জিম্মি – ৮

কাজী আনোয়ার হোসেন

আট

রূম সার্ভিসকে অর্ডার দিল সোহানা ৮১২ নম্বর কামরায় একটা ওমলেট আর কফি দিয়ে যাওয়ার জন্যে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সার্ভ করে গেল রূম সার্ভিসের

আজ সারা সকাল ধরে চেষ্টা করেও কাজে একটুও এগোতে পারেননি রাহাত খান। ইন্টারপোল, সি.আই.এ. বা ইউনাকো মনিটর কেউই কোন নতুন খবর দিতে পারেনি।

সোহানা মাত্র ওমলেটের বড় সড় একটা টুকরো মুখের কাছে এনে হাঁ করছে অমনি টেলিফোনটা বেজে উঠল। ছুরি কাঁটা প্লেটে রেখে ছুটল সে টেলিফোন ধরতে।

টেলিফোনে কথা শুনতে শুনতে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। এক ফাঁকে হাতের ডান পাশে রাখা টেলিভিশন সেটটা অন করে দিল সে।

‘ঠিক আছে, আমরা অ্যামব্যাসাডরের সাথে যোগাযোগ করছি।’ বলে ফোন ছেড়ে দিল সোহানা।

মেজর জেনারেল রাহাত খান তাঁর কাঁচা পাকা ভুরু তুলে তাকালেন সোহানার দিকে।

‘অসম্ভব কাণ্ড করে বসেছে কবির চৌধুরী!’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সোহানা। ‘আইফেল টাওয়ার হাইজ্যাক করেছে সে!’

‘আইফেল টাওয়ার হাইজ্যাক?’ খেপে উঠলেন রাহাত খান। পুরো ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ঠেকছে তাঁর কাছে।

‘হ্যাঁ, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সে আইফেল টাওয়ার দখল তো করেছেই—একজনকে জিম্মিও রেখেছে,’ বলল সোহানা।

‘কাকে?’ রাহাত খানের কপাল কুঁচকে উঠেছে উত্তেজনায়। ‘মার্কিন প্রেসিডেন্টের মা লিণ্ডা জোনসকে।’

‘গুড হেভেনস্। কাগজে দেখেছি, আজ সকালে একটা পার্টি ছিল আইফেল টাওয়ারে, ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস ফান্ডের জন্যে চ্যারিটি পার্টি।’ চিন্তিত হয়ে পড়লেন রাহাত খান।

‘টেলিভিশনে নাকি কি জরুরী ঘোষণা হবে, ইনটিরিয়র মিনিস্ট্রি থেকে বলল।’ বিড়ালের মত তখন ঘড় ঘড় শব্দ তুলছে টেলিভিশন। সেটটা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সোহানা।

একটু পরেই ঘোষকের ছবি ভেসে এল টিভির পর্দায়—’একটি বিশেষ ঘোষণার জন্যে আমরা আমাদের নিয়মিত অনুষ্ঠান আপাতত বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছি। বিশেষ ঘোষণার জন্যে অপেক্ষা করুন।

এক মিনিট অন্তর অন্তর বার তিনেক এই রকম ঘোষণার পরে হঠাৎ পর্দায় ভেসে উঠল কবির চৌধুরীর মুখ। ‘দুঃখিত,’ আরম্ভ করল কবির চৌধুরী, আপনাদের নিয়মিত প্রোগ্রামে আমি বিঘ্ন ঘটাতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু আমার ধারণা, আপনারা এখন যা দেখবেন তা আপনাদের চিরাচরিত প্রোগ্রামের চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ্য হবে।’ কথাগুলো প্রথমে ফরাসী ভাষায় বলল কবির চৌধুরী। তারপর ইংরেজীতেও সে আবার ওই একই কথা বলল।

‘আমার নাম কবির চৌধুরী। আমি একটু আগে আইফেল টাওয়ার দখল করে নিয়েছি। না, ঠাট্টা করছি না—নিজের চোখেই দেখুন আপনারা।’ অন্য একটা ক্যামেরাতে সুইচ করা হলো—ক্যামেরা প্রথমে এক নম্বর ল্যান্ডিঙের সশস্ত্র কমান্ডোদের দেখাল, পরে গিয়ে স্থির হলো বিমূঢ় রায়ট পুলিস, পুলিস কর্ডন আর জনতার ভিড়ের উপর। লেজার গানগুলো ক্যামেরায় দেখানো হলো না একবারও।

‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমি একটুও মিথ্যে বলছি না।’ আবার কবির চৌধুরীর মুখ দেখা গেল পর্দায়। ‘আর হ্যাঁ, এটাই সব নয়—আমার এখানে একজন আটক আছেন—জিম্মিও বলতে পারেন ইচ্ছে করলে। ফরাসী ও মার্কিন সরকার যদি আমার দাবি মেনে নেয় তাহলে জিম্মির কোন ক্ষতি করা হবে না।’ একটা হাতে-ধরা ই.এন.জি. ক্যামেরায় ভি.আই.পি. রূম ধরা পড়ল। দেখা গেল দৃঢ় চেহারার এক বদ্ধা বসে আছেন চেয়ারে। জুম করে শুধু মুখটা ধরে থাকল ক্যামেরা।

‘হ্যাঁ, অনেকে হয়তো চেহারা দেখেই চিনেছেন—ইনিই মার্কিন প্রেসিডেন্টের মা লিন্ডা জোনস।’ একটু থেমে আবার শুরু করল কবির চৌধুরী, ‘নিজের চোখেই সব দেখলেন। এর কোনটাই মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত নয়। আমি ও আমার সঙ্গীরা এই টাওয়ারের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব কায়েম করেছি। কিভাবে কর্তৃত্ব করছি তা একটু পরেই দেখতে পাবেন। আইফেল টাওয়ার দখল করে আমার জিম্মিকে নিয়ে আমি এইখানেই বসে থাকব যতক্ষণ না আমাকে মুক্তিপণ দিয়ে সন্তুষ্ট করা হচ্ছে।

‘ফ্রান্সের সাথে আমার কোন বিরোধ নেই—তবে এত খেটে বুদ্ধি খরচ করে আইফেল টাওয়ার দখল করেছি, এটাকে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে যাওয়ার জন্যে…আমি বলব, তিরিশ মিলিয়ন ডলার খুবই যুক্তিসঙ্গত দাবি। আমার এই অপারেশনের খরচাটা তাতে উঠে যাবে। কিন্তু মিসেস লিন্ডা জোনসের মুক্তির ব্যাপারে আমার কিছুটা বক্তব্য আছে। আমেরিকার কাছে আমার আগেরই পাওনা আছে দশ বিলিয়ন ডলার। আর মিসেস জোনসের মুক্তির জন্যে আমি দাবি করছি আরও দশ বিলিয়ন—অর্থাৎ মোট বিশ বিলিয়ন ডলার আমার চাই। আমার কাছ থেকে দশ বিলিয়ন ডলার দিয়ে রাডার ইকুইপমেন্ট কিনেছিল মার্কিন সরকার। টাকা দেওয়া দূরের কথা—উপরন্তু আমার গবেষণাগার ধ্বংস করা হয়েছিল। বিশ্ববাসীর আজানা নেই কিভাবে যুদ্ধ জাহাজ আইওয়ায় চড়ে গোটা আমেরিকা ধ্বংসস্তূপ বানাতে গিয়েছিলাম আমি কামান দেগে। যে কারণেই হোক আমার সেই মিশন সফল হয়নি—কিন্তু সেজন্যে  এখন আমি আর দুঃখিত নই। আমার ন্যায্য পাওনা এখন আমি কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নিতে চাই। যদি আমার পাওনা টাকা না দেয়া হয় তবে চরম অপমান করব আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের। তাদের প্রিয় প্রেসিডেন্টের মা অসহায় ভাবে মারা পড়বেন আমার হাতে।

টেলিফোন বেজে উঠল। সোহানা উঠে গেল টেলিফোন ধরতে। কিছুক্ষণ ওদিককার কথা শোনার পর জবাব দিল সে, আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে মিস্টার অ্যামবাসাডর—টেলিভিশনে শেষ পর্যন্ত কি বলা হয় তা না শুনে উনি টেলিফোন ধরতে পারবেন না।’ টেলিফোন রিসিভার নিচে শুইয়ে রেখে আবার টেলিভিশনে মনোযোগ দিল সোহানা। কবির চৌধুরী বলছে, ‘এবার দেখুন কেন আমার বিরুদ্ধে মিলিটারি বা সিভিল কোন শক্তি প্রয়োগেই কোন ফল হবে না।’ কবির চৌধুরীর মুখ মিলিয়ে গেল স্ক্রীন থেকে—ক্যামেরা টাওয়ারের বাইরের অংশের ওপর নিবদ্ধ। ধীরে ধীরে নাটকীয় ভাবে উপরে উঠতে লাগল ক্যামেরা—প্রথম ল্যান্ডিং ছাড়িয়ে আরও উঠে একটা ল্যাপ লেজারের ওপর এসে থামল। ওটার বদখৎ চেহারা দেখে যে কেউ নিঃসন্দেহে বলে দিতে পারবে ওটা সাংঘাতিক কিছু একটা। কবির চৌধুরী বলে চলল, ‘আপনারা এখন যা দেখছেন, তা একটা ল্যাপ লেজার গান। এই রকম চারটে গান আছে আমাদের।

‘এই গানগুলো, মানে ল্যাপ লেজার সম্পর্কে কিছুটা ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি। মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ওদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ধার নিয়েছি আমি এগুলো, ওদের স্টুটগার্ট বেস থেকে। সম্ভবত এগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে মাকে অস্ত্র। প্রত্যেকটাই এখন এমন ভাবে সক্রিয় করা হয়েছে যে আইফেল টাওয়ারের একশো গজের মধ্যে যা কিছু নড় ক না কেন তা সে মাটিতেই হোক বা আকাশেই, অবস্থান নির্ণয় করে এই লেজার গান সেটাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেবে। ফরাসী সরকার, পুলিস ও সেনাবাহিনীকে আমি তাদের ভালর জন্যেই এই উপদেশ দেব তারা যেন এই অস্ত্রের বিরুদ্ধে যুঝতে চেষ্টা না করেন। এক ঘণ্টা পরে আমি আবার আপনাদের সামনে হাজির হব—এখনকার মত বিদায়।’ পর্দা সাদা হয়ে গেল।

ওয়াশিংটন, লন্ডন, মস্কো, টোকিও, কায়রো, ব্রাসেলস, উপগ্রহের মাধ্যমে সবখানেই টেলিভিশনে ধরা পড়েছে কবির চৌধুরীর ঘোষণা। টেলেক্স আর ডিপ্লোমেটিক তারবার্তা চলতে শুরু করেছে দেশে দেশে। শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে প্যারিসে—পৃথিবীর বড় বড় সব শহরে রাস্তাঘাট খালি হয়ে গেল, আশঙ্কায় অস্থির হয়ে সবাই বসে আছে টিভি সেটের সামনে।

টেলিফোন ধরলেন রাহাত খান, ‘টেলিভিশনে কি বলল শুনেছ, এরিক?’ ওদিক থেকে কিছু বলার আগেই প্রশ্ন করলেন তিনি।

‘হ্যাঁ, পুরোটাই দেখলাম—কিন্তু কি করা যায় কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।’ উত্তেজনায় কাঁপছে অ্যামবাসাডরের গলা। ‘এর সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছি আমি।’

‘এই কবির চৌধুরী সম্পর্কে বিরাট ফাইল আছে আমাদের ইউনাকো অফিসে। দুর্ধর্ষ লোক। সে যাই হোক—ওই ল্যাপ লেজার গানগুলোই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আপদ। ওগুলোর আশ্চর্য ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার নিশ্চয়ই কিছুটা জানা আছে? বর্তমান অবস্থায় পুলিস বা আর্মির কিছুই করবার নেই।

‘ইন্টিরিয়র মিনিস্টারের সাথে যোগাযোগ করছি আমি—তুমিও যদি দয়া করে আসো তবে ভাল হয়।’

‘আসছি আমি, কিন্তু তার আগে যোগাযোগ করছি আমি হোয়াইট হাউসের সাথে।’ টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন রাহাত খান। নামিয়ে রাখার প্রায় সাথে সাথেই আবার বেজে উঠল সেটা।

‘রাহাত খান বলছি।’

‘ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আপনার সাথে কথা বলতে চান—লাইন দেব?’ বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করল টেলিফোন অপারেটার।

‘অবশ্যই,’ জবাব দিলেন মেজর জেনারেল। রাহাত খানের সাথে প্রেসিডেন্টের বেশ ভাল জানোশোনা আছে। যুদ্ধক্ষেত্রের বন্ধুত্ব।

প্রেসিডেন্টের ভারী গলা শোনা গেল টেলিফোনে, ‘সোজা কাজের কথায় আসছি—লিনডা জোন্‌স ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় অতিথি—আপনাকে তো রেড্‌ প্রায়োরিটি আগেই দেয়া আছে—এখন এব্যাপারে আমি আপনাকেই ফ্রান্সের পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিতে বলছি। আমি ডিফেন্স, হোম আর ফরেন মিনিস্টার সবাইকে খবরটা দিচ্ছি—ওরা সব রকম সহযোগিতা করবে।’

‘ঠিক আছে।’

‘আপনি দায়িত্ব নিলে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারব আমি।’

‘তবে একটা কথা, ওদের কাছে ল্যাপ লেজার গান রয়েছে—আমাদের শেষ পর্যন্ত হয়তো টাকা দিয়ে নিষ্পত্তি করতে হতে পারে।’

‘সে আপনি যা ভাল বোঝেন তা-ই করবেন। পুরো দায়িত্ব এখন থেকে আপনার, আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই সব হবে। আর আপনার সম্মতির জন্যে অজস্র ধন্যবাদ।’ ফোন ছেড়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট।

.

‘মেজর জেনারেল রাহাত খান বলছি।’ সোহানার হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে বললেন তিনি। তাঁর নির্দেশে ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউস বুক করেছিল সোহানা।

‘হ্যালো, প্রেসিডেন্ট জোনস।’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভারী গলা শোনা গেল।

‘খবর শুনেছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন রাহাত খান।

‘হ্যাঁ, এইমাত্র রেকর্ড করা টেপ দেখানো হলো সারা আমেরিকায়।’

‘কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?’ প্রশ্ন করলেন মেজর জেনারেল।

‘আমার করার কিছুই নেই। কবির চৌধুরীর চাহিদা মেটাবার মত অত টাকা আমি কোথায় পাব? সিনেট জরুরী মীটিঙে বসছে আধ ঘণ্টার মধ্যেই, ওরা কি সিদ্ধান্ত নেয় সেটা ওদের ওপর নির্ভর করছে।

‘ঠিক আছে, ঘণ্টা খানেক পরে আবার যোগাযোগ করব আমি এখনকার মত বিদায়।’ ফোন ছেড়ে দিলেন রাহাত খান।

‘রেডি হয়ে নাও। এখনই বেরোতে হবে।’ সোহানার দিকে চেয়ে বললেন মেজর জেনারেল।

.

ঘটনা যা-ই হোক না কেন বাচ্চাকে সবচেয়ে সামনে রাখা মানুষের স্বভাব। সবাই চায় বাচ্চাও উপভোগ করুক পুরোপুরি। টাওয়ারের নিচের ভিড়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

বাচ্চাটার বয়স সাত হবে। দু’দিকে দুটো পুলিসের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখছে। তার সোনালী চুল গোছা করে ফিতে দিয়ে বাঁধা। হাতে একটা বড় সাদা-কালো চেকের বীচ বল। মা দুই হাতে ওর কাঁধ খামচে ধরে রেখেছে। যদিও মজার কিছু তার নজরে পড়ছে না তবু তার দৃষ্টি আর মনোযোগ টাওয়ারের ওপর স্থিরভাবে আটকে রয়েছে। একসময় আশপাশে মনোযোগ ধরে রাখার মত কিছু না পেয়ে বল নিয়ে খেলায় মন দিল বাচ্চাটা। বলটাকে জোরে মাটিতে ড্রপ দিয়ে ধরতে গেল আবার। কিন্তু তার হাঁটুতে লেগে বলটা গড়গড়িয়ে চলে গেল সামনে চক দিয়ে চিহ্নিত টাওয়ারের সীমা রেখার দিকে। এক ঝটকায় কাঁধ ছাড়িয়ে নিয়েই ছুটল সে বলের পিছনে। চিৎকার করে উঠে মা-ও ছুটল তার পিছু পিছু, কিন্তু বাধা দিল পুলিস। কয়েক ফুট দূরে ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা টেকো হোঁতকা মত লোক পুলিসকে ঠেলে সরিয়ে ছুটল মেয়েটার পিছনে।

টাওয়ারের ওপর একটা ল্যাপ লেজারকে একটু বাম দিকে হেলতে দেখা গেল। ইঁদুরের কানের মত অ্যানটেনা আর একটু উঁচু হলো। ছুটন্ত মানুষ আর বলের সাথে সাথে লেজার গানও নড়ছে ধীরে ধীরে। কমপিউটর সবচেয়ে কাছের ছোট জিনিসটাই প্রথম টারগেট হিসাবে বেছে নিল।

দাগের কাছাকাছি চলে গেছে তখন মেয়েটা। ছুটতে ছুটতেই ডাইভ দিল টেকো। ধরে ফেলেছে সে ছোট মেয়েটার পা ঠিক দাগের একফুট বাইরে। আজই সকালে কবির চৌধুরীর নির্দেশে দাগ দিয়ে গেছে তার কমান্ডোদের কয়েকজন।

দাগ পেরিয়ে গেল বলটা। বিদ্যুৎ বেগে কাজ করল ল্যাপ লেজার। নিকষ কালো এক ঝলক আলো দেখা গেল টিউবের মাথায়। বলের আকৃতিটা উজ্জ্বল সাদা রূপ নিল মুহূর্তের জন্যে। একটু ধোঁয়া উঠে গেল ওপরের দিকে। তারপর কোন চিহ্ন মাত্ৰ আর নেই।

মেয়েকে বুকের মধ্যে ঠেসে ধরে মা তখন আবেগে ফোঁপাচ্ছে। কেমন একটা ভয়ানক স্তব্ধতা নেমে এসেছে ভিড়ের মাঝে। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য দেখে সবাই স্তম্ভিত বিমূঢ়।

.

লিমুজিন্‌টা এসে থামল ইনটিরিয়র মিনিস্ট্রি ভবনের সামনে। গাড়ি থেকে নামতেই রাহাত খান আর সোহানাকে নিয়ে যাওয়া হলো কনফারেন্স রূমে। তিনজন মিনিস্টারসহ বেশ কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা জড়ো হয়েছে—পুলিস, আর্মি, এয়ারফোর্স, সিভিল ডিফেন্স, কোনটাই বাদ নেই—প্রত্যেক বিভাগের প্রধানই স্বয়ং উপস্থিত।

ইন্টিরিয়র মিনিস্টার মশিয়ে পম্পেদু মেজর জেনারেলের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

চকচকে ওভাল টেবিল ঘিরে বসে আছে সবাই। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে মুখ খুললেন ডিফেন্স মিনিস্টার লারু। ‘ আমার বিশ্বাস এই লোকটা সম্বন্ধে যতটা সম্ভব আমরা সবাই যদি জানতে পারি তাহলে আমাদের কাজের অনেক সহায়তা হবে। মেজর জেনারেল রাহাত খানকে আমি অনুরোধ করব এই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে।’

‘কবির চৌধুরীই সম্ভবত এই যুগের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ক্রিমিনাল,’ শুরু করলেন বদ্ধ। ‘বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এত বড় প্ৰতিভা আর জন্মেছে কিনা সন্দেহ। মিসগাইডেড জিনিয়াস বলা যেতে পারে তাকে। ক্ষমতার লোভ আর বিজ্ঞান সাধনার নেশায় সে একটার পর একটা ক্রাইম করে চলেছে। প্রচুর টাকা আছে তার—আর প্রচুর ব্যয়ও করে সে তার এক্সপেরিমেন্টের পিছনে। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বেশ কয়েকবার সাফল্যের সাথে তার সাংঘাতিক পরিকল্পনা ব্যর্থ করেছে। আমি এটুকু বলতে পারি, কবির চৌধুরী যদি কোন দাবি করে বসে তবে তার সে দাবি এড়িয়ে যাওয়া যতটা সম্ভব কঠিন করে তুলবে সে।’

‘আপনি কি বলতে চান আমাদের সব সময়ে সে চাপের মধ্যে রাখবে—নড়া চড়া করার সুযোগই দেবে না?’ প্রশ্ন করলেন মশিয়ে লারু।

‘ঠিক তাই,’ জবাব দিলেন রাহাত খান। ‘ধরে নিচ্ছি যে কথাটা এই চার দেয়ালের বাইরে যাবে না—ইউনাকোর দুজন টপ্ এজেন্টকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এই লোকটার দলে। খুব একটা আশা করা ঠিক হবে না—ওরা কতদূর কি করতে পেরেছে বা পারবে কিছুই আমাদের জানা নেই; কারণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। চোখ কান খোলা রেখে অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহূর্তে আমাদের কিছুই করণীয় নেই।’ বক্তব্য শেষ করলেন রাহাত খান।

.

যারা তাকে ঘিরে রয়েছে তাদের খুঁটিয়ে লক্ষ করল ডেভিড। সুজানার দুঃসাহসিকতার জন্যে তাকেই লীডার নির্বাচিত করা হয়েছে। বাকি কয়েকজন কমান্ডো তার কথামত কাজ করবে। টেবিলের ওপর টাওয়ারের একটা প্ল্যান বিছানো। পঁচিশ পাউন্ডের চারটে চার্জ ওই প্যানের চার কোণে পেপার ওয়েটের কাজ করছে।

ডেভিডের আঙুল প্ল্যানের চারটে জায়গা নির্দেশ করল, এটা, ‘এটা, এটা আর এটা—এগুলো হচ্ছে টাওয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই বিন্দুগুলোই টাওয়ারের সবচেয়ে দুর্বল স্থান। এগুলো উড়িয়ে দিলেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে গোটা আইফেল টাওয়ার।’

‘প্রতিটি জায়গাতেই কি একটা করে পঁচিশ পাউন্ড চার্জ বসাতে হবে?’ জিজ্ঞেস করল রূপা।

মাথা ঝাঁকাল ডেভিড, ‘হ্যাঁ প্রত্যেক পয়েন্টে এক একটা পঁচিশ পাউন্ডের চার্জ বসাতে হবে। স্টীলের বাক্স থেকে একটা ডেটোনেটর বের করে নিল সে। ‘সাথে এগুলো একটা। রেডিও অ্যাকটিভেটেড ডেটোনেটর। যতক্ষণ না রেডিও সিগনাল দিয়ে অ্যাকটিভেট করা হচ্ছে ততক্ষণ সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু একবার সিগনাল দেয়া হলে নির্ধারিত সময়ে ওটা ফুটবেই—কোন উপায় থাকবে না ফেরানোর।

কাজের সময়ে দেখা গেল দুজন কমান্ডো গার্ড রেলের পাশে একটা স্ট্রাটের ওপর বসে রীতিমত ঠকঠক করে কাঁপছে। অত উঁচুতে কোন মতেই কাজ করতে পারবে না ওরা। বিরক্ত হয়ে টিচ্ কনুইয়ের গুঁতোয় একজনকে তার পথ থেকে সরিয়ে অন্যজনকে হিঁচড়ে টেনে গার্ড রেলের ওপর বসিয়ে দিল। তারপর টাওয়ারের পাশ দিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে দুটো বিস্ফোরক চার্জ বসানোর কাজ আরম্ভ করল। রূপা আর তৃতীয় কমান্ডো ধরল বাকি দুটোর কাজ।

আগের মতই সহজ সাবলীল দ্রুতগতিতে কাজ করে চলেছে রূপা। একটা অ্যাঙ্গল স্ট্রাটের ওপর বসে নরম গোলাপী রঙের প্লাস্টিক রোল গার্ডারের খাঁজে বসিয়ে টেপ দিয়ে আটকাল, তারপর ডেটোনেটরটা ঢুকিয়ে দিল ভিতরে।

উপরে দাঁড়ানো সহকর্মী কমান্ডোর দিকে চেয়ে মিষ্টি করে একটু হাসল রূপা। হয়তো ভয় পাচ্ছে লোকটা—তবু সহযোগিতা করছে। রূপাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করার জন্যে হাত বাড়াল সে। অসহিষ্ণু ভাবে হাতটা সরিয়ে দিয়ে রূপা বলল, ‘আমার কথা ভাবতে হবে না—নিজে সাবধান থাকো তুমি।’

একটু আহত ভাবেই হাত সরিয়ে নিল লোকটা। তারপর  ক্রসবীম ধরে এগিয়ে গেল সে। স্পাইরাল সিঁড়ির কাছাকাছি পর্যন্ত ক্রসৰীমটা গেছে। সিঁড়ির গার্ড রেল ধরার জন্যে লাফ দিল। কিন্তু না, মিস করেছে! চিৎকার করে উঠল সে ভয়ে। পা দিয়ে তখন একটা বীম জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে লোকটা।

লোহার ধারাল প্রান্ত হাঁটুর পিছনদিকের নরম জায়গায় কেটে বসেছে। যন্ত্রণায় পা সোজা হয়ে গেল ওর। দ্বিতীয়বার চিৎকার দিয়ে বীম ছেড়ে নিচের দিকে পড়তে শুরু করল। একটা অ্যাঙ্গেল স্ট্রাটের সাথে বাড়ি খেল। রূপার পাশ দিয়েই নিচে পড়ছে সে এখন। একহাতে শক্ত করে একটা স্ট্রাট ধরে অন্য হাতে কমান্ডোর হাতটা ধরে ফেলল রূপা ঠিক কব্জির একটু উপরে। রোমান হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে সেও আঁকড়ে ধরেছে রূপার কব্জির উপরের অংশ। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল রূপা—তার মনে হলো যেন কাঁধটা দেহ থেকে খুলে যেতে চাইছে—কিন্তু ছাড়ল না সে। দাঁতে দাঁত ঘষে আঁকড়ে ধরেই রইল।

টিচ্ ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘একটু ধরে রাখো—আমি আসছি।’

রূপার শক্তি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। বুঝতে পারছে যে আর বেশিক্ষণ তার পক্ষে ওকে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। দাঁতে দাঁত চেপে লোকটাকে বলল, ‘একটা গার্ডারের ওপর পা তোলার চেষ্টা করো।’ ঝুলন্ত লোকটা বৃথাই শূন্যে পা ছুঁড়ল কয়েকবার। আর পারছে না রূপা। ‘সারাদিন ধরে রাখতে পারব না আমি—একটা কিছু করো।’ অস্থির হয়ে উঠেছে রূপা। জড়িয়ে ধরা স্ট্রাটটা মনে হচ্ছে কেটে বসে যাচ্ছে পেশীর মধ্যে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। প্রচণ্ড চাপে ধীরে ধীরে স্ট্রাট থেকে ফসকে যাচ্ছে তার আঙুল। বীমের ওপর রূপার দেহটা ধনুকের মত বাঁকা হয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে আসছে। আর সহ্য করতে পারছে না। মুখ থেকে একটা অস্ফুট আর্তস্বর বেরিয়ে এল তার।

তারপর সব শেষ। সমস্ত উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিমেষে মিলিয়ে গেল। নিচ থেকে টিচ্ জাপটে ধরেছে ঝুলন্ত লোকটাকে। প্রায় ফস্কে গেছিল স্ট্রাট থেকে রূপার হাত—চট করে নিজেকে সামলে নিল সে। বিশালকায় টিচ্ অনায়াসে লোকটাকে শূন্যে তুলে রূপার পাশে বসিয়ে দিল।

‘কি খবর তোমার?’ উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করল রূপা।

বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে একদৃষ্টে নিচের দিকে চেয়ে আছে সে। একটু পরে বলল, ‘অজস্র ধন্যবাদ তোমাকে—বিরাট একটা ফাঁড়া কেটেছে।’

একটা চাঁটি কষাল টিচ্ ওর মাথায়। খেপে গেছে সে। কুত্তার বাচ্চা—ফাঁড়া কেটেছে? আমি হলে ঠিকই ছেড়ে দিতাম তোকে, মরণই তোর উপযুক্ত শাস্তি।’ কানটা জোরে মুচড়ে দিয়ে আবার বলল, ‘যা ভাগ্‌—চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। এরপরে আবার আমার সামনে পড়লে লাথি মেরেই তোকে নিচে ফেলব!’

টাওয়ারের তলায় রানা, লেপং আর ব্যারি কাজ করছে। লারোজ ট্রাকগুলোকে সরিয়ে বৃত্তাকারে রেখেছে ওরা রেড ইন্ডিয়ানদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্যে ওয়াগনগুলো যেভাবে সাজানো হত, অনেকটা তেমনি ভাবে। প্রত্যেক ট্রাক থেকে মোটা তারের স্থূল খুলতে খুলতে ওরা আন্ডার গ্রাউন্ড চেম্বার পর্যন্ত নিয়ে গেল। টাওয়ারের প্রধান ইলেকট্রিক পাওয়ার লাইনের সাথে একটা একটা করে তার জুড়ে দিল লেপং। অতি সাবধানে।

এখন যদি ওরা টাওয়ারের ইলেকট্রিক সাপ্লাই বন্ধও করে দেয় কিছু ক্ষতি হবে না। জেনারেটর ট্রাকগুলো থেকে শুধু ল্যাপ লেজার নয়, গোটা টাওয়ার শক্তির জোগান পাবে। কপালের ঘাম মুছল লেপং। কাজ করতে করতে প্রচুর ঘেমেছে সে। বিয়ারের ট্যাঙ্কে চোখ পড়তেই ওদিকে এগিয়ে গেল। হাতল ঘোরাতেই হিস্ করে শব্দ উঠল। কমপ্রেসড এয়ার!

‘বাহ্, প্রচুর গ্যাস আছে তো তোমাদের বিয়ারে, ব্যারি?’ হাসিমুখে মন্তব্য করল লেপং। শব্দে ঘুরে তাকিয়েছিল ব্যারি। ধমকে উঠল, ‘ওগুলো ধোরো না—বিয়ার চাও, ওপরে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাও।

বিশেষ মনোযোগ দিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ কলল রানা। বিয়ার ট্যাঙ্কে অক্সিজেন! মতলবটা কি কবির চৌধুরীর?

.

ইনটিরিয়ার মিনিস্ট্রিতে কাজ অনেক নিয়ন্ত্রিত ভাবে চলেছে এখন। ফালতু কথা বলে আর সময় নষ্ট করছে না কেউ। সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞ আর কয়েকজন পদার্থ বিজ্ঞানীকে ডাকা হয়েছে; লেজার গানের বিরুদ্ধে কি কি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে জোর গবেষণা চলছে। সবার মাথাতেই এখন ওই এক চিন্তা—লেজার গানকে ঠেকাতে হবে।

‘লাইট বীম দিয়ে কাজ করে ল্যাপ লেজার—এক কাজ করলে হয় না, আয়না ব্যবহার করে রে-টাকে আমরা ওদের বিরুদ্ধেই তো ব্যবহার করতে পারি?’ উপস্থিত পদার্থ বিজ্ঞানীদের মধ্যে

একজন প্রস্তাব দিল। একটু আশার আলো যেন দেখা যাচ্ছে।

ভুরু কুঁচকে একটু ভেবে নিয়ে মেজর জেনারেল বললেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে প্রস্তাবটা ভাল মনে হলেও বাস্তবে পরিণত করায় কতগুলো অসুবিধে আছে।’

‘কেন কি অসুবিধে?’ জানতে চাইল প্রস্তাব দাতা।

পদার্থ বিজ্ঞানী হিসেবে আপনার নিশ্চয়ই অজানা নেই যে

আয়নার ওপর পুরোপুরি লম্বভাবে কোন রশ্মি পড়লেই কেবল আলোটা যে পথে এসেছিল ঠিক সেই পথে ফেরত যাবে—অর্থাৎ‍ লেজার গানে গিয়ে হিট করবে। কিন্তু আয়নাটা যদি থিটা ডিগ্রী এদিক ওদিক হয় তাহলে কি ঘটবে?’ প্রশ্ন করলেন রাহাত খান।

সাথে সাথেই জবাব এল, ‘তাহলে দুই থিটা ডিগ্রী সরে যাবে আলোটা।’

‘ঠিক তাই,’ সমর্থন করলেন মেজর জেনারেল। ‘আমাদের পক্ষে ঠিক নব্বই ডিগ্রী কোণ বজায় রেখে ল্যাপ লেজারের আওতায় আয়না নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়—তাই রিফ্লেকটেড বীম অ্যাপ্রোচিং অ্যাঙ্গেল অনুযায়ী টাওয়ারের যে কোন জায়গায় গিয়ে লাগতে পারে।’

একজন টেলিভিশন অন করে দিয়ে বলল, ‘আমাদের নতুন টিভি স্টারের আবার পর্দায় আসার সময় হয়ে এল।

ঘড়ি দেখল সোহানা—আর একমিনিট বাকি। সবার চোখ টেলিভিশনের ওপর। সরকারী নির্দেশাবলীর ঘোষণা শেষ হওয়ার সুযোগ দিল কবির চৌধুরী। ঘোষকের মুখটা মিলিয়ে যেতেই দেখা গেল তার মুখ।

‘এখন সকাল দশটা,’ গম্ভীর মুখে শুরু করল সে। ‘আজ রাত দশটা পর্যন্ত আমি সময় দিচ্ছি তোমাদের। এই সময়ের মধ্যে আমার দাবি মত সব টাকা আমি চাই। ফরাসী সরকারের তিরিশ মিলিয়ন আমি চাই ক্যাশ ডলারে এই টাওয়ারে রাত দশটার মধ্যে। আর মার্কিন সরকারের বিশ বিলিয়ন আমি আজকের মধ্যেই সুইস ব্যাঙ্কে, K—523, এই অ্যাকাউন্টে জমা চাই। আমি টেলিফোনে খবর নিয়ে জানব জমা হয়েছে কি হয়নি। ঠিক রাত দশটায় আমি আমার সঙ্গীদের নিয়ে টাওয়ার ছেড়ে চলে যাব। ল্যাপ লেজারগুলো আমাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে। আমরা টাওয়ার ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই চারটে বিস্ফোরণ ঘটবে এক সাথে। মাটির সাথে মিশে যাবে আইফেল টাওয়ার।

‘আমি নিশ্চিত যে তোমরা কেউ চাও না এমনটা ঘটুক। মার্কিন সরকার যদি আমার দাবি মেটাতে অক্ষম হয় তাহলে, বিস্ফোরণের সময় মিসেস জোনস টাওয়ারেই থাকবেন। আমার বিশ্বাস মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্যে খবরটা খুব প্রীতিকর হবে না, জনসাধারণও এটাকে তাদের জাতীয় অমর্যাদা হিসেবে গণ্য করবে।’

কিছুক্ষণ নীরব থেকে ঘটনার ভয়াবহতা দর্শকদের পুরোপুরি উপলব্ধি করার সুযোগ দিল কবির চৌধুরী।

এবারে ট্রাম্প কার্ডটা খেলল সে। ‘লিনডা জোনসের মুখেই শোনা যাক তাঁর বক্তব্য।’ ধীরে ধীরে ক্যামেরাটা বাঁ দিকে ঘুরে কবির চৌধুরীর পাশে বসা মিসেস জোনসের উপর স্থির হলো।

‘তুমি কি মনে করো আমি নিজের জীবন ভিক্ষা চেয়ে তোমার অন্যায় দাবি মেনে নিতে বলব ওদের? কক্ষনো না!’

‘আপনি কি বলেন না বলেন তাতে আমার মোটেও কিছু আসে যায় না।’ এই বলে ক্যামেরার ভিউ থেকে হেঁটে বেরিয়ে গেল কবির চৌধুরী। ‘যা খুশি বলুন।’

ক্যামেরার দিকে মুখ ঘোরালেন লিনডা জোনস।

‘আইফেল টাওয়ারের মুক্তিপণ যদি কেউ দিতে চায় তবে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আমি অনুরোধ করছি, আমার এখানে উপস্থিতি যেন গ্রাহ্যের মধ্যে না আনা হয়। আইফেল টাওয়ারের মত আমিও পৃথিবীর বুকে অনেকদিন ধরে আছি। হয়তো আমাদের দুজনেরই প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে।

‘আমাকে আইফেল টাওয়ারের সাথে নিলামে চড়তে হবে এই অর্ধ উন্মাদ দাম্ভিক বদমায়েশটার জন্যে—এটা এই বুড়ো বয়সে আমার জন্যে যেমন লজ্জাকর তেমনি জঘন্য। ওর কথা মেনো না তোমরা—ওকে ধ্বংস করো। তোমাদের সাথে একই আলো বাতাস উপভোগ করে বেঁচে থাকার কোন অধিকারই নেই ওর মত লোকের। তোমাদের কষ্টার্জিত টাকা যদি দিতেই হয় তবে ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন্স রিলীফ ফান্ডে দিয়ো। ওদের সাহায্যের প্রয়োজন আছে—কবির চৌধুরীর নেই।’

উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেছে মার্কিন অ্যামব্যাসাডর—এরিক সমারস্। বুকটা তার ফুলে উঠেছে গর্বে। এই না হলে প্রেসিডেন্টের মা!

ক্যামেরা সরে দ্রুত ফিরে গেল কবির চৌধুরীর উপর। রাগে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার। ‘এই বেপরোয়া বোকা বুড়িটা যাই বলুক না কেন—মনে রেখো, তোমাদের সময় সীমা মাত্র বারো ঘণ্টা। গুড বাই।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন