জিম্মি – ১২

কাজী আনোয়ার হোসেন

বারো

কনুই মেরে ভিড় ঠেলে বহু কষ্টে পৌঁছাল রানা কমিউনিকেশন ভ্যানের কাছে।

‘পনেরো মিনিটের মধ্যেই কবির চৌধুরী টাওয়ার ছেড়ে চলে যাবে বলেছে—কিন্তু কিভাবে পালাবে ও, কোন ধারণা আছে তোমার?’ সরাসরি রানাকে জিজ্ঞেস করলেন রাহাত খান। ‘আমরা জানি হেলিকপ্টারে তাকে তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করেছে সে সীন নদীর একটা জায়গা থেকে—কিন্তু ওখানে আমাদের সিকিউরিটি এড়িয়ে সে পৌঁছবে কিভাবে?

‘সম্ভবত পানি পথে। বেসমেন্ট ইন্সপেকশন চেম্বারে আমি অক্সিজেন ব্যারেল দেখেছি।’ জবাব দিল রানা।

‘অক্সিজেন সিলিন্ডার!’ দ্রুত টেবিলে ছড়ানো ম্যাপগুলো ঘেঁটে টাওয়ার বেসের নক্সাটা বার করলেন রাহাত খান।

‘ঠিক। চার ফুট ব্যাসের সুয়েরেজ পাইপ গেছে টাওয়ারের তলা দিয়ে।’ নক্সার নানান দাগের মধ্যে এক জায়গায় আঙুল রাখলেন মেজর জেনারেল।

‘টাওয়ার বেসে ইন্সপেকশনের জন্যে কোন ঢাকনা বা হ্যাচ আছে?’

‘সে তো আধমাইল পর পরই আছে—ঠিক টাওয়ার বেসের নিচেই আছে একটা।’ অপরাধীর মত জবাব দিল সুপারিনটেন্ডেন্ট। একটা পেনসিল দিয়ে বুটি বুটি দাগ কেটে এঁকে দেখাল টাওয়ারের নিচে ঠিক কোথা দিয়ে গেছে ওটা—আর হ্যাচটা কোথায়।

‘কোথায় কোথায় যাওয়া সম্ভব ওই পাইপ দিয়ে?’ প্রশ্ন করলেন রাহাত খান।

‘শহরের যে কোন জায়গাতেই যাওয়া সম্ভব, যদি অক্সিজেন থাকে।’

‘সীন নদীতেও যাওয়া যাবে?’ প্রশ্ন এল মশিয়ে পম্পেদুর কাছ থেকে।

‘অবশ্যই। পাইপের পানি সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে।

‘আচ্ছা বিউ মুচের কাছে কোন্ জায়গায় নদীতে মিশেছে পাইপ?’ জানতে চাইলেন রাহাত খান।

ম্যাপ দেখল সুপারিনটেন্ডেন্ট, ‘হ্যাঁ ওখানেও একটা জায়গায় পাইপ নদীতে গিয়ে মিশেছে।’

.

প্রথম ল্যান্ডিঙে কবির চৌধুরী সবাইকে লিফটে ওঠার আদেশ দিল। জিম্মি আর কমান্ডোরা গাদাগাদি করে উঠল এলিভেটরে। পকেট থেকে একটা চাবি বার করে কবির চৌধুরী দিল লেপঙের হাতে।

একটা লাল বিপদ সঙ্কেত মার্কা বাক্সের গর্তে ঢুকিয়ে চাবি ঘোরাল সে। চাবির পাশেই ছোট্ট একটা কালো বোতাম। কবির চৌধুরী নির্দেশ দিল ওটা টিপে দেয়ার জন্যে। আদেশ অনুযায়ী কাজ করল লেপং। ‘ডে-ডেটোনেটর সক্রিয় এখন—ইচ্ছা ক—করলেও আর ফি-ফিরানো যাবে না। দ-দশ মিনিট সময় আছে আমাদের।’ একটু তোতলাল লেপং কথাগুলো বলার সময়।

‘ওগুলো কি লিফটে তুলে দেব?’ রেলিং-এ হেলান দিয়ে রাখা ক্যানভাস ব্যাগ কয়টা দেখিয়ে লেপং জানতে চাইল।

ক্রুর একটা সবজান্তা হাসির আভাস ফুটে উঠল কবির চৌধুরীর ঠোঁটে। ‘না, টাকার দেখাশোনা আমি নিজেই করব—তুমি আর সবার সাথে লিফটে ওঠো।

লিফটের লোকজনের মধ্যে একটা অসন্তোষের গুঞ্জন উঠল। রেলিঙে হেলান দিয়ে হাতের মেশিন পিস্তল নেড়ে লেপংকে ধমক লাগাল কবির চৌধুরী, ‘যা বলছি করো।’

ঘেঁষাঘেঁষি করে কোনরকমে জায়গা করে নিল সে রূপা আর ডেভিডের পাশে।

‘গেট বন্ধ করো।’ সদ্য মুক্তি পাওয়া লিফটম্যানকে তাড়া দিল কবির চৌধুরী।

বন্ধ হয়ে গেল ভারী লোহার গেট।

অবজ্ঞার সাথে একটু হেসে কবির চৌধুরী বলল, ‘তোমরা সবাই চমৎকার ভাবে সাহায্য করেছ আমার কাজে—সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ। তোমাদের আর আমার কোন প্রয়োজন নেই। অ রিভ্যু।’

নিচে নামার বোতাম টিপে দিল চৌধুরী। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই চোখের আড়ালে চলে গেল লিফট। ওয়াকিটকিতে রবার্টের সাথে যোগাযোগ করল কবির চৌধুরী, ‘প্রথম ল্যান্ডিঙে আমার কাছে রিপোর্ট করো, এক্ষুণি।’ কথাটা বলেই দেয়ালের গায়ে বসানো একটা লিভার টেনে দিল সে। টাওয়ারের ইলেকট্রিক পাওয়ার সাপ্লাই-এর মেইন সুইচ এটা—কারেন্ট অফ হয়ে গেল। খুব প্রশান্তি র সাথে সে লক্ষ করল ঝাঁকুনি খেয়ে মাঝ পথে থেমে গেছে লিফট।

ক্যানভাসের ব্যাগগুলোর মাথা পাতলা চামড়ার ফালি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। পকেট থেকে নিকেলের ক্লিপ বার করে প্রত্যেকটা ব্যাগের মাথায় তা এঁটে দিয়ে সবগুলোকে ওয়াটার প্রুফ করে নিল কবির চৌধুরী।

রবার্ট এসে পৌঁছতেই ব্যাগগুলো নিয়ে নিচে নামার নির্দেশ পেল। চোখে লাগানো অদ্ভুত যন্ত্রটার একটা নব ঘুরিয়ে দুদিকে উঁচিয়ে থাকা এন্টেনা দুটোর কোণ ঠিক করে নিল কবির চৌধুরী। রেলিঙ ধরে একটু এগিয়ে ঝোলানো দড়িটার কাছে এল সে। প্রায় অর্ধেক পথ তখন নেমে গেছে রবার্ট। সড়সড় করে দড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল কবির চৌধুরী। রানার নামাটা নিশ্চয়ই এত সহজ হয়নি, নিজের মনেই হাসল একটু।

জেনারেটর ট্রাকগুলোর ভীষণ গর্জনের মাঝখান দিয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইন্সপেকশন চেম্বারের দিকে এগোল সে।

.

লিফটের ভিতরে দুঃসহ এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। দু’হাতে খামচে ধরল ডেভিড লেপং-এর কাঁধ, প্লাস্টিক চার্জ—ওগুলো কি সক্রিয় করা হয়েছে?’

কোন জবাব না দিয়ে বোকার মত মাথা ঝাঁকাল লেপং। রাগে অন্ধ হয়ে লিফটের কাঁচের ওপর ঘুসি মারল ডেভিড। ‘হারামজাদা আমাদের সবাইকে মারতে চায়!’ চিৎকার করে উঠল সে। কিন্তু বুদ্ধি হারালে চলবে না। লিফটে বসার জন্যে রাখা লোহার বেঞ্চটার ওপর চোখ পড়ল ডেভিডের।

‘টিচ্, হাত লাগাও।’ এক লাফে টিচ্ বেঞ্চটার অন্য প্রান্তে চলে গেল। দু’জনে মিলে বেঞ্চটা তুলে নিয়ে সজোরে আঘাত করে ভেঙে ফেলল একটা জানালা। সবাই তখন হুড়োহুড়ি করছে জানালার কাছে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু ফাঁকটা খুব ছোট। ‘আবার মারো।’ কয়েক পা পিছিয়ে এসে ছুটে গিয়ে আবার আঘাত করল তারা। একটা মানুষ গলে বের হওয়ার মত ফোকর সৃষ্টি হয়েছে এখন জানালার গায়ে।

‘কি করতে হবে জানা আছে?’ রূপাকে জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘জানি—কিন্তু সময়ে কুলাবে তো?’

‘যে-ভাবেই হোক নিষ্ক্রিয় করতে হবে ওগুলো। শেষ চেষ্টা তোমার করতেই হবে। আমি যাচ্ছি কবির চৌধুরীর খোঁজে।’

লিফট থেকে বেরিয়ে রূপা গেল উপর দিকে আর ডেভিড নিচের দিকে।

রূপা অনুমান করল, হাতে সময় আছে মিনিট ছয়েকের মত, এই সময়টুকুর মধ্যেই চার চারটে চার্জ নিষ্ক্রিয় করতে হবে তাকে

দড়িটা তখনও বাতাসে দুলছে। ওটা বেয়েই নেমে গেছে কবির চৌধুরী। অন্তত দুটো প্লাস্টিক বোমার কাছে পৌঁছার ব্যাপারে সাহায্য করবে দড়িটা, কিছু মূল্যবান সময়ও বাঁচবে। হাত বাড়িয়ে দড়িটা ধরে ফেলল রূপা। তরতর করে বেয়ে উঠে গেল সে পশ্চিম দিকের বোমাটার কাছে।

একটা ক্রস স্ট্রাটের ওপর দাঁড়াল রূপা—দড়িটা দু’পায়ের ফাঁকে আটকানো। পুটির মত প্লাস্টিকের গভীরে সক্রিয় ডেটোনেটরটা রয়েছে। সাবধানে হাত বাড়াল সে—মৃদু মৃদু কাঁপছে আঙুলগুলো, দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল ও।

বাতাসের প্রবল এক ঝাপটা রূপাকে প্রায় গার্ডারের ওপর নিয়ে ফেলল। বোমাটা থেকে ওর মাথা এখন মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরে। আঙুলটা অবশ্য অনেক দূর ভিতরে ঢুকিয়েছে সে—কিন্তু ডেটোনেটরটা এখনও ছুঁতে পারেনি। লটকে রয়েছে সে শূন্যে, উৎকণ্ঠায় বড়-বড় হয়ে উঠেছে চোখ দুটো।

ছোট লাল বাক্সটার ঘড়ি টিক টিক করে সময় গুনে চলেছে, ৫.১৫… ৫.১৪…৫.১৩…

নিচে নেমে কোন জায়গা খুঁজতে বাদ রাখেনি ডেভিড, কিন্তু কবির চৌধুরীর টিকিটিরও কোন চিহ্ন নেই। একেবারে হাওয়ায় যেন মিলিয়ে গেছে সে। ইলেকট্রিক্যাল ইন্সপেকশন চেম্বারে শুধু পড়ে আছে রবার্টের রক্তাক্ত দেহ।

.

ডেভিডের পৌঁছার কিছুক্ষণ আগেই ওই চেম্বারে ঢুকে বিয়ার ব্যারেল পরীক্ষা করে দেখেছে কবির চৌধুরী। হ্যাঁ, প্রেশার ঠিক আছে। তার সামনেই রয়েছে তিনটে ক্যানভাস ব্যাগ, তাতে তিরিশ মিলিয়ন ডলার।

কোন্ পথে কিভাবে পালাবার পরিকল্পনা নিয়েছে কবির চৌধুরী তা এখন জলের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রবার্টের কাছে। বদমেজাজী লোকটার সাথে দুটি বছর কাটিয়েছে সে। এতদিনে তার ভাগ্য খুলেছে—পিছন থেকে একটা গুলি বিঁধিয়ে দিলেই তিরিশ মিলিয়ন ডলারের মালিক হতে পারে সে একা! হোলস্টার থেকে পিস্তল বার করার জন্যে ধীরে ধীরে হাত বাড়াল সে।

ঝট করেই ঘুরল কবির চৌধুরী। হাতের মাউজার মেশিন পিস্ত ল রবার্টের বুক বরাবর তাক করা। ‘কোন চালাকি চলবে না।’ ধমকে উঠল সে।

একেবারে জমে গেছে রবার্ট। ওর কি পিছন দিকেও চোখ আছে? অবাক বিস্ময়ে ভাবছে সে। টের পেল কি করে যে খুন হতে যাচ্ছিল সে?

রবার্টের চোখে অবিশ্বাস দেখেই হয়তো কবির চৌধুরীর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির একটা হাসি ফুটল। ‘আমার নিজের আবিষ্কার এটা।’ নিজের চোখে লাগানো অদ্ভুত চশমাটা দেখিয়ে বলল সে। ‘শুধু সামনে কি ঘটছে তা-ই নয়—পিছনে কি ঘটছে সেটাও আমি টের পেয়ে যাই এটার সাহায্যে।’

‘আ…আমি…’

‘চুপ! আমার জন্যে যারা কাজ করে তারা মাত্র একবারই ভুল করার সুযোগ পায়। তোমার প্রথম ভুলটা তুমি এইমাত্র করেছ। ধীরে মেশিন পিস্তলটা ওঠাল কবির চৌধুরী রবার্টের কপাল বরাবর। পরপর তিনটা গুলি করল সে। রবার্টের প্রাণহীন দেহটা লুটিয়ে পড়ল তার পায়ের কাছেই।

অক্সিজেন ব্যারেলটা চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে পিঠে বেঁধে নিল কবির চৌধুরী। ব্যারেলের নলের সঙ্গে রবারের টিউব লাগিয়ে মাস্কটা পরে নিল সে। ক্যানভাস ব্যাগ তিনটে রবারের তিনটে ব্যাগে ভরে ফেলল। ব্যাগ তিনটে একত্রে বেঁধে নিয়ে পাইপের ইন্সপেকশন হ্যাচ খুলে নেমে পড়ল ভেতরে। চার ফুট ব্যাসের পাইপ। ভেসে চলল কবির চৌধুরী সীন নদীর উদ্দেশে।

.

ইন্সপেকশন চেম্বারে রবার্টের মৃতদেহটা পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। পিছনে মৃদু একটা শব্দ হতেই ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সে। দাঁড়িয়ে আছে রানা।

কি বলতে যাচ্ছিল ডেভিড, কিন্তু তার সুযোগ দিল না রানা। ‘রূপা কই?’ জিজ্ঞেস করল সে।

টাওয়ারের ওপরের দিকটা নির্দেশ করল ডেভিড। ওদিকে রূপা এখন পাঁচ মিনিটের মধ্যে চারটে বোমা নিষ্ক্রিয় করার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু কবির চৌধুরী গেল কোন্ পথে? ওকে আমার চাই।

‘আন্ডার গ্রাউন্ড পাইপের ভেতর দিয়ে গিয়ে সীন নদীতে আধমাইল দূরে ভেসে উঠবে সে। ভেবো না, ধরা পড়বে ও। রূপার সাহায্য দরকার, আমি যাই।’ ছুটল রানা। যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছতে হবে ওকে।

ডেভিডের নামতে যত সময় লেগেছিল প্রায় একই সময় নিল রানা দড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে।

কয়েকশো ফুট ওপরে রূপা তখন হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছে ডেটোনেটরটা। মাত্র এক সেন্টিমিটার দূরেই রয়েছে সেটা।

ওদিকে অবিরাম সময় গুনে চলেছে ঘড়ি ৪.২২…৪.২১…৪.২০…

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন