মৌরি মরিয়ম
ঘুমানোর জন্য জেসমিনকে কিছু কাঁথা দেওয়া হয়েছিল। তাতে তার শীত মানে না। তাই শাল গায়ে কাঁথার ভেতর শোয় সে। বিষয়টা নজর এড়ায় নি শরিফা বানুর। তিনি তার পুরোনো একটা লেপ বের করেছেন। জেসমিনকে ডেকে সেটা দিয়ে বললেন, ‘শীতে কষ্ট করতাছস, তাও মোরে কস না। কেমন মাইয়া তুই? বয়স অইছে না? এহন কি আর এত দিকে খেয়াল রাকতে পারি? নে, এহনেইত্যা এই ল্যাপ গায় দিবি।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘লাগবে না, খালাম্মা। কাঁথা দিয়া মোর কাম চইলা যায়।’
শরিফা বানু ধমকে বললেন, ‘বেশি কথা কইস না, মাইয়া। নিতে কইছি, নিবি। সামনে বড় শীত আইতাছে। এইডা পুরান লেপ পইড়াই তো রইছে। এইগুলা কি কবরে লইয়া যামু?’
জেসমিন কাঁথার ওপরে লেপটা দিয়ে শুতেই শীতবোধ কমে গেল, আরাম লাগল। সত্যিই লেপের কাজ কি আর কাঁথায় হয়? মনে পড়ে গেল তার কত বাহারি কম্বল ছিল। একটা নরম লেপও ছিল। সেসব নিয়ে কি এখন তার মা কাঁদে? ওই জালিমদের মাঝে কেমন আছে তার দুঃখিনী মা? রঞ্জু বলেছিল ঢাকায় গ্রামের মতো এত তীব্র শীত পড়ে না, ঢাকার শীত আরামদায়ক। বড় শীতে তাকে ঢাকায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। কিন্তু এমনই কপাল, সেই দিন আর এল না।
.
প্রতি মাসের শুরুতেই মামুন খরচাপাতির একটা হিসাব করে ফেলে তার পকেট ডায়েরিতে। কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে, সব লিখে নেয়। সেই হিসাবটা একদিন রেহানার হাতে পড়ে গেল। সে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। রেহানা ভেবেছিল সে যেহেতু মামুনের কাছে চলেই এসেছে, এখন আর মামুন তাকে আলাদা করে হাতখরচা দেবে না। ঠিক একইভাবে, বাড়িতেও আগের চেয়ে কম টাকা পাঠাবে, যেহেতু এখন আর সেখানে রেহানা থাকে না। তার ওপর রেহানা আসায় এখানে খরচ বেড়েছে। কিন্তু না, তার এবং বাড়ির জন্য আগের পরিমাণের টাকাই বরাদ্দ রেখেছে মামুন। যেহেতু এখানে বাড়িভাড়া ও সংসার খরচ বাবদ নতুন একটি খরচ যুক্ত হয়েছে, তাই কমিয়ে দিয়েছে তার সঞ্চয়ের পরিমাণ, যে সঞ্চয় থেকে তার পড়াশোনা শুরু করার কথা। ডায়েরিটা যেমন ছিল, তেমনভাবে রেখে দিল। তারপর মনে মনে বহু পরিকল্পনা করে ফেলল।
.
পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো সেদিন, যেদিন মামুন বেতন পেল। মামুন ঘরে বসে তার সামনেই টাকা ভাগাভাগি করছিল। সব ভাগাভাগি শেষে কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নেও তোমার হাতখরচা।’
রেহানা টাকাটা হাতে নিয়ে ভাঁজ করে মামুনের হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘আমনের ধারে আছি। হাতখরচা লাগব না। কত খরচ বাড়ছে। এই টাহা আমনে সঞ্চয় করবেন। পড়ালেহা করার লাইগা মোরে বিয়া করলেন। আর এহন মোর লাইগাই পড়ালেহা বন্ধ, এইডা কেমন কথা?
মামুন হেসে বলল, ‘আরে, না না। বন্ধ না। ভর্তির টাকা জোগাড় অইলেই শুরু করমু।’
রেহানা মন খারাপ করে বলল, ‘জোগাড় তো অইছিলই। মোর এহেনে আগুনের পাগলামির লাইগ্যা সব নষ্ট অইলো।’
মামুন রেহানার গাল টিপে বলল, ‘আরে, মনখারাপ করে না, টাকা আবার জইম্যা অইয়া যাইবে।’
রেহানা কড়া গলায় বলল, ‘শোনেন, আমার হাতখরচার পুরা টাহা আমনে পড়ালেহার লাইগ্যা জমাইবেন। আমার কিছু লাগলে আমনের ধারেইত্যা চাইয়া নিমু।’
মামুন হেসে বলল, “আচ্ছা।’
রেহানা আবার একইভাবে বলল, ‘আর বাড়িতেও এত টাহা পাডানের দরকার নাই। গেরামে এত খরচ কিয়ের?’
মামুন অবাক হয়ে বলল, ‘কী কও, এতগুলা মাইনষের সংসার খরচ কি কম?’
রেহানা আঙুলে চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল, ‘এতগুলা কই? মানুষ তো মোডে দুইজন।’
‘মানে?’
‘আমনে টাহা পাডানি শুরু করার পরপরই আম্মায় ভাইজানেগো আলাদা কইরা দিছে। হেরা কত কষ্ট কইরা চলতাছে। তাও ভালো যে ভাইজানেগো এহন কাম আছে। নাইলে যে কী অইতো!’
মামুনের মাথা ঘুরছে। এটা কীভাবে সম্ভব! যদি ভাইজানদের আলাদাই করে দেন, তাহলে এত টাকা দিয়ে তারা করেন কী? সে রেহানার কাছে জানতে চাইল, ‘এই কথা তুমি মোরে আগে কও নাই ক্যা?’
রেহানা ঝট করে বানিয়ে বলল, ‘আম্মায় কইতে মানা করছিল। ডরে কই নাই।’
মামুন ধমকে উঠল, ‘কিসের ডর? কী কইতে চাও তুমি? তুমি জানো না, আমি চাকরিতে ঢোকার আগপর্যন্ত পুরা সংসারটা বছরের পর বছর বড় ভাইজান চালাইছে? তার এই বিপদের খবরটা তোমার আমারে দেওয়ার দরকার মনে অয় নাই?’
রেহানা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘মাফ করেন আমারে। আম্মায় ডর দেহাইছে। মুই কইতে সাহস পাই নাই। এমনেই আমনে থাকতেন না, মোর তো হেগো লগে তাল মিলাইয়া চলন লাগছে। মুই কী করমু?’
মামুন আর কিছু বলল না। তার কান্না পেল। ভাইদের সাথে কতবার চিঠি আদান-প্রদান হলো, কেউ একটিবার তাকে খবরটা দিল না! প্রচণ্ড অভিমান ও হলো তাদের প্রতি।
জেসমিন প্রতিদিন ভোরবেলা সারা দিনের রান্নার পানি তুলে ফেলে। এতে কাজ অনেকটা এগিয়ে যায়। রান্না করার মাঝে বারবার উঠে পানি আনতে যেতে তার ভালো লাগে না। তাই এই ব্যবস্থা।
প্রতিদিনের মতো আজও পানি আনতে যাচ্ছিল জেসমিন। পারুল তখন উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিল। যেহেতু জেসমিন রান্নার কাজ করে, তাই অন্যান্য কাজ তিন বউ সমঝোতার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। পারুলের ভাগে যেসব কাজ পড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভোরবেলায় উঠান ঝাড়ু দেওয়া। জেসমিনকে দেখেই পারুল ডাক দিল। জেসমিন কাছে যেতেই সে বলল, ‘হোনো, উঠানডা ঝাড়ু দিয়া দিবা? আমার পোলা দুধ খাওনের লাইগ্যা কানতাছে।’
‘দেন ভাবি, সমেস্যা নাই।’
জেসমিন ঝাড়ু দিতে শুরু করতেই পারুল নিজের ঘরে গেল। তার ছেলে এখনো ওঠেনি। সে-ও একটু লেপের ভেতর ঢুকে গড়িয়ে নিল।
এই ঘটনাটা ঘরের জানালা দিয়ে দেখল নুরজাহান। তারপর সকালের নাশতা খাওয়ার পর যখন ময়না বাসনকোসন ধুতে পুকুরে যাচ্ছিল, তখন নুরজাহান বলল, ‘জেসমিন, বাজার আসার আগপর্যন্ত তো তোমার কাম নাই। বাসনগুলা তুমি ধুইয়া আনো।’
‘আচ্ছা ভাবি, যাইতাছি।’
এঁটো বাসনকোসন নিয়ে জেসমিন পুকুরে চলে গেল। খাবার ঘরে তখন কেবল নুরজাহান, ময়না ও পারুল। জেসমিন কিছুটা দূরে যেতেই ময়না জানতে চাইল, ‘কোনো মতলব আঁটতাছ, ভাবি?’
নুরজাহান বলল, ‘হ। রান্দন আর এমন কি কাম? খালি দুইডা ভাত রাইন্দা ও মাগনা খাইবে আর কাম কইরা মরমু মোরা? ক্যা? বেবাক কাম অরে দিয়া করামু। যেমনে বেইন্যাকালে পারুল উডান ঝাড়ু দেওয়াইছে।’
‘কও কী!’
ময়না অবাক! পারুল হেসে বলল, ‘ও মোর খোদা! হগুনের চক্ষু। তোমার চক্ষু ফাঁকি দিয়া কিচ্ছু করোন যায় না গো ভাবি।’
এবার নুরজাহান আর ময়নাও হেসে দিল।
.
এ মাসে একটি টাকাও পাঠায় নি মামুন। হালিমা ভেতরে-ভেতরে আক্রোশে শেষ হয়ে যাচ্ছেন। বউ যাওয়ার সাথে সাথেই টাকা পাঠানো বন্ধ! এই দিন দেখার জন্য কি ছেলেকে জন্ম দিয়েছিলেন?
জমানো টাকা খরচ করে চলছেন। কিন্তু এভাবে কত দিন! ছেলেকে যে চিঠি পাঠাবেন, তা-ও পারছেন না। কারণ, তিনি লিখতে জানেন না। এ বাড়িতে লিখতে জানে কেবল মুকুল, মিনা আর রেনুর ছেলে ইমরান ও মেয়ে নীলা। মুকুল বা মিনাকে বলতে লজ্জা লাগছে। ইমরান ছটফটে ছেলে, কোনো কথাই গায়ে লাগায় না। ও লিখে দেবে না। একমাত্র নীলা দিলে দিতে পারে। তিনি নীলাকে ডেকে আনলেন।
নীলা চিঠি লিখে দিল, তবে চিঠির বিষয়বস্তু তাকে অবাক করল। সে দাদিকে কিছুই বলল না, এসে রেনুকে বলল, ‘মা, ছোট কাকায় না দাদা-দাদির টাহা দেওয়া বন্ধ কইরা দেছে।’
রেনু অবাক হয়ে বলল, ‘কস কী? তুই ক্যামনে জানলি?’
‘দাদি চিডি লেহাইছে আমারে দিয়া।’
‘কয় মাস ধইরা টাহা দেয় না?’
‘এই মাসেই দেয় নাই খালি।’
‘তার মানে তোর কাকি যাওনের পর।
‘হয়।’
রেনু নীলার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘থাক মা। এই সব নিয়া ভাবা লাগবে না। তোমার কাকার নতুন সংসার। ওই দিকে ম্যালা খরচ হইছে। পরের মাসে দেবেয়ানে। তুমি কাউরে কইও না।’
‘আচ্ছা।’
.
মুকুলের স্কুলের বেঞ্চ বানানোর কাজটা শেষ। এখন আবার নতুন কাজ খুঁজছে। কাজ খুঁজতে বেরিয়ে সেদিন দেখে খালের পানি প্রায় শুকিয়ে এসেছে। শীতে খাল-বিলের পানি শুকিয়ে এলে কাদার ভেতরে কিছু মাছ লুকিয়ে থাকে। মুকুল আজ সেই সব লুকিয়ে থাকা মাছ ধরতে গিয়েছিল। প্রচুর মাছ ধরা পড়েছে। বাড়িতে এসে ঘরে না ঢুকেই সে মাছগুলো কুটতে বসল।
মিনা ঘর থেকে দেখতে পেয়ে এসে বলল, ‘একি, তুমি মাছ কুটতে বইলা ক্যা? সরো, আমি কুড়ি।
মুকুল পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে মাছের পরিমাণ দেখিয়ে বলল, “অনেক মাছ, এই প্যাট লইয়া বইয়া এত মাছ কুটতে পারবা না।’
মিনা বলল, ‘ও বাবা, এত মাছ! এত মাছ ধরছ ক্যা? বেহুদা নষ্ট অইবে।’
মুকুল বলল, ‘কিচ্ছু অইবে না। আব্বা-আম্মারে দিমু, ভাবিরে দিমু। আমাগোগুলা ভাইজ্জা রাখমু। একটাও নষ্ট অইতে দিমু না দেইখ্য।’
‘আব্বা-আম্মারগুলা কুইট্যা দেওন লাগবে না। এমনেই দিয়া আহো।’
মুকুল হেসে বলল, ‘থাক, বাদ্দেও। একদিন কুইট্যা দেলে কিছু অইবে না।’
‘তহেলে ভাবির বঁড়ি লইয়া আহি। একলা পারবা না।’
মুকুল কড়া গলায় বলল, ‘এই! মানা করছি না মুই?’
মিনা বলল, ‘তুমি মানা করলেই মোর হেই কতা হোনা লাগবে?’
মুকুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিনা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বঁটি হাতে একজন নয়, তিনজনকে আসতে দেখা গেল। মিনা, রেনু আর রেনুর মেয়ে নীলা। মুকুলের কথা না শুনলেও রেনুর কথা শুনতে হলো মিনাকে। সে মিনাকে মাছ কাটতে দিল না। রেনু ও নীলা হাত লাগানোতে দ্রুতই মাছ কাটা হয়ে গেল মুকুলের।
.
রাতে শুতে গিয়ে মিনা বলল, ‘এত আদর কইত্যা আইলো আমার লাইগ্যা?’
মুকুল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কইতে চাও, আমি তোমারে আদর করি না?’
‘করো, কিন্তু মধু যখন প্যাটে আছিল, কোনো দিন মোর কোনো কাম কইরা দিছ? কিসে মোর কষ্ট অইবে, কিসের অইবে না, হেইয়া ভাবছ?’
মুকুল হেসে বলল, ‘ও, এই বিষয়! তহন তো সবাই একলগে আছিলাম। আমাগো আলাদা সংসার আছিল না। ভাবিই তোমার সব কাম কইরা দিত আলাদা অইলেও ভাবি হয়তো এহনো সব কইরা দিত। কিন্তু বেচারি নিজেই এহন অসুস্থ!’
‘হইতে পারে। তয় মোর ধারণা, যাত্রাপালা ছাড়োনের পর তুমি একটু বড় অইছো। দায়িত্ব বাড়ছে।’
মুকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ, যত দোষ যাত্ৰা ঘোষ!’
মিনা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। মুকুল বলল, ‘আচ্ছা মিনা, তোমার কোনো দিন মোর যাত্রা দেখতে মনে চায় নাই?’
‘এহ্, না। ওইয়া ছাড়ছো, আল্লাহয় বাঁচাইছে মোরে। অ মোর দেহা লাগবে না।’
‘কত মাইয়া মোর যাত্রা দেইখ্যা মোর প্রেমে পড়ছে, জানো?’
‘এহ্! যেই না চেহারা, নাম রাকছে পেয়ারা।’
মুকুল হেসে বলল, “তারা চাইয়া পায় নাই। আর তুমি পাইয়া মূল্য দিলা না।’
‘তাইলে যাও, তাগো কাছেই যাও।’
মিনা রাগ হয়ে উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল। মুকুল হাসতে হাসতে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল। মিনা সরিয়ে দেয়, সে আবার ধরে।
জেসমিন সারাক্ষণ একটা ঘোরের ভেতর থাকে। রঞ্জুর ঘোর। রঞ্জু কবে কী বলেছিল, কবে কী করেছিল, সেসব চলমান ছবির মতো ভাসতে থাকে চোখের সামনে। যেদিন প্রথম পেটের ভেতর বাচ্চাটা নড়ে উঠল, সেদিন থেকে সে কল্পনা করতে থাকে রঞ্জু থাকলে কী করত এখন? কল্পনার জীবনটা ভীষণ সুন্দর! এই ঘোরের মধ্যেই সে তার সকল কাজকর্ম সম্পন্ন করে। কীভাবে করে, সে নিজেও জানে না। পৃথিবীর এক নম্বরের ফাঁকিবাজ হলেও ভাগ্যিস রান্নাটা জানত! মা বকাবকি করে কাজ শেখাত। নাহয় আজ কী যে হতো!
ভুলভাল যে একেবারেই হয় না, তা নয়। বকাঝকাও কম শোনে না বাড়ির গৃহিণীদের মুখে। এই তো সেদিন তরকারিতে লবণ কম হওয়াতে নুরজাহান যা নয়, তা-ই বলল। বলাটাই স্বাভাবিক। ভুল তো করেছে সে। রান্না করা তার কাজ। কাজে গাফিলতি করা উচিত হয় নি।
জেসমিনের কাজ শেষ হলে এই যে নিজের ঘরে ঢোকে আর বের হয় না। রঞ্জুর চিঠিটা সে শত শতবার পড়ে, লেখাগুলোর ওপর হাত বোলায়। এই একটা জিনিসই তো আছে! শীত শেষে বসন্ত এল। প্রকৃতিতে নানান রঙের ছটা! কিন্তু তার জীবনে কোনো রং নেই। কাঁদতে কাঁদতে ভাবে, চোখের জল শুকায় না কেন? কোথায় থাকে এত অশ্রু?
আজও তা-ই করছিল। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ায় হন্তদন্ত হয়ে চিঠিটা রাখল। চোখ মুছে ঘোমটা দিয়ে দরজা খুলল। দেখে শরিফা বানু দাঁড়িয়ে। জেসমিন বলল, ‘কিছু লাগবে, খালাম্মা?’
শরিফা বানু ভেতরে এসে বসলেন। জেসমিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শরিফা বানু জেসমিনের হাত ধরে তাকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘এত কানলে কি স্বামীরে ফিরা পাবি?’
জেসমিন মাথা নিচু করল। শরিফা বানু বললেন, ‘যে বাচ্চারে বাঁচানের লাইগ্যা এত কষ্ট, সেই বাচ্চার সুস্থতার কথা ভাবা লাগবে না? বাচ্চা প্যাটে নিয়ে এত কান্দাকাটি করলে বাচ্চার ক্ষতি অইতে পারে। তুই কি হেইয়া চাস?’
জেসমিন মাথা নেড়ে না বলল। শরিফা বানু বললেন, ‘হেলে এহনেইত্যা কোনো কান্দাকাড়ি না। যে গ্যাছে, হে তো গ্যাছেই। যে আছে, যে আইতেয়াছে, হের কতা ভাব।’
জেসমিন ঘাড় কাত করে সম্মতি দিল। শরিফা বানু ধমকে বললেন, ‘ওই ছেরি, খালি মাতা ঝুলাস ক্যা? মুখ নাই লগে?’
জেসমিনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার মা-ও তো এভাবেই ধমকাত। সে বলল, ‘আচ্ছা, খালা। আমনে যেইয়া কইবেন, হেইয়াই করমু।’
শরিফা বানু কড়া গলায় বললেন, ‘আর এক দিনও যদি কান্তে দেহি, তয় সকাল-বিকাল থাপড়াইয়া এক্কালে নলের লাহান সোজা কইরা দিমু বেহাংরা মাইয়া।’
শরিফা বানু চলে যাওয়ার পর জেসমিন নিজের পেটে হাত বোলাল। ভাবতে লাগল, সত্যিই কি কাঁদলে পেটের বাচ্চার ক্ষতি হয়? তাহলে সে কাঁদবে না। শত কষ্ট হলেও কাঁদবে না। এই একটা মানুষের জন্যই তো সে এখনো বেঁচে আছে। ওর জন্য সবকিছু পারতে হবে তাকে।
জেসমিন আসলেই জানে না কী করলে বাচ্চা ভালো থাকবে আর কী করলে ক্ষতি হবে। শরিফা বানু ছাড়া এই বাড়ির কেউ তার সাথে কথা বলে না। তিনি মুরব্বি মানুষ, তাকে সব কথা জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা লাগে। সে কি খারাপ মা? সে কি পারছে না বাচ্চার খেয়াল রাখতে?
.
ঘর লেপাপৌঁছার সময় হয়েছে। গতবার নুরজাহানের পরিকল্পনা ছিল কাজটা জেসমিনকে দিয়ে করাবে। কিন্তু সেদিনই শরিফা বানু উঠোনে বসে হলুদ-মরিচ শুকোলেন। তাই তাদেরই করতে হলো। কিন্তু এবার শরিফা বানু বাড়ি নেই। ঢাকায় সেজ ছেলের সন্তান হয়েছে। তাকে দেখতে গিয়েছেন। এই সুযোগে নুরজাহান বাড়ির সব কাজ তো জেসমিনকে দিয়ে করাচ্ছেই, আজ ঘরও লেপতে দিয়েছে।
ঘরের মেঝে কিংবা পিঁড়া কীভাবে লেপতে হয়, জেসমিন তা জানে না। কিন্তু সে দেখেছে। যেমনটি দেখেছে, তেমনভাবেই করার চেষ্টা করল। কিন্তু হচ্ছিল না। নুরজাহান এসে বলল, ‘কি লো, জেসমিন? এইপিলে নি ঘর লেপে? তুই না মাইনষের বাড়ি কাম করতি? হেই বাড়ি কোনো দিন ঘর লেপোস নাই?’
জেসমিন বলল, ‘ভাবি, হেইবাড়ি আরেকজন ঘর লেপত। আমনে মোরে ইকটু দেহাইয়া দেন? একবার দেহাই দিলেই মুই পারমু।’
নুরজাহান আক্রোশে ফেটে পড়ল। জেসমিনের চুলের মুঠি ধরে টেনে উঠিয়ে বলল, ‘এত বড় সাহস তোর! মোরে হুকুম দেস কোন সাহসে? মোর স্বামীরডা খাইয়া-পইরা রইছস, আবার মোরে হুকুম দেস!’
জেসমিন এত ব্যথা পেল যে নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। চিৎকার করে উঠল।
নুরজাহান এক হাতে চুল ধরে আরেক হাতে জেসমিনকে চড় মেরে বলল, ‘নাটক করোস? কাম না পারার নাটক? ঘর লেপতে কি মন্ত্র জানা লাগে?’
চেঁচামেচি শুনে ময়না ও পারুল যে যেখানে ছিল, দৌড়ে এল। জানালা দিয়ে অলস শুয়ে থাকা মাহফুজও উঁকি মারল।
‘কোন জমিদারের ঝি তুই যে ঘর লেপতে পারবি না?’
এ কথা বলে নুরজাহান জেসমিনকে ধাক্কা দিল। সে ময়নার গায়ের ওপর গিয়ে পড়ল। ঠিক তখন নুরজাহান দেখতে পেল মুস্তাফিজ বাড়িতে ঢোকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এমতাবস্থায় নুরজাহানের ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু রাগে তার শরীরের রক্ত গরম হয়ে আছে। তাই হয়তো ভয় পেল না। তবে আর মারলও না। গজরাতে গজরাতে নিজের ঘরে চলে গেল। পারুলও চলে গেল। ময়নারই একমাত্র মায়া হলো জেসমিনের জন্য। আসলে জেসমিনের জন্য নয়, জেসমিনের বাচ্চাটার জন্য। ভয়ে তার শরীর এখনো কাঁপছে, এই ভেবে যে সে যদি এখানে না দাঁড়াত আর জেসমিন তাকে না ধরত, তাহলে আজকে একটা বড় বিপদ হয়ে যেতে পারত! দুই সন্তানের মা হয়েছে সে। একটা নষ্ট হয়েছে। সে বোঝে মায়ের কী কষ্ট।
সে বলল, ‘আহো, মুই দেহাইয়া দেই।’
জেসমিনকে ঘর লেপা শিখিয়ে দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ল ময়না। নুরজাহান যদি দেখে তাহলে তাকে শত্রু বানিয়ে ফেলতে দুবার ভাববে না। কী দরকার জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করার!
.
নুরজাহান বিছানার ওপর পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে। মুস্তাফিজ তার সামনে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে নি। একপর্যায়ে মুস্তাফিজই কথা শুরু করলেন।
জানতে চাইলেন, ‘মাইয়াডার গায়ে হাত তুললা ক্যা?’
নুরজাহান গজগজ করতে করতে বলল, ‘মোর ইচ্ছা। কারও কাছে জবাবদিহি করার ঠ্যাকা পড়ে নাই।’
মুস্তাফিজ শক্ত মুখে বললেন, ‘কাজটা ঠিক করো নাই, জাহান।’
নুরজাহান বিছানা থেকে নেমে এল। মুস্তাফিজের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এহন কী করতে অইবে? নাহে খত দেতে অইবে? দিমু না। কী করবা? বিয়া করবা অরে? যাও করো।’
মুস্তাফিজকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নুরজাহান বেরিয়ে গেল। মুস্তাফিজ চেয়ার টেনে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নুরজাহানের পেছন পেছন গেলেন না। যদি যেতেন, তাহলে দেখতে পেতেন নুরজাহান শুধু ঘর থেকে নয়, বাড়ি থেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ঘরের পিঁড়া লেপতে লেপতে আড়াল থেকে সব শুনতে পেল জেসমিন। এবার বুঝল নুরজাহান কেন তার ওপর খেপে আছে। অসহায় লাগল তার। কী করবে সে এখন?
মুস্তাফিজ দুপুরে খেতে এসেছিলেন। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটে যাওয়ায় না খেয়েই চলে গেলেন। নুরজাহান বাড়িতে নেই, এই বিষয়টি বাড়ির লোকেরা টের পেল আরও পরে। তৎক্ষণাৎ মুজাহিদ গিয়ে মুস্তাফিজকে খবর পাঠাল। মুস্তাফিজ বিচলিত হলেন না। তিনি জানেন নুরজাহান বাপের বাড়ি গেছে। তার যাওয়ার জায়গা ওই একটিই।
মুস্তাফিজ আজ হাসপাতালের ডিউটি শেষ করে চেম্বারে আর গেলেন না। সোজা শ্বশুরবাড়ি রওনা দিলেন।
মুস্তাফিজের শ্বশুর আজমল তালুকদার পাকিস্তান আর্মিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভীষণ প্রতাপশালী লোক। মুস্তাফিজ তাকে সম্মান করেন। কিন্তু ভদ্রলোক মেয়ে-অন্তঃপ্রাণ। তাই যতবার নুরজাহান রাগ করে চলে আসে, মুস্তাফিজ লজ্জায় পড়ে যান। তবে সেই লজ্জা থেকে তিনিই বাঁচিয়ে দেন। নুরজাহানকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মুস্তাফিজের সাথে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এবার ঘটনা ঘটল ভিন্ন। নুরজাহান সামনে আসে নি। সে নাকি আসবে না। কখনো ফিরে যাবে না ও বাড়িতে।
আজমল তালুকদার মুখ শক্ত করে বসে আছেন। মুস্তাফিজ মাথা নিচু করে বসে আছেন তার সামনে। আজমল তালুকদার বললেন, ‘মুস্তাফিজ, তোমরা ভালোবেসে বিয়ে করছিলা। এই সব সস্তা আবেগ আমার কোনোকালে পছন্দ না। কিন্তু মেয়ের জন্য আমার সকল পছন্দ যেমন জলাঞ্জলি দিতে পারি, তেমনি সকল অপছন্দও মেনে নিতে পারি। মেয়ের মুখের দিকে তাকাইয়া আমি তোমাদের বিয়ে দিলাম। ভালো কথা, তোমরা সুখেই ছিলা। কিন্তু একটা বাচ্চার জন্য ভালোবাসা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল, এটা কেমন কথা?’
মুস্তাফিজ চুপ। তিনিই আবার বললেন, ‘তুমি না আমারে বলছিলা নুরজাহানের বাচ্চা হবে না, এটা তোমার জন্য কোনো সমস্যা না। তাইলে এখন সমস্যা হইল কীভাবে? আচ্ছা যাক, বুঝলাম সমস্যা হইছে। তোমার বাচ্চা লাগলে আবার বিয়া করবা, ভালো কথা। কিন্তু আগে তো আমার মেয়ের সাথে সম্পর্ক ভাঙতে হবে। ওর কোনো কিছুর অভাব পড়ে নাই যে সতিনের ঘর করবে।’
মুস্তাফিজের রাগ হয়, প্রচণ্ড রাগ হয়! আজমল তালুকদার বলেন, ‘কী ব্যাপার, তোমার মুখে কোনো কথা নাই কেন? তুমি কি চুপ করে বসে থাকার জন্য আসছ নাকি?
মুস্তাফিজ সব সময় শ্বশুরকে সমীহ করে কথা বলেন। এই বোধ হয় প্ৰথম তিনি একটু কড়া জবাব দিলেন, ‘আব্বা, আপনে জিজ্ঞেস তো করবেন কী হয়েছে। একতরফা আপনের মেয়ের কথা শুনে একটা বিচার করে ফেলবেন, তা তো হয় না।’
আজমল তালুকদার ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলেন, ‘কী বলতে চাও তুমি?
‘আমার আর নুরজাহানের মধ্যে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোনো সমস্যা কখনোই ছিল না। এমনকি আমার আম্মা পুরান দিনের মানুষ হইয়াও এ বিষয়ে নুরজাহানকে কখনো কিছু বলে নাই। মাফ করবেন, আজকে আমি আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সমস্যাটা আপনার মেয়ের মানসিক। সে নিজেই বাচ্চা হবে না ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে থাকে। এই পৃথিবীতে সবার বাচ্চার প্রয়োজন নাই, এটা আমি তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না। দুনিয়ার সকল মেয়েকে নিয়ে সে আমাকে সন্দেহ করে। বাড়ির কাজের লোকেদের সন্দেহ করতেও ছাড়ে না। গত বছর থেকে তার নতুন চিন্তা মনে এসেছে আমি বুঝি আবার বিয়ে করব। এ কথা কেন তার মনে হয়েছে, আমি জানি না। আমি এমন কোনো কাজ কখনো করি নি, যাতে তার এ রকম মনে হতে পারে।’
আজমল তালুকদার যারপরনাই বিস্মিত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নাকি এক মেয়েকে নিয়ে আসছ বাড়িতে?’
মুস্তাফিজ বললেন, ‘তা থেকে কী প্রমাণ হয়, আব্বা? বাড়িতে কাজের লোক নাই। একটা এতিম, তার ওপর বিধবা, অসহায় মেয়ে কাজ খুঁজতে আসছিল, আমি বাড়িতে নিয়ে আসি। কারণ, আমাদের কাজের মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাড়ির সব কাজ ওদের তিন বউয়ের করতে কষ্ট হয়ে যায়। এটা নিয়ে নুরজাহান এত বড় লজ্জায় ফেলবে জানলে তো আনতাম না। এখন আমাকে কী করতে হবে, বলেন? মেয়েটাকে কি বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে?’
আজমল তালুকদার এবার লজ্জিত বোধ করছেন। মেয়ে তো আগেও কতবার রাগ করে চলে এসেছে কিন্তু এমন পাগলের মতো কান্নাকাটি কখনোই করে নি। মেয়ের অমন কান্না দেখে তিনি নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন নি। হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ছেলেটাকে কতগুলো কঠিন কথা শুনিয়ে ফেললেন! আগে তো খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত ছিল। বয়সের সাথে সাথে কি তার জ্ঞানবুদ্ধি কমে যাচ্ছে?
তাকে চুপ থাকতে দেখে মুস্তাফিজ বললেন, ‘মেয়েটাকে আমি আর মুজাহিদ বাড়িতে নিয়ে আসি, এই পর্যন্তই। এরপর আজ অবধি তার সাথে আমার একটা কথাও হয় নাই। আমার আম্মা তাকে জায়গা দিছেন, রান্নার কাজে দিছেন। আম্মা ঢাকা গেছেন। ফিরে এলে নাহয় বলব মেয়েটার অন্য কোনো ব্যবস্থা করতে।’
আজমল তালুকদার মুস্তাফিজের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কিছু মনে কইরো না, বাবা। মেয়ের কান্না দেখে বোধবুদ্ধি লোপ পাইছিল। বড় হওয়ার পর কোনো দিন ওরে এইভাবে কানতে দেখি নাই।’
‘কিছু মনে করি নাই, আব্বা। কালকে আমার ডিউটি আছে। রাত বাড়ার আগে আমি ওরে নিয়ে রওনা দিতে চাই। আপনে একটু দেখেন।
আজমল তালুকদার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েকে বুঝিয়ে মুস্তাফিজের সাথে পাঠিয়ে দিলেন।
পথে কেউ কোনো কথা বলল না। কথা বলার কোনো আগ্রহ মুস্তাফিজের নেই। নুরজাহান আজকে যা করেছে তা জঘন্য। সে শুধু তাকে ভুলই বোঝে নি, এ বাড়ি এসে বাবাকেও ভুল বুঝিয়েছে। তাকে ছোট করেছে। নুরজাহানের এই সব কাজ তার খুব অপছন্দ। অযৌক্তিক সন্দেহ, অহেতুক হিংসাও অপছন্দ। অথচ তিনি এই মানুষটাকেই ভালোবাসেন। এই মানুষটাকে ছাড়া একটা দিনও অতিবাহিত করতে চান না। ভালোবাসার মতো এত অসহ্যকর আর অসহায় অনুভূতি সম্ভবত আর একটিও নেই।
.
রাত বাড়ছে। ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে জেসমিন। দুপুরবেলার ঘটনাটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের পলকে ঘটে গেছে। তারপরও সে যন্ত্রের মতো সব ঘর লেপেছে, সবার কাপড় ধুয়েছে, উঠোন ঝাড়ু দিয়েছে, হাঁস-মুরগি খোপে তুলেছে, আগামীকালের রান্নার লাকড়ি জোগাড় করে রেখেছে, আরও কত কী! কিন্তু এখন ভেবে ভয় হচ্ছে যে ওই মুহূর্তে ময়না ওখানে না থাকলে কিংবা তাকে ধরে ফেলতে না পারলে সে পড়ে যেতে পারত। পেটের বাচ্চার ক্ষতি হতে পারত! আজকের ভয়ে জেসমিন কাঁদতেও ভুলে গেছে। থেকে থেকে শুধু কাঁপছে। নুরজাহান যে কাল বা পরশু আবার চড়াও হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শরিফা বানুও এ সময় বাড়ি নেই। কী করবে সে? আবার পালাবে? তখন তো খুব সহজেই পালিয়ে ছিল। কিন্তু এখন এই সাত মাসের পেট নিয়ে কীভাবে পালাবে? কোথায় পালাবে? বাচ্চাটাকে কীভাবে নিরাপদে এই পৃথিবী দেখাবে? একটু শান্তি কি সে পাবে না? নাকি নসিবের সব শান্তি শেষ করে ফেলেছে এই ১৭ বছরের ছোট্ট জীবনে?
রাত গভীর। চারদিক সুনসান, পিনপতন নীরবতা। অন্ধকার ঘরে দুটি মানুষের নিশ্বাসের শব্দ কেবল। দুজনের কারও চোখে ঘুম নেই। বাড়ি ফিরেও মুস্তাফিজ নুরজাহান কেউ কারও সাথে কথা বলে নি। হাঁসফাঁস লাগছে মুস্তাফিজের। একসময় তিনি নুরজাহানকে বুকে টেনে নেন। তারপর বলেন, ‘ক্যান যে এমন করো তুমি, জাহান!’
নুরজাহান শান্ত গলায় বলে, ‘মুই কিছু করি নাই।’
‘তুমি আমারে বিশ্বাস করো না। অবিশ্বাস হয় ক্যা? আমি কি চরিত্রহীন?’ নুরজাহান সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘এহেনে চরিত্র ভালো-খারাপের বিষয় না। দুই বিয়া করতে চরিত্র খারাপ হওয়া লাগে না।’
‘কিন্তু আমি তো কইছি তা কোনোদিনও করমু না। হেই কতাডা তোমার বিশ্বাস অয় না ক্যা?’
‘মানুষের জীবনেরই গ্যারান্টি নাই, তার তো কতা!”
মুস্তাফিজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, ‘হাসপাতালে কত বাচ্চা জন্ম দিয়া মা মইরা যায়। আমরা তো ওইহানেইত্যাও একটা বাচ্চা আনতে পারি। কী কও?’
‘না।’
‘না ক্যা?’
‘মাইনষের বাচ্চা মুই পালমু ক্যা?’
‘আচ্ছা, বাদ দেও। কিন্তু তুমি আমারে বিশ্বাস করো। আমি তোমারে ভালোবাসি, জাহান। আমার ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস রাহো। তুমি যদি আবারও জেসমিনের ওপর অত্যাচার করো, আমি আম্মার কাছে মুখ দেহাইতে পারমু না।’
নুরজাহান ছিটকে সরে গেল। তারপর ঝাঁজালো গলায় বলল, ‘এহনো তোমার মুখে ওই মাইয়ার নাম? সন্দেহ যে করি, হুদাহুদি করি না, এইডাই তার প্রমাণ। এক্কালে দরদের সাগরে ভাইস্যা যাইতেয়াছে। ওরে পিরিত!’
মুস্তাফিজ নুরজাহানের হাত ধরে নিজের কাছে টানতে চাইলেন, ‘জাহান, তুমি ভুল বুঝতাছ। এমন কিছুই না।’
নুরজাহান তড়িৎগতিতে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, “খবরদার, আমারে ধরবা না।’
তারপর উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল। মুস্তাফিজ উঠে পড়লেন। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে মাকে চিঠি লিখতে শুরু করলেন।
.
জেসমিন পারতপক্ষে নুরজাহানের সামনে আসে না। তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। আগে প্রতি বেলায় সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে রান্নাঘরে বসে খেয়ে নিত। আজকাল সে সাহস পায় না। খাবার প্লেটে নিয়ে ঘরে চলে আসে।
একদিন বড় একটা মাছ পাঠালেন মুস্তাফিজ। মাছটা এতই বড় যে কাটতে ঘাম ছুটে গেল জেসমিনের। দুপুরবেলা খাওয়ার সময় নুরজাহান দেখে মাছের মাথাটা নেই। সে ভেবেছিল মাথাটা মুস্তাফিজকে খাওয়াবে। মুস্তাফিজের অবশ্য সেসব খেয়াল নেই। তাকে যখন যা দেওয়া হয়, তিনি তখন তা-ই খান। খাওয়া শেষ করে মুস্তাফিজ হাসপাতালে চলে যাওয়ার পর জেসমিনকে ডাকল নুরজাহান। জানতে চাইল, ‘মাছের মাথাডা কই?
‘কড়াইতেই তো আছে, ভাবি।’
‘নাই। কার কার খাওয়া অইছে?’
‘ময়না ভাবি আর মুই ছাড়া সবাইর খাওয়া অইছে।’
মুজাহিদের যেহেতু ভাতের হোটেল, সে দুপুরে খেতে আসে না। নুরজাহান স্পষ্টই বুঝতে পারছে মাথাটা মাহফুজ খেয়েছে। মেজাজটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। একটা টাকা আয় করার মুরোদ নেই। বউ-বাচ্চা নিয়ে বসে বসে খাচ্ছে, সে আবার মাছের মাথা খায়! রাগটা জেসমিনের ওপর ঢালল সে। বলল, ‘মাথাটা তুইল্যা রাখতে পারোস নাই? মাছটা যে কিনছে, সে তো খাইতে পারল না।’
জেসমিন কিছু বলল না। কী বলতে কী বলবে, তারপর কী হবে, এই ভয়েই সে তটস্থ। নুরজাহান ধমকে উঠল, ‘কী ব্যাপার, মুখে কতা নাই ক্যা?’
‘ভাবি, আমনে তো তুইল্যা রাখতে কন নাই।
‘ও, এহন দোষ অইছে আমার? সবকিছু কইয়া দেতে অইবে ক্যা? তোর মাতায় কি গোবর ল্যাপা?’
‘আর ভুল অইবে না, ভাবি। এরপরেইত্যা বড় মাছের মাথা তুইলা রাখমু।’
‘মুরগির রানও তুইল্যা রাখবি। বইয়া বইয়া খাইয়া গায়ে ত্যাল বেশি অইয়া গেছে সবটির।’
কথাগুলো নুরজাহান বেশ জোরে জোরেই বলছিল, যাতে ওরা শুনতে পায়। মাহফুজ ঠিকই তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব শুনতে পাচ্ছিল। এবার গলা বাড়িয়ে জানালা দিয়ে তাকাল। নুরজাহান রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গেল। বিরক্ত হলো মাহফুজ। সে এই কর্কশ মহিলার মুখ দেখার জন্য তাকায় নি। কিছুক্ষণ পর জেসমিন খাওয়ার ঘর থেকে বের হলো। এবার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল তার। জেসমিনের রূপ দেখে প্রথম দিনই মাথা ঘুরে গিয়েছিল। সে সুযোগ পেলেই জেসমিনকে চোখ দিয়ে গিলে খায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জেসমিন সারাক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকে। ভালো করে দেখার সুযোগ নেই, কিন্তু সে প্রতিদিন সুযোগের অপেক্ষায় থাকে যে কখন জেসমিন গোসল করতে যাবে। গোসলের সময় সে একেক দিন একেক উপায়ে পুকুরঘাটে তাকিয়ে থাকে। পুকুরের ওপাড়ে একটা বাঁশঝাড় আছে। প্রায়ই ওখানে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। খুব যে আহামরি লাভ হয়, তা নয়। কারণ, জেসমিন খুব সতর্কভাবে ঢেকেঢুকে গোসল করে। সাঁতার শেষে ঘোমটা দিয়ে উঠে চলে যায়। ভেতরের গোসলখানায় কাপড় পাল্টায়।
বাড়িভর্তি এত মানুষকে অসহ্য লাগে মাহফুজের। এত মানুষ না থাকলে এত দিনে তার মনের সাধ কবেই মিটিয়ে ফেলতে পারত! সবচেয়ে বড় সমস্যা পারুল। সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থাকে সাথে, তাই সে সুযোগ আর পায় না। কবে যে একটা সুযোগ আসবে!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন