মৌরি মরিয়ম
পটুয়াখালী জেলার কেশবপুর গ্রামের সর্বদক্ষিণে মির্জাবাড়ি। বাড়ির মালিক জয়নাল মির্জা উক্ত এলাকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। প্রভাবশালী লোক। লোকে তাকে সম্মান করে, মেনে চলে, ভয়ও পায়। তার জনপ্রিয়তার কারণ, তিনি অত্র এলাকার উন্নয়নের জন্য যে সকল কাজ করেছেন, তা বিগত বছরগুলোতে কোনো চেয়ারম্যান করে যেতে পারেন নি। এ ছাড়া তিনি দিলদরিয়া মানুষ। লোকমুখে প্রচলিত আছে, জয়নাল মির্জার কাছে সাহায্যের হাত পেতে কেউ কোনো দিন ফিরে যায় নি। তা যে সাহায্যই হোক না কেন।
জয়নাল মির্জার বিভিন্ন রকম ফসলের খেত আছে। সেসব ফসল বিক্রি বাবদ তার ভালো রকম আয় হয়। স্ত্রী কোহিনুর বানু, একমাত্র কন্যা জেসমিন, দুই পুত্র জালাল ও জব্বার এবং দুই পুত্রবধূ আসমা ও মিনুকে নিয়ে তার সংসার।
আষাঢ় মাস, ১৯৭৪ সাল। আজ সন্ধ্যার পর জয়নাল মির্জার কাছারিঘরে আসর বসেছে। এ ধরনের আসর প্রায়ই বসে। এই আসরে কোনো দিন চলে কলের গান, কোনো দিন চলে রেডিও। আজ রেডিওতে ‘মধুমালা মদন কুমার’ নাটক সম্প্রচারিত হবে, তাই লোকজনের আনাগোনা বেশি। কাছারিঘরে সকলের জায়গা হচ্ছে না। গাদাগাদি করে বসার পরও অনেক লোক সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সারা দিন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ায় উঠানজুড়ে প্যাঁচপ্যাচে কাদা, না হলে উঠানেও লোকজনের বসার ব্যবস্থা করা হতো।
এ নাটক যে আগে কেউ শোনে নি, ব্যাপারখানা তা নয়। রেডিওতে একই নাটক বারবার সম্প্রচারিত হয়। একাধিকবার শোনার পরও নাটক শোনার ব্যাপারে গ্রামবাসীর আগ্রহের শেষ নেই। এ ছাড়া যেদিন ভানুর কৌতুক শোনায়, সেদিনও বেশ ভিড় হয়।
লম্বা কাছারিঘরের এক দিকে একটা চৌকি পাতা। কোনো বহিরাগত অতিথি এলে এখানেই ঠাঁই হয়। ঘরের অন্য দিকে দুই পাশে লম্বা লম্বা দুটো বেঞ্চ পাতা। গ্রামের গণ্যমান্য লোকেরা এই বেঞ্চে বসেন। আর নিচু জাতের লোকেদের জায়গা হয় মাটিতে পাটির ওপরে, যাকে স্থানীয় ভাষায় হোগলা বলা হয়। চেয়ারম্যান সাহেবের বসার জন্য একখানা গদির ব্যবস্থা আছে বৈকি। তিনি সেখানেই বসেন। কাছারিঘরে মহিলাদের আসা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের ষোড়শী কন্যা জেসমিনের নাটক শোনার খুব শখ। তার খুব জানতে ইচ্ছা হয় নাটকে কী হয়। কেন এত মানুষ ছুটে আসে এই নাটক শুনতে? বছরখানেক ধরে সে তার বাপ-ভাইদের কাছে নাটক শোনার জন্য বায়না করে আসছে। অবশেষে এত দিনের বায়নার পর চেয়ারম্যান সাহেব কাছারিঘরের পেছন দিকে একটা খোলা বারান্দা দিয়েছেন, যাতে জেসমিনসহ অন্য মহিলারাও নাটক শুনতে পারেন।
নাটক শেষে ধীরে ধীরে কাছারিঘর খালি হতে লাগল। জয়নাল মির্জা যখন উঠে যাচ্ছিলেন, তখন তার ছোট পুত্র জব্বার মির্জা তাকে ইশারা করল বসার জন্য। সম্ভবত তার কিছু বলার আছে। তিনি বসলেন। ঘর খালি হলে জব্বার বড় ভাই জালালকে নিয়ে বাবার পাশে এসে বসল।
জয়নাল মির্জা বললেন, ‘বিষয় কী?’
জব্বার বলল, ‘আব্বা, হারুন ব্যাপারীর বিষয়।’
জয়নাল মির্জা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এখন এই সব বলার সময় না। মোর ঘুমের সময় অইছে। এই সব কইয়া মেজাজ খারাপ করবা না, জব্বার।’
জয়নাল মির্জা ছেলেদের আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দিলেন না। তিনি খাবার ঘরের দিকে গেলেন। অন্যান্য দিন এতক্ষণে রাতের খাবার খেয়ে এক ঘুম হয়েও যায়। আজ নাটক শুনতে শুনতে দেরি হয়ে গেছে।
.
যেদিন সমুদ্র আমায় ইশারা করেছিল, রৌদ্রময় দিনের স্তব্ধতায় এটুকু লিখে রঞ্জু পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। কী লিখছে সে এসব? কিসের ইশারা! সমুদ্র কীভাবে ইশারা করবে, ধুর! পৃষ্ঠা ছিঁড়তে ছিঁড়তে ডায়েরির অর্ধেক খালি হয়ে গেছে। ডায়েরির এমন বেহাল দশা দেখে আপাতত কবিতা লেখা বাদ দিল সে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ছোটবেলা থেকেই তার বেশ সাহিত্যপ্রেম রয়েছে। মাঝে মাঝে কবিতা লেখে। কবিতা লিখলে তার বেশ একটা সুখ সুখ অনুভূতি হয়। কিন্তু ইদানীং শত চেষ্টা করেও ভালো কিছু লিখতে পারছে না। যা লিখছে, সেটা তার নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না। কাঠের দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তার শোবার ঘর। সেই ঘরের সামনে খোলা বারান্দা। বারান্দার এক পাশে সে এখন পা ছড়িয়ে বসে আছে। দৃষ্টির সীমানায় এই সূর্যমণি গ্রাম, এই বাড়ি, বাড়ির উঠোন, উঠোন পেরিয়ে পুকুর। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সরু খাল। খালের পাশে পানের বর। বাড়িতে ঢোকার পথে সারি সারি সুপারিগাছ। পেছনে মেহগনিবাগান। রান্নাঘরের পাশে ঝিঙে-কাঁকরোলের মাচায় ফুল ধরেছে। বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে এই বারান্দাতে। এই সবকিছুই তার নিজের। কিন্তু এসব কিছুই তার ভালো লাগে না। তার মন পড়ে রয়েছে নিজ হলের ২১৩ নম্বর ঘরে, রেসকোর্স ময়দানে, শহীদ মিনারে, মধুর ক্যানটিনে এবং পাবলিক লাইব্রেরির বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে।
রঞ্জু সূর্যমণি এসেছে বেশি দিন হয় নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে পড়ে সে। হাজি মোহাম্মদ মহসিন হলে থাকে। কিছুদিন আগে তার হলেই আকস্মিকভাবে সাত ছাত্র খুন হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন বাবার আদেশমতো গ্রামে চলে আসে। পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনো কিছুতে সে নিজেও জড়াতে চায় না। তার কয়েক দিন পরই বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। কবে সব স্বাভাবিক হবে, কবে সে ফিরে যাবে তার প্রিয় শহরে, সেই অপেক্ষায় প্রতিটি প্রহর গুনছে।
গ্রামের নাম চাঁদশী, গৌরনদী, বরিশাল। গত দুসপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে প্রতিটি বাড়ির পুকুরের পানি পাড় ছুঁই ছুঁই। আর চার-পাঁচ দিন বৃষ্টি হলে পানি বুঝি উঠোনেই চলে আসবে। এই নিয়ে চিন্তায় গ্রামবাসী দিশাহারা। কেউ কেউ পুকুরে পোনা মাছ ছেড়েছে। এমন হলে সব ভেসে যাবে। যার মাছ কিছুটা বড় হয়েছে, সে মাছ ধরা শুরু করে দিয়েছে। বিক্রি করে যা আসে, তা-ই সই। যার মাছ বড় হয় নি, তার সৃষ্টিকর্তার কাছে মিনতি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারও সবজির খেতে পানি উঠে ফসল নষ্ট হচ্ছে। কারও পানের বরে পানি উঠে পান পচে যাচ্ছে। আব্বাস কাঠমিস্ত্রির অবশ্য এসব দুশ্চিন্তা নেই। তার না আছে নিজস্ব মাছভরা পুকুর, না আছে ফসলের খেত, না আছে পানের বর। কিন্তু সে-ও কদিন ধরে গ্রামবাসীর মতোই দিশাহারা। তার দুশ্চিন্তা অন্য রকম।
আব্বাস পরিবারের বড় সন্তান। তার ছোট দুই ভাই—মেজটি মুকুল আর ছোটটি মামুন। এই ভাই দুটিকে নিয়ে তার যত চিন্তা। ছোটকাল থেকেই মামুনের বড় পড়াশোনার শখ। আজ আবার সেই দিনটি চোখে ভাসছে। মামুন তখন সবে ক্লাস ফাইভ পাস করেছে। আব্বাস কাজ থেকে ফিরছিল। পথে দেখে খালপাড়ে বসে মামুন কাঁদছে। কারণ, বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, হাইস্কুলে তিনি পড়াতে পারবেন না। এত দিন প্রাইমারিতে ফ্রি পড়েছে, এ-ই ঢের। মামুনের কান্না দেখে বড় মায়া হলো আব্বাসের। সে ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নিল। হাইস্কুলে ভর্তি করে দিল। নিজে খেয়ে না-খেয়ে ভাইকে পড়াশোনা করাল। এ বছর মামুন স্টার মার্ক পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। খবর পেয়ে কত লোক যে ওকে দেখতে এল! এখন দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে, মামুন যে আরও পড়াশোনা করতে চায়। ঢাকায় গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। ঢাকা কত বড় শহর! কত খরচ! সেসব সামলানোর সামর্থ্য যে আব্বাসের নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে লোকের অভাব বেড়েছে। কাঠের কাজের কদর কমেছে। কেউ বড় একটা ডাকে না কাজে। এখন খাওয়া জোটাতেই তাকে সারা বছর হিমশিম খেতে হয়। কদিন হয় মুন্সিবাড়িতে একটা ভালো কাজ পেয়েছে। ওরা খাবারের ঘর তুলছে। সেই ঘরের টেবিল- চেয়ার, দরজা-জানালা আর টুকটাক আসবাব বানানোর কাজ। কিন্তু এ রকম কাজ তো সারা বছর থাকবে না। কী দিয়ে ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে?
আমিন মুন্সি কদিন ধরেই দেখছেন আব্বাস কাজে বড় অমনোযোগী। সারা দিন কিছু না কিছু ভেবে চলেছে। আব্বাস চেয়ারে নকশার কাজ করছিল। আমিন মুন্সি যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে টেরই পায় নি। সেখানে কিছু না বলে আব্বাসকে তিনি ডেকে পাঠালেন পুকুরপাড়ে। এ বেলা বৃষ্টি হয় নি, অনেক দিন বাদে তাই আজ ঘাটলায় (পুকুরপাড়ে) বসার সুযোগ পেলেন। এ জায়গাটি তার বড় প্রিয়।
আব্বাস ঘাটলায় এসে বলল, ‘চাচা, মোরে বোলাইছেন?’
ঠিক সেই সময় দুজনের জন্য চা-নাশতা চলে এল। আমিন মুন্সি বললেন, ‘আহো, বহো। ভাবলাম একলগে চা খাই।’
আব্বাস কাঁচুমাচু হয়ে বসল। বড়লোকদের সাথে বসে চা খাওয়ার অভ্যাস তার বিশেষ নেই। আবার মুন্সি চাচার কথার ওপর কথা বলার সাহসও তার নেই।
চা খেতে খেতে আমিন মুন্সি দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলেন। আব্বাস সেখানে নীরব শ্রোতা।
একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘কয় দিন ধরে তোমারে আনমনা দেহি। বড় কোনো সমস্যায় আছ নিহি?’
আব্বাস মাথা নিচু করে মৃদু গলায় বলল, ‘তেমন কিছু না, চাচা।’
‘আরে মিয়া, কী সমস্যা মোরে কও। তুমি মোর পোলার মতো। উপকার করতে পারি না-পারি, হুনতে তো পারি। কী কও?’
আব্বাসের জড়তা কাটে না। তবে এরপরও কিছু না বললে খারাপ দেখায়। সে মামুনকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথাগুলো বলল। সব শুনে আমিন মুন্সি বললেন, ‘দেহি মুই কিছু করতে পারি নিহি।’
আমিন মুন্সি সারা দিন ভাবলেন। সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে আব্বাস যখন বাড়ি ফিরবে, ঠিক তখন তাকে কাছারিঘরে ডেকে পাঠালেন। আব্বাসের আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল। সত্যিই কি মুন্সি চাচা কোনো সাহায্য করবেন?
আব্বাস কাছারিঘরে ঢুকতেই দেখে বাহারি নাশতার আয়োজন। ফল, মিষ্টি, আরও কত কি! এসব দেখে আব্বাস কিছুটা ঘাবড়েই গেল বটে।
আমিন মুন্সি বললেন, ‘আহো আব্বাস, বহো। নেও, নাশতা খাও। সারা দিন ম্যালা খাটো।’
আব্বাস বিব্রত গলায় বলল, ‘চাচি দুহারকালে এত ভাত খাওয়ায়, আমার তো খিদাই লাগে না।’
আমিন মুন্সি হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘আরে মিয়া, খাও খাও। তোমাগো বয়সে এর তিন গুণ খানা একলাই খাইছি।’
আব্বাস বসে একটা মিষ্টি নিল। মাস তিনেক আগে মুকুলের শ্বশুর এসেছিল মিষ্টি নিয়ে। সেই যে মিষ্টি খেয়েছে, এরপর আর মিষ্টি খায় নি। মিষ্টি সে বড় ভালোবাসে।
আমিন মুন্সি বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে ভাবলাম, বুঝলা আব্বাস।’
আব্বাসের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে সাগ্রহে তাকিয়ে রইল পরবর্তী কথা শোনার জন্য। আমিন মুন্সি বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের লাহান পোলা লাখে একটা। মোর তাই একটু লোভ হইল। অরে মোর ছোডো মাইয়াডা জামাই করতে চাই। ঢাকায় অর পড়ালেহার সব ব্যবস্থা মুই কইর্যা দিমু। যদি কলিকাতা পড়তে যাইতে চায়, তাইলে রেলওয়েতে একটা চাকরির ব্যবস্থাও কইর্যা দিতে পারমু। তুমি তো জানো, মোর মাইজ্জা পোলাডা কলিকাতা রেলওয়েতে বড় চাকরি করে। কত মানুষের চাকরি অর হাতে। ঘরজামাই থাকন লাগব না।’
আব্বাসের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সে কী বলবে ভেবে পেল না। ছোট মেয়ে মানে তো রেহানা। কিন্তু তার তো একবার বিয়ে হয়েছিল।
আমিন মুন্সি নরম গলায় বললেন, ‘দেহো বাবা, মুই জানি মোর মাইয়া কোনো দিক দিয়াই তোমার ভাইয়ের যোগ্য না। একবার বিয়া হইল, তালাক হইল। দেখতে ভালো না, গায়ের রং ময়লা। কিন্তু এত অল্প বয়স। আজীবন তো অরে এইভাবে রাখতে পারমু না। মুই আইজ আছি কাইল নাই। মুই মরলে অরে যে অর ভাইরা দ্যাখবে, তার তো কোনো ঠিক নাই। একটা ভালো পাত্রের হাতে তুইল্যা দিয়া যাইতে পারলে শান্তিতে মরতে পারতাম। এই জন্যে বড় সাহস দেখাইয়া প্রস্তাবটা দিছি। তুমি রাজি না থাকলে মানাও কইরা দিতে পারো। মুই কিছুই মনে করমু না, বাবা।
আব্বাস আগের চেয়ে দিগুণ বিব্রত হয়ে বলল, ‘চাচা, এই রহম প্রস্তাব পাওয়া মোগো কপাল। তয় বাড়ি যাইয়া বেবাকের লগে আলাপ না কইরা তো মুই কিছু কইতারি না। তা ছাড়া মামুন কী চায়, হেইয়াও তো জানতে অইবে।’
আমিন মুন্সি আব্বাসের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি দুশ্চিন্তা কইরো না। সময় নিয়া ভাবো। আলাপ করো, এরপর মোরে জানাও। কোনো তাড়া নাই।’
ভরা বর্ষায় টলমল জলে ভরে উঠেছে পুকুর। ঝরে পড়া অজস্র সোনালু ফুল পুকুরের জলে ভাসছে। জেসমিন সেই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটলায় বসে ভাতিজা, ভাইঝিদের সাথে নিয়ে আধা পাকা আমের ভর্তা বানাচ্ছে। ভর্তা আবার দুই পদে বানানো লাগছে। বাচ্চাদের জন্য ঝাল ছাড়া, বড়দের জন্য ঝাল দিয়ে।
আউশ ধান উঠেছে। মির্জাবাড়ির বউরা সকাল থেকে বড় বড় পাতিলে সেই ধান সেদ্ধ করছে। চুলার পাশে বড় হোগলা বিছানো। পাতিলের ধান প্রথমে সেই হোগলায় ঢেলে ফেলা হয়। বাড়তি পানিটুকু ঝরে গেলে সেই ধান ডালা ভরে নিয়ে উঠানে অন্য শুকনো হোগলার ওপর ঢালা হয়। আমন ধানের সময় অবশ্য সরাসরি উঠানেই ধান শুকানো হয়। আগে গোবর দিয়ে লেপে নেওয়া হয়, এতে মাটি শক্ত হয়, ধান ওঠানোর সময় আলগা মাটি উঠে আসে না। কিন্তু আউশ ধানের সময় হুটহাট বৃষ্টি নেমে পড়ে বলে হোগলার ওপর শুকানো হয়, যাতে বৃষ্টি নামলে দ্রুত তুলে ফেলা যায়। কোহিনুর বানু বড় বউ আসমাকে নিয়ে ধান সেদ্ধ করছেন। আসমা ভূতের মতো কাজ করতে পারে। জনশ্রুতি আছে, কেশবপুরের এত বড় পালের দিঘি নাকি এক রাতে কেটেছিল ভূতেরা। সেই দিঘি কাটার গল্প একেকজনের মুখে একেক রকম। আসমা তেমনি এক দিনে মণকে মণ ধান সেদ্ধ করে ফেলতে পারে। আসমা সাথে থাকলে তার তেমন বিশেষ কোনো কষ্ট হয় না।
একজন কাজের মহিলা ডালা ভরে ধান উঠানে নিচ্ছে। ছোট বউ মিনু আরেকজন কাজের মহিলাকে নিয়ে সেই ধান আউলে দিচ্ছে। ইদানীং মিনুকে বেশি কষ্টের কাজ তিনি দিচ্ছেন না। কারণ, তার ধারণা, মিনু পোয়াতি হয়েছে। কিন্তু বান্দর মেয়েছেলে এত গুরুত্বপূর্ণ কথা তার কাছে কেন এখনো গোপন রেখেছে, বুঝতে পারছেন না!
যে পরিমাণ ধান সেদ্ধ করতে হবে, তাতে এই কজন হিমশিম খাচ্ছে। আরও লোক দরকার কিন্তু আর কাউকে এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় জেসমিনের বাচ্চাদের সাথে বসে আমভর্তা বানানোটা গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
কোহিনুর বানু এই গেরস্তবাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন ৯ বছর বয়সে। তখনো সাবালক হন নি। তার শাশুড়ি করিমন বিবির ছিল মাথার ব্যামো। এই ব্যামো শুধু শুধু হয় নি। এর পেছনে আছে বিরাট ইতিহাস। করিমন বিবি প্রায়ই স্বপ্নে দেখতেন, সাতটি মটকা ভরা কাঁচা টাকা। ঢাকনাগুলো ওঠে- নামে। ভেতরে টাকা দেখা যায়। একটা গায়েবি আওয়াজ বলে, ‘এই সব টাকা তোর।’
করিমন বিবি যক্ষের ধনের কথা শুনেছেন, তবে তার সাথে এমন কিছু হবে, বিশ্বাস করতে পারতেন না।
এরপর একদিন সেই গায়েবি আওয়াজ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তাকে বলল, “ওঠ করিমন, দেখ তোর উগুইরতলার (চাল-ডালের মটকা মাটিতে রাখলে নষ্ট হয়ে যেত, সেসব রাখার জন্য কাঠের তৈরি উঁচু তাকের মতো জিনিস) নিচে সাতটা মটকা ভরা টাকা। সব তোর। আওলা মাটি (পুকুরে পানির নিচের ভেজা মাটি) দিয়ে ঘরবাড়ি, সারা বাড়ি লেপে গোসল করে আসবি। তারপর পানিতে এক ফোঁটা গোবর দিয়ে তাতে মটকা থেকে কিছু কাঁচা টাকা নিয়ে জ্বাল দিলেই সব টাকা তোর হয়ে যাবে। কেউ দেখার আগে সব কাজ শেষ করবি।’
করিমন বিবি বিছানা থেকে নেমে উগুইরতলায় মটকাগুলো দেখতে পেলেন। ঢাকনা তুলে দেখলেন সব মটকা ভরা কাঁচা টাকা। তিনি দ্রুত পুকুর থেকে আওলা মাটি তুলে ঘর লেপৌঁছে পরিষ্কার করলেন। এরপর গোসল করে এসে চুলা ধরালেন। এসবই দূর থেকে লক্ষ করলেন তার বড় জা জমিলা বিবি। তার বড় সন্দেহ হয়। এত রাতে করিমন কেন ঘর লেপে! তিনি বিষয়টা বোঝার জন্য এগিয়ে যান। করিমন একটা হাঁড়িতে পানি ও এক ফোঁটা গোবর দিয়ে চুলায় বসালেন। ঘরে আসবেন টাকা নিতে, তার আগেই জমিলা বিবি নাপাক শরীরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘তোমাগো আগুন-তাওয়াডা কই গো করিমন?’
আগেকার দিনে আগুন বড় সহজলভ্য ছিল না। সারা রাত মাটির পাত্রে তুষের ভেতর জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে এক বিশেষ পদ্ধতিতে আগুন সংরক্ষণ করা হতো। সেই পাত্রের নাম ছিল আগুন-তাওয়া। সেই আগুন-তাওয়ার ছুতোয় যেই না জমিলা বিবির নাপাক শরীরে ঘরে পা দিলেন, অমনি টাকা ভরা সাতটা মটকা গড়গড়িয়ে নেমে গেল পানিতে। এরপর উধাও। সেই থেকেই যক্ষের ধনের শোকে করিমন বিবি পাগল। প্রবাদ আছে, যারে ধরে যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা। করিমন বিবিরও রক্ষা হয় নি। তিনি এমন বদ্ধ পাগল ছিলেন যে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। গেরস্তবাড়ির সকল কাজের সাথে পাগল শাশুড়ির সেবা, সবই তাকে বড় জায়ের সাথে ভাগে করতে হতো সেই ৯ বছর বয়স থেকে। জেসমিনটা যে রকম কামচোর হয়েছে, যদি এ রকম কোনো বাড়ি গিয়ে পড়ে, কীভাবে সামলাবে কে জানে!
কোহিনুর বানু রান্নাঘর থেকেই হাঁক ছাড়লেন, ‘ও লো নবাবের বেড়ি, আর কত গায়ে বাতাস লাগাইয়া চলবি? আসমার লগে একটু ধানের পাতিলডা ধরলেও তো পারোস।’
জেসমিন পুকুরপাড় থেকেই বলল, ‘অত বড় পাতিল মুই জাগাইতে পারি?’
‘পারবি না ক্যা? ভাত খাও না তুই? পরের বাড়ি যাইয়া ক্যামনে করবি?’
‘যহন পরের বাড়ি যামু, তখন ঠিকই পারমু। দুই চক্কু দিয়া তো দেখতেইয়াছি কোন কাম ক্যামনে করে।’
কোহিনুর বানু বললেন, ‘এত বড় বড় বয়ান না দিয়া মিনুর লগে ধান আউলা গিয়া। পাতিল জাগাইতে পারবি না বুঝলাম। ধান আউলাইতে তো পারবি। হেইডা কইরা আমারে উদ্ধার কর, মা।’
‘না, ধানও আউলাইতে পারমু না। বাপের বাড়ি বইয়াও কাম করমু, পরের বাড়ি যাইয়াও কাম করমু। হারা জনম কি কাম কইরা কাটামু? ও ছোট ভাবি, তুমি কও দেহি, বাপের বাড়ি থাকতে কি তুমি কোনো কাম করতা?’
মিনু হাসল শুধু, কিছু বলল না। কোহিনুর বানু জানতেন এ মেয়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তবু বলার কাজ বললেন। বউরা বলতে তো পারবে না তিনি মেয়েকে কাজ করতে না বলে শুধু বউদের দিয়েই কাজ করান!
আমভর্তা বানানো শেষ হলে কলাপাতায় করে সেই ভর্তা বাড়ির সকলের কাছে পৌঁছানো হলো। সবাইকে দিয়ে তারপর জেসমিন খাওয়া শুরু করল। আম কুচি কুচি করে কেটে তাতে লবণ, কাঁচা মরিচ কুচি, সরিষাবাটা আর লেবুপাতা দিয়ে মেখেছে। এ যেন অমৃত!
বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আশপাশে সবাই সব কাজ ফেলে ধান তুলতে দৌড়ে এল, শুধু জেসমিন ছাড়া। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল রঞ্জু ও তার বন্ধু মানিক। এ বাড়ির ধান ভিজে যাচ্ছে বলে তারা দৌড়ে এসে ধানের হোগলা তুলতে লাগল।
এবার কোহিনুর বানু রীতিমতো রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘নবাবের বেডি, তোর ঠ্যাং যদি আমি আইজ না ভাঙছি! বিষ্টি নাইম্যা গেল। অন্য বাড়ির পোলারা আইয়া ধান উড়ায়, তাও তুই ধরো না? তোরে মুই পয়দা করছিলাম ক্যা?’
সর্বনাশ! অন্য বাড়ির ছেলেরা আবার কেন এল! তোরা পথ দিয়ে যাচ্ছিলি, যা না বাবা। অযথা ঘরে আগুন লাগাতে কেন এলি? এসব ভাবতে ভাবতেই জেসমিন গিয়ে ধানের হোগলা ধরল। রঞ্জু ধান ঘরে তুলতে তুলতে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো পরি তার হোগলার উল্টো পাশের দিকটা ধরল। একটা ছাপাশাড়ি প্যাঁচ দিয়ে পরা। লম্বা চুলগুলো লাল ফিতেয় কলাবেণি করা। গায়ের রং দুধে আলতা, গালের রগগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটে তার চোরা হাসি। পরি তার দিকে তাকাল না।
.
কেশবপুর গ্রাম থেকে বের হতে না হতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কাঁচা রাস্তা কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে আছে। হাঁটতে গিয়ে পা গেঁথে যাচ্ছে।
মানিক বলল, ‘ভুল অইয়া গেল রে ব্যাডা।’
রঞ্জু তখনো একটা ঘোরের মধ্যে। পরিটাকে সে কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না। ঘোরের মধ্যেই সে মানিকের কাছে জানতে চাইল, ‘কী ভুল?’
‘বৃষ্টি থামা পর্যন্ত চেয়ারম্যানবাড়ি থাকা উচিত আছিল।’
রঞ্জু এবার আচমকা বলল, ‘ঠিক বলেছিস। আরও কিছুক্ষণ থাকা উচিত ছিল। পরিটারে আরও কিছুক্ষণ দেখতে পারতাম তাহলে।’
‘এ রঞ্জু, তোর কী অইছে? পরি কই পাইলি? হাবিজাবি কী কস?’
‘যে মেয়েটা আমার সাথে ধানের হোগলা ধরল, তার কথা বলি। পরির মতো সুন্দর। কালকে আবার আসব ওকে দেখতে।’
মানিক এবার আঁতকে উঠল, ‘সর্বনাশ! এই সব চিন্তা একদম বাদ দিয়া দে। জেসমিন কার মাইয়া, জানোস?’
‘বাহ্, ওর নাম জেসমিন! কামিনী ফুল!’
‘রঞ্জু, জেসমিন চেয়ারম্যানের মাইয়া। জানতে পারলে খুন করব তোরে।’
‘রাখে আল্লাহ মারে কে?’
এ কথা বলে হেসে ফেলল রঞ্জু।
মুকুলও তার বড় ভাই আব্বাসের মতো কাঠমিস্ত্রি। কিন্তু কাজকামে তার মন নেই। আব্বাস তাকে জোর করে কাঠের কাজ শিখিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে টুকটাক কাজ করলেও এখন আর কোনো কাজ সে পায় না। পাওয়ার চেষ্টাও করে না। কারণ, তার পছন্দ যাত্রাপালা। বিনে বেতনের খাটনি। মাঝে মাঝে দু-চার পয়সা যা পায়, তাতে সংসার চলে না। এখনো বাপ-ভাইয়ের সাথে খাচ্ছে বলে একভাবে দিন কেটে যাচ্ছ। যাত্রার নেশা ছাড়তে পারে না, তাই এ পথ ছাড়া হয় না। দেখতে কদাকার হলেও মুকুল পাট ভালো করে, তাই সে চাঁদশী যাত্রাদলের নায়ক। ফরসা হওয়ার কারণে নায়িকার পাট সব সময় ফয়েজের। ফয়েজ মুকুলের সমবয়সী, তবে সম্পর্কে হয় চাচা। তুই-তোকারি সম্পর্ক হলেও চাচা ডাকটি কিন্তু বিদ্যমান।
এই মুহূর্তে তারা দুজন যাচ্ছে মুস্তাফিজ ডাক্তারের বাড়ির দিকে। উদ্দেশ্য, এ বাড়ি থেকে কিছু মুরগি চুরি করা। এ ছাড়া আর কোনো উপায় এখন নেই। মুকুলের বউ মিনা রাগ করে তার যাত্রাদলের কস্টিউম ছিঁড়ে ফেলেছে। এখন নতুন কস্টিউম বানানোর পয়সা সে কোথায় পাবে? অথচ এই সপ্তাহে তাদের পালা আছে। এই অভাবের দিনে কারও বাড়িতে চুরি করতেও বিবেকে লাগে। গ্রামের বড়লোকদের একটা লিস্টি করেছে দুজন মিলে। তাদের মধ্যে একজনের মুরগির খোপ কাজের লোকেদের ঘরের বারান্দায়। বাইরে থেকে যাওয়ার উপায় নেই। আরেকজন মুরগি পালে না, গরু-ছাগল পালে। কিন্তু গরু-ছাগল ম্যালা টাকার ব্যাপার, অত টাকার তাদের দরকার নেই। আর চেয়ারম্যানের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে বিপদ, তাই সে-ও বাদ। বাকি রইল আমিন মুন্সি আর মুস্তাফিজ ডাক্তার। কিছুদিন ধরে মুকুলের বড় ভাই আমিন মুন্সির বাড়িতে কাজ করছে, সেই বাড়িতে চুরি করাটা ঠিক হবে না। অবশেষে ডাক্তার বাড়ির মুরগিই চুরি করতে হচ্ছে। কাদায় পা আটকে যাচ্ছে বারবার। বিরক্তির শেষ নেই।
মুকুল ফিসফিস করে বলল, ‘কী যে আহোইজ্জা পোলাপানের লাহান কাম করল বউডা! রাগ দেহাবি, তয় মাইরা হাত-পাও কিছু ভাইঙ্গা দে, নায় চুল কয়ডা ছিঁড়ড়া দে। হ্যানা কস্টিউম ছিঁড়ড়া দিলি! এমন কামও কেউ করে?’
ফয়েজের কাছে দুঃখ করে এসব কথাই বলছিল মুকুল। ফয়েজ ফিক করে হেসে দিল।
মুকুল চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তোর দেহি মনে ম্যালা সুখ, কাহা। ক্ষেতি তো আর তোর অয় নাই।’
ফয়েজ বলল, ‘এইয়ার লাইগ্যাই তো বিয়া করি না। তোরা তো হগলডি কও খালি বিয়া হরো বিয়া হরো। বিয়া হরলে অইবেডা কী? এইয়াই তো অইবে।’
‘এ ব্যাডা! মোরে তো বিয়া করাইছে ছোডকালে। হেকালে কি আর অত কিছু বুঝি?’
দুজনের কথোপকথনের তালে পথ ফুরিয়ে গেল। অতি সন্তর্পণে পা ফেলে বাড়ির পেছন দিকের উঠোনে গেল। মুরগির খোপ খুলে একটা হাত ঢুকিয়ে দিল। এরপর হাতের কাছে যে মুরগিটাকে পেল, গলা বরাবর চাপ দিয়ে ধরল। এই পদ্ধতিতে ধরলে মুরগি চিৎকার করতে পারে না। গুনে গুনে তিনটি মুরগি নিয়ে খোপ আটকে দিল। এগুলো বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, তাতে কস্টিউম বানানো হয়ে যাবে।
রেনুর শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার- কবিরাজ সাধ্যমতো দেখানো হচ্ছে। ওষুধপাতিও কমবেশি চলছে। কিন্তু কেউ রোগ সারাতে পারছে না। আজও শরীর খারাপ লাগছিল। তবু সবাই ঘুমিয়ে পড়ার কারণে জেগে বসে আছে সে। মুকুল যে ফেরে নি! রেনু যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে, তখন মুকুল-মামুন ছোট। ওদের কোলেপিঠে করে বড় করেছে। দুজনকে নিজের ছেলের মতো দেখে। মুকুল মাঝরাতে বাড়ি ফিরতেই রেনু তাকে ভাত খেতে ডাকল।
মুকুল বলল, ‘ও কি ভাবি, তুমি এহনো হজাগ ক্যা?’
রেনু ধমকে বলল, ‘তয় কে হজাগ থাকপে? তোর বউ তো সন্ধ্যাকালেই ঘুমাইছে। আর তোর মায়ের তো তুই খাইলেও কিছু যায়-আহে না, না খাইলেও না। সব দায় ঠেকছি একলা মুই।’
মাঝে মাঝে মুকুলের রাত করে বাড়ি ফেরা আর তার জেগে বসে থাকা আজ নতুন কিছু নয়। তাই রেনুর মেজাজ সপ্তমে থাকার আলাদা কোনো কারণ রয়েছে। সেই কারণটা জানতে পারলে সুবিধা হতো। কিন্তু এখন রেনুর কাছে কিছু জিজ্ঞেস করাটা বিপজ্জনক।
মুকুল ভয়ে ভয়ে বলল, ‘মোর কাম আছিল, ভাবি। ভাত বাইড়্যা রাইখ্যা তুমি ঘুমাইয়া পড়তা।’
রেনু আবার গর্জে উঠল, ‘হ, ভাত বাইড়্যা রাখলে কুত্তায় খায়, নাইলে বিলইতে খায়, এ কতা তুই জানো না?’
মুকুল আর কথা বলার সাহস পেল না। হাতমুখ ধুয়ে চুপচাপ খেতে বসল।
রেনু এবার পাশে বসে চাপা গলায় বলল, ‘তোর বউরে কবি মোর লগে মেজাজ না দেহাইতে। মোর লগে তার মেজাজ দেহানের কারণ কী? তুই কি মোর পোলা যে কামকাইজ না করলে তোরে মুই পিডামু? তোর মায় মোর লগে মেজাজ দেহায়, তোর বাপে মেজাজ দেহায়, তোর বউও মেজাজ দেহায়। এ মুই কি তোগো বেবাকটির মেজাজ রাহোনের ভাণ্ড? খালি তোর ভাইজান মেজাজ দেহায় না, ওই মানুষটার লাইগ্যা এই ছাতার সংসারে এহনো পইড়া রইছি, নাইলে এত দিনে বাপের বাড়ি যাইতাম যাইয়া।’
চমকে উঠল মুকুল, ‘মিনা কি তোমার লগে খারাপ ব্যবহার করছে? অর হইয়া আমি মাফ চাইতাছি। তুমি মনে কষ্ট নিয়ো না, ভাবি।’
‘বেইন্যাকালে তোর মায় একশডা কতা হুনাইছে মিনারে। এ তুই কামকাইজ করো না, এই লাইগ্যা তোর মায় অরে কতা হুনাইবে ক্যা? তোরে কইতে পারে না?’
মুকুল মাথা নিচু করে বলল, ‘কাম তো পাই না, ভাবি।’
রেনু গজগজ করে বলল, ‘যাত্রাদল ছাড়ো হেলেই পাবা।’
মুকুল চুপ হয়ে গেল। এ কথার পৃষ্ঠে বলার মতো কিছু নেই আসলে তার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন