মৌরি মরিয়ম
শরিফা বানু মুস্তাফিজের চিঠি পেয়ে দ্রুতই বাড়ি ফিরে এলেন। চিঠিতে অবশ্য মুস্তাফিজ বিস্তারিত কিছুই লেখেন নি। শুধু লিখেছেন বাড়িতে ঝামেলা চলছে, তিনি যেন চিঠি পাওয়ামাত্র লঞ্চে ওঠেন। ভোরবেলা বাড়ি ফিরতেই মুস্তাফিজ এলেন তার ঘরে।
তিনি জানতে চাইলেন, ‘ঘটনা কী, বাবা? এম্বালে আইতে কইলি ক্যা? বাড়িতে কী ঝামেলা অইছে?’
এসব কথা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলার মুখ মুস্তাফিজের নেই।
তিনি মাথা নিচু করে বললেন, ‘আম্মা, জেসমিনরে এই বাড়িতে আর রাখোন যাইবে না। অর একটা ব্যবস্থা করেন। অন্য কোথাও একটা কামের ব্যবস্থা কইরা দেন।’
‘ক্যা, কী করছে জেসমিন?’
অবাক হলেন শরিফা। মুস্তাফিজ বললেন, ‘ও কিছু করে নাই। করছে আমনেগো বউ। এত দিন আমনেরে কইতে চাই নাই। নুরজাহান অরে নিয়া আমারে সন্দেহ করে। ভাবে অরে মুই বিয়া করমু কিংবা…ওই দিন অর গায়ে হাত তুলছে। সব কথা কইতে পারমু না, আম্মা।’
‘কস কী! মুই অবশ্য ট্যার পাইছিলাম বড় বউ জেসমিনরে দেখতারে না। কিন্তু এতডা তো বুঝি নাই। কিন্তু এই সন্দেহের কারণ কী? তুই তো জেসমিনের লগে কথাও কস না।’
‘জানি না, আম্মা। জেসমিন আইছে হইতেই সন্দেহ করে। ভাবছি দিনে দিনে কমবে। কিন্তু উল্ডা বাড়ছে। আমনে না থাকায় জল অনেক দূর গড়াইয়া গেছে। সংসারে এই অশান্তি মুই আর নিতে পারতেয়াছি না, আম্মা। দেয়ালে পিঠ ঠেইক্যা গেছে।’
‘বুঝলাম। কিন্তু বাবা, এই অবস্থায় মাইয়াডারে কোই পাড়াই? সাত মাসের পোয়াতিরে কেউ কামে নেবে না। এত ভালো মাইয়াডা! অথচ কী অসহায়!’
শরিফা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মুস্তাফিজ মাথা নিচু করে রইল। শরিফা নুরজাহানকে চেনেন। তার ওপর ছেলের এমন মুখ দেখে অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পারলেন।
বললেন, ‘ঠিকাছে বাবা, তুই চিন্তা করিস না, আমি দেহি কী করোন যায়।’
জেসমিনকে অন্যত্র কোথাও পাঠাতে হবে ভেবেই মনে একটা সূক্ষ্ম বেদনা হতে লাগল। মেয়েটি তার বড় খেয়াল রাখে, যা তার তিন বউ মিলেও রাখে না। মেয়েটির প্রতি বড় মায়া পড়ে গেছে!
.
পারুলের ভাই এসেছে তাকে নাইয়র নিতে। মাহফুজকে অনেক সাধাসাধির পরও সে গেল না। জানাল, পারুলকে সে আনতে যাবে, তখন বেড়াবে। অগত্যা ভাই পারুলকে নিয়ে চলে গেল। মাহফুজ যাবেই-বা কেন? সে তো এমন একটি সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল।
পরিকল্পনামাফিক রাত বাড়লে মাহফুজ জেসমিনের ঘরে যায়। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে দরজায় টোকা দেয়। জেসমিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার ঘুম ভাঙল না। কিছুক্ষণ পর আবার টোকা দিল, এবার আরেকটু জোরে। এবার ঘুম ভাঙল জেসমিনের। সে উঠে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলে কাউকে না দেখে ভাবল ভুল শুনেছে। একটা হাই তুলে দরজাটা লাগাতে যাবে, অমনি মাহফুজ হুট করে কোত্থেকে এসে তার মুখ চেপে ধরল। জেসমিন মাহফুজকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। মাহফুজ তার মুখ চেপে ধরেই ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে কোনো শব্দ করার সুযোগ না দিয়ে মুখ বেঁধে ফেলল। মুখ বাঁধার জন্য রুমাল সে সঙ্গে করে নিয়েই এসেছে। এই রুমালে বহু নারীর মুখ বেঁধে অভ্যস্ত সে। জেসমিন ধস্তাধস্তি করেও মাহফুজকে ঘর থেকে বের করতে পারল না বা নিজের মুখের বাঁধন খুলতে পারল না। বেশি ধস্তাধস্তি করছে বলে মাহফুজ জেসমিনের দুহাত পেছনে নিয়ে নিজের এক হাতে চেপে ধরে আরেক হাতে শাড়ি খুলতে খুলতে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এত পাড়াপাড়ি কিসের? জামাই ছাড়া এত দিন আছ, তোমারও তো কষ্ট অয়। চুপ কইরা কাম সহজ কইরা দেও। দুইজনেই তাতে মজা পামু। জোরজবরদস্তি করলে হুদাহুদি কষ্ট পাবা। ‘
জেসমিন প্রাণপণে চিৎকার করার চেষ্টা করল, একটুও শব্দ বের হলো না। লাথি দিতে চাইল, পেটের কারণে পা তুলতে পারল না। ততক্ষণে মাহফুজের নোংরা হাত জেসমিনের গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাহফুজ হেসে বলল, তুমি কি ভাবছ পারবা মোর লগে? তোমার লাহান কত মাইয়ারে খাইছি, জানো?”
ঠিক তখনই জেসমিন একটা হাত আলগা করতে পেরে পাশের হারিকেনটা তুলে সেটা দিয়ে টিনের দেয়ালে একনাগাড়ে অনেকগুলো শব্দ করল যত জোরে তার পক্ষে সম্ভব। মাহফুজ খেপে যেতেই এবার জেসমিন হারিকেন দিয়ে মাহফুজের গায়েই আঘাত করল। ঠিক তখনই শরিফা বানু এসে পড়লেন।
জেসমিনের ঘরের কাছেই তার ঘর। প্রথম শব্দটাই তিনি শুনেছিলেন। কিন্তু এই বয়সে হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠা যায় না। তিনি এসে এই দৃশ্য দেখে মাহফুজকে একটা চড় মারলেন। চেঁচিয়ে বললেন, ‘হারামজাদা, কোনো দিন মানুষ হবি না তুই?’
মাহফুজ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘উফ্, এত রাইতে তুমি উইড্যা আইছো ক্যা?’
জেসমিন মুখ খোলার আগে দ্রুত হাতে শাড়িটা গায়ে জড়াল। ঠিক তখনই বাড়ির বাকিরা এসে উপস্থিত হলো। কেউই তেমন অবাক হলো না। মাহফুজের চরিত্র সম্পর্কে টুকটাক ধারণা সবারই ছিল। ময়না এগিয়ে এসে জেসমিনের মুখের বাঁধন খুলে দিল। জেসমিন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ছেলের কৃতকর্মের লজ্জায় অপমানে শরিফা বানুরও চোখে জল এল।
মুস্তাফিজ ঘরে ঢোকেন নি। বাইরে দাঁড়ানো ছিলেন। মাহফুজ বের হতেই তার চুল ধরে ঘরের খুঁটির সাথে মাথা ঢুকে দিলেন। মাহফুজ সহ্য করার লোক নয়। সে পালটা ধাক্কা দিয়ে মুস্তাফিজকে সরিয়ে দিল। এত জোরে ধাক্কা দিল যে এক ধাক্কায় মুস্তাফিজ পড়ে গেলেন। মাহফুজ নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। মুজাহিদ তাড়াতাড়ি ভাইকে ওঠাল, ভাবি দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এদিকে শরিফা বানু বললেন, ‘জেসমিন, আইজগোইত্যা মোর ঘর ঘুমাবি। এহনই ল।’
জেসমিন ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু এত ধকল নিতে না পেরে তার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ময়না বলল, ‘মুই দিয়াহি লও।
নুরজাহান চুপচাপ সব দেখছিল। একটা কথাও বলে নি এতক্ষণ। ময়না জেসমিনকে নিয়ে বের হওয়ার পর শরিফা বানু চোখ মুছে ঘর থেকে বের হবেন, এমন সময় নুরজাহান বলল, ‘এমনডা তো হওয়ারই আছিল। এর চেয়ে ভয়ংকর কিছুও অইতে পারত। তিন-তিনটা জওয়ান বেডা মানুষ যে বাড়িতে আছে, হেই বাড়িতে এমন সুন্দরী মাইয়া কেউ রাহে?’
শরিফা বানু কথাটা হজম করে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে জেসমিনের। বাড়ির সকলেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। শরিফা বানু এই বয়সে কল চেপে পানি এনে জেসমিনের মাথায় পানি দিতে পারলেন না। তবে জলপট্টি দিলেন। সকাল হলে কারও সাহায্য নিয়ে মাথায় পানি ঢালতে হবে।
দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না শরিফা বানু। মাহফুজের চরিত্রের দোষ ছিল বলেই তাকে আগেভাগে বিয়ে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিয়ের পর ছেলের এই বিশেষ দোষ ঠিক হয়ে গেছে বলেই ভেবেছিলেন তিনিসহ সকলেই। কারণ, বিয়ের পর থেকে আজকের আগে কোনো বাজে ঘটনা ঘটে নি। তবু…তবু এ রকম একটা ঘটনা ঘটার আগেই তার সাবধান থাকা উচিত ছিল। প্রথম দিন থেকেই জেসমিনকে তার ঘরে রাখা উচিত ছিল। পরোক্ষভাবে হলেও আজকের এই ঘটনার জন্য তার নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে। প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছেন তিনি।
এদিকে নুরজাহানের মুস্তাফিজ ও জেসমিনকে নিয়ে সন্দেহও তাকে পীড়া দিচ্ছে। নুরজাহানের বিষয়ে তার এত দিনের অভিজ্ঞতা আর আজকের বলা কথাগুলো থেকে তিনি যা বুঝতে পারছেন তা হলো, জেসমিন সুন্দরী, এটাই নুরজাহানের মূল সমস্যা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রয়েছে তার সন্তান না হওয়ার দুর্বলতা! নুরজাহান তার ছেলের ভালোবাসার মানুষ। ছেলের সংসারের সুখ এক দিনের জন্যও নষ্ট হোক, তা তিনি কখনো চান না।
সারা রাত ভেবে তিনি সমাধান বের করতে পারলেন। তবে এখনই কিছু করতে পারবেন না। জেসমিনের বাচ্চা হবার পর জেসমিনকে একটা বিয়ে দিয়ে দেবেন তিনি। বাচ্চা থাকলেও মেয়ের চেহারা ভালো, বয়স কম। পাত্র পেতে অসুবিধা হবার কথা নয়। কিন্তু মাহফুজের কী করবেন? এভাবে আর কত? একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। না হলে মানসম্মান যেটুকু আছে, সব ধুলোয় মিশে যাবে।
সকালবেলা শরিফা বানু কাউকে ডাকার আগেই ময়না এল খবর নিতে। তাকে বলতেই জেসমিনের মাথায় পানি ঢালার জন্য পানি এনে দিল। পানি ঢালছিলেন শরিফা বানু নিজেই।
মাথায় পানি ঢালার পর জেসমিনের জ্বর কিছুটা কমল। হুঁশ ফেরায় আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। কোনো দিন কি ভেবেছিল এ রকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তাকে! এ রকম আক্রমণ তো দূরের কথা, বাবার ভয়ে কোনো দিন কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায় নি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তাদের বাড়ি অবধি মিলিটারিরা আসতে পারে নি তার বাবার কারণে। তখনো নিশ্চিন্তেই থেকেছে! আর গতকাল রাতে! কী বীভৎস! অসভ্য লোকটা কি নোংরাভাবে ছুঁয়েছে তাকে! মনে পড়তেই নিজেকে অশুচি লাগছে। মনে মনে রঞ্জুর কাছে হাজারবার মাফ চেয়ে ফেলেছে সে। রঞ্জু কি তাকে মাফ করবে?
.
সকালের নাশতা খাওয়ার সময় দেখা গেল নির্লজ্জের মতো মাহফুজ সবার সাথেই খেতে বসেছে। ভাব দেখে কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না গত রাতে কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করেছিল সে।
শরিফা বানু সবার সামনেই ঘোষণা করলেন, মাহফুজকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন। মাহফুজ স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ‘কে যাইবে বিদেশ? আমনের শখ লাগলে আমনে যান। মুই কোনোহানে যাইতেয়াছি না।’
শরিফা বানু বললেন, ‘এই সব নষ্টামি কইরা কত দিন কাটাবি? কামকাইজ করন লাগবে না? এইহানে তোর করার মতো কাম নাই।’
মাহফুজ খেতে খেতে বলল, ‘দুনিয়ায় বেবাক মাইনষের কাম করোন লাগবে ক্যা? মোর বাপের সয়সম্পত্তির তো অভাব নাই। হারা জীবন বইয়া খাইলেও সমেস্যা নাই। কোনো কামকাইজ মুই করতারমু না। আমনের তিন পোলায় তো ম্যালা কামকাইজ করে। হেগো লইয়া খুশি থাহেন।’
শরিফা বানু বুঝলেন এত সহজেই মাহফুজ রাজি হবে না। বিষয়টা নিয়ে বিস্তর ভাবতে হবে তাকে। মুস্তাফিজ বা মুজাহিদও কিছুই বলল না। মাহফুজের মুখের ভাষা এত নোংরা আর বেপরোয়া যে তার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা বা সাহস কোনোটিই তাদের নেই। তাদের মা নিশ্চয়ই কোনো উপায় বের করবেন।
মাহফুজ খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল। তখন নুরজাহান বলল, ‘ভালো সিদ্ধান্ত নিছেন, আম্মা। এই বাড়িতে মোরা কেউই নিরাপদ না। আইজ কামের মানুষের উপ্রে হামলা করছে, কাইল যে নিজের ভাবিগো উপ্রে করবে না, তার কী গ্যারেন্টি?’
নুরজাহানের কথায় সবাই চমকে উঠল। এমন ভয় ময়নারও হয়েছে, তবে সবার সামনে এভাবে শুনতে অস্বস্তি লাগল।
এদিকে যেভাবে সব সময় মুস্তাফিজ লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখেন, আজও সেভাবেই রাখলেন। এক দিকে ভাইয়ের কৃতকর্মের কারণে লজ্জা, আরেক দিকে স্ত্রীর আচরণে। এভাবে না বললেও পারত সে!
শরিফা বানু মুজাহিদকে বলল, ‘পারুলের বাপের বাড়ি জরুলি খবর পাড়াও। আইজই যেন হে চইল্যা আহে।’
.
জেসমিন এ বাড়িতে এসেছে তিন মাসের গর্ভবর্তী অবস্থায়। এখন আট মাস চলছে। একবারও তাকে ডাক্তার দেখানো হয় নি। সংগত কারণেই মুস্তাফিজ তার ছায়াও মাড়ান না। শরিফা বানুর মনে হলো জেসমিনের শরীরটা বোধ হয় ঠিক নেই। বিশেষ করে ভয় পাবার পর থেকে।
মুস্তাফিজ যখন হাসপাতালে যাচ্ছিলেন, শরিফা বানু তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা পর্যন্ত গেলেন। মুস্তাফিজ বললেন, ‘কিছু কইবেন, আম্মা?’
শরিফা বানু বললেন, ‘কইতে চাইছিলাম জেসমিনরে একটু দেইক্কা দিবিনি? ছেড়ির শরীলডা মনে হয় ঠিক নাই। ‘
মুস্তাফিজ একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘ডাক্তার পাড়াইয়া দিমুয়ানে, আম্মা।’
শরিফা বানু ছেলের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা।’ ডাক্তার এল বিকেলে। জেসমিনকে দেখে জানাল, চিন্তার কিছু নেই। মা ও বাচ্চা দুজনেই পুরোপুরি সুস্থ আছে।
হালিমার চিঠির কোনো উত্তর দেয় নি মামুন। আরও দুমাস পেরিয়ে গেছে, একটিবারও টাকা পাঠায় নি। জমানো টাকাপয়সা শেষ হবার পথে। সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে, সেই ভাবনায় হালিমার পাগলপ্রায় অবস্থা। সেকরার দোকানে কানপাশার প্রথম কিস্তি দেওয়ার পর আর দিতে পারেন নি। সে-ও তাগাদা দিচ্ছে। বাকি টাকা দিতে না পারলে যা দিয়েছেন, তা-ও মার যাবে!
এদিকে রেনুর বড় মায়া হয়। আব্বাসের ভয়ে সে এত দিন কিছু বলেনি। কিন্তু এখন যে আর পারছে না। তাই আগেপিছে না ভেবেই সে হালিমাকে বলল, ‘আম্মা, আইজগোইত্যা আমনেরা মোগো লগে খাইয়েন।
হালিমা এ কথা শুনে মনে মনে অবাক হলেন। মুখে বললেন, ‘তোমাগো তো নিজেগোই চলে না।’
রেনু হেসে বলল, ‘মোরা দুই বেলা খাইতে পারলে আমনেগোডাও জুইট্যা যাইবে।’
হালিমার যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সে খুশিমনেই রাজি হলেন। একে তো বাজারের চিন্তা গেল, তার ওপর রান্নার ঝামেলাও। বেশ আরাম হবে!
রেনু ঘটনাটা জানাতেই আব্বাস বলল, ‘খাইতে যহন কইছ, হেগোডা তুমি কামাই কইরা আইন্নো। আমি খাওয়াইতে পারমু না হেগো।’
রেনু আব্বাসের প্রতিটা কথার ধরন বোঝে, এ কথা সে রেগে বলে নি বুঝতে পেরেই ভয় কেটে গেল। সে নরম গলায় বলল, ‘আচ্ছা।’
মোকসেদ-হালিমা তাদের সাথে খাওয়া শুরু করার পরদিন আব্বাস বলল, ‘এতজনের রান্দাবাড়া যহন করতেইয়াছ, মুকুলগোও কও মোগো লগে খাইতে। মিনার তো এই সময়ে কামকাইজ করতে কষ্ট অয়।’
খুশিতে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল রেনুর।
বলল, ‘সত্য? মোর মনডায় এইডাই চাইতেয়াছিল। তয় ডরে কই নাই।’
আব্বাস হেসে বলল, ‘ওরে বাপ রে! কেডা কয় ডরের কতা! মুকুল মোর ভাই, কোনো বেইমান না। যেহেনে ডর করার কতা, হেহেনে তো ডর করে না। করলে তোমার শ্বশুর-শাশুড়িরে আবার ঘাড়ে তুলতা না।’
রেনু আব্বাসের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ধুরো, কী যে কন! এম্বালে কয় না। হেরা আমনের বাপ-মা।’
‘চুপ করো তো।’
মুকুলরা সেদিন থেকে তাদের সাথেই খায়। মিনার গর্ভকালের আট মাস চলছে। এ সময় সংসারের এত কাজ করতে আসলেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। মুকুলের এখন একটানা কাজ নেই। তবে সে যখন যেটুকু কাজ করে, সেই উপার্জন থেকেই মিনার ডেলিভারির জন্য কিছু টাকা জমিয়ে বাকিটা এনে রেনুর হাতে তুলে দেয়। কখনো মাছ ধরে আনে, কখনোবা বাজার করে আনে।
মামুন খবরটা পেয়ে হাসল। সে জানত টাকা পাঠানো বন্ধ করলে একদিন না একদিন বাবা-মা আবার ভাইদের সঙ্গেই খেতে শুরু করবে। এটারই অপেক্ষায় ছিল সে। বন্ধুর মাধ্যমে খবর নিত এত দিন। অবশেষে সে আব্বাসকে একটা লম্বা চিঠি লিখল, অভিমানে ভরা চিঠি। বাবা-মা যে তাদের আলাদা করে দিয়েছে, এই কথাটি কেন তাকে জানানো হয় নি, সেই অভিমান সঙ্গে কিছু টাকা পাঠাল। লিখল, এখন থেকে প্রতি মাসে বাজার খরচ বাবদ কিছু টাকা তার নামে পাঠাবে।
.
শরিফা বানু মাহফুজকে বিদেশ তো দূরে থাক, বাড়ির বাইরেই পাঠাতে পারলেন না। তার নিজের পেটের ছেলে এমন বেয়াদব-বেয়াড়া, অসভ্য কোত্থেকে হলো, এখনো বুঝতে পারেন না তিনি।
এদিকে জেসমিনকে যে রান্নার কাজ থেকে অব্যাহতি দেবেন, তা-ও পারছেন না। নুরজাহানের এককথা, কাজের মানুষ থাকতে সে কেন রান্নাবান্না করবে। এমনকি অন্য বউদেরও সে রান্নাঘরের আশপাশে আসতে দেয় না। অন্য সব কাজও জেসমিনকে দিয়ে করানোর ধান্দা। তার যে শরীরের অবস্থা, তাতে তার পক্ষেও আজকাল আর রান্নাবান্না করা সম্ভব নয়। যদিও রান্না তো দূরে থাক, একটু সাহায্যও করতে দেয় না জেসমিন।
এ বাড়িতে সব দিক দিয়ে জেসমিনের যে করুণ অবস্থা, তাতে শরিফা বানু একপ্রকার উঠেপড়েই লাগলেন পাত্র খুঁজতে। বাচ্চা হওয়ার আগে তো আর বিয়ে দেওয়ার নিয়ম নেই। বাচ্চা হওয়ার পর যাতে আর দেরি করা না লাগে, তাই আগে থেকেই পাত্র খুঁজে রাখা। কিন্তু উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না। একজন বিপত্নীক পাত্র পাওয়া গেল, যার বয়স পঁয়তাল্লিশ। চার সন্তানের পিতা। বড়জনের বিয়ের বয়স প্রায় হয়ে গেছে। অথচ লোকটা রাজি হলো না জেসমিনের সন্তান হবে জেনে। যেহেতু মেয়ে খুব রূপবতী, তাই সন্তান রেখে বিয়ে করলে সে রাজি আছে। শুনে রাগে গা জ্বলতে লাগল শরিফার। নিজে চার সন্তান নিয়ে বিয়ে করতে পারবে, আর জেসমিনের এক সন্তান তার কাছে বেশি হয়ে গেল। দরকার নেই এমন ছোটলোক পাত্রের। তিনি আরও পাত্ৰ দেখতে লাগলেন।
.
জেসমিন রান্না শেষে রান্নাঘরটা ঝাড়ু দিতে দিতেই হাঁপিয়ে উঠল। একে তো বিশাল এক পেট হয়েছে! আল্লাহ জানে একটা না দুইটা এর মধ্যে। তার ওপর ভয়ংকর গরম পড়েছে আজ! ঝাড়ু দেওয়া শেষে কিছুক্ষণ বসে জিরিয়ে নিল। তারপর সবার জমিয়ে রাখা নোংরা কাপড়চোপড়গুলো নিয়ে গোসলে যাবে, এমন সময় নুরজাহান এক ঝুরি আম নিয়ে এসে বলল, ‘আমগুলা কাইড্যা দেও এহনই। আমার ভাই আসছে, তারে দিমু।’
জেসমিন বিনাবাক্যব্যয়ে আম কাটতে বসল। ইদানীং বসে কাজ করতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু কাজের মেয়ে সে, কাজ তো করতেই হবে।
নুরজাহান জেসমিনকে দিয়ে যত কাজ করায়, সবই কৌশলে শরিফা বানুর আড়ালে করায়। কিন্তু ঘটনাটা শেষ মুহূর্তে দেখে ফেললেন শরিফা বানু। দেখে কষ্ট পেলেন। মেয়েটার জন্য এত মায়া তার কেন হয়, নিজেও বোঝেন না। নুরজাহানকে কিছু বলাও সম্ভব নয়। বললেই বাপের বাড়ি চলে যাবে। তারপর যে কী হবে, কেউ জানে না!
আমগুলো কেটে দিয়ে কাপড় ধুতে গেল জেসমিন। কাপড় ধোয়া শুরু করবে, এমন সময় ময়না ঘাটে উঠে এল। গোসল করছিল সে। চোরের মতো বলল, ‘আমারে দেও, আমি ধুইয়া দেই।’
‘না না, ভাবি, মুই পারমু। বড় ভাইজান আর ভাবির অল্প কয়ডা কাপড়!’
ময়না চোখ পাকিয়ে বলল, ‘চুপ করো। বড় বেশি কথা কও। পারবা তো জানি। কষ্টডা কেমন অয়, অইডাও জানি। ভাবি দেহার আগে দেও ধুইয়া দেই। ততক্ষণে তুমি গোসল কইরা নাও।’
কৃতজ্ঞতায় জেসমিনের চোখে পানি এল। সারা জীবন সবার ভালোবাসায় চোখের মণি হয়ে থাকা জেসমিন এখন কারও সামান্য একটু ভালোবাসা পেলেই এলোমেলো হয়ে যায়।
কাপড়গুলো দড়িতে মেলতে মেলতেই জেসমিনের প্রসবব্যথা শুরু হলো। ময়নাই আগে দেখতে পেল। তারপর সবাইকে ডেকে ধরাধরি করে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। পাশের বাড়ি থেকে ধাত্রী ডেকে আনা হলো। সন্ধ্যাবেলা ঘর আলো করে এক শিশুকন্যার জন্ম হলো। অনেক অনেক কাঁদল জেসমিন। কষ্টমিশ্রিত সুখের কান্না! চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল জেসমিন, ‘রঞ্জু, দেহো আমাগো মাইয়া! পারছি! অবশেষে জন্ম দিতে পারছি! তুমি কি দেখতে পাইতেয়াছ? তুমি কি শান্তি পাইছ? খুশি অইছ?’
জেসমিনের একটা কাজ বেড়েছে। কাজটা হলো, সময় পেলেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা। মেয়ের মুখের দিকে তাকালে পুরো পৃথিবীটা তার কাছে সুন্দর মনে হয়। হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে। প্রতিদিন ওর একটু একটু বেড়ে ওঠা দেখলে জীবনী শক্তি বেড়ে যায়। এত দিনের সব কষ্ট ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। কে জানত একটা শিশুর মুখে এত শান্তি থাকবে?
তার মূল আতঙ্কটা শুরু হলো কদিন পর থেকে। সারাক্ষণ মনে হয় নুরজাহান তার মেয়ের কোনো ক্ষতি করবে। অবশ্য নুরজাহানের দৃষ্টি দেখে যে কারও এমনটাই মনে হবে। পুতুলের মতো সুন্দর একটা বাচ্চা, সবাই কোলে নিয়েছে, একমাত্র নুরজাহান বাদে।
একদিন জেসমিন শরিফা বানুকে বলেই ফেলল, ‘খালা, মোরে কি অন্য কোনোহানে একটা কাম জোগাড় কইরা দেওন যায়? মোর লাইগ্যা তো এই বাড়িতে ঝামেলা কম অয় নাই।’
শরিফা বানু জেসমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আর কয়ডা দিন কষ্ট কর, মা। মুই তোর লাইগা পাত্র দেখতাছি।’
জেসমিন আঁতকে উঠে বলল, ‘না না খালা, মুই বিয়া করমু না।’
শরিফা বানু মাথা নেড়ে বললেন, ‘স্বামী ছাড়া যুবতী মাইয়ার এই সমাজে শান্তিতে থাকার জো নাই রে মা। তার উপ্রে যদি অয় চেহারা সুন্দর, তয় তো আর রক্ষা নাই। মুই যদি আজীবন তোরে মোর কাছে রাখতে পারতাম, তহেলে রাখতাম। কিন্তু এই বাড়ি তোর আর তোর বাচ্চার লাইগা নিরাপদ না। এইডা তো তুইও বোঝস।’
জেসমিনের বুক ফেটে কান্না এল। ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইল। শরিফা বানু বললেন, ‘ঠান্ডা মাতায় চিন্তা কইরা দ্যাখ। আইজ মুই আছি। কাইল মুই না থাকলে মাহফুজ আর নুরজাহানের হাতেইত্যা ক্যামনে বাঁচবি?’
জেসমিন চিন্তা করে দেখল শরিফা বানু ঠিক বলেছেন। কিন্তু মন সায় দেয় না তার। সে রঞ্জুর। শুধুই রঞ্জুর। মনেপ্রাণে সে রঞ্জুকেই ভালোবাসে। রঞ্জু নেই, রঞ্জুর সন্তান তো আছে। আবার বিয়ে করা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
শরিফা বানু ঘুমিয়ে পড়লে জেসমিন চিঠিটা বের করে হারিকেনের সামনে ধরে। কাগজটা পুরোনো হয়ে গেছে, কিন্তু লেখাগুলো আজও কত জীবন্ত! নিঃশব্দে অঝোরে কাঁদতে থাকে জেসমিন।
.
কদিন ধরে নুরজাহানের ঘুম হচ্ছে না। বাচ্চাটাকে দেখলে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না যে এটা মুস্তাফিজের বাচ্চা নয়। বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে, মুস্তাফিজ মিথ্যা বলে নি তো? এমন নয়তো যে জেসমিনকে সে বিয়ে করেছে! সে হয়তো গোপনে জেসমিন আর বাচ্চার সাথে দেখা করে! এমনও তো হতে পারে যে শাশুড়ি সব জানেন। তা না হলে তিনি জেসমিনকে এত আগলেই-বা রাখেন কেন?
দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারে না নুরজাহান। সারা রাত জেগে থেকে স্বামীকে পাহারা দেয়। আজ একটু চোখ লেগে এল। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, দেখে মুস্তাফিজ ঘরে নেই। ছুটে ঘর থেকে বের হলো সে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়িঘর মাথায় তুলল। প্রায় সবার ঘুম ভেঙে গেল। শেষে দেখা গেল মুস্তাফিজ বাথরুমে গিয়েছিলেন। তিনি নুরজাহানকে জোর করে ধরে তাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। নুরজাহান সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, “তুমি জেসমিনের ঘরে গেছিলা না?’
মুস্তাফিজ নুরজাহানের মুখ চেপে ধরে বললেন, “আস্তে জাহান, আস্তে। আমারে নাহয় না-ই বিশ্বাস করলা কিন্তু জেসমিন যে আম্মার লগে ঘুমায়, তা তো তুমি জানো।’
নুরজাহান একইভাবে বলল, ‘উনিই তো নাটের গুরু। উনি তো তোমাগো দলেরই লোক। নাইলে যেদিন তুমি অরে বাড়ি লইয়াইলা, ওই দিনই বাইর কইরা দিল না ক্যা? ছেড়িরে জাগা দিল ক্যা উনি?’
‘উফ্!’
মুস্তাফিজ নিজের মাথা চেপে ধরলেন। নুরজাহান এবার কিছু বলল না। মুস্তাফিজই বললেন, “তুমি কি বুঝতেছ জাহান, তুমি যে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গ্যাছ?’
‘আচ্ছা, এখন আমারে অসুস্থ বানাইতে চাও? বাহ্, আমারে অসুস্থ বানাইয়া তালাক দেওনের ধান্দা! এরপর কি ওই ছেড়িরে বিয়া করবা? নাকি কইরা ফালাইছ?’
মুস্তাফিজ নুরজাহানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘প্লিজ জাহান, মাফ করো আমারে। আমি আর নিতে পারতেয়াছি না। আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো। এইবার আমি অসুস্থ হইয়া যামু।’
নুরজাহান এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
ওদিকে তাদের কথা শুনতে পেয়ে কাঁদছে জেসমিন। সে যত দিন এই বাড়িতে থাকবে, তত দিন ওদের অশান্তি চলতেই থাকবে। সে কি পালিয়ে যাবে? কোথায় যাবে? এ বাড়িতে অন্তত কয়েকটা মানুষের মনে দয়ামায়া থাকায় সে এখনো টিকে আছে। অন্য কোথাও যে এটুকু দয়া পাবে, তার কী নিশ্চয়তা? জেসমিন জানে না কী করবে, তবু ভোরের আলো ফুটতেই মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
.
সকালবেলা মুস্তাফিজ হাসপাতালে না গিয়ে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে। আজমল তালুকদারের সাথে দেখা হয়ে গেল পুকুরপাড়ে। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘আরে মুস্তাফিজ! একলা ক্যা? আমার মায় কই?’
মুস্তাফিজ ইতস্তত করে বললেন, ‘আব্বা, আপনের সাথে একটু কথা আছিল। তাই অরে আনি নাই। আমি যে আইজ আইছি, এইডাও গোপন রাখবেন।’
‘কও কী! আচ্ছা, ঘরে আসো।’
‘না, ঘরে যামু না আইজ। এইহানেই খাড়াইয়া কথা কই। আসলে আব্বা, আমি খুব বিপদে পইড়া আপনের কাছে আইছি। আপনের সাহায্য দরকার।’
মুস্তাফিজের চেহারা দেখে তিনি বুঝতে পারছেন ঘটনা গুরুতর। কী হয়েছে, জানতে চাইলেন।
মুস্তাফিজ বললেন, ‘নতুন কিছু না। নুরজাহানের পুরান পাগলামি বাড়ছে। তবে এইবার ভয়াবহ রূপ নিছে। সারা রাত জাইগা আমারে পাহারা দেয়। অরে জরুরি ভিত্তিতে মানসিক ডাক্তার দেখানো দরকার। আমি বলায় খেপে গেল। আপনি একটা ব্যবস্থা করেন, আব্বা। দিন দিন ওর মানসিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এই রকম চলতে থাকলে ও শারীরিকভাবেও অসুস্থ হইয়া যাবে।’
এবার আজমল তালুকদারও অসহায় বোধ করলেন। তিনি বললেন, “ওই মেয়েটাকে তোমরা অন্য কোথাও পাঠাই দিচ্ছ না কেন?’
‘আব্বা, আপনি বোঝার চেষ্টা করেন। সমস্যা ওই মেয়ে না। অরে তো আম্মা কিছুদিনের মধ্যেই বিয়া দিয়া দেবে। সমস্যা নুরজাহানের অসুস্থতা। এই ধরনের অসুস্থতা হালকাভাবে নিতে নাই। আপনি শুধু একবার অরে ঢাকায় নিয়া ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করেন। ও একমাত্র আপনের কথাই মানে।’
আজমল তালুকদার মুস্তাফিজের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘ঠিকাছে, আমি ব্যবস্থা করতেছি।’
সারা রাত প্রসববেদনা সহ্য করে সকালবেলা একটি পুত্রসন্তান জন্ম দিয়ে মারা গেল মিনা। সদ্যোজাত শিশুটিকে নিয়ে খুশিতে মেতে ওঠার কেউ নেই। সবাই মিনাকে হারিয়ে দুঃখে-কষ্টে জর্জরিত। বাচ্চাটা তারস্বরে চিৎকার করছে। রেনু তাকে কোলে নিয়ে কাঁদছে। কাঁদছেন হালিমা, নীলা, এমনকি পাশের বাড়ির মহিলারাও। মুকুল পাথরের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছে। মিনা একটা বাচ্চা নষ্ট করে ফেলেছিল বলে তার ভীষণ রাগ হয়েছিল। তাকে খুশি করার জন্যই হয়তো মিনা আবারও মা হতে যাচ্ছিল। সে যদি জানত মিনা আরেকবার মা হতে গিয়ে মধুকেও মা-হারা করবে, তাহলে কখনোই আর মিনাকে মা হতে দিত না। কী করবে সে এখন এই বাচ্চা নিয়ে? ওকে কী খাওয়াবে? কীভাবে পালবে? প্রচণ্ড অসহায় লাগছে তার।
জেসমিনের বাচ্চা হবার পর মাসখানেকের জন্য তিন বউকে আবার রান্নার দায়িত্ব দিয়েছেন শরিফা বানু। এই কারণেই জেসমিন যে বাড়িতে নেই, তা টের পেতে একটু সময় লাগল তার। যখন টের পেলেন, তখন দুশ্চিন্তা হতে লাগল। কোথায় গেল মেয়েটা?
এদিকে জেসমিন গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতেই তার মেয়ে কাঁদতে শুরু করল। ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু এত ব্যস্ত জায়গায় কীভাবে খাওয়াবে ওকে। এদিক-ওদিক ঘুরেও এমন কোনো জায়গা খুঁজে পেল না, যেখানে বসে সে বাচ্চাকে খাওয়াতে পারে। নতুন মা হয়েছে সে। ঘরে বসেই এখনো খাওয়ানোতে অভ্যস্ত হয় নি। খোলা জায়গায় তো অসম্ভব। এমনিতেই অতি কৌতূহলী পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টিতে সে কোথাও দুমিনিট বসতে পারছে না। অবশেষে মেয়ের কান্না বাড়লে হাল ছেড়ে দিয়ে ডাক্তারবাড়ি ফিরে এল। তাকে দেখতে পেয়ে শরিফা বানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোই গেছিলি?’
জেসমিন ইতস্তত করে বলল, ‘মাইয়া কান্তেয়াছিল, কিছুতেই থামে না। হেল্লিগা অরে কোলে লইয়া একটু হাঁটতে বাইর অইছিলাম। পুস্কুনির ওই পাড়ে গেছিলাম গিয়া।’
কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না শরিফা বানুর। তবে তিনি কিছু বললেন না আর। জেসমিন ঘরে ঢুকে মেয়েকে খাওয়াতে লাগল।
ঠিক তখনই রেনু মিনার সদ্যোজাত ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ডাক্তারবাড়িতে উপস্থিত হলো। সকাল থেকে ক্ষুধা-যন্ত্রণায় কাঁদছিল ছেলেটা। রেনু পাগলের মতো একজন বাচ্চার মা খুঁজছিল, যে তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ায়। তখনই পাশের বাড়ির এক মহিলা বলল, ‘ডাক্তারবাড়ির কামের বেডির বাচ্চা অইছে গত সপ্তায়। হে তো হের বাচ্চারে বুকের দুধ খাওয়ায়। হের কাছে গিয়া খাওয়াইয়া আনো।’
রেনুকে বাচ্চা কোলে দেখে শরিফা বানু বললেন, ‘আরে রেনু! কেমন আছ? বাচ্চা কার?’
‘কাকি, বাচ্চা মিনার। বাচ্চা হওয়ার সময় মিনা মইরা গেছে। এহোনো মুখে কিছু দিতে পারি নাই। খিদায় কান্তেয়াছে পোলায়। আমনেগো কামের মাইয়াডা শুনলাম বাচ্চারে বুকের দুধ খাওয়ায়। অরে কি একটু খাওয়াইতে পারবে? গেরামে এমন আর কাউরে খুঁইজ্জা পাইলাম না।’
শরিফা বানু আফসোস করে উঠলেন, ‘আহা রে, কী অভাগা পোলা গো। একবারও মায়ের দুধ খাইতে পারল না। আহো, ভিতরে আহো। জেসমিনরে কইয়া দেহি।’
জেসমিন তার মেয়েকে খাওয়াচ্ছিল। বাচ্চা ছেলেটার মা তাকে জন্ম দিয়েই মারা গেছে শুনে খারাপ লাগল জেসমিনের। সে নিজের মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর ছেলেটাকে রেনুর কোল থেকে নিয়ে খাওয়ানো শুরু করল। জেসমিন রেনুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমনেগো বাড়ি কত দূর, আফা?’
রেনু বলল, ‘এই তো ধারেই। রাস্তার ওই পারে।’
জেসমিন বলল, ‘হেলে তো ধারেই। বাবুর খিদা লাগলেই লইয়া আইয়েন। মোর কোনো সমেস্যা নাই। ‘
রেনু চোখ মুছে বলল, ‘আল্লাহ তোমার ভালো করুক, বুইন। ‘
ঠিক এই মুহূর্তেই শরিফার মনে হলো, মুকুল ভালো পাত্র হতে পারে জেসমিনের জন্য। মুকুলের বড় ছেলেটাও এখনো অনেক ছোট। তার ওপর সদ্য জন্মানো আরেকটা ছেলে। মা ছাড়া এদের পালবে কীভাবে? রেনু সারা বছর থাকে অসুস্থ। মুকুলের বয়সও কম, ছেলে ভালো। গায়ের রং একটু ময়লা কিন্তু জেসমিনের জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্র আর হয় না। এখন ওরা জেসমিনের মেয়েটাকে মেনে নিলেই হয়। কিন্তু সবে মিনা মারা গেছে, এখনই বিয়ের কথা বলেন কোন মুখে? কদিন যাক। এরপর রেনুর কাছে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেবেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন