জিম্মি – ১১

কাজী আনোয়ার হোসেন

এগারো

টেলিফোন রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন মশিয়ে পম্পেদু।

‘কি—নতুন কোন খবর আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন রাহাত খান। ‘হ্যাঁ, একশো প্যারাট্রুপার নামানো হয়েছিল স্যাতোয়। জায়গাটা এখন আমাদের দখলে।’ জবাব দিলেন পম্পেদু।

‘আর পাইলট? হেলিকপ্টার পাইলটের কি খবর?’

‘তাকেও পাওয়া গেছে। কবির চৌধুরীকে নাকি তার সীন নদীর একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে তুলে নেয়ার কথা আছে।’

‘সীন নদী থেকে?’ একটু অবাক হলেন মেজর জেনারেল। ‘ঠিক কোথায়?’

‘এখান থেকে প্রায় মাইল খানেক দূরে—স্ট্যাচু অভ লিবার্টি আর নোতরদাম চার্চের মাঝামাঝি একটা জায়গা।’

কবির চৌধুরী ওখানে পৌঁছবে কিভাবে? কোন টানেল বা প্যাসেজ নেই ওই টাওয়ারের তলায়। লেজারগুলো যদি সক্রিয় থাকেও নদী পর্যন্ত কবির চৌধুরীকে কাভার দিতে পারবে না—রেঞ্জের বাইরে বের হলেই গুলি খাবে সে—তাহলে? কিছু একটা নজর এড়িয়ে যাচ্ছে রাহাত খানের। কিভাবে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে টাওয়ার ছেড়ে পালাবে কবির চৌধুরী? প্ল্যান নিশ্চয়ই একটা আছে তার। পালাবার পথ না দেখে এতবড় একটা কাজে হাত দেয়ার মত কাঁচা লোক সে নয়। কিন্তু কি সেই পথ?

.

মাটি থেকে চল্লিশ ফুটের মত ওপরে থাকতেই রশি ফুরিয়ে গেল। পিঠের বোঝাটা একটু নেড়ে চেড়ে ঠিক করে নিল রানা—মিসেস জোনস গলা জড়িয়ে ধরায় দম আটকে আসতে চাইছে তার। বলল, ‘শক্ত করে ধরে থাকুন—প^ীরাজ কিন্তু উড়বে এখন। মিসেস জোনসকে রসিকতার সুরেই সাবধান করল রানা। ‘দড়ি শেষ, লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে হবে এখন থেকে।’

উপর থেকে ট্রেস করে চলেছে ওদের ল্যাপ লেজার। ইঁদুরের কানের মত জিনিস দুটো একটু একটু নড়ছে। ল্যাপ লেজার কমপিউটর খুব সতর্কতার সাথে নজরে রাখছে ধীরে নিচে নেমে যাওয়া অদ্ভুত আকৃতির বস্তুটাকে।

চোখ জ্বালা করছে রানার…এক ফোঁটা ঘাম গেছে চোখে। কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে জ্বালাটা কমিয়ে নিল সে। এবার সাবধানে কোণাকুণি নেমে যাওয়া লোহার পাতটা বেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে আর এক ধাপ নিচে নামল। আবারও একই ভাবে নামল আরও এক ধাপ।

এখন দুটো ল্যাপ লেজার ওদের ট্রেস করছে। রানার সাথে সাথে নড়ছে লেজার গান দুটো—সব সময়েই পাল্লার মধ্যে রেখেছে তাকে।

ক্লান্ত হয়ে আসছে রানার হাত পা কিন্তু থামার উপায় নেই। রীতিমত টনটন করছে সবকটা পেশী। মিসেস জোনসকে পিঠ থেকে নামিয়ে একটু জিরিয়ে নেবে, সে পথও খোলা নেই—মিসেস জোনসের সাথে ছাড়াছাড়ি হলেই ল্যাপ লেজারের আক্রমণ হবে ট্যাগবিহীন রানার ওপর। তাহলে দু’জনেই মরবে ওরা—বদ্ধার পক্ষে নিজের চেষ্টায় নিচে নামা একেবারেই অসম্ভব। হয়তো কিছুক্ষণ টিকতে পারবেন গার্ডার ধরে—কিন্তু তাঁর পক্ষে কতক্ষণ আর শূন্যে ঝোলা সম্ভব?

চিৎকার করে মিসেস জোনসকে আঁকড়ে ধরে থাকতে বলেই ধনুকের মত বাঁকা হয়ে লাফ দিল রানা। প্রায় আট ফুট দূরের একটা বীম চেপে ধরল সে—হাতের পেশী আর কাঁধের মাসলে প্রচণ্ড চাপ পড়ল দু’জনের ভার সামলাতে। লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে নামছে এবার রানা—আর দুটো বাকি। আবার একটা লাফ। এর পরেই পিচের রাস্তার ওপর পড়ল ওরা।

‘আমরা সত্যিই নিচে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছি?’ অবাক বিস্ময়ে বললেন মিসেস জোনস। ‘তোমার পিঠে চড়ে এতটা পথ নেমেছি আমি!’

‘সত্যিই তাই—তবে বললে কেউই বিশ্বাস করবে না আমাদের কথা।’ হাসতে হাসতে বলল রানা। ‘এখন আর একটা বিপদের মোকাবেলা করতে হবে।’ নিজের ট্যাগটা হারানোর কথা খুলে বলল সে। ‘আমাদের দু’জনের কাছে এখন রয়েছে শুধু একটা ট্যাগ। নিচে নামার সময় একটা ট্যাগেই কাজ চলেছে বটে—কিন্তু এখন সমান জমির ওপর দিয়ে হাঁটার সময় ল্যাপ লেজার কেমন ব্যবহার করবে তা একেবারেই অনিশ্চিত। ঝুঁকি নিতে হবে—এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কবির চৌধুরীর লোকের হাতে ধরা পড়ার কোন মানেই হয় না। আপনি কি বলেন?’

‘টেলিভিশনে তখন আমি যা বলেছি সে-কথাগুলোই আবার বলব—অনেক বয়স হয়েছে আমার, মৃত্যু-ভয় আমাকে আর সাজে না। ওই যন্ত্রগুলো যদি আমাদের জীবন নাশ করে, এটুকু সান্ত্বনা আমাদের থাকবে যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে, একজন সাহসী ব্যক্তির সাথে মরার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।’

দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে রওনা হলো আবার। সেফটি ট্যাগটা দু’জনেই ধরেছে মাথার ওপর।

টাওয়ার থেকে দূরে সরে যেতে যেতে ওপরের দিকে চাইল রানা। দেখল তাদের সাথে সাথে ল্যাপ লেজারের নলটাও ঘুরছে।

কমপিউটরের কন্ট্রোল বোর্ড থেকে লেপং উত্তেজিত ভাবে কবির চৌধুরীকে রিপোর্ট করল, ‘ল্যাপ লেজার কাকে যেন ট্রেস করছে—নিচে মাটিতে। টাওয়ার ছেড়ে দূরে সরে যাচ্ছে বড়সড় কিছু একটা।’

‘সার্চলাইট, ডেভিড!’ হুঙ্কার ছাড়ল কবির চৌধুরী। গ্যালারিতে এসে দাঁড়িয়েছে সে। হঠাৎ আলোয় ভেসে গেল জায়গাটা। রবার্টের চিৎকার শুনতে পেল রানা। চিৎকার করে কবির চৌধুরীকে জানাচ্ছে তাদের পলায়ন প্রচেষ্টার কথা।

দাগের ওপাশ থেকেও আলো এসে পড়েছে রানাদের ওপর। খুশিতে চকচক করছে মেজর জেনারেলের চোখ। আর কয়েক পা এগোতে পারলেই দাগ পেরিয়ে যাবে ওরা।

‘লেজার গান ফায়ার করছে না কেন?’ দাবড়ানি দিল কবির চৌধুরী লেপংকে।

‘ওদের কাছে সেফটি ট্যাগ আছে, স্যার,’ জবাব দিল লেপং। ওরা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে কালানিকভটা তুলে নিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ল রবার্ট ওদের লক্ষ্য করে। সেফটি ট্যাগবিহীন চলন্ত টারগেট চিনে তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হলো লেজার ব্যারেল। ঘন কালো লেজার বীম এক এক করে সব কটা বুলেট ধ্বংস করল নিপুণ ভাবে।

‘থামো!’ ধমক দিল কবির চৌধুরী। কিংকর্তব্য ভেবে নিয়েছে সে ইতোমধ্যেই। ‘ওরা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। গুলি করে নিজের বোকামি প্রকাশ কোরো না। সার্চলাইট নিভিয়ে সবাই ভেতরে চলো—অনেক কাজ এখনও বাকি।’

দাগ পেরিয়েও মিসেস জোনস রানাকে জড়িয়ে ধরে থাকলেন। আবেগে ফোঁপাতে ফোঁপাতে রানার গালে কপালে চিবুকে আদর করে চুমো খেলেন তিনি।

মেজর জেনারেলের সঙ্গে পরিচয়-পর্ব শেষ হলে মিসেস জোনস বললেন, ‘আমাকে নিরাপদে উদ্ধারের ব্যবস্থা করায় আমি কৃতজ্ঞ। টাওয়ার থেকে আমাকে প^ীরাজ ঘোড়ার মত পিঠে করে নামিয়ে আনার জন্যে এই দুঃসাহসী ছেলেটার কাছে আমি আরও বেশি কৃতজ্ঞ।’

‘আপনি নিরাপদ আছেন, সেটাই বড় কথা,’ বললেন রাহাত খান।

মিসেস জোনস একটু হাসলেন। বললেন, ‘আমার বয়স হয়েছে, একদিন মরতে হবে, সেটা এমন কিছু বড় কথা নয়; আসল কথা হচ্ছে ওই বর্বর নিষ্ঠুর লোকটার শাস্তির ব্যবস্থা হওয়া উচিত।’ বলতে বলতে দৃঢ় হয়ে এল তাঁর কণ্ঠস্বর।

‘হবে, শাস্তি ওকে অবশ্যই পেতে হবে।’ আশ্বাস দিলেন রাহাত খান। ‘এখন আপনার জন্য…

‘হ্যাঁ, আমার জন্যে এখন চাই সানের ব্যবস্থা, কিছু খাবার, আর একটা কড়া ড্রিঙ্ক। কিন্তু তার আগে আমি আমার ছেলের সাথে কথা বলতে চাই।’

‘লাইন ধরে আছেন তিনি।’

কমিউনিকেশন ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হলো মিসেস জোনসকে।

ভ্যানের এক কোণে একটা রঙিন টেলিভিশন সেট বসানো হয়েছে। মিসেস জোনসকে হারিয়ে এখন টাকা আদায়ের নতুন কোন পন্থা ঘোষণা করতে পারে কবির চৌধুরী। তাই শব্দ কমিয়ে অন রাখা হয়েছে টেলিভিশন।

ভ্যানের গায়ে টোকা পড়ল—আমন্ত্রণ জানানোর আগেই ভিতরে ঢুকলেন জেনারেল ব্রুনো। কাঁধ উঁচিয়ে হাত উল্টে তাঁর নিজস্ব বিশেষ ভঙ্গিতে বললেন, ‘মশিয়ে, এইবার কি আমি টাওয়ার আক্রমণ করতে পারি?’

‘জেনারেল ব্রুনো! খুব ঝট্‌পট্ কাজ দেখিয়েছে আপনার লোকজন স্যাতোয়। তবে আপনার প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, না। কোনমতেই টাওয়ার আক্রমণ করা চলবে না। আমাদের আরও দু’জন লোক কাজ করছে ওখানে—আমার বিশ্বাস ওরাই ব্যাপারটার একটা শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি করতে পারবে।’

আরও কি বলতে যাচ্ছিলেন মেজর জেনারেল—কিন্তু তার আগেই মশিয়ে পম্পেদু হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলে টেলিভিশনের আওয়াজ বাড়িয়ে দিলেন। কবির চৌধুরীর মুখ দেখা গেল পর্দায়।

‘ফ্রান্সের সবাইকে শুভ সন্ধ্যা জানাচ্ছি।’ বলতে শুরু করল কবির চৌধুরী। চোখে তার অদ্ভুত ধরনের একটা চশমা। ‘দুঃখিত আমি, আমাকে আবার আপনাদের সান্ধ্য আনন্দে বাদ সাধতে হচ্ছে। ইন্টিরিয়র মিনিস্টার মশিয়ে পম্পেদু আর মেজর জেনারেল রাহাত খানের জন্যে কিছু খবর আছে বলেই বিরক্ত করতে হচ্ছে আপনাদের।’

কথাগুলোতে বোমার মতই কাজ হবে, জানে কবির চৌধুরী। ভ্যানের ভিতর পরিস্থিতি এখন তড়িৎস্পৃষ্ট।

‘মশিয়ে পম্পেদু এবং ফ্রান্সের সবাইকে জানাচ্ছি আমার আন্ত রিক ধন্যবাদ। তাঁদের দেয়া এই তিরিশ মিলিয়ন ডলার চাঁদা আমার বিশেষ কাজে আসবে। যাঁরা টেলিভিশন দেখছেন তাঁদের অনেকেই হয়তো জানেন না যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মা মিসেস লিন্ডা জোনস টাওয়ার ছেড়ে চলে গেছেন।

‘অবশ্য সব সময়েই আমি মিসেস জোনসের নিরাপদ বিদায়ের পক্ষপাতী ছিলাম। আমার কথামত চললে আমার কাছ থেকে তাঁর বিদায় এতটা বিপদ সঙ্কুল হত না।

‘আমি খুশি হয়েছি যে মেজর জেনারেল রাহাত খানের লোক পিটার উডকক ওরফে মাসুদ রানা, ফিরতে সক্ষম হয়েছে—কিন্তু তাঁর অন্যান্য লোকের হয়তো সে সৌভাগ্য না-ও হতে পারে।

একটু কুঁচকাল মেজর জেনারেলের ভুরু। তবে কি রূপা আর ডেভিড ধরা পড়ে গেছে? মেরে ফেলেছে কবির চৌধুরী ওদের?

‘নির্ঘাত ব্লাফ দিচ্ছে ও!’ রাহাত খানের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে মন্তব্য করলেন পম্পেদু।

‘আপনারা অনেকেই ভাবছেন আমার চোখে লাগানো—কিছুটা চশমার মত দেখতে—জিনিসটা কি? আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি এটা আমারই আবিষ্কার। একটা বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে আমার চোখের ক্ষতি হয়—কিন্তু আমার এই যন্ত্রের সাহায্যে যে কোন মানুষের চেয়ে দশগুণ বেশি দেখতে সক্ষম আমি এখন। দুঃখের বিষয় লেনটা ফিট করতে একটা দিন দেরি হয়ে গেছে আমার—সেই সুযোগে পালিয়েছে মাসুদ রানা। কিন্তু আমার প্রশ্ন, কতদিনের জন্যে?

‘অপ্রত্যাশিত ঘটনাচক্রে আমার প্ল্যান কিছুটা পাল্টাতে হচ্ছে। আগের কয়েকবারের মত এবারও রানা বাদ সেধেছে আমার কাজে—ফলে বিশ বিলিয়ন ডলার আমি আপাতত পাচ্ছি না বটে, তবে ওটা আমি ভবিষ্যতে আদায় করবই।’

ঘড়ি দেখল কবির চৌধুরী। স্পনেরো মিনিটের মধ্যে আমি আর আমার সঙ্গীরা আইফেল টাওয়ার ছেড়ে যাচ্ছি। আমার শখের স্যাতো আমি ফরাসী সরকারকে দান করে দিয়ে যাচ্ছি—তবে আমার প্ল্যানে বাধা সৃষ্টি করার শাস্তি স্বরূপ আইফেল টাওয়ারটা আমার চলে যাওয়ার ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই ধ্বংস হবে। আপনাদের সবাইকে শুভ রাত্রি জানিয়ে আমি এখন বিদায় নিচ্ছি।’ নাটকীয় ভাবে শেষ করল কবির চৌধুরী তার বক্তব্য।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন