মৌরি মরিয়ম
বেশ কদিন ধরেই মুকুলের কাজ নেই। উপার্জন যেহেতু বন্ধ, তাই সংসারে যাতে অশান্তি না হয়, তাই সে প্রায় প্রতিদিন মাছ ধরে আনে। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হলো না। একদিন পড়তেই হলো হালিমার আক্রমণে, তবে যথারীতি শিকার মুকুল নয়, বরং জেসমিন। সে রেনুর সঙ্গে বসে মুকুলের আনা মাছ কুটছিল। এরই মধ্যে হালিমা শুরু করেছেন। লজ্জা নেই, ভাশুর-দেবরের টাকায় বসে বসে খাচ্ছে, আরও নানান ধরনের কথা। সেসব গায়ে মাখল না জেসমিন। সে চুপচাপ মাছ কুটতে লাগল। কষ্টটা লাগল তখন যখন বলল, ‘মাইয়া কইত্যা যে আইছে, এইডাই আইজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না। এতিম মাইয়া নায় বুজলাম, হেল্লিগ্যা কি তিন কূলে এককালে কেউ নাই? নাকি আকাম-কুকাম কইরা পলাইছে? প্যাট বাজাইছে ক্যামনে, কেডা জানে! আসলেই বিয়া অইছিল, না অন্য কিছু, কেডা কইবে!
রেনু এবার বলল, ‘আম্মা, কী কইতেয়াছেন এই সব? আমনের মাতা ঠিকাছে?’
হালিমা বললেন, ‘আমার মাতা ঠিকই আছে। তোগো মাতা ঠিক নাই।’
জেসমিন কান্নাটা আর আটকে রাখতে পারল না। মুকুল গিয়েছিল গোসল করতে। ফিরে এসে সে শুধু শেষের কথাটাই শুনতে পেল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী অইছে, এইডা কি বেবাইজ্জাবাড়ি? আম্মা, কী লইয়া আবার শুরু করলেন? আমনে কি একটু শান্ত থাকতে পারেন না? সব সময় এত চিল্লাচিল্লি করা লাগে ক্যা?’
‘অইছে মোর কপালের চাড়া। পোলায় আইছে কৈফিয়ত চাইতে। এ রহম দিন আইছে।’
মুকুল এবার বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমনে সব সময় এইডা ক্যা চিন্তা করেন যে আমনে যা করেন, সব ঠিক করেন, যা কন, সব ঠিক কন আর বেবাকটি ভুল? এই চিন্তা বাদ দিলেই দেকপেন আর কেউ কৈফিয়ত চাইবে না।’
‘এত বড় সাহস তোর? বউর লাইগ্যা মার লগে গলাবাজি করোছ? বউর চামচা অইছো? বউরে কিছু কইলেই এক্কালে গায়ে ফোসকা পড়ে?’
মুকুল পাল্টা বলল, ‘আমনে মোর বউরে কইছেন না অন্য কেউরে কইছেন, হেইয়া তো মুই হুনিই নাই। আমনের চিল্লাচিল্লি হুনলেই মোর গায়ে ফোসকা পড়ে।’
মুকুল কাপড় নেড়ে ঘরে চলে গেল। হালিমা বললেন, ‘খাইছে, মোর পোলার মাতাডারে খাইছে ওই ডাইনিতে।’
কাঁদতে কাঁদতে চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। মাছ কুটতে কুটতে হাতটা কীভাবে যেন কেটে গেল জেসমিনের। রেনু হাতটা ধুয়ে দিয়ে বলল, ‘ঘরে যা বুইন। রান্ধাবাড়া মুই করতেয়াছি। কাটা হাত লইয়া করা লাগবে না।’
জেসমিন কিছু বলল না আর। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে চুপচাপ ঘরে চলে গেল। মুকুল কাটা হাত দেখে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার কাপড়ে হাতটা বেঁধে দিল। তারপর বলল, ‘তুমি কি কান্তেয়াছিলা? আম্মায় তোমারে কী কইছে, কও দেহি।’
‘বাদ দেন, বাজে কতা।’
‘বাজে কতা অইলে তো আরও আগে বাদ দেওন যাইবে না। কী কইছে, কও।’
‘আমনের মনে প্রশ্ন জাগে না মুই এহেনে কইত্যা আইছি? ক্যামনে আইছি?’
‘জানি তো, ভাবি তো কইছে। তুমি যার বাসে কইরা গৌরনদী আইছিলা, হে আমার একরকম বন্ধু। হের ধারেও হুনছি।’
‘যা হুনছেন, তাই বিশ্বাস করছেন?’
‘না করার কী অইল?’
‘আমনের মায় বিশ্বাস করে নাই।’
‘কী কইছে?’
‘কী কইছে মুই তা কইতে পারমু না।’
মুকুল সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জেসমিন তাকে আটকানোর চেষ্টা করেও আটকাতে পারল না।
মুকুল রান্নাঘরে গিয়ে রেনুকে জিজ্ঞেস করল হালিমা তখন কী বলেছেন। রেনু বলল, ‘বাদ দে ভাই। ওনার মাতাডা তো ইকটু খারাপ আছে।’
‘তুমি কইবা কি না, জানতে চাই। জেসমিনও কইতেয়াছে না, তুমিও কইতেয়াছ না। সমেস্যা কী তোমাগো? যেদিকে দুই চোখ যায়, যামু গিয়া কিন্তু।’
রেনু প্রথমে একটু ইতস্তত করল। তারপর বলেই দিল। মুকুল সব শুনে রেনুকে কিছু বলল না। ঘরে ফিরে গেল। ঘরে গিয়ে জেসমিনের কাছে হাত জোড় করে মাফ চাইল।
জেসমিন মুকুলের হাত দুটো ধরে বলল, ‘আমনে মাফ চাইয়া মোরে শরম দিয়েন না। মুই অন্য একটা কতা কইতে চাই।’
‘কী কথা, কও না।’
‘মোগো যেহেতু আয়-রোজগার কম। মোরা আলাদা খাই? হেগো লগে খাওয়ার কী দরকার? আমনে মোর কতাডা খারাপভাবে নিয়েন না। মুই অভাবরে ডরাই না। ডরাই মাইনষের কতারে।’
মুকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বুজছি। মোরা ত একসময় আলাদাই খাইতাম।’
‘আফার ধারে হুনছি। মিনাবু যে অসুস্থ আছিল, তহন আবার একলগে খাওয়া শুরু করছেন।’
‘কিন্তু জেসমিন, কাঠের কাম ছাড়া মুই কোনো কামই জানি না। আর মুক্তিযুদ্ধের পর কামকাইজের অবস্থা ভালো না। আইজ আছে, কাইল নাই। এক্কালে আলাদা অইয়া গেলে এহনকার মতো সময়ে করমুডা কী?’
‘আল্লাহই পথ দেহাইবে। কিছু না কিছু উপায় তো বাইরইবেই।’ মুকুল এ বিষয়ে আর কিছু বলল না। ভাবতে লাগল কী করা যায়! রাতে ঘুমানোর আগে জেসমিন বলল, ‘আমনেরা ধান করেন না ক্যা?’ মুকুল বলল, ‘অত জমিজিরাত তো মোগো নাই। তা ছাড়া ধান হেদ্ধ, হুগনা, কেডা করবে কও? ভাবি বেশির ভাগ সময় থাকে অসুস্থ। মিনা পারত না। এসব কারণেই কোনো দিন করা অয় নাই।’
‘জমি কি মোডেও নাই?’
‘আছে কিছু।’
‘তহেলে লন মোরা ধান চাষ করি। চাউলডা তো অন্তত কেনা লাগবে না। ধানের সব কাম মুই জানি। মুই করমু।’
‘তুমি পারবা?’
‘পারমু না ক্যা?’
‘আচ্ছা, মুই অবশ্য ধানের সিজনে মাইনষের জমিতে বর্গা দেই। জমির সব কাম পারি। হেদ্ধ করতে পারি না দেইখা নিজেগো জমিতে করা অয় না। তুমি পারলে নিশ্চয়ই করমু।’
‘আর কী করবেন, জানেন?’
‘কী?’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মুকুল। জেসমিন বলল, ‘এই যে এত কেজিতে কেজিতে মাছ ধরেন। এগুলা হাটে নিয়া বেচবেন। ম্যালা টাহা পাইবেন।’
‘কও কি তুমি? মুই কি জাইল্লা? কেডা কেনবে মোর মাছ?’ জেসমিন কড়া গলায় বলল, ‘মানুষ কি জাইল্লাগো চেহারা মুখস্থ কইরা রাহে? হেগো ধারে ছাড়া মাছ কেনে না?’
‘তা না। তয় মুই বেশি মাছ ধরলে তো মাগনাই কতজনে লইয়া যায়। কেনবে কেডা, হেই চিন্তা করতেয়াছি।’
‘এহনেইত্তা কেউরে মাগনা দেবেন না। মাছ লইয়া সোজা হাটে।’
‘কিন্তু বউ, মাছ তো সব সময় পাওন যায় না।’
‘যহন পাইবেন না, তহন অন্য কিছু করবেন। যহনেরডা তহন দেহা যাইবেয়ানে।’
জেসমিন বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। সে পালিয়ে আসার সময় তার মা যে টাকাগুলো দিয়েছিল, তার প্রায় সবই রয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে কিছু টাকা বের করে মুকুলের হাতে দিয়ে বলল, ‘কাইল এইয়া দিয়া বাজার কইরা আনবেন।’
‘টাহা কই পাইছ?’
‘জমাইন্যা টাহা।’
মুকুল টাকা ফেরত দিয়ে বলল, ‘না না। লাগবে না। তোমার জমাইন্না টাহা মুই ভাঙমু না। তুমি রাহো। বাজার মুই একভাবে আনমুয়ানে।’
‘রাহেন না। টাহা দিয়া মুই করমুডা কী? মোর টাহা আর মুই—সব তো আমনেরই।’
মুকুল এ কথায় হেসে দিল। মেয়ে জিততে জানে, তা মানুষের মনই হোক বা পরিস্থিতি!
সকালবেলা মুকুল বাজার করে আনল। জেসমিন রান্না করতে যাওয়ার আগেই রেনু বলল, ‘আম্মার কতায় তুই আলাদা হবি?’
জেসমিন মাথা নিচু করে বলল, ‘মাফ করবেন, আফা। আমনেগো লগেই তো আছি। খালি আলাদা খামু। আর নাইলে তো উনি খাওনের খোঁড়া দিতেই থাকপে। আইজ মোগো পোলাপান অবুজ, অরা তো একদিন বড় অইবে। হে সময় এই সব হুনলে অগো মন ছোডো অইবে না, কন?’
এ কথার পর রেনু আর কিছু বলতে পারল না। জেসমিন তো ভুল কিছু বলে নি। একটা বেলা এভাবে গেল। বিকেলবেলাই আব্বাস এসে ঘরের দরজায় দাঁড়াল। গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘মুকুল ঘরে আছোস নিহি?’
জেসমিন বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিল। মুকুল মধুর সাথে খেলছিল। আব্বাসের গলা শুনে জেসমিন বাচ্চাদের রেখে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ঘোমটা দিল। মুকুল দরজা খুলে বলল, ‘ভাইজান, আহেন, ঘরে আহেন।’
আব্বাস ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘অসময়ে আইয়া তোমাগো বিরক্ত করলাম।’
জেসমিন চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কী যে কন, ভাইজান, আমনের যহন ইচ্ছা আইবেন। বহেন।’
আব্বাস বসে মুকুল ও জেসমিনের উদ্দেশে বলল, ‘তোমরা আলাদা খাওনের সিদ্ধান্ত নিছ, এতে ভুল কিছু নাই। তোমাগো এমন কথাই কওয়া হইছে যে তোমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হইছ। শুধু তোমারে না, সবার লগেই ওনার এমন ব্যবহার। রেনুর পুরা জীবনডারে কয়লা বানাইছে উনি। প্রতিবাদ করলে আমারও তাই হোনা লাগছে, মুকুলের এহন যা হোনা লাগে। কিন্তু কথাগুলো যে কইছে, সংসারডা তো তার না। যেকালে তার আছিল, হেকালে হে নিজেই মোগো আলাদা কইরা দিছিল। মোরা আলাদা খাইছি কিন্তু সংসারটা এহন মোগো তিন ভাইয়ের। মামুন কিছু টাহা পাড়ায় মোগো দুই ভাইয়ের নামে। মোর একলার লাইগ্যা না।’
একটু থেমে আব্বাস আবার বলল, ‘দেহো, হে মোগো মা, ফালাইয়া তো দিতে পারি না। তাই নানান অন্যায্য কথাও সহ্য করি। তোমরা এইভাবে আলাদা অইয়া গেলে মনে বড় কষ্ট পামু। মুকুল-মামুন অরা মোর চেয়ে বয়সে অনেক ছোডো। মুই আর রেনু কোনো দিন অগো ভাইয়ের চোখে দেখি নাই। সন্তানের চোখে দেখছি। মোর সন্তান যদি হারা জনম মোর ঘরে বইয়া খায়, মোর তো কোনো সমেস্যা নাই। কিন্তু মুই জানি মুকুল আবার কোনো না কোনো কাম পাইয়া যাইবে। আর এই যে ও এত মাছ ধইরা আনে, এতে তো মোগো বাজারের খরচ অর্ধেকের বেশি বাঁইচ্চা যায়। হিসাব করলে তো বহুপিলেই করোন যায়। মোগো কামই এমন, আইজ আছে কাইল নাই। আইজ মুকুলের কাম নাই, কাইল হয়তো থাকপে। আইজ মোর কাম আছে, কাইল হয়তো থাকপে না। হেকালে কি তোমরা মোরে খাওয়াবা না?’
মুকুল অস্বস্তিবোধ করল। বলল, ‘ভাইজান, কী কন এগুলা!”
জেসমিন বলল, ‘মাফ কইরা দেন, ভাইজান। মোরা আলাদা হমু না।’
আব্বাস বললেন, ‘মাফ চাইও না, বুইন। মাফ চাওয়ার মতো কিছু করো নাই। মুই তো পেরতমেই কইছি, তোমাগো সিদ্ধান্তে ভুল নাই। তবু মোর কথায় সিদ্ধান্ত বদলাইছ, মুই খুব খুশি অইছি। তোমাগো ভাবি আরও খুশি অইবে।’
জেসমিন এই সুযোগে ধান চাষের কথাটা বলল। আব্বাস অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু এত ঝামেলা করবে কেডা? মুই তো চাষবাস পারি না। তা জমির কাম মুকুল একলাই দশজনেরডা পারে। এইডা লইয়া চিন্তা নাই। কিন্তু আব্বায় যহন চাষ করত, ৩০ মণ ধান অইত। এত ধান হেদ্দ করবে কেডা? তোমাগো ভাবি তো হারা বছর অসুস্থই থাহে, জানো তো?’
জেসমিন বলল, ‘১০০ মণ আইন্না দেন। মুই একলাই পারমু।’
জেসমিনের আত্মবিশ্বাস দেখে আব্বাস হেসে দিল। তারপর বলল, পারলে করো। মুই এই বয়সে আর কী সাহায্য করতে পারমু জানি না। তয় তোমাগো লগে আছি। যহন যা লাগে, কইও।’
আব্বাস যাওয়ার আগে বলল, ‘আম্মা হাবিজাবি কইবেই। এইডা হের স্বভাব। হের মুখ বন্ধ রাহোনের ওষুধ অইল শক্ত হওয়া। হে অইলো শক্তের ভক্ত, নরমের যম।’
.
একদিন সকালে মুকুল অনেকগুলো মাছ ধরে আনল। জেসমিন সেখান থেকে কিছু মাছ সরিয়ে রেখে পাল্লা-পাথর দিয়ে বলল, ‘আইজ হাটবার। যান, মাছগুলা হাটে লইয়া যান। হাটে এই সব মাছের যা দর আছে, অই রকম দামে বেচবেন।’
মুকুল ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘জেসমিন, কেউ কেনবে না মোর মাছ। গৃহস্থগো কোনো জিনিসই গেরামের মানুষ কেনে না, হাসে।’
জেসমিন কড়া গলায় বলল, ‘হাসলে হাসবে। আল্লায় মুখ দিছে হাসার জন্য। আমনেরে জিগাইয়া হাসবে নিহি? আর মাছ না কিনলে নাই। আমনেরে কইছি যাইতে, আমনে যাইবেন। আর আমনে যাইতে না পারলে মুই যামু মাছ লইয়া।’
‘পাগল অইছ তুমি!’
এ কথা বলে মুকুল মাছ নিয়ে হাটে গেল। রেনু এই কাণ্ড দেখে হেসে মরে। জেসমিন মাছ কুটতে বসে বলে, ‘আমনের দেওরের নাকভরা খালি শরম। এহ্, আইছে নবাবে। মাছ বেচতে যাইতে ওনার শরম করে।’
রেনু হেসে বলল, ‘নায়ক মানুষ, মাছ বেচলে মাইনষে কি-না-কি কয়! ইজ্জত থাকপে? ফিরিতে বিলাইলে তো ম্যালা ইজ্জত বোজো না?’
‘নায়ক?’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল জেসমিন। রেনু বলল, ‘যাত্রাদলের নায়ক আছিল না? সবাই তো হের পালা দেকতে খুব পছন্দ করত।’
‘হাছা নি? কই, মোরে তো কিছু কইল না?’
‘ছাইড়া দেছে তো। হেল্লাইগ্যা মনে অয় কয় নাই।’
কথায় কথায় রেনু মুকুলের যাত্রাপালা নিয়ে বাড়িতে হওয়া সব অশান্তির কথাই বলল। সব শুনে জেসমিনের বড় মায়া লাগল।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই মুকুলের সব মাছ শেষ হয়ে গেল। সবাই জানে মুকুল খাল থেকে মাছ ধরে। সুতরাং চাষের মাছ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হাটবাজার চাষের মাছে সয়লাব হয়ে গেছে। কোনো স্বাদ নেই সেসব মাছে। তাই ফুরফুর করে সব বিক্রি হয়ে গেল। মাছ বিক্রির টাকায় আগামী দুই সপ্তাহ সংসারের সব বাজার অনায়াসে হয়ে যাবে। খুশিতে সে কী করবে বুঝতে পারছে না। জেসমিনের জন্য কিছু নেবে বলে সারা হাট ঘুরল। একটা শাড়ি খুব পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু শাড়িটার যা দাম, তাতে আরও টাকা লাগবে। তাই শাড়িটা রেখে আবারও ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ একটা আয়না আর এক ডজন কাচের চুরি কিনল। ঘরের আয়নাটা ভেঙে গেছে। সেটাই বিনাবাক্যে ব্যবহার করছে জেসমিন। মুরব্বিরা বলে ভাঙা আয়না ব্যবহার করলে অমঙ্গল হয়। তাই আয়না কেনাটা জরুরি। হরেক রকম খাবারের দোকান বসেছে। কিন্তু জেসমিন যে কী খেতে পছন্দ করে, সেটাই তো জানে না সে। ছি! কী খারাপ স্বামী! নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিল। পরে তার মনে পড়ল, মিনা হাটের নারকলি খেতে পছন্দ করত, এটা সে জানত। তার মানে সে খারাপ স্বামী না। জেসমিন নতুন বউ আর বিয়ের পর থেকে তার হাতে টাকাপয়সা ছিল না বলেই জানা হয় নি। আজই জেনে নেবে। পরের হাটে তাই কিনে নেবে।
.
মুকুল যখন বাড়ি ফিরল, ততক্ষণে জেসমিনের রান্নাবান্না শেষ। সে পুকুরে গেছে গোসল করতে। বাচ্চারা রেনুর কাছে। এই সুযোগে মুকুলও গেল। পুকুরপাড়ের হিজলগাছ থেকে ফুল পড়ে ছেয়ে গেছে পুকুর। তার মধ্যে সাঁতার কাটছে জেসমিন। কী অপূর্ব দৃশ্য! জেসমিন মুকুলকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘কি, অইছে না সব মাছ বেচা?’
মুকুলও পানিতে নেমে গেল। কাছাকাছি গিয়ে বলল, ‘তুমি জানতা সব মাছ বেচা অইবে?’
জেসমিন হেসে বলল, ‘না, তয় জানতাম কিছু তো অইবেই। আর এহন আমনের দাঁত কেলানি দেইক্কা বুইজ্জা গেছি যে সব বেচা অইয়া গেছে।’
মুকুল হো হো করে হেসে দিল। তারপর বলল, ‘তুমি ঠিকই কইছ, মোর আসলে বাড়তি মাছগুলা বেইচ্চা দেওন দরকার। মাছের যে এত দাম, হেইয়াই তো জানি না।’
জেসমিন পানি ছিটিয়ে বলল, ‘দেখলেন তো, মোর কতা হুনলে কোনো দিন ঠকবেন না।’
‘হুম, আচ্ছা জেসমিন, তুমি কী খাইতে সবচেয়ে পছন্দ করো?’
জেসমিন কাছে এসে বলল, ‘মধুর বাপেরে।’
তারপর নিজেই আবার লজ্জা পেয়ে সরে গেল। মুকুল হেসে দিল জেসমিন জোরে সাঁতার কাটতে শুরু করল। মুকুল সাঁতরে তাড়া করল। তারপর একসময় ধরে ফেলে বলল, ‘তহেলে খাও।’
জেসমিন বলল, ‘আরে, ছাড়েন ছাড়েন, কেউ দেইখ্যা ফালাইবে।’
জেসমিন উঠে গেল। মুকুলের আজ কী যে ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ মন খুলে সাঁতার কাটল। ঘরে যেতেই জেসমিন ধমকে বলল, ‘পয়সা পাইয়াই একদম উড়ানি শুরু হইয়া গেছে, না?’
মুকুল প্রতিবাদ করল, ‘আরে না। ভাঙা আয়না দেখলে অমঙ্গল অয়। ভাবিরে জিগাইয়া দেহো। এল্লাইগ্যা আনছি।’
জেসমিন এবার মুচকি হেসে বলল, ‘তয় কাচের চুরি মোর খুব ভাল্লাগে। নেন, পরাইয়া দেন।’
মুকুল চুড়ি পরিয়ে দিয়ে হাতটায় চুমু খেল।
বিয়ের পর প্রথম ঈদ। কোনোমতে বাচ্চাদের কাপড় আনলেও জেসমিনকে একটা শাড়ি কিনে দিতে পারল না মুকুল। এ কারণে তার মন খুবই খারাপ। সারা দিন জেসমিন নানান কাজে ব্যস্ত ছিল। রাতের বেলা মুকুলকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঈদের দিন অমন মুখ কালা কইরা রাকছেন ক্যা? কী অইছে?’
মুকুল জেসমিনের হাত ধরে বলল, ‘বিয়ার পর প্রথম ঈদ, অথচ তোমারে একটা শাড়ি দিতে পারলাম না। সারা বছর ত কিছুই দিতে পারি না। ঈদেও পারলাম না।’
জেসমিন হেসে বলল, “ধুর, মুই কি পোলাপান নিহি যে মোর ঈদ আইলেই নতুন কাপড় লাগবে? কাপড় তো আছে। এইগুলা দিয়া যত দিন চলে, তত দিন আর দরকার নাই। এইগুলা ছিঁড়লে দিয়েন।’
‘হাচা কতা কওদি, তোমার মনখারাপ হয় না?’
জেসমিন মুকুলের বুকে মাথা রেখে বলল, ‘আমনে মোরে যে দামি জিনিস দিছেন, এরপর মোর আর কিছুই চাওয়ার নাই।’
অবাক হয় মুকুল। বলে, ‘কী দিছি? মুই তো তোমারে কিছুই দেই নাই।’
জেসমিন মাথা তুলে মুকুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঘর দিছেন।’
এ কথার পর মুকুলের বুকের ভেতরটা আর্দ্র হয়ে যায়। আর কিছু বলতে পারে না সে।
.
সকাল সকাল কোদাল হাতে মাটি খুঁড়ছে জেসমিন। মুকুল জানালা দিয়ে এই কাণ্ড দেখে অবাক হয়। বাচ্চারা সজাগ। ওদের রেখে কীভাবে যায়? তাই ওদের দুজনকে দুহাতে কোলে নিয়ে জেসমিনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই, কী করো এই সব? মাডি খোঁচো ক্যা?’
জেসমিন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমনে অগো লইয়া এহেনে আইছেন ক্যা?’
মুকুল কড়া গলায় বলল, ‘আগে মোর প্রশ্নের উত্তর দেও।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘গাছ লাগামু। চিন্তা কইরা দেখলাম, শাকসবজি বাবদ ম্যালা টাহা খরচ অইয়া যায়। এইগুলা যদি নিজেগো গাছে অয়, হেলে তো টাহাগুলা বাঁইচ্চা যাইবে।’
‘আরে পাগল মাইয়া, এই মাডি ভালো না। কিচ্ছু গজায় না এই মাডিতে।’
জেসমিন মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, ‘মাডি হইল সোনা। ঠিকঠাক লাগাইতে পারলে সব গজাইবে। দেইখেন আমনে। এহন পোলাপান লইয়া যান দিহি। খালি কামের সময় বিরক্ত করে।’
‘উফ্!’
মুকুল বিরক্ত হয়ে বাচ্চাদের রেনুর কাছে রেখে এল। তারপর কোদালটা জেসমিনের হাত থেকে টেনে নিয়ে বলল, ‘দেও আমার ধারে। কতডু মাডি কাটতে অইবে, কও।
জেসমিন হাসল। তারপর হাতের ইশারায় একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে বলল, ‘এহেনে এতহানি জাগা গর্ত কইরা দেন। হেরপর খালেইত্যা কচুডি আইন্না গর্ত ভইরা দেবেন।’
‘কচুডি দিয়া কী অইবে?’
‘পচামু। হেরপর হেইয়ার মইধ্যে তরকারির বিচি লাগামু। চারা গজাইলে হ্যাষে তুইল্লা জাগামতো লাগাই দিমু।’
‘কচুড়ির মইধ্যে চারা?’
অবাক হয় মুকুল। জেসমিন বলল, ‘দেইখ্যেন কত মোড়া মোড়া চারা গজায়। মাডিতে বিচি হালাই রাহেন দেইক্কাই তো আমনেগো গাছ অয় না আর কন যে মাডি ভালো না। গাছ অইলো পোলাপানের লাহান। যত্ন করন লাগে।’
ঘটনা যে সত্য, সেটার প্রমাণ পাওয়া গেল কিছুদিন পর। অবিশ্বাস্য রকমের স্বাস্থ্যবান চারা গজিয়েছে। শুধু মুকুল নয়, রেনুও বেশ অবাক হয়েছে। মুকুল বলল, ‘তুমি আর কী কী জানো, কও দেহি?’
রেনু না থাকলে জেসমিন হয়তো এখন একটা দুষ্টু কথা বলত। রেনু থাকায় দুষ্টুমি গিলে ফেলে বলল, ‘বেশি কতা না কইয়া মোর লগে হাত লাগান। বাড়ির দক্ষিণ পাশে ভালো রদ্দুর পড়ে। হেহেনে লাগামু চারাগুলা।’
বাচ্চারা রেনুর কাছে রইল। মুকুল ও জেসমিন একে একে সব চারা যত্ন করে তুলে জেসমিনের নির্বাচিত জায়গায় লাগিয়ে দিল। তারপর বাগান থেকে বাঁশ কেটে আনল মুকুল। যেসব সবজির জন্য মাচা দরকার, সেসব সবজিগাছের ওপর মাচাও বানিয়ে দিল
দুমাস পর থেকেই গাছ ভরে শাকসবজি হওয়া শুরু করল। ফলন দেখে জেসমিন নিজেই অবাক হয়ে গেছে। অবশ্য এসব শুধু শুধু হয় নি। গরুর গোবর শুকিয়ে সার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া তরকারির খোসা, হাঁস- মুরগির বিষ্ঠা, লাকড়ির ছাই—এসব মাটির সাথে পচিয়ে সার বানিয়ে দিয়েছে। এর পর থেকে জেসমিন কাজগুলো এমনভাবে করা শুরু করল, যাতে সারা বছরই কোনো না কোনো শাকসবজি গাছে থাকে। কিনতে তো হলোই না, উল্টো প্রতি হাটবারে মুকুল শাকসবজি বিক্রি করে। মাছ ধরা না পড়লেও তাকে শাকসবজি বিক্রি করতেই প্রতি হাটে যেতে হয়।
এর মধ্যেই আরেক বুদ্ধি এল জেসমিনের মাথায়। সব বীজ যদি না গজায়, তাই সে একটু বেশি করেই বীজ বোনে। প্রতিবারই প্রায় সব বীজ থেকে অনেক চারা হয়ে যায়, যার অর্ধেকও তার লাগে না। এত গাছ লাগানোর জায়গা তাদের বাড়িতে নেই। একদিন সে বাড়তি চারাগুলো মুকুলের হাটের ঝুড়িতে তুলে দিয়ে বলে, ‘দেহেন চারাগাছ কেউ কেনেনি। এতগুলা চারা নষ্ট হইবে, মায়া লাগে। অল্প দামে দিয়া দিয়েন।’
‘আচ্ছা।’
মুকুল হাট থেকে ফিরে হাসতে হাসতে বলে, ‘আমার মনে অয় তুমি মোর হাটের হাজিতে (বড় ঝুড়ি) বিষ দিয়া দিলে হেইয়াও বেচা অইয়া যাইবে। তোমার এত মোডাতাজা চারাগাছ দেইক্কা মাইনষে তো পারলে লুটপাট কইরা লইয়া যায়। একটাও ফিরাই আনতে পারি নাই, সব বেচা শেষ। আবার কেউ কেউ জিগায় ফুলের চারা আছেনি! দেখসোনি অবস্থাডা!”
এর পর থেকে আরও বেশি বেশি বীজ বোনে জেসমিন। আশপাশে অনেক হিন্দুবাড়ি আছে। সেসব বাড়ি ঘুরে ঘুরে ফুলের বীজ সংগ্রহ করে, যেসব গাছের ডাল থেকে চারা বানানো সম্ভব, সেসব গাছের ডাল আনে। এইভাবে করে সে ফুলের চারাও তৈরি করা শুরু করে।
সবজি, চারাগাছ আর মাছের সিজনে মাছ—সবকিছু মিলে এত জিনিসপত্র হয়ে যায় যে এখন মুকুল আর একবারে সব জিনিস নিতে পারে না। ইমরান ও মধুকে পাহারায় রেখে সে তিন-চারবার আসা-যাওয়া করে জিনিসপত্র নেয়।
এই অঞ্চলে চারাগাছের যে এত চাহিদা, জেসমিন তা কল্পনাও করে নি। তাদের এলাকায় তো চারাগাছ কেউ কেনে না। সবাই যার যার মতো করে তৈরি করে নেয়।
ধান লাগানোর সময় হয়েছে। বীজতলা থেকে চারা উঠিয়ে মুকুল জমিতে রোপণ করতে গেছে। যাওয়ার পর থেকেই চিন্তা হচ্ছিল জেসমিনের। তাই সে বাচ্চাদের দায়িত্ব নীলাকে এবং রান্নার দায়িত্ব রেনুকে দিয়ে খেতে গেল। যাওয়ার সময় মুকুলের জন্য কিছু নাড়ু আর মুড়ি নিয়ে গেল। মুকুল তাকে দেখে বলল, ‘কী ব্যাপার, তুমি? বাড়িতে কিছু অইছে?’
‘না, কী অইবে? আমনের কিছু লাগে নিহি জানতে আইছি।’
মুকুল হেসে বলল, ‘নাকি আমার লাইগা মন পুড়ে?’
জেসমিন হাসতে হাসতে বলল, ‘আমনে যা মনে করেন। নেন, এইগুলা খাইয়া লন।’
মুকুল হাত ধুয়ে খেয়ে নিল। এরপর আবার কাজ শুরু করল। এরপর জেসমিন আচমকাই জমিতে নেমে চারা লাগাতে শুরু করল। মুকুল চমকে উঠে বলল, ‘আরে, করো কী, করো কী?’
তারপর খেয়াল করল, জেসমিন একদম সঠিক নিয়মে চারা রোপণ করছে। মুকুল অবাক হয়ে বলল, “এই, তোমাগো অঞ্চলে কি বেডিরাও খেতে কাম করে?’
জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। তারপর বলল, ‘না। তয় মুই সবই করতাম। যহন যেডা মনে চাইত, করতাম, আবার মনে না চাইলে কিছুই করতাম না।’
মুকুল হাসল। তারপর একটু কড়া গলায়ই বলল, ‘অইছে অইছে। শখ মিটছে না? এহন বাড়ি যাও।’
‘না। মুই আমনের লগে ধান লাগামু।’
মুকুল মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘মাইয়া কয় কী! মোগো দ্যাশে মাইয়া মাইনষে খেতে কাম করে না। এহনই বাড়ি যাও।’
জেসমিন হাত নেড়ে নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘দেহেন, আমনে একলা ধান লাগাইলে পুরা জমিতে লাগাইতে চাইর দিন লাগবে। আর আমনের লগে মুইও যদি লাগাই, হেলে দুই দিনেই অইয়া যাইবে। মুই থাকতে আমনেরে একলা রদ্দুরে পুড়তে দেই ক্যামনে?
‘চুপ থাহো তুমি। এক্ষণ বাড়ি যাও। পোলাপানে কানবে।’
‘কানবে না। নীলারে অরা ম্যালা পছন্দ করে। নীলাও অগো রাখতে জানে। আর আফাও তো আছে।’
‘দুধ খাওয়ার লাইগ্যা কানবে।’
জেসমিন প্রতিবাদ করল, ‘অরা এহন আর দুধের শিশু নাই। এক বছর অইয়া গ্যাছে, আর কত দুধ খাইবে?’
‘তুমি কি পাগল, জেসমিন?’
‘হয়, মুই পাগল। আওয়ার সময় পোলাপানরে খাওয়াইয়া আইছি। দুহাইর্যা ভাত খাইতে যাইয়া আবার খাওয়াইয়া আমু। এর মইধ্যে খিদা লাগলে আফায় ভাত খাওয়াই দেবেয়ানে।
মুকুল কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। জেসমিনও। শেষমেশ মুকুল বলল, ‘তোমার জেদের লগে দুনিয়ার কেউ পারবে না। এক ব্যাডা মাতারি। নেও, শুরু করো।’
জেসমিন দাঁত কেলিয়ে কাজ শুরু করে দিল। শাড়িটারি গোছালো না। সে যেমন ঘোমটা দিয়ে থাকে, তেমন করেই ঘোমটা দিয়ে কাজ করতে লাগল। বেলা গড়াতেই সত্যি মুকুল অবাক হলো। সে যে গতিতে কাজ করছে, জেসমিনও একই গতিতে কাজ করছে।
কাজের মাঝেই রাস্তা থেকে একটা ডাক শুনতে পেয়ে মুকুল ঘুরে তাকাল। লোকটা বলল, ‘কী মুকুল ভাই, এইবার নিজের জমিতেই ধান করতেয়াছনি?’
মুকুল হেসে বলল, ‘হয় ভাই।’
‘তা লগে কেডা? ভাবি নিহি?’
জেসমিনের কোনো হেলদোল নেই। সে তাকালও না। মুকুল বলল, ‘হয়, আমনেগো ভাবি।’
‘তোমার কি এতই খারাপ অবস্থা অইছে যে ভাবিরেও খেতের কামে নামাইছ! ছি ছি!’
এইবার জেসমিন ঘুরে তাকাল। মুকুল কিছু বলল না, একটু অস্বস্তি বোধ করল। জেসমিন বলল, ‘আহা রে মিয়াভাই, দেইক্কা কি কষ্ট অইতেয়াছে? তহেলে আমনের বউরেও দিয়া যান। হকালে কাম শ্যাষ অইবেয়ানে।
লোকটা স্বপ্নেও ভাবে নি মুকুলের বউ এমন কিছু বলবে। ‘নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ বলতে বলতে সে প্রস্থান করল। মুকুল হেসে দিল। জেসমিন রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, ‘কেডা এই হারামজাদা?”
মুকুল মিটিমিটি হেসে বলল, ‘তেমন কেউ না। প্রতিবেশী। কিন্তু জেসমিন, তুমি যদি এ রহম করো, মাইনষে কী কইবে?
‘মাইনষে আমনেরে এক বেলা মাগনা ভাত দেবে?’
মুকুল হেসে বলল, ‘না।’
‘তহেলে মাইনষের কতা চিন্তা করা বাদ দেন। মোর সামনে আমনেরে কেউ হাবিজাবি কইয়া হেরপর যদি হে মইরাও যায়, হের আত্মারেও ছাইড়া দিমু না, মনে রাইখেন।’
‘এত ভালোবাসো মোরে?’
জেসমিন এই প্রশ্নে লজ্জা পেল। সে আবার তার কাজ শুরু করে বলল, ‘বেশি কথা কন। কাম করেন তো।’
হীরা এখনো কথা বলতে পারে না। কিন্তু আয়না টুকটাক কথা বলা শিখেছে। আজ সে মুকুলকে আব্বা বলে ডেকেছে। মুকুলের খুশি দেখে কে! যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে। সে নানান কায়দায় আয়নাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে, যাতে আয়না বারবার আব্বা ডাকে। আয়নাকে নিয়ে মুকুলের এই সব পাগলামি দেখে জেসমিনের চোখ ভিজে যায়। অনেক নারীই স্বামীর আগের স্ত্রীর সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। এটা এই সমাজে স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো পুরুষ কি স্ত্রীর আগের স্বামীর সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতে পারে? মুকুলকে না দেখলে জেসমিন কোনো দিন বিশ্বাস করতে পারত না। সে রাতে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে জেসমিন মুকুলকে জিজ্ঞেস করল, ‘মুই যদি আমনের ধারে কোনো কিছু গোপন করি, আমনে কি রাগ অইবেন?’
মুকুল হেসে বলল, ‘গোপন করার কারণ থাকলে না-ও অইতে পারি।’
জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বিপদের সময় সবার আগে ডাক্তার সাব মোরে আশ্রয় দিছিল, হে গোপন করতে কইছিল। নাইলে ওই সময় ওই আশ্রয়টুক পাইতাম না। তয় আমনের মতো মানুষের ধারে কিছুই গোপন করা উচিত না। আরও আগেই সব কইয়া দিলাম না ক্যা?’
জেসমিনের চোখে জল দেখে আর এসব শুনে মুকুল তাকে বুকে টেনে নিল। তারপর বলল, ‘কিছু অইবে না, বউ। এহন কইতে চাইলে কইতে পারো। রাগ হমু না। না কইতে চাইলেও সমেস্যা নাই। না জাইন্নাই তো আল্লাহর রহমতে মোরা সুখে আছি।’
জেসমিন উঠে বসল। মুকুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খালি যে গোপন করছি, তা না, মিছা কতাও কইছি। মুই আসলে এতিম না। বাপ, মা, ভাই, ভাবি—সবই আছে। শ্বশুরবাড়ি থিকা তাড়াইয়াও দেয় নাই। মুই নিজেই পলাইয়া আইছিলাম।’
‘কও কী!’
চমকাল মুকুল। জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘রঞ্জু এমনে এমনে মরে নাই। অরে খুন করা অইছে। আর খুন করছে মোর ভাইয়েরা, মোর বাপের হুকুমে।’
মুকুল এবার উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল। জেসমিন একে একে সব বলল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। সব শুনে মুকুল বলল, ‘ভাগ্য ভালো, ডাক্তারের পরামর্শ হুইন্না সব গোপন রাখছ। এইয়া জানলে এই গেরামে কেউ জাগা দিত না তোমারে।’
‘আমনেরেও যে কই নাই, এল্লাইগ্যা রাগ হন নাই?’
মুকুল জেসমিনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আরে না। তয় এত তেজ তোমার কইত্তা আইছে এইবার বুঝতে পারছি।’
এ কথায় জেসমিন হেসে দিল। মুকুল তখন হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা জেসমিন, এত আরাম-আয়েশে বড় অইছ, আমার ঘরে আইয়া তো খালি কষ্টই করতেয়াছ। কোনো দিন আফসোস হয় না তোমার?’
জেসমিন এবার মুকুলের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘না, কত বড় বিপদে আছিলাম, দিনরাত কী পরিমাণ কষ্ট আর অত্যাচার সহ্য করছি, তা আমনে জানেন না। খালাম্মায় আছিল দেইখা রক্ষা। ওই তুলনায় আমনের ঘর স্বর্গ। আমার প্যাটে বাচ্চা না থাকলে নিজেরে শ্যাষ কইরা দিতাম। কিন্তু আয়নারে জন্ম দেওয়ার লাইগ্যা বাঁইচ্চা আছিলাম।’
তারপর মুকুলের মুখটা দুহাতে ধরে আবার বলল, ‘আর এহন আমনের লাইগ্যা, মোগো তিন পোলামাইয়ার লাইগ্যা হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে।
‘আল্লাহ তোমার মনের আশা পূরণ করুক।’
মুকুল আবার জেসমিনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এই সব কতা আর কাউরে কইও না, জেসমিন। কিছু সত্য গোপন থাহা ভালো।’
.
আপাতদৃষ্টে বিষয়টি মুকুল খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে মনে হলেও, বাস্তবে তা নয়। মুকুল খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। জেসমিন এত প্রভাবশালী বড়লোকের মেয়ে, তা ছাড়া শিক্ষিত-বড়লোকের ঘরের বউ ছিল, ভাবলেই ভয় হচ্ছে। সে কোনো দিক দিয়েই জেসমিনের যোগ্য না, ভাগ্যগুণে ঘটনাচক্রে পেয়ে গেছে।
বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সে জেসমিনকে তেমন কিছুই দিতে পারে নি। দিয়েছে শুধু অভাব আর কষ্ট। বাপের বাড়ি থাকতে যে মেয়ে নিজের ইচ্ছা না হলে একটা সুতাও নড়ায় নি, সেই মেয়েটা কী না করেছে তার ঘরে এসে! সব জানার পর থেকে প্রচণ্ড হীনম্মন্যতায় ভুগছে মুকুল।
জেসমিন বিষয়টা ধরতে পারল আরও কিছুদিন পর, যখন ধান কাটা হলো। জেসমিন ধান সেদ্ধ করতে গেলে মুকুল দৌড়ে গেল সেখানে। ধান সেদ্ধ করার সমস্ত পানি সে নিজেই পুকুর থেকে তুলে দিল। জেসমিন নিজে তুলতে গেলেও তাকে তুলতে দিল না। আবার বড় বড় পাতিলে ধান সেদ্ধ করে সে নিজেই নামাল। নিজেই ঢালল। জেসমিনকে ধরতেও দিল না। যেহেতু সে ধান সেদ্ধ হয়েছে কি না বোঝে না, শুধু সেইটুকু দেখার জন্যই জেসমিনকে সাথে রাখল। সেদিনের মতো কাজ শেষ করে যখন ঘরে গেল, তখনই জেসমিন ধরল মুকুলকে।
‘কী পাইছেন আমনে? এমন শুরু করছেন ক্যা?’
‘বুঝলাম না। কী শুরু করছি?’
‘ধান সেদ্ধ করার কথা ছিল আমার। আমনে করেন ক্যা?’
মুকুলের কাছে কোনো উত্তর ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করেই যেন মনে পড়ল। সে বলল, ‘খেতে কাম করার কতা আছিল আমার। তুমি করছিলা ক্যা?’
এবার জেসমিন চুপ হয়ে গেল। আয়না ও হীরার দুজনের কারোর চোখেই আজ ঘুম নেই। দুটো বাচ্চাই বেশ শান্ত। বেশির ভাগ সময় নিজেরা নিজেরা খেলে, কাউকে বিরক্ত করে না। মুকুল আয়নাকে কোলে নিয়ে বলল, ‘আহা রে, আইজ মোর আম্মাজানরে হারা দিনেও কোলে লইতে পারি নাই।’
আয়না ঠোঁট উঁচু করে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। কী, সেটা বোঝা গেল না। তার সব কথা এখনো স্পষ্ট নয়। জেসমিন হীরাকে কোলে নিল। মুকুল আয়নাকে বেশি আদর করে, এটা একদম চোখে লাগে। যাতে হীরার কখনো মনখারাপ না হয়, সেই বিষয়ে সব সময় খেয়াল রাখে সে।
জেসমিন হীরাকে কোলে নিয়ে মুকুলের পাশে বসে বলল, ‘মুই আসলে কেডা, কইত্তা আইছি—এইসব জানার পর আমনের আচরণ বদলাই গেছে। কোনো কাম করতে দিতেয়াছেন না, যতক্ষণ বাড়িতে থাহেন, সব নিজে করতে চান। এমন করেন ক্যা?’
মুকুল আমতা-আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করল। তার আগেই জেসমিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘হুনেন, আর এ রহম করবেন না। আগে যা আছিলাম, আছিলাম। হের পরে কিন্তু মাইনষের বাড়ি কাম কইরা খাইয়া আইছি, এইডাও ভুইলেন না। কামেরে ডরাই না। এহন মোর পরিচয় মুই আমনের বউ। আর মধু, আয়না, হীরার মা। অনেক সুখে আছি এই পরিচয়ে।’
কথাগুলো বলতে বলতে জেসমিনের চোখ ভিজে এল। মুকুল আয়নাকে এক হাতে নিয়ে আরেক হাতে জেসমিনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমারে হারানের ডর অইতেয়াছে, জেসমিন।’
‘এই সব ফাও ডর ঝাইড়া ফালান।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন