জিম্মি – ৫

কাজী আনোয়ার হোসেন

পাঁচ

রবারের একটা টিউব পরে স্যাতোর অভিজাত তাপ-নিয়ন্ত্রিত সুইমিং পুলে ভাসছে কবির চৌধুরী। নিজে সচেষ্ট না হয়ে এইরকম পানির উপর ভেসে বেড়ানোর একটা বিচিত্র আনন্দ আছে। সানের সময়ও চোখে তার মোটা লেন্সের চশমাটা রয়েছে। ওটা ছাড়া বলতে গেলে কিছুই দেখে না কবির চৌধুরী।

বিরাট এলাকা নিয়ে এই স্যাতো। বেশ আয়েশের সাথেই জীবন যাপন করছে এখানে কবির চৌধুরী। স্যাতোর আস্তাবলে তার একটা মিশমিশে কালো স্ট্যালিয়ন রয়েছে। রোজ সকালে ঘোড়া দাবড়ায় সে বিরাট ময়দানে। বিরাট ফুলের বাগান স্যাতোতে—কিন্তু কবির চৌধুরীর ক্ষীণ দৃষ্টি কোনদিনই পড়েনি এমন অনেক বাগানও আছে। বাগান রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে মালী আছে বারো চোদ্দজন। স্যাতোর বিরাট প্রাসাদে এমন অনেক কামরা আছে যেখানে কবির চৌধুরী কোনদিনই পদার্পণ করেনি। কিন্তু সে-সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্যে লোক আছে আট-দশজন।

দূরে দেখা যাচ্ছে, কে একজন আসছে সুইমিং পুলের দিকে। অনেকক্ষণ ভুরু কুঁচকে চোখ ছোট করে চেয়ে থেকেও চিনতে পারল না কবির চৌধুরী লোকটা কে। চোখের যন্ত্রটা শীঘ্রি তৈরি করার জোর একটা তাগিদ অনুভব করল সে।

আরও খানিকটা কাছে আসার পর হাঁটার ভঙ্গি দেখে অনুমান করা গেল, লোকটা তার অনুগত দেহরক্ষী ব্যারি হোমস্। অনেক কাছে আসার পর দেখা গেল সত্যই ব্যারি হোমস্ই। সামনাসামনি আসতেই জিজ্ঞেস করল কবির চৌধুরী, কি খবর, কাজ কতদূর?

‘জ্বী স্যার, হুবহু আপনার নির্দেশ মতই চলছে।’ জবাব দিল সে।

‘আমার কাছে ব্যর্থতার কোন ক্ষমা নেই। কথাটা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ো।’

‘হ্যাঁ, স্যার। আমি এখনই যাচ্ছি এয়ারপোর্টে নতুন যারা আসছে তাদের রিসিভ করতে। যাব?’ ওই প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে যে কোন সময়ে সে খালি হাতেই কবির চৌধুরীকে পিষে মারতে পারে—অথচ কবির চৌধুরীর প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ালেই কেন যেন নিজেকে কেঁচোর চেয়েও অধম বলে মনে হয় তার।

‘যাও,’ অনুমতি দিল চৌধুরী। আবার সাবধান করে দিল, ‘নির্দেশ মত সব কাজ করা চাই।’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, স্যার। ওরা যখন এখানে পৌঁছবে ওদের কারোই ধারণা থাকবে না তারা কোথায় কতদূরে আছে, বা আজ কি বার।’

‘খুব ভাল কথা। নিখুঁত কাজই আমার পছন্দ।’ বলেই চিৎ সাঁতার কেটে পুলের অন্য পারের দিকে রওনা হলো কবির চৌধুরী।

.

মেঘগুলো দ্রুত ছুটে চলে যাচ্ছে পিছনের দিকে। কংকর্ডের ঠিক জানালার ধারের সীটে বসেছে সোহানা। চালর্স দ্য গল এয়ারপোর্ট দেখা যাচ্ছে নিচে। সেন্ট্রাল প্যারিস থেকে প্রায় বারো মাইল উত্তর—পুবে এয়ারপোর্টটা।

একজন স্টুয়ার্ডেস খালি গ্লাস আর কাপ সংগ্রহ করছে। আর একজন ছুটে এল—হাতে একটা কাগজ, চোখে মুখে সম্ভ্রমের ছাপ। একজন হোমরাচোমরা কারও সাথে কথা বলছে সেটা সে উপলব্ধি করছে, ‘স্যার, এই মেসেজটা এইমাত্র এলিসি প্যালেস থেকে এসেছে আপনার জন্যে।’ এলিসি প্যালেস থেকে রেডিওতে কারও কাছে মেসেজ আসার অর্থ স্টুয়ার্ডেসকে বুঝিয়ে দেয়ার দরকার পড়ে না।

‘আমরা অল্পক্ষণের মধ্যেই চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি, স্যার। আপনার বেল্টটা একটু বেঁধে দিয়ে যাই। একটু অতিরিক্ত সৌজন্য দেখানোর যেন চেষ্টা করল স্টুয়ার্ডেস।

‘ওটা সময়মত আমিই বেঁধে নিতে পারব। ধন্যবাদ। মেসেজটা হাতে নিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন রাহাত খান।

কংকর্ডটা আলতোভাবে রানওয়ে ছুঁয়ে দৌড়াচ্ছে। মাটি ছুঁই ছুঁই করছে ওটার লম্বা নিচের দিকে নামানো ছুঁচোল নাক।

সোহানাকে নিয়ে এক নম্বর ভি আই পি টার্মিনালের দিকে এগুলেন রাহাত খান। আশেপাশে সব পপ গায়ক, চিত্র তারকা আর বিজনেস এক্সিকিউটিভদের ভিড়। প্যারিস ফ্লাইটের এরাই স্বাভাবিক যাত্রী।

গ্লাস টিউবের মধ্যে ট্রাভেলেটরে করে সামনে এগুচ্ছেন রাহাত খান। পরপর তিনটে লেভেল পার হতে হবে তাঁদের। ট্রান্সফার লেভেলে এসে সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে চাইলেন রাহাত খান—যারা আসছে যাচ্ছে তাদের সবাইকে এখান দিয়েই যেতে হবে। চেনা মুখ চোখে পড়ল না একটাও।

পাসপোর্ট আর কাস্টমস কন্ট্রোল পেরিয়ে দ্বিতীয় ট্রাভেলেটরে চড়ে অ্যারাইভাল লেভেল—তিনটে ভাগ আবার, ব্যাগেজ হল, তারপর আবার কাস্টমস কন্ট্রোল, এরপরই বাইরের গ্যালারি হয়ে কোচ-ট্যাক্সি স্ট্যান্ড।

নিজেদের সুটকেস আর ব্যাগেজ হল থেকে সংগ্রহ করে দু’জনে এখন অপেক্ষা করছে বাইরের গ্যালারিতে। আজকে এই এয়ারপোর্টে বেশ কিছু ঘটনা ঘটবে—সে সব প্রত্যক্ষ করাই উদ্দেশ্য।

দু’জন রাহাত খানেরই নিজের লোক। রানা আর রূপা। কিন্তু ল্যাপ লেজারের হাইজ্যাকারও আজ আসবে বলে গোপন খবর এসেছে। তাকে চিনে বের করার আগ্রহটা পুরোপুরি রয়েছে রাহাত খানের মনে। পুরো ব্যাপারটা ঘটছে ওই একটা লোককে কেন্দ্ৰ করে।

প্যান-অ্যামের বোয়িং ৭৪৭ নামল কংকর্ডের পরপরই। রানা এগিয়ে আসছে ট্র্যান্সফার লেভেলের দিকে। লেভেল দুই-এ বসে রানাকে চিনে নিতে কোনই কষ্ট হলো না রাহাত খানের। চট করে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন তিনি।

আধঘণ্টা পর মিউনিখ ফ্লাইট এসে পৌঁছল। সামান্য দেরি হয়েছে কি একটা গোলযোগের কারণে।

ব্যাগেজ হলের একটা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডেভিড ফ্রস্ট। নিজের সুটকেসটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে সে অনেক সুটকেসের মাঝে। কনভেয়র বেল্টে একের পর এক সুটকেস এগিয়ে আসছে। নিজের সুটকেসটা চিনতে পেরেই চট করে সেটাকে নামিয়ে নিল সে। ঠিক এই সময়ে এয়ারপোর্টের মাইকে ভেসে এল, ‘মিস্টার ফ্রস্ট—মিস্টার ডেভিড ফ্রস্ট—প্যাসেঞ্জার ফ্রম মিউনিখ—কাইন্ডলি রিপোর্ট টু দ্য লস্ট লাগেজ অফিস অভ লেভেল ওয়ান।’

কাস্টমসের একটা লোকের কাছ থেকে এক নম্বর লেভেলে পৌঁছানোর পথ জেনে নিল ডেভিড। লস্ট লাগেজ অফিসের সামনে একটা লাইন—লাইনে দাঁড়াল সে। তার টার্ন আসতেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলল তাকে আসতে বলা হয়েছে এখানে। একটা ছোট্ট পকেট রেডিও বের করে মেয়েটা কাউন্টারের উপর রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি আপনার?’

পরীক্ষা করে দেখল ডেভিড রেডিওটা। জীবনে কখনও দেখেনি আগে। তবে যে খেলায় সে নেমেছে এখানে সবই প্ল্যান মাফিক চলে, হঠাৎ করে কিছু ঘটে না। চট করে বলল, ‘তাই তো! কোথায় পাওয়া গেল?’

‘প্লেনেই ফেলে এসেছিলেন আপনি ভুল করে।’ হেসে জবাব দিল মেয়েটা। ‘স্টুয়ার্ডেস আপনার নাম জানত—আপনাকে ওই রেডিও সহ দেখেছে বলে সে এটা জমা দিয়ে গেছে এখানে।

‘যাহোক, আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে দেবেন তাকে।’ ‘সে আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছি। খুশির কথা এই যে আপনার জিনিসটা খোয়া যায়নি।’ বিনীত ভাবে বলল মেয়েটা।

রূপাকে ধরে ফেলল স্টুয়ার্ডেস ট্রাভেলেটরের উপর। ‘রোমের  প্লেন থেকে নামবার সময়ে এটা আপনার ব্যাগ থেকে পড়ে যায়, মিস মনরো।’ ছুটতে ছুটতে এসেছে মেয়েটা—এখনও হাঁপাচ্ছে।

‘ধন্যবাদ,’ হাত বাড়িয়ে রেডিওটা নিল রূপা, ‘এই রকম বোকার মত অনেক কিছুই হারিয়েছি আমি। অসংখ্য ধন্যবাদ।’

স্প্যাসেঞ্জারদের সেবাই আমাদের কাজ।’ বিনয়ের সাথে হেসে বলল স্টুয়ার্ডেস। চলে গেল দ্রুত পায়ে।

কোনখান থেকে কোন খবর না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে রানা। ইনফরমেশন ডেস্কে গিয়ে নিজেকে পিটার উকক বলে পরিচয় দিল, জিজ্ঞেস করল তার জন্যে কি কোন খবর আছে?

‘না, স্যার, কোন মেসেজ নেই—তবে এটা আপনার সংগ্রহ করার কথা। আপনার জন্যে এই ট্র্যানজিস্টারটা রেখে গেছেন এক ভদ্রলোক।’

‘সত্যি, এটার কথা একেবারে ভুলেই গেছিলাম।’ কপট বিস্ময় প্রকাশ করল রানা, ‘ধন্যবাদ।’

প্রতি পনেরো সেকেন্ড অন্তর সোনিক সঙ্কেত আসছে। রেডিও অন করতেই শোনা গেল একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ‘তোমরা সবাই আমার কথা শুনতে পাচ্ছ কিনা জানাও।’

‘লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার,’ জবাব দিল রানা।

রূপার কাছ থেকে ছোট্ট জবাব গেল, স্পাচ্ছি।’

ফ্রস্ট বলল, ‘রজার।’

প্রত্যেকটাই টু-ওয়ে সেট।

‘তোমাদের প্রতি আমার নির্দেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে নাও।’ আবার শোনা গেল ব্যারির গলা। ‘রোম থেকে যে এসেছে সে ট্রাভেলেটরে চড়বে লেভেল ওয়ানে। নিউ ইয়র্ক থেকে আগত প্যাসেঞ্জার ট্রাভেলেটরে চড়বে লেভেল টু-তে। আর মিউনিখ থেকে যে এসেছে সে চড়বে লেভেল থ্রীতে। প্রত্যেকেই তোমরা ট্রাভেলেটরের শেষ মাথায় পৌঁছে উল্টো দিকের ট্রাভেলেটরে চড়বে যতক্ষণ আমি আবার নির্দেশ না দিই।’

‘মেসেজ আন্ডারস্টুড,’ জবাব দিল রূপা। মিউনিখ? মিউনিখ থেকে আবার কে এল? অবাক হয়ে ভাবল রূপা।

তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা তিনজন। রানার মাথায় দ্রুত খেলে গেল চিন্তাটা।

নিরাপত্তার জন্যেই সোহানাকে তার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গ্রাউন্ড লেভেলে একটা সোফায় বসে জিরোচ্ছেন রাহাত খান। মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছেন। যে কেউ তাঁকে দেখলে ভাববে একজন ক্লান্ত যাত্রী। চমকে উঠলেন রাহাত খান—ও কি? রেডিও না? রূপা তার কানের সাথে রেডিওটা ধরে এগুচ্ছে! মনে মনে আঙুল কামড়ালেন রাহাত খান। রিমোট কন্ট্রোলে কাজ করছে ওরা। তিনি যেখানে বসেছেন সেখান থেকে রানা এবং রূপা দু’জনের উপরই নজর রাখতে পারছেন। গ্লাস টিউবের ভিতর দিয়ে সব কিছুই দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। তীক্ষ্ণ নজরে তৃতীয় ব্যক্তির খোঁজ করতে লাগলেন রাহাত খান। তারও কানে রেডিও থাকবে এটা নিশ্চিত। ট্রাভেলেটরে অনেক লোক। কিন্তু অনেক খুঁজেও তৃতীয় ব্যক্তির সন্ধান মিলল না।

রেডিওতে আবার ব্যারির গলা শোনা গেল। ‘যিনি তোমাদের এই কাজে নিযুক্ত করেছেন তাঁর বক্তব্য শোনো এবার।

টেলিফোন বুদের ভিতর থেকে ব্যারি নির্দেশ দিচ্ছে। সোহানা তার খুব কাছেই দাঁড়ানো। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সে টের পেল না, তার এত কাছ থেকেই এত সব কাণ্ড ঘটছে। টেপ রেকর্ডারের সুইচ অন করে দিল ব্যারি।

সিগারেট লাইটার বের করে রেডিওর সাথে লাগাল রানা, লক্ষ করলেন রাহাত খান। যাক—কিছু খবর অন্তত পাওয়া যাবে—ভাবলেন তিনি।

‘তোমাদের প্যারিস আগমন সফল হোক এই কামনা করেই স্বাগত জানাচ্ছি তোমাদের।’ টেপ করা ক্যাসেট থেকে স্পষ্ট উচ্চারণে কবির চৌধুরীর গুরু গম্ভীর গলা ভেসে এল। ‘আমার নাম কবির চৌধুরী। আমি এখন তোমাদেরকে আমার শর্তাবলী জানাচ্ছি—ইচ্ছে করলে তোমরা আমার সাথে কাজ করতে পারো অথবা আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারো। যদি কোন কারণে

আমার প্রস্তাবে অসম্মত হও তবে তোমরা যে যেখান থেকে এসেছ সেখানকার একটা রিটার্ন টিকেট পাবে গ্রাউন্ড লেভেলের ‘রিজার্ভ’ সেকশনে। যদি কেউ ফিরে যেতে চাও তোমাদের কারও বিরুদ্ধেই কোন বিরূপ পদক্ষেপ নেয়া হবে না—তবে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে তাহলে তোমরা আমার সাথে কাজ করার সুযোগ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হবে। সারা দুনিয়া জুড়ে বিভিন্ন অরগানাইজেশন আমি চালাই। তাদের কোনটাতেই আর তোমাদের কোনদিন নেয়া হবে না।’

এতদিন পরে আবার কবির চৌধুরীর গলা শুনে একটু বিচলিত বোধ করছে রানা—ওই নামটার সাথে তার অনেক দিনের পরিচয়। কি রকম সাংঘাতিক একগুঁয়ে আর নিষ্ঠুর হতে পারে লোকটা, সেটা তার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।

রাহাত খান এখনও খুঁজছেন তৃতীয় ব্যক্তিকে। কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছেন না, কারণ জাতীয় পোশাক (আলখেল্লা) পরা বিশালাকার আফ্রিকানটার আড়ালে রয়েছে সে।

‘আমার হয়ে কাজ করতে যদি তোমরা রাজি থাকো তাহলে এই মুহূর্ত থেকেই আমার অথবা আমার নিয়োজিত লোকের নির্দেশ মেনে চলতে হবে তোমাদের। কোনরকম বিশ্বাসঘাতকতা চরম ভাবে দণ্ডনীয় হবে। আমার কাছে বিশ্বাসঘাতকতার একই শাস্তি—মৃত্যু। আমি চাই না যে এই অপারেশনে তোমাদের কারও কোন ক্ষতি হোক—তবে এটা তোমাদের জানিয়ে রাখা কর্তব্য মনে করছি তোমাদের যে কারও প্রতি হত্যা করার নির্দেশ আসতে পারে। যদিও মনে করি না তার দরকার পড়বে—তবু কথাটা জানিয়ে রাখা ভাল। আমার এই শর্তগুলো মেনে নিয়ে কাজ করলে বিনিময়ে তোমাদের প্রত্যেককে আমি এক মিলিয়ন ডলার দেব। আমাদের এই মিশন সফল হোক বা বিফল হোক—টাকাটা তোমরা পাবে। দশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি তোমাদের মনস্থির করার।

রানা আর রূপার তো প্রশ্নই ওঠে না—রাহাত খান পাঠিয়েছেন ওদের। ডেভিড ফ্রস্টের রাজি হওয়ার কারণটা বোঝা মুশকিল, হয়তো টাকার লোভনীয় অঙ্ক শুনেই রাজি হয়ে গেল সে, সম্মতি জানাতে দ্বিধা করল না।

সবাই রাজি শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ব্যারি। এবার পরবর্তী আরও কতগুলো নির্দেশ দিল সে রেডিওতে।

রানা ও রূপা দু’জনকেই এক ট্রাভেলেটরে চড়ে গ্রাউন্ড লেভেলের দিকে আসতে দেখে রাহাত খান সঠিক ভাবেই অনুমান করলেন যে রেডিও ইন্সট্রাকশন শেষ হয়েছে। সোহানাকে ইশারা করে হলের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

সোহানা দ্রুত এগিয়ে এসে ধাক্কা খেল রানার সাথে। মাত্র সুন্দর দামী একটা লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল রানা—ধাক্কা খেয়ে হাত থেকে লাইটারটা ফস্কে নিচে পড়ল। কুণ্ঠিত সোহানা দুঃখ প্রকাশ করে লাইটারটা তুলে রানার হাতে দিল।

রাহাত খানের কাছে এসে দাঁড়াতেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বদলাতে পেরেছ?’ মুচকি হেসে মাথা হেলিয়ে জানাল সোহানা, পেরেছে।

চলতে চলতে হঠাৎ থেমে দাঁড়ালেন রাহাত খান। তারপরই ঝট করে ঘুরে গেলেন—ধাক্কা লাগল সোহানার সাথে, আর একটু হলেই ছিটকে পড়ত। ‘কি ব্যাপার, কি হলো?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল সোহানা।

‘লোকটা এক্সিটের দিকে এগুচ্ছে—লম্বা, বাদামী চুল। হ্যাট নেই, চামড়ার জ্যাকেট আর নীল জিন্স্ পরা, দেখেছ?’

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল সোহানা, ‘রেডিও কাঁধে ওই লোকটা তো?’

‘রেডিও, ফ্যান্টাস্টিক! এই লোকই তাহলে ল্যাপ লেজার ছিনতাইকারী।’

‘এই লোকই কি সেই তৃতীয় ব্যক্তি?’

‘হ্যাঁ, আমি চিনি ওকে। কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে আমাদের। আমার আগেই সন্দেহ করা উচিত ছিল। ওর নাম কেন যে আমার ফাইলে নেই সেটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। ওর নাম ডেভিড ফ্রস্ট। এক্স সি আই এ অপারেটার। ‘

‘এক্স?’ প্রশ্ন করল সোহানা।

মাথা ঝাঁকালেন রাহাত খান, ‘হ্যাঁ, বছর তিনেক আগে ওর একবার নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়। সেই থেকেই সি আই এ ছেড়ে দিয়েছে লোকটা।’

‘ভাল এজেন্ট ছিল?’

‘দি বেস্ট।’ জবাব দিলেন রাহাত খান। ‘আই মীন ওয়ান অভ দি। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সম্বন্ধে ওর চেয়ে বেশি খুব কম লোকেই জানে। লেজারের নাড়ি নক্ষত্র ওর নখদর্পণে। ওর নাম আমার লিস্টে না আসার একটাই কারণ হতে পারে, সেটা হচ্ছে ইউনাকোতে ওর নিজস্ব লোক আছে।’

এক কার্টন সিনিয়র সার্ভিস কেনার ছলে একটা স্টলে দেরি করে অনুসরণ করাটা আরও সহজ করে দিল রানা। এবার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সে। মিউনিখ থেকে কে এল জানতে হবে তার। কি কারণে এই লোককে আনা হয়েছে—কি তার বিশেষত্ব সেটা রানা বা রূপা কারোই জানা নেই।

রানা আগেও এখান থেকে হেলিকপ্টার ভাড়া নিয়েছে অনেকবার। তাই গন্তব্যস্থান তার কাছে খুবই পরিচিত। রূপার মিনিট খানেক আগে পৌঁছল রানা হেলিপ্যাডে। ব্যারির দেখা পেল রানা ওখানেই। রূপা পৌঁছতেই ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ব্যারি পিটার উডককের। এটাও জানাতে ভুলল না যে এতক্ষণ তার নির্দেশই শুনেছে সবাই রেডিওতে।

বিনীত ভাবে রূপার সাথে হাত মেলাল রানা—যেন প্রথম পরিচয়। ‘আমার সৌভাগ্য, মিস মনরো, যে এমন সুন্দরী এক মহিলাকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি।’ এমন ভাবে বলল মনে হলো কথায় কোন খাদ নেই। ব্যারির সাথে হেলিকপ্টারে উঠল ওরা দু’জনেই।

রাহাত খান কারগো হ্যাঙ্গারের পাশ থেকে পুরো ব্যাপারটাই লক্ষ করছেন, পাশে সোহানা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহাত খান বললেন, ‘কবির চৌধুরী টেক্কা মেরে গেল এবার আমাদের ওপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে হেলিকপ্টার নিয়ে।

‘কিন্তু আপনার তো রেড় প্রায়োরিটি আছে—ক্ষমতা খাটালে হয় না?’

‘ভাল কথা—কিন্তু তাতে সময় লাগবে যথেষ্ট। ওরা তো এক্ষুণি রওনা হবে। অবশ্য ফ্লাইট প্ল্যান জোগাড় করা যায়—কিন্তু ফ্লাইট প্ল্যান অনুযায়ী ওরা ফ্লাই করবেই এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।’

‘আমরা কি করব এখন?’ অসহায় প্রশ্ন করল সোহানা। ‘কিছুই করার নেই আমাদের এই মুহূর্তে। রূপা-রানা দু’জনেই ভাল এজেন্ট—যা করণীয় ওদেরই করতে হবে সব।’

সোহানা দেখল ডেভিড ফ্রস্ট একজন বিমান কর্মচারীর সাহায্য নিয়ে ঠিকই জায়গা মত পৌঁছে গেছে। হেলিকপ্টারের দরজা খুলে গেল। সবাই ভিতরে ঢুকতেই রোটর ব্লেড ঘুরতে আরম্ভ করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আকাশে উঠল হেলিকপ্টার। রূপা আর রানা এখন সম্পূর্ণ একা।

হেলিকপ্টারে উঠে ছয়জন অপরিচিত মানুষের সম্মুখীন হলো ডেভিড। প্রথম নজরে এদের কাউকে সে আগে দেখেছে বলে মনে হলো না তার। একজন সাদা অ্যাপ্রন পরা ডাক্তার, গলায় স্টেথোসকোপ ঝুলছে। চারজন স্ট্রেচারে শোয়া। বাকি দাঁড়ানো লোকটা নিশ্চয়ই চার্জে রয়েছে—বুঝে নিতে অসুবিধে হলো না। ডেভিড তার দিকে চেয়ে নড করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ডেভিড ফ্রস্ট।’

নিজের নাম বলে তার সাথে হাত মেলাল ব্যারি।

স্ট্রেচারের উপর রূপা ঝট করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। চেহারা দেখেই তার সন্দেহ হয়েছিল। নাম শুনে এবার নিশ্চিত হলো। রূপা ভাল করেই চেনে ওকে। ওর দক্ষতা কোন্ লাইনে তা রূপার অজানা নয়।

‘অন্যদের সাথে পরে পরিচয় করিয়ে দেব।’ ব্যারি বলল জিম্মি ডেভিডকে।

ডেভিড লক্ষ করল স্ট্রেচারে শোয়া সহকর্মীদের মাঝে একজন মেয়েলী চেহারার ইন্দোনেশিয়ান, ফিল্ম অ্যাকট্রেসদের মত দেখতে একটা মেয়ে, তৃতীয় ব্যক্তি একজন পেশীবহুল চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট শক্ত সমর্থ পুরুষ। আর চতুর্থজন একজন এশীয়। গালকাটা ব্যারি নিশ্চিত ভাবে ফ্রেঞ্চ। তার জন্যে নির্ধারিত বাঙ্কটা দেখিয়ে দিতেই নির্দ্বিধায় সেখানে টানটান হয়ে শুয়ে চোখ বুজল ডেভিড। চোখ বুজল ঘুম পেয়েছে বলে নয়—আর সবাই চোখ বুজে আছে, তাই। কিন্তু একটু পরেই একটা বাজে ধরনের চাপা হিস হিস শ েচোখ খুলল সে। দেখল ডাক্তার একজনের উপর ঝুঁকে পড়ে এনেসথেটিক দিচ্ছে। এটা কবির চৌধুরীর একটা বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তার টার্ন আসতে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিল সে এই ব্যবস্থা। অচেতন অবস্থায় ডাক্তারের মুখের দুর্গন্ধ সহ্য করা অনেক সহজ হবে।

সোহানাকে নিয়ে মেজর জেনারেল (অভ) রাহাত খান নিরবচ্ছিন্ন নীরবতার সাথে রানার সিগারেট লাইটারের মাইক্রো টেপটা বাজিয়ে শুনলেন। ফ্রেঞ্চ গভর্নমেন্ট যে লিমুজিনটা তাঁর ব্যবহারের জন্যে দিয়েছে সেটারই স্টেরিও সিসটেমে প্লাগ করে শোনা গেল টেপটা। দশ লক্ষ ডলার করে প্রত্যেককে দেয়া হবে—কাজ হোক বা না হোক। কথাটা শুনে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল সোহানা। নিশ্চয়ই একটা বড় দাঁও মারার তালে আছে কবির চৌধুরী।

গাড়ির রেডিও টেলিফোনটা বেজে উঠতেই রিসিভার তুলে নিল সোহানা।

সোহানা নিবিষ্ট মনে টেলিফোনে কথা বলছে আর নোট নিচ্ছে। কথা শেষ হতেই প্যাডের উপরকার নোট করা কাগজটা রাহাত খানের দিকে এগিয়ে দিল।

কাগজটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বিষণ্ন মুখে মাথা নাড়লেন রাহাত খান।

‘একই লোক।’ সোহানা অন্যমনস্ক ভাবে প্যাডের ওপর টোকা দিতে দিতে বলল। ‘নার্ভাস ব্রেকডাউনের পরে ১৪ জানুয়ারি ১৯৭৮ সনে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয় তার ভারসাম্যহীন আচরণের জন্যে। এটাই মনে করার চেষ্টা করছিলেন এতক্ষণ?’

‘হ্যাঁ, আমারও এইমাত্র মনে পড়েছে।’ চোখ বুজে গাড়ির নরম গদিতে হেলান দিয়ে বসলেন রাহাত খান। টিনটেঙ্ গ্লাসের লিমোজিন ছুটে চলল হোটেল রিজ-এর দিকে।

‘ডেভিড ছিল সি আই এর সবচেয়ে দক্ষ অস্ত্র বিশারদ। আমাদের দুর্ভাগ্য—নাকি কবির চৌধুরীর কপাল, ডেভিড যে কোর্সে ট্রেনার ছিল সেই ট্রেনিঙের জন্যে রূপাকে পাঠানো হয়েছিল বছর চারেক আগে।’ সারাটা পথ আর কোন কথা বললেন না রাহাত খান। কি যেন ভাবছেন তিনি—মুখটা গাম্ভীর্যের ভারে থমথম করছে। হাতে ধরা জ্বলন্ত চুরুটটাও টানতে ভুলে গেছেন—নিভে গেছে ওটা। না জেনে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন তিনি রূপাকে। সম্ভবত রানাকেও; কারণ রূপার বিপদে চুপ করে বসে থাকবে না রানা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন