কাজী আনোয়ার হোসেন
স্টুটগার্ট থেকে আটাশ মাইল পশ্চিমের এই উঁচু মাঠটা খুব নির্জন—চারদিকে গাছপালা এত ঘন যে ওগুলো রাস্তা থেকে একদম আড়াল করে রেখেছে জায়গাটাকে। ইউ এস আর্মি তাই এটাকে ল্যাপ লেজার গান পরীক্ষা করার জন্যে একটা আদর্শ স্থান বলে বেছে নিয়েছে।
চারটে ল্যাপ লেজার নিয়ে ওরা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে স্টুটগার্টে। বেশি নয়, এটা ঠিক, তবে জেনারেল ইলেকট্রিক মোট মাত্র বারোটা ল্যাপ লেজার তৈরি করেছে—এখনও গবেষণা পর্যায়ে আছে সব। বাকি আটটা নিয়ে পরীক্ষা চলছে অন্য জায়গায়। প্রতিদিন হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসা হয় ল্যাপ লেজার এই মাঠে। কাজ শেষ হলে আবার সন্ধ্যায় হেলিকপ্টারে করেই ফেরত যায় ওগুলো স্টুটগার্ট বেসের কঠোর নিরাপত্তায়। ল্যাপ লেজার গানগুলো খুবই শক্তিশালী আর বিপজ্জনক বলে স্টুটগার্ট ঘাঁটিতে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো মোটেও নিরাপদ নয়। তাই এই ব্যবস্থা।
ওগুলো চালাতে হলে অনেক পাওয়ারের দরকার। বড় বড় জেনারেটর নিয়ে টানাটানি না করে এই নির্জন জায়গায় একটা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বসিয়ে নিয়ে বেশ সুন্দর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ওরা লোকচক্ষুর অন্তরালে।
চোখ দুটো ছোট করে দূরে মেঘের মধ্যে হেলিকপ্টারটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করল কর্নেল। ঘাড় ফিরিয়ে ল্যাপ লেজারগুলো আরেকবার দেখে নিল। নিজের হাতেই স্ট্রিপ করে ভাল মত প্যাক করেছে সে—চারটেই এখন রিটার্ন ট্রিপের জন্যে রেডি।
সেকেন্ড ইন-কমান্ড পাশে এসে দাঁড়াতেই তার দিকে চেয়ে চোখ টিপে ঘাড় নেড়ে হাসল কর্নেল, ‘সত্যিই, সাংঘাতিক জিনিস বানিয়েছে ব্যাটারা—কি বলো?’ প্রশ্নের চেয়ে মন্তব্যের মতই শোনাল কথাটা।
মেজরের মুখে সব সময়েই মোটা চুরুট ঝুলে থাকে। চুরুটের ফাঁক দিয়ে একটা সম্মতিসূচক শব্দ বের করল সে।
ইউ এস আর্মির বড় বড় জেনারেলও ল্যাপ লেজার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। বিস্ময়ে হতবাক হবে তারা এই অস্ত্রের গুণাগুণ জেনে। তাদের এই বিশেষ জ্ঞানের জন্যে বেসের প্রধান অস্ত্র শিক্ষক আর তার স্টাফ মনে মনে গর্বই অনুভব করে। শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট যে ব্যালেস্টিক বা অ্যারোডাইনামিক্স্-এর উন্নতি সাধনের ফলে এই ল্যাপ লেজারের জন্ম হয়নি, হয়েছে অপটিক্স—এর কারণে। সাধারণের মাথা গুলিয়ে দেয়ার জন্যে এইটুকু তথ্যই যথেষ্ট।
আজ সারাদিন বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর পরে দিনের শেষে লেজার গানাররা ধরেছে ইন্সট্রাক্টরকে, লেজার বীম দিয়ে এক হাজার মিটার দূরে চার ইঞ্চি স্টীল প্লেট কেটে USAAF লিখবে তারা। আশ্চর্য হয়ে সবাই দেখল স্টেনসিল দিয়েও এত পরিষ্কার সুন্দর লেখা সম্ভব ছিল না। চার ইঞ্চি পুরু স্টীল প্লেট কেটে পরিষ্কার USAAF লিখেছে লেজার বীম।
ল্যাম্প লেজারে গাইডেন্স সিসটেম অনেকটা কনভেনশনাল রাডারের মতই। শুধু এক জায়গায় তফাৎ—সেটা হচ্ছে টারগেট খুঁজতে রেডিও ওয়েভের জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে লাইট ওয়েভ। যে কোন রকম টারগেট বেছে নিতে পারে ওর ইঁদুরের কানের মত বিদঘুটে দুটো জিনিস। ডজন খানেক ধাতু থেকে শুরু করে কাঠ, ইঁট, মানুষ পর্যন্ত চেনার জন্যে টিউন করা আছে কমপিউটর।
টারগেট চিনে নেবার সাথে সাথেই ল্যাপ লেজার থেকে বেরিয়ে আসে রাত্রির চেয়েও কালো এক মার্ক্সক রশ্মি। সামনে যা পড়বে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মুহূর্তে।
সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো স্পীড। সাধারণ ইলেকট্রনিকসে ন্যানো সেকেন্ডেই (অর্থাৎ এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক মিলিয়ন ভাগ) কাজ চলে। আরও স্পীড দরকার হলে লাইট ব্যবহার করা হয়। সেক্ষেত্রে পিকো সেকেন্ড বা মাইক্রো-মাইক্রো সেকেন্ড (অর্থাৎ সেকেন্ডের এক মিলিয়ন ভাগের এক মিলিয়ন ভাগ) গতি সম্ভব হয়। ল্যাপ লেজার টিউন করা হয়েছে পিকো সেকেন্ডে। এটা মানুষের
এটা মানুষের উপলব্ধির বাইরে। অপটিক্যাল সিসটেমটাকে ল্যাপ লেজারের গতির সমতুল্য করার জন্যে জেনারেল ইলেকট্রিক কমপিউটর প্রসেসরের মধ্যে লবণের দানার মত ছোট ছোট মিনি লেজার ব্যবহার করেছে। একটা পুরো আর্মিকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা আছে এক একটা ল্যাপ লেজারের।
কালো বুইকটা ছুটে চলেছে হাইওয়ে ধরে। আউসগ্যাঙ-স্টুটগার্ট রোড সাইনটা পড়ল ডেভিড ফ্রস্ট। এবার ডান দিকের রাস্তাটা ধরে সরে এল সে হাইওয়ে ছেড়ে।
একবার দায়িত্ব নিলে কখনও কোন কাজে গাফিলতি করে না ডেভিড। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সে তাই তৈরি করেছে পরিকল্পনা। কাজটা নিখুঁত ভাবে করার জন্যে আলবার্তো ভেরিনো তাকে ভাল তো বটেই, রীতিমত উদার হাতে টাকা দিয়েছে। তাকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, এটা কেবল শুরু; আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে ওকে ভবিষ্যতে, বিনিময়ে আরও অনেক গুণ বেশি টাকা দেয়া হবে। দেবে না-ই বা কেন, আলবার্তো ভেরিনো ভাল করেই জানে এই কাজে ডেভিডের জুড়ি নেই। প্রাক্তন সি আই এ এজেন্ট হিসেবে জটিল অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে ইউ এস আর্মি ট্রেনিং আছে ওর।
টাকা জুগিয়েছে কবির চৌধুরী, ভেরিনোর মাধ্যমে। চুরির ব্যাপারেও বেশির ভাগ তথ্য সরবরাহ করেছে সে-ই—কিন্তু পরিকল্পনাটা ডেভিডের নিজস্ব, তবে আস্তানায় নিয়ে গিয়ে আদ্যোপান্ত শুনে অনেক ভেবে-চিন্তে তারপর ও.কে করেছে কবির চৌধুরী। ডেভিডও হাজারবার করে উল্টেপাল্টে দেখেছে প্ল্যানটা—কোন ফাঁক নেই। নিখুঁত।
ট্রাইপডে বসানো লেজার গাইডেড ইলেকট্রনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে ইউ এস আর্মি গার্ড রূম থেকে বর্তমান সপ্তাহের পাসওয়ার্ডগুলো ইতোমধ্যেই জেনে নিয়েছে ডেভিড। ও জানে, পাসওয়ার্ড ছাড়া কারও পক্ষে হেলিকপ্টার পর্যন্ত পৌঁছানো অসম্ভব। নিষিদ্ধ এলাকা ওটা—টপ সিকিউরিটি জোন।
ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে আরও অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েছে ডেভিড। অফিসার্স মেসের বড় বড় ভিজিটিং অফিসারদের কোয়ার্টার দেখেছে। কারণ গার্ডদের কাছে তাদের চেহারা একটু অপরিচিত হবে। একজন অফিসারকে টারগেট করে সম্পূর্ণ নতুন এক সেট কাগজ-পত্র আর আইডেন্টিটি কার্ডও বানিয়েছে সে।
ধীরে ধীরে ড্রাইভ করছে ডেভিড। বেসের ভিতরই পাবলিক রোড ধরে নিষিদ্ধ এলাকা থেকে দূরে অফিসার্স কোয়ার্টারের পাশে পার্ক করল গাড়িটা।
দশ মিনিট পর ইউ এস আর্মি জেনারেলের পোশাক পরা এক লোক বের হলো অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে। দ্রুত হেঁটে অফিসার্স ক্লাবের দিকে এগিয়ে গেল সে। বগলে একটা বান্ডিল, বাঁ হাতে একটা ব্রীফকেস। ঘড়ি দেখে একবার আকাশের দিকে চাইল—তারপর ক্লাবের পিছনে পার্ক করা জীপটার দিকে পা বাড়াল।
ন্যূড ম্যাগাজিনটা ফেলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল গার্ড কর্পোরাল। জীপটা ততক্ষণে ঢাকার কর্কশ শব্দ তুলে গার্ড রূমের পাশে এসে থেমেছে। দরজার কাছে পিছন থেকে একজন সৈনিক এসে দাঁড়াল। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে বাইরে। দুজনেই পিট পিট করে চেয়ে ঠাওর করার চেষ্টা করছে। দূর থেকে হেলিকপ্টারের পত পত শব্দ কানে আসছে।
স্প্রিঙের মত লাফিয়ে নামল ডেভিড জীপ থেকে। গার্ড রূমের লাইট পড়ে জেনারেলের স্টারগুলো ঝিকমিক করে জ্বলে উঠল। নিজের অজান্তেই কর্পোরালের হাতের মুঠো আরও শক্ত ভাবে বসল তার এম ওয়ান কারবাইনের উপর।
‘হল্ট!’ চিৎকার করে উঠল কর্পোরাল।
থামল ডেভিড, কিন্তু সাথে সাথেই অসন্তুষ্ট চড়া গলায় বলল, ‘কর্পোরাল! ইমার্জেন্সী! আমার খুব তাড়া!’
‘সামনে এসে পরিচয় দিন।’ কর্পোরাল তার ডিউটিতে অটল।
গজগজ করতে করতে সামনে এগুলো ডেভিড। জি আই দুজন দেখল লম্বা শক্ত চেহারার এক অপরিচিত মুখ। চেহারায় কেমন একটা উদ্ধত ভাব। অবশ্য জেনারেলদের মুখের ভাব সচরাচর ওই রকমই থাকে।
‘নাও, তাড়াতাড়ি করো,’ খেঁকিয়ে উঠল ডেভিড।
‘স্পাসওয়ার্ড?’ কর্পোরাল জিজ্ঞেস করল।
‘খেলা পেয়েছ? নিয়ম কি আমার আগে বলার?’ ধমক দিল মাইক।
‘গ্রীষ্মের ছুটি।’ একটু দমে গিয়ে আউড়াল সে।
‘বুধবারের গান।’ বলে পরিচয় পত্রগুলো বাড়িয়ে দিল মাইক। জেনারেল এল সি বুমার। মনে পড়ে গেল কর্পোরালের—এই সেই অস্ত্র এক্সপার্ট। গত তরশু মাত্র এসেছে। খটাশ করে বুটের শব্দ তুলে স্যালিউট করল কর্পোরাল। ‘ইয়েস স্যার, জেনারেল।’ ওর সঙ্গী ততক্ষণে ব্যারিয়ার তোলার জন্যে বোতাম টিপে দিয়েছে।
এক লাফে জীপে উঠে ঝড়ের বেগে ভিতরে ঢুকে গেল ডেভিড। হেলিকপ্টারের কাছাকাছি এসে জোরে ব্রেক কষে জীপ থামাল। ‘সবাই সরে যাও এখান থেকে—এক্ষুণি।’ চিৎকার করে বলল সে।
জেনারেলের স্ট্রাইপ দেখেই কর্পোরাল ইন-চার্জ তার বাজখাঁই গলায় আদেশ করল, ‘টেনশান!’ সাথে সাথে তিনজনই ঋজু মূর্তিতে পরিণত হলো।
হাতের বান্ডিলের মোড়ক খুলে একটা র্যাডিয়েশন স্যুট বের করে পরতে পরতে চিৎকার করল ডেভিড, ‘ইমার্জেন্সী, কর্পোরাল। র্যাডিয়েশন লীক। এক্ষুণি সরে যাও এখান থেকে তোমার লোকজন নিয়ে।’
‘স্ স্যার আ-আপনার পরিচয়টা?’ আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল কর্পোরাল।
‘জেনারেল এল সি বুমার। থার্ড আর্মি স্পেশাল ওয়েপন ডিভিশন। নাউ অন দা ডাবল সোলজার, মুভ ইট।’ তাড়া দিল ডেভিড।
জেনারেলের র্যাডিয়েশন স্যুট দেখে আর কথাবার্তায় রীতিমত ভয় পেয়েছে ওরা। দ্রুত সরে পড়ল সবাই। জীপের পিছন থেকে একটা গায়গী কাউন্টার বের করে পরীক্ষা শুরু করল সে। পাইলট এতক্ষণ উদ্গ্রীব হয়ে লক্ষ করছিল জেনারেলের কার্যকলাপ। মাথা নামিয়ে রোটর ব্লেডের নিচে দিয়ে গিয়ে চপারের দরজা খুলল ডেভিড। ‘র্যাডিয়েশন লীক! শিগগির নামো! তোমাকেও ধরে থাকতে পারে!’ ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি সুইচ অফ করতে যাচ্ছিল পাইলট। বাধা দিল ডেভিড, ‘না, সুইচ অফ কোরো না—হেলিকপ্টারটাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে হবে আমাকে। ইমার্জেন্সী মেডিক্যাল ইউনিট আসছে তোমাদের সবাইকে পরীক্ষা করতে।’ আর বেশি বলতে হলো না পাইলটকে। একলাফে নেমেই ঝেড়ে দৌড় দিল সে।
গার্ড রূমের কাছে একটানা হর্ন বাজছে। সবার মনোযোগ এখন ওই দিকে। এদিকে ডেভিড টেক অফ করার জন্যে রোটর স্পীড বাড়িয়ে দিয়েছে।
দুটো জীপ ছুটে আসছে লঞ্চ প্যাডের দিকে। প্রথম জীপ থেকে এক পশলা গুলি বর্ষণ হলো।
গুলি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সৈনিক আর পাইলট সবাই শুয়ে পড়ল মাটিতে। বেঘোরে প্রাণ খোয়াতে রাজি নয় কেউ।
হেলিকপ্টারের গায়ে লেগে পিং পিং শব্দ তুলে গুলিগুলো ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা গুলি ডেভিডের র্যাডিয়েশন স্যুটের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ব্যথা অনুভব করল না সে, অর্থাৎ, গায়ে লাগেনি। ব্রীফকেসটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ডেভিড। তার হাতে এখন ভারী স্মাইজার মেশিন পিস্তল। দুটো গাড়ির হেডলাইটই ডেভিডের ওপর। দেখতে পাচ্ছে না সে ভাল করে। সহজ টারগেটই বেছে নিল সে। পেট্রোল ট্যাঙ্ক ফাটার বিকট শব্দ উঠল। জি-আই-রা জীপের আড়ালে নিরাপদেই থাকল। কিন্তু এখন আর ডেভিডকে ঠেকাবার সাধ্য কারও রইল না। আগুন আর ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে আকাশে উঠে পড়ল হেলিকপ্টার।
নিচ থেকে ট্রুপের লোকজন তখনও পাগলের মত হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে—কিন্তু সবই বৃথা। রেঞ্জের বাইরে চলে গেছে ডেভিড। সবগুলো ল্যাপ লেজারই হাতছাড়া হয়ে গেল—কোন উপায় নেই এখন ওগুলো উদ্ধারের। হতাশ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে গোলাগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দিল ক্যাপ্টেন।
‘ওটা কোন্ জেনারেল ছিল, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল সার্জেন্ট।
‘ভুয়া।’ একটু ধরা গলায় জবাব দিল ক্যাপ্টেন। ‘আর যেই হোক, ও ব্যাটা জেনারেল বুমার নয়। আর্মি অফিসার্স ক্লাবে জেনারেল বুমারের কাছ থেকেই আসছি আমি। তাঁর একটা ইউনিফর্ম খোয়া গেছে। জীপটা চুরি যেতেই খবর পেয়ে ধাওয়া করেছিলাম আমি।’
টুপিটা মাথার ওপর একটু টেনে ঠিক মত বসিয়ে কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটা চাপা শিস বেরিয়ে এল, ‘ও ব্যাটা যে-ই হোক, খেলা একটা দেখিয়েছে বটে—স্বীকার করতেই হবে। ভাবতে পারো কি লঙ্কাকাণ্ড বাধবে যখন ওপরওয়ালারা জানবে তাদের প্রিয় খেলনার একটা নয়, চার—চারটেই হাইজ্যাক হয়ে গেছে?’
‘তাহলে কি হবে, স্যার, চোটটা তো আমাদের ওপরই আসবে?’ প্রশ্ন করল কর্পোরাল। আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত সে।
‘নাহ্, আমাদের কি হবে? সিকিউরিটি ব্যবস্থার সাথে আমাদের কোন যোগ নেই। বড়য় বড়য় ফাইট হবে—এতে আমাদের কোন দায় দায়িত্ব নেই। আমরা আমাদের পক্ষে যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছি।’ প্রবোধ দিল ক্যাপ্টেন। সে নিজেও খুব একটা স্বস্তি বোধ করছে না। নিজের মনেই সপক্ষে যুক্তি খুঁজছে সেও। সে জানে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর রীতি সব দেশেই সর্বকালেই আছে।
.
ডেভিডের পরিচয় অজ্ঞাতই রয়ে গেল ইউ এস আর্মির কাছে। বুইকটা চুরি করা—কোথাও কোন আঙুলের ছাপ নেই। ফেলে আসা কাপড়গুলো চেইন স্টোর থেকে কেনা। কোথাও কোন চিহ্ন না রেখে ভূতের মতই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে লোকটা।
মিনিট পনেরো পুবদিকে উড়বার পর নিচের দিকে নেমে এল ডেভিড। গাছের মাথা ছুঁই ছুঁই করে উড়ছে হেলিকপ্টার—তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার নিচের দিকে।
অন্ধকারের মধ্যে জ্বলছে আর নিভছে একটা আলো। ল্যান্ডিং লাইট ফ্ল্যাশ করতেই উত্তর এল—তিনটে গাড়ির তিন জোড়া হেডলাইট জ্বলে উঠল একসাথে।
হেলিকপ্টারটা দক্ষ হাতে দ্রুত নিচে নামিয়ে ল্যান্ড করল ডেভিড মাঠের মাঝখানে। তিন দিকে তিনটে গাড়ি। একটা গাঢ় রঙের বড় সিট্রন, একটা ফোক্সওয়াগেন আর তৃতীয়টা একটা ছোটখাট শক্ত গোছের পিকআপ ট্রাক।
মাটিতে লাফিয়ে পড়েই সিট্রনের দিকে গেল ডেভিড। আগেই নির্দেশ ছিল সে রকম। নিঃশব্দে সামনের জানালার কাঁচটা নিচে নেমে গেল। শোফারের জামা পরে ড্রাইভিং সীটে বসে রয়েছে ব্যারি হোম্স্।
‘মাল পেয়েছ?’ ছোট্ট প্রশ্ন করল ব্যারি।
‘হুঁ।’ আরও ছোট জবাব দিল ডেভিড।
‘খুশির কথা,’ বলেই পাশের দিকে ঝুঁকে সামনের সীটে রাখা একটা নরম বান্ডিল আর ম্যাট লেদারের একটা ব্রীসে ধরিয়ে দিল সে ডেভিডের হাতে। ‘জামা-কাপড়, তোমার সাইজেরই। কেসের ভেতরে পাবে টাকা আর ফোক্সওয়াগেনের চাবি। লেজার নিয়ে তোমার আর চিন্তা করতে হবে না, আমরাই ওগুলো ট্রাকে তুলে নেব। ফেজ টুর সময়ে আবার তোমাকে খবর দেয়া হবে। এখন গা ঢাকা দাও।’ সোজা সাপ্টা নির্দেশগুলো বলে গেল ব্যারি।
ব্রীফকেস খুলে ইউ এস ডলারের তোড়াগুলো দেখে হাসি ফুটে উঠল ডেভিডের ঠোঁটে। বলল, ‘ধন্যবাদ।’ গাড়ির পিছনের সীটে বসা লোকটাকে চিনবার চেষ্টা করল, কিন্তু একে অন্ধকার, তার ওপর টিনটেড্ গ্লাস। কিছুই দেখা গেল না। একটা কথাও বলেনি লোকটা।
গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে অত্যন্ত সম্ভমের সঙ্গে বলল ব্যারি, ‘আমি লেজারগুলো পিকআপে তুলে ওয়্যার হাউসে নিয়ে যাচ্ছি, স্যার।
‘ঠিক আছে।’ এতক্ষণে কথা বলল কবির চৌধুরী। ‘রবার্টকে নিয়ে আমি হোটেলে ফিরছি—ওখানে আমার সাথে দেখা করবে তুমি পরবর্তী নির্দেশের জন্যে। রবার্টকে বলো আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিতে।’
‘হেলিকপ্টারটা?’ আদেশের অপেক্ষায় ব্যারি।
‘ইউনিফর্ম আর র্যাডিয়েশন স্যুটসহ ওটাকে উড়িয়ে দাও।’ নির্বিকার ভাবে নির্দেশ দিল কবির চৌধুরী।
মাইলখানেক যেতে না যেতেই পিছন থেকে হেলিকপ্টার বিস্ফোরণের শব্দ শুনল ডেভিড—রিয়ার ভিউ মিররে আগুনের ফুলকিগুলোও স্পষ্ট দেখল সে। মনে মনে ভাবল, সত্যিই গুছিয়ে কাজ করতে জানে কবির চৌধুরী।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন