অনবগুন্ঠিতা – ৭

আশাপূর্ণা দেবী

ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান!

সব চোখের উপর জ্বলজ্বলিয়ে উঠবে!

এ এক বড় ভয়ানক প্রলোভন!

এ প্রলোভনে আবালবৃদ্ধবনিতা ভোলে, বিজ্ঞ ভোলে, পণ্ডিত ভোলে।

আর এ তো একটা কিশোরী মেয়ে মাত্র।

যে নাকি তার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কোথাও দেখছে না আলোর রেখা।

চম্পা ভিড়ের মধ্যে থেকে মাসির সঙ্গচ্যুত হয়ে বেরিয়ে এসেছিল। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই তো ফিরে আসবে, তখন বললেই হবে, ‘কোন দিকে ছিলে তোমরা, আমি খুঁজে খুঁজে—’

তীরে নৌকো বাঁধা ছিল।

যে নৌকোয় চড়ে ওপারে গিয়ে আপন ভাগ্যের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান জেনে ফেলবে চম্পা।

তা হয়তো দেবুর সেই শয়তান বন্ধুর কথা মিথ্যাও নয়, জানতেই তো পেরেছিল সেদিন চম্পা তার ভূত ভবিষ্যৎ। শুধু জানবার জন্যে কষ্ট করে আর খেয়া পার হয়ে ফকিরের আস্তানায় যেতে হয়নি। শয়তানই সে ভাগ্যলিপি পড়ে দিয়েছিল।

কিন্তু দেবু?

দেবু যায়নি।

দেবু নৌকোয় চড়েনি।

ঠিক শেষ মুহূর্তে দেবুর বন্ধু দেবুকে বলেছিল, ‘সর্বনাশ করেছে। ফকিরের জন্যে যে একটু কর্পূর নিয়ে যেতে হয়! ওই কেবল ওঁর দক্ষিণা। আর কিছু না। ইস একদম ভুলে গেছি। … দেবু, দোহাই তোর, যা ভাই একবার ছুটে, মেলার বাজার থেকে একটু কর্পূর নিয়ে আয়।’

কর্পূর! শুনতে তুচ্ছ, মুহূর্তে উড়ে যাবার, কিন্তু জিনিসটা ঠিক সেই পরিস্থিতিতে সহজপ্রাপ্য হয়নি, অনেকটা খোঁজাখুঁজি করে যখন নিয়ে গিয়ে হাজির হলো দেবু, দেখলো কর্পূরের মতই উপে গেছে তার বন্ধু, তার বোন!

খেয়া নৌকোখানা যেমন ঘাটে বাঁধা ছিল তেমনিই পড়ে রয়েছে।

‘বোকার মত হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম রে চানু, তবু তখনো তার শয়তানির ওজন বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, তবে কি হঠাৎ মা বাবা এসে পড়েছিলেন? জামিরকে কি তিরস্কার করেছিলেন এই দুর্বুদ্ধির জন্যে? চম্পাকে ধমক দিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছেন?

তারপর বুঝতেই পারছিস অবস্থা?

ভিড়ে মেয়ে হারিয়ে ফেলা উদভ্রান্ত মা বাবার সেই মূর্তির সামনে আমি বলতে পারলাম না আমার বোকামির কথা। আমি শুধু আড়ালে মাথা ঠুকতে লাগলাম। ছেলেবেলা থেকে চম্পিকে যত উৎপীড়ন করেছি, সব মনে পড়ে বুক ভেঙে যেতে লাগলো, আর তখনই বুঝতে পারলাম ওকে আর পাওয়া যাবে না। বুঝতে পারলাম জামির কত বড় শয়তান।’

একটা মুখ্যু ছেলের মুখ্যুমিতে হারিয়ে গেল চম্পা নামের সেই ‘অসংযমী’ মেয়েটা। যে নাকি এক অনাত্মীয় পুরুষের শোবার ঘরে এসে ঢুকতে সাহস পায়—

‘অনেকদিন পরে জামিরকে একদিন দেখেছিলাম কলকাতায়—’ দেবু বলেছিল, ‘চেপে ধরেছিলাম তাকে ‘কোথায় চম্পি?’ বলে। অচেনার ভান করেছিল, বলেছিল, ‘কাকে কি বলছেন?’ …রাস্তায় লোক জমে গেল, ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম।’

আর বলেছিল দেবু, ‘সে কি আর বেঁচে আছে? নিশ্চয়ই সুইসাইড করেছে। যে অভিমানী!’

অতএব মরেই গিয়েছিল চম্পা।

কিন্তু কত বছর যেন পরে চন্দ্রভূষণ বলে উঠলেন, ‘আমায় তুমি ঠকাতে পারবে না, গেরুয়া পরেও না।’

তারপর, আরও কি যেন কথার পর বলেছিলেন, ‘কোথাও যেতে হবে না, আমার সঙ্গে এসো’।

বৈষ্ণবী এবার ওই বেপরোয়া লোকটার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিল, ‘তারপর?’

‘তারপর আবার কি? থাকবে চিরকাল।’

‘ওমা তাই নাকি? বৈষ্ণবী চোখের নীচেটা আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বলেছিল, ‘সত্যি? আহা! চিরকালের ভার নেবেন? গ্যারাণ্টি?’

‘গ্যারাণ্টি।’

‘আহা তবে আর রেল কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে, আর দু’পয়সার ছোলাভাজা খেয়ে খেয়ে ঘুরে মরি কেন? চলুন চলুন।’

যেন শুধু লীলাকৌতুকে চন্দ্রভূষণের সঙ্গে নেমে পড়েছিল বৈষ্ণবী। যেন শুধু মজা করবার জন্যেই, যেন ওই নামাটা সত্যি নামা নয়। হঠাৎ আবার কখন চড়ে বসবে ট্রেনে।

কিন্তু নাম বলে না।

বলে না, ‘চম্পা নামের একটা মেয়েকে চিনতাম।’ বলে না, ‘রাজশাহী আবার জানি না? সে কি ভোলবার জায়গা?’

বলে, ‘রাজশাহী আবার কোথায়? চম্পাটি কে গো?’ আর বলে, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন অনেক ঘাটের জল খেতে হয়েছে, অনেক ‘মহাপুরুষ’ দেখতে হয়েছে, এখন বলুন কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবেন আমাকে?’

চন্দ্রভূষণ তার উত্তর দেননি, চন্দ্রভূষণ বলে উঠেছিলেন, ‘ফেলবো, একথা তো বলিনি, চিরকাল মাথায় করে রাখবো সেই কথাই হয়েছে।’

‘যাক বাবা বাঁচা গেল—’ বৈষ্ণবী বেপরোয়া হেসে উঠেছিল, ‘এতদিনে মনের মতন একটা লোক পেলাম, যে যাবজ্জীবনের ভার নিতে রাজী। কার মুখ দেখে আজ যাত্রা গো—’

কথার ধরনই ওই।

যেন কৌতুক করছে।

যেন মোটেই নামবে না চন্দ্রভূষণের সঙ্গে, তামাসা করছে মাত্র।

যেন নামেও যদি, তো সহসা কোথায় হারিয়ে যাবে আবার।

শুধু মূঢ় চন্দ্রভূষণের ধৃষ্ট প্রস্তাবটাকে ব্যঙ্গ করতেই যেন ওর এই নেমে পড়া।

অথচ রয়ে গেল।

যেন আকাশের পাখী স্বেচ্ছায় খাঁচায় এসে ঢুকলো।

কিন্তু রইলো যেন সূক্ষ্ম একটুখানি জালের ওড়নায় মুখ ঢেকে।

চম্পাকে চেনে না, শোনেওনি কখনো তার নাম। তবে তুমি যদি সে নামে ডেকে সুখ পাও, ডাকো।

তুমি আমায় চিনেছ?

বেশ তো। ভাল কথা। তাতেই যদি খুশি হও তো হও।

কিন্তু থাক না ওই পর্যন্তই। আমি তোমায় এই নতুন চিনলাম। আমার এই ওড়না আমি নাই বা খুললাম নিজে হাতে।

তাই বলেছিল, ‘ভিখিরী, বোষ্টম, সন্নিসী, এদের কি নাম থাকে গো?’

‘নাম যদি থাকে না তো আমার দেওয়া নামটাই পাকা হোক।’

‘নাম আবার কাঁচা পাকা! কতজন তো কত নামে ডাকলো, তুমিও না হয়—হি হি হি!’

‘কিন্তু আমি তো তোমায় বানানো নাম দিচ্ছি না! তুমি যেখানে প্রথম ফুটেছিলে, যেখানে তোমার সেই সদ্যফোটা কুসুমজীবনের সৌরভ ছড়িয়ে আস্তে আস্তে দল মেলেছিলে, এ যে সেখানকার নাম!’ বলেছিলেন চন্দ্রভূষণ, এই ভাষায় না হোক, এই ধরনে।

‘ওমা তাই বুঝি! শোনো কথা! ভূতেরও আবার জন্মদিন থাকে? নতুন কথা শুনছি যে!’

হেসে গড়িয়েছে বৈষ্ণবী।

কতদিন কত মুহূর্তে চন্দ্রভূষণ বলেছেন, ‘চম্পা, তোমার মনে পড়ে না রাজশাহীতে সেই একদিন—’

ও বলেছে, ‘এই দেখ, আবার তুমি কার সঙ্গে কাকে গুলোচ্ছ! বললে সেদিন, ‘নাম নেই তো একটা নাম দিই—’ তাই জানি। ভাবলাম নামটাম ছিল না কিছু, তবু একটা মিষ্টি নাম হলো। ওমা এখন আবার লোকটা বলে কী গো! তোমার কথা শুনে মনে হয় নামটা একটা সত্যি মানুষের! তার ঘর ছিল, বাড়ি ছিল, আপনজন ছিল। না না, ওসবের মধ্যে আমি নেই। আমার ভূতও নেই, ভবিষ্যৎ নেই, আছে শুধু বর্তমান। যদি তাতেই খুশী থাকো, তোমারও কষ্ট লাঘব, আমারও কষ্টের লাঘব।’

তবু আজ সহসা অসতর্কতায় বুঝি উড়ে গেল সেই ওড়না।

পাতানো চম্পা আসল চম্পার গলায় বলে উঠলো, ‘আগে তো বেশ বুদ্ধিমান ছিলে, এমন বোকা হয়ে গেলে কেন? বুদ্ধির গোড়ায় বৌ না থাকলে—’

চন্দ্রভূষণ বাধা দিয়ে বলেন, ‘স্বীকার করছ তা’হলে, আগে চিনতে আমাকে?’

চম্পা হেসে ওঠে, ‘উদোর বোঝা বুধোর ঘাড়ে না চাপিয়ে ছাড়বে না দেখছি। কোথায় কবে একটা পাজীর পা—ঝাড়া মেয়ে ছিল, মাঝরাত্রে পরপুরুষের ঘরে এসে ঢুকতে পেছপা হতো না, আর লক্ষ্মীছাড়ামি করে মোছলমানের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছল, তার ত্যাগ করা খোলসে আমায় পুরে না ফেলতে পারলে বুঝি শান্তি নেই তোমার?’

চন্দ্রভূষণ কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, ‘না শান্তি নেই। আমি স্পষ্ট হতে চাই! চম্পা, মাঝখানের এই দিনগুলো কি সত্যিই অলঙ্ঘ্য? পার হয়ে যাওয়া যায় না? মুছে ফেলা যায় না? ফিরে যাওয়া যায় না সেই দিনটায়? যেদিন তুমি—’

‘আমি নয়, তোমার সেই লক্ষ্মীছাড়ি চম্পা বল—’

‘তুমিই আমার সেই চম্পা, যে আমায় লক্ষ্মীছাড়া করেছে!’

চম্পা আস্তে চন্দ্রভূষণের একটা হাত হাতে তুলে নেয়, বলে, ‘বেশ না হয় তাইই হলো, চম্পার সেই ছাড়া খোলসের ভিতর আবার না হয় ঢুকলাম, তারপর?’

‘তারপর?’ চন্দ্রভূষণ যেন অবোধের মত উচ্চারণ করেন।

‘হ্যাঁ, তার পরটা দেখতে হবে না? না বুঝে সুঝে ঢুকলেই হলো?’

‘চম্পা, তবে তারপর আবার ফিরে যাই চল সেদিনের পরের সকাল থেকে। তোমার মুখে আশা প্রত্যাশা আনন্দ, আমার মুখে দৃঢ় সংকল্প। বাড়ির সকলের মত করিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল চম্পা! সে চিঠির জবাব এল না। কিন্তু মনে হচ্ছে এতদিনে পেয়েছি জবাব।’

চম্পা যদি তো চম্পা, বলে ওঠে, ‘শুনতে মন্দ লাগছে না। কিন্তু জবাব পাওয়ার পরটাও ভেবে রাখতে হবে তো? তারপর?’

চন্দ্রভূষণ আহত গলায় বলেন, ‘সব সময় সব কথা হেসে উড়িয়ে দিও না। বল যদি তো বলি, তোমার আপত্তি শুনবো না আর। আমার শুধু প্রিয়া নিয়েই চলছে না, আমার বৌ চাই। যে বৌ আমার ঘরে সংসারে অধিকারের মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজ্যশাসন করতে পারবে। আমার—’

চম্পা খুব গম্ভীর আর নিরীহ গলায় বলে, ‘আচ্ছা তোমার বয়স কত হলো বলতো? বোধহয় ঊনপঞ্চাশ, তাই না? এই বয়সেই ঊনপঞ্চাশী ধরে শুনেছি।’

চন্দ্রভূষণ সহসা উঠে পড়েন।

বলেন, ‘আচ্ছা, আমার কথার উত্তর পেয়েছি। চললাম দেবুকে বোলো দোকানটা তারই রইলো—’

চন্দ্রভূষণ সেই সিঁড়িটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, যে সিঁড়িটার শেষ প্রান্তটা গিয়ে ঠেকেছে রাজরাস্তায়।

চন্দ্রভূষণ ওই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবেন, চন্দ্রভূষণ ওই রাজরাস্তায় পড়বেন। চন্দ্রভূষণ তারপর হয়তো ধূসর হয়ে যাবেন, মিলিয়ে যাবেন। আর কোনদিন ওই সিঁড়ির ধাপে ধাপে চন্দ্রভূষণের বলিষ্ঠ পদশব্দ শোনা যাবে না।

চন্দ্রভূষণ আহত হয়েছেন।

চম্পা মাত্রা ছাড়িয়েছে।

কিন্তু চন্দ্রভূষণ যে একটা ভয়ানক অবাস্তব চিন্তার মধ্যে বাস করছেন, আঘাত করা ছাড়া গতি কি? না বলে উপায় কি, ‘আগে তো বেশ বুদ্ধিমান ছিলে!’

না বলে উপায় কি, ‘বয়েস কত হলো, ঊনপঞ্চাশ?’

তাই বলে ওকে কি চলে যেতে দেবে চম্পা? যেতে দেবে চম্পার জীবন থেকে? কে জানতো চম্পার জীবনপথে আবার ওর পা পড়বে! কে জানতো ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে চলে না গিয়ে ও বলে উঠবে, ‘এসো আমার সঙ্গে!’

আশ্চর্য যে সত্যই চলে এসেছিল চম্পা। হয়তো চরম একটা ভুল করে বসেছিল সে।

সেই ভুলটা না করলে আবার সব ঠিক হয়ে যেত।

চন্দ্রভূষণের সাজানো ছক এলোমেলো হয়ে যেত না। জেঠামশাই হয়ে যাওয়া চন্দ্রভূষণ কলঙ্কের মালা গলায় পরতে বসতো না। উন্মনা হয়ে ক’দিন হয়তো ভাবতো, কে ও স্বীকার করল না, কিন্তু মনে হচ্ছিল ও বুঝি চম্পা। তারপর ভুলে যেত।

উচিত কাজ সেদিন করেনি চম্পা। চম্পা চলে এসেছিল। কারণ চম্পা লোভে মরে গিয়েছিল।

চম্পা ‘অসংযমী’ হয়েছিল। যে চম্পা রাতের অন্ধকারে একদিন ওর কাছ থেকে ছিটকে সরে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল আরো অনেক অন্ধকারের পাথারে, সেই চম্পা দিনের আলোয় আবার ওর কাছে এসে দাঁড়াবার ডাক পেয়ে লোভ সামলাতে পারেনি।

ভেবে দেখেনি, চম্পাকে ঘিরে যে অন্ধকারের বলয়, দিনের আলোকে ‘আলো’ থাকতে দেবে না সে, ম্লান করে দেবে।

চম্পা আবার জীবনের হাতছানিতে লুব্ধ হবে? জীবনের তেতাল্লিশটা বছর পার করে আসা চম্পা!

কিন্তু সত্যিই কি তেতাল্লিশ?

তিনশো বছর নয়?

শতাব্দীর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেনি চম্পা, তার জীবনের এক এক মোড়ে?

চন্দ্রভূষণ তাকে বৌ হতে বললেই হতে পারবে সে?

চন্দ্রভূষণের দিকেও যুক্তি ছিল বৈকি। চন্দ্রভূষণ একদিন শুনেছিলেন উদিতার নিজের দাদার কাহিনী। ‘অনেক হাত ফেরত’ চিত্রজগতের এক অভিনেত্রীকে বিয়ে করে, সমাজে নাকি একজন মান্যগণ্য বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে উঠেছে উদিতার দাদা! সেই বৌদি দাদার থেকে বয়সে বেশ খানিকটা বড়, কিন্তু তাতে কি? ওটাও তো প্রগতির আর এক চিহ্ন।

উদিতা অতএব তার দাদা বৌদির ‘হনিমুনে’র হরেক ছবি ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছে আনন্দে, গৌরবে, পুলকে।

বাড়িতে যে বেড়াতে আসবে, সে যেন দেখতে পায় উদিতার দাদা কেউকেটা নয়। যেন দেখতে পায় উদিতার পিতৃকুল কত প্রগতিশীল! তা’ দেখছে সেই চোখে।

ভাগ্নে ভাগ্নীরা তো তদবধি উদিতাকে পরমপূজ্যি করতে শুরু করেছে।

‘মালিনী বসু’ তোমার নিজের বৌদি ছোটমামী? তোমাদের বাড়িতেই থাকেন? উঃ কী মজা তোমার! আচ্ছা উনি ঠিক আমাদের মত?’

উদিতা কৃপার হাসি হাসে।

কারণ উদিতার মর‍্যাদা বেড়ে গেছে, কৃপার হাসি হাসবার অধিকার জন্মেছে।

উদিতার পিতৃপরিবারকে কেউ সমাজচ্যুত করেনি। উদিতার সেই আর্টিস্ট ভাইবৌ যে বাড়িতে অতিথি গেলে কখনো কখনো নিজে হাতে চা কফি পরিবেশন করে, এ শুনে মোহিত হয় লোকে, উদিতার বাবার ভাগ্যকে ধন্য ধন্য করে।

চন্দ্রভূষণ এই শোনাটা থেকে যুক্তি—

কিন্তু এ যুক্তি কি চন্দ্রভূষণের কাজে লাগবে?

চম্পা কি আর্টিস্ট? তাই ওর সাতখুন মাপ হবে?

চম্পা তো একদম রাবিশ!

আর চন্দ্রভূষণ?

ঊনপঞ্চাশের দরজায় এসে পৌঁছনো জেঠামশাই!

তবে?

কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা?

কিসের সূত্রে কিসের যুক্তি?

না, চন্দ্রভূষণের যুক্তি তাঁর জীবনের কাজে লাগবে না।

তবু চম্পা এগিয়ে আসে, সিঁড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পথ আগলায়।

বলে, ‘নিষ্ঠুরতায় দেখছি এখনো সমান আছো! ফেলে চলে যাচ্ছ যে? বলেছিলে না চিরদিনের মত ভার নেবে?’

চন্দ্রভূষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলেন, তাই নিতে চাইছি! নিতে চাইছি সম্ভ্রম দিয়ে, শ্রদ্ধা দিয়ে, সম্মান দিয়ে। কিন্তু সেটা তোমার কাছে হাস্যকর হচ্ছে—’

চম্পার বড় বড় চোখ দুটো আরো গভীর আরো কালো দেখায়, ‘যাকে যা দেওয়া যায় না, তাকে তা’ দিতে যাওয়া তো হাস্যকরই গো! তার চেয়ে এই তো বেশ আছি, রোজ তোমায় দেখতে পাচ্ছি—’

‘পাচ্ছ! তবে লোকে বলছে আমি খারাপ বাড়িতে আসছি।’

‘সে তো বলবেই’—চম্পা হঠাৎ ওর অভ্যস্ত ভঙ্গীতে হেসে ওঠে, ‘বলবে না? লোকের চোখে যার যা রং, যার যা নাম, লোকে তাইই বলবে। তুমি বাড়ির জেঠামশাই, বৌমাদের পূজনীয় ভাসুরঠাকুর, তুমি নিত্য এসে ধরনা দেবে তোমার পেয়ারের বোষ্টুমীর কাছে, আর লোকে কিছু বলবে না? না বাপু না, নিজেকে ‘নির্দোষ’ বলে চালাতে চেষ্টা করা চলবে না।’

চন্দ্রভূষণ জেদের গলায় বলেন, ‘এতে কারুর কোনো ক্ষতি হচ্ছে?’

চম্পা আবার হেসে ওঠে। সেই হাসি।

সত্যিকার চম্পা! রাজশাহীর চম্পা!

বলে, ‘সাধে কি আর বলে বুদ্ধির গোড়ায় বৌ না থাকলেই পুরুষের হতবুদ্ধি দশা!: নাই বা কারুর কোনো ক্ষতি করলে, নিজের ক্ষতি করবার অধিকারও নেই তোমার। তুমি সমাজ সংসারের একটা মানুষ নও?’

চন্দ্রভূষণ সিঁড়ির রেলিংটা ধরে আস্তে বলেন, ‘লাভ ক্ষতি বুঝি না চম্পা, জীবনের প্রারম্ভে বৌ হারিয়ে ফেলে বোকার মত সংসারের গোলকধাঁধায় ঘুরছি আর তার অভাব অনুভব করছি। হঠাৎ বিধাতা সেই হারানো বৌকে দিলেন খুঁজে—’

‘ওটা বিধাতার ব্যঙ্গ চানুদা!’ চম্পা আস্তে ওঁর গায়ে হাত রেখে শান্তগলায় বলে, ‘বৌ যদি তোমার ভাগ্যে থাকতো, আর বৌয়ের থাকতো সেই ভাগ্য, জীবনের প্রারম্ভে হারিয়েই বা যাবে কেন? ওটা আর এ জন্মে হলো না তোমার। আসছে জন্মের জন্যে মুলতুবী থাক।’

চন্দ্রভূষণ ওই শান্ত মুখের দিকে তাকান।

চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘বিধাতার এই ব্যঙ্গের কি দরকার ছিল বল তো?’

‘বোধকরি ওই কাঁটার মালাটার জন্যে!’ চম্পা বলে, ‘ওটাও পাওনা থাকে কিনা! নইলে কী দরকার ছিল বল তো, তাঁর একটা ষোলো বছরের সংসারবুদ্ধিহীন মেয়েকে ভুলিয়ে নিয়ে আগুনে ফেলে দেবার?’

চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘বিধাতার ব্যঙ্গকে ব্যঙ্গ করা যায় না? জয়ী হওয়া যায় না তার উপর?’

‘হয় না, যায় না!’ চম্পা বলে, ‘আমি তো বুঝি, তোমার মন সংসারী, তোমার মন সামাজিক, তুমি সব নিয়ে পূর্ণ। শুধু অশরীরী প্রেমের সম্বল নিয়ে নতুন জীবন গড়তে বসলে শুকিয়ে যাবে তুমি, শুকিয়ে যাবে তোমার প্রেম। তুমি বুঝতে পার না সেটা, আমি পারি। আমি তো দেখতে পাই, সংসারের কাছে আঘাত পেলে কতটা ভেঙে পড় তুমি, গল্প করতে বসলে ঘুরে ওদের কথাই এসে যায় তোমার—’

অস্বীকার করতে পারেন না চন্দ্রভূষণ।

সংসারটা তার কাছে পরম মূল্যবান।

জীবনের গভীরে যে শূন্যতা তাকে আরো গভীরে রেখে, ওই সংসারটাকে নিয়েই তো পূর্ণ হতে চেয়েছিলেন এতদিন! প্রথমে ছিল চম্পার ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র যন্ত্রণা, তারপর এল চম্পার প্রতি অবিচার করার যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার কোনো ওষুধ ছিল না। সংসারটাকেই সে ওষুধ বলে আঁকড়ে ধরেছিলেন।

কিন্তু হঠাৎ দেখতে পাচ্ছেন চন্দ্রভূষণ, তিনি সংসারটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলেও, সংসার তাঁকে আঁকড়ে থাকতে আদৌ রাজী নয়, বরং তাঁর আঁকড়ানির বন্ধনে থাকতেও নারাজ।

সে কি শুধু আজ চন্দ্রভূষণ হঠাৎ ‘চরিত্র খারাপ’ করেছেন বলে?

তা’ নয়—

বহু সন্ধ্যার গল্পের মধ্যে একথা বলেছে চম্পা, ‘নারাজ তুমি খারাপ বলে নয়, তুমি উদার বলে, তুমি মহৎ বলে, তুমি ওদের মত নও বলে।’

‘এ তুমি কী বলছো চম্পা?’

বিস্ময়াহত হয়েছিলেন চন্দ্রভূষণ।

চম্পা বলেছিল, ‘ঠিকই বলছি। তুমি যদি ওদের সঙ্গে পাই পয়সার হিসেব নিয়ে চুল চিরতে বসতে, যদি ওদের মত তোমার স্বার্থের পুঁটলিটায় কড়া করে গিঁট দিতে জানতে, যদি ওদের ওই ক্ষুদ্রতার গণ্ডির মধ্যে নেমে এসে জায়গা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে পারতে, ওরা তোমায় সহ্য করতে পারতো। কিন্তু তা তো হয়নি, তুমি উদার হয়েছ, তুমি ওদের মর‍্যাদাকে আহত করে সমগ্র সংসারের দায়িত্ব নিয়েছ, তুমি ওদের থেকে উচ্চস্তরে বসে ওদের স্নেহ করেছ, এ ওরা কতদিন সইবে? উদারতার বোঝা সবচেয়ে বড় বোঝা, বইতে পারা বড় কঠিন। তুমি অবিরত দিয়ে চলেছ, ওরা অবিরত নিতে বাধ্য হয়েছে, এ কী সোজা শাস্তি নাকি? ওরা যদি ক্রমশঃ তোমাকে সহ্য করতে অপারগ হয়ে ওঠে, দোষ দেওয়া যায় না ওদের।’

চন্দ্রভূষণ বলেছেন, ‘কিন্তু আমি তো ভালবেসেই করি। আমি তো অহমিকা দেখাতে যাইনি—’

‘তা’ বললে কি হবে? ওদের অহমিকা তো ক্ষুণ্ণ হয়ে চলেছে? দেওয়া সহজ, নেওয়া কঠিন! আমার মত বেহায়া না হলে আর—’

হেসে কথার শেষ করেছে চম্পা।

আবার একসময় চন্দ্রভূষণ রেগে উঠে বলেছেন, ‘তুমি ওদের জানো না, এক পয়সা খরচ করতে হলে মরে—’

‘জানি, জানবো না কেন?’ চম্পা হাসে, ‘তোমার যদি বৌ থাকতো, সংসার থাকতো, তুমিও তাই মরতে!’

চন্দ্রভূষণ চোখ তুলে চেয়েছেন, বিহ্বল দৃষ্টি মেলে বলেছেন, ‘আমার বৌ ওরকম হতো না।’

চম্পা হি হি করে হেসেছে, ‘হতো না মানে? অবিকল ওই হতো। ঘর পাওয়া বর পাওয়া মেয়ের মেজাজই আলাদা, বুঝলে? ঘরের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে ভরে ফেললে ঘরের মাপের মত হতে হবে তো? মেয়েদের অত উদার হলে চলে না।’

ঘুরে ফিরে প্রায়ই এ কথা হয়েছে।

হ্যাঁ, ঘরসংসারের কথাই তো বেশী।

ভালবাসার কথা আর কতটুকু?

সে তো শুধু কথার টুকরোয়, কথার অলংকারে, আর দৃষ্টির ব্যঞ্জনায়।

চম্পার কাছে এসে সুখ দুঃখের কথাই বলেন চন্দ্রভূষণ। চম্পা ধরা দেয় না, তবু মামা মামীর শেষজীবনের দুঃখময় কাহিনীর কথা বলেন, বিয়ে করা নিয়ে মার আক্ষেপের কথা বলেন, আর ইদানীং যে তাঁদের সংসারের রং হঠাৎ হঠাৎ কেমন বদলে যাচ্ছে সে কথা বলেন।

হঠাৎ নিজেকে কেমন অপমানিত লাগে, হঠাৎ যেন অসহায় লাগে নিজেকে, অবয়বহীন একটা দুঃখ যেন ঘিরে ধরতে চায়, এসব কথা বলতে পাওয়াও পরম এক সুখ!

কাউকে মনের কথা বলতে পাওয়া যে এত সুখ, একথা কবে জেনেছেন চন্দ্রভূষণ? কারো কাছে সহানুভূতি পাওয়ায় যে এত পরিতৃপ্তি, পরামর্শ পাওয়ায় যে এত রোমাঞ্চ, একথা কবে অনুভব করেছেন?

এখন মনে পড়ছে, চন্দ্রভূষণই ওদের দিকে ষোলোআনা মনোযোগ দিয়েছেন, ওরা কোনোদিন চন্দ্রভূষণের দিকে মনোযোগ দেয়নি।

চন্দ্রভূষণ বরাবর ওদের সহানুভূতি করেছেন, ওরা কোনোদিন চন্দ্রভূষণকে সহানুভূতি করেনি। চন্দ্রভূষণ ওদের পরামর্শ দিতে গেছেন, ওরা কোনো দিন চন্দ্রভূষণকে পরামর্শ দিতে আসেনি।

ওরা ছোট?

তাতে কি?

ভালবাসার দাবিতে তো সব কিছু সহজ হয়ে যায়।

চম্পা তো দিল পরামর্শ।

বললো, ‘সবসময় বোনেদের আনায় বৌরা যদি বেজার হয়, নাই বা আনলে! তোমার যখন নিজের গিন্নী নেই, জোর কার ওপর? ইচ্ছে হলে বরং তুমি ওদের কাছে চলে যেও।’

‘আমি ওদের কাছে?’

‘হ্যাঁ, মন্দ কি? দেদার বাজারপত্র করে নিয়ে হাজির হলে একজনের বাড়ি, বললে, আজ তোর কাছে খাব, রাঁধ ভাল করে—’

চন্দ্রভূষণ বিরক্ত হয়ে বলেছেন, ‘আমি খাবার জন্যে—?’

‘আহা তা’ কেন? ওদের জন্যেই। শুধু ওইভাবে বললেই শুনতে ভাল। এক বোনের বাড়িতে বা আর দুই বোনকে ডাকলে, তাতেও মজা!’

সে পরামর্শ নিয়েছিলেন চন্দ্রভূষণ, দেখেছেন সত্যি, তাতেও মজা। বেশ নতুন স্বাদ! বাড়ির সবাই ছিল না বটে, কিন্তু তাতে যেন একটা মুক্তির স্বাদ ছিল। ইদানীং যে সবসময় মনে হচ্ছে, ওরা বোধহয় এটা অপছন্দ করছে, সেটার ভার আছে।

এ পরামর্শ আর কেউ কোনোদিন দেয়নি।

সেদিন তাই বারেবারে মনে হয়েছে, যদি এই আনন্দের মাঝখানে চম্পা ঘুরতো ফিরতো!

তা’ চম্পা পরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনেছে সব।

ঠিক যেমন করে একটি প্রৌঢ় দম্পতি অবসর সময়ে বসে সংসারের গল্প করে, তেমনি দেখিয়েছে ওদের।

হ্যাঁ, ঠিক তেমনিই দেখায় ওদের।

চম্পার পরনে শুধু একটা শাদা সেমিজ আর একখানা শাদা শাড়ি, লালপাড়ের শাড়ি, চন্দ্রভূষণের বেশবাসে দোকানী মানুষের শিথিলতা।

চন্দ্রভূষণ চৌকির উপর, চম্পা সামনে একটা টুলের উপর। বিন্দুভূষণের ছোটছেলেটার বুদ্ধিমত্তার কাহিনী বর্ণনা করতে করতেই হয়তো চন্দ্রভূষণের পুরো একটা সন্ধ্যা খরচ হয়ে যায়।

কিন্তু সেই খরচটাকে কি বাজে খরচ মনে করেন চন্দ্রভূষণ?

করেন না।

চম্পার ওই সুন্দর হাসিটা তো ওতেও ক্ষণে ক্ষণে ঝলসে ওঠে, ওই বড় বড় চোখ দুটো তো ওতেও চঞ্চল হয়ে নাচে, চম্পার সুরেলা গলার মন্তব্য আর বিস্ময়ধ্বনি ওতেও তো মুহূর্তে মুহূর্তে সচকিত হয়ে ওঠে।

ওরা যে চম্পার চেনা জন নয়, তা’ তো লেশমাত্রও বোঝা যায়না।

তবে লোকসান কোথায়?

চম্পার কাছে যে—কোনো কথা কয়েও যে অগাধ সুখ! কই মনে হয় না তো এ সুখ অবৈধ, এ সুখ অশুচি!

কোনো কোনো দিন দেবু নীচ থেকে দোকান বন্ধ করে উঠে আসে হিসেবপত্র মিলোতে।

চন্দ্রভূষণ তাকে বলেছেন, ‘দোকানটা তোর, লাভ হলে তোর, লোকসান হলে তোর—’, তবু দেবু সব দায়িত্ব নেয় না। তবু আসে হিসেব দিতে।

চম্পা কি চম্পা বলে ধরা দেয়?

দেয় না।

আজই প্রথম ধরা দিল চম্পা, তুচ্ছ একটা অসতর্ক কথায় হয়তো বা ইচ্ছে করেই দিল। সূক্ষ্ম সেই জালের আবরণটুকুও ভার লাগছিল ক্রমশঃ। তাই দিল।

দেবু এলে চম্পা বলে, ‘এই যে তোমার দেবব্রতবাবু হিসেব দিতে এলেন! দিন তবে! বুঝুন মালিকে আর ম্যানেজারে, আমি আপনার খাবারটার ব্যবস্থা করিগে।’

হ্যাঁ দেবুকে চন্দ্রভূষণের ‘পেয়ারের বোষ্টুমী’ দেবব্রত বাবুই বলে। কোনোদিন তাকায়নি চোখাচোখি, কোনদিন খুলে ফেলেনি রহস্যের আবরণ।

অবশ্য দেবুও ছিল দ্বিধায়। দেবুও প্রথমে চন্দ্রভূষণকে পাগল বলেছিল।

প্রথম সেই দিনটার সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে দেবুর। তখন সন্ধ্যা। অকালবার্দ্ধক্যে জীর্ণ, আর সারাদিন দোকান চালানোর ক্লান্ত দেহটা নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উপরের এই ঘরটায় উঠছিল দেবু আর ভাবছিল, আজ আর রান্নাবান্না নয়, স্রেফ চায়ের সঙ্গে দু’খানা পাঁউরুটি খেয়ে শুয়ে পড়া, ব্যস।

হঠাৎ দেখল দোকানের সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো।

ফিরে তাকালো, আর সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রভূষণের ডাক শুনতে পেল, ‘দেবু!’

আর কিছু নয়, শুধু ‘দেবু!’

তাও যেন গলাটা কাঁপা কাঁপা।

দেবু তাড়াতাড়ি নেমে এল আধাপথ থেকে, আর এসে থতমত খেল, গাড়ীর মধ্যে আবার বসে কে! এখানেই বা এল কেন!

দিন দুইয়ের জন্যে বাইরে যাচ্ছে চন্দ্রভূষণ, এই সে জানে। কাউকে আনতে যাচ্ছে এমন কথা তো শোনেনি, আর আনলে বাড়িতে না এনে—

ওঃ বোধহয় দেবুকে কিছু নির্দেশ দিতে ষ্টেশন থেকে সোজা এখানে এসেছে, ফিরে যাবে।

দেবু তাড়াতাড়ি নেমে এসেছিল।

বলেছিল, ‘ষ্টেশনে তোমার গাড়ী যায়নি?’

‘নাঃ গাড়ী আর কি করে যাবে? আমি তো নিজেই চালাই। সে যাক, দেবু তোকে আজ দোকানেই শুতে হবে।’

দেবু মনে মনে হোঁচট খেয়েছিল।

তবে তো যা ভাবা যাচ্ছে তা নয়?

ব্যাপার কি?

সবটাই যে অন্ধকার!

চন্দ্রভূষণ তাকে আলোয় আনেন নি।

শুধু বলেছিলেন, ‘এক কাজ কর, ঘরের চাবিটা খুলে আলোটা জ্বালাগে যা। পরে বলছি।’

সাধারণ কথা, তুচ্ছ কথা, তবু যেন মনে হয়েছিল ভয়ঙ্কর উত্তেজিত চন্দ্রভূষণ। গলার স্বরে সেই উত্তেজনার কম্পন।

দেবু আবার ফিরে দাঁড়িয়েছিল, আর তখনই কানে এল তার, ‘আমায় তো স্রেফ উড়িয়ে দিচ্ছ, এবার দেবুর চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে?’ গলায় সেই উত্তেজনা।

দেবু সিঁড়িতে হোঁচট খাবে তাতে আর আশ্চর্য্য কি!

গেরুয়াপরা, কপালে তিলক, গলায় কণ্ঠি, ওই মেয়েছেলেটার সঙ্গে দেবুর আবার কিসের যোগসূত্র?

ঘরের চাবি খুলে আর আলো জ্বেলেও আর এক অন্ধকারের মধ্যে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল দেবু।

তারপর ওরা উঠে এল। চন্দ্রভূষণ তাঁর সঙ্গিনীকে ঘর দেখিয়ে দিলেন, স্নানের ঘর দেখিয়ে দিলেন। তারপর দেবুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘একে কখনো কোথাও দেখেছিস দেবু?’

দেবু তাকিয়ে দেখল, দেখল বৈষ্ণবীর মুখে রহস্যের চাপা হাসি, দেবু যেন একটা অথই জলের মধ্যে পড়লো, হারিয়ে গেল। আচ্ছন্নের মত আস্তে মাথা নাড়লো।

চন্দ্রভূষণ বললেন, ‘আচ্ছা মনে পড়বে, আগে ওর ওই কিম্ভূত কিমাকার সাজটা বদলাক। …কই যাও, হাত মুখ ধোও গে।’

বৈষ্ণবী নিজের পুঁটুলি থেকে একখানা গামছা বার করে নিয়ে স্নানের ঘর নামে অভিহিত পায়রার খাঁচাটুকুর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দেবু এবার মুখ খুললো, বললো, ‘ব্যাপার কি চানু?’

‘ব্যাপার?’ চন্দ্রভূষণের মুখে রহস্যের হাসি, ‘কেন তুই কিছু বুঝতে পারছিস না?’

‘না তো!’

‘দেখিসনি কখনো একে আগে?’

‘কি জানি, বুঝতে পারছি না তো!’

‘রাজশাহীর কথা একেবারে ভুলে গেছিস?’

‘রাজশাহী!’

‘হ্যাঁ রাজশাহী। রাজশাহীতে চম্পা বলে একটা মেয়ে থাকতো না? যাকে তুই—’

দেবু হঠাৎ প্রতিবাদ করে ওঠে, ‘ও সে? না না, কি যে বলিস! অসম্ভব!’

চন্দ্রভূষণ জেরায় নামেন, ‘কেন অসম্ভব কিসে?’

‘অসম্ভব বলেই অসম্ভব!’

‘ওটা একটা যুক্তিই নয়। অসম্ভবটা কিসে সেটা বোঝাতে হবে!’

‘বাঃ চম্পা এভাবে—এই সাজে—’

‘তা চম্পার এতদিনের জীবনযাত্রার ইতিহাস তুমি অবশ্যই জানো না। কাজেই এই ভাব অথবা এই সাজটা হতে পারে না ভাবছো কেন?’

‘কিন্তু চেহারা—একেবারেই তো—’

‘চেহারা তাই আছে! শুধু বয়সের পরিবর্তনে যা পরিবর্তন। তুমিও তখন যেমনটি দেখতে ছিলে তেমনটি নেই।’

এ যুক্তিকে অবশ্য অস্বীকার করতে পারে না দেবু। তবু অনমনীয়তাই থাকে। বলে, ‘চম্পা অনেক ফর্সা ছিল। এ তো কালো।’

‘ওর ওপর দিয়ে যা ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে এযাবৎ, সেটা হিসেব করে রঙের হিসেব করিস।’

‘তা পেলে কোথায় ওকে?’

‘রেলগাড়িতে! দেখলাম, চিনলাম, হিড় হিড় করে টেনে আনলাম, আবার কি?’ বলে একটি আত্মপ্রসাদের হাসি হাসেন চন্দ্রভূষণ।

‘ও অমনি এক কথাতেই এল?’ দেবুর কণ্ঠে অসন্তোষ।

‘এ কথাতেই কি এল?’ চন্দ্রভূষণের কণ্ঠে সন্তোষ। ‘একশো কথা কইতে হয়েছে। তবে আমি নিশ্চিন্ত।’

‘আমি নিশ্চিন্ত হচ্ছি না বাবা,—’ দেবু বলে, ‘সত্যি চম্পা হলে কখনো আসতো না। এ কোন বাজে মেয়েছেলের হাতে পড়েছ তুমি!’

‘আঃ যা—তা কথা বলিস না দেবু!’

দেবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই সময় আলোচনার বিষয়বস্তু স্বয়ং রঙ্গমঞ্চে এসে আবির্ভূত হলেন।

চন্দ্রভূষণ ইসারায় বললেন, ‘ভাল করে দেখ।’

দেবু ইসারায় বললো, ‘দেখেছি।’

‘কি মনে হচ্ছে?’

‘বাজে ধাপ্পা! ঠকিয়েছে তোমায়!’

ওই কথাই বলেছিল দেবু।

ঠকাতে আসবার পরিস্থিতিটা কি, সেটা অনুধাবন করে দেখেনি। কোনদিনই না। সমানেই বলে এসেছে, ‘ঠকিয়েছে তোমায়।’

চন্দ্রভূষণ অবিরত ওর সন্দেহভঞ্জন করতে চেষ্টা করেছেন, দেবু অবিরত সন্দেহ করেছে। তারপর চন্দ্রভূষণ বিরত থেকেছেন। বলেছেন, ‘ঠিক আছে, আমি ঠকবো, ব্যস!’

কিন্তু দেবুরই বা দোষ কি?

ও তো কোনোদিন খোলাচোখে তাকিয়ে বলে ওঠেনি, ‘যাই বল দেবুদা, তুমি দেখালে একখানা! এতদিন ধরে দেখেদেখেও চিনতে পারলে না?’

সেই আত্মপ্রকাশের মধ্যেই হয়তো সমস্ত সন্দেহের নিরসন হতো। চম্পা তা করেনি। চম্পা সমানেই বলেছে, ‘দেবব্রতবাবু’, বলেছে ‘আপনি’। এখনও বলছে।

তবু দেবুই যে ওই অপরিচিতাকে ঘাড়ে করতে বাধ্য হয়েছে, তা’তে আর সন্দেহ কি!

দেবু দোকানে শোয়, এখানে খায়।

চন্দ্রভূষণ অবশ্য প্রথমটা তাঁর কুড়িয়ে পাওয়া ঐশ্বর্যের জন্য ‘ভাল বাড়ী, ভাল বাড়ী’ করে অস্থির হয়েছিলেন। কিন্তু নিজেই সে আপত্তি করেছে। বলেছে, ‘কেন এই তো বেশ! ছোট মানুষ, ছোট ঘর, তা ছাড়া অন্যত্র গেলে আগলাবারও তো একটা লোক চাই। এ তবু দেবব্রতবাবু নীচের তলায় থাকছেন।…

দেবব্রতবাবুর অসুবিধে?

ছাড়ুন ও কথা।

‘ভারী একেবারে লাটসাহেব এসেছেন!’

তাছাড়া ঘরের দখল নিলে তো আবার সেই রেঁধে খাওয়ার ভাবনা।’

দেবুও বলেছে, ‘সত্যি কী এত তালেবর যে, দোকান ঘরের মধ্যে শুতে পারব না? পেছনে জানলা দরজা রয়েছে, উঠোনে কল চৌবাচ্চা রয়েছে। এ বরং দোকানে তালা দেওয়ার দায় থেকে বেঁচেছি।’

বাঁচছে!

তা সকলেই বেঁচেছে, বাঁচছে।

দেবু বেঁচেছে রাঁধা—ভাত, কাচা—কাপড় পেয়ে। চন্দ্রভূষণ বেঁচেছেন মনের কথা কইবার লোক পেয়ে। আর আঘাটায় ঘুরে মরা চম্পা বেঁচেছে একটা বাঁধানো ঘাট পেয়ে।

কিন্তু চম্পা নিজেকে প্রকাশ করেনি কোনদিন। নিজেকে ঘিরে পরিচয় অপরিচয়ের একটি রহস্যজাল রচনা করে এদের মধ্যেই রয়ে গেছে।

তবু ক্রমশঃই যেন দেবুর সংশয় মোচন হচ্ছে।

ও যখন বলে, ‘দেবব্রতবাবু, আপনার ভাত বাড়া হয়েছে—’

তখন যেন একটা চেনা সুর ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে।

ও যখন বলে, ‘দেবব্রতবাবু, ধোবা আপনার কাপড় দিয়ে গেছে—’

মনে হয় যেন ওই ‘বাবু’ শব্দটা কৌতুক আর ব্যঙ্গে মণ্ডিত হয়ে কানে এসে বিস্মৃত অতীতের একটা বন্ধ দরজা খুলে দিয়ে গেল।…

তবু চন্দ্রভূষণ ইদানীং আর এ নিয়ে আলোচনা করেননি। যেন বাহুল্য বোধেই ত্যাগ করেছেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন