অনবগুন্ঠিতা – ৫

আশাপূর্ণা দেবী

অনেক কথার বিনিময় হবার পর চন্দ্রভূষণ বলে ওঠেন, ‘আপনি’ বলে মরছি কেন, আশ্চর্য তো! শোনো আমি তোমায় চিনেছি।’

বৈষ্ণবী হেসে উঠে বলে, ‘সেরেছে! একেবারে চি—নে—ছি! ভদ্রলোকের ভারী অহঙ্কার তো! মশাই, নিজেকে চেনেন? নিজে কে? ফস করে ঘোষণা তো করে বসলেন, চিনেছি!’

চন্দ্রভূষণ সমীহ করলেন না।

চন্দ্রভূষণ বললেন, ‘এযে দেখি গেরুয়ার মলাটে একটা অপাঠ্য বই! এ স্রেফ বটতলা!’

বৈষ্ণবী এবার চটেছিল।

জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে বলেছিল, ‘বাবু মশায়, এই বটতলার বইখানা পড়তে তো কেউ সাধেনি আপনাকে?’

চন্দ্রভূষণ পুলকিত হয়েছিলেন।

চন্দ্রভূষণ বুঝেছিলেন, এই ফোঁটা তিলক কাটা বৈষ্ণবী নেহাৎ নিরক্ষর নয়।

তাই চন্দ্রভূষণ জায়গাটা থেকে নড়বার নাম করেননি, বরং আরো যেন গুছিয়ে বসে বলেছিলেন, ‘বলে না কেউ, তবু অপাঠ্যের দিকেই ঝোঁকা মানুষের রীতি।’

বৈষ্ণবী জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তীব্র কণ্ঠে বলেছিল, ‘ওঃ তাই! তাই বাবুর এমন নেক নজর! ভাবছেন, রসের বোষ্টুমী ঘেঁসে এসে বসলেই গলে যাবে, কেমন? আর আমি ভাবছিলাম বাবুর বুঝি গেরুয়ায় ভক্তি।…..তা’ আপনার মত বাবু ভদ্দরলোকের একটা ভিখিরি বোষ্টুমীর সঙ্গে বসে গালগল্প করলে নিন্দে হবে না? কে কখন দেখে ফেলবে—’

চন্দ্রভূষণ বললেন, ‘আমি অত নিন্দে সুখ্যাতির ধার ধারি না।’

‘সে কি কথা বাবু’—প্রৌঢ়া বৈষ্ণবীর চোখে যেন তরুণীর চোখের আগুন ঝলসে ওঠে, ‘এ যে বড় তাজ্জব কথা বলছেন! লোক নিন্দের ভয়ে স্বয়ং রামচন্দ্রই সীতাকে ত্যাগ করলেন—’

‘রামচন্দ্র?’ চন্দ্রভূষণ জোরের সঙ্গে বলেন, ‘এ যুগে কেউ রামচন্দ্রের ওই কাজটাকে সমর্থন করে না।’

বৈষ্ণবী কেন এই সাধারণ কথায় এত জ্বলে ওঠে? কেন এমন তীক্ষ্ন হয়ে ওঠে সে?

কারণ বোঝা যায় না। শুধু দেখা যায়, তীক্ষ্ন গলায় বলে ওঠে, ‘ওসব হচ্ছে ছেঁদো কথা! সমাজের মন এখনও সেই ত্রেতাযুগেই অচল আছে। এখনও মেয়েমানুষকে পুরুষের সম্পত্তি ছাড়া আর কিছু ভাবা হয় না, এখনও মেয়েমানুষের মূল্য মাটির পাত্রের থেকে বেশী নয়। তার জ্ঞানে অজ্ঞানে, ইচ্ছেয় অনিচ্ছেয়, একবার যদি কেউ উচ্ছিষ্ট করে দিয়ে গেল তো, দূর করে ফেলে দাও আঁস্তাকুড়ে।’

চন্দ্রভূষণ সচকিত হলেন।

চন্দ্রভূষণ চোখের চশমাটা একবার খুললেন আর একবার পরলেন, তারপর বলে উঠলেন, ‘অস্বীকার করে লাভ নেই। তোমায় চিনে ফেলেছি আমি। তোমার নাম চম্পা।’

বৈষ্ণবী আকাশ থেকে পড়ল।

বৈষ্ণবী চোখ গোল করলো।

তারপর বললো, ‘বাবুর বোধকরি একটু নেশাভাঙের অভ্যাস আছে।’

চন্দ্রভূষণও আশ্চর্য, তবুও চটলেন না।

বললেন, ‘যে কথা বলেই ধাঁধাঁ লাগাতে চাও, আমি চটছি না, ধাঁধাঁয় পড়ছি না।’

‘সে আপনার মর্জি! ধাঁধাঁয় পড়বো না, এমন অহঙ্কারের কথা শুনতে বেশ মজাদার!’

‘বেশ তবে তুমি বল তোমার নামটা কি?’

ও বলেছিল, ‘সন্ন্যাসিনীদের কি নাম বলতে আছে?’

‘বলতে নেই?’

‘না।’

‘গেরুয়া তো তোমার ছল।’

‘ছলনাই তো জীবন আমাদের।’

‘বেশ, আমি একটা নামকরণ করি?’

বলেছিলেন বুড়োধাড়ী চন্দ্রভূষণ।

বাড়িতে যাঁর তিন তিনটে ভাদ্রবৌ।

এরা যে বলে ‘ডাকিনীর মায়া’, বলে ‘মোহিনী মন্ত্র’, ভুল বলে না।

গেরুয়ার আবরণে মোহিনীই তো! নইলে ওই সাধারণ চোখে অমন অসাধারণ কটাক্ষ হয়? সেই কটাক্ষের সঙ্গে বলেছিল, ‘নামকরণ? অক্লেশে! একটা কেন, একশো আটটাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু যে দু’দণ্ডের পথের সাথী, তার নাম নিয়েই বা এত মাথাব্যথা কিসের?’

‘দু’দণ্ডের যদি না হয়?’

বলে ফেললেন অবোধ চন্দ্রভূষণ।

এককালে যে নাকি মেধাবী ছাত্র ছিল, ছিল বুদ্ধিমান চটপটে। কারবার করতে করতে ভোঁতা হয়ে গেছে লোকটা, তাতে আর সন্দেহ কি?

তিলককাটা বৈষ্ণবী লহরে লহরে হেসে উঠলো। বললো, ‘বলেন কি বাবু, এ যে বড় সর্বনেশে কথা! এটাই আপনার স্বভাব নাকি?’

চন্দ্রভূষণ আর একবার চশমা খুললেন, চশমা পরলেন। দেখলেন আরো একবার, তারপর জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভাবতে লাগলেন…….

ও কি শুধু আমাকে ব্যঙ্গ করতেই এমনটা করছে, না কি সত্যিই এমন হয়ে গেছে ও? এমন বাচাল, বেহায়া, আর বেপরোয়া!

হয়তো তাই!

দু’যুগ পার হয়ে গেছে, কত ঘাটের জল খেয়েছে, এখনো সেই কচি কুসুমটি থাকবে এ তো আশা করাই অন্যায়। কিন্তু তাই বলে, ও বদলে গেছে বলে আমি ওকে ফেলে চলে যাব? নেমে যাব নিজের মনে?

তার মানে ইহ জীবনে আর দেখা হবে না!

না না, সে হয় না, একবার ভুল করেছি আর করবো না। ওকে ধুলো ঝেড়ে তুলে নেব। কিন্তু ও তো স্বীকার পাচ্ছে না।

তবে কি আমারই ভুল?

আমি কি শুধু একটু সাদৃশ্য দেখে—

আবার ভাবেন, অসম্ভব! ভুল হতেই পারে না। বাইরের ভাবভঙ্গী সাজ—সজ্জা যাই বদলাক, কাঠামো বদলায় না। আর বদলায় না—

জুৎসই শব্দ খুঁজে পেলেন না চন্দ্রভূষণ, শুধু ভাবতে লাগলেন, আর বদলায় না সেই বস্তু, যার নাকি সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। সেটা মুখে থাকে, না চোখে থাকে, নাকি চামড়ার নীচেয় থাকে, কে জানে! তবু সেইটাই অবিকৃত থাকে। ও চম্পা!

‘বাবু মশায়ের রাগ হ’ল না কি?’

বৈষ্ণবী নিজেই সেধে ডেকেছিল।

চন্দ্রভূষণ ফিরে তাকিয়েছিলেন।

চন্দ্রভূষণের চোখটা লাল লাল দেখাচ্ছিল। আর মুখের চেহারায় একটা জিদের ভাব ফুটে উঠেছিল।

বৈষ্ণবী বলেছিল, ‘আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কাকে কি বলে বসি জ্ঞান থাকে না, অপরাধ নেবেন না। কথাটা না হয় ফেরতই নিচ্ছি।’

‘ফেরৎ নেওয়ার দরকার নেই। ধরে নাও ওই আমার স্বভাব। তবে আমি যা সংকল্প করি, তার নড়চড় হয় না। শুধু জীবনে সেই একবারই ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে—দেবু আমায় পরে সব বলেছে।’

কিন্তু এবার চন্দ্রভূষণকে সত্যিই থতমত খেতে হয়।

বৈষ্ণবী অবোধ দুই চোখ তুলে বলে, ‘দেবু? দেবু কে? কি বলেছিল সে? আমি তো বাবু কিছু বুঝতে পারছি না?’

‘কিছু বুঝতে পারছো না তুমি? দেবুকে চেনো না? রাজশাহীর দেবু?’

বৈষ্ণবী বলে উঠেছিল, ‘বাবু রঙে আছেন বলায় তো রাগ করলেন, কিন্তু এসব কি কথা বলুন? সাতজন্ম যে নামধাম জানি না, জবরদস্তি চিনতে হবে তাদের?’

চন্দ্রভূষণ ভাবলেন, ঠিক আছে, নেমেই যাবো। পথের দেখা পথেই মিলোক, আর কথায় কাজ নেই। এই রইলাম চুপ করে।

কিন্তু পারলেন কই?

একটু চুপ করে থেকে বলে উঠলেন, ‘পরেছ গেরুয়া, অথচ অনর্গল মিথ্যে কথা বলে চলেছ।’

‘কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে তা’ কি নির্ণয় করা সোজা বাবু? কত নদী পার হয় মানুষ, কত পাহাড় ডিঙোয়, কত তাঁবু খাটায়, কোনটা যে সত্যি—জল, না স্থল, না ঘর, তা সে কি নিজেই জানে?’

চন্দ্রভূষণ নির্নিমেষে একটু তাকিয়ে অভিভূত গলায় বলেছিলেন, ‘এ সব কথা তুমি শিখলে কোথায়?’

‘ওমা, এই এতখানি বয়েস হলো, দুটো কথাও শিখবো না? আমাদের ‘সখীকুঞ্জের’ গুরুগোঁসাই যে কথার সাগর গো! তাঁর আশ্রয়ে থাকতে থাকতে বোবারও বোল ফুটলো!’

‘তা’ বলে বোবা তুমি ছিলে না কখনো—’ যেন রেগে রেগে বলে ওঠেন চন্দ্রভূষণ, ‘কথায় চিরদিন ওস্তাদ!’

বৈষ্ণবী এবার গালে হাত দেয়, ‘তাই বলুন, বাবু হচ্ছেন গণৎকার! এতক্ষণ বলতে হয় সে কথা!’

চন্দ্রভূষণ এবার প্রায় চড়া গলায় বলেন, ‘না বলে পারছি না—তুমি বড় বাচাল হয়ে গেছ।’

বৈষ্ণবী সচকিত ভঙ্গীতে বলে, ‘আস্তে বাবুমশাই, লোকে কান করছে, চোখ ফেলছে। ভাববে বাবুর সঙ্গে বুঝি আমার আগের কোনো সম্পর্ক ছিল। ‘সখীকুঞ্জে’র অষ্ট প্রহরের বোষ্টুমী, সামাজিক মান মর‍্যাদাটা তো জোরালো নয় তার?’ এক সকাল থেকে পরদিন সকাল অবধি নাম গান হয়, একশো আট নাম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই নাম।’

পরিচয় পাওয়া গেল।

নবদ্বীপের ‘সখীকুঞ্জে’র বৈষ্ণবী।

নামগানের বিনিময়ে ভাত কাপড় জোটে।

পুণ্যটা কুঞ্জের মালিকের, ভাড়াটে নাম—গাইয়েদের ওই ভাত কাপড়ের উপর ‘ফাউ’ লাভ হচ্ছে ‘রসনাশুদ্ধি, চিত্তশুদ্ধি’।

আর ক্রমশঃ রীতিমত চিত্তশুদ্ধির পরিচয় দিতে পারলে ‘গেরুয়া’!

চাইতে হবে সেটা মালিকের কাছে।

ও নাকি চেয়েছিল।

তবে শুদ্ধিটুদ্ধির পরিচয় দিয়ে নয়। শুধু বুদ্ধির জোরে।

বলেছিল, ‘শাদা কাপড় বড্ড ময়লা হয়ে যায় মহারাজ, গেরুয়ায় সুবিধে। দিয়ে দিন না।’

তাক মাফিক বলতে পারলে সব হয়, এ তো শুধু শাদার বদলে গেরুয়া!

তা’ নাম একটা ছিল বৈকি।

সখীকুঞ্জে অষ্টসখীর নাম হচ্ছে বাধ্যতামূলক! কাজেই সেখানে ‘বড় বিশাখা, ছোট বিশাখা, বড় বৃন্দা, ছোট বৃন্দা। ললিতার আবার মেজ সেজও আছে। এর নাম ছিল ‘ছোট ললিতা’।

মহারাজ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মনের ময়লা ত্যাগ করে তবেই গেরুয়া নিতে হয় ছোট ললিতা!’

ও বলেছিল, ‘ত্যাগের চেষ্টাই তো করছি মহারাজ!’

কিন্তু কে জানতো, ‘সখীকুঞ্জটা’ই ত্যাগ করবার চেষ্টায় ছিল ছোট ললিতা। গেরুয়াদের রেলের টিকিট লাগে না, গেরুয়াদের ইহজগতের অনেক টিকিট হাতে এসে যায়, তাই মহারাজকে ভুলিয়ে আদায় করে নিল দু’সেট গেরুয়া!

শাড়ি, সেমিজ, চাদর।

ব্যস, পরদিন আর ছোট ললিতাকে নামগানের আসরে দেখা গেল না!

কি হলো?

অসুখ?

কিন্তু অসুখ যদি তো ওর বাসা শূন্য কেন?

কোথায় গেল ঝাঁপি, কোথায় গেল পুঁটলি?

কোথায় গেল রান্নার বাসন?

উনুনটাই শুধু পড়ে আছে।

তাও নিষ্ঠুর প্রহারে জর্জরিত।

ছোট ললিতা যেন তার এই পরিত্যক্ত জীবনের সাক্ষী ওই উনুনটার উপরই আক্রোশ ফলিয়ে চলে গেছে।

ছোট ললিতা মহারাজজীর বিশেষ প্রিয় শিষ্যা বলে ঈর্ষা ছিল আর সকলের, তাই বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলো বড় ললিতা, মেজ ললিতা, আর বড় বিশাখা, ছোট বিশাখারা!

কিন্তু চন্দ্রভূষণের কাছে নিজের সেই নামটা প্রকাশ করলো না ছোট ললিতা, বললো, ‘নতুন নামকরণ? অক্লেশে!’

হয়তো ভাবলো, যতবার মনিব বদল হচ্ছে ততবারই তো নাম বদল হচ্ছে, ওতে আর ভাববার কি আছে?

নয়তো বা ভাবলো, ও নিয়ে আপত্তিটা হাস্যকর।

তাই বললো, ‘একশো আটেও আপত্তি নেই।’

চন্দ্রভূষণ বললেন, ‘আটও নয় শতও নয়, শুধু এক। ওইটাই বলবো একশোবার করে। নাম দিচ্ছি ‘চম্পা’।’

আশ্চর্য!

মিলিয়ে গিয়েছিল তো কোন কালে চম্পার সৌরভ, তবু ওই নামটাই ইচ্ছে হলো চন্দ্রভূষণের।

ছোট ললিতা বললো, ‘আমাকে ‘এসো তুমি’ বলে ডাকলেই নাহয় আমি হাত ধুয়ে বসলাম, কিন্তু আপনার দশা কি? বয়েস হয়েছে, সমাজে মানসম্মান আছে, বৌ ছেলে আছে—’

‘বৌও নেই ছেলেও নেই!’ চন্দ্রভূষণ হেসে উঠেছিলেন, ‘ওদিকে শূন্যি!’

‘ওঃ বৌ বুঝি মরেছে? আর—ছেলে মেয়ে হয়নি?’

চন্দ্রভূষণ মৃদুগম্ভীর হাস্যে বলেন, ‘বৌ মরেনি, বৌ শুধু হারিয়ে গিয়েছিল। তবে হুকুম জারি হয়েছিল যেন জপ করি ‘মরেছে মরেছে।’ অতএব মরেছে। কাজেই ছেলের প্রশ্ন নেই।’

‘সে জপ করা হয়েছিল?’

‘সে আর বলতে? আজীবন!’

‘যাক শুনে বাঁচলাম। থাকা হয় কোথায়?’

‘সেটা অবশ্যই বাড়িতে। ঠাকুদ্দার ভিটেয়।’

‘আছে কে আর?’

‘ছোট তিন ভাই, তাদের তিন বৌ, ছেলে মেয়ে।’

‘তিন ভাদ্রবৌ, ওরে সর্বনাশ!’ ছোট ললিতা ভয়ের ভান করে, ‘অবস্থা বড় খারাপ! কী বলবে তারা, এখন এ বয়সে মেয়েছেলে পুষলে?’

চন্দ্রভূষণ বললেন, ‘পোষবার জিনিস পুষতে চাইলে কেউ যদি আপত্তি করে, নাচার!’

‘ভাবছি—’

‘কী ভাবছো?’

‘ভাবছি বিনি খাটুনিতে নিশ্চিত অন্ন, বিনি নামগানে নিশ্চিত আশ্রয়, এটা ত্যাগ করবো? বড় বোকামি হবে না?’

‘হবে।’

‘তবে নাহয় আপনার সঙ্গেই যাই।’

‘যাই নয়, আসি।’

সেই আসা!

নবীন উৎসাহে বাসা গোছ করেন চন্দ্রভূষণ, নবীন উৎসাহে সংসার পাতার সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন, ছোট ললিতা নতুন জন্ম আর নতুন নাম পরিগ্রহ করে ঢুকে পড়ে সেই সংসারে।

চন্দ্রভূষণ বললেন, ‘গেরুয়া চলবে না।’

চন্দ্রভূষণের চম্পা বললো, ‘ছাড়তে পারলেই তো বাঁচি। চওড়া লালপাড় শাড়ি পরে ঘরসংসারী কাজ করে বেড়াচ্ছি, এ সাধ জন্মাবধি।’

হঠাৎ চন্দ্রভূষণ একটা কাজ করে বসেন। সন্ন্যাসিনীর একটা হাত চেপে ধরে বলেন, ‘শুধু ঘরসংসারী কাজ করে বেড়ানোর সাধ? ঘরসংসারের সাধ নেই?’

সন্ন্যাসিনী হেসে উঠে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘বুদ্ধিমান বামনরা চাঁদে হাত দিতে চায় না।’

‘আর চাঁদ যদি ইচ্ছে করে হাতে নেমে আসতে চায়?’

বললেন চন্দ্রভূষণ আবেগের গলায়।

বোধকরি ভুলে গেলেন, পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি বয়েস হয়েছে তাঁর।

গেরুয়া হেসে উঠে বলে, ‘চাঁদ এমন অবোধই বা হবে কেন?’

‘চম্পা!’

চম্পার নামে নামকরণ যার, সে যেন চম্পার চোখেই তাকায়। ওরও যে অমন তাকানোর বয়েস নেই, তা ভাবে না।

‘চম্পা, বহুকাল আগে বৌ হারিয়ে গিয়েছিল, বৌয়ের সাধ মেটেনি, ইচ্ছে হচ্ছে সে সাধ মেটাই, সম্মান, সম্ভ্রম, অধিকার দিই তোমায়!’

‘সর্বনাশ! ইচ্ছে হলেই হলো? সম্মান, সম্ভ্রম, অধিকার—’

ও সহসা হেসে উঠে বলে, ‘শব্দগুলো ভয়ানক ভারী, ঘাড়ে সইবে না। হালকা ঘাড় নিয়ে, রেলের টিকিট ফাঁকি দিয়ে দিয়ে চলা অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই ফাঁকি দিয়ে স্বর্গলাভটাই সহজ মনে হচ্ছে।’

চন্দ্রভূষণ কিছুক্ষণ ওই বহু অভিজ্ঞতায় পোড়—খাওয়া মাঝারি বয়সের মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘এত কথা শিখলে কোথায়?’

‘কেন, সখীকুঞ্জের আখড়ায়!’ ও হেসে ওঠে, ‘কথারই চাষ যে সেখানে! কথার সিঁড়ি গেঁথে গেঁথেই স্বর্গে ওঠা!’

তা’ হয়তো এ একটা মস্ত উপকার করছে ‘সখীকুঞ্জে’র আখড়া। অনেক কথা শিখিয়েছে একটা ভেসে বেড়ানো পথের মেয়েকে পথ থেকে কুড়িয়ে এনে আখড়ায় পুরে ফেলে।

কথার চাষই বটে।

ধর্মকথা, দার্শনিক কথা, রহস্যময় কথা, আবছা ধোঁয়াটে রসের কথা, কথার শেষ নেই।

সেই ‘কথা’র সঞ্চয় নিয়ে এসেছে ছোট ললিতা।

কথাই তো আসল।

কথাই তো আকর্ষণ রজ্জু।

ওতেই প্রকাশ, ওতেই বিকাশ, ওতেই ব্যঞ্জনা।

ব্যঞ্জনাহীন সৌন্দর্যের মূল্য কি?

কথায়—দরিদ্র রূপসীর থেকে অনেক বাঞ্ছনীয়া ভাষায় ঐশ্বর্য্যবতী রূপহীনা।

তাই চন্দ্রভূষণ ওই বাক্যশালিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

চন্দ্রভূষণের মন যায় হারিয়ে।

অনেক অনেক বছর আগে ফেলে আসা একটা দিনের চারপাশে আছড়ে মরে সে মন।

ছোট ললিতাকে ‘চম্পা’ বলতে সাধ হলো কেন চন্দ্রভূষণের?

এখন কি মনে হয় ‘চম্পা’ নামের সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার ওপর অবিচার করে এসেছেন চিরকাল? তাকে খোঁজা উচিত ছিল? উচিত ছিল ক্ষমা করা?

ছোট ললিতা বলে, ‘মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে না থেকে গল্প কর দিকি! শুনি তোমার ছোট ভাইয়ের ব্যাপারটা। বদলীই হলো তাহলে?’

চন্দ্রভূষণের মুখে একটা বেদনার ছায়া পড়ে।

একদা যে নিজেই চন্দ্রভূষণ ভাবতেন, যেখানেই কাজ করি কলকাতায় কদাচ না, কলকাতায় থাকলেই বাড়িতে থাকতে হবে—সে কথা মনে পড়ে না বলেই ওই ছায়াটা পড়ে।

সেই ছায়া—ছায়া মুখে বলেন চন্দ্রভূষণ, ‘হলো বৈকি! সামনের সোমবারে রওনা দেবে।’

‘তা’ ভালই তো—ছোট ললিতা বলে, ‘বদলী হলেই উন্নতি—’

‘নাঃ চম্পা, ওইখানেই মজা। ও নাকি বদলী হয়ে নীচু পোস্টে চলে যাচ্ছে ইচ্ছে করে, আর একজনের বদলে।’

‘কে আবার একথা বললে তোমায়?’

‘বললে? যে ছেলেটির বদলী রদ হলো, সে বলে গেল কৃতজ্ঞতা জানাতে। বিন্দু তখন বাড়ি ছিল না, আমাকেই বললো। বললো, ‘এমন মহানুভব! আমার বদলী হওয়ায় অসুবিধে রয়েছে বলে নিজে যেচে—’

‘তা সেটাই ভাবো না—’ ছোট ললিতা সহজ গলায় বলে, ‘ভাবো না আমার ভাই মহানুভব। তোমার কাছ থেকে চলে যাবার জন্যেই স্বেচ্ছায় একথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছ কেন?’

‘সেটাই যে সত্যি কথা,’ চন্দ্রভূষণ বলেন, ‘যখন তখন সেই কথারই আভাস পাই যে!’

তা’ সত্যি, সেই আভাসই ঝিলিক দিয়ে ওঠে আজকাল যখন তখন। উদিতা আর চন্দ্রভূষণের তাঁবে বৌগিরি করে থাকতে রাজী নয়। আর শুধু তো চন্দ্রভূষণই নয়, শেফালী নেই? সুনন্দা নেই? মাথার উপর এতগুলো লোক নিয়ে কী সুখ জীবনে? উদিতার যেদিন শুধু বরটির সঙ্গে দুটি দামী সিটে বসে বিখ্যাত একটি বিলিতী ছবি দেখতে ইচ্ছে করে, ঠিক সেদিনই হয়তো জা—ননদ ভাগ্নে ভাগ্নী ইত্যাদি করে একটা রেজিমেন্টের সঙ্গে একটাকা চল্লিশের সিটে বসে একখানা অখাদ্য বাংলা ছবি দেখে আসতে হয়।

কারণ, তার উদারচিত্ত আমুদে ভাসুর সকলকে নিয়ে আমোদ করে উল্লসিত হচ্ছেন।

উদিতার যেদিন ইচ্ছে হয় নিজের ছেলে দুটিকে নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে যাবে, এবং ভাইপো—ভাইঝিদের নিয়ে আমোদ আহ্লাদ করবে, ঠিক সেইদিনই হয়তো ভাসুর বাড়ির সবকটা বাচ্চাকে নিয়ে সার্কাস দেখাতে কি স্টীমারে বেড়াতে, একজিবিশন দেখাতে, কি পিকনিক করতে বেরিয়ে পড়বেন।

‘ঠিক সেইদিনটা’ যে হাতগোনার ব্যাপার তা’ অবশ্য নয়, ব্যাপারটা হচ্ছে সুবিধাজনক ছুটির দিনটি তাক করেই তো সকলের আমোদ প্রমোদের চিন্তা।

এছাড়া নিজেদের ব্যাপারেও আছে বৈকি।

উদিতার বেশী বিশ্বাস বাপের বাড়ির ইয়ং ডাক্তারের উপর, চন্দ্রভূষণের ঘোরতর বিশ্বাস তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক বৃদ্ধ ডাক্তারবাবুর উপর। দুজনের বিশ্বাস গড়ে ওঠার মূলে অবশ্য কারণ আছেই কিছু।

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে চন্দ্রভূষণের বিশ্বাসেরই জয় হয়। কারণ চন্দ্রভূষণ কারো অসুখ হতে না হতে ডাক্তারকে এনে হাজির করেন, নিজে বোঁ করে বেরিয়ে যান প্রেসকৃপশনটা হাতে নিয়ে, এবং দাঁড়িয়ে থেকে ওষুধ খাওয়ান।

খরচ সব চন্দ্রভূষণের।

সিন্ধুভূষণ যদি স্ত্রীর বাক্যযন্ত্রণায় অস্থির হয়ে দাদার কাছে টাকা নিয়ে এসে দাঁড়ায়, চন্দ্রভূষণ আহত গলায় বলেন, ‘তোর ছেলের অসুখ, তাই তুই ডাক্তারের ফীজ দিবি, ওষুধের দাম দিবি?’

এরপরও আর কে বলবে ‘হ্যাঁ দেব!’

কিন্তু উদিতা তাই বলতে চায়।

চন্দ্রভূষণের উদারতা তার হজম হচ্ছে না আর।

সিন্ধুভূষণ বলে, ‘কি আর করা যাবে, ওঁর নিজের ছেলেমেয়ে নেই তাই, থাকলে অবশ্যই করতেন না এত!’

করতেন না যে অবশ্যই তার নজীর আছে। গায়ের কাছেই আছে। ইন্দুভূষণ যদি ‘পথে বেরোচ্ছেন’ হিসেবে কারো কোনো জিনিস কিনে আনবার ‘ফেরে’ পড়েন, কদাচ সে ‘ফেরে’ পড়ে থাকেন না। বাসভাড়া লাগলে সেটারও বিল কাটেন।

সেজদা অতটা না হলেও বড়দার মত আদৌ নয়।

অতএব ধরে নিতে হবে বড়দার নিজের ছেলেমেয়ে নেই বলেই—

তা’ সেই ধরে নেওয়াটুকুতে আদৌ রাজী নয় উদিতা। ওর মানমর‍্যাদাজ্ঞান বড় বেশী। কাজে কাজেই সেই বস্তুটাকে বাঁচাতে বদলীর চেষ্টা করতে হচ্ছে সিন্ধুভূষণকে!

কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে বুক ফেটে গেলেও করতে হচ্ছে।

ঝামেলা কি কম? ছেড়ে যেতে কত দিকে কত ব্যবস্থা! তা’ছাড়া ছেলে দুটোর স্কুল ছাড়ানোর প্রশ্ন রয়েছে।

চন্দ্রভূষণ যখন শোনেনি বদলী হওয়াটা চেষ্টাকৃত, তখন কাতর কাতর গলায় বলেছিলেন, ‘তা’ ওরা সুদ্ধু যাবে কেন? বছরের এই মাঝামাঝি? তাছাড়া সেখানে ভাল স্কুল আছে কি না ঠিক নেই—’

উদিতা শেফালীর মত সেকেলে বৌ নয় যে ভাসুর দেখে ঘোমটা দেবে। অতএব জবাবটা দেয় মুখোমুখিই, ‘ওদের রেখে যাব? আমরা চলে যাব, ওদের রেখে যাব? দেখবে কে?’

উদিতা ইচ্ছে করলে লাঠি না ভেঙে সাপ মারতে পারতো। খুব নরম করে বলতে পারতো, ‘ওদের ছেড়ে থাকতে পারবো না বড়দা!’

তাতেও কাজ হতো।

চন্দ্রভূষণই হয়তো লজ্জিত হয়ে ভাবতেন, ‘তাইতো সত্যিই তো! আমারই একথা ভাবা উচিত ছিল।’

কিন্তু তা’ বললো না উদিতা।

সাপটা সে মারলো বটে, কিন্তু লাঠিটাও ভাঙলো।

চন্দ্রভূষণ আহত হলেন।

চন্দ্রভূষণ আহত বিস্ময়ের গলায় বললেন, ‘বাড়িতে এতগুলো লোক রয়েছে ছোটবৌমা, বুবু টুটুকে কেউ দেখবে না?’

সিন্ধুভূষণ ওই আহত আহত মুখের দিকে তাকিয়ে মরমে মরলো। সিন্ধুভূষণ তাড়াতাড়ি ভাঙা বাসনটায় তালি দিতে বসলো, বসলো ছেঁড়া কাপড়টায় রিপু করতে।

বলে উঠলো, ‘শোনো কেন দাদা ওসব কথা! ছেলেদের ছেড়ে থাকতে পারবে না, অথচ মান খুইয়ে বলবে না সে কথা!’

কে জানে ভাঙা বাসন জোড়া লাগলো কি না।

চন্দ্রভূষণ আর কিছু বললেন না।

না প্রতিবাদ, না সমর্থন।

উদিতা ঘরে ফিরে এলে সিন্ধু বললো, ‘কথাটা ওভাবে না বললেও পারতে!’

উদিতা গম্ভীর গলায় বললো, ‘জানি না কী ভাবে তোমাদের দাদার চিত্তে আঘাত না দিয়ে কথা বলা যায়! তুমি তো মলম বুলিয়েছ তা’হলেই হবে।’

তারপর বললো, ‘তোমাদের এই ‘কর্তাভজা’র বাড়িতে তিষ্ঠানো শক্ত! উনি যা খুশি করতে পারেন, যেহেতু উনি কর্তা। আর সেই হেতুই ওঁর দোষের দিক থেকে চোখ বুজে ভজতে হবে ওঁকে। জানো, ওই বেলেঘাটার ব্যাপার নিয়ে আমাদের বাড়ীতে কী নিন্দে, কী ব্যঙ্গ!’

সিন্ধুভূষণ মাথা হেঁট করে।

দাদার ওই বেলেঘাটার ব্যাপারটাই তাদের মাথা হেঁট করিয়েছে, বিশেষ করে বৌদের কাছে।

যতই বৌদের বোঝাতে চেষ্টা করুক, অবিবাহিত মানুষ, ওরকম একটু—আধটু দুর্বলতা স্বাভাবিক, ওটা প্রকৃতির প্রতিশোধ, তবু বলতে মনে জোর পায় কই?

দাদার উপরই অতএব রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে যায়।

সেদিন আবার জামাইবাবুর আচমকা প্রশ্নে বলা হলো কিনা ‘জানো না, ওখানে যে সংসার পেতেছি! তোমরা যে রসে হাবুডুবু খাচ্ছো, সে রসটা কেমন জানতে ইচ্ছে হলো হঠাৎ!’

লজ্জার লেশ নেই, যেন ঠাট্টাতামাশা!

যেন আসলে ব্যাপারটা সত্যি নয়।

বড় জামাইবাবু ভালমানুষ, অতটা জানেন না, হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগলেন। ভাবলেন ঠাট্টাই।

কিন্তু ছোট জামাইবাবু তো জেনে এসেছে।

বুড়োবয়েসে নাকি একটা বোষ্টমী নিয়ে—ছি ছি!

লোকে যে রসে হাবুডুবু খাচ্ছে সে রসটা কেমন, এতদিন পরে জানতে ইচ্ছে হলো তোমার?

সেদিন আবার পাড়ার গোবিন্দবাবুকে বলা হচ্ছিল, ‘বেলেঘাটায় একটা হার্ডওয়ারের দোকান দিয়েছি—’

যেন সেটাই আসল।

সেটা তো হলো নিত্য গতায়াতের কারণ দেখানো। জানতে তো বাকী নেই কিছু? দিয়েছেন অবিশ্যি একটা দোকান, সে তো নাম কা ওয়াস্তে। আবার সে দোকানে বসানো হয়েছে কাকে? না গেঁজেল পাজী দেবুটাকে।

মেজদা তো মুখফোঁড়, বলেছিল সেদিন, ‘পাড়া রাজ্য ছাড়িয়ে বেলেঘাটায় দোকান! আশ্চর্য বটে! আর সে দোকানে বসাবার জন্যে আর লোকে পেলে না? দেবুদা? ছি ছি! অথচ আমার সেজ শালাটা—’

তা’ দাদার উত্তর হলো কিনা—’মামা মামী মরে পর্যন্ত দেবুটা ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে, ওর একটা ব্যবস্থা করা তো দরকার! মামা মামীর কাছে তো আমার ঋণের শেষ নেই!’

কেন নেই, তা’ও জানি না।

মামা সাধ করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাই, নইলে বাবার কি ছেলেকে মানুষ করে তোলবার ক্ষমতা ছিল না? মামার সখকে যদি ঋণ বল তো ঋণ!

কে বলতে পারে ওই দেবুদাটাই কুপথের মন্ত্রণাদাতা কিনা! নষ্ট তো হয় মানুষ সঙ্গদোষেই। বুড়োবয়সেও যে হয়, তার নজীর আছে। আবার সেটা নতুন করে দেখালো দাদা।

দেবুদার উপর এত কর্তব্যজ্ঞান না দেখালেও চলতো! স্বর্গ থেকে মামা মামী নিশ্চয় ওই ছেলের গুণে গালে মুখে চড়াচ্ছেন!

ঠিক, ওইটাই দাদাকে নষ্ট করছে।

ওই বোষ্টমী যোগাড়ের কর্ত্তাও ওই দেবু।

সিন্ধু অনেক ভাবে।

কিন্তু ভেবে ভেবে কূলকিনারা পায় না।

‘দাদা খারাপ হয়ে গেলেন—’ এটা উচ্চারণ করেও যেন বিশ্বাস হয় না। বিশ্বাস হয় না, দাদা দেবুদা’র সঙ্গে মিশছেন।

পুরুষের যত রকম দোষ থাকা সম্ভব, তার কোনোটিতে তো ঘাটতি নেই দেবুদার।

নেশাভাঙ, বদভ্যাস, চরিত্রহীনতা, জালজোচ্চুরি, ভিক্ষাবৃত্তি, সবেতে পটু। সেই লোকটাকে ক্ষমা করতে হবে? আগে তো ঠিক উলটো ছিল, আগে তো দাদা দেবুদাকে দেখলে জ্বলে যেত, কথা বলতো না।

মামা যখন মারা গেলেন, দেবুদা এলো জানাতে, অর্থাৎ সাহায্য চাইতে। দাদা বললো, ‘ওর হাতের পিণ্ডি খেয়ে মামার তো স্বর্গ হবে না, হবে অনন্ত নরক, সেই নরকের পথ প্রশস্ত করবার সাহায্য করতে পারব না।’ অবিশ্যি দিল শেষ পর্যন্ত টাকা, তবে কথা বলেনি।

আর এখন কিনা ‘ও ভেসে বেড়াচ্ছে’ বলে ওই বুড়ো বদমাশটাকে দোকান পাতিয়ে দিয়ে পুষত হবে?

অন্য কিছু নয়, ওই।

এখন রতনে রতন চিনলো!

দাদা এমন হয়ে গেল!—সিন্ধুভূষণ যেন দিশেহারা হয়ে যায়।

ভাবে, আমার শাশুড়ী যে বলেন, ‘মোহিনী মায়া’, নির্ঘাত তাই। তুকতাকেরই ব্যাপার!

দাদার অধঃপতন বিন্দু সিন্ধুকে মরমে মেরেছে!

সিন্ধু শেষ পর্যন্ত চলেই যাচ্ছে।

কারণ উদিতা কিছুতেই রাজী হচ্ছে না ওই ভাসুরকে প্রণাম করতে, সমীহ করে কথা বলতে, তাঁকে সেবা যত্ন করতে।

অতএব কলকাতা ত্যাগ।

এতে যদি চন্দ্রভূষণ ভাবেন তাঁর পাঁজরের একখানা হাড় খসে গেল, তো বোকার মত ভাবা হবে সেটা।

বিন্দুভূষণ অবশ্য বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাচ্ছে না, তবে বাড়ির মধ্যেই আলাদা হতে চায়।

শেফালীর গিন্নীপড়া আর সহ্য করতে পারছে না সুনন্দা। বয়সে সামান্য তফাত, কিন্তু মান্য দাবি করে অসামান্য। কারণ বড় ভাসুর তাকেই সংসারের কর্ত্রীর পোষ্টটা দিয়ে রেখেছেন।

অসহ্য নয়?

তার থেকে অনেক ভাল, ঘরের মধ্যে ‘জনতা’ জ্বেলে ভাতে ভাত রেঁধে খাওয়া।

ঢের সুখের, ঢের স্বস্তির।

আর সম্মানের তো বটেই।

কিন্তু চন্দ্রভূষণের উপস্থিতিই এই সম্মানজনক পথটা নিতে দিচ্ছিল না।

দাদা দুঃখিত হবেন!

দাদা আহত হবেন!

দাদা কি মনে করবেন!

বিন্দুভূষণ তাই বলে। বলে—

দাদার যদি মতিচ্ছন্ন ঘটেও থাকে, সন্দেহ নেই সেটা সাময়িক।

সেটা—ওই বুড়ো বদমাইশ দেবুদাটার কেরামতি! যতই হোক দাদা পুরনোকালের বন্ধু, কবলে ফেলতে বেশী দেরি হয়নি। এখন ওই পাজীটা দাদার খরচে বদমাইশি করবে এই মতলব! তাই তুক তাক করেছে।

তা ওরা যদি বলে একথা, তুকতাক করেছে দেবু চন্দ্রভূষণকে, তাহ’লে অন্যায় বলে না। বাস্তবিক দেবুর ওপর করুণা আসবার কোনো যুক্তি আছে কি? চন্দ্রভূষণের সমস্ত জীবনটা ভেস্তে যাওয়ার মূলে কে? দেবু নয়? দেবুই কি ধ্বংস করে দেয়নি চম্পা নামের এক টুকরো শুভ্র পবিত্রতাকে?

দেবু যদি সেদিন শুধু একটু ‘বকুনি’ খাবার ভয়ে কাতর না হয়ে মা বাপের কাছে এসে আছড়ে পড়ে বলতো, ‘মা, জামির পাজীটা চম্পাকে ভুলিয়ে নিয়ে—’

যদি বলতে পারতো, ‘বাবা আমায় কেটে দু’খানা করে ফেল তুমি, আমি মহামুখ্যু। শুধু তুমি চম্পাকে—’

তা করেনি দেবু।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন