জিম্মি – ১০

কাজী আনোয়ার হোসেন

দশ

সাভাতে স্টাইলে পা দুটো ফুট দেড়েক ফাঁক করে দাঁড়িয়েছে ব্যারি। একটু সামনে ঝুঁকে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে সে রানার দিকে, খুব সাবধানে। রানা দাঁড়িয়েছে জুডোর ভঙ্গিতে ব্যারির দিকে পাশ ফিরে—আঘাত করার লক্ষ্য যতটা ছোট করা যায় ততই ভাল। সামান্য একটু তেরছা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যারিও— হাত দুটো তার শরীরের সাথে তিরিশ ডিগ্রী কোণ করে দুপাশে নেমে এসেছে, হাতের আঙুলগুলো সোজা অবস্থায় খোলা। সমস্ত শক্তি নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে সে লাফিয়ে লাথি মারার জন্যে—সাভাতে মারপিটের বিশেষত্বই এটা।

নিকষ কালো অন্ধকার রাত। প্রথম ল্যান্ডিং আর নিচের আর্ক ল্যাম্প থেকে সামান্য আলো শুধু এসে পড়েছে জায়গাটায়। হঠাৎ করেই প্রথম লাথিটা এসে পড়ল রানার ডান হাতের বগলের কাছে। মনে হলো লোহার ডাণ্ডা দিয়ে বাড়ি মেরেছে যেন কেউ তাকে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল রানা। লাফিয়ে আবার প্ল্যাটফর্মের ওপর উঠে পরের আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে তৈরি হলো। বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে। চোখেমুখে উড়ে এসে পড়ছে চুল, দু’হাতে সরাচ্ছে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। চারদিক থেকে যেন শয়তান আক্রমণ করেছে ওকে আর দুহাতে ও ঠেকাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু না, সাক্ষাৎ শয়তান একটাই—রানার ঠিক সামনেই নাচতে নাচতে এগিয়ে আসছে আবার। সুযোগ খুঁজছে সে মোক্ষম লাথিটা মারার ঠিক মত লাগাতে পারলে উড়ে গিয়ে পড়বে রানা টাওয়ারের নিচে।

ডান হাতটা ডলতে ডলতে তৈরি হলো রানা। কপাল গুণেই যেন বেঁচে গেছে সে প্রথম বার। পেট লক্ষ্য করে মেরেছিল ও। না বুঝেই অনুমানে বসে পড়েছিল ও।

এবারে আক্রমণটা এল রানার হাঁটু লক্ষ্য করে। হাঁটুই ব্যারির সবচেয়ে কাছে। পা ভাঁজ করে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে রানা। দেহটাকে ভাঁজ করে প্রশ্নবোধকচিহ্নের মত করে ফেলল ব্যারি। সরু পথটা ছেড়ে তার পা নয় ইঞ্চি উপরে উঠে গেছে। দেহটাকে অদ্ভুত কায়দায় সরু ব্রিজটার সাথে সমান্তরাল করেই ঝাড়ল প্রচণ্ড লাথি।

এবার প্রস্তুত ছিল রানা। কোথায় মারবে আগেই আন্দাজ করেছিল সে। লাফিয়ে একপাশে সরে গিয়েই সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে জুডো চপ মারল ঊরু লক্ষ্য করে।

কিন্তু ব্যারির পা আর এখন ওখানে নেই। শূন্যের ওপরই ডিগবাজি খেয়েছে সে—এখন তার অন্য পা আঘাত করল রানার হাঁটুর নিচে। প্রথম লাথির মত জোর নেই এতে—জায়গাটা নীল হয়ে গেল শুধু।

আবার দক্ষ জিমনাস্টের মত শরীরটা মুচড়ে ফেলল ব্যারি। দু’পা একই সাথে পড়ল প্ল্যাটফর্মে—নিখুঁত ভাবে সুষম। ছুটে গেল রানা ওর দিকে—পাঁজর লক্ষ্য করে চালাল লাথি। হো হো করে হেসে অদ্ভুত কায়দায় ব্যাক সমারসল্ট দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল ব্যারি। দেহটা নাচছে তার মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর বিখ্যাত প্রজাপতি নাচের মত।

ব্যারির তুখোড় দক্ষতার সামনে নিজেকে অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর, অসহায় মনে হলো রানার। মাথা ঝাঁকিয়ে দূর করবার চেষ্টা করল সে ভাবনাটা, কিন্তু পারল না। বুঝতে পেরেছে আন-আর্মড কমব্যাটে ব্যারির কাছে সে দুগ্ধপোষ্য শিশু মাত্র। কিন্তু তাই বলে হাল ছাড়ল না সে।

আবার ছুটে গেল রানা ওর দিকে। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল সে, লাফিয়ে স্টীল ফ্লোর ছেড়ে উঠে গেল ব্যারি। এবারেই মারবে সে তার শেষ লাথিটা—একটা অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার সমাপ্তি ঘটবে।

বিশৃঙ্খল ভাবে আক্রমণ করে ব্যারিকে কাবু করা যাবে না ভেবে হঠাৎ থেমে পড়ল রানা। এদিকে শূন্যে উঠে পড়েছে ব্যারি। তার জয় নিশ্চিত—লাথিটা ভয়াবহ গতিতে লাগবে রানার হৃৎপিণ্ডের ওপর—মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যু ঘটবে ওর। প্রাণহীন দেহটা ডিগবাজি খেতে খেতে আছড়ে পড়বে টাওয়ারের তলায় কংক্রীটের ওপর।

তার লক্ষ্যে কোন ভুল ছিল না—যে শক্তিতে ছুঁড়েছে লাথিটা তা যে-কোন পালোয়ানকে প্রাণে মারার জন্যে যথেষ্ট। রানার তিন ইঞ্চি দূর দিয়ে গেল ওর পা। যে গতিতে এগোচ্ছিল রানা সেই গতিতে এগোলে ঠিক হৃৎপিণ্ডেই লাগত লাথিটা।

চিৎপাত হয়ে পড়ল ব্যারি লোহার ফ্লোরে। হাত দিয়ে ঠেকিয়ে পিঠটাকে কিছুটা বাঁচাল সে।

উড়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে পড়ল রানা বুকের ওপর। ‘হুঁক’ করে শব্দ হলো ওর মুখ থেকে। কলার ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে দাঁড় করিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা ঘুসি মারল রানা ওর পেটে। দু’ভাঁজ হয়ে গেল ব্যারির শরীর—এবার রানার হাঁটু সজোরে গিয়ে লাগল ওর মুখে—টলতে টলতে পিছিয়ে গেল সে। লাথি খাওয়ার ঝালটা এতক্ষণে কিছুটা মিটিয়ে নিল রানা ওর পাঁজরে একটা লাথি মেরে। সাবধান হয়ে গেল ব্যারি।

কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছে না রানা। কাছেই ঘেঁষতে পারছে না সে ব্যারির। পায়ের রেঞ্জের মধ্যে গেলেই লাথি চালাচ্ছে ব্যারি। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে জুডো হোল্ডে ব্যারির জামা ধরল রানা। হিপ থ্রো করে ওকে নিচে ফেলবে সে। কিন্তু তার আগেই ব্যারির লাথি খেয়ে আবার ছিটকে পড়ল রানা। মাটিতে আছড়ে পড়েই লাথির অপেক্ষা করছে রানা। মাংস পোড়া গন্ধ এল ওর নাকে। চোখ খুলে ব্যারিকে আশপাশে কোথাও দেখল না। হাতের মুঠো খুলে দেখল ব্যারির ট্যাগটা চলে এসেছে ছেঁড়া জামার সঙ্গে।

ল্যাপ লেজার তার নির্ধারিত কাজই করেছে। বাতাসে মাংস পোড়া গন্ধ ছাড়া ব্যারির আর কোন চিহ্নই রইল না।

.

রেস্তোরাঁয় কমপিউটর মনিটরের সামনে লেপঙের পাশে দাঁড়িয়ে কবির চৌধুরী। লেপং রিপোর্ট করল একটা ল্যাপ লেজার ফায়ার করেছে এইমাত্র। মনিটরের স্ত্রীনে লম্বা উজ্জ্বল রেখা দেখা যায় প্রত্যেক ফায়ারিঙের সাথে সাথে।

স্ক্রীনের দিকে মনোযোগ দিল কবির চৌধুরী—রাতের পাখি হতে পারে—তার শত্রুও হতে পারে। আবার একটা রেখা স্ক্রীনের এমাথা থেকে ছুটে চলে গেল ও মাথা পর্যন্ত—ব্যারির মৃত্যুটাই প্রত্যক্ষ করল সে স্ক্রীনে।

‘আমাকে ফায়ারিঙের পজিশনটা দাও।’ নির্দেশ দিল সে।

রবার্ট ঘরে ঢুকল একটু পরেই। অস্থির পায়চারি থামিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল কবির চৌধুরী, ‘ব্যারি কোথায়?’

‘আমি তো ভেবেছিলাম আপনার সাথেই আছে।’

‘দেখতেই তো পাচ্ছ নেই,’ খেঁকিয়ে উঠল কবির চৌধুরী, ‘ডাকো ওকে ব্লীপারে।’ রেডিও নিয়ে তাড়াতাড়ি সিগন্যাল পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রবার্ট। একটু অপেক্ষা করে আবার সিগন্যাল পাঠাল সে—এবারেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। রবার্টকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কবির চৌধুরী নিজেই বোতাম টিপে সিগন্যাল পাঠাল।

‘জবাব দিচ্ছে না কেন?’ বিরক্ত হয়ে বলল সে।

‘হয়তো…’

‘হয়তো কি?’

জবাব দিতে পারল না রবার্ট

ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল কমিউনিকেশন ভ্যানের টেলিফোন। ফোন ধরে রিসিভার বাড়িয়ে দিল সোহানা রাহাত খানের দিকে। প্রেসিডেন্ট জোন্‌স,’ বলল সে।

‘রাহাত খান বলছি।’

‘আমি জোন্‌স্‌, সিনেটের মীটিং শেষ হয়েছে—মুক্তিপণ দেয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা।

‘অত্যন্ত ভাল সিদ্ধান্ত। টাকাটা দিতে রাজি না হলে শুধু প্রেসিডেন্টকেই নয় গোটা যুক্তরাষ্ট্রকেই অপমান করা হত,’ মন্তব্য করলেন রাহাত খান।

‘টাকাটা ক্যাশ দেয়া হচ্ছে। টাকা নিয়ে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার জন্যে এয়ারফোর্সের দুটো এফ ১১ তৈরি আছে—কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা হয়ে যাবে,’ জানালেন প্রেসিডেন্ট জোনস।

‘ঠিক আছে, ওদের নির্দেশ দিন সুইস ব্যাঙ্কে টাকা নিয়ে হাজির থাকতে—কিন্তু আমার টেলিফোন না পাওয়া পর্যন্ত যেন কবির চৌধুরীর অ্যাকাউন্টে জমা না দেয়। আরেকটা কথা—আপনি নিজে টেলিফোনে সুইস ব্যাঙ্কের হেড অফিসকে অনুরোধ জানান তারা যেন আজ রাত দশটা পর্যন্ত অফিস খোলা রাখে।’ বক্তব্য শেষ করলেন রাহাত খান।

‘তাহলে কি টাকাটা এখনই দেয়া হচ্ছে না?’ মায়ের জন্যে একটু যেন উদ্বেগ প্রকাশ পেল তাঁর গলায়।

‘আপনার মায়ের পূর্ণ নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রেখেই কাজ করব আমরা। আসলে শেষ সময় সীমা পর্যন্ত দেখতে চাই আমি। টাওয়ারে কবির চৌধুরীর লোকের সাথে আমারও দুজন এজেন্ট কাজ করছে। ভাল কর্মী ওরা। ওদের একজনকে ভাল করেই চেনেন আপনি…মাসুদ রানা।’

‘তাই নাকি? মাসুদ রানা আছে ওখানে? অনেকটা ভরসা পাচ্ছি শুনে।’

‘ওর সাথে আরও একজন যোগ্য এজেন্ট রয়েছে আমাদের। আমি দেখতে চাই ওরা কতদূর কি করতে পারে। শেষ পর্যন্ত টাকা দেয়ার সুযোগ তো থাকছেই।’

‘অগ্রগতির খবর…’

‘আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব।’

‘ভেরি গুড। থ্যাঙ্কিউ।’ লাইন কেটে দিলেন প্রেসিডেন্ট।

.

ভি আই পি রূম থেকেই রানা শুনতে পেল কবির চৌধুরীর গলা। পোর্টেব্‌ল লাউড স্পীকারে সবাইকে রেস্তোরায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে।

সবাই জড়ো হয়েছে রেস্তোরাঁয়। রবার্টকে চেক করে দেখার নির্দেশ দিল কবির চৌধুরী।

‘ব্যারি হোমস, পিটার উডকক আর টিচ্ ছাড়া সবাই উপস্থিত, স্যার।’ রিপোর্ট করল সে।

‘গত পনেরো মিনিটের মধ্যে তোমরা কেউ ব্যারিকে দেখেছ?’ সবার ফাঁকা চাহনি আর মাথা নাড়া ছাড়া কোন জবাব মিলল না।

‘কিংবা পিটার উডকককে?’ এবারেও একই উত্তর।

‘টিকে দেখেছ কেউ?’

‘ভি আই পি রূমের সামনে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আমি,’ জবাব দিল একজন কমান্ডো। ‘এই…দু’মিনিট আগেই ‘

‘হুঁ,’ থমথমে গম্ভীর হয়ে গেছে কবির চৌধুরীর মুখ, ‘টাওয়ারে এমন জায়গা নেই যেখান থেকে আমার রেস্তোরায় আসার নির্দেশ শোনা যাবে না। তোমরা সবাই পরিষ্কার শুনতে পেয়েছ। হয় তারা টাওয়ারে নেই—কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়—কিছু একটা ঘটেছে হয়তো। ওদের খুঁজে বের করতে হবে—এখনই।’

খোঁজার জায়গা ভাগ করে দিল কবির চৌধুরী তার লোকজনের মধ্যে। শেষ আদেশটা দিল ডেভিডকে—তারা একসাথে যাবে কবির চৌধুরীর সাথে ভি আই পি রূমে চেক করতে। ডেভিডের পিছন পিছন রবার্টও রওনা হলো। রূপাও রূপার উপর ভার পড়েছে ভি আই পি রূম সহ পুরো ব্লকটার। অর্থাৎ প্রথম লেভেলের পুরোটা চক্কর দিতে হবে ওকে। ওখানে পৌঁছতেই দেখা গেল টিচ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে

‘রেস্তোরাঁয় রিপোর্ট করোনি কেন? ধমকে কৈফিয়ত চাইল কবির চৌধুরী।

‘আপনিই তো হুকুম দিয়েছেন কোন অবস্থাতেই আমার পোস্ট ছাড়া চলবে না?’

‘মাইকে দেয়া হুকুমটাও তো আমারই ছিল।

কোন জবাব না দিয়ে ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল টিচ্।

নির্দেশ অমান্য করার অপরাধ ক্ষমা করে দেয়ারই সিদ্ধান্ত নিল কবির চৌধুরী। আসলেও টিচের পাহারায় থাকাটাই সঙ্গত কাজ হয়েছে।

‘সব ঠিক তো?’ জিজ্ঞেস করল কবির চৌধুরী।

‘কেউ ধারে কাছেও ঘেঁষেনি। অন্তত আমি যতক্ষণ গার্ড আছি, কেউ আসেনি।’

নিজেই দরজা খুলল কবির চৌধুরী। ডেভিডকে দরজার কাছেই থাকতে বলে এগিয়ে গেল সে। চেয়ারটা ঠিক দরজার উল্টোদিকে ঘোরানো। ঘরে কেউ নেই। কাঁপা-কাঁপা হাতে জানালা খুলে বাইরে তাকাল কবির চৌধুরী, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই পড়ল না তার চোখে।

ডেভিডের দিকে ফিরল সে। বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে। তার চোখ একবার টিচ্ তারপর রবার্ট আর সবশেষে ডেভিডের ওপর ফিরে এল।

পরমুহূর্তে চিৎকার করে উঠল কবির চৌধুরী, ‘তোমরা যে যেখানে আছ সবাই শুনে রাখো—এটা অসম্ভব!

রবার্টকে বোকার মত তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেল তার। বোকার মত হাঁ করে দেখছ কি? খোঁজো! প্রত্যেকটা জায়গা, প্রত্যেকটা জিনিস তন্ন তন্ন করে খুঁজবে।’

এবার টিকে নিয়ে পড়ল সে। শার্টের কলার ধরে ওকে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেউ ধারে কাছে আসেনি, না? বুড়িটা এখান থেকে বেরোল কি করে?’

টিচ্ হাতের ইশারায় জানালাটা দেখিয়ে দিল।

‘মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? এই বয়সে? পাকা দড়াবাজ ছাড়া ওই পথে নামা অসম্ভব।’

‘তা ঠিক, কিন্তু পিটার উডকক পারে,’ বলল টিচ, ‘আপনিও ট্রেনিঙের সময় দেখেছেন, তার পক্ষে যে কোন দুর্গম জায়গায় ওঠা বা নামা সম্ভব।’

‘হয়তো তোমার অনুমানই ঠিক। আমাদের এখন অঙ্ক কষে হিসেব করে কাজ চালাতে হবে। আমার স্থির বিশ্বাস ওরা এখনও টাওয়ারেই আছে। যাও, প্রত্যেকে খুঁজতে লেগে যাও।’

টিচ্ ভি আই পি রূমের তালা লাগাতেই কবির চৌধুরী ঘুরে দাঁড়াল, ‘তালা দিয়েছ?’ মাথা ঝাঁকাল সে। ‘গুড।’ তালা থেকে চাবিটা বার করে নিতে নিতে মন্তব্য করল কবির চৌধুরী।

লেপং এসে খবর দিল মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফোন করেছেন।

‘নতুন কোন খবর আছে? নাকি সেই পুরানো গীতই গাইবে?’ গত আলাপের পর থেকেই তার ওপর খেপে আছে কবির চৌধুরী।

‘হ্যাঁ, অবশ্যই একটা খবর আছে আপনার জন্যে। সিনেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই প্রেসিডেন্টের মার এরকম অসহায় মৃত্যুর সম্ভাবনায় নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। টাকা আমরা দেব—কিন্তু…’

‘আবার কিন্তু কি?’ কথার মাঝখানেই ধমকে উঠল কবির চৌধুরী।

‘মানে খুবই তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে আমাদের পক্ষে—সময়টা যদি একটু বাড়াতেন তবে খুব ভাল হত।’

‘রাত দশটা—এটাই আমার শেষ কথা।’ টেলিফোন ছেড়ে দিল কবির চৌধুরী।

.

সোফার আড়ালে মেঝেতে বসে আছে দু’জনেই। ভি আই পি রূম থেকে সবাই বেরিয়ে যেতে বদ্ধাকে নিয়ে রানা আবার ভি আই পি রূমেই ঢুকেছে। পুরো টাওয়ারে এটাই এখন সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। ভুলেও কেউ এখানে ওদের খোঁজ করতে আসবে না। এতক্ষণ অন্ধকারে একটা গার্ডারের আড়ালে লুকিয়ে ছিল সে মিসেস জোনসকে নিয়ে। জানালা গলে ফিরে এসেছে আবার।

‘এবার কি করবে কিছু ঠিক করেছ, মিস্টার উডকক?’ মিসেস জোনস জানতে চান।

‘রানা,’ হাসল সে, ‘এরা আমাকে পিটার উডকক বলে জানলেও আমার আসল নাম মাসুদ রানা। আপনি আমাকে রানা বলেই ডাকবেন।’ বলতে বলতে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল রানা।

ওরা খুঁজে পাওয়ার আগেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের। প্রথম কাজ হচ্ছে ডাইভার্শন।’

একটা বাল্ব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রানা। পট্টি লাগাল সে বাবের চারপাশে—তারপর সুইচ অন করল। শুধু বালবের লাল আভাটুকু দেখা যাচ্ছে এখন। জানালার ধারে এসে সিগন্যাল পাঠাতে শুরু করল রানা। সে জানে রাহাত খান অপেক্ষা করছেন তার সিগন্যালের জন্যে।

সোহানা কমিউনিকেশনস ভ্যানের ছাদে শুয়ে বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে নজর রেখেছে টাওয়ারের ওপর। কনুইয়ে ভর দিয়ে অনেকক্ষণ থাকার পর এখন শুয়েছে চিৎ হয়ে। কিন্তু পাঁচ মিনিটও যায়নি টাওয়ারের একটা আলো জ্বলতে নিভতে দেখে হুড়মুড় করে সিধে হয়ে বসল সে।

গাড়ির ছাদে শব্দ শুনে কি হলো জানতে চাইলেন রাহাত খান।

‘টাওয়ারে একটা আলো জ্বলছে আর নিভছে—কোন সিগন্যাল হতে পারে। হ্যাঁ, ঠিক তাই—রানা যোগাযোগ করছে—প্রথম কয়টা কথা বুঝতে পেরে জানাল সোহানা।

মেজর জেনারেল আর মশিয়ে পম্পেদু দু’জনেই বেরিয়ে এলেন সোহানার কথায়।

‘কি বলছে রানা?’ অসহিষ্ণু ভাবে প্রশ্ন করলেন রাহাত খান।

‘আমাদের পক্ষে আরও একজন কাজ করছে—নাম ডেভিড। মেসেজ জোরে জোরে পড়ে যাচ্ছে সোহানা। ‘আমি মিসেস জোনসকে নিয়ে পালাবার চেষ্টায় আছি—সবাই খোঁজাখুঁজি করছে আমাদের—ডাইভার্শন দরকার—সম্ভব হলে মুক্তিপণের টাকা এখনই পাঠান।’ মেসেজ শেষ করল সোহানা।

‘মশিয়ে পম্পেদু,’ বললেন রাহাত খান, ‘যে করেই হোক টাকার একটা ব্যবস্থা এখন করতে হবে।’

‘আমি এখনই ফোন করছি ফাইন্যান্স মিনিস্টারকে। আগেই বলা আছে। টাকা রেডি থাকারই কথা।’

ফোন তুলে নিলেন মশিয়ে পম্পেদু, ‘কনফারেন্স রুম? পম্পেদু বলছি, ফাইন্যান্স মিনিস্টারকে চাই। জলদি।।’

.

রেস্তোরাঁয় পায়চারি করছে কবির চৌধুরী। বোঝা যায় অস্থির হয়ে উঠেছে সে। ডান হাতে ঘোড়া ছোটাবার ছড়ি। ছড়ি দিয়ে কখনও টেবিলের ওপর, কখনও বা সোফার পিছনে সপাং সপাং বাড়ি মারছে সে। ডেভিড টেলিফোনে রিপোর্ট নিচ্ছে—রূপা আর রবার্ট ওয়াকি টকির রিপোর্ট প্যাডে নোট করছে।

‘কেউ কিছু রিপোর্ট করেছে?’ ক্রমেই যেন আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে কবির চৌধুরী।

মাথা নাড়ল ডেভিড, রূপা আর রবার্টও নতুন কোন তথ্য দিতে পারল না।

‘কিন্তু উডকক কিভাবে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিল?’ কপাল কুঁচকে গেছে কবির চৌধুরীর। ‘এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে ও আসলেই উডকক কিনা।’

‘কিন্তু ডাক্তারের রিপোর্টে তো জন্মদাগ পর্যন্ত মিলে গেছে?’ কবির চৌধুরীর সন্দেহ ভঞ্জন করতে চাইল রবার্ট।

‘ছদ্মবেশ সম্পর্কে যদি স্পষ্ট ধারণা থাকত তোমার তাহলে বুঝতে।

‘আমি বাজি রেখে বলতে পারি—সব রেকর্ড আমি চেক করেছি—ও ঠিকই উডকক। সবই একদম ঠিক ঠিক মিলেছে।’

‘দেখা যাবে—সেটা দেখা যাবে। আমার হয়ে যারা কাজ করে তারা কেবল একটাই ভুল করার সুযোগ পায়।’ ক্রুর হাসি ফুটে উঠল কবির চৌধুরীর ঠোঁটের কোণে। ‘তুমিও তোমার শেষ ভুলটা করেছ কিনা কে জানে?’

রবার্টের মনে হলো যেন মুখ থেকে তার রক্ত সরে যাচ্ছে। সে—ই নতুন পাঁচজনকে পরীক্ষা করে, রেকর্ড চেক করে ও. কে. করেছিল।

হঠাৎ রূপার সামনে এসে থামল কবির চৌধুরী। ‘তোমার সাথেই লক্ষ করেছি ওর খাতির ছিল সবচেয়ে বেশি।’ ছড়ির মাথায় লাগানো চামড়া রূপার গালে ছুঁইয়ে ধীরে ধীরে নিচে টেনে থুতনির তিলটার ওপর এনে স্থির করল কবির চৌধুরী।

বিরক্তিকর একটা পরিস্থিতি। এক পা পিছনে সরে গেল রূপা। ‘অপমানিত হওয়ার জন্যে আপনার সাথে যোগ দিইনি আমি। কেউ বলতে পারবে না আমার কর্তব্যে আমি বিন্দুমাত্র অবহেলা করেছি।’

ছড়িটা সরিয়ে নিল কবির চৌধুরী।

‘আমিও একই কথা ভেবেছিলাম,’ বলে উঠল ডেভিড, ‘আপনি যেদিন বলেছিলেন বেশি হৃদ্যতা ঠিক নয়, সেদিন থেকেই প্ৰায় ছায়ার মত ওদের পেছনে আমি লেগে ছিলাম—কিন্তু সন্দেহ করার মত কিছুই পাইনি।’

‘হতে পারে—হতে পারে।’ বলতে বলতে আবার উত্তেজিত ভাবে পায়চারি শুরু করল কবির চৌধুরী। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়েই ছড়িটা সশব্দে নামিয়ে আনল সে টেবিলের কাচটার ওপর। ‘খুঁজে ওদের পেতেই হবে।’ ক্রুদ্ধ গর্জনে ফেটে পড়ল কবির চৌধুরীর কণ্ঠস্বর।

.

ফোন নামিয়ে রাখল মশিয়ে পম্পেদু। স্পাঁচ মিনিটের মধ্যেই টাকা পৌঁছে দেয়া হবে টাওয়ারে। কবির চৌধুরীকে খবরটা এখনই জানানো হবে।

রাহাত খান সোহানাকে বললেন খবরটা রানাকে জানিয়ে দিতে। টর্চ নিয়ে সিগন্যাল পাঠানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সোহানা। এমন একটা কোড ব্যবহার করছে যেটা বি.সি.আই এজেন্ট ছাড়া আর কারও পক্ষে ডিসাইফার করা সম্ভব নয়। টাওয়ার থেকে আর কেউ লক্ষ করলেও বুঝবে না কিছু।

গদিতে হেলান দিয়ে বসে মশিয়ে পম্পেদু তাঁর উৎকট গন্ধের টোব্যাকো পাইপটা ধরালেন। খোলা জায়গায় বলে আর আপত্তি করলেন না রাহাত খান। কনফারেন্স রূমে ওই পাইপ খাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। ‘ঘটনা পরিণতির দিকে যাচ্ছে, অথচ আমরা এখনও জানি না কবির চৌধুরী টাওয়ার ছেড়ে কোন্ পথে পালাতে চায়,’ মন্তব্য করলেন মশিয়ে পম্পেদু।

অন্যমনস্ক ভাবে মাথা ঝাঁকালেন মেজর জেনারেল। প্যারিস সিটি ইঞ্জিনিয়ার্স-এর সুপারিনটেন্ডেন্ট তখনও ব্যস্ত টাওয়ারের ম্যাপ নিয়ে। তার দিকে এগিয়ে গেলেন রাহাত খান, ‘আপনি কি একেবারে নিশ্চিত যে কোন রকম কোন সুড়ঙ্গ পথ বা প্যাসেজই নেই টাওয়ারের তলায়?’

‘বলেছি তো স্যার, তেমন কোন পথ অন্তত এই ম্যাপে দেখানো নেই। টাওয়ারের চারটি খুঁটিই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানে, এখানে, এখানে আর এখানে।’ ম্যাপের ওপর আঙুল ঠুকল সে। ‘হ্যাঁ, একটা ইলেকট্রিকাল ইন্সপেকশন চেম্বার আছে। কবির চৌধুরীর লোকজনকে ওখানে ইলেকট্রিক তার নিয়ে যেতে দেখা গেছে। কোন রকম সুড়ঙ্গ পথ টাওয়ারের তলায় নেই। আছে পানির পাইপ, পাওয়ার লাইন, আর আছে নিউমাটিস্ আর হাইড্রলিক্‌স্—সবগুলোই রয়েছে চালু অবস্থায়।’

পম্পেদু বললেন, ‘ওদের একটা হেলিকপ্টার আছে আমরা জানি—কিন্তু ওটা ব্যবহার করা সম্ভব নয়—এয়ারফোর্স ছাতু করে দেবে হেলিকপ্টার।

‘হেলিকপ্টার!’ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন মেজর জেনারেল। ‘অবশ্যই, ওরা যদি কোন স্টেজে ওটা ব্যবহার করার প্ল্যান করে থাকে—পাইলট জানবে কোথায় কখন কবির চৌধুরীকে তুলে নিতে হবে। আর্মি জেনারেলকে চাই আমি। স্যাতো দখল করে ওই পাইলটকে ধরে আনতে হবে।’

.

টেলিফোন ডিউটিতে রয়েছে লেপং। রিং হতেই রিসিভার তুলল, ও-প্রান্তের বক্তব্য শুনে বলল, ‘এক মিনিট ধরুন, আমি স্যারকে ডেকে দিচ্ছি।’

রিসিভার নামিয়ে রেখে গ্যালারির দিকে ছুটল লেপং। একটা সার্চ পার্টি সহ খালি হাতেই ফিরছে কবির চৌধুরী। ‘তিরিশ মিলিয়ন ডলার রেডি, স্যার—আপনি কখন ডেলিভারী চান জানতে চাইছে ওরা।’

‘বেশ, বেশ, এই তো পথে আসছে। ডেভিড, একটা সার্চ লাইট দিয়ে সদর রাস্তার ওপর আলোর ব্যবস্থা করো। যে কেউ দাগের দিকে আসবে তার ওপরই স্থির ভাবে আলো ধরবে। কোন রকম চালাকির সুযোগ যেন না পায়। রবার্ট, দু’জন লোককে পাঠাবে টাকা নিয়ে আসার জন্যে।’

রিসিভার তুলে নিল কবির চৌধুরী। ‘হ্যালো…হ্যাঁ, আমরা এখনই ডেলিভারী নিতে প্রস্তুত…পাঠিয়ে দিন।’ অল্প কথায় কাজ সারল সে।

.

পন্ট দিয়েনা যেখানে কোয়েই ব্রানলিকে বিভক্ত করেছে—টাওয়ারের নদীর ধারের সেই দিকটা থেকে একটা মিলিটারি আর্মার্ড ট্রাক দাগ আর ব্যারিকেডের মাঝামাঝি জায়গায় এসে থামল। ফরাসী সেনাবাহিনীর আটজন কমান্ডো নামল গাড়ি থেকে। প্যাসেঞ্জার সীটে বসা অফিসারের দিকে গেল সবাই, পরবর্তী নির্দেশের জন্যে।

চড়া গলায় কি একটা নির্দেশ দিল অফিসার। ফ্লোরেসেন্ট পেইন্ট দিয়ে একজন মাটিতে একটা দাগ কাটল। বাকি সবাই ট্রাকে ফিরে গিয়ে চারটে অ্যালুমিনিয়াম সুটকেস বের করে আনল। অফিসারের নির্দেশে কবির চৌধুরীর দেয়া দাগের তিন ফুট দূরে লাইন করে সাজিয়ে রাখল ওরা বাক্সগুলো।

টাওয়ার থেকে সার্চ লাইট জায়গাটাকে দিনের মত উজ্জ্বল করে ফেলেছে। মুখ ঢাকা দুটি মূর্তি দেখা গেল টাওয়ারের নিচে—টাকা নিয়ে যেতে আসছে ওরা।

আটজন কমান্ডো দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে—সবাই সশস্ত্র ও প্রস্তুত। বাছাই করা লোক এরা। পৃথিবীর সেরা ট্রেনিংপ্রাপ্ত এজেন্টদের সাথে মোকাবেলা করেও মাঝে মাঝে জিতেছে বলে রেকর্ড আছে ওদের।

টাওয়ারের লোক দু’জন দাগের একটু ভিতরেই থেমে দাঁড়াল। বুক পকেটের কাছে লাগানো ট্যাগ গাড়ির হেড লাইটের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠছে। ওদের মধ্যে একজন ওয়াকি টকিতে যোগাযোগ করল রবার্টের সাথে। বিনকিউলার দিয়ে অবস্থাটা মোটামুটি বুঝে নিয়ে কি যেন নির্দেশ দিল ওয়াকি টকিতে।

একজন সঙ্গীকে ছেড়ে দাগের দুই ফুটের মধ্যে এগিয়ে এল। বাক্সগুলো দেখিয়ে সে বলল কবির চৌধুরী ওগুলো দাগের ওপর চায়।

‘অর্ডার নেই। আমার আর একচুল সামনে এগোবার উপায় নেই।’ জবাব দিল তরুণ অফিসার। ‘তোমার নিতে হয় যেখানে আছে সেখান থেকে নিয়ে যাও।’

একটু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল যেন কবির চৌধুরীর কমান্ডো। মনে মনে হিসেব করল সে দাগ থেকে সুটকেসের দূরত্ব। দাগের বাইরে বের হলেই আট-আটজন সশস্ত্র সৈনিকের সম্মুখীন হতে হবে—অর্থাৎ নির্ঘাত মৃত্যু। ফিরে গেল সে সঙ্গীর কাছে—রবার্টের সাথে যোগাযোগ করল আবার।

নির্দেশ পেয়ে এবার দু’জনেই এগিয়ে এল একসঙ্গে। দাগের খুব কাছে। ‘কবির চৌধুরীর নির্দেশ, ওগুলো দাগের সাথে ছুঁইয়ে রাখতে হবে। আর তা যদি না করা হয় তবে পরিণতির জন্যে কবির চৌধুরী দায়ী থাকবেন না। চড়া গলায় বলল ওদের একজন।

‘কবির চৌধুরী কে? তার নির্দেশ আমি মানতে যাব কেন?’ বলল তরুণ অফিসার, ‘আমি যার আদেশ মেনে চলি তিনি হচ্ছেন আমাদের চীফ জেনারেল ব্রুনো; কবির চৌধুরীর ইচ্ছায় এখানে কোন কাজ হবে না।

‘ভুল করছ, তোমাকে কবির চৌধুরীর ইচ্ছা মতই কাজ করতে হবে।’ কথা বলে উঠলেন রাহাত খান পিছন থেকে। এগিয়ে এসে লেফটেনেন্টের সামনে দাঁড়ালেন তিনি। ‘ওগুলো দাগের ওপর নিয়ে গিয়ে রাখো।’

‘আপনাকে চিনতে পারলাম না, মশিয়ে,’ বলে উঠল অফিসার।

‘আমি একজন জেনারেল। তোমাদের প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত অনুরোধে আমি রেড প্রায়োরিটি নিয়ে এই অপারেশনের প্রধান হিসাবে কাজ করছি। জেনারেল ব্রুনোর সাথে একটু আলাপ করে নিলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার।’

অস্বস্তির ভাব দেখা গেল অফিসারের মধ্যে। ‘এক মিনিট, স্যার—আমি একটু আসছি।’ ট্রাকের পিছন দিকে গিয়ে ওয়াকি টকিতে সে কি যেন কথাবার্তা বলল—দুই মিনিট পর ফিরে এসে বলল, ‘আপনার কথা মতই কাজ হবে, মশিয়ে জেনারেল।’ তারপর বাক্সগুলো দেখিয়ে নির্দেশ দিল সে। দু’জন কমান্ডো খুব সাবধানতার সঙ্গে বাক্স চারটে দাগ ছুঁইয়ে রেখে এল। কবির চৌধুরীর কমান্ডো দু’জন দু’হাতে দুটো বাক্স নিয়ে রওনা হলো টাওয়ারের দিকে।

টাকাগুলো গোণার জন্যে একটা দল আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিল, ওরা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে কবির চৌধুরী তাদের কাজে লাগিয়ে দিল। কমান্ডো দু’জনের কাছে পুরো ঘটনা শুনল সে—চেহারার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানতে চাইল বাক্সগুলো দাগের ওপর রাখা হলো যার কথায় সেই বৃদ্ধের।

রাহাত খান! চমকে উঠল কবির চৌধুরী। এই লোক মেজর জেনারেল রাহাত খান না হয়েই যায় না! আর রাহাত খান মানেই রানা! দ্রুত চিন্তা চলেছে তার মাথায়। এখন বুঝতে পারছে সে পিটার উডকককে কেন তার চেনা-চেনা মনে হয়েছিল।

জাপান থেকে তৈরি হয়ে আসা লেন্সগুলো আরও আগেই কেন ফিট করেনি—তাই ভেবে রাগ হলো নিজের ওপর। চশমা জোড়া রেডি করবার জরুরী তাগিদ অনুভব করল সে নিজের ভেতর। রানার বিরুদ্ধে জিততে হলে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সব কটাই প্ৰয়োজন পড়বে। যন্ত্রটা ফিট করার কাজে লেগে গেল সে।

.

ভি আই পি রুমের জানালার ধারে বসে আছে রানা। অন্ধকার ঘর—সামান্য আলো আসছে ন্যাকড়া জড়ানো বালবটা থেকে। দড়িটা টেনে রূমের ভিতর তুলে আনল সে। তারপর সেটাকে নিজের শরীরে বেঁধে নিয়ে বলল, ‘অনেকক্ষণ ধরে ফেঁসে আছি এখানে —এবার বের হতে চাই।’

‘ঠিক, আমিও মুক্তি চাই,’ বললেন মিসেস জোনস ম্লান মুখে।

‘ঠিক আছে, উঁচু জায়গায় চড়তে কি আপনি ভয় পান?’ প্রশ্ন করল রানা।

‘ভয়ে মরে যাওয়ার অবস্থা হয়,’ জবাব দিলেন তিনি।

একটু গম্ভীর হলো রানা। ‘তাহলে আপনাকে সারাক্ষণ চোখ বুজে থাকতে হবে। উপায় নেই।’

ওদিকে রেস্তোরাঁয় নোট গোণার কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। বিদ্যুৎ বেগে আঙুল চলছে দু’জন গণনাকারীর।

রূপা আর ডেভিড রেস্তোরাঁয় দাঁড়িয়ে টাকা গোণা দেখছে। এত টাকা! গোটা ব্যাপারটা কেমন যেন অবাস্তব ঠেকছে রূপার কাছে।

হঠাৎ জানালা দিয়ে অস্পষ্ট নড়াচড়া চোখে পড়ল রূপার। চোখের ইশারায় ডেভিডকে জানাল সে। দু’জনেই লক্ষ করল দড়ি বেয়ে নিচে নামছে রানা। তার পিঠে মিসেস লিনডা জোনস—দুহাতে রানার গলা জড়িয়ে ধরে আছেন। রূপা আর ডেভিডের নজরের বাইরে চলে গেল রানা।

দড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে নামছে রানা। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। মিসেস জোনসের লম্বা চুল বাতাসে উড়ে এসে ওর চোখে পড়ছে বারবার। একটা ক্রস স্ট্রাটের ওপর দাঁড়িয়ে পাশে দাঁড় করাল সে মিসেস জোনসকে। শক্ত করে তাঁকে ধরে রেখে কপালের ঘাম মুছে নিল শার্টের হাতায়। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে বদ্ধার। চোখ বন্ধ রেখেই কাঁপা গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কতদূর?’ নিচের দিকে তাকাবার জন্যে মুখ নামাতেই রানা তাঁর চিবুক ধরে বাধা দিল।

‘নিচের দিকে তাকাবার কথা চিন্তাও করবেন না। শুধু এটুকু মনে রাখবেন, আমার জীবন থাকতে আপনার কোন বিপদ হবে না।’

মাথা ঝাঁকিয়ে আস্থা প্রকাশ করলেন বদ্ধা।

ধীরে ধীরে নিচে নামা শুরু হলো আবার। মিসেস জোনস পিঠের সাথে সেঁটে রয়েছেন। ওপরে কিছু একটার অস্তিত্ব অনুভব করে তাকিয়ে দেখল রানা, ডেভিড আর রূপা রেলিঙের ধার থেকে তার নিচে নামা লক্ষ করছে।

হঠাৎ টাওয়ারের একটা রিভেটে রানার সাফারী জ্যাকেটের বোতাম ফেঁসে গেল। কাপড় ছেঁড়ার শব্দ হলো—কয়েক ইঞ্চি নামতেই শব্দটা হলো আরও জোরে। কাপড়ে টান লাগছে রানার। দড়ি ধরে খানিক ওপরে উঠল রানা, কিন্তু খুলল না, জামাটা ভাল মতই ফেঁসেছে।

‘শক্তভাবে ধরুন আমাকে—আমার জামাটা আটকে গেছে। সাবধান করল রানা মিসেস জোনসকে। হ্যাঁচকা টান দিতেই আর একবার কাপড় ছেঁড়ার শব্দ হলো—সেই সঙ্গে রানার বুক পকেটের সাথে ঝোলানো ট্যাগটা টাওয়ারের লোহার কাঠামোতে বাড়ি খেতে খেতে চলে গেল নিচে।

কয়েক সেকেন্ড পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলো রানা। নিজের অজান্তেই চোখের পলক পড়ল একবার। এই বুঝি আসে, এই বুঝি আসে…অপেক্ষা করল সে মৃত্যু রশ্মির। পেরিয়ে গেল আরও কয়েকটা সেকেন্ড—না, কিছুই ঘটল না। বুঝতে পারল রানা, মিসেস জোনসের ট্যাগটা কাভার দিচ্ছে ওকে। যতক্ষণ মিসেস জোনস জড়িয়ে ধরে আছে, ততক্ষণ সে নিরাপদ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন