অনবগুন্ঠিতা – ১০

আশাপূর্ণা দেবী

চম্পা হঠাৎ ভারী শান্ত হয়ে যায়।

বদ্ধ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে, তারপর বলে, ‘যদি বলি সত্যিই পালাচ্ছিলাম।’

‘পালাচ্ছিলে! পালাচ্ছিলে তুমি? কার কাছ থেকে পালাচ্ছিলে?’

চন্দ্রভূষণের কণ্ঠস্বরে স্থিরতার অভাব।

চন্দ্রভূষণের পা দুটোতেও যেন সেই অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

চরিত্রহীন চন্দ্রভূষণ কি তবে এবার—

অধঃপাতের শেষ ধাপে নামছেন?

মদ্যপও হচ্ছেন?

বেএক্তার হয়ে এসেছেন? না কি অসুস্থই?

চম্পা শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায়। তবু স্থির গলায় কথা বলে, ‘যদি বলি নিজের কাছ থেকে?’

‘নিজের কাছ থেকে পালাতে পারো, আমার কাছ থেকে কেমন পালাও দেখি!’

‘সে ক্ষমতা নেই বলেই তো চোরের মতন চুপিচুপি—কিন্তু তুমি অমন টলছো কেন? স্বভাব খারাপ তো করেইছ, আবার মদও ধরছো নাকি?’

চন্দ্রভূষণ হঠাৎ খাপছাড়াভাবে হেসে ওঠেন।

বলেন, ‘সন্দেহ হচ্ছে বুঝি? ধর তাই, হা হা হা! এখন দেখ, এরপরও এই হতভাগাকে ভালবাসতে পারবে কি না।’

চম্পা গম্ভীরভাবে বলে, ‘বিবেচনা করে দেখতে হবে। এখন চল দিকি ওপরে। মনে হচ্ছে তো জ্বর এসেছে। আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাক্যব্যয়ে কাজ নেই, চল চল।’

চন্দ্রভূষণ স্খলিত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকেন।

চম্পা দ্রুত পিছু পিছু এগোয়।

পথের মাঝখানে গায়ে হাত দিয়ে জ্বর হয়েছে কিনা দেখে না, শুধু তীব্র কণ্ঠে বলে, ‘এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে আসার কি দরকার ছিল?’

‘দরকার?’

চন্দ্রভূষণ ফিরে দাঁড়ান, বলেন, ‘একটা প্রকাণ্ড দরকার তো ছিলই দেখতে পাচ্ছো? অহঙ্কার করে চলে যাওয়া হচ্ছিল—’

‘অহঙ্কার!’

চম্পা কপালে একটা চাপড় মারে, ‘অহঙ্কার করবারই কপাল যে! গুরু রক্ষে করেছেন তাই সত্যি আরও দু’পা এগোইনি।…কিন্তু পায়ে হেঁটে কেন, সেটা তো বললে না? গাড়ীখানা বেচে খেয়েছ নাকি?’

‘ঠিক ঠিক, তাই।’ ঘরে ঢুকে চৌকীটার ওপর ধপ করে বসে পড়ে উত্তর দেন চন্দ্রভূষণ, ‘গাড়ী বেচে খেয়েছি, বাড়িও বেচে খাব। টাকার দরকার, বাবুদের টাকার দরকার, বৌরা আর ওই পচা বাড়িতে থাকতে রাজী নয় বুঝলে? দু’লাখ টাকার বাড়িখানা বেচে ফেলে টাকা ভাগ করে নিয়ে, আলাদা আলাদা ছোট ছোট পায়রার বাসা গড়ে বাস করবে। …ভুলে যাবে ওই বাড়িতে আমাদের ঠাকুর্দার গায়ের রক্ত মিশে আছে, ওই বাড়িতে আমার মা কনে বৌ হয়ে এসে ঢুকেছিলেন, আবার ওই বাড়ি থেকেই বিদায় নিয়েছেন। ভুলে যাবে ওই বাড়িতে আমরা সবাই জন্মেছি। আমার কাকা—জ্যাঠার ছেলেরা কেউ বাড়ি বেচলো না, আমরা বেচবো! বরাবর যারা একসঙ্গে নিশ্বাস নিচ্ছিলাম, এক ছাতের নীচে ঘুমোচ্ছিলাম, তারা পরস্য পর হয়ে যাব, কেউ কাউকে চিনতে পারব না আর! ছেলেগুলোকে কেড়ে নিয়ে চলে যাবে। ঠিক আছে, ভালই হয়েছে, তোমাতে আমাতে কাশী চলে যাব এবার। বাড়ি বেচার আগেই চলে যাব। পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছিলে, মাথায় চেপে বসবো দেখো।…আমায় জব্দ করবে সবাই? আমি পারি না জব্দ করতে?’

চৌকীটার উপর শুয়ে পড়েন, আধখানা শরীর ঝুলিয়ে। চম্পা একহাতে ধরে ঠেকিয়ে রেখে গলা বাড়িয়ে উদ্বিগ্নগলায় চেঁচিয়ে বলে, ‘দেবুদা! দেবুদা! শীগগির এসো, জ্বরে কাঠ ফাটছে চানুদার।’

দেবুদা!

দেবুদা, চানুদা!

উন্মোচিত হল সূক্ষ্ম জালের ওড়নাটুকু, বেরিয়ে এল ভিতরের মানুষটা।

দোকান বন্ধ করে উঠে এসে বাড়া খাবারের কাছে বসে পড়েছিল দেবু নিত্য নিয়মে, জানতেও পারেনি কি ঘটছিল এতক্ষণ। ভেবেছিল ছোট্ট কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে ছাতে উঠে গেছে হয়তো চম্পা। চানুটা তো দেখছি আসেনি আজ!

হঠাৎ আর্তনাদটা কানে এল, ‘দেবুদা, দেবুদা! জ্বরে কাঠ ফাটছে চানুদার।’

‘আজ আর তা’হলে রাত্রে ফিরলেন না—’ ইন্দু ঘরটার দরজায় উঁকি মেরে বলে, ‘এইরকমই হবে ক্রমশঃ জানতাম।’

বিন্দুও এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘গেলেনই বা কখন? অনেকক্ষণ পর্যন্ত তো শুয়েছিলেন—’

‘গেছেন উঠে। দেখে গেছি ঘরে নেই। নেশাটা তো মদের নেশার চাইতে কিছু কম নয়! যাকগে, সতীশকে বলে দাও গেটে তালা দিয়ে দিতে।’

নিজ নিজ শয়নকক্ষে ঢুকে যায় দুজনেই।

এবং নিজ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে দাদার অধঃপতন সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকে, ঘৃণা লজ্জা আর আক্ষেপের সঙ্গে।

কিন্তু দাদার অধঃপতনের কতটুকুই বা দেখেছে ওরা এ পর্যন্ত? দেখবার আরো কত তোলা ছিল তা’ কি ভেবেছে ওই আক্ষেপের সময়? ঘুণাক্ষরেও ভেবেছে? ওরা জানে দাদা মোহিনী মায়ায় চরিত্র হারিয়েছে—এই তো!

কিন্তু কে ভেবেছিল, দাদা সেই মোহিনীর কোলে মাথা রেখে গাড়ি চেপে ভোরবেলা এসে ওই বন্ধ গেটের চাবি খোলাবে? চাবি সতীশই খুলে দিয়েছে, ওরা শুধু পাথর হয়ে তাকিয়ে আছে।

শেষকালে কিনা মৃত্যু হল খারাপ জায়গায়!

কী মানুষের কী পরিণাম!

কিন্তু নামাচ্ছে না কেন গাড়ী থেকে?

এরা কি ছুটে এগিয়ে যাবে?

‘দাদা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে?

ওই মেয়েমানুষটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে গেটের বাইরে বার করে দেবে? যে নাকি গাড়ী থেকে নেমে গেটে ঢুকছে?

বলবে, ‘সর্বনাশী পিশাচী, জ্যান্ত থাকতে তো মানুষটাকে গ্রাস করেছিলি, মৃতদেহটাতেও অধিকার জানাতে এসেছিস? তুই এলি কি বলে? বল কোন লজ্জায় এসে মুখ দেখাচ্ছিস?’

কথাগুলো মনের মধ্যে তোলপাড় করছে, অথচ বলে ফেলা যাচ্ছে না। বুকের মধ্যে আরও ভয়ঙ্কর একটা তোলপাড়।

দাদা নেই!

দাদা মরে তাদের ওপর টেক্কা দিয়ে গেলেন!

দাদা কি তবে ‘সেখানে’ গিয়ে বিষ টিষ খেলেন? ভাইদের ওপর এতই মর্মাহত হলেন?

হঠাৎ দুচোখ জ্বালা করে জল আসে বিন্দুর। এতটা করবার ইচ্ছে ছিল না তার, শুধু সুনন্দার অসহিষ্ণুতাতেই—

স্ত্রীলোক মাত্রেই অকল্যাণরূপিনী তাতে আর সন্দেহ কি!

সময় সামান্যই।

হয়তো মিনিট দুই, তার মধ্যেই দু’ সহস্র স্মৃতি উথলে ওঠে।

ইদানীং নষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু আগের সেই দাদা? বুক দিয়ে রক্ষা করেছেন, প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছেন।…

ওটা আবার কে নামছে গাড়ী থেকে?

দেবুদাটা না?

যেটা এসে জুটে দেবতাকে ভূত বানিয়ে ফেলেছে!

ওটা সঙ্গে এসেছে।

তা আসবেই তো। ওটাই তো দালাল! উচ্ছন্নে পাঠাবার গুরু! মৃত্যুর পরও অশুচি স্পর্শ! ছি ছি!

আর একবার ভাবলো, কী মানুষের কী পরিণাম! তারপর সেই পাজীটাকে উদ্দেশ করেই শুকনো গলায় বলে উঠলো ইন্দু, ‘ব্যাপার কি দেবুদা? আমি তো কিছুই বুঝতে—’

সহসা বজ্রপতন হলো সামনে।

সেই নির্লজ্জ মেয়েমানুষটা কাছে এগিয়ে এসে সোজা সপ্রতিভ গলায় বলে উঠলো, ‘যাক তবু একজনেরও বাক্যি ক্ষমতা আছে দেখছি। ভয় হচ্ছিল ভুল করে কোনো বোবার ইস্কুলে ঢুকে পড়লাম না তো! তা আপনিই বোধহয় মেজ ভাই? নীচের তলার ঘরে একটা বিছানা পাতিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন তো, বিছানা না পাতিয়ে নামানো যাবে না, প্রবল জ্বর আপনাদের দাদার।’

জ্বর!

মৃত্যু নয়, বিষটিষ কিছু নয়, শুধু জ্বর! বিন্দুর মুখ দেখে মনে হল কে যেন দারুণ ঠকিয়েছে তাকে! অনেকটা মূল্য দিয়ে কিনে, দেখছে জিনিসটা পচা।

আর ইন্দুভূষণ?

তার সামনে যেন ভয়ানক একটা পাপাচার ঘটছে, মুখে সেই অনুভূতির গভীর কুঞ্চন। ঘৃণা, ধিক্কার, বিস্ময়, সব কিছু ফুটে উঠেছে তার মুখে।

ওই মেয়েমানুষটাই তা’হলে?

কিন্তু কত বড় জাঁহাবাজ ও, তাই এমন করে বুক জোর করে এবাড়িতে এসে দাঁড়ায়? আর কত বড় শয়তান যে অমন গলা খুলে কথা বলে?

ব্যঙ্গ করলো!

বোবার ইস্কুলে ঢুকে পড়েছেন বলে ভয় হচ্ছিল!

চাবুক নেই বাড়িতে? চাবুক?

নিদেন পক্ষে ঝাঁটা?

কাকে দিয়ে মারানো যাবে? সতীশকে দিয়ে? নাকি পুলিশে হ্যাণ্ডওভার করে দেওয়া হবে? বলা যাবে, সহজ মানুষ রাত নটার সময় বেরিয়েছিল, এখন এই অবস্থায়—

কে বলতে পারে পানের সঙ্গে, কি চায়ের সঙ্গে, কিছু খাইয়ে দিয়েছে কিনা। বদ মেয়েমানুষের অসাধ্য কিছু আছে নাকি?’

হ্যাঁ পুলিশেই দিতে হবে।

সেই সঙ্গে ওই দেবাটাকেও।

ওর সঙ্গ মুক্ত হলে হয়তো চন্দ্রভূষণ আবার শুধরে যেতে পারেন।

কিন্তু বিন্দু ইন্দুর স্ত্রীরা?

যারা নাকি এখন সেই চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ দাঁড়িয়ে আছে।

তারাও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল যেন!

এখন শিউলী ভাবলো, এইরে আবার কী গেরো দেখ!

ভাবছিলাম, মুড়ি গরম থাকতে থাকতেই খাওয়া হয়ে যাবে, তা নয় আবার সেই তপ্ত মুড়ি জুড়বে, তবে!

এখন তো উনি শয্যা নিলেন, কবে উঠবেন, আদৌ উঠবেন কিনা ঈশ্বর জানেন। বাড়ি বিক্রীর কথা অতএব মাথায় উঠলো এখন।

তারপর কে জানে ভিতরে ভিতরে কি ঘটেছে।

ওই বেহায়া মাগীটা যে রকম বুকের পাটা করে সঙ্গে এসে ঢুকছে, ওকেই যথাসর্বস্ব দানপত্র করে বসেননি তো! কিম্বা কে জানে, নীলামে তুলে বেনামী করে নিয়েছেন কিনা। তলে তলে এসব নাকি করা যায়। আর মেয়েমানুষের নামে বেনামী করা সম্পত্তিতে জ্ঞাতিবর্গের দাঁত ফোটাবার অধিকার থাকে না।

হয়েছে, নিশ্চয় তেমনি একটা কিছু হয়ে বসে আছে! নচেৎ ও কোন সাহসে—?

শেফালী আরও একটু ভাবে। তার বর দেওরের মতই ভাবে, ভগবান জানেন জ্বর না বিষটিষ কিছু দিয়েছে। বিষয় সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়ে বিষ খাইয়ে মারার উদাহরণও তো আছে। হঠাৎ মরার বিষে সন্দেহ হবার সম্ভাবনা বলে হয়তো মৃদু কোনো বিষ! আছে, জগতে সবই আছে। কোনো একটা পাপিষ্ঠ ডাক্তারকে হাত করতে পারলে কি না করা যায়? তিল তিল করে মারবার মত বিষ এরাই জোগান দিতে পারে।

তার মানে বটঠাকুর গত হবেন, আর ওঁর ওই ‘ইয়ে’র সঙ্গে মামলা লড়তে হবে আমাদের!

গুরুদেব, তোমার মনে এই ছিল?

কোথায় নগদ পঞ্চাশ হাজার হাতে করে সপরিবারে তোমার আশ্রমে গিয়ে পড়বার স্বপ্ন দেখছিলাম, সে জায়গায় কি না এই বিপত্তি!

কিন্তু ওদের এই ভিতরের কথা বাইরের লোকের বোঝবার সাধ্য হয় না। সে তাই সরে এসে গায়ে পড়ে বলে ওঠে, ‘নাঃ পাথরে প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে না দেখছি। মানুষটা জ্বরে বেহুঁস হয়ে গাড়ীতে গুঁজে বসে আছে, তুলে এনে শোওয়াতে হবে তো? দেবুদা একলা পারবে না, আপনারা কেউ এসে হাত লাগান।’

বলা বাহুল্য হাত লাগাবার জন্যে উৎসাহ বোধ করে না কেউ। শুধু ইন্দুভূষণ এবার তীব্রস্বরে বলে ওঠে, ‘উনি কোথায় কিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তা না জানতে পারলে তো এখন বাড়িতে নেওয়া যাবে না!’

‘বাড়িতে নেওয়া যাবে না?’ অবাক গলায় বলে চম্পা।

‘কি করে যাবে?’ ইন্দু আরো তিক্ত গলায় বলে, ‘ধরুন যদি মার্ডার কেস হয়?’ তুমি বলতে গিয়েও আপনিটাই বেরিয়ে যায়।

চম্পা হতবাক গলায় বলে ‘মার্ডার কেস?’

ইন্দু একটা হিংস্র আমোদ বোধ করে।

হয়েছে, ঘায়েল করা গিয়েছে।

এই পথেই তোমায় দেখাচ্ছি মজা।

তাই আরো কটু গলায় বলে, ‘আশ্চর্য কি? জগতে এমন ঘটনা ঘটে না তা নয়। আপনি তো ঘরে তুলে দিয়ে সরে পড়বেন, তারপর? পুলিশ এসে আমাদের হাতে দড়ি পরাবে না?’

‘এই কথা!’

চম্পার মুখে একটা অলৌকিক হাসি খেলে যায়। হাসির মত গলাতেই বলে, ‘সে ভাবনা করবেন না। ফেলে পালাব না। ইহজীবনেও না! বরং এক কাজ করুন, আপনাদের পছন্দ মত একটা ডাক্তার ডেকে আনুন, দেখুন এসে তিনি কেসটা কি? জানা ডাক্তার দেখবে বলেই সেখান থেকে এখানে ছুটে আসা।… তা কেউ যদি না ধরে, সতীশ তুইই বাবা একটু ধর। বড়বাবুর শোবার ঘর তো দোতলায়? সেখানে তুলতে গিয়ে কাজ নেই এখন, এইখানেই বৈঠকখানা ঘরে—যা বাবা আগে ছুটে বড়বাবুর ঘর থেকে একটা চাদর আর একটা মাথার বালিশ নিয়ে আয়।’

সতীশ!

তুই।

ফরমাস!

এ কী জাঁহাবাজ মেয়েমানুষ?

আশ্চর্য যে সতীশটাও ওই হুকুমে ছুটলো। এবং মুহূর্তের মধ্যে আনলোও।

নির্লজ্জ মেয়েমানুষটা বলে ওঠে, ‘ঠিক আছে, এবার ধরাধরি করে নামা এসে। দেবুদা সাবধানে ধরবে, দেখো যেন হাঁটুটা না দুমড়ে যায়। না বাবা, আমিও ধরি গিয়ে। …দেবুদা একটু থেমে। …এই যে তুমিই বোধ হয় সেজ বৌ সুনন্দা? চাদর বালিশটা ঠিক করে দাও তো ততক্ষণ। তারপর কেউ ছুটে গিয়ে ডাক্তার আনুক একজন।’

হুকুম!

নির্দেশ!

অর্থাৎ পরিকল্পিত দুঃসাহস!

পুত্তলিকায় প্রাণ সঞ্চার হয়। তবে ফরাশে ফরসা চাদর পেতে দিতে নয়, তীব্র একটা প্রশ্নের মধ্যে ঠিকরে ওঠে সেই লক্ষণ, ‘আপনি কে শুনতে পারি কি? উনি হঠাৎ আপনার কাছেই বা জ্বরে পড়তে গেলেন কেন? আর আপনিই বা কোন অধিকারে হঠাৎ এসে আমাকে ‘তুমি’ বলবার সাহস করছেন?’

‘বলছি’, মহিলাটি বলেন, ‘আগে ওঁকে শোওয়াই।… দেবুদা ভাল করে ধর ভাই!… এই সতীশ যা তুইই ছুটে যা, বিছানাটা ঠিক করে দে। …দেবুদা সাবধান!’

হয়তো চন্দ্রভূষণের বেহুঁশ অবস্থাটা দেখেই ইন্দ্রভূষণ একটু ইতস্ততঃ করছিল, গুছিয়ে শোওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে সে, তীব্র ব্যঙ্গের সঙ্গে বলে ওঠে, ‘দেবুদার আড্ডাতেই বুঝি যাতায়াত হচ্ছিল আজকাল দাদার? তা’ দেবুদা, ইনি খামোকা দাদার মালিক হলেন কি করে শুনতে পাই না?’

‘ইনি’ চন্দ্রভূষণের ঘাড়ের নীচে বালিশটা ভাল করে গুঁজে দিয়ে এবার ঘুরে দাঁড়ান। তারপর খোলা গলায় হেসে উঠে বলেন, ‘জ্বরটা বেশী, মনটা ভাল নেই, তবু না হেসে থাকতে পারছি না ভাই। তুমিই বোধহয় মেজঠাকুরপো?

তোমাদের দাদার মালিক কি আমি হঠাৎ আজ হলাম? এ যে দু’যুগের। আমি রাজশাহীর চম্পা, তোমাদের বড় ভাজ। ডাকাতে লুঠ করে নিয়ে ভারী ভুগিয়েছে অনেকদিন। তোমাদের সঙ্গে তো চেনাজানাই হয়নি।’

চম্পা আস্তে চন্দ্রভূষণের গায়ের উপর একটা চাদর ঢাকা দিয়ে দেয়।

সতীশের বিবেচনাপ্রসূত দুখানা চাদরের একটা।

পুরুষরা থতমত খায়।

রাজশাহীর চম্পা? যাকে নিয়ে দাদার বদনাম, একি তবে বেলেঘাটার সে নয়? এ আবার আর কেউ?

শুনেছিল, সে নাকি নাকে রসকলিকাটা বৈষ্ণবী, শুনেছিল, লক্ষ্নৌয়ের নাচনা গাওনা বাঈজী, কিন্তু শোনার সঙ্গে দেখার মিল হচ্ছে না তো!

শুকনো মুখ, রুক্ষুচুল, একেবারে তাদের মা কাকীমাদের ধরনে পরা যেমন তেমন সেমিজ শাড়ি। মুখের রেখায় উদ্বেগ আর ক্লান্তির ছাপ!

এই মুখ নিয়ে রোগীর বিছানায় চুপ করে বসে থাকলেই মানাতো, কিন্তু সেই মানানটা না করে বেমানান কাজ করছে ও।

কথা বলছে। তীক্ষ্ন তীব্র আর অদ্ভুত আশ্চর্য একটা কথা বলছে।

আর বলছে একেবারে সহজ জোরের সঙ্গে। কী এটা?

পুরুষরা ভাবছে। রাজশাহী আর চম্পা শব্দটা তাদের নাড়া দিয়েছে। তাই তারা সহসা চুপ করে গেছে।

মেয়েরা চুপ করে থাকতে জানে না, মেয়েরা কথা বলে।

সুনন্দা তাই কথা বলে ওঠে।

সুনন্দা বলে, ‘বিয়েটা বুঝি সকলের অজানাতেই হয়েছে? আমরা তো জীবনেও শুনিনি।’

চম্পা হেসে ওঠে।

বলে, ‘ওমা, তোমরা তখন কোথায়? কখনো মামাশ্বশুরবাড়ি চক্ষেও দেখনি তো? তোমাদের মামাশ্বশুরবাড়িতেই তো আমার স্থিতি ছিল, শোনোনি বুঝি কখনো? উনি যে আমার মাসী ছিলেন। তাঁর কাছেই মানুষ, আর ইনিই তো সেইখানেই—’ একটু হেসে থেমে গেল।

বিয়ের কথাটার অবশ্য ফয়সালা হলো না। কিন্তু সেটা ধরাও পড়লো না।

ইন্দু এবার কথা বললো।

ভুরু কুঁচকে বললো, ‘বিয়ের কথাই হয়েছিল শুনেছি, বিয়ে হয়ে যাওয়াটা কেমন?’

চম্পা মৃদু হেসে বলে, ‘কেমন’ সেটা তো ভাই এই বেহুঁশ মানুষটার হুঁশ না হলে বোঝানো যাবে না!’

ইন্দু ক্রুদ্ধ অনমনীয় গলায় বলে, ‘কেউ জানল না শুনল না, বিয়ে হয়ে গেল, একথা আর যে কেউ মানুক, আমি মানতে রাজী নই।’

‘না হলে নাচার। তুমি বিষয়ের ভাগ দেবার ভয়ে অরাজী হলেই তো আর ধর্মসাক্ষী করে বিয়েটা নাকচ হয়ে যাবে না। কিন্তু এখন কথা থাক ভাই, ডাক্তারের বিশেষ দরকার।’

ইন্দু অথবা বিন্দু কেউই অবশ্য ওই বিশেষ দরকারে উৎসাহ দেখায় না। তারা শুধু স্মৃতির সাগর তোলপাড় করে।

তবে কি বাড়িতে যে ঝড়টা উঠেছিল, সেটা বিয়ের অনুমতি প্রার্থনায় নয়? সংবাদ নিবেদনে? দু’যুগ পরে সেই বিয়ের বৌ এসে ঠেলে বাড়িতে উঠবে?

খুব ভুল হয়ে গেল, গেট বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল। রুগী নিয়ে ফিরে যেতে হলে এতটা মুখসাপোট করতে পারতো না। … দাদার জ্বর শুনে আমরাও কেমন ‘ইয়ে’ হয়ে গেলাম! শয়তান মহিলাটি বুদ্ধিমতী খুব! জানে একটা রুগীকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারলে সহজে কিছু করা যায় না তাকে।

যে রকম বুকের পাটা, একেবারে মিছে কথা নয় বোধ হয়। নিশ্চয় আমাদের সেই ফিচেল মামীটা—ফিচেলই, তা নয়তো অমন গুণবান পুত্ররত্নের জননী হন? তা তিনি নির্ঘাৎ ভাগ্নেটাকে কোর্টে পেয়ে বোনঝিটাকে গলায় গেঁথে দিয়েছিলেন ভুলিয়ে ভালিয়ে।

তা সে যাই হোক, সহজে স্বীকার পাচ্ছিনা বাবা, বলবো কোথায় তার প্রমাণ? কে তার সাক্ষী? বিয়ে হয়েছিল বললেই বিয়ে প্রমাণ হয় না! ধর্ম সাক্ষী? আসুন তবে ধর্মঠাকুর সাক্ষীর কাঠগড়ায়! …আশ্চর্য, দাদা একটা রামগঙ্গা কিছুই করছে না! সত্যি বেহুঁশ না সাজা বেহুঁশ ঈশ্বর জানেন! গায়ে হাত দিয়ে দেখতেও প্রবৃত্তি হচ্ছে না যে! …ডাক্তার একটা আনছি, দেখি কি বলে সে।

এঘরে ফ্যান নেই।

চম্পা ইত্যবসরে ঘরের কোণে রাখা জলের কুঁজো থেকে জল নিয়ে রুগীর পকেটেরই রুমালটা ভিজিয়ে কপালে জলপটি দিয়ে, একখানা খবরের কাগজ পাট করে বাতাস দিতে বসেছিল, সতীশ কোথা থেকে একখানা রান্নাঘরের হলুদমাখা বাঁটভাঙা পাখা এনে হাজির করল।

‘এনেছিস? লক্ষ্মী ছেলে!’ বলে পাখাটা হাতে নেয় চম্পা। তারপর উপস্থিত সবাইকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ওকেই উদ্দেশ করে বলে, ‘তুই তো পুরনো লোক, এদের ডাক্তারবাবুর বাড়ি চিনিস না?’

সতীশ সমবেতদের দিকে একবার অস্বস্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৃদু উচ্চারণে বলে, ‘চিনবনা কেন?’

‘চিনিস? তা তুই একবার যা বাবা! দেখছিস তো তোর বাবুদের সময় হবে না!’

এই ব্যাঙ্গোক্তিতে এবার শেফালী কথা ধরে।

কড়া গলায় বলে, ‘আপনার সাহসটা বেশ জোরালো, সেটা স্বীকার করতেই হবে। তা’ ধর্মসাক্ষীরই ব্যাপার যখন, সাড়া শব্দ ছিল না কেন এতদিন?’

‘ওই তো বললাম ভাই, ডাকাতে লুঠ করে নিয়ে গিয়ে একেবারে নিঃসার করে দিয়েছিল।’

ভাই!

‘ভাই’ শব্দটা কানে ছুঁচের মত ফোটে।

তবু চট করে সে সম্পর্কে কোনো প্রতিবাদও করতে পারে না শেফালী, বিরক্ত তিক্ত গলায় বলে, ‘ওঃ, তা’ হঠাৎ এখন যে?’

তা’ ওদেরও দোষ দেওয়া যায় না।

সক্কাল বেলা ঘুম ভেঙেই যদি দেখা যায় মাথার উপর একটা পাহাড় পড়েছে, কে না ঘাড়টা ঝাঁকায়? কে তাকে মাথার মণি বলে আহ্লাদে গ্রহণ করে?

এরাও করছে না।

বলছে, ‘ওঃ তা’ হঠাৎ এখন যে?’

তা’ বেহায়াদের বোধকরি অভিমানও থাকে না, অপমান জ্ঞানও থাকে না।

তাই চম্পা স্বচ্ছন্দে বলে, ‘হঠাৎ আর কি, দেখছোই তো ‘কারে’ পড়ে। নইলে তোমাদের ভাসুর তো নিয়ে আসবার জন্যে অস্থির। আমিই আসতে রাজী হইনি এতদিন! বলতাম, রোজ তো দেখা হচ্ছে সেই ঢের! জা দ্যাওরদের সঙ্গে চেনাজানা নেই—তা’ ছাড়া—’ আরো হেসে ওঠে, ‘ডাকাতে লুঠে নিয়ে যাওয়া বলে যদি আবার তোমরা নাক উঁচু কর! … তা’ ভেবে দেখলাম কত লুঠের মাল তরে যাচ্ছে আজকাল, আমি কেন লোকটাকে আর কষ্ট দিয়ে মরি!’

হ্যাঁ, এই কথাই সত্য কথা। এ কথা সাময়িকের প্রয়োজনে বানানো কথা নয়। কালকের সেই আতঙ্কিত বিনিদ্র রাত্রি, একটা নতুন সত্যের দরজা খুলে দিয়েছে তার সামনে। চম্পার সংস্পর্শে এই মানুষটা অশুচি হয়ে যাবে কেন? চম্পা কি নিজে অশুচি? চম্পার উপর যদি একটা হিংস্র বাঘ তার থাবা বসাতো, চম্পা কি তার শুচিতা হারাতো? আর এই মানুষটার আজীবনের একনিষ্ঠ ভালবাসা? তার কোনো মূল্য নেই? এতই ক্ষমতাহীন সে? সে পারবে না চম্পার সব কলঙ্ক মুছে দিয়ে চম্পাকে এ বাড়ির বড়বৌ করে তুলতে? আনুষ্ঠানিক একটা বিয়ে হয়নি বলে সব ব্যর্থ? সারারাত্রি এই প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলে এসেছে চম্পা সকালে। দ্বিধাহীন গ্লানিহীন পরিশুদ্ধ মন নিয়ে।

ওরা তাদের দাদার অচৈতন্য মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। সাক্ষ্য মানবার উপায় নেই।

অতএব দেবু।

তীক্ষ্নকণ্ঠে বলে, ‘তা’ দেবুদাটি কোথা থেকে জুটলো?’

‘ওমা! শোনো কথা, দেবুদা আমারও দাদা নয়? মাসীর ছেলে তো! ওই তো আমার একমাত্তর দাদা। উঃ কত মার খেয়েছি ওর কাছে। তোমাদের দাদাই তো রক্ষা করেছেন। যাক, সব কথা পরে হবে, এখন যাও ভাই লক্ষ্মীটি, তোমাদের বাড়ির ডাক্তারবাবুকে একটা খবর দাও। তিনিই বুঝবেন ভাল। তাই ছুটেপুটে নিয়ে আসা! সতীশ সাহস পাচ্ছে না। …বাড়ি বাড়ি’ করে তো বেচারার জ্বরই এসে গেল!… শুনলাম নাকি পৈত্রিক বাড়ি বেচে দিতে চাইছ তোমরা? … আমি কিন্তু ভাই আপত্তি তুলবো তা’ বলে রাখছি।’

যুগপৎ দুটো গলা থেকে শব্দ ওঠে, ‘আপত্তি? আপনি আপত্তি তুলবেন?’

‘তা’ তুলবো। বলবো তোমাদের উকিলকে, আমি বাড়ির বড়বৌ, দাদা—শ্বশুরের এই বাড়ি বেচে দেওয়ায় আমার মত নেই। … এই বাড়িতে আমার শাশুড়ী দিদিশাশুড়ীর লক্ষ্মী ষষ্ঠী মনসা মঙ্গলাচণ্ডী—সব। এ ভিটে কি নষ্ট করতে আছে? …আর তোমরাই বা তা’ করবে কেন ভাই? …দেবুদা, একটু বরফ তো আনাতে হবে! … কই ডাক্তারের কি হল গো? বিনা চিকিৎসায় মরবে নাকি তোমাদের বড় ভাই?’

বিন্দু তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ইন্দু বোধকরি ডাক্তারকে খবর দিতেই রাস্তায় নামে।

অধ্যায় ১০ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন