মৌরি মরিয়ম
পুকুরে জাল ফেলে বড় বড় মাছ ধরা হয়েছে। বড় কাতল ও বোয়াল ধরা পড়েছে জালে। খাসিও জবাই করা হয়েছে। মেয়েরা তিন দিন বসে নতুন গুড়ের পিঠাপুলি বানাচ্ছে। এত দিন বাদে জামাই আসছে বলে কথা। লোক পাঠিয়ে গৌরনদীর রসমালাই ও দই আনালেন জয়নাল মির্জা। আয়োজনের কোনো কমতি রাখলেন না।
জেসমিনও আজ ভীষণ খুশি। এত দিন বাদে রঞ্জু আসছে। গতকাল সূর্যমণি এসেছে। আজ কেশবপুর আসবে জেসমিনকে নিতে। গত মাসে সে ঢাকা থেকে একটা লাল রঙের ঢাকাই জামদানি পাঠিয়েছিল। সেটা আজ পরেছে জেসমিন। শাড়িটা পরে ঘর থেকে বের হলো। কাছারিঘরের পেছনে একটা জবা ফুলের গাছ আছে। সেখান থেকে কিছু ফুল এনে রাখলে হয়। রঞ্জু খুশি হবে। ফুল খুব পছন্দ করে মানুষটা।
জেসমিন ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে আঁচলে রাখছে। এরই মাঝে শুনতে পেল কাছারিঘরে তার বাবা এবং ভাইয়েরা রঞ্জুর নাম নিয়ে কিছু বলাবলি করছে। যেহেতু রঞ্জুর নামটা আসছে, তাই কৌতূহলবশত সে কাছারিঘরের পেছনের বারান্দায় জানালার কপাটের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। এরপর সে যা শুনল, তাতে তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। তার বাবা এবং ভাইয়েরা মিলে আজ রাতে রঞ্জুকে খুন করার পরিকল্পনা করছে! সামান্য একটা জমি হারিয়েছে বলে ছেলেকে মেরে বাবার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে! তার বাপ-ভাইয়েরা ভয়ংকর, তা সে জানত, তাই বলে এতটা হিংস! পালাতে হবে, এই মুহূর্তে এখান থেকে পালাতে হবে। রঞ্জুর এখানে আসা আটকাতে হবে। জেসমিন দৌড় দিল। দুর্ভাগ্যবশত তাড়াহুড়োয় তার হাতের সাথে জানালার কপাট একটা ধাক্কা খেল। শব্দ শুনে জালাল-জব্বার পেছনের বারান্দায় তাকাতেই দেখতে পেল জেসমিনকে। কিছু বুঝতে আর বাকি রইল না তাদের। জব্বার লাফিয়ে পড়ে দৌড় দিল জেসমিনের পেছন পেছন। কয়েকটা বাড়ি পার হয়েই জেসমিনকে ধরে ফেলল। জেসমিন ক্রোধে গর্জন করতে লাগল, ‘খুনির বাচ্চা খুনি, ছাড় আমারে, ছাড় কইতাছি।’
জব্বার জেসমিনের মুখ চেপে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইল। জেসমিন কিছুতেই যাবে না। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর। জব্বার তাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে যেতে লাগল। কাছারিঘরে নিয়ে তবেই মুখটা ছাড়ল। সেখানে জয়নাল মির্জা এবং জালাল বসে ছিল। জব্বার যখন গেছে, ধরে আনতে পারবে বলেই তাদের বিশ্বাস ছিল। জেসমিনের মুখটা ছাড়তেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আব্বা, আমনে নিজের মাইয়ার স্বামীরে খুন করার কথা ক্যামনে চিন্তা করলেন? এত বড় কষাই আমনে?’
জয়নাল মির্জা ঠান্ডা মাথার মানুষ। সহজে বিচলিত হন না। তিনি শান্ত স্বরে মেয়েকে বললেন, ‘অরা আমাগো শত্রু, মা। তোমার শ্বশুর অনেক বড় পরিকল্পনা কইরা পোলারে তোমার পিছনে লাগাইছিল। কালিশুরির জমিখান যৌতুক নিতে চাইছিল। আমি তো তহন বুঝতে পারি নাই, মা। অগো ফাঁদে পা দিয়া ফালাইছি। আমারে মাফ কইরা দেও।’
‘মিথ্যা কতা কইবেন না, আব্বা। আমি এগুলান বিশ্বাস করি না।’
‘বিশ্বাস করো আর না করো, সত্য বলছি। তুমি তারে ভুইলা যাও। তোমারে আরও ভালো পোলা দেইখা বিয়া দিমু।’
জেসমিনের ক্রোধপরায়ণ চোখ দুটো এবার ভিজে এল। কাঁদতে কাঁদতেই সে চিৎকার করল, ‘আল্লাহর গজব পড়ুক। আমারে ছাড়েন, রঞ্জুরে কমু জমি আমনের নামে লেইখ্যা দিতে।’
জয়নাল মির্জা হুঁক্কায় টান দিতে দিতে বললেন, ‘জমি দিয়া কী করমু এহন আর? যে সম্মান আমার গেছে, তা কি ফেরত পামু?’
ওরে জল্লাদ রে!’
জেসমিন এবার ওপর দিকে চেয়ে দ্বিগুণ স্বরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আল্লাহ, তোমার দুনিয়ায় কোনো বাপ কি এমন অয়?’
জয়নাল মির্জা জালাল জব্বারকে বললেন, ‘অরে এখন আর বাড়ির ভিতর নেওন যাইব না। চিল্লাইয়া বাড়ির সবাইরে জানান দিবে। কাছারিঘরেই আটকাইয়া রাখ। আর হাত-মুখ বাইন্দা রাখ। তেজ বেশি মাইয়ার।’
‘আব্বা!’
জেসমিন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। জব্বার হাত ধরে রেখেছে, জালাল মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর চেয়ারে বসিয়ে দুই হাতলের সাথে দুই হাত বাঁধল। জেসমিন নুন পড়া জোঁকের মতো ছটফট করছে। কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারল না। জয়নাল মির্জা বেরিয়ে গেলেন আগে। জালাল ও জব্বার শেষে দরজায় তালা মেরে বের হলো। ভারী কাঠের চেয়ারের সাথে এমন শক্ত করে বেঁধেছে যে জেসমিন আর নড়তেও পারল না। অসহায়ের মতো কেঁদে চলল শুধু।
.
রঞ্জু এল সন্ধ্যার পর। শ্বশুরের সাথে বসে গল্প করছে। জেসমিনকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করতেও একটু লজ্জা লাগছে। এরই মাঝে জেসমিনের মা খেতে ডাকল। খেতে বসেও জেসমিনকে দেখতে না পেয়ে অবশেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘আম্মা, জেসমিনকে দেখছি না। ও কোথায়?’
কোহিনুর বানু স্বামীর কাছ থেকে যা জেনেছেন, তা-ই বললেন, “মিনুর বাচ্চা অইবে তো। কী সমেস্যা জানি অইছে। আমাগো এদিকের হাসপাতালে আনছে। খবর পাইয়া জব্বার গেছে, লগে জেসমিনও গেছে। আইয়া পড়বে, তুমি খাও, বাবা।’
রঞ্জুর একটু মন খারাপ হয়েছিল, তিন মাস পর বাড়ি এল, অথচ জেসমিনকে দেখতে পাচ্ছে না! এখন অবশ্য মনখারাপ লাগাটা আর নেই। শাশুড়ির হাতের রান্না বরাবরই রঞ্জুর খুব প্রিয়। সে খুব তৃপ্তি করে কবজি ডুবিয়ে খেল। খাওয়া বেশি হওয়াতে সে একটু উঠোনে হাঁটতে নামল। কাছারিঘরের সামনেই হাঁটছিল সে। জালাল পেছন থেকে বলল, ‘রঞ্জু, বিলে মাছ কোপাইতে যাবানি?’
জেসমিন এ কথা শুনে চমকে উঠল। রঞ্জু এসে পড়েছে? তখনই রঞ্জুর গলা শোনা গেল, ‘আরে ভাইজান, দারুণ আইডিয়া! কত দিন মাছ কোপাই না! চলেন যাই। জেসমিন বাড়িতে নাই, ভালোও লাগছে না।’
জেসমিনের হৃদয়টা হু হু করে উঠল। কত দিন পর রঞ্জুর গলার স্বর শুনতে পেল। রঞ্জু তার এত কাছে!
জালাল হাঁক ছেড়ে বলল, ‘এ কুদ্দুস, ফুলকুচি আর কোঁচ গুলান লইয়া আয়। জামাইরে নিয়া মাছ ধরতে যামু।’
জেসমিন মরিয়া হয়ে উঠল রঞ্জুকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু কীভাবে বাঁচাবে তাকে? চেয়ারটা এত ভারী যে সে একটুও নড়াতে পারল না। মাটির মেঝেতে ঠেসে আছে চেয়ারের পায়াগুলো। আশপাশে তাকিয়ে জয়নাল মির্জার রেখে যাওয়া হুঁক্কাটা দেখতে পেল। সেটাকেই পা বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করল। অনেক কষ্টে যখন ছুঁতে পারল, তখন সেটা উল্টে দিল, যাতে শব্দ হয়। আর শব্দটা রঞ্জুর কানে যায়। যদিও এটা সন্দেহ হওয়ার মতো কিছু নয়, তবু একটা চেষ্টা। শব্দটা শুনে রঞ্জু বলল, ‘কাছারিঘরে তো তালা মারা। তাহলে ভেতরে কিসের শব্দ, ভাইজান?’
জালাল বলল, ‘বিলোই হানছে মনে হয়। বাদ দেও। চলো মাছ ধরতে যাই।’
হুঁক্কাটা ধাক্কা খেয়ে দূরে গিয়ে পড়েছে, আরেকটা শব্দ করার মতো কোনো উপায় জেসমিনের রইল না। পায়ের আওয়াজ দূরে যেতে থাকায় জেসমিন বুঝতে পারল জালাল ও রঞ্জু চলে যাচ্ছে। শেষ, সব আশা শেষ। জেসমিন অঝোরে কাঁদতে লাগল। পেটের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘তোর আসার খবরটা তোর বাপরে দেওয়ার জন্য এত উতলা হইয়া চিঠি লেখছিলাম, তারপরেও কত অপেক্ষা! অথচ তোর বাপ জানতেও পারল না তোর আসার কথা!’
জালাল জামাই নিয়ে মাছ ধরতে ময়নার বিলে গেল। জালাল জব্বার ও জয়নাল মির্জার লোকেরা সেই বিলেই তাকে মেরে ধাপের নিচে ফেলে এল। তবে মৃত্যুর আগে রঞ্জু এটা জেনে যেতে পারল যে তার বাবার ঠিক কোন অপরাধের জন্য তাকে মরতে হচ্ছে। এ-ও জানতে পারল, কাছারিঘরে কোনো বিড়াল ছিল না। ছিল হাত-মুখ বাঁধা তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। তাকেই বাঁচাবার শেষ চেষ্টাস্বরূপ শব্দটা করেছিল সে। জালাল-জব্বার রসিয়ে রসিয়ে বলছিল সেসব কথা!
আহা রে জীবন! আরেকটিবার জেসমিনের সাথে দেখা হলো না। শোনা হলো না তার না-বলা সেই কথাগুলো! দীর্ঘ তিন মাস অপেক্ষার কোনো অর্থ রইল না। কে জানত তিন মাসের ব্যবধানে এত কিছু ঘটে যাবে!
সেই রাতেই জেসমিনকে কাছারিঘর থেকে তার ঘরে আনা হলো। কিন্তু এখানেও তাকে আটকে রাখার নির্দেশ দিলেন জয়নাল মির্জা। জেসমিনের দরজার বাইরে একজনকে পাহারায়ও বসানো হলো।
রঞ্জুর মৃত্যুর খবর পেয়ে জেসমিন মাটিতে শুয়ে পড়ে বলল, ‘আমারেও ওই মাটিতে মিশাইয়া দেও!’
কিন্তু চিৎকার করার মতো শক্তি আর তার অবশিষ্ট নেই। সে শুধু উদ্ভ্রান্তের মতো কেঁদে চলেছে। উল্টোপাল্টা প্রলাপ বকছে। কোহিনুর বানু জয়নাল মির্জাকে বললেন, ‘আর কত পাপ করবেন? নিজের মাইয়ারেও যে কেউ বিধবা করতে পারে, আপনেরে না দ্যাখলে জানতাম না।’
জয়নাল মির্জা মেয়েছেলের কথা গায়ে মাখেন না। তিনি তার ঘরে গিয়ে শান্তির ঘুম দিলেন। হারুন ব্যাপারী অতি বাড় বাড়ছিল। এত দিনে তাকে একটা উপযুক্ত জবাব দেওয়া গেছে। জয়নাল মির্জার সাথে লাগতে এলে কী হতে পারে, সেটা এবার বুঝবে।
.
একদিন দুপুরের খাবার খাওয়াতে জেসমিনের ঘরে ঢুকলেন কোহিনুর বানু। বাইরে পাহারাদার। তাই জেসমিন ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমার পেটে রঞ্জুর বাচ্চা, মা।’
এ কথা শুনে আঁতকে উঠলেন কোহিনুর বানু। যে খবরে খুশি হবার কথা, সে খবরে আজ তিনি খুশি হতে পারছেন না। তার কষ্ট আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল।
তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। জেসমিন আবার বলল, ‘আমি পলাইয়া যামু। আমারে সাহায্য করো, মা। এই শকুনের দল বাচ্চাডার কথা জানতে পারলে রাখতে দেবে না।’
‘কিন্তু পলাইয়া যাবি কোতায়?’
‘শ্বশুরবাড়ি যামু। হেরা জাগা না দিলে একদিকে যামু যাইয়া। কপালে যা আছে, তাই অইবে। আমি খালি বাচ্চাডারে জন্ম দিতে চাই, মা। আমার রঞ্জুর একমাত্র চিহ্ন ও। আমি অরে সারা জীবন আমার লগে রাখতে চাই। তোমার দুইডা পায়ে ধরি, আমারে পলাইতে সাহায্য করো।’
রাতের খাবার খাওয়ানোর ছুতোয় জেসমিনের ঘরে ঢুকে তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন কোহিনুর বানু। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “এই টাহা কয়ডা রাখ। কামে লাগবে। পাশের বাড়ির কাশেমরে কইয়া ঘরের সিঁধ কাটনের ব্যবস্থা কইর্যা রাখছি। ও গোপন রাখপে। রাইত বাড়লে আইয়া সিঁধ কাইট্যা দেবে। বাইর হইয়া যাইছ।’
জেসমিন মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘মা গো, সারাটা জনম তোমারে খালি জ্বালাইসি। আমারে মাফ কইরা দিয়ো।’
কোহিনুর বানুও চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘পাগল মাইয়া আমার! যেখানেই থাকোস, নিজের যত্ন নিবি, মার দোয়া সব সময় তোর লগেই আছে। অনেক দূরে চইলা যাইস। এই শকুনের দল জানি তোর নাগাল না পায়! এত বড় দুনিয়ার কোনো না কোনোখানে তোর জায়গা নিশ্চয়ই অইবে।’
.
রঞ্জুর মৃত্যুর তিন দিন পর মাঝরাতে জেসমিন পালিয়ে গেল। কিছুই নিল না সঙ্গে। শুধু একটা শাল গায়ে পেঁচিয়ে বেরিয়ে গেল। দৌড়াতে দৌড়াতে যখন শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাল, তখন ভোর হয়ে গেছে। বাড়িতে ঢুকে উঠান পার হয়ে ঘরে ঢোকার সিঁড়িতে উঠল। তারপর আচমকাই ঘরের ভেতর থেকে রোকেয়া বেগম আর হারুন ব্যাপারীর কথা শুনতে পেয়ে থেমে গেল। রোকেয়া বেগম বিলাপ করছিলেন, ‘আপনেরে আমি বলছিলাম জয়নাল মির্জার লগে গ্যাঞ্জাম কইরেন না। গ্রামের সবাই মানা করছিল। আপনি শুনেন নাই। কী এক জমি নিয়া পইড়া ছিলেন। কী লাভ হইল জমি পাইয়া? ছেলে তো হারাইলেন। আবার জমির আশায় ছেলে বিয়া করাইলেন ওই কষাইয়ের বাড়িতে। এত লোভ ক্যান আপনের? এখন দেন, আমার ছেলেরে ফেরত দেন।’
হারুন ব্যাপারী বললেন, ‘কাইন্দ না, রঞ্জুর মা। আমাদের ছেলেকে যে এইভাবে হত্যা করেছে, তাকে আমি ছাড়ব না। জেসমিন একদিন না একদিন এই বাড়ি আসবে। তার বাপের চোখে ফাঁকি দিয়ে হলেও আসবে। সেই দিন জেসমিনকে টুকরা টুকরা করে তার বাপের কাছে পাঠাব।’
জেসমিন কেঁপে উঠল। রোকেয়া বেগম বললেন, ‘আপনাদের খুনাখুনি তো চলতেই থাকবে…’
জেসমিন বাকি কথা আর শুনল না। শোনার দরকারও নেই। চুপিচুপি আবার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। তারপর দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় উঠেও দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে কোন দিকে গেল, সে জানেও না। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দৌড় থামিয়ে সে মাথায় ঘোমটা তুলে হাঁটতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে এক নদীর ঘাটে এসে পৌঁছাল। ততক্ষণে সূর্য মাথার ওপরে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। একটা নৌকায় অনেক যাত্রী উঠছে। নৌকা কোথায় যাবে, সে জানে না। তবু উঠে পড়ল। নৌকা এঘাট-ওঘাট ঘুরে শেষ ঘাটে যখন থামল, তখন সে একটা বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছাল। উঠে পড়ল বাসে। বাস কোথায় যাবে, তা জানার আগ্রহ তার নেই। সে শুধু দূরে যেতে চায়। এই সব মারামারি-খুনোখুনি থেকে অনেক দূরে। যেখানে গেলে সে তার সন্তানকে নিয়ে নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারবে।
রাত তখন অনেক। কুয়াশায় কয়েক কদম সামনেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডের দোকানিরা একে একে দোকানপাট বন্ধ করছে। আনোয়ারের বড় চা তৃষ্ণা পেয়েছে। নরেনের হাতের এক কাপ চা না হলে তার এখন হবেই না। আনোয়ারকে দেখে নড়েন বলল, ‘এত দেরি কইর্যা আইলে বাবু চা দেতে পারমু না আমি। তোমারে আগেও কইছি।’
আনোয়ার নরম গলায় বলল, ‘আহা, নরেনদা, রাগ অও ক্যা? রাস্তাঘাটের মামলা কি অত সময় বাইন্ধা পারোন যায়? দুই-এক দিন এট্টু দেরি অইলে মাফসাফ কইর্যা দিয়ো। এত চায়ের দোকান কিন্তু তোমার হাতের চা না খাইলে হারা দিনের ক্লান্তি যায় না। দেও দেও, এক কাপ চা দেও, গা-ডা গরম করি।’
নরেন সব গোছগাছ করেই রেখেছিল। আনোয়ারের চা দিয়েই চুলা নিভিয়ে দোকানের ঝাঁপ নামাল।
দোকানে তালা দিতে দিতে বলল, ‘বাবু, কাপ খান টোঙের নিচে থুইয়া দিয়ো।’
দোকান বন্ধ করে নরেন বাড়ি চলে গেল। যেহেতু আজ কাপ ফেরত দেওয়ার তাড়া নেই, একটা বিড়ি ধরিয়ে সময় নিয়ে আয়েশ করে চা খেতে লাগল আনোয়ার। চা শেষ হবার আগেই দেখতে পেল তার বাসের হেলপার ছুটতে ছুটতে আসছে। আনোয়ার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী অইছে তোর, দৌড়াছ ক্যা?’
ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ওস্তাদ, বাসের মইধ্যে এউক্কা মাইয়ামানুষ ঘুমাই রইছে।’
আনোয়ার চমকে উঠে বলল, ‘কস কী? লগে কেউ নাই?’
‘না, একলা। বাস পরিষ্কার করতে যাইয়া হ্যারে দেকছি।’
আনোয়ার দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে ঘটনা সত্য। অপূর্ব রূপবতী একটি মেয়ে জড়সড় হয়ে বাসের পেছনের সিটে শুয়ে আছে। এত রূপবতী মেয়ে আনোয়ার তার জীবদ্দশায় কখনো দেখে নি। অনেক ডাকাডাকি পরেও যখন মেয়েটির ঘুম ভাঙল না, তখন সে বুঝতে পারল, মেয়েটি সম্ভবত ঘুমিয়ে না, অজ্ঞান হয়ে আছে। আনোয়ার প্রথমে ভয় পেয়েছিল, তারপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় এখন তার কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছিল না। আর যা-ই হোক, এভাবে একটি মেয়েকে ফেলে যাওয়া যায় না। ভেবেচিন্তে সে মেয়েটিকে মুস্তাফিজ ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেল।
.
মুস্তাফিজ ডাক্তার মেয়েটির চিকিৎসাকালে আঁচলে কিছু বাঁধা দেখতে পেলেন। যেহেতু মেয়েটির এখনো জ্ঞান ফেরে নি এবং অত্র এলাকায় তাকে আগে কখনো দেখে নি, তাই তার পরিচয় জানা জরুরি। সেই কারণেই আঁচলের গিঁট খুললেন, যদি কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো ঠিকানা পাওয়া গেল না। কিছু টাকা ও একটি চিঠি পাওয়া গেল। চিঠিতে লেখা :
তুমি নেই সঙ্গে সখী
তুমি নেই চোখেরও সমীপে,
আছ তুমি অঙ্গে সখী
আছ পরশ ও প্রতাপে।
যে অঙ্গসুধা এনেছি ভরে হৃদয়কোটর
ফুরাবে না গেলে সহস্র কোটি বছর
তুমি নেই বক্ষে সখী
তুমি নেই কক্ষে,
আছ তুমি রোমন্থনে
আছ স্মৃতির দংশনে।
প্ৰিয় জেসমিন,
তোমার চিঠি পেয়েছি। আশা করি তুমিও ভালোই আছ। গত সপ্তাহে বাবার চিঠি পেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন যে তুমি আমাদের বাড়ি গিয়েছ। তুমি যাওয়াতে তারা দুজনেই খুব খুশি হয়েছেন।
তোমার কামিনীগাছ দেখি ভালোই কথা শিখেছে। এরপর গেলে তাকে বলো, খুব দ্রুতই তার কাছে আমাদের ভালোবাসার সুবাস পৌঁছাবে।
আর শোনো মেয়ে, কামিনী শীতে ফোটে না। এটা বর্ষার ফুল। বর্ষা আসলেই আবার ফুটবে, তুমি-আমি থাকি বা না থাকি।
জেসমিন, আর কটা দিন একটু কষ্ট করো। আমি এখন বাড়ি গেলে এই ক’মাস আমার ঢাকা থাকা বৃথা। কারণ, আমার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষাগুলো দিয়ে চলে আসব। এর পর থেকে আর ক্লাস করব না, শুধু পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দেব। তোমাকে ছেড়ে থাকাটা আমার জন্য কতটা কষ্টের, আশা করি বুঝবে। একটু ধৈর্য ধরো, লক্ষ্মী বউ আমার। খুব শীঘ্রই তোমার নাইয়র শেষ হবে।
ভালোবাসা নিয়ো।
ইতি তোমার রঞ্জু।
জেসমিনের জ্ঞান ফিরল কিছুক্ষণ পরই। কিন্তু সে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে, কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না।
শুধু বলল, ‘খিদা লাগছে।’
মুস্তাফিজ ডাক্তারের চেম্বারের পাশেই তার ভাই মুজাহিদের ভাতের হোটেল। সেখান থেকে জেসমিনের জন্য খাবার আনা হলো। একটা জলজ্যান্ত মেয়ে নাম-পরিচয় কিছুই বলতে পারছে না। তার ওপর চোখধাঁধানো রূপবতী। একে নিয়ে এত রাতে এখন তারা কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। জেসমিন খেতে বসলে আনোয়ার রাস্তায় গিয়ে সিগারেট ধরাল।
জেসমিনের খাওয়া শেষ হলে মুস্তাফিজ ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, ‘জেসমিন, তুমি যখন অচেতন ছিলা, তোমার ঠিকানা খোঁজার জন্য আঁচলের গিঁটে চিঠি পেয়ে সেটা পড়ছি। আমাদের রঞ্জুর ঠিকানা বলো। সে ঢাকায় কোথায় পড়াশোনা করে? কোথায় থাকে? তারে খবর দেই, তোমারে নিয়া যাক।’
এ প্রশ্নে জেসমিন আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। মুস্তাফিজ ডাক্তার বিব্রত হয়ে বললেন, ‘কী হইল? কান্দ কেন?
‘আমার বাপে আমার স্বামীরে খুন করছে। আমি পলাইয়া আইছি। আমারে একটু সাহায্য করেন, মিয়াভাই।’
মুস্তাফিজ ডাক্তার রীতিমতো চমকে উঠলেন। বললেন, ‘বলো কী! কদিন আগে যে শুনছিলাম এক ডাকাত তার মেয়েজামাইকে খুন করেছে, সে কি তোমার বাবা?’
জেসমিন কান্না থামাতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘না, তয় হে ডাকাইতের চাইয়া কম না। সম্পত্তির মামলায় আমার শ্বশুরের লগে হারছে। প্রতিশোধ নেওয়ার লাইগা আমার স্বামীরে মারছে। আমার শ্বশুর আবার হেই প্রতিশোধ নেওয়ার লাইগা আমারে মারতে চাইছিল। কোনোমতে পলাইয়া আইছি। আমার যাওনের কোনো জাগা নাই। আপনের দুইডা পায়ে ধরি, আমারে একটু সাহায্য করেন।’
জেসমিন সত্যি সত্যি পা ধরতে যাচ্ছিল। মুস্তাফিজ ডাক্তার সরে গেলেন, ‘আরে করো কী করো কী, খাড়াও, আমি দেখতেছি কী করা যায়। তুমি কান্নাটা থামাও।’
খানিক বাদেই ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তোমার বাড়ি কি পটুয়াখালী বা বরগুনা?’
জেসমিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস বলল, ‘পটুয়াখালী। কিন্তু আপনে ক্যামনে জানলেন?’
ডাক্তার বললেন, ‘জানি নাই, আন্দাজ করলাম। এমন কথায় কথায় খুনখারাবি ওই দিকেই হয় বলে শুনি।’
জেসমিন চোখ মুছল। ডাক্তারকে আগের চেয়েও বেশি চিন্তিত মনে হলো।
কিছুক্ষণ পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার পেটে বাচ্চা আছে, এ কথা তুমি জানো?”
জেসমিনের চোখ দুটো আবারও জলে ভরে উঠল। মাথা নিচু করে বলল, ‘জানি। বাচ্চারে বাঁচানোর লাইগ্যাই পলাইছি। নাইলে তারে ছাড়া এই জীবনের কোনো দাম আছিল না।’
ডাক্তার বললেন, ‘জেসমিন, তুমি একা হইলে তোমার হয়তো কোনো ব্যবস্থা করা যাইত। কিন্তু বাচ্চাসহ তোমার কী ব্যবস্থা করব, বুঝতে পারতেছি না। আপাতত তুমি সত্যি কথাটা আর কাউরে বইল না। এমনকি আনোয়াররেও না। সবাইরে বলবা তুমি এতিম। তোমার স্বামী মারা গেলে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়াইয়া দিছে। এখন তোমার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। তুমি কোত্থেকে আসছ, এইটাও বলবা না। যেহেতু তোমার কথায় বরিশাল অঞ্চলের টান আছে, তাই বরিশালের কোনো জায়গার নাম বলবা। স্বরূপকাঠি বইল।’
জেসমিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। ডাক্তার আবার বললেন, ‘এ ছাড়া উপায় দেখতেছি না। এদিকে খুনখারাবি হরহামেশা হয় না। লোকে এই সব ভয় পায়। তাই সত্যিটা জানলে তোমারে কেউ সাহায্য করবে না। গ্রামছাড়াও করতে পারে। এমনকি সবাই সত্যিটা জানলে আমারেও সাহায্য করতে দেবে না। সমাজে তো সবাইরে নিয়াই চলতে হয়।’
‘বুজছি।’
মুস্তাফিজ ডাক্তার দোকানের বাইরে তাকিয়ে আনোয়ারকে ডাক দিলেন। আনোয়ার এলে তাকে স্বরূপকাঠির শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত এতিম বিধবা জেসমিনের গল্প শোনালেন।
আনোয়ার এসব শুনে অসহায় গলায় বলল, ‘কী বিপদ!’
মুস্তাফিজ ডাক্তার জানতে চাইলেন, ‘অরে কি তোমার লগে লইয়া যাইবা? আমার তো চেম্বার বন্ধ করনের সময় পার অইয়া গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে।’
আনোয়ার কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘ডাক্তার সাব, মুই এরে কই লইয়া যামু? এতগুলা পোলাপান, বাপ-মা নিয়া এত বড় সংসার চালাইতে হিমশিম খাইয়া যাই। তার মধ্যে আরেকজনরে ক্যামনে উডাই? থাকোনের জাগাও তো নাই।’
‘তাইলে কী করবা?’
‘আমনেগো তো অনেক বড় বাড়ি। কামের লোকটোক দরকার অয়। আমনেরা লইয়া যান।’
মুস্তাফিজ ডাক্তার বললেন, ‘কী কও তুমি? শিক্ষিত বড়লোকের ঘরের বউ, গেরস্তবাড়ির কাম…।’
জেসমিন বলল, ‘মুই সব কাম পারি। আমনেগো বাড়ি বা যেকোনো বাড়িতেই একটা কাম জুটাইয়া দিলেই অইবে। কোনো টাহাপয়সা লাগবে না। খালি থাকতে দিলে আর তিন বেলা খাইতে দিলেই অইবে।
তাদের কথাবার্তার মাঝখানেই মুজাহিদ এল। প্রতি রাতেই দুই ভাই যার যার দোকান বন্ধ করে একসঙ্গে বাড়ি ফেরে। জেসমিনের ব্যাপারে সব শুনে সে-ও ঘাবড়ে গেল।
আনোয়ার প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘মাইয়াডারে জানে বাঁচাইতে যাইয়া আমি একি বিপদে পড়লাম? আপনেরা একটু মোর অবস্থাডা ভাইবা দয়া করেন। মুই হ্যারে কই নিমু?’
মুজাহিদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। মুস্তাফিজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, আপাতত অরে আমরাই আমাগো বাড়ি নিয়া যাই। এরপর কাইল দিনে ভাবনাচিন্তা কইরা একটা সমাধান বাইর করোন যাইব।’
মুজাহিদ বলল, ‘ভাইজান, এই কাম করোন যাইব না। এত রাইতে হেরে বাড়ি নিয়া আমনে কইবেনডা কী? ভাবি রাগ অইবে। আমার বউও কম না। সংসারে এই অশান্তি ক্যামনে সামলাইবেন?’
মুস্তাফিজ বললেন, ‘আরে ভাই, সবাই খালি নিজেগো কথা চিন্তা করলে ক্যামনে অইবে? গর্ভবতী অসহায় একটা মাইয়ামানুষ এত রাইতে রাস্তায় তো আর ছাইড়া দেওন যায় না। নিয়া চলো। যা অইবে দেহা যাইবেয়ানে।’
নুরজাহান বড় দুচিন্তায় পড়ে গেছে। একেক দিন মুস্তাফিজের ফিরতে দেরি হয় বটে। কিন্তু এত দেরি তো কখনোই হয় না। তার ওপর যেদিন দেরি হয়, সেদিন তিনি খবর পাঠান। আজ তো কোনো খবরও পাঠালেন না। দুশ্চিন্তার বোঝা একা বইতে না পেরে সে শরিফা বানুর ঘরে গিয়ে বলল, “আম্মা, আমনের পোলায় তো এহনো আইলো না। মোর ডর করতেয়াছে।’
শরিফা বানু দোয়া পড়ছিলেন। হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে তিনি দোয়া শেষ করলেন।
তারপর বললেন, ‘এত উতলা হওনের কোনো কারণ নাই। যেহেতু মুজাহিদও আহে নাই, তার মানে দুইজনে একলগেই আছে। আইয়া পড়বে।’ মুজাহিদও আসে নি, এ কথা শুনে কিছুটা শান্ত হলো নুরজাহান। নিজের ঘরে ফিরে গেল। তবে শাশুড়ির মতো অতটা নিশ্চিন্ত সে হতে পারে নি। তার অধিক চিন্তার দোষ আছে।
.
শরিফা বানুর বয়স খুব বেশি নয়। অতি অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি দুটোই বেশ অবস্থাসম্পন্ন। অল্প বয়সেই মা হয়েছেন। চার ছেলে তিন মেয়ে ছিল তার। বড় মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে মুস্তাফিজ হয়েছেন ডাক্তার, মেজ ছেলে মুজাহিদের হোটেলের ব্যবসা, সেজ ছেলে মুস্তাকিম ঢাকায় সরকারি চাকরি করে, ছোট ছেলে মাহফুজ আলালের ঘরের দুলাল। কেবল টইটই করে ঘোরে, না করে পড়াশোনা, না করে কোনো কাজ। ছেলেরাও সবাই বিবাহিত।
শরিফা বানু মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামী ও ছোট মেয়েকে হারিয়েছেন। তাদের লাশও খুঁজে পাওয়া যায় নি। তারপরও শক্ত ছিলেন। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত খাওয়াতেন। বড় সাহসী নারী! বিচক্ষণও বটে। এই বয়সেও তাকে সবাই মান্য করে চলে। কিন্তু তাই বলে তিনি শুয়ে পড়ার পরও এত রাতে তার কেন ডাক পড়ল বোধগম্য হচ্ছে না। সাধারণত ছেলেরা বাড়ি ফিরতে দেরি করলে তিনি শুয়ে পড়েন। এরপর আর কেউ তাকে ডাকে না।
শরিফা বানু বিছানা ছেড়ে বসার ঘরে যেতেই দেখেন বাড়ির সকলে সেখানে জড়ো হয়েছে। ঘরের এক কোণে একটি অপরিচিত মেয়ে মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথায় ঘোমটা। মেয়েটি কে, এই প্রশ্নের আগে তার মনে প্রশ্ন জাগল, মানুষও এত সুন্দর হয়? এ যেন সাক্ষাৎ পরি! মুখশ্রী থেকে দ্যুতি ঠিকরে বের হচ্ছে। এমন রূপবতী তিনি আরেকটি দেখেন নি
ছেলেদের নয়, বউদেরও নয়, তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন মেয়েটিকেই, ‘তুমি কে, মা?’
মেয়েটি একবার তার দিকে তাকিয়েই আবার মাথা নিচু করে ফেলল। মেয়েটির চোখে স্পষ্ট ভয় দেখলেন তিনি। তার প্রশ্নের উত্তর দিলেন মুস্তাফিজ।
তিনি বললেন, ‘মা, অর নাম জেসমিন। এতিম মাইয়া। স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাড়াই দিছে। বাপের বাড়ি বলতে কিছু নাই। বিয়ার আগে আশ্ৰিত আছিল। যাওয়ার কোনো জাগা নাই।’
মুজাহিদ দেখে তার বউসহ ভাইয়ের বউদেরও চেহারা থমথমে। যেন শরিফা বানু এখান থেকে সরলেই তাদের দুই ভাইয়ের কলিজা বের করে নেওয়ার অপেক্ষাতেই আছে তারা। তিনি দ্রুত বললেন, ‘এহন কাম খুঁজতাছে। তোমরা তো হেদিন কামের মানুষের কতা কইছিলা। হেইল্লাইগ্যা নিয়াইলাম। ও সব কাম জানে।’
মুজাহিদের স্ত্রী ময়না কড়া গলায় জানতে চাইল, ‘এত রাইতে তোমরা তারে কই পাইলা?’
মুস্তাফিজ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই মুজাহিদ বলল, ‘রাইত কই? মাইয়াডা বিয়ালে কাম খুঁজতে আমাগো দোকানে আইছিল। তা আমরা তো কাজের চাপে আগে বাইর অইতে পারলাম না। রাইত অইয়া গেল।’
মুজাহিদ যেহেতু এ কথা বলেই ফেলেছে, মুস্তাফিজের আর কিছু বলার রইল না। মেয়েটিকে এভাবে কাজের লোক বানিয়ে ফেলায় তিনি লজ্জিত।
শরিফা বানু সবার কথা চুপচাপ শুনে শেষমেশ বললেন, ‘আচ্ছা নুরজাহান, এখন সবাইর খাওনের ব্যবস্থা করো। আর মাইয়াডারে পিছের বারান্দার ঘরে থাকনের ব্যবস্থা করো। অর ব্যাপারে বাকিডা কাইল দেখমু।’
মূল বাড়ির পেছনের বারান্দায় একটা ছোট ঘরে কাজের মেয়েরা থাকত। আপাতত কোনো কাজের মেয়ে না থাকায় ঘরটি খালি পড়ে আছে। সেখানেই স্থান হলো জেসমিনের।
খাওয়াদাওয়ার পর মুস্তাফিজ ঘরে ঢুকতেই তাকে জেরা করতে শুরু করে দিল নুরজাহান।
‘এত দামি শাড়ি পরা, কাশ্মীরি শাল গায়ে, গলায় কানে সোনার জিনিস পরা সুন্দরী মাইয়া কাম খুঁজতে আইছে, এইডা আমারে বিশ্বাস করতে কও তুমি?’
মুস্তাফিজ বললেন, ‘তাইলে তোমার কী মনে হয়?’
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে নুরজাহান বলল, ‘সত্য কইরা কও মাইয়াডা কেডা?’
মুস্তাফিজ ধৈর্যের সাথে বুঝিয়ে বললেন, ‘দেখো জাহান, মেয়েটার শ্বশুরবাড়ি বেশ অবস্থাসম্পন্ন আছিল। দামি শাড়ি সে পরতেই পারে। কিন্তু তারা অরে এক কাপড়ে বাইর কইরা দিছে। এখন কাজ না করলে খাবে কী?’
নুরজাহান সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তা এক বাড়ির আশ্রিত কামের মাইয়ার বড়লোকের ঘরে বিয়া ক্যামনে হইল?’
মুস্তাফিজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এত কিছু তো আমি জিগাই নাই। তোমার জানার দরকার অইলে তুমি জিগাইয়া নিয়ো। আপাতত তোমার জেরা শেষ অইলে ঘুমাইতে আসো।’
মুস্তাফিজের সাথে নুরজাহানের বিয়ে হয়েছে আট বছর। তাদের সন্তানাদি হয় না। মুস্তাফিজ চিকিৎসার শেষ রাখেন নি। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। সন্তান না হওয়ার কারণে সব সময় হীনম্মন্যতায় ভোগে নুরজাহান। ভয়ে ভয়ে থাকে মুস্তাফিজ যদি আবার বিয়ে করতে চায়! জেসমিনকে সাথে করে নিয়ে আসাতে সেই ভয় আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে।
শুধু নুরজাহান নয়, মুজাহিদের স্ত্রী ময়না, এমনকি মাহফুজের স্ত্রী পারুল ও জেসমিনের রূপ দেখে অনিরাপদ বোধ করছে। কারোর বিশ্বাস হচ্ছে না জেসমিন কাজ খুঁজতে এসেছিল!
বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ক্লান্তিতে ঘুমে তলিয়ে গেল জেসমিন। টানা চার-পাঁচ দিনের মানসিক-শারীরিক ধকলে ভয়াবহ রকমের বিধ্বস্ত সে। কিন্তু সেই ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হলো না। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নে দেখছিল, জয়নাল মির্জা রামদা নিয়ে রঞ্জুকে ধাওয়া করছেন। লাফিয়ে উঠে বসল জেসমিন। বুক ধড়ফড় করছে তার। রঞ্জুকে যখন স্বপ্নে দেখলই, ভালো কিছু দেখত! অদ্ভুত এক সুচালো ব্যথা বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে। চোখের জলে ভেসে যেতে লাগল। আর ঘুম এল না।
.
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নামাজের পর শরিফা বানু এক কাপ চা খান। সাথে থাকে মুড়ি। এ সময় নিজের চা তিনি নিজেই তৈরি করেন। চা বানাতে যাওয়ার সময় তার মনে হলো জেসমিনকে যে ঘরে শুতে দেওয়া হয়েছে, সে ঘর থেকে অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে জেসমিনকে ডাকলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলল জেসমিন। তিনি বললেন, ‘কহন উঠছ?’
জেসমিন বলল, ‘একটু আগে।’
‘আচ্ছা, উঠছ যখন, মোর লগে আহো। কথা কই।’
জেসমিন তাকে অনুসরণ করল।
শরিফা বানু চুলা ধরাতে পাটখড়ি হাতে নিতেই জেসমিন হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দেন খালাম্মা, মুই করি।’
শরিফা বানু হেসে বললেন, ‘তোমারে তো এহনো কোনো কামে নিয়োগ দেই নাই। আগে কাম দেই, হেরপর কইরো। এহন বহো।’
জেসমিন পিঁড়ি পেতে বসল। শরিফা বানু চা বসালেন, দুটো লেবুপাতা ছিঁড়ে দিলেন চায়ে। তারপর জেসমিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাইতে বালো ঘুম অয় নাই, না? অনেক ডরাইয়া আছ মনে অইতেয়াছে। এত ডর কিসের তোমার?’
জেসমিন মাথা নিচু করে আছে। শরিফা বানু বললেন, ‘মুখ না খুললে তোমার সমস্যা বুঝমু ক্যামনে?’
জেসমিনের কেন যেন মনে হলো এই মানুষটাকে সব বলা যায়। কিন্তু যে আশ্রয় দিয়েছে, সে যখন কিছু বিষয় গোপন করতে বলেছে, তখন তা গোপন রাখাই ভালো। এমনিতেও এই গ্রামের হালচাল সে জানে না। কিন্তু এভাবে বললে চুপ করেও থাকা যায় না। সে বলল, ‘আসলে আমার মাথার ঠিক নাই। চাইর দিন হয় আমার স্বামী মরছে। এহনো নিজেরে সামলাইতে পারি নাই। তার আগেই শ্বশুরবাড়িত্যা বাইর কইরা দিল।’
‘চাইর দিন!’
গলাটা আহত শোনাল শরিফা বানুর। বিস্ময় সামলে তিনি বললেন, ‘আমি ভাবছিলাম অনেক দিন বুঝি অইছে। তা তোমারে বাইর কইরা দিল ক্যা?’
জেসমিন একটু ভেবে বলল, ‘আমারে হেগো পছন্দ আছিল না। হেগো অনুমতি ছাড়াই উনি আমারে বিয়া করছিল।’
‘ও। তোমার বাচ্চাকাচ্চা আছে?’
জেসমিন মাথা নিচু করে বলল, ‘আছে, প্যাটে।’
অবাক হলেন শরিফা। বললেন, ‘কও কী! তুমি পোয়াতি! এই অবস্থায় তোমারে বাইর কইরা দিল? এরা মানুষ নাকি অন্য কিছু?’
জেসমিন হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। শরিফার এ মুহূর্তে আর কিছুই জিজ্ঞেস করতে মন চাইল না। মেয়েটা একটু ধাতস্থ হোক। পরে জেনে নেওয়া যাবে। চা হয়ে গেছে। শরিফা এক কাপ চা জেসমিনের দিকে এগিয়ে দিতেই জেসমিন বলল, ‘আমার লাগবে না, খালাম্মা, আমনে খান।’
শরিফা বানু বললেন, ‘খাও তো, মাইয়া, কোন সময় যে ঘুমেইত্যা উঠছ, তার নাই ঠিক। এই সময় খিদা প্যাটে থাকতে নাই। মুড়িও নেও। বেইন্যা নাস্তা অইতে ম্যালা দেরি।’
জেসমিনের বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে উঠল। আহা মায়া! এইটুকু মায়া এ জগতে কে কাকে দেখায়? তার সবচেয়ে ভরসা ও আদরের জায়গা তার বাবাই তো তার সাথে সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতা করেছে!
চা পর্ব শেষ করে শরিফা বানু জেসমিনকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে কিছু পুরোনো শাড়ি ও আনুষঙ্গিক কাপড় দিলেন। ব্লাউজগুলো অনেক ঢোলা। অবশ্য তাতে কোনো অসুবিধা নেই, সুই-সুতোর ফোঁড় দিয়ে নিজের মাপের করে নিতে পারবে সে।
জেসমিন গর্ভবতী, এ কথা জেনে শরিফা বানু তাকে রান্নার কাজে নিয়োগ দিলেন। কোনো ভারী কাজ তাকে দেওয়া ঠিক হবে না।
খবর শুনে খুশি হলো ময়না ও পারুল। সবচেয়ে বেশি খুশি ময়না। যদিও রান্নাবান্নার কাজ তিন বউ মিলেই করে, তবু ময়নার ভাগে কাজ সবচেয়ে বেশি পড়ে। তাই সে কিছুটা নির্ভার বোধ করছে। কিন্তু এ খবরে মাথায় যেন বাজ পড়ল নুরজাহানের!
মুস্তাফিজ দুপুরে খেতে এসে দেখেন নুরজাহান কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। মুস্তাফিজ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কী অইছে তোমার, এমনে কান্দ ক্যা? কোনো খারাপ খবর আছে নি?’
নুরজাহান ফোঁস করে উঠল, ‘ওই মাইয়া যে পোয়াতি, এর চাইয়া খারাপ খবর আর কী অইতে পারে?’
মুস্তাফিজের কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি পুনরায় জানতে চাইলেন, ‘তাতে খারাপের কী আছে?’
নুরজাহান দুহাতে মুস্তাফিজের শার্ট খামচে ধরে বলল, ‘হাছা কইরা কও, ওই বাচ্চা তোমার? গোপনে বিয়া কইরা অন্য জায়গায় রাখছিলা?’
‘ছি ছি, আস্তাগফিরুল্লাহ। এইডা তুমি কী কইলা?’
মুস্তাফিজ দারুণভাবে অপমানিত বোধ করলেন। নুরজাহান এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাচ্চা অয় না দেইখা সবাই তো তোমারে আবার বিয়া করার কথা কয়। করতেই পারো, তুমি ব্যাডা মানুষ। ‘
রাগে-দুঃখে মুস্তাফিজের ইচ্ছা করছে নুরজাহানকে একটা চড় মারেন। কিন্তু এমন কাজ তিনি কখনো করেননি, করতে চানও না। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমারে ভালোবাসি, সেই ভালোবাসা একটা বাচ্চার চেয়ে অনেক বড়, এইডা এহনো বুজলা না, জাহান!’
.
পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েক মাস চাকরি করে টাকা জমিয়ে মামুনের পড়াশোনা শুরু করার কথা। প্রতি মাসে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠিয়েও যথেষ্ট জমিয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে পড়াশোনা শুরু না করে সংসার শুরু করল সে। ভালো পরিবেশে একটা ঘর ভাড়া করল। খাট-আলমারি, বিছানা-বালিশ, হাঁড়িপাতিল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছুই কিনল। রেহানা এত বড় ঘরের মেয়ে, তাকে তো আর যেনতেনভাবে রাখা যাবে না।
মামুন রেহানাকে নিয়ে সেই ঘরে ঢুকতেই রেহানার চোখ কপালে। পুরুষমানুষ এত গোছানো হয়, এ কথা তার জানা ছিল না। জানালায় রঙিন পর্দা, টানটান বিছানার চাদর; আর সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, বিছানার ওপর একটা গোলাপ ফুলের তোড়া। রেহানা তোড়াটা হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘ফুল কি আমার লাইগা আনছেন?’
মামুন লজ্জা পেয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। রেহানা ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মামুনের কাছে এসে দাঁড়াল।
তারপর জিজ্ঞেস করল, “তাইলে স্টেশনে নিয়া যান নাই ক্যান? ওইহানেই তো আমনের লগে এত দিন পর দেহা অইল।’
‘ইয়ে মানে…।’
রেহানা হেসে বলল, ‘আমনের এত শরম যে মুই কই থুমু!’
এবার মামুন হেসে ফেলল। রেহানা সে হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। নিজের স্বামীর প্রেমে কয়বার পড়া যায়?
রেহানা ফুলগুলোকে টেবিলে রেখে বলল, ‘আমারে একখান ফুলদানি আইন্না দিয়েন। ফুলগুলা পানিতে রাখমু।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন