কাজী আনোয়ার হোসেন
প্যারিস।
গাছে ছাওয়া আইল সেইন্ট লুই। সুন্দর রোদ ঝলমলে দিন। ধীর পায়ে, যেন উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হেঁটে চলেছে আলবার্তো ভেরিনো। গাছের পাতার ফাঁক গলে মাঝেমধ্যেই একআধ চিলতে রোদ এসে পড়ছে ওর শক্ত সমর্থ চৌকো মুখের ওপর। বয়স ষাটের কাছাকাছি। টুপি পরেনি—তারের মত একমাথা এলোমেলো পাকা চুল। পরনে মোটা কাপড়ের চেক স্যুট। ওয়েস্ট কোটের বোতামগুলো সব লাগানো—ফলে তার ছোট্ট নটের টাইটা কুঁচকে উঁচু হয়ে রয়েছে। সাধারণ ব্যবসায়ীর মতই দেখাচ্ছে ওকে এখন। কিন্তু বছর দুই আগেও আলবার্তো ভেরিনো ছিল ফ্ৰেঞ্চ আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। গত পাঁচ দশকের মধ্যে ফ্রান্সের ক্রাইম জগতে এত বড় প্রতিভা আর উদয় হয়নি। সহকর্মীদের কাছে এখনও সে আগের সম্মানই পায়। সবার সাথে আগেরই মত যোগাযোগ রাখে সে, কিন্তু এখন রিটায়ার্ড।
চলতে চলতেই একবার ঘড়ি দেখল আলবার্তো ভেরিনো। তিনটে বাজছে। এখনও তিন-তিনটে ঘণ্টা সময় কাটাতে হবে তাকে। ছটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
কাছেই মডার্ন আর্ট, পোরসিলিন, আর ক্রিস্টাল গ্লাসের দুটো মিউজিয়াম, রোডিন আর ক্লানি। এই দুটোর ওপরই কাজ করবে ঠিক করল ভেরিনো। ঘণ্টা দুই খুব নিষ্ঠার সাথে কাজ করল সে। নোট বই বের করে নোট করল কোথায় কোন্ জিনিসটা নতুন আনা হয়েছে, সেগুলোর সিকিউরিটি ব্যবস্থা কি কি—জানালা দরজা কোটার অবস্থান কোথায়। কোন খুঁটিনাটিই বাদ গেল না। এটা তার একটা শখে দাঁড়িয়ে গেছে। নিজের ঘরে ফিরে অবসর সময়ে ঠিকই সে ওই সব মূল্যবান জিনিস সরাবার ফুলপ্রুফ একটা প্ল্যান তৈরি করবে। ক্রাইম ছেড়ে দেয়ার পরে এই ধরনের মানসিক ব্যায়ামে সে অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি পায়। ইচ্ছে করলেই করতে পারতাম, পুলিস টিকিটিও ছুঁতে পারত না—কিন্তু ছেড়ে দিলাম—বর্তমানে এই ত্যাগেই ওর আনন্দ।
লম্বা একটা শ্বাস নিল ভেরিনো। কি ভালই না লাগে! ধন—সম্পদ পরিবেষ্টিত সব জায়গাতেই কেমন যেন একটা মিষ্টি মধুর গন্ধ থাকে।
মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে সোজা গেল সে তার গাড়ির কাছে। আলভারো পিয়েত্রোর ছদ্মনামে ভাড়া করা হয়েছে গাড়িটা। পিছনের সীটে রাখা সুটকেসটা তুলে নিয়ে নির্বিকার ভাবে গাড়ি লক করে ওটাকে ওখানেই পরিত্যাগ করল। ঘটনাটা ওর মনে কোনই আমল পেল না—ও জানে, কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িটা হারিয়েছে বলে রিপোর্ট করা হবে—আরও পরে ওটা পুলিস খুঁজে বের করে পৌঁছে দেবে মালিকের কাছে।
পাঁচটা বাজে। সময় হয়ে আসছে। ট্যাক্সি নিয়ে বুলেভার্ড হাউসমানে আর একটা কার রেন্টালে গেল ভেরিনো। সেখানকার
সুন্দরী সেক্রেটারি তাকে হেনরী বুংগার্ট নামে চিনে ফেলল তৎক্ষণাৎ। ওই নামে আগেও এই গ্যারেজ থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়েছে ভেরিনো। তবে ওই সুন্দরীর ওকে মনে রাখার ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি ভাড়া করতে এসে গতবার ডোরিনকে আপন মেয়ের মত লাগায় একটা হীরের ব্রোচ উপহার দিয়েছিল সে—মনে থাকার সেটাই কারণ। ডোরিনই সব ব্যবস্থা করল—পনেরো মিনিটের মধ্যে মারসিডিস বেজ্ -২০০ ড্রাইভ করে রওনা হয়ে গেল ভেরিনো ভারসেই হয়ে র্যামবুইলের উদ্দেশে। কাছাকাছি একটা বাগানে বসে রুটি আর হ্যামবার্গার খেয়ে নিল।
র্যামবুইল্লের গির্জায় ছ’টার প্রথম ঘণ্টার সাথে সাথেই আধো অন্ধকার গির্জার বিরাট দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল আলবার্তো ভেরিনো। ঘণ্টার ধ্বনিতে গমগম করছে হলের ভিতরটা। সন্তর্পণে এগিয়ে গেল সে একসারি কনফেশন বক্সের শেষটার দিকে। বক্সটার হাত ছয়েক দূরে পাথরের মূর্তির মত পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্যারি হোম্স্। একেও ডাকা হয়েছে নাকি? ইউরোপের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সাভাতে-ফাইটার এ লোক। পিস্তল ছোঁড়াতেও এর জুড়ি মেলা ভার। এই লোক এখানে কেন বুঝতে না পারলেও সৌজন্যের খাতিরে একটু মুচকি হেসে কনফেশন বক্সের লাল পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল ভেরিনো।
চৌধুরী! মনে মনে ভীষণ চমকাল ভেরিনো। কিন্তু মুখের ভাবে কিছুই প্রকাশ পেল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করল পরিবর্তনগুলো। চোখ দুটো বোধ হয় নষ্ট হয়ে গেছে লোকটার। জুলফির কয়েকটা চুলে পাক ধরেছে। কিন্তু চেহারায় আগের মতই প্রতিভার ছটা।
‘ফাদার, আমি পাপ করেছি, আমাকে আশীর্বাদ করুন,’ বলল সে কাতর কণ্ঠে।
‘ইন নোমাইন প্যারিস, ফিলি এত্ স্পিরিতাস স্যাঙ্ক…’ প্রিস্টের সাদা জোব্বা পরা ফাদার আউড়ে গেল তার কোড়টা বেশ গাম্ভীর্যের সাথে।
‘হ্যাঁ, এবারে কাজের কথায় আসা যাক, কি বলো, ভেরিনো?’ সময় নষ্ট করার লোক যে ফাদার নয় তা বেশ বোঝা গেল।
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’ সাগ্রহে সম্মতি জানাল ভেরিনো। বড় কিছু করার মতলব এঁটেছে লোকটা, পরিষ্কার আঁচ করতে পারছে সে।
‘আমার কিছু লোক দরকার। খোঁজ নিয়ে জেনেছি সেরা লোকদের সাথেই তোমার ওঠাবসা।’
‘কি করার জন্যে, বস্?’
‘সেটা সময় মত প্রকাশ করা হবে।’ একটু ধমকের সুরে বলল ফাদার।
‘ঠিক আছে। কতজন কি ধরনের লোক দরকার আপনার?’ নোট বই বের করে নোট নিতে আরম্ভ করল ভেরিনো।
‘তিন জন। একজন অস্ত্র বিশারদ। অবশ্যই তাকে সেরা, আর অভিজ্ঞ লোক হতে হবে।’ নিচু গলায় কথা বলছে কবীর চৌধুরী। ভারী লেসের চশমার ভিতর দিয়ে তার চোখ দুটো চার আনা, থুড়ি, দু’টাকা দামের রসগোল্লার মত দেখাচ্ছে।
‘দুই নম্বর চাই আমার সার্কাসের একজন সেরা গেছো লোক, বা মেয়েলোক, যে অনেক উঁচুতে রশি বেয়ে উঠতে পারবে নির্ভয়ে। আর অবশ্যই তাকে ইলেকট্রিক ওয়েল্ডিং জানতে হবে।’
খসখস করে নোট লিখে চলেছে আলবার্তো ভেরিনো।
‘তৃতীয় জনকে হতে হবে কমপিউটর প্রোগ্রামিঙের এক্সপার্ট। খুব শক্তিশালী, আর দড়ি বেয়ে অনেক উপরে ওঠানামায় এক্সপার্ট হতে হবে একেও। বিশেষ করে হাইটের ব্যাপারে নির্ভীক তিনজন লোক আমার দরকার।’
‘আর কিছু?’ নোট বই থেকে মুখ তুলে ফাদারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল ভেরিনো।
‘না।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর এল।
‘খরচা হবে বেশ। মাথার পিছনটা একটু চুলকিয়ে নিয়ে জানাল ভেরিনো।
‘খরচ যা লাগে আমি দেব। কাজ পছন্দ হলে খুশি করে দেব।’ ‘ঠিক আছে, টাকা আপনি দেবেন—সেরা লোকই আমি সাপ্লাই দেব।’
‘একমাস সময়—একমাস পর আমার লোক তোমার সাথে যোগাযোগ করবে।’
মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়াল আলবার্তো ভেরিনো। তার হাতের টানে পর্দার ব্রাস রিংগুলো পরস্পরের সাথে বাড়ি খেয়ে বেজে উঠল। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে চার্চের আধো অন্ধকার হলঘরে এসে দাঁড়াল। দেখল এখনও দাঁড়িয়ে আছে ব্যারি। বেরিয়ে আসার সময়ে লক্ষ করল অন্য একটা পর্দার আড়াল থেকে আরও এক জোড়া চোখ তার ওপর সতর্ক নজর রেখেছে। রাস্তায় নামল ভেরিনো। একটু এগিয়েই বুঝল ফেউ লেগেছে পিছনে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন