মৌরি মরিয়ম
প্রতিদিনই ধান সেদ্ধ করা হচ্ছে, শুকানো হচ্ছে। উঠানে ধান ছড়িয়ে দিয়ে তার ভেতরে পা গলিয়ে, পা টেনে টেনে হাঁটা, এই হলো গ্রামবাংলায় ধান নাড়ার প্রাচীন পদ্ধতি। অনবরত এভাবে নাড়তে থাকলে ধানগুলো উল্টেপাল্টে সব দিক সমানভাবে শুকিয়ে যায়। এই পদ্ধতিতেই জেসমিন ধান নাড়ছিল। সঙ্গে মুকুলও ছিল। সে জেসমিনকে দেখে দেখে কাজটা শেখার চেষ্টা করছে। দেখতে দেখতেই হঠাৎ জেসমিনের পায়ের দিকে চোখ পড়ল তার। সোনারঙা ধানের ভেতর জেসমিনের উজ্জ্বল পা দুটো কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল! তখনই মনে হলো পায়ে আলতা থাকলে আরও বেশি সুন্দর লাগত।
পরের হাটেই মুকুল জেসমিনের জন্য আলতা কিনে আনল। আলতা দেখে জেসমিন অবাক হলো। একসময় আলতা পরতে কী ভীষণ পছন্দ করত সে! সময়ের গহ্বরে হারিয়ে গেছে যেন সব! জেসমিনকে চুপ হয়ে যেতে দেখে মুকুল জিজ্ঞেস করল, “তুমি খুশি অও নাই?’
জেসমিন বলল, “একটু বেশিই খুশি অইছি। আলতা যে মোর কী পছন্দ! আমনে যে ক্যামনে মোর পছন্দের জিনিসগুলান লইয়া আহেন, বুজি না!”
মুকুল বিরক্তমুখে বলল, ‘তা পছন্দের জিনিসের কতা তো কত জিগাই তোমারে। হেই সমায় কইতারো না?’
জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাঁইচ্চা থাহার লাইগ্যা যেভু দরকার, হেডু ছাড়া ব্যাবাক ভুইল্লা গেছিলাম। হেইল্লাইগ্যা আমনে যেকালে জিগান, হেকালে আর কিছু মনে পড়ে না।’
মুকুল জেসমিনের একটি হাত ধরে বলল, ‘যাউক, এইল্লাইগ্যাই আল্লায় মনে অয় তোমার-আমার পছন্দগুলা মিলাইয়া দিছে।’
হাসল জেসমিন। সত্যিই তো, এই যে না বলতেও মুকুল তার পছন্দের জিনিসগুলো নিয়ে আসে, এ তো সৃষ্টিকর্তারই আশীর্বাদ। সেই রাতেই জেসমিন যত্নে আলতা পরল পায়ে। পরদিন যখন সেই আলতা পায়ে জেসমিন ধান নাড়ছিল, মুগ্ধ চোখে বারবার চেয়ে দেখছিল মুকুল। দৃশ্যটা ছিল তার কল্পনার চেয়েও মনোহর।
.
মুকুলদের জমিতে ৪০ মণ ধান হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছেন মোকসেদ। কারণ, তিনি এই জমি থেকে ৩০ মণের বেশি ধান কখনোই ফলাতে পারেন নি। তিনি মুকুলকে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন, ‘কী করছস ক দিহি? ওই একই জমিতে এত ধান ক্যামনে অইলো?’
মুকুল হেসে বলে, ‘কী আর করমু? যেমনে করে হেমনেই করছি। যহন যেমন যত্ন করা লাগে করছি, ফসল নষ্ট অয় নাই মোডেও।’
‘হ্যাঁ তো মুইও করতাম।’
ধান ভাঙাতে নেওয়ার সময় জেসমিনের মনে হলো ধানের পরিমাণ কম। তার আন্দাজ বলে, যতটা ধান সে সেদ্ধ করেছে, শুকিয়েছে, ততটা এখানে নেই। তাই মুকুলকে বলে দিল ধান ভাঙানোর আগেই যেন আবার মাপা হয়। মুকুল বলল, ‘কাইল না একবার মাপলাম? আবার মাইপা কী অইবে?
জেসমিন বলল, ‘আমার ধারণা, এহন মাপলে দেখপেন ৩০ মণ।’
কথাটির অর্থ যেন মুকুলও বুঝতে পারল। সে আবার ধান মাপল। সত্যি সত্যি এবার ৩০ মণ হলো। জেসমিনকে জানানোর সাথে সাথেই সে বলল, ‘এইবার বুজছেন আব্বার ধান ৩০ মণের বেশি অইতো না ক্যা?’
রাগে-দুঃখে জেসমিন কেঁদে ফেলল। মুকুল তক্ষুনি ভাইয়ের কাছে ছুটে গেল। আব্বাস তখন গ্রামের নবনির্মিত মসজিদের দরজার কাজ করছিল। দুপুরবেলা মুকুলকে ছুটে আসতে দেখে আব্বাস বলল, ‘কী রে, বাড়িতে কিছু অইছে?’
মুকুল ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ‘অনেক কিছু অইছে। আর এইডার বিচার যদি আমনে না করছেন, হেলে আইজগোই মুই বাড়িত্তা বাইরাই যামু।’
চমকে উঠল আব্বাস, ‘আরে, কী অইছে এইডা তো কবি।’
‘আম্মায় ১০ মণ ধান সরাইছে। মনে অয় বেইচ্চা দিছে। কাইল ধান হুগাইন্না শ্যাষ অইছে পরে মাপসি, ৪০ মণ অইছে। আইজ মাইপ্পা দেহি ৩০ মণ। আব্বারও আসলে ৪০ মণ ধানই অইতো। আম্মায় সব সময় ১০ মণ সরাইয়া হালাইত। কাইল যেকালে মাপসি, হেকালে আম্মায় বাড়ি আছিল না। হেল্লাইগ্যা জানে না যে কাইল মাপছিলাম। আব্বায় সব সময় ভাঙানের আগে মাপত। মোরাও হেইয়া করমু ভাবছিল। হেইয়াই করতাম, তয় পেরতমবার নিজের জমিতে ধান হওয়াইছি, হেই খুশিতে কাইলই মাপছিলাম।’
আব্বাস কাজে বিরতি দিয়ে তখনই মুকুলের সাথে বেরিয়ে পড়ল। বাড়ি ফিরে হালিমাকে জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই তিনি ঘাবড়ে গেলেন এবং অস্বীকার করলেন। ঘাবড়ে যাওয়া দেখেই আব্বাস বুঝে গেল যে মুকুল ঠিকই ধরেছে। এরপর আব্বাস একটা টোপ ফেলল।
বলল, ‘আম্মা, মিছা কতা কইয়া লাভ নাই। আমনেরে একজন দেখছে ধান সরাইতে। ধান কী করছেন, হেইয়া কন। কই রাখছেন? নাকি বেইচ্চা দিছেন?’
একসময় হালিমা স্বীকার করলেন। কিন্তু ধান ফেরত দিতে পারলেন না। ধান তিনি পাশের বাড়িতে বিক্রি করে দিয়েছেন। রাতের অন্ধকারে নিতে হবে, এই শর্তে কম মূল্যে বিক্রি করেছেন। ধান বিক্রির টাকাও ফেরত পাওয়া গেল না। সে টাকা কানপাশার কিস্তি বাবদ সেকরাকে দিয়ে দিয়েছেন। জেসমিন পালিয়ে আসার সময় তার কানে এক জোড়া সোনার দুল আর গলায় একটা চেইন ছিল। সেগুলো খুলে হালিমার হাতে দিয়ে বলল, ‘আম্মা, এইগুলা আমার চেয়ে আমনের বেশি দরকার। আমনে পরেন।’
হালিমা চুপ করে রইলেন। জেসমিন নিজের ঘরে চলে গেল। মুকুল পেছন পেছন গিয়ে দেখে সে কাঁদছে। মুকুল জেসমিনের হাত দুটো ধরে আকুল গলায় বলল, ‘আমারে মাফ কইরা দেও। তোমার এত কষ্টের ফসলের হেফাজত মুই করতে পারলাম না।’
জেসমিন কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘মোর ফসল কইতেয়াছেন ক্যা? ওগুলা মোগো ফসল। আর আমনে হুদাহুদি মাফ চাইয়েন না, এমনেই মেজাজ খারাপ আছে কইয়া দিলাম।’
মুকুল কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আব্বাস এসে দুল আর চেইন দিয়ে গেল। এত কিছু হয়ে গেল, তবু হালিমা কারও কাছে মাফ চাইলেন না।
আয়না ও হীরার দেখাদেখি মধুও এখন জেসমিনকে মা বলে ডাকে। বড়ই হয়েছে বৈকি, আজকাল সে নিজের হাতে ভাত খেতে পছন্দ করে। আজ জেসমিন তার নিজের খেতের লালশাক রান্না করেছে। সেই লালশাক দিয়ে ভাত মেখে মধু অবাক হয়ে গেল। তার সব ভাত লাল হয়ে গেছে। ভাতগুলো তার এত সুন্দর লাগছে যে শুধু দেখতেই ইচ্ছা করছে, খেতে ইচ্ছা করছে না। অনেকক্ষণ ধরে ভাত নাড়াচাড়া করতে দেখে জেসমিন বলল, ‘কী গো বাজান, ভাত খালি লাড়োচাড়ো, খাও না ক্যা? রান্দা মজা অয় নাই?’
‘জম্মের মজা অইছে, মা। কিন্তু এত সুন্দর ভাত ক্যামনে খামু? দেহো দিহি কী সুন্দর লাল!’
জেসমিন হেসে বলল, ‘লাল তোমার পছন্দ?’
‘হয়।’
জেসমিন চোখ নাচিয়ে নাচিয়ে বলল, ‘পশ্চিমের বিলে লাল শাপলা ফুটছে। তুমি যাবা?’
আনন্দে লাফিয়ে উঠল মধু।
জেসমিন বলল, ‘তয় ভাত শ্যাষ না করলে তো কোনোহানে যাওন যাইবে না, বাজান।’
মধু উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘মুই এহনই সব ভাত শ্যাষ কইরালাইতেয়াছি, মা। তুমি খালি দেহো।’
যে মধু এক ঘণ্টা ধরে ভাত নাড়াচাড়া করছিল, সে মুহূর্তেই সব ভাত শেষ করে ফেলল। বিকেলবেলা জেসমিন ও মধু একটা ডোঙা নিয়ে পশ্চিমের বিলে গেল। সত্যিই অপূর্ব লাল শাপলা ফুটে রয়েছে সেখানে। ডোঙা ভাসিয়ে তারা বিলের ভেতর চলে গেল। ডোঙা ভর্তি করে মোটা মোটা শাপলা তুলে আনল। মধু আজ ভীষণ খুশি।
জেসমিন শাপলার ডাঁটাগুলোকে রান্নার জন্য রেখে ফুলগুলোকে কিছুটা ডাঁটাসহই আলাদা করল। তারপর কাচের গ্লাসে পানির ভেতর রাখল। একটা গ্লাসে যতগুলো ফুল রাখা সম্ভব, রাখল। তারপর একটা গ্লাস দিল মধু যে ঘরে ঘুমোয়, সে ঘরে, আরেকটা রাখল নিজের ঘরে।
মুকুল একটু দূরে কাজে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। তাই সোজা খাবার ঘরে চলে গেল। খেয়েদেয়ে ঘরে ঢুকতেই লাল শাপলাগুলো দেখতে পেল। শাপলা ফুলও যে ঘরের ভেতর এভাবে রাখা যায়, কখনো মাথায় আসে নি তার। মাঝে মাঝেই মনে হয় সে কোনোভাবেই জেসমিনের যোগ্য নয়। তাই তো হারানোর ভয়ও হয় খুব!
জেসমিন মুকুলের গা ঘেঁষে বসে বলল, ‘আচ্ছা, আমনে বলে আগে যাত্রাপালা করতেন?’
মুকুল হেসে বলল, ‘কেডা কইল তোমারে?’
‘আফায় কইছে। ছাড়ছেন ক্যা, হেইয়াও কইছে।’
মুকুল চুপ। জেসমিন আবার বলল, ‘আমনে আবার যাত্রাপালা শুরু করেন না।’
মুকুল এবার হো হো করে হেসে বলল, ‘এইয়ারেই কয় নিজের পায়ে কুড়াল মারা।’
জেসমিন অভিমানী গলায় বলল, ‘ধুরো, আমনে হাইস্যা উড়াইয়া দিলেন। যাত্রাপালা দেহার মোর অনেক শখ।’
‘তয় লও একদিন দেহাইয়া আনি।’
‘না। যার-তারডা মুই দেখমু না। মোর নায়ক যদি যাত্রাপালার নায়ক অয়, তহেলেই দেকমু খালি।’
‘ওরে বাপে!’
মুকুলের হাসি থামছে না। জেসমিন এবার কড়া গলায় বলল, ‘হাসি থামান কইলাম।’
মুকুল এবার গম্ভীর হলো, ‘জেসমিন, তুমি হেই সময় আছিল না। এই জন্য জানো না, ওই যাত্রাপালাই আছিল সংসারের অশান্তির মূল কারণ। পয়সাপাতি পামু না কিছু না, সংসার চালামু ক্যামনে? পোলাপানের ভবিষ্যতের কতা ভাবতে অইবে না? এহন তো পোলাপান আরও দুইজন বেশি।’
‘কিন্তু এহন তো আর মোগো অত টানাটানিও নাই। চাউল, ডাইল, মাছ, শাকসবজি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল—সবই তো নিজেগো। কিছুই কেনা লাগে না। উল্ডা বেচিও। এমনেও তো সব সময় আমনের কাম থাহে না। যেকালে থাকপে, হেকালে তো কাম করবেনই। আর মুই কাঁথা সেলাই কইরাও তো টুকটাক টাহাপয়সা পাই। এত টাহা দিয়া কী অইবে?’
মুকুল বিরক্ত গলায় বলল, ‘তোমারে না কইছি মাইনষের কাঁথা সেলাই করবা না?’
‘করমু না ক্যা? সংসার-পোলাপান কি আমনের একলার? আর আমনে মানা করলেই মোর হুনতে অইবে ক্যা? আমনে কি মোর মালিক নিহি?’
‘উফ্!’
মুখে যাই বলুক, যাত্রাপালা শুরু করার কথাটা কিন্তু মুকুলকে ভালোই আন্দোলিত করল। তার সবচেয়ে প্রিয় কাজই যে ওটা। কিন্তু এত কষ্টে ওসব থেকে বের হয়ে এসেছে! আবার যদি যায়, আবার যদি সংসারে ঝামেলা হয়? তারপর বের হয়ে আসতে পারবে তো?
অনেক তর্কাতর্কির পর মুকুল রাজি হলো। তবে সে ঠিক করল, আগের মতো নিয়মিত নয়। যখন তার হাতে কোনো কাজ থাকবে না, তখনই শুধু যাত্রাপালা করবে।
মুকুল যাত্রাদলে ঢুকতে না ঢুকতেই আবার গ্রামের মানুষদের মধ্যে যাত্রা দেখার হিড়িক পড়ে গেল। একদিন জেসমিনও গেল। আর সেদিনই আবিষ্কার করল, এটাই মুকুলের আসল জায়গা। কী প্রাণবন্ত অভিনয় তার! মনে হয় যে মানুষের সাথে সে ঘর করে, এই মানুষ সেই মানুষ নয়, যেন এক অন্য মানুষ। ভীষণ গর্ব হলো তার।
দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর পেরিয়ে গেল জেসমিন-মুকুলের সংসারজীবনের। আয়না ও হীরা গত বছর থেকে মধুর সাথে স্কুলে যায়। মধু একটু পড়াচোর হলেও এই দুজনের পড়াশোনার দারুণ আগ্রহ। ওদের আগ্রহ দেখে আবার মাঝেমধ্যে মধুর আগ্রহ বাড়ে।
মুকুলও তার সব কাজকর্ম আর যাত্রাপালা উভয়ই একসাথে সামলাতে পারছে। জেসমিন পাশে আছে যে! সংসারের কত কিছুর দায়িত্ব তো সেই নিয়ে বসে আছে।
জেসমিন আবারও মা হতে যাচ্ছে। ভীষণ খুশি সে। মুকুল খুশির চেয়ে বেশি ভীত! বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মিনা মারা যাওয়ার পর থেকে বাচ্চা হওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটাই তার খুব ভয় লাগে। যেভাবে মিনাকে হারিয়েছে, সেভাবে জেসমিনকে হারালে পাগল হয়ে যাবে সে। তবে এসব ভয়ের কথা জেসমিনকে বুঝতে দেয় না।
এদিকে জেসমিনের আজকাল মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। এই একজন ছাড়া তার আর কোনো পিছুটান নেই। মাকে দেখতে ইচ্ছা করে খুব। কিন্তু উপায় কী?
একদিন হুট করেই মুকুলকে বলল, ‘মায়রে বড় দেখতে ইচ্ছা করে। কেমন আছে কে জানে!’
মুকুলের বড় মায়া হলো। সে বলল, ‘খোঁজ লমু?’
জেসমিন দ্রুত বলে উঠল, “না না।’
‘ক্যা?’
‘ডর করে।’
মুকুল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের ডর?’
জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘অগো আমনে চেচেন না। অরা ডাহাইত। আমনের কোনো ক্ষতি করে যদি?’
‘আরে, মুই কি যাইয়া কমু নিহি মুই তোমার স্বামী? কৌশলে খোঁজ লমু। চিন্তা কইরো না তুমি।’
‘না, থাউক, লাগবে না। এমনেই মার লাইগ্যা মন পুড়তেয়াছিল, এইল্লাইগ্যা কইছি।’
মুকুল জেসমিনের কথা শুনল না। জেসমিনকে না জানিয়েই যাত্রাদলের প্রপস থেকে দাড়ি-মোচ আর পরচুল পরে নিজের চেহারা বদলে ফেলল। তারপর গেল সেই কেশবপুর।
.
কেশবপুরে প্রভাবশালী চেয়ারম্যান জয়নাল মির্জার বাড়ি খুঁজে বের করতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হলো না মুকুলের। যদিও তিনি এখন ক্ষমতায় নেই। তবে প্রতাপ ছিটেফোঁটাও কমে নি। মুকুল সুযোগের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করল। অনেকেই এল-গেল কিন্তু কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। তারপর একসময় বাড়ির ভেতরেই ঢুকে পড়ল। এক ভদ্রমহিলা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। মুকুল বলল, ‘কোহিনুর খালারে একটু ডাইক্কা দিবেন? মুই ওনার বাপের বাড়িত্তা আইছি।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমনেরে চেনলাম না।’
মুকুল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, ‘চেনবেন না। মুই ওই বাড়ির কেউ না। মোরে পাড়াইছে একখান খবর দিতে।’
ভদ্রমহিলা বলল, ‘আচ্ছা, আমনে কাছারিঘরে বহেন। মুই আম্মারে ডাইক্কা দেই।’
মুকুল এবার আন্দাজ করতে পারল ভদ্রমহিলা জেসমিনের ভাবি হবেন। মুকুল বলল, ‘না, তার দরকার নাই। মুই ঘাডলায় (পুকুরপাড়ে) বইতেয়াছি আমনে খালারে ডাইক্কা দেন।’
মুকুল পুকুরপাড়ে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যে এক লোক এসে এক প্লেট মিষ্টি, পিঠা আর পানি দিয়ে গেল। কোহিনুর বানু এলেন তার পরপরই। মুকুল লক্ষ করল, জেসমিন মায়ের চেহারা পেয়েছে। কোহিনুর বানু কাছাকাছি আসতেই মুকুল দাঁড়িয়ে সালাম দিল। কোহিনুর বানু সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ‘তোমারে তো চেনলাম না। কেডা খবর পাড়াইল? ভাইজান সুস্থ আছে তো?’
মুকুল আড়চোখে চারপাশে পরখ করে নিল কেউ আছে কি না। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘আমারে জেসমিন পাড়াইছে। মিছা কথা বলার জন্য মাফ করবেন। এ ছাড়া উপায় আছিল না।’
কোহিনুর বানু জেসমিনের কথা শুনে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। মুকুল বলল, ‘আমনের কি শরীর খারাপ লাগে? বহেন এহেনে।
মুকুল পানি এগিয়ে দিল। কোহিনুর বানু পুকুরপাড়ের শানবাঁধানো ঘাটলায় বসে পানি খেলেন। তারপর হঠাৎ নীরবে কাঁদতে শুরু করলেন। মুকুল বলল, ‘কাইন্দেন না, কেউ দেখলে সন্দেহ করবে।’
কোহিনুর বানু সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু গলায় জানতে চাইলেন, ‘কেমন আছে আমার মাইয়াডা? কই আছে?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছে। কই আছে, সেই সব নাহয় পরে জানবেন। জেসমিন আমনের লগে দেহা করতে চায়। কোনোভাবে কি ব্যবস্থা করতে পারবেন? আমনে যদি যাইতে পারেন, নাইলে যেহেনে কইবেন, অরে নিয়া আইতে পারি।
কোহিনুর বানুর এবার হুঁশ হলো। সে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেডা?
মুকুল ইতস্তত করে বলল, ‘আমার নাম মুকুল। জেসমিনের স্বামী। বছর পাঁচেক আগে আমার সাথে ওর বিয়ে হয়।’
কোহিনুর বানু কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “মোর বাপের বাড়ি কই, তুমি জানো?’
‘জানি, বরগুনা। জেসমিন কইছে।’
‘হেহেনে লইয়া আইতে পারবা অরে?’
‘জি, পারমু।’
‘তহেলে কাইল আহো তোমরা।’
মুকুল চলে যাবার পর কোহিনুর বানুর আফসোস হতে লাগল। ছেলেটা যে-ই হোক না কেন, যেহেতু জেসমিনের স্বামী, সেহেতু একটু আদর-যত্ন করার দরকার ছিল। সৌজন্যবশত হলেও বেড়াতে বলা দরকার ছিল। পরক্ষণেই আবার ভাবলেন, ও ছেলে এ বাড়িতে যত কম সময় থাকবে, তত ভালো। জামাই আদর নাহয় কাল তার বাপের বাড়িতে করা যাবে। কিন্তু ছেলেটার সাথে জেসমিনের বিয়ে হলো কীভাবে? বাচ্চাটা কি তবে বাঁচে নি জেসমিনের? নানান জল্পনাকল্পনা করতে লাগলেন তিনি। তবে এটুকু বুঝতে পারছেন যে জেসমিন যেখানেই আছে ভালো আছে। কারণ, ছেলেটা ভালো মানুষ, তা না হলে জেসমিনের খবর নিয়ে এই যমের দুয়ারে আসত না।
মুকুল কেশবপুর গিয়েছিল শুনে রাগে ফেটে পড়ল জেসমিন।
বলল, ‘আমনেরে মুই মানা করছিলাম না? মরার শখ জাগছেনি যে মানা করার পরেও গ্যাছেন?’
‘আরে জেসমিন, বোঝার চেষ্টা করো…’
মুকুল কাছে যেতেই জেসমিন তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘খবরদার, মোর ধারে আইবেন না। মোরে ধরবেন না। দূরে যান, যান কইতাছি।’
মুকুল একটু সরে বসল। তারপর বলল, ‘মাফ কইরা দেও আমারে। এরপর আর যামু না।’
রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল জেসমিন। এবার কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমনেরে যেডা মানা করা অয়, অইডাই বেশি কইরা করেন। আমনে জানেন ওরা টের পাইলে কী অইতে পারত?’
‘হয়, স্বীকার করলাম তো মোর ভুল হইয়া গ্যাছে। মাফ কইরা দেও।’
‘এট্টা কতাও আর কইবেন না মোর লগে।’
‘আচ্ছা, মোর লগে কতা না কও, তোমার মায়ের লগে তো কবা। হে কাইল তোমারে লইয়া তোমার নানাবাড়ি যাইতে কইছে।’
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, ‘আমনে আম্মার লগে দেহা করছেন?’
‘হয়। চিন্তা কইরো না। তৃতীয় কেউ আছিল না।’
‘ক্যামনে? আম্মায় তো ঘরেইত্তাই বাইরায় না। বাইরের মাইনষের লগে দেহা দেয় না।’
মুকুল হেসে বলল, ‘এইল্লাইগ্যাই কইছি মোরে হের বাপের বাড়িত্তা পাড়াইছে।’
জেসমিন অবাক চোখে চেয়ে রইল। মুকুল তাকে পুরো ঘটনা ও পরবর্তী দিনের পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলল।
.
জেসমিন সাবধানতার জন্য বোরকা পরে নিল। দীর্ঘ ছয় বছর পর মা-মেয়ের দেখা হওয়াতে কেউই নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। অনেকক্ষণ চলল সে কান্নাকাটি পর্ব। তারপর দুজন দুজনের খবর নেওয়া শুরু করল। জেসমিনের পেট দেখে কোহিনুর বানু হাত বোলালেন।
তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কয় মাস, মা?’
জেসমিন হেসে বলল, ‘ছয় মাস।’
‘মাশা আল্লাহ, জামাই কেমন?’
‘অনেক ভালো মা, অনেক ভালো। এত ভালো মানুষ আমি দুনিয়ায় আরেকটা দেহি নাই। খালি কইছি তোমারে দেখতে মনে চায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়া গ্যাছে যাইয়া।’
জেসমিনের চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। কোহিনুর হেসে বললেন, ‘আর মোরে কইছে তুই পাডাইছস।’
জেসমিন আবারও হেসে বলল, ‘হে এ রহমই।’
‘জানে সব?’
জেসমিন মাথা নেড়ে বলল, ‘সব জানে। পেরতমে লুকাইছিলাম। এরপর দেহি মানুষটা অন্য রহম। হ্যাষে সব কইয়া দিছি।’
কোহিনুর বললেন, ‘কই পাইলি অরে? ক্যামনে বিয়া অইল?’
জেসমিন সব বলল। পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে কী কী ঘটেছে, খুঁটে খুঁটে সবটা বলল।
কোহিনুর সব শুনে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। অনেক কষ্ট করছস। দিন শ্যাষে আমার মাইয়া সুখে আছে জানতে পারছি। এই জীবনে আল্লাহর কাছে আর কিচ্ছু চাওয়ার নাই।’
একটু থেমে কোহিনুর বানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘রঞ্জুর কথা মনে পড়লে কষ্ট হয়?’
জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তা তো হয় মা। মোর বাপের লাইগ্যা অর জীবনডা গেল। তয় আল্লায় মোরে যেহানে আইন্না ঠেকাইছে, তাতে মুই অখুশি না। তুমি গৌরনদী মোগো বাড়ি যাইয়ো মা। টাহাপয়সা নাই অত। বাড়িঘরের অবস্থাও ভালো না। তয় উনি মোরে এত আদর-যত্নে রাখছে যে-কোনো কিছুর অভাব ঠেহি না। তার ওপর আমার তিন রত্ন। এই জীবনডাও বড় সুখের মা।’
জেসমিন সঙ্গে করে তিন সন্তানকেই নিয়ে এসেছে। কোহিনুর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর বাচ্চা কোনজন?’
জেসমিন হেসে বলল, ‘তিনজনই মোর, মা গো। অগো বাপে যে রহম অগো আলাদা কইরা দেহে না, মুইও আলাদা করি না।’
কোহিনুর বানু অবাক হলেন। কত বড় হয়ে গেছে জেসমিন। কত সুন্দর চিন্তা! তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
রাতে জেসমিন মায়ের সাথে ঘুমাবে। আর মুকুল বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা ঘরে। শোবার আগে একবার মুকুলের কাছে গেল জেসমিন। ততক্ষণে বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। জেসমিন বলল, ‘ও মা, অরা দি ঘুমাইয়া পড়ছে।’
মুকুল হেসে বলল, ‘রাইত অইছে তো। মায়ের লগে গল্প করতে করতে তোমার খেয়াল নাই। তা তুমি এহনো ঘুমাইতে যাও নাই ক্যা?’
‘যাইতেয়াইছি। তার আগে একখান কতা কইতে আইছি।’
জেসমিন কাছে এসে মুকুলকে জড়িয়ে ধরল। মুকুলও ধরল। কিছুক্ষণ পর ছাড়তে চাইলে জেসমিন আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মুকুল হেসে বলল, ‘কী অইল?’
জেসমিন একইভাবে জড়িয়ে থেকেই জানতে চাইল, ‘আমনের এই ঋণ মুই ক্যামনে শোধ করমু?’
মুকুল হেসে দিল। তারপর জেসমিনের কানে কানে বলল, ‘তোমার শোধ করা লাগবে না। মুই সময়মতো বুইজ্জা লমুয়ানে।’
দুষ্টু ইঙ্গিত পেয়ে লজ্জা পেল জেসমিন। দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘মায়রে দেইখ্যা কী যে শান্তি লাগদেয়াছে, বোঝাইতে পারমু না।’
এবার মুকুল একটু অভিমানী সুরে বলল, ‘হয়, এহন তো শান্তি আর কাইল তো মোরে আরেট্রু অইলে শূলে চড়াইতা।’
জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
মুকুল একটা বড় কাজ করে একসাথে বেশ কিছু টাকা পেল। সেই টাকা দিয়ে সে ঘরের মেঝে পাকা করে ফেলল। হীরা ও আয়নার যেন উৎসব লেগে গেছে। সারা দিন মেঝেতে একটা অদ্ভুত খেলা খেলে। তারা সেই খেলার নাম দিয়েছে গড়াগড়ি খেলা। দুজনে একসাথে গড়িয়ে এক পাশ থেকে আরেক পাশে যাবে। যে আগে যেতে পারবে, সে জিতবে। মধুরও তাদের দেখাদেখি গড়াগড়ি খেলা খেলতে ইচ্ছা করে। তবে সে বড় হয়েছে, তাই তার লজ্জা লাগে। তার আর গড়াগড়ি খেলা হয় না।
হেমন্তের এক মিষ্টি সকালে সেই পাকা ঘরে নতুন অতিথি এল। পুত্রসন্তানের জন্ম দিল জেসমিন। নাম রাখল মিঠু। কোহিনুর বানু গোপনে গৌরনদী এসে নাতিকে দেখে গেলেন। দেখে গেলেন জেসমিনের সংসারও।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ রেনুর শরীর সাংঘাতিক খারাপ হতে লাগল। ডাক্তার-কবিরাজ কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছে না। টানা দুমাস একই রকম অবস্থা দেখে একদিন জেসমিন বলল, ‘আফারে ঢাকায় নিয়া ভালো একখান ডাক্তার দেহাইলে কেমন অয়? চোখের সামনে মানুষটা এত কষ্ট পাইতেয়াছে।’
আব্বাস বলল, ‘এই কতা মুইও ভাবছিলাম, মাইজ্জা বউ। কিন্তু ঢাকায় তো মোগো কোনো আত্মীয়স্বজন নাই, কোতায় যাইয়া উডমু?’
এ কথার পর সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। মুকুল বলল, ‘মোর এক বন্ধু আছে ঢাকায়। অরে চিডি দিয়া দেহি।’
তখন রেনু বলল, ‘না না, চিনি না জানি না একজনের বাসায় যাইয়া ক্যামনে উডমু?’
তারপর আব্বাসের দিকে তাকিয়ে রেনু আবার বলল, ‘মোর চাচাতো ভাই থাহে ঢাকায়। হের বাসায় ওডোন যাইবে। আমনে আব্বার লগে যোগাযোগ করেন।’
রেনুকে ঢাকায় নিয়ে গেল তার বাবা ও আব্বাস। রেনুর চাচাতো ভাইয়ের বাসায় উঠল। তার বাসা বংশাল। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল খুবই কাছে। রেনুকে সেখানেই নেওয়া হলো। অনেক পরীক্ষা- নিরীক্ষা করার পর জানা গেল রেনুর লিভারে সমস্যা। এত দিন উপযুক্ত চিকিৎসা পায় নি। এখন অপারেশন করতে হবে। যেহেতু অপারেশন করাতেই হবে, সেহেতু অনেক দিনের ব্যাপার। অপারেশন থেকে শুরু করে পরবর্তী বিশ্রামসহ বাড়িতে ফেরত নেওয়ার মতো সুস্থ হতে সব মিলিয়ে মাসখানেক তো লাগবেই। এত দিন এত অসুস্থ মানুষ নিয়ে কারও বাসায় থেকে তাকে ঝামেলায় ফেলা ঠিক না। তাই রেনুর বাবা নিজেই একটা বাসা ভাড়া করল। এক মাসের জন্য বাসা নিয়েছে। আব্বাস বাড়ি এল প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিতে। বাসা নিয়েছে শুনে জেসমিন বলল সে-ও যাবে। আব্বাস বলল, ‘এতগুলা পোলাপান হালাইয়া তুমি ক্যামনে যাবা?’
‘ও মা ভাইজান। হালাইয়া যামু ক্যা? মোর পোলাপান মোর লগেই যাইবে।’
‘হেরপরও মিঠু তো বেশি ছোডো। অরে লইয়া এত দূর যাবা, অর কষ্ট অইবে না?’
‘ছোডো কই? তিন মাস অইয়া গেছে। তা ছাড়া লঞ্চেই তো যামু। কষ্ট কী? দেহেন ভাইজান, তালোই আছে, আমনে আছেন, অপারেশনের কথা হুইন্না আমনের ভাইও যাইবে। এতগুলা মাইনষের রান্নাবাড়ার লাইগ্যাও তো একটা মানুষ লাগবে। তা ছাড়া আফায় অসুস্থ। একজন মহিলা মানুষ, হের লগে না থাকলে অয় না।
জেসমিনের শেষ কথাটায় যুক্তি আছে। বিষয়টা কারও মাথায় আসে নি। তাকে সঙ্গে নেওয়া হলো।
ঢাকার বংশালে দোতলা একটা বাড়ির নিচতলাটা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। গাছপালায় ঘেরা বাড়ি, সামনে একচিলতে উঠোন। তারা বাড়িতে উঠল কাকডাকা ভোরে। সকালের নাশতা মুকুল হোটেল থেকে কিনে আনল। সঙ্গে দুপুরের রান্নার জন্য বাজার। একদম না হলেই নয়, এমন কিছু হাঁড়ি-কড়াই, থালাবাসন, চাল-ডাল, তেল-মসলা জেসমিন বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। নাশতা করেই জেসমিন রান্না বসিয়ে দিল। এ রকম গ্যাসের চুলার কথা সে কেবল শুনেছে। এই প্রথম দেখল। যদিও রান্না করতে অসুবিধা হলো না। বরং মাটির চুলার থেকে অনেক আরামের।
যত দ্রুত সম্ভব রেনুর অপারেশনের ব্যবস্থা করা হলো। সপ্তাহ দুয়েক পর রেনু হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরলে সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
.
শাকসবজির ফেরিওয়ালারা প্রতিদিন সকালে এসে হাঁকডাক ছাড়ে। জেসমিন সেসব ফেরিওয়ালা থেকেই কিছু তরকারি নিয়ে নেয়। মাছও কখনো ফেরিওয়ালাদের কাছে পায়। যেদিন না পায়, সেদিন আব্বাস বা মুকুল বাজার থেকে এনে দেয়। আজ মাছ-তরকারি একটু কম করেই নিল জেসমিন। আজ সন্ধ্যায় তারা লঞ্চে উঠবে, বাড়ি ফিরে যাবে। আজকের মধ্যেই যাতে শেষ হয়ে যায়, এমন হিসাব করেই সব নিল। তারপর বাজারগুলো ঘরে রেখে টাকা নিয়ে এল। টাকা দিয়ে ঘরে ফিরে যাবে, ঠিক সেই সময় পেছন থেকে একটা ডাক শুনতে পেল। তার নাম ধরে ডাকছে। পিলে চমকে উঠল তার। পেছনে তাকিয়ে দেখে রঞ্জু দাঁড়িয়ে। জেসমিনের বাক্শক্তি রোধ হয়ে এল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
রঞ্জু বলল, ‘জেসমিন, তোমাকে আমি পাগলের মতো খুঁজছি। এইভাবে পাব কোনো দিন ভাবি নাই।’
জেসমিন কোনোমতে বলল, ‘তুমি বাঁইচ্চা আছ!’
‘হয়তো থাকতাম না। তোমার ভাইয়েরা আমাকে মারধর করে ধাপের নিচে ফেলে আসছিল। ওদের সাথে যেতে দেখেই মানিক সন্দেহ করে লুকিয়ে অনুসরণ করেছিল। ওই আমাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা হয়। মানিক বাবাকে খবর দেয়। আমি কিছুটা সুস্থ হলে বাবা আমাকে সোজা ঢাকায় নিয়ে আসে। গ্রামের কাউকে জানতে দেয় না যে আমি বেঁচে আছি। পরে অবশ্য সবাই জেনেছে। যখন আমি বহুবার পটুয়াখালী গিয়েছি তোমাকে খুঁজতে।’
জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, ‘তিন দিন পর আমি পলাইছি। এর মধ্যে একটাবার মানিক ভাই আমারে একটা খবর দিতে পারল না? তার কি একবারও মনে হয় নাই তুমি জীবিত আছ, এইডা আমার জানা দরকার?’
রঞ্জু মাথা নিচু করে বলল, ‘ও আসলে ভয় পেয়েছিল। এই একই কারণে আমি বহুদিন ওর সাথে রাগ করে ছিলাম।’
এমন সময় আয়না ও হীরা মা মা করতে করতে বেরিয়ে এল উঠানে এসে একজন আরেকজনের নামে বিচার দিতে লাগল। রঞ্জু বলল, ‘তোমার বাচ্চা?’
‘হয়। আরও দুইজন আছে। তুমি এইখানে? এইডা কি তোমার বাসা?’
রঞ্জু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘না, শ্বশুরবাড়ি। গত বছর বিয়ে করছি। বেড়াতে আসছি। ওপরের বারান্দা থেকে তোমারে দেখে ছুটে আসছি।’
জেসমিন বলল, ‘তুমি তো ম্যালা দিন অপেক্ষা করছ। মোর অপেক্ষা করার সুযোগ আছিল না। মরা মানুষের জন্য কেউ অপেক্ষা করতে পারে না। তোমার প্রাণের বন্ধুরে কইয়া দিয়ো, যেইভাবে মোর বাপ-ভাইয়েগো কোনো দিন মাফ করমু না, ঠিক সেইভাবে ওনারেও কোনো দিন মাফ করমু না। হাশরের ময়দানে বিচার চামু।’
এ কথা বলে বাচ্চাদের নিয়ে জেসমিন ঘরে চলে গেল। ঘরে ঢুকেই মুকুলের সামনে পড়ল। তার মানে মুকুল শুনেছে সব। জেসমিন ঘাবড়ে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। মুকুল তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কিচ্ছু কইতে অইবে না।’
স্নেহের পরশ পেয়ে জেসমিন কেঁদে ফেলল। মুকুল বলল, ‘আয়নার কতা কইলা না ক্যা?’
চমকে তাকাল জেসমিন, ‘পাগল হইছেন আমনে?’
মুকুল করুণ গলায় বলল, ‘নিজের মাইয়ার কথা একবার জানতেও পারবে না?’
জেসমিন বলে, ‘চুপ করেন। যা হইছে হইছে। আল্লাহ যা করে ভালোর লাইগ্যা করে। এহন আর পিছুটান বাড়াইয়া লাভ কী?’
মুকুল মাথা নাড়ল।
জীবনে সুখ ও দুঃখ সর্বদা নিজস্ব সমান্তরাল রেখায় চলে। কিন্তু কখনো কখনো জীবনই সুখ আর দুঃখকে একই রেখায় নিয়ে আসে। তখন দুঃখ তার পথ চলতে চলতে সুখের রেখাকে মুখে দেয়।
কখনোবা সুখ মুছে দেয় দুঃখের রেখাকে।
(সমাপ্ত)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন