জিম্মি – ১৩

কাজী আনোয়ার হোসেন

তেরো

খুঁজে পেয়েছে রূপা। দুই আঙুলের নখে খুব সাবধানে ধীরে ধীরে এক এক মিলিমিটার করে ডেটোনেটরটা বার করে আনল সে। বিচ্ছিরি একটা শব্দ তুলে ওটা বিচ্ছিন্ন হলো আঠাল প্লাস্টিক চার্জ থেকে। হাত থেকে ছেড়ে দিতেই নিচের দিকে রওনা হলো ওটা। সশব্দে শ্বাস ছাড়ল রূপা। অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করল, ‘একটা গেল, আরও বাকি তিনটা!’

লাল বাক্সের ঘড়ি এগিয়ে চলেছে ৩.৫২…৩.৫১…৩.৫০…৩.৪৯…

দড়ি বেয়ে নেমে এল রূপা। দ্বিতীয় চার্জটার সামনে স্ট্রাটের ওপর দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। তার ঠিক মুখের সামনেই রয়েছে ওটা। ভেতর থেকে কে যেন বার বার বলছে, তাড়াতাড়ি কাজ সারো! এখনও কয়েকটা বাকি!

কিন্তু ও ভাবছে, আর সময় নেই। বিরাট টাওয়ারটা যখন ভেঙে দুমড়ে টুকরো টুকরো হয়ে নিচে পড়বে—তখনও টাওয়ারেই থাকবে রূপা।

টাওয়ারের কাঠামো বেয়ে উঠছে রানা। একবার টর্চ জ্বাল রূপাকে খুঁজে বার করার জন্যে—দেখল রূপা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা বোমার মধ্যে। কোন শব্দ করল না রানা। তাতে চমকে যেতে পারে রূপা, হারাতে পারে দেহের ভারসাম্য!

ততক্ষণে ডেটোনেটরটা বের করে এনেছে রূপা। দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে কপালের ঘাম মুছে নিল সে কমব্যাট জ্যাকেটের হাতায়।

‘রূপা, আর ক’টা বাকি?’ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা।

রানাকে দেখে খুশি হয়ে উঠল রূপা, ‘আরও দুটো।’

অর্থাৎ টাওয়ারটাকে বাঁচাবার জন্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালাবে সে! অধীর হয়ে উঠেছে রানা, ওপরে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রূপারও জীবন-মরণ নির্ভর করছে এর ওপর।

ঘড়ি টিক টিক করে চলেছে ২.৪৮…২.৪৭…২.৪৬…

নিচে চারদিক থেকে আর্ক ল্যাম্পের আলো ফেলা হয়েছে টাওয়ারটার ওপর

‘আর কতক্ষণ সময় আছে?’ জেনারেল ব্রুনো জিজ্ঞেস করল মশিয়ে পম্পেদুকে। দুজনেরই চোখে বিনকিউলার, টাওয়ারের দিকে দৃষ্টি।

‘আমরা ঠিক জানি না কখন চার্জগুলোকে সক্রিয় করা হয়েছে। কবির চৌধুরীর দশ মিনিটের আর মিনিট তিনেক বাকি।’ খুব উৎকণ্ঠার সাথে দুজনেই রূপা ও রানার প্রতিটি কার্যকলাপ লক্ষ করছে।

‘মেজর জেনারেল যা করছেন বুঝেশুনে করছেন, এই কামনাই করি।’ মন্তব্য করল জেনারেল ব্রুনো। ‘আচ্ছা, যারা ধরা পড়েছে তাদের মধ্যে কবির চৌধুরীকে পাওয়া গেছে?’

‘না।’ ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন মশিয়ে পম্পেদু, ‘তবে আমার বিশ্বাস মেজর জেনারেল রাহাত খান যা করছেন বুঝেশুনেই করছেন।’

২.০০…১.৫৯….গুনে চলেছে ঘড়িটা।

ঘোরানো সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে রানা তার নিজের ব্যবহার করা সেই দড়িটা ধরার চেষ্টা করছে। বাতাসে দুলছে সেটা, তবু শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল ও দড়ি লক্ষ্য করে। কপাল ভাল, বাতাসের ঝাপটায় একেবারে হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিল দড়িটা। সময় ফুরিয়ে আসছে, অনিবার্য হয়ে উঠছে ঝুঁকি নেয়া। দড়ি বেয়ে কিছুটা ওপরে উঠে দোল খেয়ে তৃতীয় চার্জের খুঁটির কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করছে রানা। পায়ের কাছে একটা গার্ডার দেখে ঠেলে দোলার বেগ বাড়িয়ে দিল সে। বিপজ্জনক গতিতে ছুটে যাচ্ছে পুবের খুঁটিটার দিকে। এক হাত দিয়েই ধরতে হলো একটা গার্ডার। কিন্তু শিশিরে ভিজে আছে ওটা—হাত পিছলে গেল। ফিরতি পথে আরেকটা গার্ডারের সঙ্গে ধাক্কা খেল। আবার পা দিয়ে গার্ডারে ধাক্কা দিয়ে পুব দিকের খুঁটিতে পৌঁছার চেষ্টা করল সে। এবার হাত ফসকাল না আর। ধরে ফেলেছে রানা একটা গার্ডার শক্ত হাতে। দড়িটা দুই হাঁটুর মাঝে ধরে বোমাটার দিকে মনোযোগ দিল। কয়েকটা সেকেন্ড কাটল রুদ্ধশ্বাসে। তারপর ডেটোনেটরটা বের করে এনেই ফেলে দিল সেটা নিচে।

উত্তর খুঁটির বোমাটা রয়ে গেছে এখনও। রূপা আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওখানে পৌঁছতে। দড়িতে ঝুলে পেন্ডুলামের মত দোল খাচ্ছে সে।

খেপে যাওয়া কোন অ্যাক্রোব্যাটের মতই এখন রানা বীম বেয়ে উপরে উঠছে সড়-সড় করে। মিসেস জোনসকে পিঠে নিয়ে নিচে নামার সময়ও এত ঝুঁকি ও নেয়নি। একটা আই বীমের ওপর দিয়ে দৌড়ে ছুটে গেল রানা উত্তরের খুঁটিটার দিকে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ভয়ের অনুভূতি আর কাজ করছে না রানার মধ্যে।

সেকেন্ড গুনে চলেছে ঘড়ি ০.২৩.০.২২…০.২১…

ভয় ডর হারিয়েছে রূপাও—উল্টো দিক থেকে সে-ও দৌড়ে ছুটে আসছে উত্তর খুঁটিটার দিকে। দুজনেই এক সাথে হাত বাড়াল —খালি গার্ডারটা খামচাচ্ছে ওরা!

‘চার্জটা গেল কই?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘মনে হয় ওপরেরটাতে রয়েছে!’ জবাব দিল রূপা। কান্নার মত শোনাল ওর গলাটা।

তরতর করে উঠে গেল রানা। রূপাও উঠছে।

ঘড়িতে চার সেকেন্ড মাত্র বাকি।

কোনকিছু ভাবারও সময় নেই এখন।

দুই সেকেন্ড!

প্লাস্টিক চার্জে আঙুল ঢোকাল রানা। ডেটোনেটরটা বের করেই ছুঁড়ে মারল নিচের দিকে!

এক সেকেন্ড… জিরো… ডেটোনেশন!

কয়েক ফুট নিচে শূন্যেই শব্দ করে ফুটল ডেটোনেটরটা। আগে ফেলে দেয়া ডেটোনেটর তিনটেও ফুটল একই সাথে।

কপালের ঘাম মুছল রানা। যুক্তি, ভয় সবই ফিরে পেয়েছে সে এখন। বুঝল কত অল্পের ওপর দিয়ে বেঁচে গেছে ওরা। যে কোন জিনিস ওপর থেকে ছেড়ে দিলে প্রথম সেকেন্ডে পড়ে বত্রিশ ফুট—আর ওটা ফুটেছে মাত্র ছয় ফুট নেমেই! অর্থাৎ আর এক সেকেন্ড দেরি হলেই রূপা সহ সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত বিস্ফোরণের ধাক্কায়।

কিন্তু আর ভয় নেই—এখন সে, রূপা আর আইফেল টাওয়ার, সবাই বিপদ মুক্ত।

.

সীন নদীর ধারে প্রশস্ত পানির পাইপের মুখ খুলে গেল। তিনটে বিরাট কোলবালিশের মত ব্যাগ ভেসে উঠল নদীতে। প্ৰায় সাথে সাথেই একটা মাথা ভেসে উঠল সেগুলোর পাশে।

চারদিক একবার ভাল করে দেখে নিয়ে সাঁতার কেটে ব্যাগগুলোর দিকে এগোল কবির চৌধুরী। ওগুলো সংগ্রহ করে বিউ মুচের পাড়ে নোঙর করা ব্যাটিউ মুচে নামের বোটটার দিকে সাঁতরে গেল।

মিনিট তিনেক পরে আর একটা মাথা ভেসে উঠল একই জায়গায়। সে-ও সতর্কভাবে তাকাল চারদিকে—দেখল দড়িতে বেঁধে ব্যাগ তিনটে একটা বোটে তুলছে কবির চৌধুরী। নিঃশব্দে রওনা হলো সে ওই বোটের দিকে। ক্রলিং করলে বেশি শব্দ হবে বলে বুক সাঁতার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ডেভিড।

ব্যাগগুলো বোটের পিছনদিকের কেবিনে রেখে সামনে গিয়ে নোঙরের দড়ি খুলে দিল কবির চৌধুরী। পিছন দিককার দড়ি খুলতে এসে সাঁতরে এগিয়ে আসা লোকটার ওপর নজর পড়ল তার। চশমা ঠিকঠাক করে ভাল করে লক্ষ করল সে। ডেভিডকে চিনতে কোন ভুল হলো না। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল তার। বোটের ইঞ্জিন স্টার্ট দিল সে—বোতাম টিপতেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন।

গিয়ারের লিভার টেনে রিভার্স করে দিল কবির চৌধুরী। তারপরেই দিল ফুল থ্রটল। দ্রুত বোটটা পিছিয়ে আসছে ডেভিডের দিকে।

ছিন্ন ঝুলন্ত স্ট্র্যাপ সহ গিয়ার ব্যারেলটা ভেসে যেতে দেখে কবির চৌধুরীর মৃদু হাসি ধীরে ধীরে বিকশিত হলো পরিপূর্ণ দেঁতো হাসিতে।

আবার পাইলট কেবিনে ঢুকে গিয়ার লিভার পালটে সামনে এগোবার ব্যবস্থা করল কবির চৌধুরী। সীনের বুকে চলাচলকারী বোটগুলোর সঙ্গে এটার একটাই মাত্র তফাৎ—অন্যগুলোর মত এটা আলোয় ঝলমল করছে না। খুব সামান্য আলো জ্বলছে এই বোটে। চট করে কাপড় বদলে নিল কবির চৌধুরী। টাওয়ার থেকেই নিয়ে এসেছিল নতুন ছদ্মবেশের উপকরণ।

উজানের দিকে ছুটে চলেছে এখন কবির চৌধুরীর বোট।

.

বোটটা সোজা তার দিকে ছুটে আসতে দেখেই স্ট্র্যাপ খুলে ডুব দিয়েছিল ডেভিড। তার মাথার এক হাত ওপর দিয়ে চলে গেল বোটের ঘুরন্ত চাকা—ছিন্নভিন্ন করে দিল বিয়ার ব্যারেলের স্ট্র্যাপ। বোটের পাশে ঝোলানো সারিবদ্ধ বড় বড় রবারের টায়ারের একটা ধরে বোটের গায়ে সেঁটে থাকল সে।

একবার উঁকি মেরে দেখল, পোশাক পাল্টাচ্ছে কবির চৌধুরী। অর্থাৎ তার ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়েছে, ডেভিড এখন ছিন্নভিন্ন একটা লাশ।

সুযোগমত রেলিং টপকে বোটের ডেকে নামল ডেভিড। তারপর সোজা এগিয়ে গেল হুইল হাউসের দিকে। কাঁচের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কবির চৌধুরীকে। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সে। ডেভিডের আগমন ধরা পড়ে গেছে তার চোখে লাগানো ওই অদ্ভুত যন্ত্রটায়। উবু হয়ে কাঠের পায়ের ভিতর গোপন কুঠরি থেকে বের করল একটা লম্বা ফলার ধারাল ছুরি।

বাতির আলোয় ফলাটা ঝিলিক দিয়ে উঠল একবার। পিছিয়ে গেল ডেভিড। মুহূর্তের মধ্যে দরজা ঠেলে ডেকে বেরিয়ে এল কবির চৌধুরী।

অতি সাবধানে গোল হয়ে ঘুরছে ওরা। ডেভিডের ওপর সতর্ক নজর রেখেছে কবির চৌধুরী। মোটেও অবাক হয়নি সে ডেভিডকে দেখে। টাওয়ারটা এখনও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তাতেও বিস্ময় বা দুঃখ নেই কবির চৌধুরীর। টাওয়ারের মুক্তিপণ সে পেয়ে গেছে। ও জানে, তার সহকর্মীদের মধ্যে একজনই শুধু পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে পালাবার যোগ্যতা রাখে, সে হচ্ছে ডেভিড ফ্রস্ট।

ঘটনাচক্রে তাই হয়েছে। তবে ডেভিডের কাছে কোন অস্ত্র নেই বুঝে আশ্বস্ত হলো কবির চৌধুরী। অভিজ্ঞ ছুরিবাজদের মতই নেচে নেচে ঘুরছে সে। ছুরিটা হাতের মুঠোয় ওপরের দিকে মুখ করে ধরা। প্রত্যেকটা চাল তার মাপা—নির্ভুল।

কিন্তু ডেভিডও সি আই এর ট্রেনিং পাওয়া এজেন্ট—যে কোন রকম নিরস্ত্র দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে ট্রেনিং শেষ করেছে সে। পরে নিজেও হয়েছিল ট্রেনার। ছুরির বিরুদ্ধে খালি হাতে লড়া তার কাছে নতুন কিছু নয়। খুব ভাল করেই জানে সে চুরিবাজের সুবিধে আর অসুবিধেগুলো কোথায়। দুর্বলতার সুযোগ নেয়ার অনেক রকম কায়দাই তার রপ্ত করা আছে—আর সুবিধেগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে তারই বিরুদ্ধে ব্যবহার করার কৌশলও জানে সে।

আপ্রত্যয়ের সাথে এগিয়ে গেল সে কবির চৌধুরীর দিকে। যেন ভয় পেয়েছে এমন ভাব দেখিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল কবির চৌধুরী। পরক্ষণেই ‘িপ্রঙের মত ঝটকা দিয়ে এগিয়ে গেল তার হাত, ডেভিডের হৃৎপিণ্ড বরাবর বিদ্যুৎবেগে ছুরি চালিয়েছে সে।

ডেভিডের পুরো চালটাই ছিল প্রতিপক্ষকে লাফিয়ে আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ করা। বুলফাইটারের মত ঝট করে ডান দিকে সরে গেল সে—সঙ্গে সঙ্গে ডান পায়ের একটা জোর লাথি চালাল কবির চৌধুরীর পা লক্ষ্য করে।

জায়গা মতই পড়ল লাথিটা—ঠিক হাঁটুর একটু নিচে পিছন দিকে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠার আগেই আর একটা লাথি পড়ল দুই ঊরুর মাঝখানে। ওটা আরও দুই ইঞ্চি বাঁয়ে লাগলে মুহূর্তে ‘মিস্টার’ থেকে ‘মিস’-এ পরিণত হত কবির চৌধুরী।

উবু অবস্থায় থাকতেই ডেভিড এগিয়ে গেল আবার—ভীষণ বেগে তার হাঁটু গিয়ে লাগল কবির চৌধুরীর চিবুকের ওপর।

দুটো দাঁত আলগা হয়ে গেল নিচের পাটি থেকে। চোখে এখন শর্ষেফুল দেখছে কবির চৌধুরী। ছুরি ধরা হাতের কব্জি ধরে ফেলল ডেভিড বাঁ হাতে। তারপর হাতে মোচড় দিল কষে।

ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেল কবির চৌধুরীর মুখ—শব্দ করে ডেকের ওপর পড়ল ছুরিটা। যেন ডেভিডের হাতে চলে যাওয়ার জন্যেই। জোর এক ধাক্কা দিল সে কবির চৌধুরীকে।

হেলিকপ্টারের শব্দটা ধীরে ধীরে জোরাল হচ্ছে। আশার আলো দেখতে পাচ্ছে কবির চৌধুরী। নির্দিষ্ট সময়েই এসে গেছে পাইলট। ছুরি তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেভিড।

‘কি চাও তুমি? টাকা? মুক্তিপণের টাকা থেকে একটা বখরা চাও—এই তো?’ বলে উঠল কবির চৌধুরী। টাকা দিয়ে হলেও বাঁচতে চায় সে।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ডেভিড। ‘না, টাকায় আমার লোভ নেই, কবির চৌধুরী।’

‘তাহলে আমার কাছে কি চাও তুমি?’

অনেকক্ষণ কঠিন ভাবে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ডেভিড কবির চৌধুরীর চোখের দিকে। হেলিকপ্টারটা এখন মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে।

‘প্রতিশোধ!’ বলল ডেভিড। চার বছর আগে লিবিয়ায় তুমি একটা সন্ত্রাসবাদী দলের কাছে রাশিয়ান অস্ত্র বিক্রি করেছিলে—মনে পড়ে?’ জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

মাথা ঝাঁকাল কবির চৌধুরী। চোয়ালে হাত বুলাচ্ছে সে।

‘একজন সি.আই.এ এজেন্ট তোমার পিছু নিয়েছিল—তুমি তার গাড়িতে বোমা লুকিয়ে রেখেছিলে—মনে পড়ে?’ উত্তেজনায় এক ধাপ চড়ে গেছে ডেভিডের গলা।

কাঁধ একটু ওপরে তুলে ঠোঁট উল্টে জবাব দিল কবির চৌধুরী, ‘এই খেলায় অনেক অপ্রিয় কাজই করতে হয়।

‘অপ্রিয়? হ্যাঁ, অবশ্যই অপ্রিয়। বিশেষ করে আমার জন্যে। কারণ সি. আই.এর সেই এজেন্ট মারা পড়েনি ওই বিস্ফোরণে—মারা পড়েছিল তার স্ত্রী, তাদের প্রথম বাচ্চা পেটে নিয়ে।’

ডেভিডের উদ্ভ্রান্ত চোখের দিকে চেয়ে কবির চৌধুরীর মুখ থেকে অবজ্ঞার ভাবটা মিলিয়ে গেল। একটা ঢোক গিলে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার স্ত্রী?’

মাথা ঝাঁকাল ডেভিড। ক্রুদ্ধ এক ঘৃণায় চোখ দুটো ছোট হয়ে গেছে তার। ‘সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত দিনরাত আমি তোমার পিছনে ঘুরছি, কবির চৌধুরী। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে।’ ধীরে ধীরে এগোল ডেভিড কবির চৌধুরীর দিকে।

ঠিক এই সময়ে হেলিকপ্টারের উজ্জ্বল আলো এসে পড়ল ডেকের উপর। উপরের দিকে চেয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ডেভিডের। সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করল কবির চৌধুরী। বিদ্যুৎ বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে হুইল হাউসের পাশে পড়ে থাকা লোহার রডটা তুলে নিল। ডেভিড ছুরি হাতে ঘুরে দাঁড়াতেই প্রচণ্ড বেগে ছুঁড়ে মারল ডাণ্ডাটা ডেভিডের দিকে। সোজা গিয়ে লাগল ওটা মাথার পাশে। টলতে টলতে কয়েক পা পিছিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে—ছুরিটা ছিটকে পড়েছে নদীতে। এগিয়ে এসে লোহার ডাণ্ডাটা আবার তুলে নিল কবির চৌধুরী। দুহাতে ডাণ্ডাটা তুলে নিয়ে মারতে উদ্যত হলো সে—এখনই ছাতু করে দেবে ডেভিডের মাথা। তার আগেই হেলিকপ্টার থেকে একটা দড়ির সিঁড়ি ঝপ করে পড়ল কবির চৌধুরীর ওপর। দড়ির জালে ফেঁসে গেল রড—শেষ বাড়িটা আর মারা হলো না। হেলিকপ্টারের পাইলট মুখ বের করে হাতের ইশারায় তাড়াতাড়ি করতে বলল কবির চৌধুরীকে।

ব্যাগ তিনটে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল কবির চৌধুরী। হেলিকপ্টারটা উঠে গেল অনেক উপরে।

‘আরও জলদি ওঠাও!’ চিৎকার করে বলল কবির চৌধুরী। বেশ উপর দিয়ে চলছে এখন হেলিকপ্টার। সিঁড়ি বেয়ে দরজার কাছাকাছি চলে এসেছে সে। একটা হাত বেরিয়ে এল—শক্ত করে কবির চৌধুরীকে ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে গেল হাতটা।

‘স্বাগতম, আপনার জন্যেই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছি আমরা।’ প্যারিসের পুলিস কমিশনার রীতিমত বাউ করে সম্ভাষণ জানাল।

বিমূঢ় কবির চৌধুরীর চোখ ঘুরে ফিরে বার বার দেখছে মেজর জেনারেল রাহাত খান, রানা আর পুলিস কমিশনারকে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে।

কমিশনারের সঙ্গী দুজন পুলিস তখন হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে কবির চৌধুরীর হাতে।

হোটেল রিজ—রূম ৮১২, মেজর জেনারেল রাহাত খানের স্যুইট। একটা সোফায় বসে আছেন মেজর জেনারেল। খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে তাঁকে আজ। তাঁর চার পাশে ঘিরে বসেছে রানা, রূপা, সোহানা, আলবার্তো ভেরিনো, পুলিস কমিশনার আর ডেভিড।

আলোচনার বিষয়—ডেভিড। তার ব্যাপারে অনেক কিছুই অস্পষ্ট রয়ে গেছে সবার কাছে।

কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আরম্ভ করলেন রাহাত খান, ‘ডেভিড, তোমার কাছ থেকে কিছু কৈফিয়তের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তুমি কবির চৌধুরীর হয়ে কাজ করতে করতে হঠাৎ দল বদল করলে কেন?’

সবাই উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে ডেভিডের উত্তরের অপেক্ষায়।

একটু অপ্রস্তুত ভাবেই ডেভিড জবাব দিল, ‘না, দল বদল তো করিনি—সব সময়েই আমি কবির চৌধুরীর বিপক্ষে ছিলাম।’

‘তবে কবির চৌধুরীর জন্যে জেনারেল বুমারের ছদ্মবেশে ল্যাপ লেজার গানগুলো কে চুরি করেছিল?’ প্রায় ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন মেজর জেনারেল।

‘আমিই করেছিলাম,’ জবাব দিল ডেভিড, ‘কিন্তু, সেটা আমাকে করতে হয়েছিল তার বিশ্বাস অর্জনের জন্যে, তার দলে ঢোকার জন্যে।’

‘এটা তোমার স্বপক্ষে কোন জোরাল যুক্তি হলো না, ডেভিড। কারও দলে ঢোকার বা তার বিশ্বাস অর্জন করবার জন্যে অন্যায় করলেও সেটা অন্যায়ই—তার জন্যে মানুষকে শাস্তি পেতে হয়। ডেভিডের জবাবে সন্তুষ্ট নন রাহাত খান।

‘একটা জোরাল যুক্তি আছে আমার। মিস সুজানা মনরো—মানে মিস রূপাকে আমি প্রথম দেখায় চেনার পরও তাকে কবির চৌধুরীর কাছে ধরিয়ে দিইনি—এটাই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয় যে আমি আপনাদের হয়ে তার বিরুদ্ধে কাজ করছিলাম?’ জবাব দিল ডেভিড।

চোখ তুলে তাকালেন রাহাত খান রূপার দিকে। ‘হ্যাঁ, ডেভিড ঠিক বলছে। প্রথম দেখাতেই আমরা পরস্পরকে চিনেছিলাম—কিন্তু আমার পরিচয় ফাঁস করেনি ডেভিড,’ বলল রূপা।

‘আমি এখনও ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না।’ এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লেন মেজর জেনারেল। ‘তুমি বলতে চাইছ, বেগতিক দেখে দল পাল্টাওনি, তুমি বরাবরই আমাদের দলে ছিলে, আমাদের অজান্তে আমাদের হয়ে কাজ করছিলে তুমি; তোমার কাজকর্মেও তাই দেখা যাচ্ছে, রূপাকে চিনতে পেরেও চেপে গেছ, তাড়া করে গিয়ে ধরার চেষ্টা করেছ কবির চৌধুরীকে। একটু ব্যাখ্যা করে বলবে, এত সব করেছ তুমি কিজন্যে?’

খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল ডেভিড। তারপর বলল, ‘প্রতিশোধ।’

‘প্রতিশোধ?’

‘হ্যাঁ। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর প্রতিশোধ।’

ঘরের মধ্যে সবাই চুপ। অদ্ভুত এক স্তব্ধতা নেমে এসেছে। নীরবতা ভঙ্গ করলেন রাহাত খান, ‘তুমি কবির চৌধুরীর দলে ভিড়লে কি করে?’

‘আলবার্তো ভেরিনোর মাধ্যমে,’ জবাব দিল ডেভিড।

কাঁচা পাকা ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল রাহাত খানের। কই, ঘুণাক্ষরেও তো এ-কথাটা তাঁকে জানায়নি সে?

‘কি ব্যাপার, আলবার্তো? ডেভিড যা বলছে, ঠিক?’

ম্লান মুখে মাথা ঝাঁকাল আলবার্তো।

‘আমাকে জানাওনি কেন?’ জবাবদিহি চান রাহাত খান।

‘জানাইনি তার কারণ, আমি চেয়েছিলাম এক পক্ষ বিফল হলেও যেন অন্য পক্ষ কাজ উদ্ধার করে বেরিয়ে আসতে পারে।’

‘কবির চৌধুরীকে শায়েস্তা করাটা তোমার জন্যে এতই দরকার?’ জানতে চাইলেন রাহাত খান। ‘তোমারও কোন ব্যক্তিগত আক্রোশ রয়েছে বুঝি ওর বিরুদ্ধে?

কোলের ওপর রাখা হাত দুটো গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করছে আলবার্তো ভেরিনো।

‘ডেভিড তার স্ত্রীর নামটা বলেনি, তাই না? ওর নাম ছিল মারিয়া ভেরিনো—আমার একমাত্র মেয়ে।’

নীরবে মাথা ঝাঁকালেন মেজর জেনারেল, তারপর জানতে চাইলেন, ‘তা এখন কি করবে বলে ঠিক করেছ, ডেভিড?’

‘ঠিক করিনি কিছুই।’ বিষণ্ণ সুরে জবাব দিল ডেভিড।

‘সি. আই. এ তে তোমার ফিরে যাওয়ার উপায় নেই—তুমি ইউনাকোতে জয়েন করো না কেন? তোমার মত লোকের দরকার আছে আমাদের।’

‘ইউনাকো যদি আমাকে উপযুক্ত মনে করে তাহলে নিজেকে আমি ধন্য মনে করব।’ ডেভিডের চোখেমুখে ফুটে উঠল কৃতজ্ঞতা।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। রানা, রূপা আর সোহানা আগে থেকেই তাদের প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছে। বাইরে এসে ডেভিডকে প্রস্তাব দিল রানা, ‘চলো আজ রাতে আমরা চারজন সেলিব্রেট করব।’

‘তোমার রান্না করা মাইসনার মেশিন পিস্তল আর থমসন মেশিনগানের সুয়ে যদি খেতে না হয়, তা হলে রাজি আছি আমি।’ হাসতে হাসতে বলল ডেভিড।

‘না আজকে তোমাদের সবাইকে খাঁটি সুয়ে অউ ক্রিভেট দিমোল খাওয়াব, শ্যাম্পেনের সাথে।’ জবাব দিল রানা।

হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল ওরা। পার্কিং লটের দিকে এগোচ্ছে সবাই, এমন সময় রানার হাতটা টেনে ধরল সোহানা, ‘ওই দেখো…’

দূরে আঙুল দেখাল সে।

একসঙ্গে সেদিকেই তাকাল রানা, রূপা আর ডেভিড।

অটল গাম্ভীর্য নিয়ে আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে আইফেল টাওয়ার। যেন কিছুই হয়নি।

মৃদু হাসি ফুটে উঠল সবার ঠোঁটে।

***  

অধ্যায় ১৩ / ১৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন