মৌরি মরিয়ম
মিনু বহুদিন পর বাপের বাড়ি এল। নতুন অতিথি আসার খবর পেয়ে মিনুর বাবা ইয়াসিন আলী মেয়েকে নাইয়র নিতে গিয়েছিলেন। তিনি মেয়ের সাথে জেসমিনকেও বেড়াতে আনতে চাইলেন। জেসমিনের ইচ্ছা না থাকা স্বত্ত্বেও জয়নাল মির্জার হুকুমে তাকে কুটুমবাড়ি আসতে হয়েছে। এমনিতে সে এ বাড়িতে আসতে পছন্দ করে। মিনুর ছোট ছোট ভাইবোন থাকায় তাদের সাথে খেলে জেসমিনের সময় অনেক ভালো কাটে। কিন্তু এবার মন টিকছে না। রঞ্জুর জন্য অস্থির লাগছে। একটা খবরও দিয়ে আসতে পারে নি। এই ছেলেটা জীবনে আসার পর থেকে সবকিছুতেই তার অস্থির লাগে! এ কী ভয়ংকর অসুখ!
মিনুর মা ছালেহা রান্নাঘরে বসে তাল গোলাচ্ছেন। কলাপাতায় তালের পিঠা তৈরি হবে। তার হাতের এই পিঠা জেসমিনের অতি পছন্দের। প্রতি বর্ষায় নিয়মিত এ বাড়ি থেকে তালের পিঠা যায় তার জন্য। আর সে এ বাড়ি বেড়াতে এলে তো তালের পিঠা বানানো আবশ্যক। জেসমিন রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে ছালেহার তাল গোলা দেখছে। ঠিক সেই সময়ে আচমকা রঞ্জুর গলা শুনতে পেল। পিলে চমকে গেল জেসমিনের। রঞ্জুর মতো কণ্ঠ, ডাকছেও রঞ্জুকে। বাড়ির পাশে রাস্তা। শব্দটা রাস্তার দিক থেকেই আসছে এবং অনেকটাই দূরে। কিন্তু জেসমিন তো এই গলাটা চেনে। রঞ্জুর তো এখানে আসার কথা নয়, আসা সম্ভবও নয়। মতির মাধ্যমে খবর নিতে পারে যে সে বেড়াতে এসেছে; কিন্তু এ বাড়ির ঠিকানা তো পাওয়া সম্ভব নয়। তবে কি সে ভুল শুনেছে? ভুল শোনাটা অস্বাভাবিক নয়। হ্যাঁ, ভুলই হয়তো শুনেছে। সত্যি হলে তো ছালেহাও শুনতেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই ডাকটা আবার শুনতে পেল জেসমিন। রঞ্জু রঞ্জুকেই ডাকছে। এটা ভুল হতে পারে না। রঞ্জু এসেছে! কীভাবে এসেছে, সে জানে না, তবে রঞ্জু এসেছে। রাস্তায় যে কেউ যে কাউকে ডাকতে পারে, তাই হয়তো ব্যাপারটা আমলে নেন নি ছালেহা। তিনি তার কাজ করে যাচ্ছেন। জেসমিন অস্থির হয়ে পড়ল। যে করেই হোক, তাকে রাস্তায় যেতে হবে।
জেসমিন ঘরে ঢুকল। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে সোজা রাস্তার দিকে চলে গেল। রাস্তার কাছাকাছি গিয়ে দেখে রঞ্জু আর মানিক দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জু আশপাশে সবদিকে তাকিয়ে জেসমিনকে খুঁজছিল। তাই জেসমিন রাস্তায় উঠতেই রঞ্জু তাকে দেখে এগিয়ে গেল। জেসমিনের চোখে চোখ পড়তেই রঞ্জু হাসল। জেসমিন হাসির উত্তর দিল না। তাকে ইশারা দিয়ে বাড়ির পাশের বাঁশবাগানে যেতে বলে সে আবার বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। রঞ্জু বাঁশবাগানে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। মানিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেসমিন এল। এবার সে রঞ্জুর হাসির উত্তরটা দিল। বলল, ‘আমি যে এইহানে, হেই কতা ক্যামনে জানলা?’
রঞ্জু হেসে বলল, ‘মতি ডাকপিয়ন!’
‘কিন্তু এই বাড়ি তো মতি চেনে না। ঠিকানা কোতায় পাইছ?’
‘মানিক জোগাড় করেছে। আমি তো এদিকের কিছুই চিনি না। মানিকই নিয়ে এসেছে।’
‘সে এখন কই?’
‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।’
‘তোমার ডর লাগল না আইতে?’
‘কিসের ভয়?’
‘ভিনগাঁয়ে দেহা করতে আইয়া যদি ধরা খাও?’
‘তোমাকে দেখা এত জরুরি ছিল যে এসব মাথায়ও আসে নি।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘এই না হইলে প্রেমিক!
জেসমিন রঞ্জুকে নিয়ে মিত্তির দিঘির দিকে গেল। দিঘিতে মিনুদের দুটি ডোঙা নৌকা বাঁধা। এই ডোঙা দুটিতে করে মিনুর ভাইবোনেরা দিঘিতে মাছ ধরতে যায়, শাপলা তুলতে যায়। জেসমিন এলে তাদের সাথে সে-ও যায়। তালগাছের কাণ্ড দিয়ে এই নৌকা বানানো হয়। ডোঙা বেশ টেকসই। তালগাছের কাণ্ড সহজে পচে না বলে একটি ডোঙা বেশ কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়। তবে তালগাছের প্রস্থ কম হওয়াতে একসাথে বেশি মানুষজন ওঠা বিপজ্জনক। ডোঙায় যদি দুজন ওঠে, তবে দুজনই বইঠা বাইতে পারলে ভালো। জেসমিন রঞ্জুকে সাথে নিয়ে একটি ডোঙা ভাসাল। দুজনের হাতে দুটি বইঠা। কিছুদূর যেতেই রঞ্জু বলল, ‘তুমি আমাকে কিছু না জানিয়ে বেড়াতে এসেছ শুনে হঠাৎ করে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। অন্তত মতির কাছে একটা চিঠি দিয়ে আসতে পারতা।’
জেসমিন বইঠা বাইতে বাইতে বলছিল, ‘সুযোগ আছিল না। তালোইসাব আচুক্কা আইয়া পড়ছিল। চিডি একখান লেখছিলাম, কিন্তু মতির কাছে যাইতে পারি নাই।’
‘একটা অজানা ভয় কাজ করছিল।’
‘যেকালে তোমার ইনভার্সিটি খুইল্যা যাইবে, হেকালে কী করবা?’
‘তখন তো জেনেই ঢাকা যাব যে এত দিন দেখা হবে না। মানসিক প্রস্তুতি থাকবে।’
‘এহ্, নিজে যাওনের সময় এক্কালে ষোলো আনা। আর মাইনষের বেলায় এক আনাও না! ‘
রঞ্জু হেসে বলল, ‘আচ্ছা যাও। পুরা ষোলো আনাই তোমার।’
জেসমিনের মুখে এবার হাসি ফুটল। বলল, ‘আচ্ছা, এই দিঘির একখান কাহিনি আছে। হুনবা?’
‘বলো।’
‘এই গেরামের যত মাইনষের বিয়া লাগত, বিয়ায় খাওনের সব থালাবাসন, হাঁড়িপাতিল দিত এই মিত্তির দিঘি।
রঞ্জু কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কীভাবে?
‘কারও বিয়া লাগলে পাত্র-পাত্রীর বাপ-মা এহেনে আইয়া কইত, অমুক দিন আমার মাইয়ার বিয়া। পোলার বাপেরা কইত আমার পোলার বিয়া। আমারে কিছু থালাবাসন, হাঁড়িপাতিল দাও গো মিত্তির দিঘি। পরদিন বেইন্যাকালে দিঘির পাড়ে পিতলের থালাবাসন, হাঁড়িপাতিল পাওন যাইত। বিয়া মিট্যা গেলে থালাবাসন, হাঁড়িপাতিলগুলা আবার মাইজ্যা-ধুইয়া দিঘির পাড়ে থুইয়া দিতে হইত। দিঘি রাইতের বেলা ফেরত নিয়া নিত। একবার হইল কি, এক লোক হের মাইয়ার বিয়ার লাইগা থালাবাসন নিল। বিয়ার কাম শ্যাষ হইতেই সব আবার মাইজ্যা-ধুইয়া দিঘির পাড়ে থুইয়া গেল। কিন্তু পরদিন দেখে থালাবাসন পাড়েই রইসে। দিঘি ফেরত নেয় নাই। এমনে আরও এক দিন এক রাইত গেল। থালাবাসন পাড়েই পইড়া রইছে। লোকটা তো বেজায় দুশ্চিন্তায় পইড়া গেল। দিঘি থালাবাসন নিতাছে না, এইডা তো ভালো লক্ষণ না। সেই দিন রাইতেই লোকটা স্বপ্নে দেখল থালাবাসন সব যায় নাই। এর লাইগ্যা দিঘি ফেরত নিতাছে না। কী সর্বনাইশা কথা! মিত্তির দিঘির পিতলের জিনিস চুরি! শ্যাষম্যাশ চাচা বাড়ির বেবাকটিরে ডাইক্যা কইল, কেউ কিছু চুরি করলে রাইতে জায়গামতো রাইখা আইতে। আর নাইলে এই বংশ ধ্বংস হইয়া যাইবে। আসলে ওই ক্যাডার পোলার বউ এত সুন্দর নকশা করা পিতলের থালাবাসন দেইখা লোভে পইড়া একটা বাটি পলাইয়া রাখছিল। যা-ই হোক, পরে মহিলা ওই রাইতেই বাটিটা ফেরত রাইখা আসছিল। সেই যে সেদিন রাতে দিঘি সব থালাবাসন নিল, এরপর আর কোনো দিন কাউরে দেয় নাই। কত মানুষ চাইল, দিঘির পাড়ে আর থালাবাসন আহে না।’
রঞ্জু হেসে বলল, ‘এটা তোমার বানানো গল্প, তাই না?’
জেসমিন রেগে গেল, ‘বানাইন্যা অইবে ক্যা? তুমি এই গেরামের মিত্তির দিঘির কথা যে কাউরে জিগাও গা যাইয়া, সবাই জানে। এই জেসমিন মিছা কথা কয় না।’
রঞ্জু কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তীরের দিক থেকে একটা হুংকার শোনা গেল, ‘এই…ডোঙায় তোমরা কার পোলা? কার মাইয়া?’
সাথে সাথে আরেকজনের গলা পাওয়া গেল, ‘মাইয়ার তো চেহারা দেহা যায় না। পোলাউগ্যারে ত দেইক্কা মনে হয় না এই গেরামের।’
‘কী সর্বনাশ, জওয়ান মাইয়া-পোলা একলগে ডোঙা বায়! দ্যাশটা তো এক্কালে রসাতলে গেল।’
রঞ্জু সেদিকে তাকাল। জেসমিন একজনের গলা শুনে চিনতে পারল। এটা ইয়াসিন আলীর গলা। তারা জেসমিনের পেছন দিকে। সে আর পেছনে তাকাল না। রঞ্জুকে বলল, ‘এই, তুমি ওই দিক চাইয়ো না। শ্যাষের জন আমার তালোই। তাড়াতাড়ি ডোঙা বাও। এদিক থিকা পলাইতে অইবে। আমার চেহারা দেহান যাইবে না।’
ইয়াসিন আলীর গলা আবারও শোনা গেল। তবে আগের মতো চেঁচিয়ে না বলায় বোঝা গেল না।
রঞ্জু বলল, ‘সর্বনাশ! ওরা একটা নৌকায় উঠেছে। এদিকেই আসছে।’
‘নৌকা না ডোঙা?’
‘নৌকা।’
‘ডোঙা বাইয়া নৌকার লগে পারমু না। লাফ দাও। সাঁতরাইয়া পলাইতে অইবে।’
রঞ্জু জেসমিনের হাত ধরে দিঘিতে লাফ দিল। জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। ডুবসাঁতার দিয়ে দুজনে যে কোন দিকে গেল, ইয়াসিন আলীরা আর খুঁজে পেলেন না।
.
জেসমিন চোরের মতো পেছন দিকের রাস্তা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। লুকিয়ে ঘরে ঢুকে দ্রুত কাপড়টা পাল্টে ফেলল। এর কিছুক্ষণ বাদেই মিনু এসে বলল, ‘জেসমিন, তুমি কাইল সকালে বাড়িত চইলা যাও। আমাগো বাড়ি বইয়া ধরা খাইলে বিপদের ভাগীদার আমরাও হমু। আমি আমার বাপেরে এই বয়সে বিপদে ফালাইতে চাই না।’
মিনু জেসমিনের উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল। রাতে খাওয়াদাওয়ার সময় মিনু ইয়াসিন আলীকে বলল, ‘আব্বা, জেসমিন বাড়ি যাইতে চায়। কাইল ব্যানে (সকালে) আমনে অর যাওনের ব্যবস্থা করেন।’
ইয়াসিন আলী বিচলিত হয়ে বললেন, ‘ক্যা মা, কী অইছে? আম্মাজানের কি কোনো সমেস্যা অইতেয়াছে এহেনে?’
‘এত ভাইবেন না, আব্বা। সে বড় হইছে। যাইতে যখন চায়, যাওনের ব্যবস্থা করেন।’
জেসমিনকে কিছু বলারই সুযোগ দিল না মিনু। অবশ্য জেসমিনের বলারও কিছু নেই। যেতে পারলে বরং ভালো।
‘আচ্ছা, বেইন্যাকালে আমি লইয়া যামু।’
ইয়াসিন আলী এ কথা বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। মিনু যখন এভাবে বলছে, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
রাতেই জেসমিনের জ্বর এল। দিঘিতে অনেকক্ষণ সাঁতরানোর ফলে ঠান্ডা লেগে জ্বর। খুব বেশি জ্বর নয় যদিও। সে ব্যাপারটা কাউকেই বুঝতে দিল না। বাড়ি চলে এল। অসুস্থ অবস্থায় অনেকটা পথ নৌকা করে আসায় জ্বর বেড়ে গেল। নৌকার ঘাটে দেখা হয়ে গেল মানিকের সাথে। ইয়াসিন আলী নৌকার ভাড়া মেটানোর সময় জেসমিন মানিকের কাছে গিয়ে বলল, ‘কী মানিক ভাই, বন্ধুরে তালাক দিতে পারলেন না? ভিনগাঁয়ে গেলেন গিয়া তার প্রেমিকার কুটুমবাড়ি চিনাইতে!’
মানিক বলল, ‘তালাক ক্যান দিমু? সে আমার বন্ধু। তারে ভালো-মন্দের বুঝ দেওন দায়িত্ব ছিল, তাই দিছি। তার ভালোর লগে যেমন থাকি, মন্দের লগেও থাকি। তাই আছি। লাগলে তার লাইগা জান দিমু। কুটুমবাড়ি চিনানো তো কিছুই না।’
‘আমার ব্যাপারটাও তাই, লাগলে জান দিতে পারমু কিন্তু তারে ছাড়া থাকতে পারমু না।’
.
রাত তখন অনেক। জানালায় দুটো টোকা পড়ল। মতিকে বলা আছে জরুরি প্রয়োজনে এসে যদি জানালা বন্ধ পায়, তাহলে হালকাভাবে দুটো টোকা দেবে। তখনই জেসমিন বুঝবে মতি এসেছে। জ্বর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে কষ্ট হলো জেসমিনের। তবু সে উঠল। নিশ্চয়ই রঞ্জুর কোনো খবর হবে। জানালা খুলতেই চমকে উঠল জেসমিন। রঞ্জু দাঁড়িয়ে! ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তুমি এত রাইতে এহেনে?’
‘তোমার জ্বর খবর পেয়ে এলাম। জ্বর বাধালে কী করে? সাঁতার কেটে?’
‘মনে হয়। আইনকা পানি তো। কিন্তু তুমি খবর পাইলা ক্যামনে?’
‘তুমি খেয়াঘাটে নামতেই মানিক তোমাকে দেখছিল। তাড়াতাড়ি আসছ কেন, এই খবর নিতে গিয়ে জ্বরের খবর পেল।’
‘ও! জানো, একটা গন্ডগোল হইয়া গেছে।’
‘কী গন্ডগোল?’
‘ছোট ভাবির কাছে ধরা খাইয়া গেছি।’
‘সর্বনাশ। কীভাবে?
‘তা জানি না। ভাবির লগে এই বিষয়ে আর আলাপ করার সাহস পাইতাছিলাম না।’
‘যদি তোমার বাবাকে বলে দেয়?’
‘তা কইবে না। সে তার নিজের আব্বারেও কয় নাই।’
‘আচ্ছা।
জেসমিন আচমকাই বলে উঠল, ‘কপালে হাত দিয়া জ্বর দেখতে মনে চায়, এইটা মুখে কইতে ডরাও? ক্যামন পুরুষ তুমি?’
রঞ্জু হেসে বলল, ‘তুমি কীভাবে মন পড়তে পারো, জেসমিন?’
‘মন পড়তে হইলে চক্ষু লাগে। আর হেইডা আমার আছে।’
জেসমিন জানালার একদম কাছে চলে গেল। রঞ্জু কপালে হাত রাখল। জেসমিন কেঁপে উঠল। মনে হলো বরফের হাত বসেছে তার কপালে। এই হাত তার প্রিয় মানুষের হাত! সে চোখটা বন্ধ করে প্রার্থনা করে নিল, এই হাত যেন আজন্মকাল তার কপাল ছোঁয়ার অধিকার পায়।
চাঁদশী গ্রামে আজ হাটবার। মোকসেদ হাটে যাচ্ছেন। হালিমা টাকা দিতেই তিনি বললেন, ‘ও বউ, এত অল্প টাহা দিলা। এই টাহায় কতডু সদায় অইবে? ফর্দ তো ম্যালা লম্বা। সদায়পাতির দাম জানো?’
হালিমা বললেন, ‘অত কিছু মোর জানা লাগবে না। যে পয়সা দিছি, হেইয়াইদ্যা যা পারেন আনেন, নাইলে আব্বাসের ধারে চান। মামুন টাহাপয়সা পাডাইন্যা দেছেইত্যা আব্বাস টাহা দেওয়া বন্দ করছে। এ রহোম করলে এতগুলা মাইনষের সংসার ক্যামনে চালামু?’
মোকসেদ অবাক হয়ে বললেন, ‘আব্বাসের হাতে তো এহন বড় কোনো কাম নাই। ছোডখাডো কাম কইর্যা যে টাহা পায়, হ্যাতো রেনুর চিকিসসায় লাগে। দেবে কোতাইদ্দা? আবার বড় কাম পাইলে দেবেয়ানে। তয় মামুন তো ম্যালা টাহা পাড়ায়। হেইয়া দিয়া তো ভালো কইর্যা মাস পার অইয়া যাওয়ার কতা।’
হালিমা খেপে গেলেন, ‘কী কইতে চান আমনে? মুই কি মামুনের টাহাপয়সা সব গিল্লা খাইছি? সব তো সংসারেই খরচ অইছে। সদায়ডা করা ছাড়া কোনো খবর রাহেন সংসারের? সামনের মাসেইত্যা মামুনের সব পয়সা আমনে রাইখা সংসারডা চালাইয়া দেইখেন আমি ক্যামনে এত কিছু সামলাই।’
‘আহ রাগ অও ক্যা? একটা কতা কওন যায় না, ছ্যাত কইর্যা ওডে।’
মোকসেদ হাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লে হালিমা দরজায় খিল দিয়ে জমানো টাকাগুলো বের করে গুনলেন। তিনি জানেন কত টাকা আছে, তারপরও ঘরে একা থাকলেই টাকাগুলো বের করে গুনে একটা তৃপ্তি নিশ্বাস ফেলেন। কী যে শান্তি লাগে! মামুন টাকা পাঠানো শুরু করার পর থেকে তিনি নিয়মিত সেই টাকা থেকে কিছু টাকা সরিয়ে রাখেন। তার একটা কানপাশার বড় শখ। আর কিছু টাকা জমলেই একটা কানপাশা বানাবেন। তারপর আবার টাকা জমাবেন। সেই টাকায় নিজের ঘরের মেঝেটা পাকা করবেন। তার একটা পাকা ঘরের স্বপ্ন বহুদিনের।
এত দিন হয়ে গেল, এখনো মুকুল মিনার সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকে না। মাঝে মাঝে মিনা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে উঠে বেরিয়ে যায়। রাতেও ফেরে অনেক দেরি করে, ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে কাদা। একদিনও জেগে থাকতে পারে না। সারা দিন বাড়ির এত কাজ করতে হয় যে রাত জেগে থাকা আর শরীরে কুলায় না। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে, নিজেও টের পায় না। কোথায় যে থাকে সারা দিন! ফয়েজের থেকে জেনেছে, মুকুল হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছে।
অনেক দিন বাদে আজ দুপুরবেলা মুকুল বাড়ি এসেছে। খাওয়াদাওয়া করে একটু শুয়েছে। কে জানে শরীরটা খারাপ করল কি না! সে যে একটু ঘরে গিয়ে খোঁজ নেবে, সেই সুযোগ নেই। হালিমা বিবি রাজ্যের কাজ দিয়ে রেখেছেন। এগুলো কখন যে শেষ হবে! এসব ফেলে রেখে ঘরে গেলে কপালে দুর্ভোগ আছে।
কাজগুলো সেরে ঘরে যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। ঘরে ঢুকে দেখে মুকুল মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। মিনা কপালে হাত রেখে বলল, ‘তোমার শরীলডা কি খারাপ?’
মুকুল বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, ‘না।’
‘হেলে অবেলায় ঘুমাইলা যে?’
মিনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মুকুল শান্ত গলায় জানতে চাইল, ‘ঘুমাইন্যা কি মানা?”
‘না না। তা কই নাই।’
মুকুল শার্ট গায়ে দিচ্ছে দেখে মিনা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আবার কই যাও?’
‘কাম আছে।’
‘আরেকটু থাহো। কামকাইজ শ্যাষ কইরা হপায় আইলাম আর এহনই তুমি যাও। আবার তো আবা বেইন্যারাইতে।’
মুকুল শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, ‘কামকাইজ শ্যাষ করছ, এখন জিরাও।’
মিনা মুকুলের হাত দুটো চেপে ধরে বলল, ‘মোরে কি মাফ করোন যায় না? আম্মায় উঠতে-বইতে খোড়া দিত তোমার আয় নাই দেইখা। মোর মাতাডা ঠিক আছিল না।’
‘এরপর মাথা খারাপ অইলে কি মধুরে মাইরা ফালাবা?’ আঁতকে উঠল মিনা, ‘এইডা তুমি কী কইলা?’
মুকুল নির্বিকার গলায় বলল, ‘একই তো। মধুও আমাগো বাচ্চা, যারে মারছ, হেও আমাগোই বাচ্চা।’
মিনা কাঁদতে শুরু করল। মধুকে নিয়ে বলা কথাটি সে নিতে পারে নি মুকুলের সাথে তৈরি হওয়া এই দূরত্বটাও কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। যেকোনো মূল্যে সে সবকিছু মিটিয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
মিনা এবার মুকুলের পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে এইবারের মতো আমারে মাফ কইরা দেও। আর রাগ হইয়া থাইকো না। আর সইতে পারতেয়াছি না।’
মুকুল মিনাকে দুহাতে ধরে ওঠাল।
দুঃখী গলায় বলল, ‘কাইন্দ না, রাগ হইছিল। এহন আর নাই। গ্যাছেগা ম্যালা আগেই। তয় কষ্টডা রইয়া গেছে। কথাডা আর তুইল্য না। ভুইল্যা যাইতে চাই।’
মুকুল বেরিয়ে গেল। মিনা দরজার কপাটে মাথা ঠেকিয়ে মুকুলের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগল।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলেছে। রঞ্জুকে উঠোনে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। উঠোনভর্তি লোকজন। সালিস বসবে একটু পরই। শুধু চেয়ারম্যান সাহেবের অপেক্ষা। গ্রামের অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এসে পড়েছেন। মাঝরাতে রঞ্জুকে জেসমিনের জানালার সামনে থেকে ধরে আনা হয়েছে, সারা রাত সে এই গাছের সাথেই বাঁধা। প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর সে, শরীরের সব শক্তি যেন শেষ।
মানিক টের পেয়েছে দুপুরে। কিন্তু রঞ্জু সবার চোখের সামনেই। পাহারাও দেওয়া হচ্ছে, ধারেকাছেও যেতে পারে নি সে। তাই সে এখন রঞ্জুর বাবার কাছে যাচ্ছে খবর দিতে। চেয়ারম্যানের ভয়ংকর কোনো শাস্তির হাত থেকে হয়তো একমাত্র উনিই বাঁচাতে পারবেন রঞ্জুকে।
যেহেতু রাতে ধরা পড়েছে, সেহেতু সালিস সকালেও হতে পারত। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব নাকি আজকে কঠিন ব্যস্ত। মেয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কি কিছু থাকতে পারে? মানিক ভালোভাবেই জানে, ব্যস্ততা আসলে কিছুই না। অপরাধীকে যাতে সালিস হবার আগেই অভুক্ত অবস্থায় বেশিক্ষণ বেঁধে রেখে কষ্ট দেওয়া যায়, তাই এই ব্যস্ততার নাটক। এই নাটক শুধু সে নয়, গ্রামের অনেকেই বোঝে কিন্তু কিছু করার নেই। বড় বড় মানুষের বড় বড় ব্যাপার। গরিবের না আছে কিছু বলার ক্ষমতা, না আছে কিছু করার ক্ষমতা। গরিব সর্বক্ষেত্রেই অক্ষম!
রঞ্জু ধরা খাওয়ার পর থেকে জেসমিনকে ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে। জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করেছে। ঘরের ভেতর থেকেই বারবার রঞ্জুকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করেছে সে। কেউ তেমন একটা গায়ে মাখে নি। তবে কোহিনুর বানু একবার এলেন। জানালা খুলে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘বেশি চিল্লাইলে গরম শিক আইন্যা গলায় ঢুকাইয়া দিমু।’
জেসমিন ফুঁসে উঠল, ‘দেও। আমারে মাইরা হালাও, তবু রঞ্জুরে ছাইড়া দিতে কও, মা। আল্লাহর দোহাই লাগে।’
‘পোড়াকপালি! পিরিত মারানির আগে মনে আছিল না কী অইতে পারে? তোর আহ্লাদীর ঠেলায় জওয়ান পোলাডার জীবন দিতে অইবে এহন।’
জেসমিন পা দাপিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মাফ কইরা দেও, মা গো, মাফ কইরা দেও।’
‘আমার বাপে আইলেও তোর বাপেরে আইজগো আটকাইতে পারবে না লো সর্বনাশী ছেরি। যে সর্বনাশ তুই করছস, হেইয়া এহন চক্ষু মেইল্যা দ্যাকতে অইবে।’
জয়নাল মির্জা সালিসে যাওয়ার আগে জেসমিনের ঘরে ঢুকলেন। জেসমিন বিছানায় বসে ছিল। বাবাকে দেখে নেমে এল। তবে বাবাকে সে ভীষণ ভয় পায়। তার মুখের ওপর কোনো দিন কথা বলে নি। জয়নাল মির্জা বললেন, ‘কী বলি মনোযোগ দিয়ে শোনো। সালিসে তোমারে ডাকা অইবে। ছেলে যা-ই বলুক, তুমি বলবা এই ছেলে তোমারে পছন্দ করে, তবে তুমি কখনোই তার ডাকে সাড়া দাও নাই। এই কথার যেন নড়চড় না হয়, জেসমিন। তার জীবনে সর্বনাশ ডাইকা আনবা না আশা করি।’
জেসমিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
সালিস শুরু হবার আগেই রঞ্জুর বাবা এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে জয়নাল মির্জার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। কারণ, রঞ্জুর বাবা হারুন ব্যাপারী। এই ছেলে যে হারুন ব্যাপারীর, সেটা যদি তিনি আগে জানতেন, তবে খেলার চাল ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। ঘুণাক্ষরেও সালিস ডাকতেন না। এই ছেলেকে তুরুপের তাস বানিয়ে জমির ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে পারতেন।
তিনি সব সময় ভেবেচিন্তে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেন। সেই হিসেবে তার প্রথমে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল ছেলেটির বাবা কে? কিন্তু এই ক্ষেত্রে নিজের মেয়ের প্রণয়ের সম্পর্ক ধরা পড়ায় তার মাথা আউলে গিয়েছিল। ছেলেটিকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। সেই জন্যই সালিস ডেকে বসলেন।
.
কেশবপুরের সকল সালিসে সাধারণত চেয়ারম্যান জয়নাল মির্জা, মেম্বার কাশেম মোল্লা, কেশবপুর বাজারের একমাত্র ডাক্তার প্রণব সাহা, কেশবপুর হাইস্কুলের হেডমাস্টার নাসেরউদ্দিনসহ গ্রামের প্রভাবশালী অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও আসেন। সকলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আজ ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। যেহেতু ভিকটিম চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যা, সেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর। সকলেই এসেছেন। যে ছেলে চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যাকে রাতবিরাতে উত্ত্যক্ত করতে পারে, অবশ্যই সেই ছেলের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
প্রথমেই জেসমিনকে ডাকা হলো। সে যেহেতু ভিকটিম, তার কথাই আগে শুনতে হবে। জেসমিনের গায়ে জ্বর, শরীর কাঁপছে। তাকে ধরে আনলেন কোহিনুর বানু। রঞ্জু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সালিস শুরুর আগে অবশ্য তার বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবের পুত্রদ্বয়ও পাশেই দাঁড়ানো। হারুন ব্যাপারী অন্য গ্রামের হলেও প্রভাবশালী এবং সম্মানীয় লোক। তাই অপরাধীর বাবা হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিচারকারীদের সাথেই বসতে দেওয়া হয়েছে। তিনি কোনো কথা বলছেন না, চুপচাপ দেখছেন। খবর পেয়ে এখানে আসতে আসতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিকল্পনা করে ফেলেছেন তিনি, তবে তার আগে জেসমিনের বক্তব্য শোনা দরকার। জেসমিন এবং রঞ্জুর বক্তব্যের ওপর নির্ভর করছে তার পরিকল্পনা কাজে লাগানো যাবে নাকি যাবে না।
সকল সালিস চেয়ারম্যান সাহেবই শুরু করেন, তবে এই সালিস শুরু করার দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন মেম্বার সাহেবকে। প্রয়োজনে তিনি তার বক্তব্য পেশ করবেন। মেম্বার সাহেব জেসমিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো মা, এই ছেলে কবে থেইক্যা তোমারে উত্ত্যক্ত করে?’
জেসমিন কিছু বলার আগেই কেশবপুর হাইস্কুলের হেডমাস্টার বললেন, ‘আগে গতকাল রাইতের ঘটনাটা জেনে নিলে ভালো হয় না?’
আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিল না জেসমিন। সে দৃঢ় গলায় বলল, ‘সে আমারে উত্ত্যক্ত করে নাই। আমি তারে ভালোবাসি, সে-ও আমারে ভালোবাসে। আমার জ্বর হইছে, সেই খবর পাইয়া সে আমারে দেখতে আসছিল। আমি ঘরে, সে বাইরে। জানালা দিয়া কথা কইতাছিলাম আমরা। তখনই বড় ভাইজান দেইখ্যা ফালায়। তারে ধইরা নিয়া বাইন্ধা রাখে। সে যদি অপরাধ করে, তাইলে আমিও অপরাধ করছি।’
সালিসের বিচারকারী সকলেই জেসমিনের কথা শুনে নিজেরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ মনে হতে লাগল রঞ্জুর। সে জানত জেসমিন সাহসী। তাই বলে যে একগ্রাম লোকের সামনে, নিজের বাবা ভাইদের সামনে, ভালোবাসার কথা বলার মতো সাহস রাখে, সেটা সে কল্পনাও করে নি। জয়নাল মির্জা রক্তবর্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু জেসমিন তার দিকে তাকাচ্ছে না। সে শুধু একবার রঞ্জুর দিকে তাকিয়েছিল। তার পর থেকেই মাথা নিচু করে আছে। মানুষটার ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত-অসহায় মুখটা দেখে নিজেকে অপরাধী লাগছে।
প্রণব সাহা বললেন, ‘রঞ্জু, তোমার কী বক্তব্য?’
রঞ্জু বলল, ‘আমি জেসমিনকে ভালোবাসি। সে আমাকে ভালোবাসে কি না, সেটা তার নিজের মুখেই আপনারা শুনেছেন। আমি শুধু ওকে ভালোই বাসি না, সম্মানও করি। তাই আমি চাই না ওর সম্মান নষ্ট হোক। আমি ঢাকা শহরে জন্মেছি, সেখানেই বড় হয়েছি। আমার বাবা গ্রামে স্থায়ী হলেও আমার সেভাবে গ্রামে থাকা হয়ে ওঠে নি। পড়াশোনার জন্য আমি ঢাকাতেই থাকি 1 তাই গ্রামের নিয়মকানুন সেভাবে জানি না। যদি কোনো অন্যায় করে থাকি, তাহলে আমাকে শাস্তি দেবেন। তবে আমার অনুরোধ, জেসমিনকে যেন অসম্মানিত করা না হয়।’
রঞ্জুর কথা শেষ হতেই হারুন ব্যাপারী বললেন, ‘আপনারা অনুমতি দিলে আমি কিছু কথা বলতে চাই।’
সবার আগে জয়নাল মির্জা বললেন, ‘বলেন জনাব, আপনার ছেলে অপরাধ করছে, আপনার তো বলতেই হবে।’
হারুন ব্যাপারী অপমান গায়ে মাখলেন না। হেসে বললেন, ‘প্ৰেম- ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে আমার পুত্র যেমন অপরাধ করেছে, চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যাও অপরাধ করেছে। তবে তাদের বয়স কম, আবেগ বেশি। তারপরও যখন এত মানুষের সামনে তারা উভয়েই ভয়, লজ্জা, সম্মানের তোয়াক্কা না করে তাদের ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছে, তখন আপনারা বুঝতেই পারছেন তারা একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। এবং তার চেয়েও বেশি আমি আমার ছেলেকে ভালোবাসি। আমি মনে করি, এর একটা সুন্দর সমাপ্তি হতে পারে। চেয়ারম্যান সাহেব এবং উপস্থিত সকলের কাছে আমি রঞ্জুর ও জেসমিনের বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনারা সকলে রাজি থাকলে শুভদিন দেখে আমরা দুজনের বিয়ে সম্পন্ন করতে পারি। এতে ওরা দুজন সুখী হবে এবং সকলের সম্মান বজায় থাকবে।’
প্রস্তাব শুনে জয়নাল মির্জার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। প্রণব সাহা বললেন, ‘অতি উত্তম প্রস্তাব। ছেলের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিলে এরপর তো আর কথাই থাকে না। মিয়ারা কী বলেন?’
একে একে দেখা গেল সকলেই হারুন ব্যাপারীর প্রস্তাবে একমত। শুধু জয়নাল মির্জা চুপ করে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, “আমার একটু ভাবতে অইবে। জেসমিন আমার একমাত্র মাইয়া। তার ব্যাপারে এত জলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে মুশকিল।’
কাশেম মোল্লা বললেন, ‘চেয়ারম্যান সাব, সালিসের সিদ্ধান্ত সালিসেই নেওয়া ভালো। নাইলে পরে লোকে নানান কথা কইবে। বিগত দিনে এই ধরনের মামলায় তো দেখছেন, ব্যাপারগুলা পরে কেমন হয়।’
নাসেরউদ্দিন বললেন, ‘হ্যাঁ, নুরুর মাইয়ার বেলাতেও তো এমন হইছিল। বিয়ার তারিখ কয় দিন পরে দেওয়াতেই ত লোকে বিয়ার আগপর্যন্ত নানান রকম কথা হুনাইছে।’
প্রণব সাহা বললেন, ‘আমার মতে, বিয়ে হলে আজকে হয়ে যাওয়াই ভালো।’
কাশেম মোল্লা হারুন ব্যাপারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আইজ বিয়ে পড়াইলে আপনার কোনো আপত্তি আছে?’
হারুন ব্যাপারী বললেন, ‘আমার কোনো আপত্তি নাই। আমি আমার ছেলের জন্য যেকোনো মুহূর্তেই প্রস্তুত। আপনারা বললে আমি আজকেই বিয়ের ব্যবস্থা করব।’
জয়নাল মির্জা বললেন, ‘বিয়ার ব্যবস্থা পোলার বাপ করে না, মিয়া। করে মাইয়ার বাপ। জালাল, হুজুররে খবর দাও। আইজকেই ওগো বিয়া পড়ানো অইবে।’
জালাল কাছে এসে বলল, ‘আব্বা, আপনের মাথা কি ঠিক আছে?’ জয়নাল মির্জা চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘আমার চেয়ে বেশি বুঝার চেষ্টা করবা আমি মরণের পরে। যা বলা হইছে, তাই করো গিয়া।’
বাদ মাগরিব রঞ্জু ও জেসমিনের বিয়ে সম্পন্ন হলো। যাকে সারা দিন অভুক্ত অবস্থায় গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল, তাকেই এখন জামাই আদর করে খাওয়ানো হচ্ছে। রঞ্জু অবশ্য খেতে পারছে না। বমি এসে পড়ছে তার। মাথা ঘোরাচ্ছে। কোনোমতে হাত নাড়াচাড়া করছে। সময়টা পেরিয়ে গেলে সে বাঁচে। গায়ে এক ফোঁটা শক্তি নেই। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে স্থির থাকার। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাতে পারে।
জেসমিনকে এখনই শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবে না, রঞ্জুকেও এ বাড়িতে রাখা হবে না। আগে আনুষ্ঠানিক বিয়ে সম্পন্ন হবে, এরপর দুজনের বাসর হবে। আনুষ্ঠানিক বিয়ের তারিখ দেওয়া হলো সপ্তাহখানেক বাদে। তখনই জেসমিনকে উঠিয়ে নেওয়া হবে। তাই রঞ্জু চলে যাওয়ার আগে জেসমিনের ঘরে তাদের দুজনকে কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতে দেওয়া হলো। এর পেছনে অবশ্য জেসমিনের বড় ভাবি আসমার অবদান সবচেয়ে বেশি। সে-ই প্রথম বলেছে, নববিবাহিত দম্পতিকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও কথা বলতে দেওয়া উচিত। তার ওপর যে ঝড় আজ সারা দিন দুজনের ওপর দিয়ে গেছে, তাতে এটা না হলেই নয়।
রঞ্জু ঘরে ঢুকতেই জেসমিন মাথা নিচু করে অপরাধীর গলায় বলল, ‘আমারে মাফ কইরা দেও।’
রঞ্জু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ‘কেন? তুমি কী করেছ?” ‘আমার পাগলামির কারণেই কাইল ধরা খাইছি। তুমি চইল্যা যাইতে চাইছিলা, আমি বারবার তোমারে আটকাইতেয়াছিলাম।’
রঞ্জু মৃদু হেসে জেসমিনের হাত দুটি নিজের দুহাতে ধরে বলল, ‘ভাগ্যিস আটকেছিলে। না হলে এত তাড়াতাড়ি তোমাকে পেতাম কীভাবে?’
জেসমিন মুখ তুলে তাকাল। তারপর অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল, ‘কিন্তু তোমারে রাইতভর বাইন্ধা রাখল। বড় ভাইজান তোমার গায়েও হাত তুলল। কত বড় অপমান!’
‘মাঝরাতে দেখা করতে এসে প্রেমিকার বাপ-ভাইয়ের কাছে ধরা পড়লে এর চেয়ে ভয়ংকর কিছুও হতে পারত। যা হয়েছে, তা অপমান হিসেবে না দেখে শাস্তি হিসেবে দেখো।’
জেসমিনের চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। রঞ্জু তা যত্ন করে মুছে দিয়ে বলল, ‘কাল থেকে অনেক কেঁদেছ। এই সুন্দর চোখে আর যেন জল না দেখি। তোমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, জেসমিন। মাথায় পানি ঢালতে হবে। দাঁড়াও, আসমা ভাবিকে ডাকি।’
রঞ্জু দরজার দিকে যাচ্ছিল। জেসমিন একটা হাত ধরে তাকে থামাল।
‘না, খাড়াও, ভাবিরে বোলাইও না।’
‘কেন? ভাবিকে না ডাকলে পানি পাব কোথায়?’
জেসমিন রঞ্জুর হাতখানা ধরে নিজের কপালে রেখে বলল, ‘তোমার ঠান্ডা হাতখান আমার কপালে রাহো, এমনেই জ্বর সাইরা যাইবে। এত দিন বাপ- ভাইয়েগো ডরে কত কষ্ট কইরা পলাইয়া তোমার কাছে গেছি। আর এহন তারাই তোমারে আমার কাছে পাড়াইছে। আইজ আর কোনো ডর নাই। ভাবিরে ডাইকা এই সময়টারে এমনে নষ্ট করতে চাও?’
.
সপ্তাহখানেক বাদেই অনুষ্ঠান করে জেসমিনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠালেন জয়নাল মির্জা। এ রকম কোনো সুযোগ আসবে, জয়নাল মির্জা তা কল্পনাও করেন নি। হারুন ব্যাপারী বুদ্ধিমান লোক হলেও ছেলের প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ। না হলে কেউ এমন প্রস্তাব দেয়! সালিসে তার ছেলের কী-বা শাস্তি হতো! এইটুকু তিনি মেনে নিতে পারলেন না! শত্রুর সাথে আত্মীয়তা বড় কঠিন জিনিস। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তিনি এই কঠিন পথ বেছে নিলেন। অবশ্য একমাত্র ছেলের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা থাকা অস্বাভাবিক নয়।
তবে এই আত্মীয়তা হলে হারুন ব্যাপারী ছাড় দিতে বাধ্য। এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চান নি জয়নাল মির্জা। এককথাতেই রাজি হলে সেটা অনেকের চোখে পড়ত, তাই তিনি প্রথমে ভেবে দেখার কথা বলেছিলেন। একটু তো গাঁইগুঁই করতেই হয়।
জেসমিন শ্বশুরবাড়ি যেতেই বউ দেখার ঢল নামল রঞ্জুদের বাড়িতে। সূর্যমণি গ্রামের কোনো বাড়ির মহিলা বাদ রইল না। গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলে রঞ্জু এবং সে-ই একমাত্র, যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তার বউখানা কেমন হলো, তা না দেখলে গ্রামবাসীর চলবে কীভাবে! জেসমিনের শাশুড়ি রোকেয়া বেগম তাদের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুতুলের মতো একটা বউ আসাতে তিনি ভীষণ আনন্দিত।
.
সন্ধ্যার পর থেকেই প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বইতে লাগল। দূর আকাশ থেকে ভেসে আসতে লাগল মেঘমালা। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বারান্দার কপাট বারবার বাড়ি খাচ্ছে। রঞ্জু বারান্দার দরজা আটকাতে গেলে জেসমিন বলে, ‘আমারে কামিনী ফুলের গাছটা দেখাইলা না যে?’
‘এত মানুষ ছিল এতক্ষণ, কীভাবে দেখাব বলো? কাল দেখো। ‘
‘আমি এহনই দেখমু
রঞ্জু অবাক হয়ে বলল, ‘বলে কী মেয়ে! ঝড় শুরু হয়েছে দেখো না? বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।’
‘তাতে আমার কী? আমি দেখমু।’
জেসমিন এগিয়ে গেল দরজার কাছে। রঞ্জু তার দুই বাহু ধরে আটকাল।
বলল, ‘পাগলামি করে না। কাল সকালে দেখো। এখন দরজা-জানালা সব আটকে দেওয়া উচিত। ঝড় শুরু হয়ে গেছে।’
জেসমিন একটু অভিমান করে বলল, ‘হুম, আমারে দেহাবা ক্যা? কার লাইগা জানি গাছখান লাগাইছ, হেরেই দেহাইয়ো। আমি কেডা!
ফিরে এসে বিছানার ওপর বসল সে। রঞ্জু দরজা লাগিয়ে এসে তার পাশে বসে বলল :
তুমি আমার একলা আকাশ
দখিন দ্বারের বাউলা বাতাস
কদম ফুলের ঘ্রাণ,
তুমি আমার জলজোছনা
অন্ধকারের গান।
কবিতা শুনে জেসমিনের অভিমান নিমেষেই উধাও। সে বলল, ‘এই কবিতাডা আমারে চিডিতে দেও নাই তো?’
‘এটা তো এইমাত্রই বানালাম।’
‘কিন্তু অন্ধকারের আবার গান ক্যামনে হয়?’
‘অন্ধকারের গান অনেক রকম হয়। মনখারাপের হয়, খুশির হয়।’
‘আমি তোমার কেমন অন্ধকারের গান? মনখারাপের, নাকি খুশির?’
বিছানার পাশেই হারিকেন। রঞ্জু সেটা নিভিয়ে কাছে এসে বলল, ‘চলো দেখাই তুমি আমার কেমন অন্ধকারের গান।’
ছোটবেলা থেকেই জেসমিন কিছুটা অলস। কোহিনুর বানু বকাবকি করে তাকে দিয়ে সব কাজই শিখিয়েছেন, কিন্তু নিয়মিত করাতে পারেন নি। যখন থেকে ভাবিরা এসেছে, তখন থেকে তো সে রান্নাঘরের মাটিও মাড়ায় নি। কোহিনুর বানু বলতেন, ঘোরা দেখে খোঁড়া হয়েছে মেয়ে! সেই মেয়েকে কিনা শ্বশুরবাড়ি এসে এখন মসলা বাটতে হচ্ছে! রাতে বাড়িতে কুটুম আসবে। তাই বাহারি রান্নার আয়োজন হচ্ছে। সকালের নাশতার পরই কতগুলো করে আদা, রসুন, জিরা, ধনিয়া, হলুদ ও মরিচ বাটতে দিয়েছে শাশুড়ি। জেসমিন যখন এসব বাটছে, তখন রান্নাঘরে এল রঞ্জু। জেসমিনের পাশে বসে বলল, ‘তোমার কষ্ট হচ্ছে, ফুল?’
‘সব কামেই কষ্ট আছে। তয় শাশুড়ি যখন কাম দিছে, করতে তো অইবেই। মায় দিলে না কইরা পারা যায়।
‘ইশ্, আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্টটা! আমাদের বাড়িতে এসব করার কত লোক আছে। মা তোমাকে কেন দিল?’
‘তোমাগো বাড়িতে কেউ নাই। হেরা পাশের বাড়িত্যা আহে কাম করতে। আইজ আইতে পারবে না কেউ। এল্লিগা আমারে দিছে।
‘আমার পড়া শেষ হলে যখন চাকরি করব, তখন তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাব। তখন আর তোমার এত কষ্ট করা লাগবে না।’
‘ঢাকায় গেলে বুঝি এই সব করা লাগবে না? আরও বেশি করা লাগবে। সবই একলার করা লাগবে হেকালে।
‘যেসব রান্না করতে মসলা বাটা লাগে, তার কোনোটাই আমরা খাব না।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘বাড়া মসল্লা ছাড়া কোনো রান্নাই হয় না। এত কষ্ট বুঝলে বাইট্যা দাও।’
‘আচ্ছা, বেটেই দেই বরং। তুমি দরজায় পাহারা দাও। মা যদি দেখে তোমাকে মসলা বেটে দিচ্ছি, তুফান নামাবে।
জেসমিন ফিক করে হেসে বলল, ‘মায় এহন আইবে না। তবু পাহারা দেই। নাইলে যদি দেইখ্যা হালায়, আমারে দজ্জাল বউ কইবে।
রঞ্জু হেসে দিল। জেসমিন আবার বলল, ‘মরিচ বাড়া লাগবে না। হাত জ্বলবে। আমি পরে বাডমু। তুমি অন্যগুলান বাডো যেদ্দুর পারো।’
‘তোমার হাত জ্বলবে না?’
‘আমি তো আগেও বাড়ছি। টেকনিক জানি ক্যামনে হাত না লাগাইয়া বাড়তে অয়। আর জ্বললেও সহ্য করতে পারমু। তুমি পারবা না।’
জেসমিন উঠে গেল। পাশে বসে দরজায় পাহারা দিল। রঞ্জু সত্যিই সত্যিই মসলা বাটতে শুরু করে দিল।
জেসমিন-রঞ্জুর বিয়ের পর দুই-তিন মাস সময় নিলেন হারুন ব্যাপারী। তত দিনে রঞ্জুর ইউনিভার্সিটি খুলে গেছে। সে ঢাকা যাবে, যাওয়ার আগে জেসমিন তার বাপের বাড়িতে নাইয়র যাবে। রঞ্জুই দিয়ে আসতে চেয়েছিল, যাতে রঞ্জু চলে গেলে তার একা না লাগে। কিন্তু জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করল। সে জানাল, রঞ্জু যতক্ষণ আছে, সে ততক্ষণ কোথাও যাবে না। রঞ্জু ঢাকা যাওয়ার পর সে শ্বশুরের সাথে বাপের বাড়ি যাবে।
রঞ্জু চলে যাওয়ার পর হারুন ব্যাপারী জেসমিনকে নিয়ে কেশবপুরে গেলেন। জেসমিনকে দেখামাত্র তার ভাবিরা খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল, “আমাগো নাইয়রি আইছে!’
.
হারুন ব্যাপারীর আতিথেয়তার জন্য বিরাট আয়োজন করা হলো। খাওয়াদাওয়ার পর তারা যখন বাহির বারান্দায় পান নিয়ে বসলেন, তখন হারুন ব্যাপারী কথাটা তুললেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব, কালিশুরির জমিটার কী করবেন? কতগুলা নগদ টাকা দিয়া জমি কিনেছিলাম! আপনি বিচক্ষণ মানুষ, এখন আবার পরম আত্মীয়। আশা করি আপনি ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।’
মুহূর্তের মধ্যেই টনক নড়ল জয়নাল মির্জার। এবার তিনি বুঝতে পারলেন তিনি যে চিন্তা করে জেসমিন-রঞ্জুর বিয়েতে খুশি হয়েছিলেন, ঠিক একই চিন্তা করে হারুন ব্যাপারীও বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে তিনি হারুন ব্যাপারীর ফাঁদে পড়েছেন। ইচ্ছা করেই কি তিনি জেসমিনের পেছনে তার ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন? জয়নাল মির্জার মেজাজ তখন সপ্তম আসমানে। তিনি বললেন, ‘ব্যাপারী কি এই কারণেই ছেলে বিয়ে করাইয়া আত্মীয়তা করছেন?’
হারুন ব্যাপারী হেসে বললেন, ‘কী যে বলেন, চেয়ারম্যান সাহেব! ছেলে- মেয়ের ভালোবাসার মর্যাদা দেওয়ার জন্যই তো এই বিয়ে। ছেলে-মেয়ের ভালোবাসা আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যার সাথে জড়ানোর কথা চিন্তাও করতে পারি না।’
‘চিন্তা কইরেনও না। ভুলেও না। ছেলে-মেয়েরে আমরা তাদের জায়গায় রাখি আর নিজেগো নিজের জায়গায়। এতেই তারা এবং আমরা ভালো থাকমু। এই সব জমিজিরাতের ভেজালে তাগোরে আইন্যা তাগোর বিপদ ডাকনের দরকার কী?
চেয়ারম্যানের সূক্ষ্ম হুমকি সাথে করে বাড়ি ফিরলেন হারুন ব্যাপারী। তিনি আজ এটা বুঝে গেলেন যে জেসমিন-রঞ্জুর বিয়ে তার একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি যেই চিন্তা করে এই বিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা সম্ভব নয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন