন্দ্রভূষণও মান খোওয়াবে না যতক্ষণ না চম্পা ডেকে কথা কয়। প্রতিজ্ঞা!
কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা কি রাখা গেল?
গেল না!
চানুই আগে মান খোওয়ালো, চানুই ডেকে কথা কইলো।
কিন্তু সেই সামান্য ব্যাপারটুকুর জন্যে হঠাৎ নির্জনতা খুঁজতে গেল কেন চানু? কই, ইতিপূর্বে তো কখনো এ খেয়াল হয়নি? আগে এমন হলে মামীর সামনে, দেবুর সামনে, হয়তো বা মামার সামনেই হাঁক পেড়েছে, ‘কি হে চম্পাবাবু, আপনার যে আর দেখাই পাওয়া যায় না! ইউনিভার্সিটির ছাতটা নিতান্তই নামাচ্ছেন তা’হলে?’
চম্পা পড়া ফেলে উঠে আসতো।
চম্পা বলতো, ‘দেখ মেজমাসী, চানুদা আমার পড়া খুঁড়ছে! একেই তো আমার মাথায় ঢোকে না, তার ওপর আবার—’
তার ওপর আরো কি সেটা হয়তো চট করে মনে পড়ে না চম্পার, তাই হঠাৎ থেমে যায়, আর পাদপূরণ করে দেয় চানু, ‘তার উপর আবার সময় পাই না।’
‘সময় পাই না? সময় পাই না মানে?’ চম্পা রেগে বলে, ‘বলেছি আমি তোমাকে ওকথা?’
‘আহা বলতে হবে কেন? ইহা যে সত্য ঘটনা।’
চম্পা বিপন্নমুখে বলে, ‘সত্য ঘটনা মানে? কী কাজ করি আমি? তাই সময় পাব না?’
বাস্তবিকই কাজের চাপ কিছু ছিল না চম্পার। মাসী কোনোদিন তার কাজের প্রত্যাশা করতেন না। কেবল বলতেন, ‘ভাল করে পড়ে পড়ে মানুষ হ।’
বলতেন, ‘তোর মা’র কত সাধ ছিল, মেয়ে ছেলে খুব বিদ্বান হবে, খুব নামডাক হবে! তা ছেলে তো চলেই গেল—’
চম্পা কি সেই তার অদেখা মা’র মনের বাসনাটুকুকে রূপ দেবার ইচ্ছেতেই বলতো, ‘বিয়েই করব না, ডাক্তার হবো’!
নাকি ছেলেমানুষের বাহাদুরির কথা?
হয়তো তাই।
কিন্তু এই দু’মাস সময়ের মধ্যে কি হঠাৎ বড় একটা মানুষ হয়ে উঠলো চম্পা? তাই চানু তাকে ডেকে কথা বলবার জন্যে নির্জনতা খুঁজলো?
চম্পাকে আবিষ্কার করলো চানু রান্নাঘরের পিছনের শসা কুমড়োর বাগানে।
একটা লোহার শিক দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি খুঁড়ছিল চম্পা।
চানু খুব কাছাকাছি এসে মৃদু হেসে বললো, ‘আজকাল বুঝি খুব পেটুক হয়ে উঠেছিস চম্পা?’
চম্পা অবশ্যই এ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। চম্পা চমকে দাঁড়িয়ে উঠে রুদ্ধকণ্ঠে বলে, ‘তার মানে?’
‘মানে অতি প্রাঞ্জল। সামনের ফুলবাগান ছেড়ে পিছনের শসাবাগানে আশ্রয়! তা’ছাড়া সারাদিন রান্নাঘরের কাছাকাছি অবস্থান! এসব কিসের লক্ষণ বল?’
চম্পা ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘নিজেও ফুলবাগান ছেড়ে শসাবাগানে এসেছ!’
‘এসেছি কি আর সাধে? সারাদিন বাবুর পাত্তাই নেই, একটা মানুষ যে দু’মাস পরে এলো, সে জ্ঞানই নেই! ভাবলাম কি হলো? হঠাৎ এর মধ্যে ঠ্যাংট্যাং ভাঙলো নাকি—’
চম্পা তেমনিভাবে জোরে জোরে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বলে, ‘যা মুখে আসবে, তা বলবে ভেবে এসেছ বুঝি চানুদা? তাই ঠ্যাং ভাঙার কথা বলতে ইচ্ছে হলো?’
‘ইচ্ছের কি আছে!’ চানু উদাস গলায় বলে, ‘ঠ্যাং ভাঙলেই মানুষ চলৎশক্তিরহিত হয়।’
‘তুমি এসেছ বলেই যে ছুটে ছুটে দেখতে যেতে ইচ্ছে হবে, তারও কোনো মানে নেই।’
চানু বোঝে এটা ইচ্ছাকৃত।
ঝগড়া করতেই ইচ্ছে ওর।
মৃদু হেসে বলে, ‘দেখতে না যাওয়ারও কোনো মানে নেই। সবাই গেছলো। মামী, দেবু, কানাই, বিধু ঝি—’
‘তা’ নিজেকে যদি বিধু ঝিয়ের দলে ফেলতে না পারি!’ চম্পা উঠে দাঁড়িয়ে হাতের ধুলো ঝেড়ে বলে, ‘মামী গেছে, দেবু গেছে, ওরা তোমার আপনার লোক! আমি কে? কেউ না। অতএব কানাই কিংবা বিধুর দলে!’
‘হঠাৎ তুই আমার কেউ না, এমন ভাববার দুর্মতির হেতু?’
‘দুর্মতি আবার কি?’ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চম্পা বলে, ‘যা সত্যি তাই বলছি।’
চম্পার এ রূপ নতুন! চন্দ্রভূষণ বুঝি একটু অবাক হয়।
বলে, ‘হঠাৎ এমন নির্জলা সত্যিটা আবিষ্কার করে ফেললি যে?’
‘তুমিই ফেলিয়েছ!’ ঘাড়টা বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকায় চম্পা।
অদ্ভুত সুন্দর এই ভঙ্গী!
চন্দ্রভূষণের সমস্ত চেতনার মধ্য দিয়ে যেন একটা আলোক প্রবাহ বহে যায়! বহে যায় অজানিত এক আনন্দের তরঙ্গ!
একেবারে নতুন লাগে চম্পাকে, অপরিচিত লাগে। কে বলবে এই মেয়েটাকেই সে বছর আষ্টেক বয়েস থেকে দেখে আসছে! দেখে এসেছে কখনো পেনি পরা, কখনো ফ্রক পরা! কখনো উল্লাসে অধীর, পুলকে চঞ্চল, কখনো ব্যথায় বিবর্ণ, ক্রন্দনে বিধুর।
কান্নাটাই অনেক সময়।
দেবুর উৎপীড়ন অবিরত কাঁদিয়েছে তাকে।
আর সেই উৎপীড়নটা যেন চন্দ্রভূষণ আসার পর থেকে অধিকতর উগ্র হয়ে উঠেছিল।
হয়তো এই হয়ে ওঠার পিছনে আছে অন্য এক মনস্তত্ত্ব! দেবু এ বাড়ির শিবরাত্রির সলতে, দেবু সর্বেসর্বা আসল, দেবু দামী মাল, তথাপি দেবু নিজেকে ‘হঠাৎ—এসে—পড়া’ চানুটার থেকে হেয় জ্ঞান করে। কেন করে কে জানে! মনকে বোঝাতে চেষ্টা করে, পরীক্ষায় দুটো বেশী নম্বর পায় বলে মাথা কিনেছে নাকি? ভারী একেবারে!
কিন্তু মন অবুঝ।
মন যে পথে যেতে চায় যাবেই।
মন মনেমনে ওই চানুটাকেই বরমাল্য দিয়ে বসে।
সেই ঘটনাটাই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
বুদ্ধিতে যদি বা খাটো হয় দেবু, শক্তিতে নয়, এটা বোঝাবার জন্যেই হয়তো একটা অধস্তনের উপর সেই শক্তির প্রকাশ দেখায়। হয়তো এটাই মানুষের স্বভাবধর্ম। অসহায়ের উপর ক্ষমতার প্রয়োগ করে মনে করে ‘শক্তি দেখাচ্ছি’।
তা’ সেই শক্তি দেখাতো দেবু।
হঠাৎ হঠাৎ তুচ্ছ কারণে হুকুম দিত চম্পাকে, ‘কান ধরে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাক।’ হুকুম দিত, ‘মেপে সাত হাত নাকে খৎ দে।’
অকারণে বলতো, ‘দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে এক থেকে হাজার অবধি গোণ।’…. আর নয়তো বা শক্ত শক্ত এক মুঠো অঙ্ক দিয়ে বলতো, ‘দশ মিনিটে কষে নিয়ে আয়।’
না পারলে চুল টানা, কান মলা, রামচিমটি, শ্যামচিমটি, বোম্বাই গাঁট্টা, মোগলাই কিল!
মাসীকে লাগিয়ে দিয়ে দেবুকে বকুনি খাওয়ানো শক্ত ছিল না চাঁপার পক্ষে। মাসী ন্যায়বিচারক। অন্যায়কারী ছেলের পক্ষ সমর্থন করবেন না তিনি ঠিকই, কিন্তু সে পথে যে আরো ভয়!
বকুনি খাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় আরো হিংস্র হয়ে উঠবে না দেবু? তখন? আবার লাগিয়ে দেবে?
কেবল কেবল লাগাতে যাওয়ার মধ্যে লজ্জার গ্লানি নেই?
চানুর কাছেই নালিশ জানাতো চম্পা, চানুর কাছেই কেঁদে ভাসাতো।
‘জানো চানুদা, দেবুদা মাথায় এমন গাঁট্টা মেরেছে, মাথাটা আলু হয়ে উঠেছে!…দেখো চানুদা, কী জোর রামচিমটি কেটেছে দেবুদা, নীঃ—ল হয়ে উঠেছে!’
চানু দেখতো।
দেখে চানুর মুখটা গম্ভীর হয়ে যেত, কঠোর হয়ে যেত। বলতো, ‘তুই কী করেছিলি?’
তা’ অপরাধের তালিকা নগণ্যই ছিল। হয়তো, দেবু তার জন্যে একশোটা টোপা কুল তুলে রাখতে বলেছে, পঁয়তাল্লিশের বেশী রেখে উঠতে পারেনি চম্পা। হয়তো ঘুড়ির সূতোয় মাঞ্জা দেবার জন্যে ময়দার আটা করে রেখে দেবার কথা, হয়ে গেছে ভুল।
ব্যস! লেগে যায় শাস্তির ব্যবস্থায়।
চানু চম্পার অপরাধের ওজন শুনে গম্ভীর হয়ে যেত।
তারপর ধরতো দেবুকে।
বলতো, ‘বাহাদুরিটা দেখাচ্ছিস ভাল দেবু! বাঃ এই তো বীরত্ব!’ বলতো, ‘পূর্বজন্মে নবাব বাদশা ছিলি বোধহয়, তাই ক্রীতদাস নির্যাতনটা অভ্যাস থেকে মুছে যায়নি এখনো! তা’ শুধু ওর চুলের বেণীটা জানলায় বেঁধে দিয়ে ওকে ছুটতে বললি কেন? মাথার খুলিটা খুলে নিতে পারলিনে? তাতে কাজটা নিখুঁত হতো!’
বলতো, ‘মোটে সাত হাত নাকখৎ? আরে ছিঃ! সাত হাত আবার একটা মাপ? ওটুকুতে তো চম্পির যেমন বাঁশীনাক তেমনিই থেকে যাবে রে! এমন শাস্তি অন্ততঃ দে, যাতে নাকটা খেঁদিয়ে গিয়ে তোর শিল্প কাজের মহিমা চিরস্মরণীয় করে রাখতে পারে!’
এই ব্যঙ্গের ঘায়ে মাথাটা হেঁট হয়ে যেত দেবুর। মুখ তুলে উত্তর দিতে পারতো না।
আবার কখনো চানু তীব্র তিরস্কারও করতো।
বলতো, ‘তুই তার মানে চাস যে আমি এখানে না থাকি, কেমন?’
দেবু মিনমিনিয়ে বলতো, ‘তোর সঙ্গে কি?’
‘আমার সঙ্গে কিছু না, কিন্তু মানুষ তো আমি? মানুষের চামড়া গায়ে আছে তো? এই অবিচার, এই অসভ্যতা, চোখে দেখে সহ্য করা আমার কর্ম নয়।…একটা অসহায় জীবের ওপর বীরত্ব ফলানোয় বাহাদুরি নেই দেবু, এইটুকুই শুনে মনে রাখিস। ঠিক আছে, মামাকে বলে চলে যাব আমি। খুব সম্ভব আমার হিংসেতেই এরকম করিস তুই!’
মামাকে বলে দেবার নামে ভয় পেত দেবু।
তখন প্রতিজ্ঞা করতো, ‘আর কক্ষনো করবো না, মা কালীর দিব্যি।’
তা’ চলে যাবার নামে ভয় কি শুধু দেবুই পেত?
চম্পা আকুল হতো না?
বলতো না, ‘তা’হলে তো তুমি আমায় খুব মায়া দেখালে চানুদা! যদি বা তুমি একটু ভালো কথা বল, ভালো ব্যাভার কর, তাও ঘুচে যাবে।’
ভাল কথা!
ভাল ব্যাভার!
হ্যাঁ, এইটুকুই বলতে জানতো তখন মেয়েটা।
‘ভালবাসা’ কথাটা ব্যবহার করতে জানতো না।
কিন্তু আজ?
আজই কি ব্যবহার করবে সে কথাটা?
তা’ করবে না।
তা’ কোনো মেয়ে করে না।
শুধু অভিব্যক্তিকে কাজে লাগায়।
বোঝায় গ্রীবার ভঙ্গীতে, মুখের রক্তিমায়। বোঝায় উলটো—পালটা কথায়, অকারণ ঝংকারে, অহেতুক অভিমানে।
তরুণ চন্দ্রভূষণ সেই অপরূপ অভিব্যক্তির দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে থাকে, তারপর আস্তে ওর মুখটা ধরে ঘুরিয়ে আনে। সঙ্গে সঙ্গে যেন দিশেহারা হয়ে যায়।
স্পর্শের কী শিহরণ!
চম্পাকে কি কোনোদিন স্পর্শ করেনি চন্দ্র?
কত শত বারই তো করেছে!
হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনেছে, খেলতে খেলতে ধরে ধরে ঘুরিয়ে ঠিক পথে দাঁড় করিয়েছে, চোর কুমীর খেলায় পা ধরে টেনে ‘জলে’ নামিয়েছে। এই সেদিনও যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় সৈন্য সমাবেশের লাইনে ফেলে কাঁধ ধরে ঠিক করেছে। জানা অজানা কত স্পর্শের প্রবাহ বহে গেছে চম্পার গায়ের উপর দিয়ে, অথচ আজকের এই সামান্য স্পর্শটুকুতে যেন বিদ্যুতের শক!
চম্পা সেই ‘শক’ খেয়ে বিবশ হয়ে বসে পড়ে, চন্দ্রর সেই ‘শকে’ একটা বন্ধ দরজা খুলে যায়।
চন্দ্র অনুভব করে এই আনন্দ, এই ভয়, এই শিহরণ, এই দাহ! এরই নাম ভালবাসা!
চম্পা আমায় ভালবাসে!
তাই চম্পা অমন করে অভিমান জানালো।
আমি চম্পাকে ভালবাসি, তাই চম্পার স্পর্শে আর এক জগতের স্পর্শ পেলাম আমি!
আশৈশব এই যে আমার প্রতি আকর্ষণ চম্পার, তার নামই ভালবাসা।
বরাবর চম্পার প্রতি আমার যে অফুরন্ত মমতা, তার নামই ভালবাসা।
আমরা দুজনে দুজনকে ভালবেসে আসছি, অথচ এতদিন টের পাইনি। আশ্চর্য, আশ্চর্য! কী অন্ধের মত, কী বোকার মত কাটিয়েছি আমরা এতদিনে!
কি জানি, হয়তো চম্পা টের পেয়েছিল, হয়তো চম্পা অন্ধও নয়, বোকাও নয়। তাই আজ চম্পা অভিমানে ফেটে পড়তে চাইছে। চম্পা আমাকে কী বুদ্ধুই না ভেবেছে তা’হলে!
আস্তে নীচু হয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে চন্দ্র।
ডাকে—’চম্পা!’
চম্পা মুখ তোলে না।
চম্পার ঘাড় আরো গুঁজে যায়।
চন্দ্রভূষণ এবার সাহসের কাজ করে, ওই দুই বাহুমূল ধরে তুলে দাঁড় করায় জোর করে। আস্তে বলে, ‘তাকাও, তাকাও আমার দিকে।’
কিন্তু তাকাবে নাকি চম্পা?
তাই কেউ তাকায়?
চন্দ্র আর একটু সাহস দেখায়, সেই শিথিল দেহটাকে আর একটু কাছে টেনে আনে, আরো কাছে, জোরে চাপ দেয়। আবেগের গলায় বলে, ‘চম্পা চম্পা! চম্পা, আমি কী বোকা!’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন