মৌরি মরিয়ম
মুকুলের এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কারণ, দুই ছেলে একসাথে কাঁদতে শুরু করেছে। মধু কেন কাঁদছে, জিজ্ঞেস করলে বলে জানে না। হয়তো মায়ের অনুপস্থিতি অনুভব করছে কিন্তু বুঝতে পারছে না। এদিকে ছোটটা কেন কাঁদছে, সেটা তো জিজ্ঞেস করারও উপায় নেই। হয়তো ক্ষুধা লেগেছে। ছোট বাচ্চাদের গরুর দুধ হজম হয় না। তাদেরকে ছাগলের দুধের সাথে সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। তাই রেনু ছাগলের দুধ পানি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে রেখে গেছে। কাঁদলে খাওয়াতে বলেছে। কিন্তু মুকুল প্রতি রাতেই এই চেষ্টায় ব্যর্থ হয়। রেনুর ঘুম ভাঙলে সে এসে খাইয়ে রেখে যায়। আজ এল না। সম্ভবত তার শরীরটা আবার খারাপ করেছে। মুকুল বাটিতে দুধ ঢেলে নিয়ে এল। চামচ দিয়ে একটু তুলে মুখে দিচ্ছে আর অমনি ছেলে তা ফেলে দিচ্ছে। মুকুল মুখ মুছিয়ে আবারও দিচ্ছে, ছেলে আবারও ফেলছে। এমন অসহায় দিন কখনো আসবে মুকুল কি ভেবেছিল? কেন চলে গেল মিনা? কিসের শাস্তি দিয়ে গেল তাকে?
জেসমিনের বাচ্চাটা ছোট বলে শরিফা বানু তার বাপের বাড়ি থেকে একটা কাজের লোক এনেছেন। তবে মেয়েটার রান্নার হাত ভালো না। তাই সে অন্য কাজ করে, রান্নাবান্না বউদেরই করতে হয়। যদিও বাচ্চা যতক্ষণ ঘুমায়, জেসমিন তাকে শরিফা বানুর কাছে রেখে রান্নাবান্না যতটুকু পারে এগিয়ে দেয়। তবু মাসখানেক যেতে না যেতেই একদিন নুরজাহান শাশুড়িকে বলল, ‘কামের মাইনষেরে আর কয় দিন বহাইয়া খাওয়াইবেন, আম্মা? ও ঘরে বইয়া আরাম করে আর কাম করতে করতে মরি মোরা। এইডা আমনের কেমন বিচার?’
শরিফা বললেন, ‘জেসমিন না থাকলে ক্যামনে করতা?’
‘না থাকলে যেমনে পারতাম করতাম। থাকতে করমু ক্যা?’
‘অর মাইয়াডা অনেক ছোডো। অরে রাইখ্যা কাম করবে ক্যামনে?’
নুরজাহান মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘আর কামের বেডিগো তো আর বাচ্চা অয় না। একলা অর অইছে।’
আরও কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর শরিফা বানুই থামলেন। তিনি না থামলে এই তর্ক কখনোই থামবে না। তার থামার আরেকটা কারণ হচ্ছে রেনু। মিনা-মুকুলের বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে দুধ খাওয়াতে। বাচ্চাটা কাঁদছিল। কাছাকাছি আসতেই শরিফা কিছু বলার আগে নুরজাহান বললেন, ‘নিজের বাচ্চায় ছুতায় কোনো কামে হাত দেয় না, এহন আবার আরেক বাচ্চা দুধ খাওয়ানের বর্গা লইছে।’
এ কথা শুনে চমকে উঠল রেনু। শঙ্কিতও হলো। যদি ওরা দুধ খাওয়াতে না দেয়, তাহলে বাচ্চাটাকে কী খাওয়াবে তারা? কৌটার দুধে যে খরচ, পুরা সংসার খরচ দিয়ে ফেললেও হবে না। শরিফা রেনুকে ঘরে নিয়ে গেলেন। জেসমিন বাচ্চাটাকে কোলে নিতে নিতে বলল, ‘আহা রে বাজান, বেশি খিদা লাগছে? থাক, আর কাইন্দ না, নেও, খাও।’
বাচ্চাটার কান্না থেমে গেল, সে আরাম করে খেতে লাগল। জেসমিন বলল, ‘আইজ এত দেরি করলেন ক্যা, আফা? পোলার তো ম্যালা খিদা লাইগ্যা গেছে।’
রেনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘শইলডা ভালো না, বুইন। আমার মাইয়াডারে এত কইরা কইলাম অরে লইয়া আইতে, হে শরমেই বাঁচে না।’
‘রাইতে কী খাওয়ান অরে?’
‘কী আর খাওয়ামু? গরিব মানুষ! ছাগলের দুধ খাওয়াই। খাইতে চায় না। জোর কইরা খাওয়ান লাগে। এই বয়সে এত খাওনের কষ্ট করে পোলাডা! কান্দন আহে আমার।’
জেসমিনের মনখারাপ হলো। দুধ পড়ে তার কাপড় ভিজে যায় অথচ ছেলেটা ক্ষুধায় কষ্ট করে!
.
রেনু যখন ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল, তখন শরিফা তার সাথে বের হলেন। রেনু জিজ্ঞেস করল, ‘কাকি, কই যান?’
শরিফা বাড়ি থেকে বের হয়ে তারপর বললেন, ‘রেনু, আমি তোমারে একটা প্রস্তাব দিতে চাই। তোমরাও আছ বিপদে। আমরাও আছি বিপদে। এর চেয়ে ভালো সমাধান আর অয় না।’
রেনু বুঝতে পারল না। সে জানতে চাইল, ‘কিসের প্রস্তাব, কাকি?’
‘তোমাগো মুকুলরে বিয়া করাবা না?’
রেনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘করাইতে তো চাই কিন্তু ও তো রাজি অয় না। ম্যালা বুজাইছি। হপায় বউডা মরছে তো। যাক কিছুদিন, হেরপর আবার চেষ্টা করমু। ছোডো ছোডো দুগ্গা পোলা। মুই এই বয়সে আর কয় দিন পালতারমু। তার ওপর শইলডাও বালো না।’
শরিফা বললেন, ‘মুই কই কি, মুকুল আর জেসমিনের বিয়া দিলে কেমন অয়?’
আকাশ থেকে পড়ল রেনু। বলল, ‘মাইয়া বিয়াতো না?’
‘বিধবা।’
‘আহা রে!”
শরিফা বানু বললেন, ‘মাইয়ার মাত্র ১৭ বছর বয়স। বাকি জীবন তো পইড়াই রইছে। এইল্লাইগ্যা পাত্র দেখতাছি। বিয়া দিয়া দিমু। খুব ভালো মাইয়া। কামকাইজও সব জানে। চেহারা তো তুমি নিজ চউক্ষে দেখছ। মুকুলেরও অল্প বয়স, ওর পোলাগোও মা দরকার। জেসমিনেরও একটা ঘর দরকার। তুমি মুকুলের লগে কথা কইয়া আমারে জানাও, মা গো। রাজি অইলে মাইয়া দেখানের ব্যবস্থা করমু।’
‘আচ্ছা কাকি।’
.
রেনু বাড়ি ফিরে দেখে মুকুল মধুকে গোসল করিয়ে এনে চুল মুছে দিচ্ছে। মধু জিজ্ঞেস করল, ‘আব্বা, আম্মায় কি আর আইবে না?’
মুকুল যন্ত্রের মতো বলল, ‘না।’
‘ক্যা? মায় কি রাগোইছে?
‘মানুষ মইরা গেলে আর আহে না।’
‘তয় মইরা গেল ক্যা?’
মুকুলের এত রাগ লাগছে, ইচ্ছা করছে এক চড়ে মধুর সব দাঁত ফেলে দেয়।
রেনু বলল, ‘তুমি নীলাবুর ধারে যাও। হে তোমারে আম কাইড্যা দেবেয়ানে।’
মধু চলে গেলে রেনু মুকুলকে বিয়ের প্রস্তাবটা দিল। মুকুল সঙ্গে সঙ্গে মানা করে দিল।
রেনু অবাক হয়ে বলল, “বিয়া করতে চাস না ক্যা তুই?’
মুকুল বিরক্তমুখে বলল, ‘ঘর-সংসার আমার ভালো লাগে না, ভাবি। এই সব গ্যাঞ্জামে আমি আর জড়াইতে চাই না।
রেনু রেগে গিয়ে বলল, “হেলে পোলাপান হওয়াইছ ক্যা? তোমার পোলাগো কেডা পালবে? হেরা কি বাতাসে বড় অইবে?’
‘তোমরা তো আছ। আমি আছি। সবাই মিল্লা পালমু।’
‘নাই আমি। তোগো ছোডোকালেইত্যা পালছি। তোগো পোলাপানও পালমু ক্যামনে? মোর শইল কি লোহা দিয়া বানাইছেনি আল্লায়? নিজের পোলাগো নিজে পালতে না পারলে, বিয়া না করলে মাইনষেরে পালতে দিয়া দে। মুই তোগো বাড়ির কামলা না।’
রেনু বাচ্চাটাকে বিছানার ওপর রেখে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাটা কাঁদতে শুরু করল। মুকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাচ্চাকে কোলে নিল। কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়ল।
মুকুলের বিয়ের ব্যাপারে বাড়ির সবার সাথে আলাপ করে রেনু। সব শুনে আব্বাসের প্রস্তাবটা পছন্দ হয়। মোকসেদ এই বাড়িতে অনেকটা অদৃশ্য হয়ে থাকেন। বেশির ভাগ বিষয়েই তিনি বিশেষ কোনো মতামত দেন না। এই বিষয়েও দিলেন না। বাদ সাধলেন হালিমা। তিনি বললেন, ‘মুকুলের বয়েস কম। বিয়া করাইতে অইলে আবিয়াতো মাইয়া বিয়া করামু। বিধবা, তার ওপরে বাচ্চা আছে, এমন মাইয়া বিয়া করানের কী এমন দরকার পড়ছে? মাইয়ার কি অভাব দুনিয়াতে?’
রেনু বলল, ‘আম্মা, মাইয়ার তো অভাব নাই। কিন্তু মুকুলের দুই পোলা এহনো ছোডো। অগো পালার মতো মাইয়া তো লাগবে। একটা বউ আইন্না দিলেই অইলো না। এই মাইয়া এককালে নরম-শরম। খুব বালো মাইয়া। দেখতেও সুন্দরী। সব মিলায়া মাইয়া আমার খুবই পছন্দ অইছে।’
হালিমা কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই আব্বাস বলল, ‘হোনো রেনু, এত মাইনষের মতামতের দরকার নাই। মুকুলের লগে ভালোমতো কতা কও। ও রাজি থাকলে এহনই বিয়ার ব্যবস্থা করমু। মা ছাড়া পোলাপানগুলার মুখের দিক চাওন যায় না।’
আব্বাসের এ কথার পর নিমেষেই সকলে চুপ হয়ে গেল।
.
মিনা মারা যাবার পর বাচ্চাদের নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল মুকুল যে এত দিন কাজে যেতে পারে নি। এদিকে টাকাপয়সাও সব শেষ। কাজে না গেলে খাবে কী? তাই ঠিক করেছে, আজ থেকে আবার কাজে যাবে। টুকটাক কিছু কাজ আছে। যাবার সময় বাচ্চাকে রেনুর কাছে দিতে যেতেই রেনু বলল, ‘মোর কি আর কাম নাই রে মুকুইল্যা? তোর পোলা মুই রাখতে পারমু না। এহন রানতে যামু, নাইলে গুষ্টিসুদ্ধা না খাইয়া থাহা লাগবে।’
মুকুল মুখ কালো করে বাচ্চাটাকে নিয়ে নীলার কাছে গেল। গিয়ে দেখে সে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। তাই তাকে আর কিছু বলল না। এবার গেল হালিমার কাছে। তিনি বললেন, ‘এই আপদ এহন আমার রাহন লাগবে?’
মুকুল অবাক হয়ে বলল, ‘আম্মা, আমনে আমনের নাতিরে আপদ কইলেন?’ নাতি-নাতকুর তো দাদা-দাদিই পাইল্যা দেয়।’
‘আপদ না তয় কী? জন্মাইয়াই তো মায়রে খাইল, এহন পুরা সংসারডা না খাইলেই অয়। ‘
খেঁকিয়ে উঠলেন হালিমা। মুকুল কিছু বলার আগেই মোকসেদ বললেন, ‘রাখ বাবা, তুই অরে এহেনে হোয়াই রাইক্কা যা। মুই দেখমুয়ানে।
মুকুল এবার বাচ্চাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাবাকে বলল, ‘কানলে ভাবির ধারে লইয়া যাইও। খাওয়াই দেবেয়ানে।’
কাজে গিয়েও মুকুল শান্তি পাচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল বাবা কি আসলেই বাচ্চাকে দেখে রাখতে পারবে? ভাবির রাগ কি ভাঙবে না?
নানান দুশ্চিন্তায় টিকতে না পেরে দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ফিরল মুকুল। ফিরে দেখে বাচ্চা ব্যথা পেয়েছে। এইটুকু সময়ের জন্য বাচ্চাটাকে এরা দেখে রাখতে পারল না! রাগে-অভিমানে, অসহায়ত্বে নিজেকে এক্ষুনি শেষ করে দিতে ইচ্ছা করল।
.
সন্ধ্যাবেলা রেনু বাচ্চার খাবার দিয়ে চলে যাচ্ছিল। মুকুল বলল, ‘ভাবি, মনু এগুলা খাইতে চায় না। এহনো ত রাইত অয় নাই। ওই বাড়িত্তা দুধ খাওয়াইয়া আনো না।’
রেনু কিছুক্ষণ আগেই বাচ্চাকে খাইয়ে এনেছে। কিন্তু মুকুলের কাছে গোপন করেছে। সে ধমক দিয়ে বলল, ‘পারমু না। ছেড়িরে বিয়া করতে চাস না। আবার দুধ খাওয়াইতে নিতে কস। তোর শরম করে না?’
মুকুল অবাক! সে বলল, ‘আরে, আমি তো হেরে চিনিই না। হেরে বিয়া করতে চাই না, এমন তো না। বিয়াই আর করতে চাই না। তুমিই তো হের ধারে মনুরে খাওয়াইতে নিতা। এইল্লাইগ্যা কইছি।’
‘আর পারমু না।’
রেনু মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল।
পরপর কয়েক দিন এ রকম চলার পর মুকুল বিয়ে করতে রাজি হলো। রেনু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। চিন্তামুক্ত হলো। মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা বললে মুকুল বলল, ‘দেহা লাগবে না। তোমরা তো দেকছই। বিয়ার ব্যবস্থা করো।’
জেসমিনও রাজি হলো। প্রথম দিকে বিয়ে করতে না চাইলেও যা কিছু ঘটে গেল, তারপর এখন এই বাড়ি থেকে বের হতে পারছে আর নিরাপদ একটা আশ্রয় পাচ্ছে, এতেই স্বস্তি পেল।
.
খুব তাড়াহুড়ার মধ্যেই অনাড়ম্বরভাবে বিয়েটা হয়ে গেল। কবুল বলার আগে জেসমিন মনে মনে বারবার একই কথা আওড়াচ্ছিল, ‘মাফ কইরা দিয়ো, রঞ্জু। এই অভাগিনীরে মাফ কইরা দিয়ো। সারা জীবন তোমার থাকতে পারলাম না।’
মুকুল বউকে কিছু দিতে পারল না, একেবারেই কিছু না। আব্বাস এখন যেখানে কাজ করছে, সেখান থেকে কিছু টাকা অগ্রিম চেয়ে এনে একটা শাড়ি কিনল। তা না হলে কী পরিয়ে বউ আনবে। এ বাড়ি থেকে ওই শাড়িটি ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হলো না। মুকুলের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে শরিফা জেসমিনকে পূর্বেই অবগত করেছেন। জেসমিন অবশ্য একটু নিরাপদ আশ্রয় ছাড়া আর কিছুই আশা করে না।
তবে শরিফা খরচাপাতি ভালোই করলেন। মুকুলের বাড়ির সবাইকে এক বেলা ভালো-মন্দ খাওয়ালেন। শুধু তা-ই না, জেসমিনকে তিনি যেসব শাড়ি পরতে দিয়েছিলেন, সেগুলো সবই অনেকখানি করে ছিঁড়ে গেছে। সেই সব কি আর নিতে দেওয়া যায়? তিনি জেসমিনকে দুটো শাড়ি কিনে দিলেন। মুকুলকে একটি পাঞ্জাবি কিনে দিলেন। সঙ্গে জেসমিন ও মুকুলের ছেলেমেয়েদের জন্য একটি করে জামাকাপড়।
মধু এত দিন চাচার জন্য বউ আনতে দেখেছে, ভাইদের জন্য বউ আনতে দেখেছে। এই প্রথম বাবার জন্য বউ আনতে দেখছে। বাবার জন্যও যে বউ আনা যায়, এটি সে জানত না। তবে সে ভীষণ খুশি। নতুন বউ তার খুব ভালো লাগে। চাচার বউ তার সাথে কথা বলত না। তার মন খারাপ হতো। কিন্তু বাবার বউ তার সাথে অনেক কথা বলছে। বাবার বউ সাথে করে একটা বাবুও এনেছে। চাচি বলেছে, এটা তার বোন। ভালোই হলো, এত দিন তার একটা ভাই ছিল, এখন একটা বোনও আছে। ওরা আরেকটু একটু বড় হলে আর পাশের বাড়িতে খেলতে যেতে হবে না। ওদের সাথেই খেলতে পারবে।
মধু জেসমিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘আচ্ছা, মুই তোমারে কী কইয়া ডাকমু?’
জেসমিন কিছু বলার আগেই রেনু বলল, ‘মা কইবা, বাবা।’
মধু অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘মা কমু ক্যা? মোর মায় তো মইর্যা গেছে। যে মইরা যায়, হে আর কোনো দিন আহে না, এই কতা তুমি জানো না, কাকি?’
রেনু কিছু বলার আগেই জেসমিন বলল, ‘তোমার আমারে কী ডাকতে মনে চায়, বাজান? তোমার যা ডাকতে মনে চায়, তাই ডাইকো।’
মধু এক সেকেন্ডের মধ্যে বলল, ‘মোর তোমারে নতুন বউ ডাকতে মনে চায়।’
রেনু জেসমিন দুজনেই হেসে দিল। জেসমিন বলল, ‘তাইলে তাই ডাইকো।’
মধু ভীষণ খুশি হলো।
এবার রেনু বলল, ‘হইছে মধু, এইবার ঘুমাইতে লও।’
মধু বিনাবাক্যে রওনা হলো। কারণ, রেনু তাকে বলেছে সে এখন বড় হয়েছে। যেহেতু তার আরেকটা ভাই ও আরেকটা বোন এসেছে, তাই তাকে তার ইমরান ভাইয়ের সাথে থাকতে হবে। বড়রা একসাথে থাকবে, আর ছোটরা একসাথে থাকবে। যদি সে এখনো এখানে থাকতে চায়, তাহলে তার নতুন ভাই-বোন আর নতুন বউয়ের জায়গা হবে না। রেনুর এই এককথাতেই সে রাজি হয়ে গেছে। এমনিতেও ইমরানকে মধুর ভীষণ পছন্দ। ইমরানের সাথে ঘুমালে সে মধুকে দারুণ দারুণ সব গল্প শোনায়।
জেসমিন বলল, ‘ও থাকুক না, আফা। ওর তো ওর বাপের লগে ঘুমাইয়াই অভ্যাস।’
রেনু কিছু বলার আগেই মধু বলল, ‘না না, নতুন বউ, মুই যদি এহেনে থাহি, তয় তুমি কই থাকপা? মোর নতুন ভাই আর নতুন বুইনে কই থাকপে?’
জেসমিনের লজ্জা লাগছে। সে স্পষ্টই বুঝতে পারছে রেনুই মধুকে আগেভাগে এসব বুঝিয়ে রেখেছে। মধু থাকলে সে একটু নিশ্চিন্তে থাকত। লোকটাকে এখনো দেখেও নি জেসমিন। যদিও লোকটা এখন তার স্বামী, তবু চেনে না, জানে না। খুব অস্বস্তি লাগছে। কীভাবে সে একটা অচেনা লোকের কাছে নিজেকে সঁপে দেবে?
দুই ছেলে-মেয়ের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবনায় বুঁদ হয়ে ছিল জেসমিন 1 তখনই দরজা খোলার শব্দ পেয়ে জেসমিন ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নিল। মুকুল মধুকে ঘরে না দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘মধু কই?’
জেসমিন ইতস্তত করে বলল, ‘আফায় লইয়া গ্যাছে।’
‘কোন আফা?’
‘আমনের ভাবি।’
মুকুলের মনটা ভার হয়ে গেল। তার সাথে ঘুমিয়ে অভ্যাস মধুর। কাজটা ঠিক করে নি ভাবি। মুকুল জেসমিনের উদ্দেশে বলল, ‘মধু যদি আমাগো লগেই থাকে, তোমার কোনো অসুবিধা অইবে?’
জেসমিন সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘না না, মোর কোনো অসুবিধা নাই।’
‘আচ্ছা, তাইলে গিয়া নিয়া আহি। ও মোরে ছাড়া ঘুমাইতে পারবে না, কানবে।’
মুকুল বেরিয়ে গেল। লোকটাকে ভালো লাগল জেসমিনের। নতুন বউ পেয়ে যে ছেলেকে ভুলে যায় নি, সে নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ।
.
মুকুল মধুকে ডাকতে গিয়ে দেখে কান্না তো বহুদূর, সে ইমরানের সাথে গুটুর গুটুর করে গল্প করছে। মুকুল বলল, ‘মধু, ঘুমাইতে আয়।’
মধু উঠে বসে বলল, ‘ঘুমাইতেই তো আইছি।’
‘তুই এহেনে ঘুমাবি?’
অবাক হলো মুকুল। মধু বলল, ‘হয়, মুই ত বড় অইয়া গেছি। হেইল্লাইগ্যা এহেনে ঘুমামু। এইডা বড় ভাইগো ঘর। আর ছোড ভাই ছোডো বুইনে তোমার লগে ঘুমাইবে।’
ধমকে উঠল মুকুল, ‘এত পাকনামি কে হিকাইছে তোরে? রাইতে তো উইড্যা কানবি। আয় কইলাম।’
‘কানমু না, তুমি যাও। মুই এহন বড় ভাই।’
ইমরান বলল, ‘কাকা, তুমি চিন্তা কইরো না। মধু তো মোর লগে আগেও ঘুমাইছে। কোনো সময় কান্দে নাই।’
মধু বলল, ‘হয় কান্দি নাই।’
অগত্যা মুকুল ফিরে এল ঘরে। রেনুর ওপর রাগ হলো তার। একদম বিয়ের দিন থেকেই ছেলেটাকে সরিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল? একটু লজ্জাও লাগছে। রেনু কী মনে করে তাকে?
মুকুল একা ফিরে এলে জেসমিনের মনে আবারও ভয় ঢোকে। ঘোমটার আড়াল থেকেই বলল, ‘আইলো না?’
‘না।’
মুকুল বিছানার এক কোনায় বসল। তারপর বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কাছে মুই আজীবন ঋণী থাকমু।’
জেসমিন অবাক হলো, তারপর আড়চোখে তাকাল মুকুলের দিকে। এই প্রথম তাকে দেখল। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যা?’
‘এই যে জন্মের দিনেইত্যা আমার পোলাডারে খাওয়াইতেয়াছ।’
হাসল জেসমিন, ‘এ আর এমন কী?’
‘অনেক কিছু, মোর লাহান বিপদে পড়লে বুঝতা। সারা রাইত পোলা কোলে লইয়া বইয়া থাকতাম। কোন সময় রাইত পোহাইবে আর ভাবি অরে খাওয়াইতে নেবে। কিছুই খাইতে চাইত না, খালি কানত।’
জেসমিন চুপচাপ শুনল। সেও যদি নিজের বিপদের কথা মুকুলের মতো এত অনায়াসে বলতে পারত! মুকুল প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘জেসমিন, তুমি মোর ব্যাপারে কতডু জানো, তা জানি না। মুই গরিব মানুষ। আয়-উপার্জন খুবই কম। ঘর-সংসার করার মতো না। মধুর মার লগে যহন বিয়া অয়, তহন বয়স অনেক কম, ঘর-সংসার বুজি না। বাপ-মায় বিয়া করাইতে চাইছে, মুইও কইর্যা হালাইছি। বউরে কী খাওয়ামু, এই চিন্তা মাথায় কোনো দিন আহে নাই। মিনা অনেক কষ্ট করছে মোর লগে ঘর করতে যাইয়া। এহন ঘর-সংসার বুজি, তাই চাই নাই আর কেউ এই কষ্ট করুক। এই ডরেই বিয়া করতে চাই নাই আর। কিন্তু পোলাপানের লাইগা করতে অইলো। তোমারও হয়তো কষ্ট করা লাগবে। মাফ কইরা দিয়ো।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘জানি। তয় আমনে মনে অয় মোর ব্যাপারে কিছুই জানেন না। মাইনষের বাড়ি আশ্রিত থাকার চেয়ে স্বামীর বাড়িতে অভাবে থাকন ভালো।’
নতুন বউ বলে হয়তো মিষ্টি কথা বলছে, এ কথা ভেবে মুকুল হাসল। তারপর তাকাল জেসমিনের দিকে। কিন্তু ঘোমটায় মুখ ঢেকে রেখেছে। রাখুক, লজ্জা একটু কমুক। সে বলল, ‘মাইয়াডারে দেও, একটু কোলে লই।’
এই ছোট্ট একটা কথায় জেসমিনের বুকের ভেতরটায় ভেঙেচুরে কান্না এল। এটা খুশির কান্না, নাকি কষ্টের, সে বুঝতে পারল না। মেয়েকে বিছানা থেকে তুলে মুকুলের কোলে দিল। তখন জেসমিনের আঁচলটা পড়ে গেল। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ‘মাশা আল্লাহ’ বলে জেসমিনের দিকে তাকাতেই মুকুলের বুক কেঁপে উঠল! এ কি মানুষ, নাকি কোনো পরি? মানুষ কি এত সুন্দর হয়? এই মানুষটা তার স্ত্রী? আসলেই একে বিয়ে করেছে সে? মুকুলের কথা আটকে গেল, আরেকটু হলে নিশ্বাস আটকে যেত। মুকুল চোখ সরিয়ে নিল। জেসমিন আবারও ঘোমটা দিল। ওর দিকে তাকাতেও এখন ভয় লাগছে মুকুলের। প্রচণ্ড অস্থির লাগছে!
মুকুল এতটাই এলোমেলো হয়ে গেছে যে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অস্থিরতা কমলে নাহয় কথা বলবে। কিন্তু এই অস্থিরতা কমার কোনো লক্ষণ নেই। মুকুল মেয়েকে ফেরত দিয়ে কোনোরকমে বলল, ‘বিছনাডা ছোডো। আমাগো সবাইর অইবে না। তুমি পোলা-মাইয়া লইয়া শোও। আমি নিচে বিছনা করি।’
বিছানাটা বেশ বড়। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তাদের কেন জায়গা হবে না, সে বুঝল না। বলল, ‘হেলে আমনে বিছনায় শোন। মুই নিচে শুই।’
‘আরে, না না। তুমি নতুন বউ। তুমি নিচে শুইবা ক্যা? তার ওপর তোমার লগে দুই পোলা-মাইয়া।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘মধু মোরে মা কইতে চায় না। কী কইতে চায়, জানেন?
‘কী?’
‘নতুন বউ।
মুকুল হো হো করে হেসে দিল। জেসমিনও খিলখিলিয়ে হাসল। মুকুল খুব চেষ্টা করল জেসমিনের হাসিমুখটা দেখার কিন্তু ঘোমটার যন্ত্রণায় পারল না।
হাসাহাসি শেষ হলে জেসমিন বলল, ‘মুই কই কি, নিচে বিছনা করোন লাগবে না। বাবুরা এহনো ম্যালা ছোডো। এই বিছনায় আরামসে অইয়া যাইবে।’
মুকুল বলল, ‘আচ্ছা, শুইয়া পড়ো তাইলে। ম্যালা রাইত অইছে।’
জেসমিন দুই বাচ্চাকে নিজের দুই পাশে রাখল। একজন টিনের দেয়ালের পাশে, আরেকজন মুকুলের পাশে। তারপর নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ল। সে এখন বেশ নির্ভার বোধ করছে। এই যে মানুষটা তাকে একটু সহজ হবার সময় দিয়েছে, এটুকুতেই সে বুঝিয়ে দিয়েছে সে কেমন মানুষ।
অস্থিরতায় সারা রাত ঘুমাতে পারল না মুকুল। অন্য দিকে জেসমিন এত দিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমাল। সকালবেলা জেসমিন মুকুলকে বলল, ‘মনুরা ঘুমাইতেয়াছে। আমনে একটু অগো দেখতারবেন? হেলে মুই ইকটু আফার লগে হাত লাগাই। বেচারি হেই কোন কাল হইতে একলা একলা সব কাম করতেয়াছে।’
মুকুল অভয় দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, মুই আছি। তুমি যাও।’
রেনু কেবল রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জেসমিন রান্নাঘরে ঢুকে রান্না করতে চাইলেই রেনু বলল, ‘আরে, তুমি নতুন বউ। যাও যাও, কয় দিন আরাম করো।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘এই যে নিজের একখান ঘর অইছে, এইডাই আরাম গো আফা। আমনে মোরে দেন। দেহেন কেমন রান্দি।’
‘তুমি যে ভালো রান্দো, এইডা মুই জানি। ডাক্তারের মায় কইছে। আচ্ছা, চাইতেয়াছ যহন, রান্দো।’
জেসমিন খুব দ্রুত কাজ করে। চোখের পলকে রান্নাবান্না শেষ করে ফেলল। রান্না শেষে রান্নাঘরটা যখন গোছাচ্ছিল, তখন সেখানে এসে হাজির হলেন হালিমা।
কোনো ভালো-মন্দ কথা নেই, হুট করেই জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘এই মাইয়া, ডাক্তারবাড়িতে কত দিন কাম করছ?’
জেসমিন বলল, ‘সাত-আট মাস অইবে।’
‘হেলে তো মেলা দিন। পয়সাপাতি কেমন জমাইছ?’
জেসমিন অবাক হলো। রেনু চাপা গলায় বলল, ‘আম্মা! কী কন এগুলা!”
হালিমা রেনুকে ধমকে বললেন, ‘তুই চুপ কর। বেয়াদব কোনহানকার, শাশুড়িরে ধমকাস।’
রেনু চুপ হয়ে গেল। কিন্তু এমন প্রশ্নে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছে সে। হালিমা এবার জেসমিনকে ধমকে বললেন, ‘এই ছেড়ি! কতা কস না ক্যা?’
জেসমিন বলল, ‘আসলে আম্মা, থাকা-খাওয়ার লাইগ্যা কাম করতাম। পয়সাপাতির বিষয় আছিল না।’
হালিমা ক্ষিপ্তস্বরে বললেন, ‘ওরে আমার দয়ার সাগর!’
চেঁচামেচি শুনে মুকুল এসে দরজায় দাঁড়াল। ঠিক সেই সময় আব্বাস বাড়িতে ঢুকছিল। মুকুল কিছু বলার আগেই সে বলল, ‘রেনু, কী অইছে এহেনে?’
রেনু দ্রুত বলল, ‘কিছু অয় নাই। আমরা এমনেই কথা কইতেয়াছিলাম।’
হালিমা মুহূর্তেই সেখান থেকে সরে গেলেন। হালিমা সরে গেলে আব্বাস আর মুকুলও সরে গেল। রেনু জেসমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি মনে কষ্ট নিও না বুইন। উনি একটু এই রকমই।’
‘না না, কষ্ট পাই নাই।’
জেসমিন কাজ শেষ করে ঘরে আসতেই মুকুল বলল, ‘আম্মা কী কইতেয়াছিল তোমারে?’
জেসমিন মাথা নিচু করে বলল, ‘তেমন কিছু না।’
‘আমার কাছে লুকাইও না। সব কথা শুনতে পারি নাই। চেঁচামেচি শুইনা গেছি, তহনই ভাইজান আইছে আর আম্মা থাইম্মা গেছে।’
জেসমিন ইতস্তত করে ঘটনাটা বলল। মুকুল বলল, ‘এই লোভই ওনারে ডুবাইছে। লোভ কইরা ছোডো পোলারে হারাইছে। বছরে এক দিন চেহারা দেখতেও আহে না। হেরপরেও শিক্ষা অয় নাই।’
জেসমিন চুপ।
মুকুল আবার বলল, ‘হোনো, ওনারে পাত্তা দেওয়ার দরকার নাই। ওনারে যত বেশি পাত্তা দেবা, তত খারাপ ব্যবহার পাইবা। ওনার লগে যত শক্ত অইতে পারবা, উনি তত ডরাইবে। এইডা আমরা নিজে নিজে বুজি নাই। আমাগো ছোডো ভাইয়ের বউ প্রমাণ কইরা দিয়া গেছে।’
‘আহ্, থাক না। বাদ দেন।’
‘আইছে! আরেক রেনু!”
জেসমিন মুচকি হাসল। সেই হাসি মুকুল দেখল না। কারণ, জেসমিন ঘোমটা দিয়ে অন্য দিকে ফিরে কথা বলে।
জেসমিন বাচ্চাদের কাছে গেল। ওদের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। একজনের ঘুম ভেঙেছে। আরেকজন এখনো ঘুমে। মুকুলের সামনে খাওয়াতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। কিন্তু সে স্বামী, তাকে তো আর বাইরে যেতে বলা যায় না। উল্টো দিকে ঘুরে বসে বাচ্চাটাকে আঁচলের তলায় নিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। জেসমিনের অস্বস্তিটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সেটা খেয়াল করেই মুকুল ঘর থেকে বের হয়ে গেল। জেসমিন আবারও হাসল।
.
একদিন রাতের বেলা মধুকে পড়তে বসিয়েছে মুকুল। কিছুতেই তাকে এক, দুই, তিনের ধারাবাহিকতা শেখানো যাচ্ছে না। সে বলছে, এক, চার, তিন, পাঁচ। পাঁচের পর থেকে আবার দশ পর্যন্ত ঠিকঠাক পারে। মুকুল বিরক্ত হয়ে ধমকাচ্ছিল। জেসমিন মধুকে বলল, ‘বাজান, তোমরা মোট কয় ভাই-বুইন?’
মধু ঠোঁট উল্টে বলল, ‘মুই তো জানি না, নতুন বউ।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘তোমরা পাঁচ ভাই-বুইন। সবার বড় কে, কও তো?’
‘ইমরান বাইয়া।’
‘হেরপর?’
‘নীলা বু।’
‘নীলা বুর পরে কে?
এবার মধু নিজেকে দেখিয়ে বলল, ‘মধু। কিন্তু হেরপর কে, এইডা তো জানি না। ছোডো মনুরা তো দুইজন একই সোমান।’
‘না, তোমার বুইনে তোমার ভাইয়ের থেইক্কা এক মাসের বড়। বেবাকটির ছোডো তোমার ভাই।’
‘ও।’
‘এইবার শোনো, তোমার ইমরান বাইয়া অইল এক, তোমার নীলা বু দুই, তুমি তিন, তোমার ছোডো বুইনে চাইর, আর তোমার ছোডো ভাইয়ে পাঁচ। এইবার এক থেইক্কা কও দেহি, বাজান।’
মধু একেকজনের চেহারা মনে করে করে বলল, ‘এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ।’
জেসমিন হাততালি দিয়ে বলল, ‘সাব্বাস, এই তো পারছে আমার বাজানে।’
মধু আরও একবার বলল, এবারও ভুল হলো না। তারপর সে পড়া রেখে উঠে ছুটে গেল জেসমিনের কাছে। জেসমিন তাকে কোলে নিল। তারপর মুকুলের দিকে তাকিয়ে মধু বলল, ‘তুমি পড়াইতে পারো না। মুই তোমার ধারে পড়মু না। মুই কাইল হইতে নতুন বউর ধারে পড়মু।’
মুকুল বলল, ‘অইছে কাম! নেও, আরেকখান কাম বাড়ল তোমার।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘ধুর, কী যে কন! আমার আর কাম কী?’
মধুকে কোলে নিতে গিয়ে জেসমিনের আঁচল সরে গেছে। তাই হাসিটা মুকুল দেখল। এই হাসি সুন্দর কি না, সে জানে না। সে শুধু জানে এই হাসি দেখলে হুঁশ থাকে না।
মুকুল কাজে গিয়ে শান্তি পায় না। সারাক্ষণ অস্থির অস্থির লাগে। জেসমিনের জন্য মন কেমন করে। যদিও সে এক মাথা ঘোমটা দিয়ে থাকে। মুখটা দেখা যায় না ভালোভাবে। তবু জেসমিনের আশপাশে গেলে, তার কণ্ঠস্বর শুনলে শান্তি শান্তি লাগে। এখন যেখানে কাজ করছে, সেই জায়গা বাড়ির কাছেই। নানান ছুতোয় বারবার বাড়ি আসে মুকুল। আজ মুকুলের মেজাজ খারাপ। দুপুরের আগে একবার এসেছিল। জেসমিনের দেখা পায় নি। দুপুরবেলা এসে জেসমিনকে ঘরে পেয়ে বলল, ‘তোমার কারবারটা কী, কও দেহি? দিনরাইত সব সময় একটা ঘুড্ডির লেঞ্জার লাহান লম্বা ঘোমটা দিয়া থাহো ক্যা? মুই তো তোমার স্বামী? নাকি পরপুরুষ?’
জেসমিন মুখ টিপে হাসল। মুকুল বলল, ‘হাসির কী কইলাম?’
জেসমিনের বলতে ইচ্ছা করল, ‘মুই নাহয় ঘোমটা দিয়া থাহি। আমনের লগে কি হাত নাই? সরাইতে জানেন না?’
কিন্তু কথাটা বলতে পারল না জেসমিন। রঞ্জু হলে সে নিশ্চিত এটাই বলত। কিন্তু মুকুলকে পারল না। আগের জেসমিন আর নেই। মাঝে মাঝে নিজেকেই চিনতে পারে না সে। এত বদলে গেল কীভাবে? ভয়? ভয়ই কি তাকে এতটা বদলে দিয়েছে? ভয় আর বিপদের সাথে তাল মেলাতে মেলাতেই কি ত্যাড়া কথাগুলো আর মুখে আসে না তার?
সেদিনের পর জেসমিন ঘরের বাইরে ঘোমটা দিয়ে থাকলেও ঘরের ভেতর ঘোমটা দেয় না। দিনেও না, রাতেও না। এখন মুকুল যখন ইচ্ছা প্রাণভরে জেসমিনকে দেখে। যতক্ষণ ঘরে থাকে, ততক্ষণই তাকিয়ে থাকে। জেসমিন টের পায়। কিন্তু তার কোনো অস্বস্তি হয় না। মুকুলকে নিয়ে তার যাবতীয় অস্বস্তি, সংকোচ—সব কখন যেন কপূরের মতো উড়ে গেছে।
.
শরিফা বানু একদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে এলেন জেসমিনকে। জেসমিন তখন উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিল। তাকে দেখতে পেয়েই ঝাড়ুটা ফেলে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছুটে এল। তারপর সালাম করে বলল, ‘কেমন আছেন, খালা? আমনের কতা ম্যালা মনে পড়ে! কিন্তু খবর লইতে যে যামু, ডর লাগে।’
শরিফা বানু হেসে বললেন, ‘ভালো আছি গো, মা। ওই বাড়ি আর তোর যাওন লাগবে না। মুই-ই আমু তোরে দেখতে। বাপের বাড়ি গেছিলাম এর মইধ্যে, নাইলে আরও আগেই আইতাম।’
‘বাড়ির সবাই কেমন আছে?’
‘ভালো আছে। নুরজাহানেরও মাথা ঠিক হইছে। অর তো সব চিন্তা তোরে লইয়াই আছিল।’
জেসমিন হাসে। যে বিষয়ে তার একদিন খারাপ লাগত, সেই বিষয়ে এখন হাসি পায়।’
জেসমিন শরিফা বানুকে ঘরে নিয়ে বসাল। নিজ হাতে বানানো মুড়ির মোয়া খেতে দিল। শরিফা বানু জেসমিনের সংসার দেখে ভীষণ শান্তি পেলেন। জানতে চাইলেন, ‘জামাই কেমন? কোনো অসুবিধা নাই তো?’
এ কথায় জেসমিন লজ্জা পেয়ে বলল, ‘খালি একটা আশ্রয়ের লাইগ্যা বিয়া করছিলাম। কিন্তু এত ভালো একজন মানুষ পামু, স্বপ্নেও ভাবি নাই খালা। আমনের এই ঋণ মুই ক্যামনে শোধ করমু, জানি না।’
‘ধুর পাগল। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ যা চাইছে, তাই অইছে।’
.
বর্ষা এসে গেছে। খালে মাছ ধরার মৌসুম। নানান জিনিসপাতি লাগে মাছ ধরতে। বাঁশ দিয়ে এমনই নানান রকম অভিনব জিনিস তৈরি করেছে মুকুল। তারই একটা প্রস্তুত করে রাখছে সকালের জন্য। সকালে এটা নিয়ে মাছ ধরতে যাবে। জেসমিন মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। তার মাঝেই বলল, ‘মনুগো নাম রাখবেন না? বড় অইয়া যাইতেয়াছে না অরা?’
মুকুল হেসে বলল, ‘রাহো তুমি।
‘এহ্, মুই একলা রাখমু ক্যা? পোলাপান কি মোর একলার? দুইজন মিল্লা রাহি।’
মুকুল একটু ভেবে বলল, ‘আচ্ছা, মাইয়ার নাম আয়না রাখলে কেমন অয়? ও ত আয়নার মতোই, স্বচ্ছ, সুন্দর।’
জেসমিনের চোখ দুটো জ্বলে উঠল, ‘খুব সুন্দর নাম। আমার পছন্দ অইছে।’
‘যাও, হেলে অর নাম রাখলাম আয়না। এইবার পোলার নাম তুমি রাহো।’
এবার জেসমিন ভাবতে বসল। ভেবে বলল, ‘পোলার নাম হীরা রাহি?’
‘রাহো। খুব সুন্দর নাম।’
মুকুলের কাজ শেষ হয়ে গেল। সে সব গুছিয়ে রেখে যখন শুতে এল। তখন জেসমিন বিছানা গুছিয়ে বাচ্চাদের শোয়াচ্ছে। আয়নাকে টিনের দেয়ালের পাশে রেখে হীরাকে মুকুলের পাশে রাখতে গেলেই মুকুল কাছে এসে বলল, ‘অরে আপাতত ওই পাশেই রাহো না।’
জেসমিন চমকে তাকাল। বাচ্চাদের জন্য বানানো কাজল চিকন করে চোখে দিয়েছে সে। কী যে সুন্দর লাগছে তাকে! মুকুল জেসমিনের সেই কাজলকালো চোখের দিকে তাকিয়ে ঘোরলাগা গলায় বলল, ‘অবশ্য তোমার যদি আপত্তি না থাকে।’
মুকুলের ওই দৃষ্টিতে জেসমিনের শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। সে হীরাকে আবার আয়নার পাশে শুইয়ে দিল। দুজনের মাঝে একটা কোলবালিশ দিল। একজন নড়লে যাতে আরেকজন ব্যথা না পায়। জেসমিন বাচ্চাদের দিকে ফিরে শুয়ে পড়ল। মুকুলও হারিকেনের আলো কমিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর জেসমিনের দিকে ফিরে নিজের একটা হাতের ওপরে ভর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘জেসমিন?’
‘হুম?’
‘আমারে কি তোমার পছন্দ অইছে?’
জেসমিন না তাকিয়েই উত্তর দিল, ‘এইডা আবার কেমন কতা?’ মুকুল প্রথমবারের মতো জেসমিনের হাত ধরে বলল, ‘কও না।’ এবার জেসমিন মুকুলের দিকে ফিরল। তারপর বলল, ‘মুই কি আমনেরে এ রহম কোনো প্রশ্ন করছি? আমনে করেন ক্যা?’
মুকুল আবারও জেসমিনের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘পরিগো কোনো মাইনষেরে এই প্রশ্ন করা লাগে না। কিন্তু সাধারণ কোনো মানুষ যদি হুট কইরা কোনো পরি পাইয়া যায়, হেলে এই প্রশ্ন বাধ্যতামূলক।’
‘ধুর!’
জেসমিন লজ্জা পেয়ে মুকুলের বুকে মুখ লুকাল, নিঃসংকোচে। মুকুল জেসমিনের মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শরম করলে কানে কানে কও।’
জেসমিন সরে যেতে চাইল, মুকুল আবার তাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘উঁহু, বহুত দূরে দূরে থাকছ। আর না।’
অনেক দিন পর জেসমিনের মুখে যেন বুলি ফুটেছে। সে বলল, ‘আমনে দূরে রাখছেন।’
‘তা রাখছি। যাতে একটু আগের লাহান কোনো ভয়, কোনো সংকোচ ছাড়াই বুকে আইতে পারো।’
জেসমিন মুকুলের দিকে তাকিয়ে হাসল। মুকুল সেই হাসিমাখা ঠোঁটে তপ্ত চুমু খেল। ভালোবাসার শুভ সূচনা হলো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন