জিম্মি – ৭

কাজী আনোয়ার হোসেন

সাত

আরও কয়েকটা দিন পরের কথা।

ভোরেই উঠেছে সোহানা। হোটেল ছেড়ে অপূর্ব সুন্দর স্কোয়ার প্লেস ভেনডোমে এসে দাঁড়াল। মাথায় তার একটাই চিন্তা—এমন অদ্ভুত একটা জায়গায় কেন তাকে বুড়ো সকাল আটটার সময়ে দেখা করতে বলল? দেখা করতে অবশ্য বলেননি তিনি, আজ সকালে উঠে সে দেখে মেজর জেনারেল তাঁর ঘরে নেই—তার জন্যে কেবল একটা ছোট্ট নোট রয়েছে, তাতে লেখা, ‘লা স্যাত কুই সিফল’, সকাল আটটা পর্যন্ত থাকবেন তিনি সেখানে। আটটা বাজতে দেরি আছে—হাঁটতে হাঁটতে ঠিক করল সোহানা কিছু উইনডো শপিং করবে। রু-দু ফবর্গ সেন্ট অনর হয়ে রু ক্যাস্টিলিয়ন, বুলেভার্ড হাউসমান, বুলেভার্ড ব্যাটিনোল, বুলেভার্ড কুরেল ঘুরে আর্ক দ্য ট্রায়াম্প-এ এসে পৌঁছল সোহানা।

একটা বাস নিয়ে ক্লেবার এভিনিউ ধরে প্যালেস দ্য শাইলোতে এসে নামল। নদীর ধারে টাওয়ার পার হয়ে বুলেভার্ড গারিবালডি। ঘড়িতে দেখল পৌনে আটটা বাজে।

মিলিটারি স্কুলের পিছনে একটা ছোট রাস্তা ধরে এগিয়ে দেখতে পেল সে ‘লা স্যাত কুই সিফল’। মেহনতি মানুষদের জন্যে ছোট্ট একটা কাফে। প্রায় চার ভাগের তিনভাগ ভর্তি রয়েছে লোকের ভিড়ে—বেশির ভাগই শ্রমিক।

কোণের দিকে একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল সোহানা। একটা খবরের কাগজে প্রায় সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে বসে আছেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। সামনে কফির কাপ। প্রিয় ক্যাফেতে এরই জন্যে আসে বুড়ো সময় পেলেই। কফিটা সত্যিই ভাল।

‘বসো।’ কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বললেন রাহাত খান।

ও যে এসেছে তা কাগজ থেকে চোখ না সরিয়ে কি করে জানলেন উনি? অবাক হয়ে ভাবতে ভাবতে বসল সোহানা। ওয়েটার এসে দাঁড়াল সামনে। কফি আর ক্রয়সান্টের অর্ডার দিল সোহানা।

অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। ‘ভোর রাতে তোমাকে জাগাইনি—ভোর পাঁচটার দিকে খবর পেলাম ছয়টা ট্রাক আর হেলিকপ্টার নিয়ে ওরা রওনা হয়েছে। স্যাতোর ছাত থেকে অদৃশ্য হয়েছে লেজার গানটা।’ মেজর জেনারেল চুপ করলেন।

‘কোন্ দিকে যাচ্ছে?’

‘এইদিকেই। হেলিকপ্টারটা প্যারিসেরই কোথাও প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেছে স্যাতো-য়। ট্রাকগুলো এখনও এসে পৌঁছায়নি। রানাদের কোন খবর পেলে?

মাথা নাড়ল সোহানা।

‘আজ সকালেও আমি চেক করেছি—রানা বা রূপার কাছ থেকে কোন মেসেজই আসেনি। কোন বিপদ-আপদ হলো কিনা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রূপাকে যদি ওই ফ্রস্ট-ব্যাটা চিনে ফেলে থাকে…রানাও ঝাঁপিয়ে পড়বে রূপার বিপদে…পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে দুজনেরই…’

‘হুঁ, চলো হোটেলে ফিরব।’ অত্যন্ত গম্ভীর আর কঠিন দেখাচ্ছে মেজর জেনারেল রাহাত খানের মুখ।

বুলেভার্ড গারিবালডি হয়ে ডান হাতে মিলিটারি স্কুল পেরিয়ে ক্যাম্প দ্য মার্সে এল ওরা। সারা পথ কোন কথা বলেননি রাহাত খান। চুরুট ধরাবার জন্যে একটু থামলেন তিনি, এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে আইফেল টাওয়ারের দিকে তাকালেন।

টিচ্ আর লেপং ‘লা স্যাত কুই সিফলে দরজার ধারের টেবিলটা ছেড়ে রাস্তায় নামল। কিছুক্ষণ আগে রাহাত খান আর সোহানা যে পথ ধরে গেছে সেই একই পথে রওনা হলো ওরাও। অল্পক্ষণের মধ্যেই টাওয়ারের নিচে পৌঁছে গেল ওরা।

পাগলাটে ফরাসী ইঞ্জিনিয়ার গুস্তাভ আলেকজান্ডার আইফেল ১৮৮০ সালের শেষের দিকে আইফেল টাওয়ারের কাজ আরম্ভ করেন। দু’বছর কঠোর পরিশ্রম করে বিকট আকার অথচ সুন্দর এই টাওয়ারের ডিজাইন শেষ করেন।

প্রমাণ সাইজের ডিজাইন করতে আইফেল পাঁচ হাজার এক বর্গগজ কাগজের পাতা ব্যবহার করেছিলেন। প্রায় এক হাজার ফুট উঁচু জিরাফের মত দেখতে এই কাঠামোটা বানাতে পনেরো মিলিয়ন পাউন্ড ধাতু, বারো হাজার টুকরো লোহা আর আড়াই মিলিয়ন রিভেট লেগেছে।

১৮৮৯ সালের ১০ জুন ইংল্যান্ডের প্রিন্স বার্টি আনুষ্ঠানিক ভাবে এর উদ্বোধন করেন। আরও পরের দিকে অয়্যারলেস সম্পর্কে যখন ফলপ্রসূ কাজ চলছিল তখন আইফেল টাওয়ারকে রেডিও ব্রডকাস্টিং টাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

গুস্তাভ আইফেল নিশ্চয়ই এতটা কল্পনা করতে পারেননি যে তাঁর তৈরি এ টাওয়ার পরবর্তী কালে টেলিভিশন ট্র্যান্সমিটার হিসেবেও ব্যবহৃত হবে। নিঃসন্দেহে তিনি জেনে খুশি হতেন যে তাঁর ৯৮৪ ফুট ৬ ইঞ্চি টাওয়ার এখন রেডিও আর টেলিভিশন দুটোরই ট্র্যান্সমিটার হিসাবে কাজে লাগছে।

টিচ আর লেপং বেলুন বিক্রেতার পাশ কাটিয়ে টাওয়ারে উঠবার প্রবেশ পথের দিকে গেল। সকাল, ভিড় তাই পাতলা। বেলুন বিক্রেতা ডেভিড মোটামুটি ভালই ব্যবসা করছে। গ্যাস সিলিন্ডার সে আগেও ব্যবহার করেছে বলে অসুবিধে হচ্ছে না তার। একটা বেলুনে কিছুটা হাইড্রোজেন গ্যাস ভরে মন্ত্রমুগ্ধ ছোট্ট ডাচ মেয়েটার হাতে দিল ডেভিড।

‘ক্লিক!’ একটা দামী ক্যামেরার শাটার পড়ার শব্দ পাওয়া গেল। একটা সুন্দর কাটের হালকা স্যুট পরেছে কবির চৌধুরী—সাথে ম্যাচিং টাই রুমাল আর মোজা। নিজের লোকদের ধোঁকা লাগতে পারে মনে করে মুখের চেহারা আগেরটাই রেখেছে।

আর একটা ছবি তুলল সে। সেন্ট্রাল আর্কটার মধ্যে দিয়ে প্যানেল দ্য শাইলোর ছবি উঠে গেল তার ক্যামেরায়। ধীর পায়ে হেঁটে লিফটে চড়ল, লিফটের অন্য ধারে কথা বলছে রূপা আর ব্যারি। লিফট প্রথম ল্যান্ডিঙে পৌঁছতেই কবির চৌধুরী নেমে গেল।

ক্লিক করে একটা ছবি তুলল রবার্ট গোমেস। কনুই দুটো রেলিঙে ঠেকিয়ে নিয়েছে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে আইপীসের ভিতর দিয়ে চেয়ে আর একটা অর্থহীন স্যাপ নিল সে।

‘রেস্তোরাঁ লারোজ’ লেখা তিনটে বিশাল ট্রাক ধীরে গড়িয়ে এসে থামল টাওয়ারের নিচে। একটা সার্ভিস এলিভেটরের কাছে জায়গা মত পার্ক করা হলো। সাদা অ্যাপ্রন পরা শেফ নামল ট্রাক থেকে। আড়মোড়া ভেঙে বেলুন বিক্রেতাকে চোখ টিপে এগিয়ে গেল শেফের পোশাক পরা রানা। বাকি তিনটে ট্রাকও যোগ দিয়েছে আগের ট্রাকগুলোর সাথে।

টাওয়ার গার্ডদের একজন অফিস থেকে বেরিয়ে এসে কথা বলছে রানার সাথে। এদিকে একজন লোক লেগে গেছে মালপত্র নামানোর কাজে। দ্রুত কাজ চলছে—এরই মধ্যে অনেকগুলো ক্রেট, স্টীম বক্স, উজ্জ্বল রঙের বিয়ার ট্যাঙ্ক, স্টোভ, মাইক্রোওয়েভ আভ্—আরও কত কি।

গার্ড সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওই পাহাড় প্রমাণ জিনিসগুলোর দিকে চেয়ে দেখল। তারপর বলল, ‘বাক্স খুলে দেখাও ভেতরে কি আছে।’

‘কি!!’ আকাশ থেকে পড়ল রানা। একসেট কাগজপত্র সে গার্ডকে আগেই দেখিয়েছে। ওতেই সব ব্যাখ্যা করে বলা আছে। ‘আমাকে ক্রেট খুলে দেখাতে হবে? স্টীম বক্স খুলে দেখাতে হবে? আমার সুফের বারোটা বাজাতে চাও তুমি—আমার সসে ধুলো ফেলে নষ্ট করতে চাও?’ বকবক করেই চলল রানা।

রানাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে চাড় দিয়ে স্টীম বক্স খুলে দেখল গার্ড। একটা ক্রেট খুলে গার্ড দেখল কাঁচা রুটি সার বেঁধে সাজানো রয়েছে।

শেফের ভূমিকায় খুব ভাল ভাবেই উতরে গেল রানা। বারবার গালাগাল দিল গার্ডকে এভাবে ঢাকনা খুলে অপূর্ব স্বাদের খাবার নষ্ট করছে বলে।

ডেভিড বেলুন হাতে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা বেশ উপভোগ করল—মনে মনে রানাকে বাহবা না দিয়ে পারল না সে। রানার সাথে চোখাচোখি হতেই মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চাইল। গ্যাস বেলুনগুলো আরও শক্ত মুঠোয় ধরেছে—একটা হলুদ বেলুন হাত ফসকে ছুটে গেল। লাফিয়ে শূন্যে উঠে ওটাকে ধরার নি ́ল একটা চেষ্টা করল সে। না পেরে হাত ঝাঁকিয়ে হেলে দুলে শূন্যে উড়ে যাওয়া বেলুনটাকে শাসাল। পিটার উডককই কেবল পারে না—অ্যাটিং করতে আমিও পারি, ভাবল সে সন্তুষ্ট চিত্তে।

ক্রেটের সারির দিকে চেয়ে বুঝল গার্ড তার পক্ষে সবগুলো খুলে দেখা সম্ভব নয়। দু’একটা খুলেই সে রীতিমত উত্তেজিত করে ফেলেছে শেফকে। এরপর হয়তো কিল-ঘুসি মেরে বসবে। ও.কে করে দিল। রানা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার সঙ্গীদের নিয়ে লোডিং-এ।

ক্যামেরা ছেড়ে বিনকিউলার বের করেছে রবার্ট। গলায় ক্যামেরাটা ঝুলছে। প্রথমে ছুটে যাওয়া হলুদ বেলুনটাকে দেখল সে কিছুক্ষণ। এবার সীন নদীতে ভাসমান প্রমোদ তরীগুলোর দিকে চোখ গেল ওর। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নদীতে ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হয় এই সব বোটে। ট্যুর আইফেল ভেডেট; ছোট্ট বিরাশি সীটের কাঁচের ছাদওয়ালা জাহাজটা। টাওয়ারের কাছে পন্ট দিয়েনা থেকে কোয়াই মন্টেবেলো পর্যন্ত যাওয়া আসা করে ওটা। ‘বিউ মুচে ছাড়ে ডান পাড়ের পন্ট দিই আলমা থেকে। এটারই খোঁজ করছিল রবার্ট, এতক্ষণে দেখতে পেয়ে একটা সন্তুষ্টির হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটের কোণে।

সার্ভিস এলিভেটর এসে পৌঁছল গ্যালারিতে। কাজের মানুষের ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে রানার মধ্যে। মালপত্র সব রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে সরানো হচ্ছে ট্রলিতে করে। রেস্তোরাঁয় ঢুকেই রানা লক্ষ করল এক দল ফ্রেঞ্চ টেলিভিশনের লোক ক্যামেরা লাইটিং ইত্যাদি চেক করতে ব্যস্ত। কোন একটা নিউজ আইটেম কাভার করার জন্যে এসেছে ওরা।

এখনও রেলিঙের ধারেই দাঁড়িয়ে আছে কবির চৌধুরী। তবে এখন তার পাশে রয়েছে রবার্ট। এখনও চোখ থেকে বিনকিউলার নামায়নি। টাওয়ারের প্রবেশ পথে সাংবাদিকদের ভিড়টা লক্ষ করছে সে। দেখল ব্যারিও—কিছুক্ষণ আগে সে-ও গিয়েছিল নিচে—অপেক্ষা করছে সাংবাদিকদের সঙ্গে ওপরে ওঠার জন্যে।

কবির চৌধুরী মৃদু স্বরে রবার্টকে বলল, ‘সবাই জায়গা মত উপস্থিত হলে আমাকে জানিয়ো।’ মিনিট পাঁচেক পর রবার্ট জানাল, ‘অল প্রেজেন্ট। এইমাত্র সবাই যার যার জায়গা মত পজিশন নিয়েছে।’

পুলিস গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। আবার বিনকিউলারটা তুলে নিল রবার্ট। একটা লিমুজিন—সম্ভবত ফরাসী সরকারের সবচেয়ে ভাল আর দামী লিমুজিনটাই, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে টাওয়ারের দিকে। সামনে দু’জন সশস্ত্র পুলিস মোটর সাইকেলে লীড করছে—পিছনে আরও চারজন। ডপলার এফেক্ট অনুযায়ী সাইরেন এক পর্দা উপরে বাজছে। সাইরেন থেমে গেল। টাওয়ারের নিচে এসে থেমেছে ওরা সবাই।

গাড়ি থেকে একজন নামল। চারদিক একবার ভাল করে তদারক করে নিল সে। লোকটার কোটের নিচে বাম দিকটা যে উঁচু হয়ে ফুলে আছে তা নজর এড়াল না রবার্টের। সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট।

গাড়ির অন্য দিকের দরজা দিয়ে আর একজন এজেন্ট বের হলো। সেও তার সহকর্মীর মত সবাইকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এক নজর দেখে নিল। এবারে ওরা দু’জন দু’জনের দিকে চাইল। প্রথমজন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাতেই দ্বিতীয়জন বিনীত ভাবে গাড়ির দরজা খুলে ধরল। একজন লম্বা সুন্দরী মহিলা বের হলেন গাড়ি  থেকে—বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি।

রিসেপশন কমিটির চারজন অফিশিয়াল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে সামনে বাড়ল। একটা ভ্যান থেকে একজন নাদুসনুদুস ছোট্ট টাক মাথা লোক নেমে এল। সম্ভান্ত অতিথির দিকে চেয়ে, বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে ছোটখাট একটা বক্তৃতা আরম্ভ করল সে। ‘আজকে আপনার এই শুভ আগমনে আইফেল টাওয়ার ধন্য হয়েছে। আমরা সবাই আনন্দিত, সম্মানিত এবং কৃতজ্ঞ বোধ করছি। ফ্রান্সের শিশুদের রিলীফ ফান্ডের…’

কথার মাঝখানেই মিসেস লিনডা জোন্‌স্‌ বলে উঠলেন, ‘আহ্, মশিয়ে গার্ডিয়াস জেসন্। আপনার সাথে আবার মিলিত হতে পেরে, খুব খুশি হলাম। আপনারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এতে বরং আমিই নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করছি।’

মশিয়ে জেসন অপ্রস্তুত ভাবে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাল মিসেস জোনসকে। এগিয়ে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল টাওয়ারের লোকজন আর ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন্স রিলীফ ফান্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। স্বভাবজাত আভিজাত্যের সাথেই আলাপ করলেন মিসেস জোন্‌স সবার সাথে। কখনও বিশুদ্ধ ফরাসীতে আবার কখনও বা ইংরেজীতে—আমেরিকার পশ্চিম উপকূলীয় অ্যাকসেন্টে।

ফরাসী নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন তাদের চিরাচরিত পন্থায় ঘিরে রেখেছে সম্মানিত অতিথিকে। মিসেস জোন্স্ উপরে ওঠার সময়ে তারা ভাগ হয়ে গেল। গাড়িতে যে দু’জন ছিল তারাই কেবল রইল তাঁর সাথে।

টাওয়ার রেস্তোরাঁর নিয়মিত রাঁধুনী জোসেফ। তার সুষ্ঠু নেতৃত্বে রান্নাঘরে সব সময়েই নিয়ন্ত্রিত বিশৃ^লা বিরাজ করে। সে একেবারেই আশা করেনি আর একজন শেফ আজ তার রান্নাঘরে

হামলা চালাবে। শুধু তাই না, তার সাথে আবার দশ বারো জন সহকারীও রয়েছে। মাত্র আধ ঘণ্টা আগে তাকে নিচে থেকে টেলিফোন করে, ‘রেস্তোরাঁ লারোজ’-এর লোকজনের আসার কথা জানানো হয়েছে। ভাল খাবার সাপ্লাই করার জন্যে ওদের নাম আছে। রীতিমত বিখ্যাত ওরা সারা ফ্রান্সে আউট সাইড কেটারিং—এর জন্যে। কিন্তু তবু তার রান্নাঘরে এসে মাতব্বরি করবে ওরা এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না জোসেফ।

আড় চোখে লক্ষ করছে জোসেফ। রান্নার খবরদারি করছে রানা। এক সময়ে ভেংচি কেটে মন্তব্য করল জোসেফ, ‘ফুঁঃ, টিনের খাবার গরম করা আবার রান্না হলো?’

একলাফে জোসেফের দিকে ঘুরে দাঁড়াল রানা, ‘কি বললে? টিনের খাবার গরম করছি আমি?’ হাত নেড়ে সে স্টীম ওঠা বাক্সগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল, ‘ডিম সেদ্ধ করতে শিখেই শেফ হয়ে গেছ? আরে গাধা, এখানে গরম নয়, রান্না করা হচ্ছে চল্লিশ পদের বিভিন্ন ‘সুয়ে অউ ক্রিভেট দিমোল।’ আর এক দিকে দেখিয়ে বলল, ‘আর এখানে মডিউলেটেড় মাইক্রোওয়েভে ব্রেইজ্‌ করা হচ্ছে ট্রুফলে। তাও আবার ফাইন হার্বের সস ক্রনে অউ ব্যবহার করে—বুঝতে পারছ কিছু, নাকি এটুকু বিদ্যেও নেই পেটে?’

হাত দুটো চিত করে সামনে বাড়িয়ে কাঁধ দুটো উঁচিয়ে মুখ বিকৃত করল জোসেফ। একটা বাক্সে কি রান্না হচ্ছে দেখার জন্যে হাত বাড়াতেই হাতের ওপর চাঁটি খেল। ‘নে তসে পাস্।’ ছোট বাচ্চাকে শাসন করার মত করে ফ্রেঞ্চে জোসেফকে কিছু ছুঁতে বারণ করল রানা।

রেস্তোরাঁর ভিতরে সবাই অপেক্ষা করছে আজকের বিশেষ সম্মানিতা প্রধান অতিথির জন্যে। ফিসফিস করে ব্যারিকে কি যেন বলল কবির চৌধুরী। বাইরের করিডরে এসে ব্যারি সার্ভিস এলিভেটরটা আবার নিচে পাঠিয়ে দিল। টাওয়ারের নিচে একজন আইসক্রীমওয়ালা তার আইসক্রীমের বাক্সের ভিতর থেকে দুটো মেশিন পিস্তল বের করে একটা দিল ডেভিডের হাতে। মেশিন পিস্ত ল হাতে পেয়েই ঝড়ের বেগে ঢুকল সে টাওয়ারের গার্ড রূমে।

ডেভিডের পিস্তল দেখে গার্ড নিজের পিস্তল বের করার জন্যে হাত বাড়াল। কিন্তু তার আগেই ঘাড়ের কাছে পিস্তলের বাঁটের বাড়ি খেয়ে মেঝেতে নেতিয়ে পড়ল তার অচেতন দেহ। ওর অবস্থা দেখে অন্য গার্ডটা আর কোন বাহাদুরির চেষ্টা করল না। তাকে দিয়েই সার্ভিস এলিভেটরে অচেতন দেহটা বইয়ে নিয়ে উপরে ওঠার বোতাম টিপে দিল ডেভিড।

প্রধান লিফটটা এসে দাঁড়িয়েছে প্রথম লেভেলে। দরজা খুলতেই এজেন্ট দু’জন বেরিয়ে এল মিসেস জোকে পথ দেখাতে। ব্যারির অ্যামবুশটা এল অকস্মাৎ—খুবই নিষ্ঠুর আর নিৰ্মম।

ব্যারির প্রথম লাথিটা পড়ল প্রথম এজেন্টের দুই ঊরুর সংযোগ স্থলে। দ্বিতীয়জন চট করে পিস্তল বের করতে যাচ্ছিল—কিন্তু রবার্ট গোমেস ধরে ফেলল তার হাত। ব্যালে নাচের ভঙ্গিতে ঘুরে গেল ব্যারির শরীরটা—পিছন দিক থেকে প্রচণ্ড একটা লাথি পড়ল এজেন্টটার পেটে। দু’ভাঁজ হয়ে গেল হয়ে গেল। চপটা ঘাড়ের পিছনে পড়তেই ধরাশায়ী হলো।

পিছনের রান্নাঘরে রানা তখন জোসেফকে বলছে, ‘এইবার তোমার কৌতূহল মেটানোর সময় এসেছে। একটা বড় মত কেটারিং বাক্সের ওপর টোকা দিল সে। ‘দেখো কি রান্না হয়েছে।’ ঢাকনা খুলে শান্ত ভাবে নিজের লোকদের মধ্যে বিদঘুটে চেহারার এম এ-২৮ মাইসনার মেশিন পিস্তল আর থমসন সাব-মেশিনগান বিলি করল রানা। বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে জোসেফের।

কবির চৌধুরীর লোকজন ইতোমধ্যেই চাদরে ঢাকা ট্রলি রেঁস্তোরায় ঠেলে আনতে শুরু করেছে। চাদরের তলায় নানান যন্ত্রপাতি আর অস্ত্র। মিসেস জোস্-এর সামনে এগিয়ে এল কবির চৌধুরী। ‘গুড মর্নিং, মিসেস জোন্‌স্‌, আমি কবির চৌধুরী। ঠাণ্ডা নির্লিপ্ত গলায় বলল সে। ‘আমি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আপনি আমার হাতে আটকা পড়েছেন। লক্ষ্মী মেয়ের মত ওর,’ আঙুল দিয়ে রবার্ট গোমেসের দিকে দেখাল সে, ‘সাথে গেলে আমি গ্যারান্টি দিতে পারি আপনার কোন ক্ষতি করা হবে না।

কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন মিসেস জোস্ তার দিকে। ‘তুমি জানো, আমি কে?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

মাথা ঝাঁকাল কবির চৌধুরী। ‘যদি না জানতাম, তাহলে আপনাকে কিডন্যাপ করার জন্যে এত ঝামেলায় যেতাম না।’

কটমট করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকেই বললেন, ‘তুমি মনে কোরো না যে বোকার মত এই রকম একটা জঘন্য অপরাধ করে তুমি পার পেয়ে যাবে, এর মাশুল তোমাকে দিতেই হবে।’ রানা মনে মনে মিসেস জোনস-এর প্রশংসা না করে পারল না। সত্যি, এঁর মধ্যে সুরুচিসম্পন্ন একটা শক্ত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। পরনে অত্যন্ত সুন্দর দামী গাউন, পাকা চুলের গোছা ঢেউ খেলে খেলে নিচে নেমেছে। মুখে ভয়শূন্য উদ্ধত একটা অবজ্ঞা প্রকাশ পাচ্ছে।

‘ভি আই পি রূমেই আপনার সময় আরামের সাথে কাটবে। রবার্ট পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আপনাকে।’ বলল কবির চৌধুরী।

‘রূমটা আমি খুব ভাল করেই চিনি, তবে তুমি ওই রূমে প্রবেশ করার অধিকার কোনদিন পেয়েছ কি না সে সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’ কাটা কাটা ভাবে কথাগুলো শেষ করেই ঘুরে গটমট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন রেস্তোরাঁ থেকে ভি আই পি রূমের দিকে। রবার্ট ছুটল তাঁর পিছন পিছন

রেস্তোরাঁর কমান্ডোরা ছড়িয়ে পড়ে সব অতিথিদের বন্দুকের ডগায় এক কোণে জড়ো করেছে। ডেভিড আর আইসক্রীম বিক্রেতা পৌঁছল টাওয়ার গার্ডদের নিয়ে।

সেকেন্ড ল্যান্ডিঙে অন্যান্য কমান্ডোরা পিস্তল দেখিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেছে সব দর্শকদের। একজন গার্ড দৌড়ে গেল অ্যালার্ম বোতামের দিকে। কালাসনিকভের এক ঝাঁক গুলি ওর পিঠটা ঝাঁঝরা করে দিল।

‘কেউ নড়বে না! সাবধান করে দিল টিচ একটা ব্যাটারি সেট লাউড স্পীকারে। ‘কেউ হিরো হতে যেয়ো না, মারা পড়বে।’

রেস্তোরাঁর কিচেনে রানা ‘মাইক্রোওয়েভ আভন পি ৭৬৯৮৫২১ কুকফাস্ট’ লেখা কেটারিং ক্রেটটার তালা খুলল। ডেভিডকে ডেকে দু’জনে মিলে খুব সাবধানে তুলে আনল একটা চকচকে ল্যাপ লেজার।

ওদিকে সেকেন্ড গ্যালারির রেলিঙের ধারে তিনজনে ধরাধরি করে সমান সাবধানতার সাথেই টাওয়ারের পাশ দিয়ে রূপাকে উঠিয়ে দিল একটা লোহার পাতের ওপর। রূপা ওয়েল্ডিং মাস্ক পরা। একজন একটা এসিটিলিন টর্চ আর একটা শক্ত মত লোহার ব্রাকেট এগিয়ে দিল। কাজে লেগে গেল রূপা… তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারে বটে মেয়েটা।

লিন্ডা জোন্‌স্‌ ভি আই পি রূমে একটা মোটা গদিওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন, দু’হাতের আঙুল পরস্পরের সাথে আবদ্ধ। আঙুলের কাঁপুনি বন্ধ রাখবার জন্যেই হয়তো। দরজাটা বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছে রবার্ট। তাঁকে নিয়ে কবির চৌধুরী কি করবে কোন ধারণাই নেই তাঁর। সম্ভবত টাকা দাবি করবে তাঁর মুক্তির বিনিময়ে। তাঁর সন্দেহ হচ্ছে কবির চৌধুরী ভুল জায়গা বেছে নিয়েছে এই কাজের জন্যে। তাঁর সাথে সে-ও তো এখানে বন্দী। তাঁর মন বলছে আর চব্বিশ ঘণ্টাও আয়ু নেই তাঁর।

সেকেন্ড লেভেলের ট্যুরিস্টদের ফার্স্ট লেভেলে নিয়ে আসা হয়েছে। কবির চৌধুরী ব্যাটারি সেট লাউড স্পীকার তুলে নিল তাদের নির্দেশ দেয়ার জন্যে। ‘শোনো সবাই—আমি কবির চৌধুরী বলছি, তোমাদের সবাইকে নিরাপদে মুক্তি দেয়া হবে যদি তোমরা আতঙ্কিত না হয়ে আমার নির্দেশ মেনে চলো। একটু পরেই তোমাদের ছোট ছোট দলে লিফটে করে নিচে নিয়ে যাওয়া হবে আমার লোকজনের তত্ত্বাবধানে। নিচে পৌঁছেই তোমরা টাওয়ার এলাকা ছেড়ে দ্রুত সরে যাবে। যদি না যাও কঠিন বিপদ নেমে আসবে তোমাদের ওপর। এখন সবাই লিফটের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করো, যার যার পালা মত সবাইকেই নিচে পৌঁছে দেয়া হবে।

প্রথম আর দ্বিতীয় ল্যান্ডিঙের মাঝামাঝি এক জায়গায় অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে একটা বীমের ওপর বসে ওয়েল্ডিং করছে রূপা। কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্রথম ল্যান্ডিং থেকে দৃশ্যটা দেখে রানাকে ডাকল ডেভিড। কাছে আসতেই বলল, ‘ওই যে দেখো, সুজানা কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে।’ এক গোছা দড়ি কোমরে ঝুলিয়ে নিয়ে তরতর করে লোহার কাঠামো বেয়ে উঠে গেল রানা  রূপার কাছে। দড়ি নিচে ফেলতেই ল্যাপ লেজার গানটা বেঁধে দিল ডেভিড। রানা আর রূপা দু’জনে পরামর্শ করে ঠিক করে রেখেছিল অন্তত একটা ল্যাপ লেজার ওরা নিচে ফেলবে। একটা নষ্ট করতে পারলেও তাদের বাধা দেয়ার কাজে কিছুটা সুবিধা হবে। ধীরে ধীরে ল্যাপ লেজার উপরে উঠছে। কবির চৌধুরীর গলা শোনা গেল লাউড স্পীকারে। ‘কোন রকম ত্রুটি বিচ্যুতি সহ্য করব না কিন্তু আমি। লেজার গানের কোন ক্ষতি হলে যার যার নিজের ভুলের জন্যে তাদের ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী করা হবে। সাবধান করে দিচ্ছি আমি আগেই টিচ্, পিটার আর সুজানাকে।’

নিচে পুলিস আর লোকজনের একটা মাঝারি রকমের জটলা জমেছে। তারা সবাই বিশেষ মনোযোগের সাথে লক্ষ করল অদ্ভুত দেখতে একটা জিনিস ধীরে ধীরে রশি দিয়ে টেনে উপরে তোলা হচ্ছে।

টিচ্ তার ব্রাকেট ওয়েল্ডিং শেষ করে দড়ি নিচে ফেলতেই দ্বিতীয় লেজার গানটা বেঁধে দিল ডেভিড। ওপরে উঠে গেল সেটাও।

ওদিকে লেপং ব্যস্ত রয়েছে তার ট্রেনিং দেয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইলেকট্রিকাল কাজে। টাওয়ারের মেইন সাপ্লাই-এর তার আর অন্যান্য আরও অনেক তার নিয়ে ওরা কাজ করছে। স্যাতো ক্লারিনটে যেমন শিখেছে ঠিক তেমনি ভাবে। স্যাতোতে একজন একটা ভুল করেছিল কিন্তু এখানে সবাই নির্ভুল ভাবেই কাজ করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সম্পূর্ণ টাওয়ারের ইলেকট্রিক সাপ্লাই এসে গেল লেপং-এর নিয়ন্ত্রণে।

প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েকজন দ্রুত বেরিয়ে গেল টাওয়ার এলাকা ছেড়ে। ততক্ষণে অনেক পুলিস এসে গেছে ঘটনাস্থলে। কিছু এসেছে টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায়, আর বাকি পুলিস এসেছে মিসেস জোনসের গার্ড এজেন্ট দু’জন রুটিন রিপোর্ট পাঠায়নি বলে। ছাড়া পাওয়া কয়েকজন বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ফিরে চাইছে টাওয়ারটার দিকে। কেউ কেউ উত্তেজিত স্বরে জানাচ্ছে তাদের জান নিয়ে ফিরে আসার কথা। পুলিস অধীর ভাবে লিফটের বোতাম টিপে ধরে আছে—কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। টাওয়ারে এখন পুরোপুরি তার আধিপত্য কায়েম করেছে লেপং। সে একাই এখন টাওয়ারের একক লিফটম্যান।

স্টীল হেলমেট পরা দাঙ্গা-পুলিস হাজির হলো টাওয়ারের নিচে। মুক্তিপ্রাপ্ত ট্যুরিস্টদের কাছে ঘটনা জেনে নিয়ে প্রবেশ পথের দিকে এগুলো তারা। সিঁড়িপথে ছুটল তারা ওপরের দিকে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই টের পেল যে তাদের শীল্ড তাদের রক্ষা করতে পারছে না। শীল্ড ফুটো করে গায়ে লাগছে বুলেট। ছত্র ভঙ্গ হয়ে নিচে নেমে এল ওরা। নিহত দেহগুলো সিঁড়ির উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইল।

গোলাগুলির শব্দে কবির চৌধুরী মেইন লিফটের পাশে তার পোস্ট ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নেমে এল। লাউড স্পীকারে নির্দেশ দিল সিঁড়ি রক্ষীদের, ‘যত কম গোলাগুলি করে কাজ হাসিল করা যায় সে চেষ্টাই করো।

কমান্ডোদের মধ্যে কে একজন মন্তব্য করল, ‘সেটা আমাদের না বলে ওই দাঙ্গা পুলিসকে বলুন।’

মন্তব্যকারীর নাম জেনে নিল কবির চৌধুরী কমান্ডো চীফের কাছ থেকে। আদেশ দিল, ‘অপারেশন শেষ হলে ওকে গুলি করবে, ওর মেরুদণ্ডে। কিন্তু সাবধান, লক্ষ রেখো যেন ও মারা না পড়ে।’

দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে টাওয়ার। টেলিভিশনের লোক ছাড়া আর সবাইকে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

রানা আর রূপা তৃতীয় ল্যাপ লেজারটা তুলে ওয়েল্ডিং করে লাগিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। ওদিকে টিচ্ চতুর্থটার ওপর কাজ করে চলেছে। সবাইকে জড়ো করল কবির চৌধুরী লেভেল ওয়ানে। রবার্টকে এক বাক্স চাকতি দিল সে সবাইকে একটা করে দেয়ার জন্যে।

‘তোমরা জানো এগুলো কি,’ হাঁক ছেড়ে বলল রবার্ট। ‘এগুলো লেজার গান থেকে নিরাপদ থাকার ট্যাগ। আশা করি তোমাদের নতুন করে সাবধান করার দরকার নেই—কারণ তোমরা সবাই জানো এবং দেখেছ এটা সারাক্ষণ সাথে না রাখলে কি ঘটতে পারে। ল্যাপ লেজারগুলোকে কিছুক্ষণের মধ্যেই সচল করা হবে। টাওয়ারের একশো গজের মধ্যে যে কোন কিছু নড়বে, তাই ধ্বংস করবে ল্যাপ লেজার যদি তার সাথে এই ট্যাগ না থাকে!’

প্রথম ট্যাগটা কবির চৌধুরীকে দিল রবার্ট। ধন্যবাদ জানিয়ে গ্রহণ করল সেটা কবির চৌধুরী। বুক পকেটের সাথে ওটা গেঁথে নিয়ে বলল, ‘বিলি শেষ করে রেস্তোরাঁয় আমার সাথে দেখা করবে তুমি।’ রেস্তোরাঁয় ঢুকল সে। যাবার আগে নিজের লোকজন সবাইকে সাইপিং রেঞ্জের বাইরে থাকার নির্দেশ দিল।

টাওয়ার থেকে মুক্তি পাওয়া ট্যুরিস্টদের শেষ দলটা এগিয়ে গেল পুলিস বেষ্টনীর দিকে, জনতাকে ওখানেই আটকে রেখেছে পুলিস। অজস্র মানুষের ভিড় জমেছে এখন। পুলিসের পক্ষে এই ভিড় ঠেকিয়ে রাখা রীতিমত কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু আগেই মাইক্রোফোনে টাওয়ারের একশো গজের মধ্যে কাউকে আসতে নিষেধ করে ঘোষণা দিয়েছে কবির চৌধুরী; পুলিস সে ভাবেই এখন বেষ্টনী তৈরি করেছে। সেই বেষ্টনীর ভিতরে কোন কিছুই আর নড়াচড়া করছে না। রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কোন যানবাহন চলছে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রেস্তোরাঁয় কবির চৌধুরীকে খবর দিল লেপং, ল্যাপ লেজারগুলোকে এখন সক্রিয় করা হয়েছে। সুষ্ঠু ভাবে কাজ করছে সব কটা ল্যাপ লেজার

‘গুড,’ বলল কবির চৌধুরী। রেস্তোরাঁর ভিতরে ফরাসী টেলিভিশনের কর্মীদল আর কবির চৌধুরীর লোকজন ছাড়া আর কেউ নেই। টেলিভিশনের কর্মীরা কল্পনাও করতে পারেনি তাদের এমন এক নাটকীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে আজ।

অনেকগুলো বৈদ্যুতিক তার আনা হয়েছে রেস্তোরাঁর মধ্যে লেপঙের নির্দেশে। এখান থেকে লাইভ টেলিকাস্ট করতে ওগুলো কাজে লাগবে। সান্ধ্য বাদকদের মঞ্চে এখন একটা টেলিভিশন মনিটর শোভা পাচ্ছে। রিস্টওয়াচটা একবার দেখে নিল কবির চৌধুরী। সবই তার প্ল্যান অনুযায়ী এগোচ্ছে। নিউজের ক্যামেরাম্যানদের ডাকল কবির চৌধুরী। কন্টিনেন্টাল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের মত এরাও পুরানো জিনিস ছেড়ে আজকাল ই.এন.জি. (ইলেকট্রনিক নিউজ গ্যাদারিং) ব্যবহার করছে।

‘তোমরা ই.এন.জি. ক্যামেরা ব্যবহার করে আমার নির্দেশ মত ফরাসী টেলিভিশনে সরাসরি এখানকার দৃশ্য দেখাবে। ঠিক আছে?’ সম্মতি চাইল কবির চৌধুরী টিভি কর্মীদের।

‘অবশ্যই—পাঁচশোবার।’ জবাব দিল চীফ ক্যামেরাম্যান। একটু যেন বেশি উৎসাহ লোকটার। ভয়ে? না নাম কিনবার আশায়?

‘আমার কথা মত না চললে কি ঘটবে সেটা নিশ্চয়ই নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না তোমাদের?’ জিজ্ঞেস করল সে।

‘না স্যার, আমার দুঃসাহসী হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই। আপনার কথামতই সব কাজ হবে। শুধু কি করতে হবে আদেশ করুন।

মনে মনে খুশিই হলো কবির চৌধুরী। মুখে বলল, ঠিক আছে—প্রস্তুত হও তবে।

‘স্যার, কি করতে হবে আমাকে আগে একটু বুঝিয়ে দিন।

‘আমি সারা দুনিয়াকে জানাতে চাই যে আইফেল টাওয়ার দখল করে নিয়েছি আমি, আর জিম্মি রেখেছি মার্কিন প্রেসিডেন্টের মাকে। আর কিছু জানবার আছে তোমার?’ প্রশ্ন করল কবির চৌধুরী।

‘না, স্যার। আমি সব ব্যবস্থা করছি।’ ত্বরিত জবাব দিল টি ভি ক্যামেরাম্যান। ব্যাপারটা বুঝে গেছে সে। মরে যাওয়ার ইচ্ছে তার নেই।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন